অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-২৬+২৭

0
884

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২৬

ব্যস্ততায় আমরা হাঁপিয়ে উঠি। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বিষিয়ে উঠে আমাদের শরীর-মন। সেই সময় সম্পর্কগুলোও বড্ড নড়বড়ে হয়ে উঠে। অপর মানুষটির ব্যস্ততা আমরা মেনে নিতে পাড়লেও ব্যস্ততার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সহজে গ্রহণ করতে পারি না। দিনশেষে ব্যস্ততার বেড়াজালে পড়ে প্রিয়জনের সামান্য খেয়ালের অভাবকে নিজের অজান্তেই তিলতিল করে তাল বানিয়ে ফেলি। অভিমান-রাগ পুষিয়ে তারউপর অভিযোগের এক পাহাড় তৈরি করি৷ যেটা ঠিক না হলেও গুটিকয়েক ব্যতিত সবাই আমরা ঠিক এই কাজটাই করি।
কিন্তু প্রিয়জনকে যে শুধু ভালোবাসলেই হয় না। তাকে বুঝতেও হয়। তার সময় না দেওয়ার কারণটা নিয়ে কথা শুনানো উচিত নয়। বরং তার সাথে থেকে হোক বা দূরে থেকে, তাকে নিজের জায়গায় সময় দেওয়া উচিত। তার পরিস্থিতিটা বুঝা উচিত। এই যেমন আজ সপ্তাহেরও উর্ধ্বে সাদিদ-নীলার দেখাসাক্ষাৎ নেই৷ প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও খুবই কম৷ ক্লান্ত সাদিদ রাতে ফিরে আর এনার্জি খোঁজে পায় না৷ তাই রাত জেগে আর কথাও হয় না। কিন্তু তারপরও যেন এই মানুষটার প্রতি নীলা বিন্দু পরিমাণ অভিযোগ জমাতে পারেনি। বলতে পারেনি এত কিসের ব্যস্ততা আপনার?
নীলার কেবল এই উশকুখুশকো ছেলেটাকে দেখে বুকের বামপাশে তীক্ষ্ণ একটা কষ্ট হচ্ছে। কি ধকলটাই না যাচ্ছে এই ছেলেটার উপর দিয়ে। ভালোবাসার ব্যাথা ব্যতিত দরজায় দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে নীলার আর কোনো অভিযোগমূলক অনুভূতি হচ্ছে না। নীলা সিক্ত চোখে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল কাঙ্ক্ষিত সেই মুখের দিকে। সাদিদ নীলার গালে নিজের হাতের স্পর্শ দিলো। আদরমাখা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ কেমন আছ পাখি? ‘

ইশশ কি মধুর ডাক। দূরত্বে নাকি সম্পর্কের গভীরতা কমে যায়। কিন্তু নীলার ক্ষেত্রে বোধহয় উল্টো হচ্ছে। এই খানিকের দূরত্ব যেন নীলাকে সাদিদের প্রতি আরও দুর্বল করে দিয়েছে। আরও যেন নিজের ভালোবাসায় সাদিদ তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে। নীলা নিষ্পলক সাদিদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

— ‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি? ‘
— ‘ এতদিন ভালো ছিলাম না। কিন্তু এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ‘

বলেই সাদিদ নিজেও নিঃশব্দে মৃদু হাসল। তারপর নীলার গাল থেকে হাত নামিয়ে শার্টের হাতাগুলো ঠিক করতে লাগল। সে অফিস থেকে সোজা বেড়িয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতে পর্যন্ত পারেনি। অতঃপর চুলে হাত বুলিয়ে সে বলল,

— ‘ আঙ্কেল বাসায় আছে? ‘
— ‘ এই যা এতক্ষণ আপনাকে আমি বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখলাম! প্লিজ ভিতরে আসুন। ‘
— ‘ অস্থির হবার কিছু নেই। আমি-ই তো। ‘

নীলা শুনল না। সাদিদকে ভিতরে নিয়ে এসে তারপর শান্তি হলো। সাদিদ সোফায় বসতেই বলল,

— ‘ আব্বু বাসায় আছে। আমি ডেকে আনছি। ‘

নীলা কয়েককদম এগিয়ে থেমে গেল। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখা মিলল ক্লান্ত সাদিদকে। সে ইতিমধ্যে চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা হেলিয়ে দিয়েছে। নীলা এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। নরম আঙ্গুলগুলো দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই সাদিদ দ্রুত চোখ খোলে তাকালো। সে কিছু বলবে তার আগেই নীলা বলে উঠল,

