অনেক সাধনার পরে পর্ব-৪২+৪৩+৪৪+৪৫

0
336

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪২]

আমরা ঠিক এমন একটা সমাজে বসবাস করি, যেই সমাজের মানুষ গুলো প্রতিহিংসায় ম’রে। তারা কেউ কারোর ভালো দেখতে পারে না। হামলে পরে কিভাবে অন্যদের হেনস্তা করতে পারবে ভেবে। নিখুঁতের মাঝে খুঁজে খুঁজে খুঁত বের করা তাদের স্বভাব। অন্যের সুখ দেখে ইর্ষান্বিত হয়ে কটুকথা শুনাতেও তারা পিছপা হয় না। কথায় আছে ‘হাতে নয়, ভাতে মা’রে!’ তবে তাদের ক্ষেত্রে এই কথাটির যথাযথ এভাবে হবে ‘ভাতে নয়, কথায় মা’রে!’ শরিরে একশত চাবুকের ঘা পরলে যতোটা যন্ত্রনা হয়। তার থেকেও শতগুণ বেশি যন্ত্রনার শিকার হতে হয় প্রতিবেশী নামক অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষদের কাছ থেকে। এরা কখনো ভালো হবার নয়। যুগে যুগে ঠিক এমনি হয়ে এসেছে। আজও এমন হবে।

বিয়ের কার্ড হাতে পাওয়ার পর থেকেই মোটামুটি আলোচনায় চলে এসেছে। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু টা হলো মিতালীর মতো মোটা মেয়েটাকে বিয়ে করছে কে? সকলে যার-পর-নাই অবাক। প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হয়ে রীতিমতো কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে। জামাই টা কে দেখার জন্য আগ্রহ বেড়েছে সবার। ‘এতোদিনে মাইয়া বিয়া দিতাছে জুলফিকার। দেখো গিয়ে জামাই হয়তো বিয়াইত্তা, হাত-পা ভাঙ্গা; নাইলে এমন মোটা মাইয়ারে কেউ বিয়া করবো?’ মহিলাদের এমন কথাবার্তার কিছু অংশ পরেপরে মিতালীদের পরিবারের লোকদের কানে এসেছে। কিন্তু কেউ সেই দিলে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিচ্ছে না। সমাজে চলতে গেলে নানান কথার সম্মুখীন হতেই হবে। এতো কিছুর গুরুত্ব দিতে গেলে সুখশান্তি বলে কিছুই থাকবে না জীবনে। তাই এইসব কটুকথা কেউ কানে না নিয়ে নিজেদের মতো বিয়ের আয়োজন সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।

বিয়ের একদিন আগেই মিতালীদের আত্মীয়স্বজনরা চলে এসেছে। সকল কাজিনদের নিয়ে ভীষণ রকমের আনন্দময় সময় কাটছে মিতালী ও শেফালীর। দীর্ঘসময় পর এক হলো তারা। কথার ছলে ছলে মিতালীকে নানান ভাবে লজ্জায় ফেলছে মেয়েরা।
.
গায়ের হলুদের আয়োজন জমজমাট ভাবে হয়েছে। চারপাশে ইলাস্টিকের হলুদ-লাল সংমিশ্রনের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। মিটমিট করে জ্বলছে ছোট ছোট রঙবেরঙের বাত্তি গুলো। হলুদের ডেকুরেশনের প্ল্যানিং টা শেফালী করেছে। ডেকুরেশনের লোক গুলোর সাথে থেকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে কি সাজাবে, কোথায় কি লাগাবে। মূলত পুরো কাজটা শেফালী তার মন মতো সাজিয়েছে সবটা। যদিও তার এখন একটাই আফসোস হচ্ছে। সেটা হচ্ছে তার বুবুর বিয়ের লেহেঙ্গাটা নিজে ডিজাইন করে দিতে পারলো না। যদিও এঅ আফসোস সাময়িক সময়ের জন্য। মন খারাপ করে সময় নষ্ট করার মেয়ে শেফালী না। ব্যস্ততার মাঝেও আনন্দ করেছে সবার সাথে। শেফালীর এমন মনোবল, এভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখে জুলফিকারের মন ভরে গেলেন। দুই মেয়ের পাশাপাশি একটা ছেলের অভাববোধ করতেন তারা। এখন শেফালীকে দেখে তার ছেলের অভাবের কষ্ট কিছুটা দূর হলো। মন ভরে দোয়া করলেন মেয়ের জন্য।
.

কাচা ফুলের সজ্জিত হয়ে হলুদের স্টেজে বসে আছে মিতালী। চোখেমুখে তার লাবণ্যতা। দুই হাত ভর্তি চুড়ি। পরনে কাচা হলুদ রঙের শাড়ি। চারপাশে মেহমানের ভরপুর। মিতালীর আত্মীয় সকলের ঠোঁটে সন্তুষ্টির হাসি। অন্যরা আর যায় করুক, তারা কখনো মিতালীকে অবহেলা করেনি। নিজের মেয়ের মতোই যথেষ্ট আদর যত্ন করেছে। কাজিনরা তো রীতিমতো লাফালাফি শুরু করেছে। তাদের কাজিনদের মাঝে এই প্রথম কোনো বিয়ে হচ্ছে। বংশের বড় মেয়ে বলে কথা।

অংকুরের পরিবার থেকে সুপ্তি বেগম, রাকিব, ওবাইদুর ও মনিরা সহ অংকুরের অন্য কাজিনরা হলুদ ও যাবতীয় তথ্যাদি নিয়ে এসেছে। বরপক্ষ আসায় হৈহোল্লুর পরে গেলো। স্টেজের মাঝে মিতালী। প্রথমে আমেনা ও জুলফিকার তাকে হলুদ লাগালেন। তারপর মিষ্টি খাইয়ে দিলেন। আমেনা মেয়ের মাথায় এক হাত রেখে দোয়া করলেন। মিতালী খেয়াল করলো মায়ের চোখে পানি। ক্ষুন্ন হলো মন। ঠোঁট উলটে এগিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। জুলফিকার ও আমেনা গিফটের ছোট একটা প্যাকেটে হাতে দিয়ে নেমে গেলেন স্টেজ থেকে। তারপর আসলেন জুলেখা ও সুপ্তি বেগম। জুলেখা নাতনীর গালে হলুদ লাগাতে লাগাতে কেঁদে ফেললেন। কতোই না কথা শুনিয়েছে নাতনীকে। কোনো প্রতিত্তুর করে নি। কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি দাদীর সাথে। আজ সেই মেয়েটার গায়ের হলুদ। কাল অন্য ঘরে চলে যাবে। নিজের মন কে কিছুটেই শান্ত রাখতে পারছেন না। মিতালী দাদীর চোখের পানি মুছে জড়িয়ে ধরলো। শান্ত্বনা দিলো কিছুক্ষন। জুলেখা তার হাতের দুটো বালা থেকে একটা মিতালীর হাতে পরিয়ে দিলেন। অরেকটা রাখলেন শেফালীর জন্য। তারপর নেমে গেলেন স্টেজ থেকে। সুপ্তি বেগম পুত্রবধূর গালে হলুদ লাগিয়ে উপহার দিয়ে নামলেন। তারপর আসলো মনিরা ও ওবাইদুর। দুইজনই হলুদ লাগালো। ওবাইদুর নেমে গেলেও নামলো না মনিরা। বান্ধুবির পাশে বসে রইলো। মিতালীর কানের কাছে মুখ এনএ ফিশফিশ করে বলল,

‘কবে থেকে চলছে এইসব?’

