অনেক সাধনার পরে পর্ব-২+৩

0
460

#অনেক_সাধনার_পরে’
#মাইশাতুল_মিহির [লেখিকা]

[০২]

‘হ্যালো মিস? সমস্যা কি আপনার?’

কথাটি কর্ণপাত হতেই থমকালো মিতালী। পিছু ফিরে তাকালে গাঢ় নীল রঙের হাফ হাতা টি-শার্ট পরা একটি ছেলে কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। চেহেরায় তার স্পষ্ট রাগের ছাপ ভাস্যমান। চোখমুখ শক্ত করা তাকিয়ে আছে মীতালীর দিকে। তার এমন চাহনীতে মিতালী ভ্যাবাচেকা খেলো। বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু।

‘আমার শরির টা কি আপনার ডাস্টবিন মনে হয়? চোখে দেখেন না?’

ছেলেটির গমগমে কন্ঠ শুনে বিস্মিত হলো মিতালী। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো একবার। না তাকেই কথাগুলো বলছে। চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মিতালী। হঠাৎ তাকে এমন কথা বলার কারণ বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো। ছেলেটির রাগ যেন আরো আকাশচুম্বী হলো। রাগে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘সমস্যা কি? এভাবে হাম্বার মতো তাকিয়ে আছেন কেন? আমার শরিরে কি কলার খোসা ফেলার জায়গা? কলা খাবেন ভালো কথা তাই বলে যার তার গায়ে ছুঁড়ে ফেলবেন?’

মিতালী নিশ্চুপ। একদম প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে সে। আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো প্রথম বারের মতো। ছেলেটির এরূপ ব্যবহারের কারন তার বুঝে আসলো তার। ভুলবশত কলার খোসা ছেলেটির গায়ে পরেছে। যার ফলস্বরুপ এমন বাঘের মতো ক্ষেপে আছে। ধাতস্থ হলো মিতালী। কণ্ঠস্বরে রুক্ষতা এনে বললো, ‘আমি তো রাস্তার পাশে ফেলেছিলাম। আপনি ওইখানে কি করছিলেন? এটা কি আমার দুষ? আপনি ওই নোংরা জায়গায় না থাকলে কলার খোসা আপনার গায়ে পরতো না।’

ছেলেটির রাগ আরো তিরতির করে বেড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করে বললো, ‘বাহ্ একে তো দুষ করলেন নিজে। তার ওপর আবার আমার উপর দুষ চাপাচ্ছেন? আমি ক্রিকেট বল আনতে রাস্তার নিচে নেমেছিলাম। আপনি দেখে ফেলবেন না? যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন কেন? ডাস্টবিন কিসের জন্য রাখা হয়েছে হ্যাঁ? পরিবেশ দূষণ করার ধান্দায় থাকেন নাকি?’

বিরক্ত হলো মিতালী। ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই একদম। এমনিতেই সময় কম। তাড়াতাড়ি ক্লাসে ফিরতে হবে। অসন্তুষ্টির চোখে তাকালো সে। কন্ঠস্বরে মলিনতা এনে বললো, ‘কলার খোসা ফুটপাতে পরে ছিল। আমি এখান থেকে তুলে রাস্তার নিচে ফেলেছি যেন কেউ পিচ্ছিল না খায়। আর আপনি যে ওইখানে ছিলেন একদমই দেখতে পাই নি। দুঃখিত।’

ত্যাঁছড়া ভাবে তাকালো ছেলেটি। ঠোঁট যুগল হাল্কা টেনে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো একটা। বললো, ‘এতো তাড়াতাড়ি সরি আশা করিনি। ভেবেছিলাম আজ সারাদিন ঝগড়া করতে হবে সরি শুনার জন্য। মেয়ে জাতি নাকি খুব সহজে হার মানে না। তাই এমন ভাবনা ছিলো। কিন্তু আপনি তা ভুল প্রমান করেছে।’

তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো মিতালী। এই কথা গুলো ডিরেক্ট ফালতু কথার মতো লাগছে তার কাছে। কথা বললেই কথা বাড়বে। তাই আর কথা বাড়ালো না। চেহারায় বিরক্তি এনে অপরপাশ দিয়ে হাটতে লাগলো। উফফ আজ সকালে কার মুখ দেখেছিল সে? এই ফালতু ছেলের সাথে কথা বলে তার টাইম নষ্ট হয়েছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। উফ শিট! অলরেডি নয় মিনিট লেইট হয়েছে। পায়ের গতি আরো বাঁড়াল মিতালী। দ্রুত হাটার কারনে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কপালে জমে এসেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
.

‘মেয়েটি কে অংকুর?’

মিতালীর যাওয়ার পথে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অংকুর। চাচাতো ভাই রাকিবের কথা শুনে ধ্যান ভাঙ্গে তার। একবার রাকিবের দিকে তাকিয়ে আবারো মিতালীর দিকে তাকালো। বললো, ‘চিনি না।’

রাকিব দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ভ্রুঁ নাচিয়ে বললো, ‘তাহলে কি কথা বলছিলি এতোক্ষণ?’

অংকুর মৃদু হাসি দিলো একটা। এক হাতে মাথা চুঁলকে বললো, ‘তেমন কিছু না। এমনি!’

‘যাই বল। তোর সাথে মানায় না। মেয়েটি বেশি মোটা।’ বিদ্রূপাত্মক করে বললো রাকিব। কপাট রাগ উঠলো অংকুরের। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো রাকিবের পানে। কণ্ঠস্বর শক্ত করে বললো, ‘কারোর দেহের গড়ন নিয়ে মজা করা ঠিক না। মেয়েটি তার দিক দিয়ে অবশ্যই সুন্দর। বরং তোর ম্যান্টালিটি কুৎসিত।’

বিস্মিত হলো রাকিব। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো অংকুরের দিকে। তার বিশ্বাস হিচ্ছে না একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য অংকুর তার ম্যান্টালিটিকে কুৎসিত বলবে? মানতে পারলো না। বলে উঠলো, ‘তুই ওই মেয়েটার জন্য আমার ম্যান্টালিটিকে কুৎসিত বলছিস?’

এবার বেশ ভালো বিরক্ত হলো অংকুর। ত্যাড়াভাবে বললো, ‘হয়েছে। এবার চল খেলতে সবাই ওয়েট করছে।’

রাস্তার পাশে থাকা বড় মাঠে চলে আসলো অংকুর। রাকিব কিছুসময় সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুটা অপমানিত হলো সে। চুপচাপ খেলার মাঠে আসলো। বড় মাঠ জুড়ে ক্রিকেট খেলছে বড় ছেলেদের দল। জুনিয়র রা পাশে বসে তাদের খেলা দেখছে। রৌদ্দুরের তাপে অংকুরের কপাল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঘাম ঝরে পরছে। অংকুর আবারো রাস্তায় দেখলো। মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে না দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলো খেলায়।
.

দ্রুত পায়ে হেটে কুচিং’এ আসলো মিতালী। এতো তাড়াতাড়ি করে আসায় হাঁপিয়ে গেছে সে। জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন অবস্থা। ওড়নার আঁচলখানি টেনে কপালের, ঠোঁটের পাশের ঘামটুকু মুছে নিলো। দরজায় কাছে এসে দাঁড়িয়ে ভিতরে আসার পারমিশন চাইলো।

ক্যানভাস থেকে চোখ তুলে দরজায় তাকালো মুফাজ্জল। গম্ভীর তার চাহনী। চোখে পাওয়ারফুল চশমা। মাথায় বোধহয় হাতে গুনা কয়েকটা সাদা চুল। বয়সের সঙ্গে কুঁচকে এসেছে গায়ের চামড়া। তিনি মিতালীকে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আসো। এতো দেড়ি হলো কেন তোমার? আজকে নতুন একটা নিয়ম শিখেছি। তুমি লেইট করলে।’

