অনেক সাধনার পরে পর্ব-১২+১৩

0
299

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[১২]

সারাটা দিন ভার্সিটিতে কাটিয়ে দুপুরের শেষ ভাগে বাসায় ফিরলো মিতালী। চোখে-মুখে তার স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। আজ যা গরম পরেছে। গায়ের চামড়া বোধহয় জ্বলে শেষ হয়ে গেছে। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে মিতালী। সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশ ছিলো বিধায় খোলা চুলে বেড়িয়ে ছিলো। কিন্তু অতিরিক্ত গরমের কারনে খোলা রাখতে পারেনি আর। ব্যাগ থেকে ব্যান্ড বের করে বেধে ফেলেছে। চুল একদম ঘেমে আছে যার কারনে মাথা এখন ভীষণ ব্যাথা করছে। বাসায় এসে একদফা চমকে উঠলো মিতালী। অবাক হলো ভীষণ।

‘তুই এখানে?’

সোফায় বসে থাকা মনিরার উদ্দেশ্যে বললো কথাটি। মনিরা ও শেফালী সোফায় বসে কথা বলছিলো। মিতালীর কথা শুনে মনিরা উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে এসেছে মিতালীর হাত ধরে বললো, ‘কখন থেকে তোর জন্য ওয়েট করছি আমি। যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। কথা আছে।’

বিলম্ব করলো না মিতালী। সম্মতি দিয়ে তড়িৎ বেগে রুমে চলে গেলো। চটজলদি আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে পা বাড়ালো। শেফালীকে নিয়ে মনিরা মিতালীর রুমের বারান্দায় গিয়ে বেতের মোড়ায় বসলো। হাতে দুজনের কোল্ড কফির কাপ। আমেনা তাদের কফি কিংবা চা বানিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু বাধ সাধলো শেফালী। এই অসয্য গরমে নাকি আবার গরম কফি? এমনিতেই গায়ের চামড়া জ্বালা-পালায় শেষ। কফি খেলে তো ভিতর টাও শেষ হয়ে যাবে। তাই শেফালী নিজ হাতে কোল্ড কফি বানিয়েছে। মিতালীর কাপটা পাশে টেবিলে রেখে নিজেদের টা খাচ্ছে দুজন।

‘তো এক্সামের পর কি করবে?’

কফির কাপে ছোট চুমুক বসিয়ে প্রশ্ন করলো মনিরা। পরনে তার গোলাপি কুর্তি। রিবর্ডিং করা চুল গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। চোখেমুখে তার লাবণ্যতা। ভীষণ মিষ্টি লাগছে দেখতে। পাশের বেতের মোড়ায় দুই পা তুলে বসে ছিলো শেফালী। কালো টি-শার্ট টা কোমড়ে কাছে গিট্টু দেওয়া। সে সাথে সাথে মনিরার কথার প্রতিত্তুর করলো, ‘উত্তরা চলে যাবো। মার্চেন্ডাইজিং এ ভর্তি হবো সেখানে।’

‘ওহহো ভালো তো। আঙ্কেলের অর্ধেক টাকা সেখানেই গায়েব হয়ে যাবে।’

‘ব্যাপার না। আমি সেখান থেকে বের হলে তার থেকেও বেশি ইনকাম করবো।

‘তা পাবলিকে ট্রাই করবে না?’

‘না। আমি শুধু এই জিনিসটাতেই ফোকাস করবো। তাহলে আমার জন্য সহজ হবে। যেহেতু আমি মার্চেন্ডাইজিং’এ যাবো ফাইনাল সেহেতু এইদিকেই ফোকাস করলে ভালো হবে। পাবলিকে যাবার ইচ্ছে নেই তাই চাপ নিচ্ছি না।’

‘তা অবশ্য ঠিক বলেছো।’

‘হুম। দেখবে একদিন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন ডিজাইনার হবো। ইনশাআল্লাহ।’ উল্লাসিত কন্ঠে বললো শেফালী। চোখে মুখে তার অগাত স্বপ্ন। ঠোঁটে মৃদু হাসি। মনিরা দেখলো তাকে। মুচকি হেসে বললো, ‘বাহ্! কনফিডেন্স থাকা ভালো। পারবে ইনশাআল্লাহ দোয়া রইলো।’ বিনীময়ে শেফালী মুচকি হাসলো শুধু।
.

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে। মৃদু বাতাসে বারান্দায় টবে ঝুলানো বেবি টিয়ার্স গুলো নড়বড়ে। সেগুলোর দিকেই তাকিয়ে আছে মনিরা। অপেক্ষা করছে মিতালীর। দীর্ঘসময় লাগিয়ে তৈরি হয়ে বারান্দায় আসলো মিতালী। পাশে বসে কথার আলাপ জুড়ে দিলো। তিনজন মিলে বেশ ভালোই আড্ডা দিয়ে সময়টা পার করলো। সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগে মিতালীর বাবা বাসায় আসলেন। তখন মনিরা পরিবারের সবাইকে তার বিয়ের দাওয়াত দিলো। আগামী মাসের দুই তারিখ বিয়ে।প্রসন্ন হলেন জুলফিকার ও আমেনা। দুইজনই মনিরার জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর মনিরা সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
.