মিতালী বুঝতে না পেরে মনিরার দিকে একটু মাথা ঝুকে বলল, ‘কি বুঝলাম না।’

‘আমার দেবরের সাথে কবে থেকে প্রেম চলছে?’

হকচকিয়ে গেলো মিতালী। চোখ তীক্ষ্ণ করে বলে উঠলো, ‘কিসব যাতা বলছিস। সর এখান থেকে।’

মনিরা ভাব নিয়ে বলল, ‘আমি তো ভেবেছিলাম আমার বিয়েতেই বুঝি তোদের দেখা। কিন্তু না। ওবাইদুর বলেছে বহু আগে থেকেই নাকি আপনারা কাহিনী করে রাখছেন। যাক ভালো। আজ থেকে আমরা দুইজন জা হলাম। বেবি? আমার তো এটো এতো খুশি লাগতেছে।’

শেষের কথা গুলো মিতালীর হাত ধরে প্রফুল্লিত হয়ে বলল মনিরা। আলতো শব্দ করে হেসে ফেললো মিতালী। তখুনি রাকিব ডাকলো মনিরাকে, ‘ভাবি? আপনি কি একাই হলুদ লাগাবেন? আমাদের সুযোগ দিবেন না?’

মনিরার শাড়ির কুঁচি ধরে উঠে দাঁড়াল। স্টেজ থেকে নামতে নামতে বলল, ‘কি করবো বলেন? জা পেয়ে আমি বিরাট খুশি। তাই তো নামতে ইচ্ছে করছে না।’

মনিরার পর শেফালী হলুদ দিয়ে আসলো। মিতালীর এক গালে আলতোভাবে হলুদ লাগিয়ে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। এতোটাই শক্ত করে ধরেছে যেন ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে। মিতালী বুঝলো বোনের মন ভালো নেই। মিতালী শেফালীকে ছাড়িয়ে শেফালীর দুই গালে আদুরে হাত রাখলো। দেখলো শেফালী নিঃশব্দে কাঁদছে। চোখ দুটো লাল হয়ে পানিতে টলটল করছে। দূর থেকে শেফালীর কান্না দেখলো রাকিব। বুকের বাম পাশে ব্যাথা অনুভব করলো সে। মেয়েটাকে কাঁদতে এই প্রথম দেখছে। ভালো লাগছে না একদম।

মিতালী শেফালী কে বুঝাতে লাগলো। বলল, ‘এভাবে কাঁদছিস কেন? মেক’আপ নষ্ট হয়ে যাবে পাগল। কাঁদিস না। শেফালী? বুবুর কথা শুনবি না?’

শেফালী মাথা উপর নিচ দুলালো। নাক টেনে চোখের পানি মুছলো। মিষ্টি করে হাসি দিয়ে আবারো জড়িয়ে ধরলো। তারপর স্টেজ থেকে নেমে একটু দূরে একা দাঁড়াল। অতঃপর এক এক করে মিতালীর অন্যান্য কাজিনরা তাকে হলুদ লাগিয়ে দিতে লাগলো। আনন্দ করতে লাগলো সবাই।

শেফালীর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বুবু কাল চলে যাবে? আর পাশাপাশি থাকা হবে না। বাসায় আসলে বুবুর হাসি মুখখানি দেখা হবে না। ভাবতেই গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আশেপাশে তাকালো একবার। এতো এতো মানুষের ভরপুর এখানে। তাই লেহেঙ্গা হাল্কা উঠিয়ে হলুদের স্টেজ থেকে বেড়িয়ে বাহিরে আসলো। জায়গা টা নির্জন। আশেপাশে মানুষ নেই। অন্ধকার পরিবেশ। সেন্টারের ভিতরে ও বাহিরে থাকা আলোতে এই খালি নির্জন জায়গাটা আবছায়া আলোকিত হয়ে আছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে শেফালী। কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না। দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্না করছে অনবরত।

স্টেজ থেকে নামার পর থেকেই রাকিব শেফালীকে দেখছিলো। সেন্টার থেকে বেড়িয়ে যেতে দেখে সন্দেহ হলো তার। কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? পিছু নিলো। বাহিরে অন্ধকারে এসে শেফালীকে এভাবে কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। কি করবে, কি বলবে কিছুই বুঝে আসলো না তার। তবুও চুপচাপ এগিয়ে আসলো শেফালীর কাছে। পিছন থেকেই আলতো গলায় ডাকলো, ‘শেফালী?’

রাকিবের ডাক কর্ণগোচর হলে কান্না থামালো শেফালী। মুখ থেকে হাত সরিয়ে ধীরে ধীরে পিছু ফিরে তাকালো। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। গাল ও নাক দুটো একইভাবে রক্তিম। শেফালী রাকিবকে দেখে যেন আরো ভেঙ্গে পরলো। হঠাৎ-ই রাকিবকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে অঝরে কেঁদে উঠলো। শেফালীর এহেন কান্ডে প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হলো রাকিব। অসাড় হলো শরির। বুকের বা পাশটা ভাড়ি হলো শেফালীর কান্নার শব্দে। বিষণ্ণবদন চোখেমুখে শেফালীকে নিজেও জড়িয়ে ধরলো। এক হাত মাথায় রেখে শান্ত্বনা দিলো, ‘ক্ল্যাম ডাউন শেফালী। এভাবে কেউ কাঁদে?’

ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো শেফালী। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাকিবকে। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘আমি বুবুকে অনেক ভালোবাসি। বুবুকে ছাড়া কখনো থাকি নি। দুজনের রুম আলাদা হলেও মাঝ রাতে বুবুর পাশে ঘুমিয়েছি। সময়ে অসময়ে বুবুকে পাশে পেয়েছি। সব সমস্যা সমাধানে বুবু সাহায্য করেছে। আজ বুবুর গায়ের হলুদ। কাল বিয়ে। চলে যাবে বুবু। এটা আমি মানতে পারছি নাহ।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাকিব। শেফালীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘এটা স্বাভাবিক। সৃষ্টির শুরু থেকেই এমনটাই ঘটে এসেছে। একদিন বাবা-মা কে ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে যেতেই হয়। সেখানে নিজের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয়। মিতালীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। শ্বশুরবাড়ি না, ওটা হবে মিতালীর সংসার। এটা তুমি বুঝোই। তাহলে এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছ কেন? তোমাকেও তো যেতে হবে। তখন কি করবে?’

শেফালী রাকিবকে জড়িয়ে ধরেই মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বুঝালো। মুখেও বললো, ‘নাহ্। আমি বিয়েই করবো না।’

মৃদু আওয়াজে হেসে ফেললো রাকিব। শেফালীর মাথায় তার অগোচরে আলতো চুমু খেয়ে বলল, ‘দেখা যাক। এবার কান্না থামাও। নাকি কান্না করার উছিলায় আরো জড়িয়ে ধরে থাকতে চাও?’

এতোক্ষণে স্বজ্ঞানে আসলো শেফালী। নিজের অবস্থান টের পেতেই রাকিবের বাহুডোর থেকে চটজলদি ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। নিজের এমন কর্মকান্ডে লজ্জা পেলো ভীষণ। কান্নারত চোখেমুখে লাজুকলতা ভর করলো। এভাবে জড়িয়ে ধরাতে বড্ড লজ্জাবোধ করলো শেফালী। হাত ধরা অব্ধি ঠিক আছে। কিন্তু আজ? সে নিজেই জড়িয়ে ধরলো? ছিঃ! সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো অস্বস্তিতে আর থাকতে পারলো না। হলদে লেহেঙ্গা হালকা উঠিয়ে দৌড়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।

শেফালীকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো রাকিব। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে পকেটে দুই হাত রেখে দাঁড়াল। শেফালীর গায়ের ঘ্রাণ একদম পাগল করে দেবার মতো। মেয়েটা এতোক্ষণ তাকে জড়িয়ে ধরেছিল? ভাবতেই অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করলো মনে। আনমনে মুচকি হাসলো।

চলমান..