প্রছন্ন হাসলো মিতালী। ক্লাসরুমে ঢুকে ব্যাঞ্চিতে ব্যাগ কাধ থেকে খুলে রাখতে রাখতে বললো, ‘সরি স্যার! আসলে কিভাবে যেন আজ দেড়ি হয়ে গেছে। তার উপর রাস্তায় একটা ঝামেলায় পরেছিলাম।’

‘ঠিক আছে! ব্যাপার না। তুমি বসো। আমি ক্যালিগ্রাফির হরফ টানার নিয়মটা দেখাচ্ছি।’

মিতালী ব্যঞ্চে বসে ব্যাগ থেকে এক্রাইলিক কালার, কিপ স্মাইলিং ব্যান্ডের প্রয়োজনীয় কিছু তুলি বের করলো। ক্যানভাসে আগে থেকেই জেসু দেওয়া ছিলো বিধায় প্রথমেই রঙ দিয়ে দিলো। মুফাজ্জল ক্যালিগ্রাফির আরবি হরফ গুলো সূক্ষ্মতার সঙ্গে মিতালীকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। হোসাইন মুফাজ্জল একজন বড় আর্টিস্ট ম্যান। তার ক্যালিগ্রাফি, বিভিন্ন আর্ট দেশবিদেশে খুব খ্যাতি পেয়েছে। তার বড় একটা কুচিং সেন্টার আছে। যেখানে নবীন দের ক্যালিগ্রাফি শিখানো হয়। মিতালী তারই কাছে ক্যালিগ্রাফি শিখছে। তার ক্লাস সাপ্তায় তিন দিন।

ক্লাস শেষে মুফাজ্জল চলে গেলেন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে আর সহপাঠীদের সাথে আলাপ আলোচনা করছে। মিতালী মৌনতার সঙ্গে রঙ, তুলি, ক্যানভাস গুছিয়ে নিলো। ব্যাগ কাধে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ওবাইদুর ও মনিরা আসলো সেখানে। ওবাইদুর হাসিমুখে মিতালীকে বললো, ‘আজকে আমরা কয়েকজন রেস্টুরেন্টে পিজ্জা পার্টি এরেঞ্জ করেছি। আমিও চাই তুমি আমাদের সাথে জয়েন করো।’

ওবাইদুর আর মনিরা এখানেই ক্যালিগ্রাফি শিখে। সেই সুবাধে পরিচিত তারা। যদিও মনিরারর সঙ্গে মিতালীর সম্পর্ক খুব গভীর। ওবাইদুর হলো মনিরার বয়ফ্রেন্ড আবার ফিয়ন্সে। মনিরার কারনেই ওবাইদুরের সাথে মিতালীর ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মনি উল্লাসিত হয়ে মিতালীর হাত ধরে বললো, ‘অনেক মজা হবে রে। না করিস না প্লিজ।’

তাদের দুইজনের অনুরোধে মিতালী পরলো বিপাকে। যাবে? নাকি যাবে না? ভাবতে লাগলো। প্রতিত্তুর করার সময় পেলো না। তার আগেই পাশ থেকে হাফছা নামের উজ্জ্বল ফর্শা সুন্দর ফিগারের মেয়েটি বলে উঠলো, ‘আরে আমাদের সাথে মিতালীও যাবে নাকি? তাহলে তো হলোই। পকেট একদম ফাঁকা হয়ে যাবে আজ।’

হাফছার দিকে দৃষ্টি গেলো সবার। হাফছা যে এখন মিতালীকে অপমান করবে তা কারোর বুঝতে বাকি নেই। মনি দাঁতে দাঁত পিষে তাকালো। গ্লানিবোধ করলো মিতালী। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শুনতে লাগলো রোজকার দিনের মতো সেই একই কথা। বেশিরভাগ সময় হাফছা নামের স্টাইলিশ মেয়েটি তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করে। ফুঁশ করে বিমূঢ়তার নিশ্বাস ফেললো মিতালী।

ক্লাসে অন্য একটা মেয়ে হাফছার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘পকেট ফাঁকা হবে কেন?’