রাত্রীর মধ্যভাগের সময়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। চারপাশে পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। চাঁদের জ্যোৎস্নায় মুখরিত চারপাশ। বারান্দায় কার্নিশ ঘেঁষে পরেছে চাঁদের ঝলমলে আলোকরশ্মি। বিষন্নতায় ছেঁয়ে আছে মিতালীর মন। ক্ষুন্ন মনে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। একমনে তাকিয়ে আছে রাত্রীর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তায়। সোডিয়ামের ঝাপসা আলোতে পিচ ঢালা কালো কুচকুচে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে একটা ব্যথিত কুকুর বসে ঘুমাচ্ছে। রাতের আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিতালী। সন্ধ্যা রাতের পর থেকে মনটা বিষন্নতায় ভরে আছে। দাদীর কূটক্তি বরাবরই বিষাদ লাগে তার। আজও তাই শুনতে হয়েছে। কারন একটাই। সেটা হলো বিয়ে! মিতালীর বান্ধুবি মনিরার বিয়ে হবে কিছুদিন পর অথচ তার আদৌ কোনো খবর নেই। সব মিলিয়ে তাকে কিছু কথা শুনিয়েছে জুলেখা বেগম। সেকারণেই ক্ষুন্ন হয়ে আছে মিতালীর মন। ভালো লাগছে না কিছু। একদম না! হঠাৎ মোবাইলের ম্যাসেজের কর্কষ ধ্বনির আওয়াজে ধ্যান ভাঙ্গলো তার। সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মোবাইলের দিকে তাকালো। দেখলো অংকুরের একটা ম্যাসেজ।

‘ম্যাডাম? আপনার কথা ভেবে যে কেউ একজন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। সেই খেয়াল কি আপনার আছে?’

অংকুরের দেওয়া ম্যাসেজ টা পড়ে আলতো করে হেসে ফেললো মিতালী। ছেলেটা ভারী অদ্ভুত তো। এতো রাতে জেগে আছে আবার বলছে তার কথা ভাবছে। হাসি পেলো মিতালীর। এতোক্ষনে বিষন্নতায় ছেঁয়ে থাকা মনটা এখন ফুরফুরে হয়ে গেলো। সম্পূর্ণ নিজের অজান্তে। আবারো আরেকটা ম্যাসেজ আসলো।

‘জেগে আছো? কল দিতে পারবো এখন?’

দ্বিতীয় ম্যাসেজটা পড়ে এবার ঠোঁট প্রসারিত করে নিঃশব্দে হেসে ফেললো মিতালী। কাল পারমিশন ছাড়া কল দেওয়ার কারনে রেগে গিয়েছিলো সে। তাই আজ পারমিশন চাচ্ছে। ব্যাপারটা কিউট লাগলো মিতালীর কাছে। রিপ্লাই করলো না। ঠোঁটে স্মিতি হাসি রেখেই বেতের মোড়ায় বসলো। খোলা চুল গুলো দুই হাতের সাহায্যে খোঁপা করে নিলো। তারপর দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো। হঠাৎ দখিনা বাতাসের দমকা হাওয়ার শীতলতা ভয়ে গেলো মনে। মৃদু বাতাসে চুল, কাপড় গুলো উড়ছে। ঠোঁটে স্মিতি হাসি রেখেই ভাবতে লাগলো অংকুরের কথা। ছেলেটা এতো অদ্ভুত কেন? ব্যবহার যেমন অদ্ভুত; কথাবার্তাও অদ্ভুত।

আবারো মোবাইলের কর্কষ কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো। তবে এবার ম্যাসেজ নয় বরং কল। অংকুর কল দিয়েছে। অবাক হলো মিতালী। এক মুহূর্তও দেড়ি না করে কল রিসিভ করলো সে। কানে দেওয়ার পর অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো অংকুরের কণ্ঠস্বর।

‘এখনো ঘুমাও নি?’

‘কেন ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো নাকি?’ মিতালীর কথার পিঠে কথা। স্মিতি হাসলো অংকুর। হাসির শব্দ মৃদু হলেও মোবাইলের এপাশ থেকে শুনতে পেয়েছে মিতালী। অংকুর বললো, ‘তেমন কোনো কথা ছিলো না। যাইহোক না ঘুমিয়ে ভালোই করেছো। এবার চুটিয়ে প্রেম ইয়ে… মানে কথা বলা যাবে আরকি।’

কথাটা বলে নিজের মাথায় নিজেই চাপড় বসালো অংকুর। বিরক্ত হলো নিজের উপর। বিড়বিড় করে বলে উঠলো ‘কন্ট্রোল ইউর মাউথ অংকুর! কন্ট্রোল!’