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪৩]

দৌড়ে আসায় হাঁপিয়ে উঠেছে শেফালী। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। কিছুসময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় সে হতভম্ব। ভীষণ লজ্জিত। ইশ লোকটা কি ভাবলো? এভাবে জড়িয়ে ধরা উচিত হয়নি। এমন বেহায়া কর্মকান্ডের কারণে নিজেকে নিজে শখানেক গালি দিয়ে দিলো ইচ্ছে মতো। তারপর লম্বা দম ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। ধীর পাশে ঠোঁটে হাসি টেনে স্টেজের সামনে এসে তারই সমবয়সী ফুফাতো বোন মুনিয়ার পাশে দাঁড়ালো। শেফালীকে দেখে মুনিয়া প্রশ্ন করলো, ‘কিরে? কখন থেকে তোকে খুঁজছি। কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?’

শেফালী আড় চোখে আশেপাশে তাকিয়ে ভালো ভাবে প্রখর করলো একবার। না! লোকটা কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ফুঁশ করে স্বস্তির নিশ্বাস ছুঁড়লো একটা। তারপর মুনিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলো, ‘সেফটিপিন খুলে গিয়েছিলো। সেটাই লাগাতে ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।’

ঠোঁট দুটো সরু করে গোলাকৃতি করলো মুনিয়া। কথায় টান দিয়ে রশালো গলায় বললো, ‘ওওওহ আচ্ছা! ওয়াশরুম টা বুঝি সেন্টারের বাহিরে? আর সেফটিপিন লাগানোর মানুষটা বুঝি বেয়াই সাহেব?’

চোখ দুটো বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেলো শেফালীর। অবাক চোখে তাকালো মুনিয়ার দিকে। এই মেয়ে কিভাবে জানলো? এবার পুরো দুনিয়া রটিয়ে দিবে। শেফালী কে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুনিয়া ভাব নিয়ে বলল, ‘হয়েছে হয়েছে। আমি কাউকে বলবো না। যাইহোক, দুলাভাই কিন্তু সেই বোইন। তোর সাথে মানিয়েছে।’

প্রতিত্তুর করলো না। নিশ্চুপ থেকে মুচকি হাসলো। অন্য সময় হলে এই কথাটার জন্য মুনিয়ার চুল ছি’ড়ে ফেলতো শেফালী। কিন্তু আজ কেন জানি রাগ উঠলো না। উলটো মুনিয়ার এমন কথায় ভালোলাগা কাজ করলো মনে।
.

হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় শেষপ্রান্তে। খাওয়া দাওয়া শেষে মেহমানরা এক এক করে বিদায় জানিয়ে চলে যাচ্ছে। সাথে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে সুপ্তি বেগম। মিতালীর পরিবারের সবার সাথে আলাপ করছে এই মুহূর্তে।

রাকিব ও ওবাইদুর তাদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মিতালীর কাজিন সুমন ও রায়াজের সাথে কথা বলছে। কথায় মশগুল থাকলেও চোখ দুটো তার অন্য কাউকে খুঁজচ্ছে। মেয়েটা ভারী অদ্ভুত। তখনের পর থেকে এখন অব্ধি সামনে আসে নি। তাকে দেখলেই পালায় পালায় করেছে। এই ধানিলঙ্কা এতো লজ্জা পায়? আগে জানা ছিলো না তো। হাসি পেলো তার। কিন্তু হাসলো না।

রায়াজ কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। সেই সুবাধে সবাই তার কথার সম্মান করে। একটু গম্ভীর টাইপ। কিছুটা রাগ চটা। তবে অকারণে রাগার অভ্যেস নেই। বোনদের প্রতি একটু বেশি সিরিয়াস। আদর আহ্লাদও করে সবচেয়ে বেশি। তাই সবাই রায়াজ ভাই বলতে পাগল। রাকিবের সাথে কথার মাঝে রায়াজ খেয়াল করলো তার মোবাইল বন্ধ। আশেপাশে তাকিয়ে একটু দূরে শেফালীকে দেখে ডাক দিলো, ‘ওইইই শেলী? এখানে আয়।’

মানুষটা কে দেখলো না শেফালী। কিন্তু ‘শেলী’ ডাক শুনে বুঝে গেলো কে ডাকছে। রাগ শরিরে তিরতির করে বেড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে রায়াজের সামনে আসলো। বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি ভাই? মাথায় কি কয়দিন পর পর ডাব পরে? আমার নাম শেফালী। শেলী শেলী করো কেন?’

শেফালী বিরক্তির কন্ঠ শুনে রায়াজ তার মাথায় গা’ট্টা মা’রলো একটা। তারপর মোবাইল ও গাড়ির চাবি শেফালীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোরে শেলী বলে ডাকতেই ভাল্লাগে। আমার মোবাইলে চার্জ নাই। গাড়িতে পাওয়ার ব্যাঙ্ক আছে। চার্জ দিয়ে আয়। মুনিয়া কে নিয়ে যা সাথে।’

শেফালী মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ‘পাসওয়ার্ড টা বলো একটু।’

‘থা’প্রা’বো ধরে। যা।’

মুখ কালো করে ফেললো শেফালী। আড় চোখে একবার রাকিবের দিকে তাকিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। রাকিব এক হাত পকেটে রেখে চুপচাপ দেখছিলো সব। রায়াজের সাথে কথা বলে ভালোই লেগেছিলো তার। কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না। শেফালীকে স্পর্শ করার পর রাগ হলো প্রচুর। অন্য ছেলে কেন শেফালীর মাথায় হাত দিবে? শেফালীও কিছু বলল না? ভীষণ রাগ হলো রায়াজের উপর। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চুপচাপ সাবলীল ভাবে আলাপ চালিয়ে গেলো কিছুসময়। অতঃপর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুপ্তি বেগম ও অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে চলে গেলো।

.

হলুদ শেষে এবার মেহেদি দেবার পালা। ঘড়ির কাটা বারোটা ত্রিশের ঘরে। মধ্যরাত্রি! কিন্তু ঘুম নেই কারোর চোখে। আড্ডায় ব্যস্ত সব ভাইবোন। বড়রা অন্যান্য কাজ সামলাতে ব্যস্ত। হৈহোল্লুরে পরিপূর্ণ বাড়ি। বিছানায় মিতালীকে ঘিরে বসে আছে জারা ও মুনিয়া। বাকিরা ফ্লোরে, সোফায়, বেতের মোড়ায় বসে আছে। জারা মিতালীর হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। মহা আড্ডা আনন্দে ব্যস্ত সবাই। ছেলে ও মেয়েদের মাঝে গানের কলি খেলা চলছে। যেই টিম পয়েন্টে বেশি পাবে তাদের কে ফুচকা ট্রিট দিবে অপর টিম। দীর্ঘক্ষণ খেলার পর মেয়েদের দল জিতলো। হারলো ছেলেরা। অতঃপর বউভাতের দিন মিতালীকে বাসায় নিয়ে আসা হবে। তার পরের দিন সবাইকে ফুচকা ট্রিট দিবে বলে ঠিক করলো ছেলেরা। নিজেদের আনন্দে মিতালী বাদ যাবে কেন? এমনি ভাবে হাসাহাসিতে পুরো রাত্রী কাটলো সবার। আড্ডার এক পর্যায়ে ছেলেদের দল ঘুমানোর জন্য বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। মিতালীর পাশে রইলো শুধু মেয়েরা। জারা, মুনিয়া, তাহমিনাহ ও শেফালী।