বিদ্রূপমাখা হাসি দিলো হাফছা। মিতালীকে অপদস্থ করতে বললো, ‘মিতালী মাশাআল্লাহ যা খায়, বিল দিতে গেলে পকেট খালি হবে না? বাজেট আরো বেশি ধরতে হবে। আমাদের সবার খাওয়ার বিল, আর মিতালীর একার খাওয়ার বিল। দুইটা একদম সমান সমান হবে।’

হেসে ফেললো উপস্থিত কয়েকজন। বাকি কয়েকজন হাফছার এরূপ ব্যবহারে অসন্তুষ্ট প্রকাশ করলো। মনি মাত্রারিক্ত রাগান্বিত হলো। রাগে চোখমুখ শক্ত করে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি তোর? সবসময় মিতালীর পিছু পরে থাকিস কেন?’

অবাক হওয়ার ভান ধরলো হাফছা। বললো, ‘যা বাবাহ্! আমার কি আর কোনো কাজ নেই? মিতালীর পিছনে পরে থাকবো কেন? আর মিথ্যে কি বলেছি? ওই তো খায় বেশি। শরির দেখ আস্তো আটার বস্তা।’

হেসে উঠলো অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ গুলো। মিতালী নিঃশব্দে অপমান সয্য করতে লাগলো। মুখের উপর কথা বলে দেওয়ার মতো অভ্যেস তার নেই। যার ফলস্বরুপ সব সময় ঠোঁট চেঁপে শুনতে থাকে শুধু। চোখে পানি জমে ঝাপসা হয়ে এলো তার। কান্না গুলো গলায় দলা পাকিয়ে এলো। কিন্তু নিজেকে খুব করে সামলানোর চেষ্টা করছে মিতালী। কাঁদবে না সে।

ওবাইদুর রাগি গলায় বললো, ‘মিতালী কম খেলো নাকি বেশি খেলো সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। তুমি নাক গলানোর কে? তোমার বাপের টাকায় তো আর খায় না।’

‘পারলে বোধহয় তাই করতো।’ ত্যাঁছড়া কন্ঠে বললো হাফছা। মনিরা হাফছাকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই মিতালী তার হাত ধরে ফেললো। মনিরা তাকালো তার দিকে। দেখলো মিতালীর চোখের কোণে জলের কণা চিকচিক করছে। আহত হলো মনিরা।

মিতালী কোনো রকমে বললো, ‘আমি যাবো না। তোরাই যা। বাসায় কাজ আছে আমার।’

ওবাইদুর বললো, ‘আরে ওই অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষদের জন্য তুমি কেন যাবে না? তারা তো পথেঘাটে মানুষ দেখলেই উঠেপড়ে লাগে। এদের ব্যবস্থা করার জন্য তো পাবনার ম্যান্টাল হস্পিটাল আছে। তুমি কেন টেনশন নিচ্ছো?’

সম্পূর্ণ কথাটা হাফছাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে ওবাইদুর। হাফছার শরিরে রাগ তিরতির করে বেড়ে গেলো। চেঁচিয়ে উঠলো, ‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমাকে অসুস্থ বলার সাহস হয় কি করে তোমার?’

চলমান!!

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির [লেখিকা]

[০৩]

ওবাইদুরের পাল্টা জবাব, ‘আমি তো কারোর নাম একবারও উল্লেখ করিনি। তুমি চেঁচাচ্ছ কেন?’