পুরুষ মানুষ হয়তো আস্তে কথা বলতে পারে না। তাদের কণ্ঠস্বর থাকে মোটা যা দূর থেকেও শুনা যায়। অংকুরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তার বিড়বিড় করে বলা কথাটা সম্পূর্ণই কর্ণপাত হয়েছে মিতালীর। প্রচুর হাসি পেলো তার। খিলখিল করে হেসে উঠলো সে। হাসির কারনে চোখমুখ খিঁচে আছে তার। মৃদু হাসলো অংকুর। তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তোমার হাসিটা অনেক সুন্দর মিতালী। বারবার প্রেমে পরতে বাধ্য করবে।’

আপনা আপনি ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে এলো মিতালীর। মুখের হাসিটা তাৎক্ষনাৎ মিলিয়ে গেলো তার। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হলো তার। সন্দেহ হলো প্রচুর। চকচকিয়ে তাকালো সে। অস্থির মনে প্রশ্ন করে বসলো, ‘আপনি কি করে দেখলেন? কোথায় আপনি?’

হকচকিয়ে উঠলো অংকুর। কান থেকে মোবাইল দূরে সরিয়ে চোখ বন্ধ করে খিঁচে ‘ড্যাম’ বললো। ফুঁশ করে নিশ্বাস ফেলে শান্ত করলো নিজেকে। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে বলল, ‘আমি দেখবো কিভাবে আজিব। আমি তো শুধু তোমার হাসির আওয়াজ শুনে বলেছি। হাহা! আচ্ছা দুপুরে কি দিয়ে ভাত খেয়েছো?’

কথার প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য বললো অংকুর। এই মুহূর্তে কি বলা উচিত তার বুঝে আসছে না। তাই মাথায় যা এসেছে তাই বলে দিয়েছে। কিন্তু অপর প্রান্তে প্রচন্ড সন্দেহপ্রবন হলো মিতালীর মন। এখন অব্ধি ভ্রুঁ কুঁচকে রইলো তার। কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ। সন্দেহের খাতা রেখেই উত্তর দিলো, ‘লাউ তরকারি, মুরগীর মাংস আর ডাল।’

‘ওহ’ ছোট করে বললো অংকুর। বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেলো না সে। তাই নিরবতা নেমে এলো দুজনের মাঝে।ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো কি বলবে সে। মিতালী কানে মোবাইল রেখে বসে আছে। অপেক্ষা করছে অংকুর কিছু বলার। দশ সেকেন্ড, ত্রিশ সেকেন্ড, এক মিনিট, দুই মিনিট! এতোটা সময় দুজন নিশ্চুপ ছিল। কানে মোবাইল রেখেই একে অপরে নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে বোধহয়।

চলমান..

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[১৩]

দশ সেকেন্ড, ত্রিশ সেকেন্ড, এক মিনিট, দুই মিনিট! এতোটা সময় দুজন নিশ্চুপ ছিল। কানে মোবাইল রেখেই একে অপরে নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে বোধহয়। ধৈর্যহীন হয়ে উঠলো মিতালী। কিছু বলার জন্য উদ্বেগ হতেই অংকুর বলে উঠলো, ‘একটু রেলিং’এর কাছে আসবে?’

ভ্রুঁ কুঁচকে এলো মিতালীর। অংকুরের কথা খানি ভারী অবাক লাগলো। বিস্মিত হলো কিছুটা। রেলিং’এর কাছে যাবে কেন? সেখানেই বা যেতে বলছে কেন অংকুর? নানান ধরনের চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগলো মাথায়। অস্থির হলো মন। বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো, ‘মানে?’

‘তুমি বসে পরলে কেন বলো তো? দেখা যাচ্ছে তোমাকে। একটু কষ্ট করে রেলিং’এর পাশে এসে দাঁড়াও।’

প্রকাণ্ড বিস্মিত হলো মিতালী। চটজলদি উঠে দাঁড়ালো। রেলিং’এর পাশে এসে এক হাতে রেলিং’এ ভর দিয়ে পাশেপাশে তাকাতে লাগলো। অন্ধকারে সোডিয়ামের কৃতিম আলোতে সব কিছু ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। বাসার কাছে তাকালো মিতালী। না! বাসার সামনের আঙিনা টা একদম ফাঁকা। গেইটের পাশে দারোয়ান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কেউ তো নেই এখানে। কিন্তু অংকুর কোথায়? তাকে দেখতে পাচ্ছে কিভাবে? তার এমন অস্থিরতা দেখে মৃদু আওয়াজে ফেললো অংকুর। হাসির শব্দটা কর্ণপাত হলো মিতালীর। প্রশ্ন করলো, ‘হাসছেন কেন? কোথায় আপনি?’

অংকুর মৃদু স্বরে বললো, ‘সামনে তাকাও।’

কথা মতো সামনে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মিতালী। গেইটের দূরপ্রান্তে রাস্তার পাশে একটা আবছা অবয় দেখা যাচ্ছে। একদম স্পষ্ট নয়। তবে এই ছায়াটা যে কোনো পুরুষ মানুষের তা মিতালী একদম নিশ্চিত। তার মানে এই ছায়া অংকুরের? এতো রাতে এখানে কি করছে সে? ভাবান্তর আসলো মিতালীর মাঝে। অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আপনাকে দেখা যাচ্ছে না কেন।’

স্মিতি হাসলো অংকুর। বাইকে হেলান দিয়ে পকেটে একহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। উষ্ঠধয়ে হাসি রেখে এগিয়ে গেইটের সামনে আসলো। মুহূর্তেই সোডিয়ামের কৃতিম আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো অংকুরের মায়াবি মুখশ্রী। ঠোঁটে তার মৃদু হাসি। বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো মিতালী। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অংকুরের পানে। এটা আদৌ সম্ভব? কণ্ঠস্বরে বিস্মিত রেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘আপনি এখানে কি করছেন? আমার বাসা চিনেন কিভাবে?’