মিতালীর হাতে মেহেদি দেওয়া শেষ অনেক আগেই। মেহেদি দেওয়া শেষে জারা যেন হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলো। দুই হাতের চার পিঠে মেহেদি দিতে দিতে তার হাত দুটো অবশ হয়ে গেছে। এই কারণে অন্য মেয়েরা পার্লার থেকে মেহেদি দিয়ে এসেছে। যার কারণে জারার উপর চাপ কম পরেছে।

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো সবাই। দুইজন থাকবে বিছানায়, আর তিন জন থাকবে ফ্লোরে। যেহেতু মিতালীর বিয়ে তাই তাকে সম্মান সহিত উপরেই থাকতে দেওয়া হয়েছে। মিতালী ওয়াশরুমে গেলো হাতের মেহেদি পরিষ্কার করতে আর নিজেও ফ্রেশ হতে। অন্যরা বিছানা গুছাচ্ছে। তখুনি মোবাইল বেজে উঠলো। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো চারজন। কার ফোন এসেছে? সবাই নিজেদের মোবাইল বের করে দেখতে দেখতে কল বেজে কেটে গেলো। তাদের মোবাইলে কল আসেনি। কিছুসময় পর আবারো কল আসলো। আওয়াজ টা টেবিল থেকে আসছে। তাহমিনাহ স্টাডি টেবিলের বইয়ের নিচে মিতালীর মোবাইলটা পেলো। দেখলো অংকুরের কল। অন্যরা জানতে চাইলো কে কল দিয়েছে। তাহমিনাহ হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বললো সবাইকে। তারপর বিছানার উপর বসে কল রিসিভ করে স্পিকারে দিলো। বাকি তিনজন আগ্রহভরে এগিয়ে এসে তার পাশে বসলো।

কল রিসিভ করার পরপর অপর পাশ থেকে অংকুরের পুরুষনালীর কন্ঠ ভেসে আসলো, ‘হ্যালো?’

ঠোঁট টিপে হাসলো সবাই। কেউ প্রতিত্তুর করলো না। অংকুর কোনো প্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারো বললো, ‘মিলি? আর ইউ দেয়ার?’

তাহমিনাহ মিতালী সাজার ভান ধরে ছোট করে উত্তর দিলো, ‘হুম!’

‘কথা বলছো না কেন? সারাদিন এতো কল দিলাম রিসিভ করলে না যে?’

জারা কন্ঠটা একদম মিতালীর মতো করতে চেয়ে লাজুক হেসে বলল, ‘আসলে সারাদিন তোমার কথা ভাবছিলাম। এতোটাই বিমোহিত ছিলাম যে কল ধরতে ভুলেই গিয়েছিলাম।’ বলা শেষেই সকলে মুখে হাত রেখে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো।

আপনা আপনি কপালে ভাজ পরলো অংকুরের। কন্ঠ যতোই মিতালীর মতো করে বলার চেষ্টা করুক না কেন অংকুর বুঝবেই বুঝবে। তাছাড়া মিতালী কখনো তাকে তুমি করে বলে না। এরা কারা? নিশ্চয় মিতালীর কাজিন। মেয়েদের ফা’জ’লামো ভালোই বুঝলো অংকুর। তাই নিজেও মজা নিলো একটু, ‘ওওহ আচ্ছা। কিন্তু তোমার কন্ঠ এতো মোটা মোটা লাগছে কেন?’

জারা থমথমে খেলো এমন কথা শুনে। অন্যরা ঠোঁট চেপে হাসলো। কিন্তু শেফালী আওয়াজ করে হেসে উঠলো। তাকে শব্দ করে হাসতে দেখে তাহমিনাহ চোখ পাকালো। শেফালী হাসি শব্দ একটু কমিয়ে বললো, ‘আমার জিমিকে এতো সহজে বোকা বানানো যাবে না।’

শেফালীর কথাটা সম্পূর্ণ রুপে স্পষ্ট অংকুরের কানে আসলো। মৃদু হাসলো অংকুর। তারপর বলল, ‘কেমন আছো তোমরা সবাই?’

তাহমিনাহ উত্তর দিলো, ‘জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমাদের বোন কোথায়? ঘুমিয়ে গেছে?’

মুনিয়া দুষ্টু হেসে বললো, ‘কি ব্রো? বিয়ের আগেই বউ পাগল হলেন দেখছি। এতোদিন তো বউয়ের সাথেই কথা বললেন। এবার নাহয় আমাদের সাথেও কথা বলেন।’

‘আগে বউ ফিট করে নেই তারপর শালীদের ব্যাপারে ভাববো।’

জারা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো, ‘সব ছেলেরা তো বউয়ের সাথে শালী ফ্রি চায়। আপনি আবার এই চান্স টা মিস করছেন না তো।’

অংকুর বললো, ‘বউকে বাগে আনতে পারলে শালীরা এমনিই আমার গান গাইবে।’

অংকুরের এমন কথায় ঠোঁট যুগল গোল করে সুর তুললো সবাই ‘ওওওহো’। তাহমিনাহ চিত্তবিকার ভাবে বললো, ‘বউয়ের বোনরা যদি বউকে আটকে রাখে বিয়ে করবেন কি করে! সুতরাং বউ চাইলে আগে শালীদের বাগে নিতে হবে।’

‘তাই নাকি! তা শালীদের বাগে আনতে কি করা লাগবে এই অসহায় দুলাভাইকে? একটু ক্লিয়ার করে বলো তো শুনি!’

অংকুরের কথা শুনে চকচকিয়ে তাকালো সবাই। একে অপরের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে প্রকাণ্ড রকমের খুশি হলো। আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলো তারা। তাহমিনাহ আবারো বলল, ‘ক্লিয়ার কেনো করতে হবে? আপনি তো সব বিষয়ে ভীষণ এক্সপার্ট শুনেছি।’

অংকুর বলল, ‘না মানে, জীবনে প্রথম বিয়ে করছি তো! তাই এই ব্যপারে একটু কাঁচা আরকি।’

তাহমিনাহ বলল, ‘এই কাজে আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি! যদি বউ চান তাহলে যা আবদার করবো তাই রাখতে হবে কিন্তু।’

‘আচ্ছা সে দেখা যাবে, এখন তোমরা শালিরা মিলে আমার একটা উপকার করো তো।’

উপকারের কথা বলায় ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো তাহমিনাহ। তখন জারা বলে উঠলো, ‘উপকার? কি উপকার? আমরা আপনার কি উপকার করতে পারি? বোকা বানানোর ফন্দি ফিকির করছেন না তো?’