— ‘ আপনার জন্য লেমন জুস নিয়ে আসি? ‘
— ‘ তুমি নিজে বানাবে? ‘

নীলা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁবোধক উত্তর দিলো। সাদিদ ক্লান্তিময় হেসে বলল,

— ‘ আচ্ছা নিয়ে আস তাহলে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ‘

নীলা সাদিদের চুলগুলো হালকা এলেমেলো করে দিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে আসলো। ব্লেন্ডারে ৪টা পুদিনাপাতা, দুই চা চামচ লেবুর রস, দুই চা চামচ চিনি আর অল্প বিটলবন মিশিয়ে ব্লেন্ড করে ছেকে নিলো।
তারপর গ্লাসে ৩টা বরফ কিউব দিয়ে দিলো। শেষে ব্লেন্ডারে তৈরি করা রসের মিশ্রণটি দিয়ে তারউপর ঠান্ডা পানি দিয়ে গ্লাস পূর্ণ করল। ট্রেতে নিয়ে সাদিদের জন্য বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

— ‘ নিন আপনার জন্য মিন্ট লেমোনেড। ‘

নীলার কথার ভঙ্গিমা দেখে সাদিদ নিঃশব্দে হাসল। গ্লাস হাতে নিয়ে সে একচুমুকে সবটা শেষ করল। ঠোঁট টিস্যুতে মুছিয়ে নিতে নিতে বলল,

— ‘ পাখি তোমার হাতটা দাওতো। একটা চুমু খাই। ‘

নীলা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। তাকে আর আরিফ রহমানকে ডাকতে যেতে হয়নি। তিনি নিজেই এশার নামাজ পরে চলে এসেছেন। শরীরটা তেমন ভালো লাগছিল না উনার। তাই নামাজটা বাসাতেই পরে নিয়েছেন। তার পিছু পিছু নার্গিস খাতুনও আসলেন। সাদিদকে সোফায় বসা দেখেই তিনি আনন্দিত কন্ঠে বললেন,

— ‘ কতদিন পর দেখলাম। কেমন আছো বাবা? ‘
— ‘ জ্বি আন্টি ভালো আছি৷ আপনি কেমন আছেন? ‘
— ‘ আমিও ভালো-ই আছি। ছেলেটা কখন এসেছে আর তুই আমাদের কিছু বলিসনি কেন? ‘
— ‘ আন্টি অস্থির হবেন না। আমি মাত্র-ই আসলাম। ‘
— ‘ তুমি এই মেয়ের সাফাই গাইতে এসো না। একে আমার ঠিক চেনা আছে। নিশ্চয়ই তোমাকে খালি মুখে বসিয়ে রেখেছে? ‘

নার্গিস খাতুন আর কারো কথা শুনে সময় নষ্ট করতে চাইল না। মেয়ে জামাইয়ের জন্য দ্রুত খাবার তৈরি করতে কিচেনের দিকে ছুটলেন। নীলা সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আরিফ রহমান এসেও সাদিদের সাথে কথা জমিয়ে দিলো। সবার খোঁজ-খবর নিতে লাগল।

— ‘ বাবা, তুমি আসাতে কিন্তু আমরা ভিষণ খুশি হয়েছি। ‘

সাদিদ ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলল,

— ‘ আঙ্কেল আমি কিন্তু মূলত আপনার আর আন্টির কাছেই এসেছিলাম। ‘
— ‘ বাপরে বউ ছেড়ে এখন শশুর-শাশুড়ির দরকার পড়ল? ‘

আরিফ রহমান কথাটা বলে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলেন। মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে এমনটা তিনি মোটেও বলতে চাননি। কিন্তু হঠাৎই ভুলটা হয়ে গেল। নীলাতো বাবার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে রয়েছে। কি বললেন উনি?
পরিস্থিতি সামলাতে তিনি গলা পরিষ্কার করে সোজা-সাপ্টা বললেন,

— হ্যাঁ বলো কি দরকারে এসেছিলে? ‘
— ‘ আঙ্কেল আমার ফ্রেন্ড অর্ণব মুখার্জিকে তো আপনি ইতিমধ্যে চিনেন। ওর বিয়ে সামনের সোমবারে। কিন্তু পাত্রী ডেসটিনেশন ওয়েডিং চায়। তাই বিয়ের সমস্ত কার্যক্রম সিলেটের শ্রীমঙ্গলে করা হবে। এমতাবস্থায় তারা নীলাঞ্জনাকেও বিয়েতে চাচ্ছে। এখন যদি আপনারা পারমিশন দিতেন…

সাদিদের কথাটুকুর সারমর্ম বুঝতে আরিফ মাহমুদের অসুবিধা হলো না। তিনি মৃদু হেসে বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললেন,