‘নাম্বার ট্র‍্যাক করেছি।’

অংকুরের মোলায়েম কণ্ঠ ধ্বনি। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিতালীর দিকে। এতোক্ষণ খোলা চুল গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছিলো। এখন খোঁপা করে নিয়েছে। তাও যেন অবাধ্য ছোট ছোট গুলো কপালের কাছে পরে দুল খাচ্ছে। পরনে লাল রঙের থ্রি-পিস। নিজের বাসার বারান্দা হলেও ওড়নাটা খুব সাবলীল ভাবে গায়ে আঁটসাঁট ভাবে দেয়া। নিশব্দে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো অংকুর। চোখেমুখে তার খুশীর ঝিলিক। যেন কতশত অপেক্ষার প্রহর শেষে মিতালীর দেখা মিললো। অথচ প্রায় ঘন্টা তিনেক সময় ধরে সে মিতালীকে দেখছিলো। মেয়েটাকে এতো দেখতে ভালো লাগে কেন? গুলুমুলু বলে?

অংকুর কে বাসার গেইটের কাছে দেখে অস্থির হলো মিতালী। বাই চান্স দারোয়ান কিংবা বিল্ডিং’এর কারোর নজরে আসলে কেলেঙ্কারি বেধে যাবে। আর যদি কোনো ভাবে জানতে পারে ছেলেটা মিতালীর পরিচিত তাহলে তো রক্ষে নেই। এমনিতেও তাকে নিয়ে সবার কানাঘুষা, অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষদের টেনশনের শেষ নেই। যদি এই ছেলের ব্যাপারে অবগত হয় তাহলে তো তিল থেকে তাল বানিয়ে বি-টিবিতে ছেঁড়ে দিবে। কতশত চিন্তা মাথায় আসলো তার। অস্থির হলো মন। বিচলিত হয়ে বলে উঠলো, ‘আপনি এখানে এসেছেন কেন? কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্লিজ চলে যান এখান থেকে। কেউ দেখে ফেলবে।’

আলতো ভাবে হাসলো অংকুর। বললো , ‘রিলেক্স! এতো হাইপার হচ্ছো কেন? এই দেখো হাঁপিয়ে উঠেছো। সব ব্যাপারে এতো অস্থির হতে নেই। কে কি ভাবলো সেটা দেখার বিষয় না। আমার তো এখন তোমাকে দেখতে পারলেই চলবে।’

‘পাগল আপনি? এতো রাতে একটা মেয়ের জন্য তার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকাটা দৃষ্টিকটু নয়? প্লিজ চলে যান এখান থেকে। দেখুন বাসার গেইটের ভিতরই দারোয়ান চাচা আছে। উনি টের পেয়ে যাবে।’

‘ব্যাপার না মিলি জাস্ট চিল। উনাকে পেপসি খাইয়ে আমার দলে নিয়ে এসেছি। উনি জানে আমি এখানে আছি। টেনশন নিও না।’

এক হাতে কপালে পরলো মিতালী। কপাল চাপড়ে হতাশার নিশ্বাস ছুঁড়লো। অস্থির মনে রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে রুমের দরজার দিকে তাকালো। মাঝে মাঝে মাঝ রাতে তার বাবা জুলফিকার তার রুমে এসে তাকে দেখে যায়। কারন তিনি জানেন তার মেয়ে রঙতুলি নিয়ে রাতের বেলায় মেতে উঠে। সেই সুবাধে মাঝে মাঝে তিনি নিজেও এসে মেয়ের সাথে রাতে আড্ডা জমান। দিনে তো সময় পায় না তাই। কিন্তু মিতালী আছে এখন টেনশনে। এযেন এক মহা বিপদ। যদি তার বাবা এখন রুমে চলে আসে তাহলে? যদি বুঝতে পারে তার মেয়ের জন্য কোনো ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে? ছিঃ কি লজ্জা! এইসব ভেবে নিজেই নিজের উপর লজ্জিত হলো মিতালী। অংকুরের দিকে তাকিয়ে অনুনয় স্বরে বলে উঠলো, ‘দোহাই লাগে আপনার চলে যান। বাবা টের পেয়ে যাবে। আমার ভয় করছে। প্লিজ অংকুর! আপনি চলে যান।’

চকচকিয়ে মিতালীর দিকে তাকালো অংকুর। চোখে মুখে তার খুশির আভাষ। প্রছন্ন হাসি দিলো একটা। বললো, ‘কি বললে? আরেকবার বলো তো শুনতে পাই নি।’

বিরক্ত হলো মিতালী। অংকুরের কথাটা তার রশিক প্রবন লাগলো। এমন মুহূর্তে হাসিটা বিরক্তির তালিকায় যুগ হলো। তাই অসন্তুষ্ট হয়ে বলে উঠলো, ‘কি সমস্যা আপনার অংকুর? এখন মজা করার জায়গা? আপনাকে না আমি যেতে বলেছি? যাচ্ছেন না কেন?’