‘না না। ওতো ভয় পেতে হবে না। তোমরা জাস্ট কিউট করে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে একটু উচ্চস্বরে হাসো। প্লিজ।’

চারজনের মুখ আপনা আপনি কিঞ্চিৎ পরিমান ফাঁক হয়ে গেলো। হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। লজ্জা লজ্জা ভাব নিবে কেন? তাহমিনাহ বুঝলো কারণ টা। ঠোঁট টিপে হাসলো নিরবে। মুনিয়া তাহমিনার কাছ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে তাদের থেকে একটু দূরে সরালো। তারপর বাকি তিনজনের কানে ফিশফিশ করে কিছু একটা বললো। মুনিয়ার এমন কথা শুনে চারজন উচ্চহাসিতে মেতে উঠলো তাৎক্ষনাৎ। হাসি তাদের থামছে না। তখুনি ওয়াশরুমের দরজা খুলার ঠক শব্দ হলো। শব্দ করে হাসি থামিয়ে দিলো চারজন। হাসির শব্দ কমলেও হাসি থামলো না কারোর। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিরবে হাসতে লাগলো তারা। জারা হাসি ধরে রাখতে না পেরে মুখে দুই হাত দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। মুনিয়া বিছানায় শুয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পরলো। শেফালী আর তাহমিনাহ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে জায়গা থ মেরে বসে রইলো। তাদের এমন কর্মকান্ডে অবাক হলো মিতালী। টাওয়াল টা চেয়ারে মেলে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাকালো। এভাবে হাসছিলো কেন তারা? তাহমিনার হাতে নিজের মোবাইল দেখে সন্দেহ বাড়লো আরো। এগিয়ে এসে তাহমিনার কাছ থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিলো মোবাইলটা। স্কিনে অংকুরের নাম দেখে গা পিত্তি জ্বলে উঠলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাহমিনার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলো, ‘কল দিয়েছিলি নাকি রিসিভ করেছিস?’

শেফালী অবুঝের ভান ধরে বললো, ‘তাহমিনাহ আপু রিসিভ করেছে।’

তাহমিনাহ কাটমট চোখে শেফালীর দিকে তাকালো। অর্থাৎ তার নাম বলাতে কাঁচা চিবিয়ে খাবে শেফালীকে। মিতালীর দিকে তাকিয়ে ক্যাবলা মার্কা হাসি দিলো তাহমিনাহ। তারপর বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘আমার ঘুম পাইছে রে শেফু। তাড়াতাড়ি আয় ঘুমাতে।’

শেফালী ডাক পেয়ে চটজলদি বিছানা থেকে নেমে ফ্লোর বেডে গিয়ে শুয়ে পরলো। মিতালীর নজর এড়াতে লাইট বন্ধ করে ড্রিমলাইট অন করে শেফালীর পাশে শুয়ে পরলো তাহমিনাহ। মিতালী দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করে তাকালো মোবাইলের দিকে। বারান্দায় গিয়ে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল কানে ঠেকিয়ে বলল, ‘কি কথা হচ্ছিলো এতোক্ষণ?’

মিতালীর ঝাঁঝালো গলা শুনে মোবাইলের অপরপাশ থেকে অংকুর ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তারপর বলল, ‘মোবাইল নিয়ে এলে কেন? কথা তো এখনো শেষ হয়নি। খুব ভালো জমিয়ে আড্ডা হচ্ছিলো আমাদের।’

মোবাইলটা শক্ত করে ধরলো মিতালী। রাগ উঠলো শরিরে। ঝাঁঝ মেশালো গলায় বলে উঠলো, ‘মেয়েদের সাথে এতো কথা কিসের? তাও আবার হেসে হেসে। কি কথা বলছিলেন যে ওরা এভাবে হাসছিলো? বলেন।’

‘ওটা আমাদের পারসোনাল ব্যাপার। এখনো কথা শেষ হয়নি। ওরা পাশে আছে? তাহলে দাও কথা বলি।’

মিতালী শক্ত গলায় ‘অসভ্য’ বলে লাইন কেটে দিলো। রাগ উঠলো শরিরে। সবচেয়ে বেশি রাগ লাগলো তাহমিনার সাথে এতো কথা বলায়। তাহমিনাহ তার সমবয়সী। শেফালী, মুনিয়া আর জারা নাহয় একটু ছোট। তাছাড়া ওয়াশরুম থেকে এসে তাহমিনার হাতে মোবাইল দেখেছে। আবার শেফালী বললো তাহমিনার রিসিভ করেছে। যেহেতু মিতালী রিসিভ করেনি সেহেতু তাহমিনার সাথে এতো কথা কিসের? তাও এভাবে হেসে হেসে। কল কেটে দিতে পারতো না অংকুর? ক্ষুন্ন হলো মিতালীর মন। বিষন্নতায় ছেঁয়ে এলো হৃদয়। শরিরে রাগ নিয়েই রুমে এসে জারার পাশে শুয়ে পরলো।

চলমান…

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪৪+৪৫]

দুপুরের শেষভাগের সময়। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পরেছে। বাহিরের পরিবেশ গমগমে হলেও কমিনিটি সেন্টারের ভীতর টা বেশ শীতল। পুরো জায়গা মেহমানদের ভরপুর। রয়েছে খাওয়া দাওয়ার বেপক আয়োজন। কাঁচা ফুলের সৌরভে মু-মু করছে পরিবেশ। দুটো থালায় গোলাপ ফুলের পাপড়ি, তিনটে থালায় গাঁদাফুলের পাপড়ি সাজিয়ে গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েদের দল। উল্লাসিত সবাই। বরপক্ষ এসেছে খবর আসার পর থেকেই তারা দাঁড়িয়ে আছে। সকলে প্রস্তুত যার যার লাভের আশায়।
.

অংকুরদের গাড়ি গুলো কমিনিটি সেন্টারের বাহিরে এসে থামলো। প্রথম গাড়িতে অংকুর, রাকিব, ওবাইদুর ও অংকুরের অন্য দুইজন কাজিন। গাড়ি থামার পর এক এক করে সবাই নেমে পরলো। শুধু অংকুর ও ওবাইদুর অবশিষ্ট রইলো। রাকিব দরজা খুলে গাড়ির ভিতরে কিছুটা ঝুকে বলল, ‘ব্রো? আসবা নাকি কোলে তুলে নিতে হবে?’

বিরক্তিকর চোখে রাকিবের দিকে তাকালো অংকুর। কপাল কুঁচকালো নিরবে। তার পাশে ওবাইদুর বসে ছিলো। সে অংকুরের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বের করতে করতে বলল, ‘ভাই তাড়াতাড়ি বের হ। ক্ষিদা লাগছে প্রচুর। আগে খাইতে হবে।’

অংকুর গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলল, ‘যতোসব রা’ক্ষ’স আমার বং’শেই পরতে হয়েছে।’

অংকুরের বিড়বিড় করে বলা কথাটা রাকিব ও ওবাইদুরের কর্ণপাত হলো। তারা অল্প শব্দে হেসে উঠলো। অতঃপর অংকুর গাড়ি থেকে নামলো। জুলফিকার, রায়াজ ও অন্যরা এসে বরপক্ষ কে আন্তরিকতার সঙ্গে ভিতরে নিয়ে গেলো।

গেইটের কাছে আসার পর মেয়েদের দল ফুল ছিটিয়ে স্বাগতম করলো তাদের। জুলেখা ও আমেনার হাতে মিষ্টির থালা। তারা দুইজন অংকুরকে বরণ করতে লাগলেন। আমেনা শেফালীর হাতে মিষ্টির থালাটা দিয়ে কাটা চামচ দিয়ে মিষ্টি নিলেন। তারপর অংকুরের মুখে তুলে দিয়ে পানি খাইয়ে দিলেন। এভাবে জুলেখাও খাইয়ে দিতে লাগলেন। আমেনার পাশে মিষ্টির থালা হাতে নিয়ে দাঁড়ানো লাল লেহেঙ্গা পরিহিত শেফালীকে দেখে রাকিবের চোখ আটকে গেলো। খোলা কুঁকড়ানো চুল, বড়বড় কানের দুল, কপালে সুন্দর একটা টিকলি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাত ভর্তি চুড়ি ; সব মিলিয়ে মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। শেফালীর চোখেমুখে প্রশান্তিময় হাসি। খুবই আনন্দিত সে। কেউ একজন যে তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেদিনে বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই তার।