— ‘ বেশ তো, নিয়ে যাও। সবাই না জানলেও আমাদের কাছে তো তোমাদের সম্পর্কের নামটা স্পষ্টত। তাই নীলাঞ্জনার উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার এখন তোমার এবং তোমাদের পরিবারের-ই। তোমরা ওকে এখনও আমাদের সাথে থাকতে দিচ্ছ এটাই আমাদের জন্য অনেক। ‘

নীলা বাবার সম্মতিতে খুশি হলেও তার চোখ মুহূর্তেই ভরে উঠল। বিয়ে হলেই কি মেয়েরা এতটা পর হয়ে যায়? ছোট্ট থেকে বড় করে তোলা সেই মা-বাবার অধিকার কি সন্তানের উপর থেকে এতটা কমে যায়?
সাদিদ একপলক নীলার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তারপর এগিয়ে গিয়ে আরিফ রহমানের হাতটা মুঠোয় নিয়ে সাবলীল কন্ঠে বলল,

— ‘ ভুল আঙ্কেল। নিজেদের জায়গা সম্পর্কে কখনও এমনটা চিন্তা করবেন না। নীলাঞ্জনা এখন আমার ওয়াইফ। সত্য যে তার উপর আমার অধিকার অনেক। কিন্তু তাই বলে যে আপনাদের অধিকার সেখানে কমে যাবে এমনটা নয়। একজনের জন্য আরেকজনের অধিকার কেন কমবে? অধিকারতো আর ব্যস্তানুপাতিক নয়। আপনার মেয়ের উপর আগেও যেমন আপনাদের অধিকার ছিল এখনও আছে আর ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবে। সেটা সে এখানে থাকুক বা আমার সাথে। কিন্তু অধিকার কিন্তু আপনার কাছেই থাকবে। ‘

আরিফ রহমানের ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে শক্ত করে বুকে আগলে ধরতে। সে এতটা ভালো কেন? এমন চিন্তা-ভাবনার জন্য বৃহৎ মন সে কোথায় থেকে পেয়েছে? নিজের মেয়ের জন্য আল্লাহ নিঃসন্দেহে রাজকপাল মিলিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই তিনি খুশিতে পুলকিত হলেন। আর নিজের ইচ্ছেটাকেও প্রাধান্য দিলেন।
সাদিদকে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে তার পিঠ চাপড়ে বললেন,

— ‘ বিয়াইসাব আর বিয়াইন নিশ্চয়ই কোনো মহৎ পূর্ণ করেছে। যার জন্য সৃষ্টিকর্তা তোমাকে তাদের জন্য উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছেন। খুব সুখি হও বাবা। আল্লাহ তোমাদের দুইজনকে খুব হাসি-খুশিতে রাখুক। ‘

.

ভালো কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে সাদিদ যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। নার্গিস খাতুন তাকে ডিনার না করিয়ে ছাড়লেন না। অবশেষে ডিনার এবং নীলাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার পারমিশন সাথে নিয়ে সাদিদ বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলো। নীলার ইতস্ততবোধ দেখে নার্গিস খাতুন নিঃশব্দে হাসলেন। কিন্তু কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললেন,

— ‘ ছেলেটাকে এগিয়ে পর্যন্ত দিতে গেলি না! এমনটাই কি তোকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে? ‘

নীলা মায়ের দিকে তাকালো। তার ইচ্ছে করছে খুশিতে মাকে এখন ঝাপটে ধরতে। কিন্তু লজ্জা আর সাদিদ চলে যাবে সেই শঙ্কায় দ্রুত সে নিচে ছুটল।
সাদিদ গাড়ির দরজা লাগিয়ে কার স্টার্ট দিতেই সাইড আয়নায় নীলাকে দেখতে পেল। সে মৃদু হাসল৷ তারপর গাড়ির দরজা খোলে বাহিরে এসে নীলার দিকে দুইহাত প্রসারিত করল।
নীলাও দ্রুত এসে নিজের শান্তির জায়গাটাতে নিজের মাথা এলিয়ে দিলো। সাদিদ তাকে নিজের উষ্ণ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মাথায় দীর্ঘ চুমু খেল। অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

— ‘ ভালোবাসি পাখি। নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসি। ‘
— ‘ আমিও ভালোবাসি। ভীষণ রকমভাবে ভালোবাসি। ‘