‘আমার নামটা খুব সাধারন ছিলো। কিন্তু তোমার মুখ থেকে আমার নামটা শুনে এখন এই ছোট নামটাও পৃথিবীর সব চেয়ে দামি মনে হচ্ছে। আরেকবার বলবে প্লিজ?’

মহা বিরক্ত হলো মিতালী। চোখে মুখে রাগের ছাপ ভেসে উঠলো তার। অংকুরের কথাবার্তা এখন তার বিরক্ত লাগছে। এইদিকে ভয়ে তার প্রাণ পাখি যায় যায় অবস্থা। আর অন্যদিকে অংকুর ঠাট্টার ঝুড়ি খুলে বসে আছে। দাঁতে দাঁত পিষলো সে। মহা বিরক্তি নিয়ে ধমকে বলে উঠলো, ‘অংকুর?’

‘আহঃ কি শান্তি!’ বুকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো অংকুর। ঠোঁটে তার প্রাপ্তির হাসি। হৃদয়ে তার প্রশান্তির শ্রোত বয়ে যাচ্ছে। মিতালী কে দেখার পর থেকেই ভালো লাগছে। সকল প্রকার ক্লান্তি নিমিষেই দূর দূর হয়ে গেছে। মনে এক অদ্ভুত রকমের অনুভূতি কাজ করছে। এই প্রশান্তি তার চায়। সারাজীবনের জন্য মিতালী নামক প্রশান্তি তার চায়। প্রেমিকা নয় বরং অর্ধাঙ্গিনীর রূপে জীবনে চায়। যার হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে জীবন অতিবাহিত করবে। ছোট একটা সংসার হবে। মিতালীর মতোই ছোট ছোট নতুন প্রান আসবে। প্রসন্নমনে হাসলো অংকুর।

‘কি সমস্যা কি আপনার? যাচ্ছেন না কেন এখান থেকে? কেউ দেখে ফেললে কি হবে ভেবেছেন একবার? নাকি গণধোলাই খেতে ইচ্ছে করছে কোনটা?’

মিতালীর ধমকানো কণ্ঠস্বর শুনে ধ্যান ভাঙ্গলো অংকুরের। চুপচাপ লাইটের আলো থেকে পিছিয়ে অন্ধকারে আসলো। আগের মতোই বাইকে আড়ামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজল। বললো, ‘এখন অন্ধকারে আছি। কেউ দেখবে না।’

‘আপনি যাচ্ছেন না কেন?’

‘এতো নির্দয় কেন তুমি? একটা ছেলে তার ঘুম হারাম করে মাঝ রাতে তোমার বারান্দার নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশাদের চুম্মা খাচ্ছে। কোথায় তুমি তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে আপ্যায়ন করবে তা না। উল্টো অসহায় ছেলেটাকে চলে যেতে বলছো? এতো কঠোর তুমি মিলি? দয়া মায়া কিচ্ছু নেই।’

অংকুরের কন্ঠ স্বর শুনে মনে হচ্ছে মিতালী তার উপর অন্যায় করছে। যার কারনে তাকে আদালতে টেনে নিয়ে কঠিনতম শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। হতাশার নিশ্বাস ছুঁড়লো মিতালী। প্রশ্ন করলো, ‘স্বেচ্ছায় মশার কামড় খেতে এখানে বসে আছেন কেন? আমি কি বলেছি আপনি আসেন। এসে মশার কামড় খেয়ে যান।

দাঁত কেলিয়ে হাসলো অংকুর। প্রতিত্তুর করলো, ‘তুমি এতো গুলুমুলু কেন বলো তো? দেখতে প্রচুর কিউট লাগে। তাই তো তোমাকে দেখার ইচ্ছা দমাতে পারিনি। সন্ধ্যা সাত টায় মিটিং ছিল, শেষ হয়েছে দশটায়। এখনো বাসায় ফিরিনি। তোমাকে দেখার জন্য চলে এলাম। প্রথমে কানফিউড ছিলাম যে পাঁচ তলা বিল্ডিং’এর কোন তলায় থাকো। প্রায় পনেরো মিনিটের মতো এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর মহারানীর দেখা মিললো। আমার ভাগ্য ভালো তোমরা দুই তলায় থাকো। যদি চার-পাঁচ তলায় থাকতে তাহলে তো তোমাকে দেখায় যেত না।’

চলমান..