অংকুরকে বরণ করার পর আমেনা আর জুলেখা চলে গেলেন। কিন্তু বরপক্ষ আর গেইটের ভিতরে যেতে পারলো না। ঘিরে ধরেছে পাত্রীপক্ষ। নতুন করে লাগলো আরেক ভয়ংকর বিপত্তি। অর্থাৎ পাত্রীপক্ষের পকেটে কিছু চালান দিয়ে ভিতরে যেতে হবে। নাহলে বউ ছাড়া বাড়ি ফিরতে হবে। শুরু হলো তর্কাতর্কি। এক পর্যায়ে বরপক্ষ ফাইনালি বলে দিলো, ‘আমরা কিছুতেই টাকা দিবো না।’

মুনিয়া বুকে হাত গুঁজে বলে বলল, ‘তাহলে আমরাও বউ দিচ্ছি না।’

রাকিব প্রতিত্তুরে বলল, ‘বিয়েতে যখন এসেছি তখন বউ নিয়ে যাবোই।’

শেফালী রাকিবের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আমরা বউ না দিলে হাওয়ার উপরে বউ নিবেন নাকি?’

অংকুরের এক ছেলে কাজিন বললো, ‘কোন সংবিধানে লিখা আছে যে জামাই বউ নিতে আসলে টাকা দিয়ে নিতে হবে?’

জারা বললো, ‘আপনি বোধহয় আয়ীন বিভাগে পড়েন নি তাই জানেন না। আগে শালীকাদের বাগে নিয়ে তারপর বউ নিতে হবে।’

ওবাইদুর মেয়েদের দিকে একটু ঝুকে বলল, ‘ভদ্র মেয়েরা এভাবে তর্ক করে না।’

মুনিয়া কড়া চোখে তাকালো। তখন তাহমিনাহ ওবাইদুরের কথার প্রতিত্তুর মুচকি হেসে বললো, ‘এক হাতে তালি বাজে না।’

হেসে উঠলো সবাই। ওবাইদুর এমন উত্তর শুনে থমথমে খেলো। তবুও স্বাভাবিক রইলো। দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ‘সুন্দরী বেয়াইনদের কাছ থেকে এমন আশা করছি না আমরা।’

তখুনি পিছন থেকে মনিরা ওবাইদুরের বাহুতে জোড়ে চিমটি কাটলো। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো ওবাইদুর। কিন্তু আর্তনাদ করলো না। মনিরা তার কানে ফিশফিশ করে বলল, ‘সুন্দরী বেয়াইন? আজকে রুমে আসিস তুই।’

অন্ধকার নেমে এলো ওবাইদুরের মুখে। আড় চোখে অংকুরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ঠোঁট চেপে হাসছে। অংকুর দুজনের পাশাপাশি থাকায় সম্পূর্ণ কথায় শুনেছে। ওবাইদুর নিচু কন্ঠে অভিশাপের ন্যায় বলল, ‘বিয়ে করছিস তো? তারপর দেখিস মজা কেমন।’

অংকুর প্রতিত্তুরে নিরবে হাসলো শুধু। চুপচাপ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। দুই পক্ষের মাঝে তু’মুল রুপে ঝ’গ’ড়া চলছে। তাহমিনাহ এবার অংকুর কে বলে উঠলো, ‘টাকা দিবা না তাহলে বউ নিতে এসেছো কেন?’

অংকুর জড়তাহীন কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘আমার বউ আমি নিবো, টাকা কেন দিবো?’

তাহমিনাহ বললো, ‘দেখুন দুলাভাই। শালী মানে আধা ঘারওয়ালী। যদি শালীদের খুশি করেন তাহলে এতো এতো শালীদের আদরযত্ন পাবেন। নাহলে শালী তো পাবেন-ই না, সাথে বউ টাও কপালে জুটবে না।’

শেফালী কন্ঠে কিছুটা ক্ষুব্ধ করে বললো, ‘জিমি? এতো কিপটামি করছো কেন? টাকা দিয়ে দাও।’

শেফালীর কথার প্রতিত্তুরে রাকিব বলে উঠলো, ‘এতো দেখছি ডিজিটাল ফকি… মানে কিছু না।’

শেফালীর কড়া চোখের চাহনী দেখে বলতে গিয়েও বললো না রাকিব। মেয়েটাকে এতো কিউট লাগছে। আজ মেয়েটার সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তাকিয়ে থেকেই দিন পাস করা যাবে। রাকিবকে চুপ হয়ে যেতে দেখে হাসি পেলো শেফালীর। মুগ্ধকর চোখে রাকিবের দিকে তাকালো। লোকটা অনেক অদ্ভুত। কাল থেকে এখন অব্ধি নতুন নতুন অনুভূতির স্বীকার হচ্ছে শেফালী। এই অনুভূতির নামকরণ করতে পারছে না সে। হয়তো ভালোলাগা! রাকিবের চোখে চোখ পরতেই ভ্যাবাচেকা খেলো শেফালী। চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। অস্বস্তি আঁকড়ে ধরলো আবারো। শেফালীর বিব্রতভাব দেখে মৃদু হাসলো রাকিব।

তর্কাতর্কি চলতেই লাগলো। মেয়েরা যা ডিমান্ড করছে, তার থেকেও কম দিচ্ছে ছেলেরা। কিন্তু কেউ টাকা হাতে নিচ্ছে না। সময় অনেক পার হয়ে গেছে। বরপক্ষ কে তারা এখনো ছাড়ছে না দেখে রায়াজ সেখানে উপস্থিত হলো। সবার হাল-বেহাল দেখে বিরক্ত হলো কিছুটা। বরপক্ষ কে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখাটা পছন্দ হলো না তার। তাহমিনাহ কে ধমকে উঠলো, ‘হচ্ছে টা কি তাহমিনাহ? ওদের ভিতরে যেতে দিচ্ছিস না কেন?’

জড়সড় হলো সবাই। নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ। কেঁপে উঠলো সবাই। তাহমিনাহ ধমক খেয়ে মিহিয়ে গেলো। আওয়াজ নিচু করে উত্তর দিলো, ‘ওরা কম দিছে তাই।’

তাহমিনার এমন মিহিয়ে যাওয়া দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রায়াজ। এক হাতের ইশারায় শেফালীকে ডাকলো। শেফালী প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও মৌনতার সাথে রায়াজের দিকে এগিয়ে গেলো। শেফালী পাশে এসে দাঁড়াতেই রায়াজ শেফালীর কানের দিকে কিছুটা ঝুকে ফিশফিশ করে বললো, ‘বোকা, এখন এতো টাকা নিয়ে কি করবি? যতোই নিবি তার ১৪ ভাগ হবে। তাহলে তোর ভাগে পরবে কত? মাত্র এক ভাগ। লাভ হবে? তার থেকে বরং এখন কমিয়েই নিয়ে নে। পরে সবাই চলে গেলে কৌশলে তুই একা হাতিয়ে নিস। লাভ হবে। বুঝছিস?’