__________________

বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে শান্ত অনবরত বাদামের খোসা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি এদিক-ওদিক। এক্সাইটমেন্টের চকরে সে ট্রেনের রেগুলার টাইমের একঘণ্টা আগেই এসে হাজির হয়েছে। এখন বারবার গেইটের দিকে নজর দিয়ে দেখছে তারা এসেছি না-কি না?
নীলাকে ইতিমধ্যে কল দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তারা সবেমাত্র মিরপুর থেকে রউনা হয়েছে। সাদিদ নিজে-ই নীলাকে পিক করেছে।
শান্তর এমন চঞ্চল দৃষ্টির মধ্যেই সে তারপাশে কারো উপস্থিতি বুঝতে পাড়ল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই এটিটিউড নিয়ে দাঁড়ানো তানবীরকে চোখে পড়ল। সাদা রঙের ট্রি-শার্টের উপরে কালো রঙের জ্যাকেট। সাথে জিন্স এবং ব্ল্যাক লোফার। শান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আড় চোখে তানবীরকে উপর থেকে নিচ পরখ করল। দেখতে মাশাল্লাহ ভালো-ই। শান্তর দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটল তানবীরের খোঁচাযুক্ত কথায়,

— ‘ দেখতে হলে ভালোভাবে দেখ। এরকম আড়-টাড় চোখে দেখার মানে কি? ‘

শান্ত থতমত খেয়ে গেল। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

— ‘ নিজেকে কোন ছবির হিরো মনে করেন? আমি মোটেই আপনাকে দেখছিলাম না। ‘
— ‘ তারমানে বলতে চাইছ তোমার চোখে সমস্যা আছে? আই মিন তুমি ট্যারা? ‘
— ‘ একদম বাজে বকবেন না। ‘
— ‘ তুমি বাজে কাজ করতে পারো আর আমি বললেই দোষ? ‘
— ‘ আপনি… আপনি একটা অসহ্য। ‘

শান্ত চোখ-মুখ শক্ত করে তানবীরের থেকে কয়েককদম পিছিয়ে আসলো। একা থেকে এতক্ষণ বোর হচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই রকম সহযাত্রীর থেকে একা থাকা বেশ ভালো। শান্তর এমন বিরক্তিপূর্ণ মনোভাব দেখে তানবীর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। কিন্তু তার হাসিটা দীর্ঘায়িত হতে পাড়ল না। মুহূর্তেই তার চোখ-মুখ লালচে বর্ণে পরিণত হলো। সাথে শক্ত হলো হাতের মুঠি। সে রাগ মিশ্রিত চোখে শান্তর দিকে এগিয়ে গেল। বিনাবাক্য তার গায়ের জ্যাকেটটা শান্তর শরীরের উপর দিয়ে দিলো। তারপর রাগী চোখে শান্তর থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ছেলেগুলোর দিকে তাকালো। সম্ভব হলে সবগুলোকে সে এখনই কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।
সে বারকয়েক লম্বা শ্বাস টেনে শান্তর বামহাতটা নিজের ডানহাতে নিয়ে নিলো। শক্ত করে চেপে ধরে সামনে হাঁটা দিলো।
শান্ত বেচারি আকষ্মিক এমন কান্ডে পুরোপুরি থতমত খেয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই সে দ্রুত বলল,

— ‘ কি হচ্ছে টা-কি? এমন করার কি অর্থ? ছাড়ুন আমার হাত, ব্যাথা পাচ্ছি আমি। ‘

তানবীর ছাড়ল না। এমনকি সামান্য টু শব্দটা অব্দি করল না। শুধু লাল চোখগুলো নিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। ব্যস এতেই কাজ হলো। শান্ত আর কথা বাড়িয়ে ধমক খাওয়ার চিন্তা বাদ দিলো।
বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন জমজমাট পূর্ণ এলাকা। আর এখন যেহেতু ট্রেনের সময় তাই লোকসমাগম আরও বেশি। তানবীর এদিক-ওদিক তাকিয়ে খালি জায়গা খোঁজতে লাগল। কিন্তু না, তেমন কোনো কিছু চোখে পড়ছে না। সে শান্তর হাত ধরেই ফ্রুটঅভার ব্রিজ দিয়ে দুই নাম্বার প্লাটফর্মে গেল। এদিকটা বেশ নীরব। পরিবেশের সাথে শান্তও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তানবীর তাকে লোকচক্ষুর থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়ে থামল।
এতক্ষণ পর এমন একটা কথা শান্তর উপর রীতিমতো বাজ পড়ার মতো করে পড়ল। সে গোল গোল চোখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তানবীরের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। তানবীর এবার পিঠ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। তারপর নিচুস্বরে আবারও বলল,

— ‘ ইনারওয়ার ঠিক করো। সম্ভব হলে আমার জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে রাখ। পরনের জামাটা বেশ পাতলা। ‘