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[১৪]

ধাতস্থ হলো মিতালী। কণ্ঠস্বর প্রথমের মতো রুক্ষতা করলো না। এই ছেলেকে ধমকে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে বরং একটু ভালো করে কথা বলে দেখা যাক। তাই করলো সে। কণ্ঠস্বর মোলায়েম করে বললো, ‘যেহেতু অফিস থেকে ফিরে বাসায় যান নি। আপনি নিশ্চয় অনেক ক্লান্ত। তাই চুপচাপ বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন। ভালো লাগবে।’

‘ক্লান্ত তো অবশ্যই। প্রচুর ক্লান্ত ছিলাম। কিন্তু তোমাকে দেখার পর সব ক্লান্ত নিমিষেই গায়েব হয়ে গেছে। মহা ঊষুধের মতো কাজ করেছো তুমি। আম্মাকে বলে তাড়াতাড়ি তোমাকে আমার ঘরে আনতে হবে। অফিস থেকে ফিরেই যেন তোমাকে দেখতে পাই।’

হতাশ হলো মিতালী। ‘উফ’ বলে ফুঁশ করে বড় একটা নিশ্বাদ ছুঁড়ে ফেললো। উষ্ঠধয় জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো একবার। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারনে পা দুটো অবস হয়ে আসছে। ভীষণ ব্যাথা করছে। তাই দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না আর। পিছু ঘুরলো বসার জন্য। তখুনি অংকুরের অস্থির কন্ঠ ভেসে আসলো।

‘এই মেয়ে, ঘুরছো কেন? বাসায় চলে যাচ্ছো নাকি? খবরদার যাবে না। আমাকে এখানে একা ফেলে ভিতরে যাওয়ার চিন্তা করবে না। আরেহ্ এই দিকে ঘুরে দাঁড়াও নাহলে দেখা যায় না তোমাকে। এই মিলি। এইদিকে তাকাও।’

অংকুরের অনুনয় কন্ঠস্বর শুনে ঠোঁট চেপে মৃদু হাসলো মিতালী। পিছু ফিরে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। কণ্ঠস্বর শক্ত করে বললো, ‘সমস্যা কি? আর কত দেখবেন? এবার তো বাসায় যান।’

‘প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে। চটজলদি এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসো তো।’

‘মানে কি? পাগল হয়েছেন নাকি? এতো রাতে কিভাবে চা নিয়ে নিচে যাবো আমি? চা খেতে হবে না আপনি বাসায় যান।’

‘তাহলে আমিও যাবো না।’

‘এমন করবেন না প্লিজ। চলে যান এখান থেকে।’ অনুরোধ করে বললো মিতালী। কিন্তু অংকুরের ত্যাড়া প্রতিত্তুর, ‘জি না!’

ব্যর্থ হলো মিতালী। নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে তার। এই ছেলের সাথে কেন দেখা হলো তার? কেনো সেদিন কলার খোসা রাস্তার পাশে ফেলে মানবদরদী দেখাতে গিয়েছিলো? এখন এই ছেলের পিছু ছাড়াবো কিভাবে? হায় আল্লাহ! কাদুকাদু ভাব আসলো তার মাঝে। ঠোঁট উল্টে ফেললো। বললো, ‘দেখুন, এখন নিচে যাওয়া সম্ভব না। বুঝার চেষ্টা করুন। আব্বু জানতে পারলে মে:রে ফেলবে। প্লিজ আপনি চলে যান। আমি কাল সকালে আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াবো।’

অংকুর ফিরতি প্রশ্ন করলো, ‘কিভাবে খাওয়াবে?’

‘সকালে আমি চা বানিয়ে নিয়ে যাবো। তারপর আপনার সাথে দেখা হলে চা দিব আপনি খাবেন। ব্যাস।’

কিছুক্ষন ভাবলো অংকুর। যাক এই সুযোগে তাহলে সকালেও মিতালীর সঙ্গে থাকা হবে। সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে হয়। তাই সে রাজি হয়ে গেল। বললো, ‘ঠিক আছে। দুই কাপ বানিয়ে নিয়ে আসবে। সকাল সাতটায়। না ছয়টায় আসবে। আমি মাঠে অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। মনে থাকবে তো?’

মিতালী সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলালো। অর্থাৎ তার মনে থাকবে। মৃদু হাসলো অংকুর। বাইকে হেলান দেওয়া অবস্থা পরিবর্তন করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ‘রাখছি’ বলে কল কেটে দিলো সে। বাইকে উঠে বসে মিতালীর দিকে তাকিয়ে চৌড়া করে একটা হাসি দিলো। তারপর বাইক সার্ট দিয়ে চলে গেলো। স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো মিতালী। এতোক্ষণে যেন সে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কি এক মহা বিপদ! এই ছেলের থেকে আমাকে উদ্ধার করো মাবুদ। উদ্ধার করো। মনে মনে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে পিছু ঘুরতেই দেখলো পেলো শেফালী বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ পিছনে শেফালীকে দেখেই পিলে চমকে উঠেছিল মিতালী। ভরকে গিয়ে জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলো। বললো, ‘এভাবে কেউ আসে? ভয় পেয়েছিলাম।’

‘মানুষ প্রেম করতে গিয়ে ধরা পরলে যেমন অবস্থা হয়। তোমার ঠিক তেমনি হলো। কাহিনী কি বুবু?’