মনিরা ঠোঁট চেপে হাসলো। হাফছাকে আজ সঠিক ভাবে হ্যানস্তা হতে দেখে ভীষণ রকমের হাসি পাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে মুখের সামনে মাইক এনে হাফছার কানের কাছে হাসতে। ওবাইদুর কে সে মনে মনে শ’খানেক ‘লাভ ইউ’ বলে দিয়েছে অলরেডি।

হাফছার শরির রাগে অপমানে জ্বালা-পালা করে উঠলো। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে ওবাইদুরের দিকে তাকালো। ব্যাগ হাতে নিয়ে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো ক্লাস রুম থেকে। হাফছার সঙ্গ দেওয়া মেয়ে গুলো তার পিছু পিছু বেড়িয়ে গেলো। উচ্চস্বরে হেসে উঠলো বাকিরা। রুমি হাসতে হাসতে বললো, ‘ওবাইদুর তোমাকে আজকে আমার পক্ষ থেকে একটা কোকাকোলা ট্রিট রয়েছে।’

ওবাইদুর বললো, ‘আমার কিন্তু ছোট টা দিয়ে হয় না। এক লিটারের টা হলে ভালো হতো। আর যদি পারো তো দুই লিটারেরটা দিতে পারো আই ডোন্ট মাইন্ড।’

রুমি মুখ হা হয়ে গেলো তাৎক্ষনাৎ। আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো ওবাইদুরের দিকে। অন্যরা হাসলো তার কথায়। সে নিজেও ক্যাবলা মার্কা হাসি দিলো। মনি ওবাইদুরের পেটে কুনই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বললো, ‘নির্লজ্জ পোলা! এতো খাই খাই করো কেন হ্যাঁ?’

হেসে উঠলো সবাই। সাথে মিতালীও। অপর দিকে ওবাইদুর কনুই’য়ের গুঁতো খেয়ে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো ‘উরিম্মা’.
.

সকালে স্নিগ্ধ সূর্যকিরণ থাকলেও দুপুরের প্রথম ভাগে রোদের আলো তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। ভ্যাঁপসা গমগমে গরম ছড়িয়ে পরলো চারপাশে। দীর্ঘসময় ধরে রোদের তাপে ক্রিকেট খেলার পর দুই ভাই প্রচুর ক্লান্ত। ঘেমে একাকার দুজন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। অলস শরির টেনে বাসায় আসলো তারা। মাঠ থেকে তাদের বাসার দূরত্ব খুব কম। পায়ে হেটে আসলেও বোধহয় এক মিনিটও লাগবে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালো অংকুর। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মুখখানা গম্ভীর করে রেখেছে। সেই থেকে এখন অব্ধি রাকিব অংকুরের সাথে একটা কথাও বলেনি। অংকুর ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। তবে নিশ্চপ রইলো। কলিংবেল বাজানোর কিছুসময় পর অংকুরের মা সুপ্তি দরজা খুলে দিলো। দুই ছেলের দিকে হাসিমাখা মুখে তাকিয়ে বললো, ‘এসেছিস তোরা? ওমা ঘেমে আছিস দেখছি। দিনদুপুরে খেলে অসুস্থ হয়ে যাবি তো।’

চাচিমার কথা কানে তুললো না রাকিব। গম্ভীর মুখ বজায় রেখে বিলম্ব না করে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলো। ভিতরে গিয়ে ঠাস্ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। রাকিবের এহেন কান্ডে সুপ্তি বেগম অবাক হলেন। তাড়াতাড়ি করে অস্থির হয়ে অংকুর কে প্রশ্ন করলেন, ‘রাকিবের কি হয়েছে? ছেলেটা রেগে আছে মনে হচ্ছে। কি রে কি হয়েছে?’