শান্ত এতক্ষণ অবাক হলেও এবার সে লজ্জায় নতজানু হলো। তানবীরের থেকে এমন একটা কথা সে স্বপ্নেও আশা করেনি। এখন লজ্জায় প্রায় মাটির ভিতরে চলে যাবার অবস্থা।
সে তানবীরের থেকে আরও কয়েককদম পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করল। এখনতো তানবীরের চোখের দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগবে। তাই সে মাথা নিচু করে রাখল৷ তানবীর অতটাও অবুঝ নয়। তাই শান্তর ইতস্ততবোধটা সহজেই ধরতে পাড়ল। সে আর এই প্রসঙ্গে কথা বলল না। কিছুক্ষণ আগের সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দিয়ে বলল,

— ‘ কফি খাবে? সাদিরা বোধহয় এখনও এসে পৌঁছাতে পারেনি। এলে আমাদের ফোন দিবে। ‘

শান্ত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁবোধক সম্মতি জানালো। তানবীর শান্তকে প্লাটফর্মের চেয়ারে বসিয়ে রেখে তাদের জন্য কফি আনতে গেল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তাদের জন্য ওয়ানটাইম গ্লাসে ফিল্টার কফি নিয়ে হাজির হলো। শান্তর দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে সেও শান্তর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তার পাশে বসল। তানবীরের জ্যাকেকটা অবশ্যই শান্তর সাইজের চেয়ে বড়। তাই সে খানিকটা টানাটানিতে রয়েছে। শান্তকে এমন করতে দেখে তানবীর বলে উঠল,

— ‘ ভালোভাবে পরে নাও। তাহলে এমন লাগবে না। ‘
— ‘ আপনি পরবেন না? ‘

তানবীর উত্তর দিলো না। সামনে তাকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিলো। শান্ত কফি খেতে খেতে এবার জ্যাকেটটাও পরে নিলো। এবার শান্তর শান্তি লাগছে। তার চেহারায় হাসি হাসি ভাব ফোটে উঠল। তানবীর আড়চোখে সবটাই খেয়াল করেছে। তার চোখে-মুখে মুগ্ধতারা এসে ভিড় জমাতেই সে নিজের উপর-ই বিরক্ত হলো। বারবার সে নিজের অজান্তেই এই মেয়েটার নিকট চলে আসে। আর সে তার মায়াজাল তানবীরের শক্ত খোলস ভাঙতে উঠে পড়ে লাগে। তানবীর বিরক্ত। নিজের উপর-ই সে এখন চরম বিরক্ত।
ফোনের ভায়োব্রেশনের আওয়াজে তানবীর বিরক্তিভরা চাহনি নিয়েই পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিলো। অপরদিকে শান্তর ফোনেও কল এসেছে। তারা দুইজন-ই একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। আর একসঙ্গেই বলে উঠল,

— ‘ তারা চলে এসেছে। ‘

.

অর্ণব-প্রিয়তীর সপরিবারসহ তাদের বন্ধু বান্ধবদের জন্য ট্রেনের পুরো একটা বগি রিজার্ভ করা হয়েছে। এটাও কনের-ই ইচ্ছার বদলে। সে ট্রেনের জার্নি করে শ্রীমঙ্গল অব্দি হইহট্টগোল করে যেতে চায়। পরিবারের কেউই এতে অমত পোষণ করেনি। অর্ণব তার কান্ডে ঠোঁট টিপে হাসছে। এই মেয়ের যে দুইদিন পর বিয়ে এটা কে বলবে? প্রিয়তী অর্ণবকে হাসতে দেখলেই লজ্জা পেয়ে তাকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে। আর অর্ণবের তাতে হাসির পরিমাণ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
অবশেষে কিছুটা লেইট করেই ঢাকা-সিলেট অভিমুখী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে হাজির হলো। তারা সবাই একএক করে তাদের বগিতে উঠল।
সাদিদ নীলাকে জানালার পাশে বসিয়ে নিজেও তার পাশেই বসল। নীলার দৃষ্টি অর্ণব আর প্রিয়তীর ফ্যামিলির বিবাহিত মেয়েমানুষদের উপরে। সাদিদ প্রথম থেকেই তাকে খেয়াল করেছে। এবার কিছুটা উৎসাহের জোরে প্রশ্ন করে বসল,

— ‘ পাখি তখন থেকে একদৃষ্টিতে কি দেখছ? কিছু লাগবে তোমার? ‘
— ‘ না, না কিছু লাগবে না। ‘
— ‘ তাহলে কি দেখ? ‘
— ‘ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়মগুলো দেখছিলাম। দেখেন সব বিবাহিত আপুরা শাঁখাসিঁদুর পরে রয়েছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনারা বিবাহিত। ‘
— ‘ হ্যাঁ এটাতো তাদের ক্ষেত্রে কমন বিষয়। ‘
— ‘ হ্যাঁ সেটা ঠিক। কিন্তু আমাদের ইসলাম ধর্মের মেয়েদেরকে এমনভাবে চিহ্নিত করা যায় না। এই যে দেখুন আমিও বিবাহিত। কিন্তু আমাকে দেখে কি এমনটা বুঝার উপায় আছে? ‘