ভ্রুঁ যুগল নাচিয়ে প্রশ্ন করলো শেফালী। কড়া চোখে তাকালো মিতালী। কন্ঠ শক্ত করে বললো, ‘পাকনামি করবি না। এখানে কি করছিস?’

পাত্তা দিলো না শেফালী। বরঞ্চ উল্লাসিত হয়ে মিতালীর ঘা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো, ‘এটা কি অংকুর ভাইয়া ছিলো? বিশ্বাস করো বুবু অংকুর ভাইয়াকে আমার দারুণ লেগেছে। দেখেতে ফাটাফাটি হ্যান্ডসাম। তোমার সাথে পারফেক্ট মানাবে।’

মৃদু হাসলো মিতালী। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বললো, ‘কিন্তু আমি একটুও না। উনি কতো সুন্দর আর আমি? উনার সাথে আমার যায় না। সো এইসব চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।’

‘উফফু, এতো নেগেটিভ কেন তুমি? কে বলেছে তুমি যাও না উনার সাথে? অবশ্যই মানাবে তোমাদের। কে কি বললো তা যদি ভাবতে যাও তাহলে তোমার জীবনে সুখ আসবে না। মাঝে মাঝে নিজের জন্য হলেও সার্থপর হতে হয়। তুমি তোমার পছন্দ অনুযায়ী থাকো তাহলে জীবনে সব পাবে। ইউ নো হুয়াট? নিজের সুখ পৃথিবীর সব থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট।’

স্মিতি হাসলো মিতালী। সুখ কি যেচে পরে আসে? সমাজে চলতে গেলে নানান কটুকথার সম্মুখীন হতে হয়। সমাজের মতে মেয়ে মানুষ মানেই নির্ভুল, নিখুঁত হতে হবে। কোনো প্রকার খুঁত থাকা চলবে না। দুর্ভাগ্যবশত যদিও তিল পরিমানেরও খুঁত পায় তারা তাহলে উঠে পরে লেগে পরবে অপদস্থ করতে। অথচ তাদেরই নিজের ঘরে মা, বোন ও মেয়ে থাকে। কিন্তু অপর মা, বোন ও মেয়েকে কথা শুনাতে পিছপা হয় না। ধিক্কার এই সমাজকে। ধিক্কার জানাই তাদের কুৎসিত মন মানসিকতা কে।

.
ভোরে পূর্ব আকাশে দিবাকরের মিটমিট আলোকরশ্মি পুলকিত হচ্ছে। স্নিগ্ধ সকালের আলোতে নিজেকে মাখিয়ে নিচ্ছে অংকুর। পরনে তার সাদা শার্ট ইন করে পরা। গলায় ঝুলানো কালো টাই ঢিলে করে রেখেছে। মাঠের এক প্রান্তে বসে অপেক্ষা করছে মিতালীর আসার। মাঠের পাশে রাস্তাটার দিকে তাকালো একবার। তারপর হাতে থাকা টাইটান ব্র‍্যান্ডের কালো ঘড়িটার দিকে নজর বুলালো একবার। সকাল ছয়টা আট বাজে। মিতালী আসছে না কেন? এতো দেড়ি করছে মেয়েটা। লেইট-লতিফ। বিরক্তি চেহারায় নাক মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করছে অংকুর। বেশ কিছুক্ষন পর খেয়াল করলো শুভ্র রঙের কাপড় পরে মিতালী তার দিকে এগিয়ে আসছে। দৃষ্টি সরালো না অংকুর। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো মিতালীর দিকে। চুল গুলো বেনী করে একপাশে রাখা। শুভ্র রঙের চুড়িদার জামা, হাল্কা লাল লিপস্টিক, কপালে কালো টিপ হাতে কালো চুড়ি সব মিলিয়ে মারাত্তক সুন্দর লাগছে মিতালীকে। চোখ সরানো কষ্টসাধ্য হয়ে পরেছে অংকুরের জন্য। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অংকুর। এখনো কেমন হা হয়ে তাকিয়ে আছে সে।

মিতালী ধীর পায়ে অংকুরের পাশে এসে দাঁড়ালো। কপালের পাশে খুলে আসা কিছু অবাধ্য চুল কানের পিছে গুঁজল। অংকুর তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো মিতালী। প্রশ্ন করলো, ‘কি?’

হকচকিয়ে গেলো অংকুর। চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। ব্যাপার টা অপ্রীতিকর লাগলো তার কাছে। এক হাতে মাথা চুলকালো। নিজের ভিতরের অস্থিরতা বুঝতে দিলো না। বরঞ্চ বললো, ‘এতো দেড়ি করে এলে যে?’