চোখ দুটো চড়কগাছে উঠে গেলো শেফালীর। ঠোঁটে ফুটে এলো আনন্দোৎসব হাসি। মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। নিজেও ফিশফিশ করে বললো, ‘ভাইইইই তোমার মতো হাজারটা ভাই ঘরে ঘরে হোক।’

মৃদু হাসলো রায়াজ। তারপর স্বাভাবিক হয়ে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললো, ‘এখন যতো দিচ্ছে ততো নিয়ে নে। কথা বাড়াবি না কেউ। ওদের ভিতরে আসতে দে।’

তাহমিনাহ, জারা ও মুনিয়ার মুখখানি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। মুখ অন্ধকার করে টাকা হাতে নিয়ে ওদের ভিতরে আসতে দিলো। রায়াজ ব্যস্ত হয়ে তাদের খেয়াল রাখছে। স্টেজে বসে আছে অংকুর। তার-ই পাশে অন্যরা। রাকিব স্টেজের নিচে এক পাশে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে রায়াজের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা দেখতে স্মার্ট বটে। কথাবার্তা, ব্যবহার সাবলীল। কিন্তু শেফালীর সাথে একটু বেশি ক্লোজ। যার ধরণ রায়াজকে একদম পছন্দ হচ্ছে না তার। বরঞ্চ রাগ উঠছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। রায়াজের থেকে চোখ সরিয়ে শেফালীর দিকে তাকালো। দেখলো শেফালী তার অন্য কাজিনের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বাহ্! এখন তদূরত্ব বজায় রেখেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রায়াজের সাথে এতো ক্লোজ হবার মানে কি? জেলাসি আঁকড়ে ধরলো রাকিবকে। শেফালীকে অন্য কারোর সাথে দেখে সহ্য হয় না তার।
.

একা রুমে আয়নার সামনে বসে আছে মিতালী। চোখে তার গাঢ় কাজল দেওয়া। ঘন কালো চোখের পাপড়ি তুলে তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। বধূ সাজে বসে আছে সে। আজ তার বিয়ে! অবাক করার বিষয়। সমাজে এতো এতো অপমান সহ্য করা মোটা মেয়েটার বিয়ে। উঠতে বসতে যেই মেয়েটাকে মানুষ কথা শুনাতো ; সেই মোটা মেয়েটাকে কেউ একজন ভালোবেসে বিয়ে করছে। অদ্ভুত না ব্যাপার টা? সে কি আসলেই এতো ভালোবাসা ডিজার্ভ করে? অংকুর অনেক সুদর্শন। চাইলেই মিতালীর থেকে দ্বিগুণ সুন্দর মেয়ে বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু তাকে কেন বেছে নিল? ভালোবাসা বুঝি এতোই সুন্দর? আপন মনে ভাবছে মিতালী। চোখেমুখে তার সন্তুষ্টকরণ হাসি। একটু পর লিখিত ভাবে অংকুরের স্ত্রীর মর্যাদা পাবে। সারাজীবনের জন্য পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে। বুক ফুলিয়ে প্রাপ্তির নিশ্বাস নিলো একটা।
.

মানুষ অনেক অদ্ভুত। সমাজে বসবাস করে কিছু নিম্নমানের মানুষ। যাদের অন্যের ভালো দেখলে গা জ্বলে। কারোর সুখ সহ্য করতে পারে না। ঠিক তেমনি হলো আজ। কারণ টা অন্য কিছু না। মিতালী নামের মোটা মেয়েটার জামাই দেখে। এতো সুদর্শন একটা পুরুষ বলে কথা। সবাই যার-পর-নাই অবাক। ভেবেছিলো হয়তো ষাট বছর বয়সের কোনো বুড়ুর সাথে বিয়ে হচ্ছে। কিংবা বিবাহিত কোনো ছেলে। তা নাহলে প্রতিবন্ধী তো হবেই। এমন ভাবনা নিয়েই বিয়ে খেতে এসেছিলো তারা। কিন্তু আজ্ঞত জামাইকে দেখে যেন সবাই আকাশ থেকে পরেছে। এটা কিভাবে সম্ভব? চোখ জোড়া সবার বিস্ময়ের কৌটায়। তবুও তারা তাদের কটূকথা থামায় নি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কানে কানে ফিশফিশ চলছে মহিলাদের।

‘এতো সুন্দর ছেলে এই মেয়েকে বিয়ে করছে কিভাবে?’
‘দেখো গিয়ে ছেলের কোনো দোষ আছে কিনা।’

নানান প্রকার কথাবার্তা চলছে তাদের মাঝে। নিন্দুকরা সারাজীবন সমালোচনা করবেই। তাদের কথার গুরুত্ব দিলে জীবনে সামনে এগিয়ে চলা কষ্টসাধ্য হয়ে পরবে। সবাইকে সমান ভাবে গুরুত্ব দিতে নেই। তাইতো সেদিকে কারোর বিন্দুমাত্র পাত্তা নেই। মিতালীর অতি কাছের আত্মীয়স্বজন, কাজিনরা মিলে সব কিছু সামলাতে ব্যস্ত।
.

রুমের দরজা খুলার শব্দ শুনে পিছু ফিরে তাকালো মিতালী। লাল সিল্কি শাড়ি পরিহিত ছিমছাম গড়নের উজ্জ্বল ফরসা তিথী কে দেখে স্মিতি হাসলো মিতালী। প্রতিত্তুরে তিথীও হাসলো। আশেপাশে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মিতালীর পাশে চেয়ারে বসলো। আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বললো, ‘কেমন আছো?’

আলতোভাবে মুচকি হাসি দিলো মিতালী। সাবলীল ভাবে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন ভাবি?’

‘এইতো ভালো।’

লম্বা দম নিলো মিতালী। কথা বললো না আর। হাতের সোনালি চুড়ি গুলোর দিকে তাকালো। দাদীর দেওয়া স্বর্ণের বালা টা ধরে ঘুরাতে লাগলো। তখুনি কানে হাসলো তিথী কথা গুলো।

‘তোমার বর কে দেখলাম। মাশাআল্লাহ অনেক হ্যান্ডসাম। ভেবেছিলাম বুড়া হবে কিন্তু হলো অল্পবয়সী। তবে আমি অনেক অবাক হচ্ছি একটা ব্যাপারে। সেটা হলো ছেলেটা বিয়েতে রাজি হলো কিভাবে?’

ফুঁশ করে হতাশার নিশ্বাস ছুঁড়লো মিতালী। তার ধারনা-ই ঠিক। তিথী উরফে আজিম খন্দকারের স্ত্রী। তাদের বাড়ির তৃতীয় তলার ভাড়াটে। মেয়েটি যখুনি পারে মিতালীকে কথা শুনিয়ে দেবার চেষ্টা করে। নিজে দেখতে মারাক্তক সুন্দরী বলেই অন্যকে ছোট ভাবে দেখে। রূপ নিয়ে তিথী অহংকার করে বেশি। মেয়েটিকে মিতালীর একদম ভালো লাগে না। সামনা সামনিও কিছু বলতে পারে না। বিরক্তির নিশ্বাস ফেললো একটা।

তিথী আবারো বলতে লাগলো, ‘ছেলেটা অনেক স্মার্ট। আমার মতো সুন্দর মেয়ে ডিজার্ভ করতো। কিন্তু তোমাকে? তুমি তো অনেক মোটা।’ বলে মুখ দিয়ে ‘ চাহ্’ জাতীয় উচ্চারণ করে বললো, ‘তোমাদের পাশাপাশি মানাবে না।’

প্রথমে বিরক্ত লাগলেও এবার কষ্ট লাগলো মিতালীর। চোখ ঝাপসা হলো। অংকুরের সাথে তাকে মানাবে না। কথাটি সত্ত্য। অংকুর অনেক সুদর্শন। তার সাথে সুন্দর ফিগারের মেয়ে পারফেক্ট। মিতালীর মতো মোটা মেয়ে যায় না। কিন্তু অংকুর তাকে ভালোবাসে। সে মোটা হওয়ার পরেও অংকুর তাকেই বিয়ে করছে। ভালোবাসে বলেই তো। মন খারাপ কেটে গেলো মুহূর্তেই। যেখানে অংকুর তাকে ভালোবাসে সেখানে অন্যদের কথার গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।