সাদিদ এতক্ষণে নীলার উৎসুক দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পাড়ল। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে সে বাঁকা হাসল। আশেপাশে মানুষজনের অভাব নেই। সাদিদ একপলক ব্যস্ত জনগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে নীলার প্রায় শরীর ঘেঁষে বসল। নীলা তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কি করতে চাইছে এই ছেলে?
সাদিদ নীলার জামার উপর দিয়ে নিজের একটাহাত হালকা করে চেপে ধরল। তারপর নীলার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ এখানে কেউ আসলে বুঝতে সুবিধা হবে। কি বলো, আসার ব্যবস্থা করব? ‘

নীলার পুরো মুখ লালাভ আভায় ছেয়ে গেল। কি বলল এই দুষ্টু ছেলেটা? নীলা সাদিদকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরাল। তারপর দ্রুত জানালার বাহিরে মুখ দিয়ে নিজের অতিরিক্ত লজ্জা লুকাতে চাইল। সেটা সম্ভব না হলেও সাদিদের ধমক খাওয়া মিস হলো না।

— ‘ এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? মাথা ভিতরে আনো। এখনি হকারদের জিনিসপত্রের সাথে লেগে মাথায় ব্যাথা লাগত। ‘

নীলা নিঃশব্দে মাথা ভিতরে এনে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে পড়ে রইল। আসলে এখন সাদিদের মুখোমুখি হওয়া তার জন্য ভীষণ লজ্জাকর। কিন্তু কথায় আছে না? যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়৷ সাদিদের থেকে এত লুকাচুরি খেলেও অবশেষে তার হাতেই ধরা দিতে হলো।
রাগী সাদিদ রকেটের গতিতে আবারও দুষ্টু সাদিদে পরিণত হলো।
সে নীলার পিছন দিক দিয়ে একটাহাত নিয়ে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। নীলা টের পেয়েও চোখ খোলল না। সাদিদের চোখে তাকালেই সে এখন লজ্জায় আহত হবে।
সাদিদ বোধহয় সবটাই বুঝতে পাড়ল। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসল। তারপর নীলার মুখের উপর চলে আসা ছোট চুলগুলোকে যত্নের সাথে নিজের বামহাতে কানের পিছনে গোঁজে দিলো। সাদিদের তপ্ত নিঃশ্বাসের স্পর্শ মুখে লাগতেই নীলা এবার কাঁপা চোখজোড়া ধীরে ধীরে খোলল। সাদিদ তাকে চোখ খোলতে দেখে মৃদু হাসল। তারপর নীলার চোখের দিকে তাকিয়ে-ই আদরমাখা কন্ঠে বলল,

— ‘ তুমি চাওনা এখানে কেউ আসুক?
আমিতো চাই। আমাদের ভালোবাসার রাজ্যে আরেকটা মিষ্টি রাজকন্যার আগমন হোক সেটা আমি খুব করে চাই। ‘

নীলা আর পাড়ল না। লজ্জা পেয়ে অবশেষে নিজের লজ্জার উৎপত্তিস্থলকেই লজ্জা নিবারণের জন্য বরাদ্দ করল। সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে সে কাঁপা কন্ঠে বলল,

— ‘ নির্লজ্জ একটা। ‘

সাদিদ আবারও হাসল। নীলার লজ্জারাঙা মুখটা তার বরাবরই ভীষণ পছন্দের। যখন লজ্জায় লালাভ বর্ণে তার মুখ ছেয়ে যায় তখন সাদিদের জাস্ট চোখ ধাঁধিয়ে আসে। একি সাথে নিজেকে প্রাণপাখির মুগ্ধতার চাদরে আবরণযুক্ত পায়, আর অপরদিকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এক কঠিন যুদ্ধে নামতে হয়। প্রকৃতপ্রেমিক বা প্রকৃত স্বামীরা-ই হয়তো বুঝতে সক্ষম এই যুদ্ধে বিজয় লাভ করা কতটা ভয়াবহ। কতটা কঠিনসাধ্য।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২৭