অংকুর ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে প্রতিত্তুর করলো, ‘উচিত কথা কারোরই হজম হয় না। চিন্তা করো না। আমি কথা বলবো।’

পিছু ফিরে তাকালো না অংকুর। বড়বড় পায়ের কদম ফেলে নিজের রুমে চলে আসলো। পিছু ফিরে তাকালে হয়তো মায়ের চিন্তিত মুখখানি নজরে আসতো তার।

রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। গা থেকে ঘামে ভেজা টি-শার্ট খুলে পাশের ঝুড়িতে রাখলো। আলমারি থেকে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট ও তাওয়াল হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো গোসল করতে। পাক্কা পঁচিশ মিনিট সময় নিয়ে গোসল সেরেছে অংকুর।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুপুরের শেষভাগ। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। খিদায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। সুপ্তি এসে ডেকে গেলো দুপুরের খাবার খেতে। অংকুর গায়ে কালো পাতলা টি-শার্ট পরে বের হলো রুম থেকে। ডাইনিং টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসলো। খেয়াল করে দেখলো রাকিব এখানে নেই। তাই সে মাকে প্রশ্ন করলো, ‘রাকিব কই? ডাক দেও নাই তুমি?’

সুপ্তি টেবিলে মাছের বাটি রেখে উত্তর দিলো, ‘ডেকেছিলাম। আসছে না। ছেলেটার মন ভালো নেই। তুই যা না গিয়ে কথা বল।’

অংকুর মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো। এই ছেলেকে নিয়ে সে পারে না। সকালে কি থেকে কি বললো সেটা নিয়ে রাগ করে বসে আছে। এতো ইমোশনাল কেন এই ছেলে? ছেলে মানুষ হবে শক্ত। কাঁদবে না তারা। অল্পতে ভাঙ্গবে না। সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে অটুট রাখবে তারা। কিন্তু রাকিব তার বিপরীত পারসন। কোনো ব্যাপারে উনিশ থেকে বিশ হলেই অংকুরের নাম জপবে। যদিও দুই ভাইয়ের সম্পর্ক অনেক গভীর।

বিলম্ব করলো অংকুর। চেয়ার ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো রাকিবের রুমের উদ্দেশ্যে। রুমে এসে দেখলো পুরো রুম ফাঁকা। তাই বারান্দায় গেলো সে। দেখলো রাকিব সেখানে বেতের মোড়ায় বসে মোবাইল ঘাঁটছে। পাশ থেকে আরেকটা বেতের মোড়া টেনে রাকিবের পাশে বসলো অংকুর। রাকিব প্রথমের ন্যায় প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে বসে রইলো। এমন একটা ভাব যেন এই বারান্দায় সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই।

বেশ কিছুক্ষন পর যখন অংকুর দেখলো রাকিবের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তখন আরো বিরক্ত হলো। বললো, ‘ভাই নাটক থামা। তোর এই নাটক আমি নিতে পারি না। তুই আমার গার্লফ্রেন্ড না যে ঘটা করে তোর রাগ ভাঙ্গাতে হবে।’

ত্যাঁছড়া চোখে তাকালো রাকিব। বললো, ‘তো এখানে আসছিস কেন? যা!’

ফুঁশ করে হতাশার নিশ্বাস ফেললো অংকুর। কন্ঠস্বর মোলায়েম করে বললো, ‘ভাই তখন কি বললাম তাই নিয়ে রেগে থাকবি?’

‘আর আমিই বা কি বললাম? মেয়েটা সত্যি একটু মোটা সেটাই তো বলেছি। মেয়েটাকে তো ছোট করে বলিনি। তুই আমার নরমাল কথাটা সিরিয়াসলি নিয়ে বসেছিস। আর কি বললি? আমার ম্যান্টালিটি কুৎসিত।’ রাকিবের পাল্টা উত্তর। কথাটা বলে অংকুরের দিকে আর তাকালো না। মুখ ঘুরিয়ে তাকে পিছ দিয়ে বসলো রাকিব। অংকুর রাকিবের বাহু টেনে তার দিকে ঘুরালো। দুই হাত জুড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললো, ‘মাফ চাই ভাই মাফ চাই। আমার আসলেই তখন ওই কথাটা বলা উচিত হয় নাই। মাফ কইরা দে ভাই। আমিও ওইভাবে বলতে চাই নাই। রাগ করিস না এবার খেতে আয়।’

ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো রাকিব। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বললো, ‘তোকে এভাবে মাফ চাইতে বললো কে? আর কে বলেছে আমি রাগ করে খেতে যাচ্ছি না? সর, আমার ইনভেস্ট করা শেষ হলে খেতে আসবো।’

হতভম্ব হলো অংকুর। রাগ হলো তার। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে রাকিবের মাথায় গাট্টা মারলো একটা। বললো, ‘শালা, তুই আগে বলবি না? আমরা তো ভাবছি রেগে খেতে আসছিস না। নাটক ভালোই পারিস।’

হেসে উঠলো রাকিব। পকেটে মোবাইল রেখে বললো, ‘আয়!’ অতঃপর দুজন খাবার খাওয়ার জন্য টেবিলে গেলো।
.

অপরাহ্নের স্নিগ্ধ কিরণ! দিবাকর পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে। ধরনীতে ছড়িয়ে আছে হলুদ লালছে আলো। আকাশে উড়ন্ত কালো পাখি গুলো ঢানা ঝাপটাচ্ছে নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। মিতালীর কোমড় অব্ধি মৃসন চুল গুলো হিম শীতল বাতাসে উড়ছে। আঁচড়ে পরছে চোখে মুখে। এক হাতে চুল গুলো খোঁপা বেধে নিলো সে। ওড়নার আচল টেনে ঘোমটা দিলো মাথায়। দৃষ্টি রাখলো সামনে। তাকিয়ে রইলো শেফালীর বাচ্ছামোর দিকে।

শেফালী ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইটের টুকরো হাতে নিয়ে সামনের ছাদে ঢিল ছুড়ছে সে। উদ্দেশ্য তার সামনের ছাদে থাকা ইটের তৈরি ছোট পুকুরটা সই করা। পুকুরটা ছাদের অপর প্রান্তে হওয়ায় শেফালী সই করতে পারছে না। বারবার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে সে।

‘থামবি তুই? হুদাই লাফিয়ে শক্তি খরচ করছিস। পারছিস তো না। বাদ দে এবার আয়। একটু পর আজান দিবে। বাসায় আয়।’

বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো মিতালী। শেফালী ইটের আরো দুইটা টুকরো হাতে নিলো। একটা টুকরো ছাদে ঢিল ছুঁড়লো। ব্যর্থ হলো সে। অপর টুকরো হাতে নিয়ে আবারো ঢিল ছুঁড়ে মিতালীর দিকে তাকালো। বললো, ‘বুবু রব্রাট ব্রুস এর একটা গল্প আছে পড়ো নাই? রব্রাট একবার পারে নাই। কিন্তু মাকরশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চেষ্টা করে রাজ্যজয় করেছে। আমিও পারবো। তুমি আমাকে উৎসাহ না দিয়ে উল্টো থামতে বলছো।’

বলেই আরেকটা ইটের টুকরো নিচে থেকে নিয়ে ঢিল দিলো এবং ভাগ্যবশত ছোট পুকুরটার মধ্যে ইটের টুকরোটা পরলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো শেফালী। ‘ইয়েয়ে’ বলে চেঁচিয়ে লাফাতে লাগলো। উল্লাসিত হয়ে দৌড়ে এসে মিতালীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধলো। মিতালীও প্রতিত্তুরে মুচকি হাসলো কেবল।

মিতালী এক হাত শেফালীর গালে রেখে বললো, ‘হয়েছে। এবার চুল গুলো বেঁধে ফেল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’

শেফালী তাকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বললো, ‘উহুম! আমি তো কাটা আনি নি। তাহলে বাধবো কিভাবে?’