তিথী আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই কানে আসলো শেফালীর কন্ঠ, ‘আসলে কি বলেন তো ভাবি। যাদের নজর ত্যাড়াব্যাকা। জামাই থাকা শত্বেও অন্যের জামাইয়ের দিকে নজর দেয় তারা।’

মিতালী ও তিথী ঘার ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। শেফালীকে দরজার এক পাশে বুকে হাত গুঁজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। মিতালী বুঝলো এবার তিথী কে আচ্ছা মতো ধুলাই দিবে।

শেফালীর কাধে এক হাত রেখে আরেক হাতে কিছু চুল আঙ্গুলে প্যাচাতে প্যাচাতে জারা বললো, ‘জামাই রেখে পরপুরুষের দিকে তাকানো পরকীয়ার শামিল। হায় আল্লাহ। কি নোংরা একটা ব্যাপার।’

কথাগুলো ঠিক কাকে এবং কিসের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে সেটা বুঝতে বাকি নেই তিথীর। রাগে দাঁতে দাঁত পিষলো সে। চোয়াল শক্ত করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মুনিয়া দরজার অপর পাশে হেলান দিয়ে বললো, ‘রূপবতী মেয়েদের একটা দিয়ে হয় না। তাইতো ঘরে জামাই থাকতে অন্যের জামাই নিয়ে গবেষণা করে।’

জারা হাই তুলতে তুলতে বললো, ‘একদম বারোভাতারি।’

মিতালী হতবাক হয়ে গেলো বোনদের এমন কথা শুনে। চোখ তার বিস্মিত। তিথীর দিকে তাকিয়ে দেখলো রেগে নাক লাল করে ফেলেছে একদম। হাসি পেল তার। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হেসে উঠলো মিতালী। তার হাসি তিথীর নজর এড়ালো না। এতো অপমান সহ্য হলো না আর। গটগট পায়ে দরজার সামনে আসলো। কড়া চোখে একবার তিনজনকে দেখে চলে গেলো।

তিথী যেতেই শেফালী, জারা ও মুনিরা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে তাদের জান যায় যায় অবস্থা। একজন আরেকজনকে ধরে হাসছে। মুনিয়া হাসিতে মুখ খিঁচে বললো, ‘মেয়েটার চেহারা দেখার মতো ছিলো।’

মিতালী হতাশার নিশ্বাস ছুঁড়লো একটা। কন্ঠ কিছুটা মলিন করে বললো, ‘এভাবে না বললেও পারতি।’

জারা কথার ভঙ্গির সাথে হাত নাড়িয়ে বললো, ‘এতো ভালো মানুষিকতা দেখিয়ো না তো আপু। মুখের উপর উচিত কথা বলতে শিখো।’

শেফালী মিতালীর পাশে বসে বললো, ‘বুবুর সব কিছুই ঠিক আছে। তবে প্রতিবাদ করতে পারে না।’

মুনিয়ে মিতালীর মাথায় দোপাট্টা পরিয়ে দিলো। তারপর খুব সূক্ষ্ম ভাবে তাতে ক্লিপ লাগিয়ে দিতে লাগলো। জারা মিতালীর উদ্দেশ্যে বললো, ‘তোমার এই অতিরিক্ত ভালো ব্যবহার ধুয়ে পানি খাবে? শুনো আপু, মানুষ যেমন কটুকথা শুনাতে পারে। তেমনি তুমিও তাদের মুখের উপর জবাব দিতে পারবে। এতে দোষের কিছু নেই। একটা প্রবাদ আছে ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুইজন সমান অপরাধী। বুঝলা?’

মিতালী জারার ফোলা ফোলা গাল দুটো টেনে আহ্লাদিত কন্ঠে বললো, ‘ওকে মেরি জান। বুঝেছি।’

জারা আমোদিত হাসি দিয়ে মিতালীকে জড়িয়ে ধরলো। মিতালী হাতের ইশারায় মুনিয়া, শেফালীকে কাছে ডাকলো। উল্লাসিত হলো দুজন। ঝাঁপিয়ে এসে ধরলো মিতালীকে।

দোপাট্টা মাথায় ভালো ভাবে লাগিয়ে দেওয়ার কিছুসময় পর সেখানে আমেনা উপস্থিত হলেন। মেয়েকে বধূ সাজে দেখে বুক ভার হয়ে এলো তার। চোখে জমে এলো জলের বিন্দু কণা। আমেনা কে দেখা চার বোন সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমেনা শাড়ির আচল টেনে মেয়ের কাছে আসলেন। এক হাত মিতালীর গালে রেখে আদর করলেন।

‘মাশাআল্লাহ!’

মিতালীর মন খারাপ হয়ে গেলো। কান্না পেলো ভীষণ। মাকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন আমেনা। শেফালীও ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর প্রয়াস করতে লাগলো। জারা এক হাত শেফালীর কাধে রেখে ইশারায় শান্ত্বনা দিলো। রুমে উপস্থিত সকলের চোখে পানি। মুনিয়া কাঁদছে, জারা কাঁদছে, কাঁদছে শেফালী। আমেনা নিজেকে শান্ত করে মেয়েকে সরালেন। মিতালীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, ‘সারাজীবন সুখে থেকো।’

কান্নায় খিচঁকি উঠছে মিতালীর। মায়ের চোখ সরিয়ে দরজায় তাকালে বাবাকে দেখতে পেলো। জুলফিকার নিরবে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সব। কষ্ট হচ্ছে তার। মেয়েটা আজ চলে যাবে। ফাঁকা হয়ে যাবে বাড়ি। মেয়েকে ছাড়া বড্ড একা একা লাগবে নিজেকে।

মিতালী এক হাতে বাবাকে কাছে ডাকলো। জুলফিকার ধীর পায়ে এগিয়ে আসলে মিতালীও তার দিকে এগিয়ে গেলো। অতঃপর জুলফিকার কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মিতালী। জুলফিকার পরম আদরে মেয়েকে ধরলেন। এক হাত মাথায় রেখে হাত বুলালেন। জুলফিকার কাঁদছে না। তবে চোখ জোড়া লাল হয়ে এসেছে তার। তার লাল চোখ দেখে শেফালীও কেঁদে ফেললো। এগিয়ে এসে মিতালীকে সহ জুলফিকার কে জড়িয়ে ধরলো। কিছুসময় পর জারা, মুনিয়া দুইজনও এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাদের। জুলফিকার নিজের দুই বাহুতে চার মেয়েকে আগলে রাখলেন।

তাহমিনাহ এসেছিলো মিতালীর খোঁজ নিতে। রুমে এসে এমন করুণ দৃশ্যপট দেখে বাকশূন্য হয়ে গেলো। সবাইকে একইসাথে জড়িয়ে ধরতে দেখে খুশিতে চোখ লাল হলো তার। লেহেঙ্গা হালকা উঠিয়ে নিজেও এসে জড়িয়ে ধরলো তাদের।

এমন একটা সুন্দর মুহূর্ত ফ্রেমে বন্দি করে নিলো রায়াজ। বেশ কয়েকটা শাটারের শব্দে দরজায় তাকালো সবাই। রায়াজ কে ছবি তুলতে দেখে হেসে উঠলো সবাই।

চলামান….