হেসে ফেলল মিতালী। ঠোঁটে হাসি রেখেই হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এতো দেড়ি কোথায়? মাত্র দশ মিনিট লেইট হয়েছে।’

‘আমার কাছে দশ দিন লেগেছে।’

মৃদু স্বরে বললো অংকুর। মিতালীর দিকে প্রগাঢ় চোখের চাহনীতে তাকালো। দুই কদম এগিয়ে এসে মিতালীর ঠিক এক হাত দূরত্বে এসে দাঁড়ালো। মিতালী নিস্থব্ধ। প্রতিক্রিয়াহীন! চুপচাপ অংকুরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। বরঞ্চ বুঝার চেষ্টা করল ঠিক কি করতে চাইছে এখন? অংকুর এগিয়ে এসে মিতালীর মুখের সামনের অবাধ্য চুল গুলো আলতো স্পর্শে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। এতোটাই সাবধানে করেছে যে মিতালীর গায়ের সাথে তার আঙ্গুলের স্পর্শ লাগে নি। কন্ঠস্বরে মুগ্ধতা এনে বললো,

‘তোমাকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে মিতালী।’

এই প্রথম অংকুর তাকে তার পূর্ন নামে ডাকলো। জড়সড় হলো মিতালী। অংকুরের এমন চাহনীতে ঘায়েল হলো সে। নিস্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অংকুরের চোখের দিকে। দৃষ্টি ফিরালো না আর।অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো মনে। এর আগে কখনো এমন অনুভূতির স্বীকার হয়নি মিতালী। এই অনুভূতি কিসের? নামকরণ করতে পারলো না!

স্মিতি হাসলো অংকুর। তারপর রসালো গলায় বললো, ‘প্রেমে পরার মতো সাংঘাতিক ব্যাপার আর দুটি নেই। যারা একবার প্রেমে পরে তারা এই প্রেমনামক অসুখ থেকে মুক্তি পায় না। আমারও অসুখ পরেছে। তোমাকে ভালোবাসার মতো সাংঘাতিক অসুখ। এবার বলো মুক্তির উপায় কি?’

মিতালী নিশ্চুপ রইলো। অংকুরের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে নিলো। নির্জন পরিবেশ। মাঠের আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। শহরের বুকে এই সকালে জনমানবশূন্য। মৃদু বাতাস প্রভাহমান। স্নিগ্ধ পরিবেশে শীতল বাতাসে মন ফুরফুরে বেশ। মিতালীর মন প্রফুল্ল। তবে অংকুর পাশে থাকায় জড়তা কাজ করছে মনে। কিছুক্ষণ আগের কথায় নিশ্চুপ রইলো সে। লজ্জাভূতি হচ্ছে সে।

আলতো ভাবে হাসলো অংকুর। মিতালীর লজ্জা এড়াতে বলে উঠলো, ‘ আমার চা কোথায়? তোমার হাতের চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি ক্লান্ত। ঝটপট চা দাও তো শরির টা একটু চাঙ্গা করি।’

হেসে উঠলো মিতালী। অংকুর মাঠের এক পাশে আসন পেতে বসে পরলো। মিতালীও নিশ্চুপ থেকে তার সামনে বসলো। ব্যাগ থেকে পানি গরম রাখার ফ্লাক্স বের করলো। তারপর দুইটা সাদা কাপ বের করে চা ঢেলে নিল। অংকুরের হাতে দিলে অংকুর চটজলদি চায়ের কাপে চুমুক বসালো। তারপর পরিতৃপ্তির সুর তুললো ‘আহ্!’

‘এত্ত ভালো চা বানাও তুমি? জাস্ট অসাধারন হয়েছে।’

মিতালী ত্যাড়া চোখে তাকালো তার দিকে। মনে মনে ভাবলো এই ছেলে ভালোই তেল দিতে জানে। নিজের জন্য কাপে চা ঢাললো। কাপে চুমুক বসাতে কাপ ঠোঁটের কাছে আনতেই চেঁচিয়ে উঠলো অংকুর।

‘আরেহ্ আরেহ্ করছো কি? চা খেয়ে নিচ্ছো কেন? ছবি তুলবে কে? এটা আমাদের প্রথম টি-ডেইট। ছবি তুলবো না? ভারী আশ্চর্য মেয়ে তুমি। কাপটা হাতে নিয়ে এইদিকে দাও। কয়েকটা ছবি তুলবো। ফেসবুকে আপলোড দিয়ে ‘চাকসবাসী’ কে দেখাতে হবে না আমিও তাদের মতো টি-ডেইটে গেছি। দাও দাও।’

হতভম্ব হয়ে গেলো মিতালী। মুখ হা করে ফ্যালফ্যাল চোখে অংকুরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলে নির্ঘাত পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছে। এই কার পাল্লায় পরলাম খোদা?

অংকুর পকেট থেকে মোবাইল বের করে মিতালীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারো বলে উঠলো, ‘আমাকে দেখার সময় সারাদিন পাবে। এখন ঝটপট চায়ের ছবি তুলি। নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

অপ্রীতিজনক কথা শুনে লজ্জা পেলো মিতালী। চোখ সরিয়ে নিলো। অতঃপর দুজনের চা কাপ এক সাথে রেখে কয়েকটা ছবি তুললো অংকুর। বেশ কয়েকটা চা কাপের ছবি তুলে মিতালীর সঙ্গে একটা সেলফি নিয়ে নিলো। যদিও সেলফি তুলার সময় মিতালী প্রস্তুত ছিলো না। একদম ক্যান্ডিট!’

চলমান..