প্রিয়তী এবং অর্ণবকে বিয়ের জন্য হলুদ-চন্দন এবং দুধ দিয়ে গোসল করানো হচ্ছে। নীলাসহ দুইপরিবারের সবাই মোটামোটি এখানে উপস্থিত। এক এক করে কনে এবং বরকে হলুদ মাখাচ্ছে সবাই। মৌলভীবাজার জেলার গিয়াসনগরে দুসাই রিসোর্ট এন্ড স্পা অবস্থিত। নীলারা শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত ট্রেনে এসে বাকি রাস্তাটা রিসোর্টের কার বুক করে চলে এসেছে। কেননা অর্ণব আর প্রিয়তীর ওয়েডিং প্রিপারেশন এখানেই করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথের দুরত্বে এই রিসোর্টের অবস্থান। সুদৃশ্য লেক এবং পাহাড়ের ওপর সবুজ বনানী পরিবেষ্টিত এই রিসোর্টটি অবকাশ যাপনের জন্য একটি আদর্শ স্থান।
প্রিয়তীর ভীষণ পছন্দের জায়গাতে এই সিলেট অবস্থিত। সিলেটের প্রকৃতিক সৌন্দর্য বরাবরই তাকে খুব টানে। তাই নিজের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটা সে এখানেই কাটাবে বলে মনোবাসনা করেছে। নরমালি বিয়েতে কনেরা একটু লাজুক, একটু চুপচাপ থাকে। কিন্তু প্রিয়তীর ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই উল্টো হচ্ছে। সবার থেকে হাসিখুশি সে নিজেই। কনের এমন চঞ্চলতা দেখে সবাই মুখটিপে হাসছে। প্রিয়তীর মা-বাবাও হাসছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মেয়েটাকে দূরে চলে যেতে হবে ভাবলেই অশ্রুসিক্ত চোখগুলো মুছিয়ে নিচ্ছে।
সবার এমন হাসি-আনন্দের মধ্যে নীলাকে বেশ অস্থির দেখা যাচ্ছে।
নীলা আশেপাশে তাকিয়ে বারবার তাকেই খোঁজে চলেছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কোনো হদিস নেই।
একটু দূরে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকা তানবীরকে দেখা যাচ্ছে। নীলা ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিলো। এই ছেলের আবার কি হয়েছে? মুখটা এমন বাংলার পাঁচ কেন?
কিন্তু আপাতত এসবদিকে সে তাকাতে চাচ্ছে না। তাই সোজা গিয়ে তানবীরের সামনে দাঁড়াল। কোনো বণিতা ছাড়া বলে উঠল,

— ‘ ভাইয়া উনাকে দেখেছেন? অনেকক্ষণ যাবত দেখছি না। ‘

তানবীর কপাল কুঁচকে নিলো। তার বিরক্তিমাখা মনে আবারও যেন শব্দটার প্রতিধ্বনিত হলো। সে কিছুটা বিরক্তিভরা চেহারা নিয়েই বলল,

— ‘ উনাকে মানে কাকে? ‘
— ‘ আরে আপনার বন্ধুর কথা বলছি। দেখেছেন উনাকে? ‘

তানবীরের বিরক্তি যেন এবার আকাশ ছুঁয়েছে। মেয়েমানুষ কত কিছুই না করতে পারে। এই যেমন সামান্য একটা সম্বোধন নিয়েও তাদের যেন অতিরঞ্জিতা। এককথায় অপরজনকে কনফিউশান করতে তারা এক্সপার্ট। সে আড়চোখে ডানদিকে তাকিয়ে আবারও কপাল কুঁচকে নিলো। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই বলল,

— ‘ ঘণ্টাখানেক আগে রুমে দেখেছিলাম। এরপর আর নজরে পড়েনি। ‘

বলেই সে নীলার থেকে দুরত্ব আরও বাড়িয়ে আনলো। নীলা একপলক সেদিকে তাকিয়ে সাদিদ যেই রুমে উঠেছে সেই রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
তামবীর এতক্ষণ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালেও এখন একবারে শান্তর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। তানবীরের হঠাৎ এমন আগমনে রিয়াদ নিজের হাতটা শান্তর কাঁধ থেকে নামিয়ে আনলো। যেটা হাস্যরত শান্ত বেচারি এতক্ষণ খেয়াল-ই করেনি। কিন্তু তানবীর তীক্ষ্ণ চোখে সবটা খেয়াল করেছে। আর বলাবাহুল্য লুচির মতো ফোলেছে।

— ‘ এত হাসাহাসির কি হয়েছে? মনে তো হচ্ছে হাসতে হাসতে এখন-ই অক্কা পাবার অবস্থা। ‘
— ‘ আর বলবেন না। রিয়াদ ভাইয়া কি যে হাসির কৌতুক জানে। আপনি শুনলে আপনারও হাসি পাবে। ‘