মিতালী নিশ্চুপ রইলো। শেফালীকে ধরে ঘুরালো। তারপর তার পিঠ সমান হাল্কা ঢেউ হেলানো চুল গুলো ধরে খোঁপা করে দিলো। শেফালী হাত দিয়ে মাথার সামনের বেবি হেয়ার গুলো টেনে আনলো। সেই ছোট ছোট অবাধ্য চুল গুলো বাতাসে উড়ে এসে মুখে পরছে। শেফালী বোধহয় এই মুহূর্তটা উপভোগ করছে।

আরো কিছুসময় থাকার পর সিদ্ধান্ত নিলো বাসায় ফিরে যাবার। তাই দুই বোন চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে এক মহিলা উদ্ভব কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো। চালিত পা থামিয়ে দিলো দুজন। ভ্রুঁ কুঁচকে পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলো পাশের বাসার মালকিন-কে।

‘এই মাইয়া রা। দাঁড়াও কইতাছি।’

অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো দুজন। এই মহিলা ডেকেছে নিশ্চয় কিছু কটুকথা শুনিয়ে দিবে আজ। শেফালী বিরক্ত হলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলো আজ রেহাই দিবে না সে। আজ প্রতিটি কটুকথার প্রতিত্তুর দিবে সে। আর তার বোনকে নিয়ে কিছু বললে চুল টেনে ছিঁড়ে দিবে। দাঁতে দাঁত পিষে ঘর্ষণ করতে লাগলো। চোখমুখ শক্ত করে মহিলাটার সামনে এগিয়ে আসলো দুজন।

পাশাপাশি ছাদের কার্নিশ দাঁড়িয়ে আছে তারা। মহিলাটি অর্থাৎ সখিনা বিবি মিতালীর উদ্দেশ্যে বললো, ‘তোমার আম্মা বাড়িতে আছে?’

মিতালী স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো, ‘জি বাসায় আছে। কেন আন্টি কোনো দরকার?’

‘আসলে তোমার আম্মার লগে আমার জরুরি কথা আছিলো। আমার শরিরটা ভালা না নাইলে আমি জাইতাম তোমাদের বাড়ি। তোমার আম্মারে কইয়ো আমার কথা। আমাদের বাড়ি আইসা যাতে দেখা কইরা যায়। মনে থাকবো নি?’

‘জি আন্টি মনে থাকবে।’

‘আইচ্ছা তাইলে ঘরে যাও। এই সন্ধ্যা বেলা বাইরে থাকলে কাল নজর পরবো। এমনিতেও তোমার উপরে কাল নজর পইরা আছে। এর লাগি তো বিয়াশাদী হইতাছে না। তাড়াতাড়ি ঘরে যাও।’

দাঁতে দাঁত পিষে তাকালো শেফালী। কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিতালী তার হাত ধরে আটকে দিলো। মিতালী ঠোঁটে হাসি টেনে মহিলাটিকে বিদায় জানিয়ে দিয়ে শেফালীর হাত টেনে ছাদ থেকে দ্রুত নিচে নেমে আসলো।

বোনের এমন ব্যাবহারে বিরক্ত হলো শেফালী। সিঁড়ির কাছে আসতেই হাতটা ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিলো। বললো, ‘সমস্যা কি তোমার বুবু? আমাকে থামালে কেন? ওই বজ্জাৎ মহিলার মজা আজ বুঝিয়ে দিতাম।’

মিতালী বললো, ‘মানুষ খারাপ ব্যাবহার করলেই কি আমাদেরও খারাপ ব্যাবহার করতে হবে? ওরা নিকৃষ্ট হলে আমরা ভদ্র। তাছাড়া উনি তোর বড়। মুখের উপরে কিছু বলা উচিত না।’

‘ছাই গেছে তোমার উচিত অনুচিত। ওই মহিলা যে তোমাকে ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করলো তার বেলা? আমি এতো ভালো মানুষ না। নেক্সট টাইম কেউ কিছু বললে তাকে একদম ছাড়বো না। মনে রেখো।’ শক্ত গলায় বললো শেফালী। দাঁড়ালো না আর এক মুহূর্তও। রাগে গিজগিজ করতে করতে গটগট পায়ে নিচে নেমে এলো। মিতালী তার জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে হতাশার নিশ্বাস ফেললো।

চলমান..