শান্ত হাসতে হাসতেই কথাটা বলল। রাগীস্বরের তানবীরের ঠোঁটের কোণেও এক চিলতে হাসির রেখা দৃশ্যমান হলো। শান্তর রিয়াদের জন্য ভাইয়া ডাকটাই মূলত তার এই খুশির কারণ। কিন্তু রিয়াদ বেচারা তাদের মতো খুশি হতে পাড়ল না। সে দুঃখভরা কন্ঠে বলল,

— ‘ শান্ত তুই আমাকে ভাইয়া বললি কেন? আমরা না সেইম ইয়ার, তারউপর একি এলাকার? ‘
— ‘ কিন্তু বয়সে তো আমার থেকে বড়। ‘
— ‘ ক্লাস তো সেইম। ‘
— ‘ আচ্ছা যা আর বলব না। এবার খুশি? ‘

বলেই শান্ত হাসল। আর তার সাথে তাল মিলিয়ে এবার রিয়াদও মৃদু হাসছে। কিন্তু স্থানান্তর রূপে তানবীরের হাসিটা যেন রিয়াদের কাছে চলে গেল। নতুবা তার মুখ আবারও এমন গম্ভীর কেন?
সে আর একমুহূর্ত এখানে দাঁড়াল না। হাতের মুঠি শক্ত করে সামনে হাঁটা ধরল। শান্ত একপলক সেদিকে তাকালেও মাথা খুব একটা ঘামাল না। তানবীরকে সে বুঝতে পারে না। এই নরম তো এই গরম। অদ্ভুত লোক!

তানবীর তাদের থেকে বেশ অনেকটা দূরে এসে বেঞ্চে বসল। কিন্তু দৃষ্টি তার এখনও সেই দক্ষিণ দিকের মেয়ে-ছেলের উপর।
সে আবারও একটা রাগ মিশ্রিত বিরক্তির শ্বাস ফেলল।
বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠার পর থেকেই তানবীরের এই বিরক্তি শুরু হয়েছে। শান্ত আগে গিয়েই মধ্যম সারির জানালার পাশের সিটে বসেছিল। তানবীরও তারপাশের সিটটা দখল করতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পথিমধ্যেই তাকে থেমে যেতে হয়েছিল। কেননা ততক্ষণে তার-ই সিটটা অপরজন বেশ হাসিমুখে দখল করে নিয়েছে।
শান্তর পাশে কেউ বসাতে সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছিল। মুহূর্তেই তার মুখটা অবাকের চূড়ান্ত পযার্য়ে এসে ঠেকেছিল। গোল গোল চোখজোড়া নিয়ে সে প্রায় চেঁচিয়ে ডেকে উঠেছিল,

— ‘ রিয়াদ! ‘

ব্যস তারপর থেকেই দুইজনের এই কথোপকথন শুরু। পুরোটা রাস্তা তারা একেবারে বিরামহীনভাবে কথার সাগরে ডুবে ছিল। তানবীরও রাগমিশ্রিত চেহারা নিয়ে শান্তর বরাবর পিছনের সিটে বসেছিল। সেই অজুহাতে আড়িপেতে সে সবটা শুনে নিয়েছে।
এই বিরক্তির চিহ্নিত প্রধান আসামি রিয়াদ হলো শান্তর ক্লাসমেইট। ক্লাস এইট পর্যন্ত নাকি তারা একসাথেই পড়াশোনা করেছে। এবং ভাগ্য নতুবা তানবীরের জন্য দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের গ্রামের বাড়ি একি জায়গায় অবস্থিত। তাই দুইজনের মধ্যে ভাবও অনেক। এতো বছর পরে আবারও প্রিয়তীর বিয়ে উপলক্ষে তাদের দেখা হয়েছে। কেননা পড়াশোনার এক পর্যায়ে রিয়াদের বাবার চাকরির ট্রার্ন্সফার হয়ে যায়। এবং তারা সপরিবারে রংপুর চলে যায়।
কিন্তু আজ রিয়াদের সপরিবার এখানে হাজির হয়েছে। প্রিয়তীর বাবা পঙ্কজ সেনের খুব ভালো বন্ধু হচ্ছেন রিয়াদের বাবা। সেই কারণেই তারা এখানে উপস্থিত।
একজন ওয়েটার কোল্ড ড্রিংক্স সার্ভ করছিল। তানবীরকে দেখে সে তার দিকে এগিয়ে আসলো।

— স্যার ড্রিংক্স দিব? ‘
— ‘ সম্ভব হলে বরফ দাও। মাথা প্রচন্ড গরম। সামান্য ড্রিংক্সে কাজ হবে না। ‘

ওয়েটার ছেলেটা থতমত খেল। অবিশ্বাস্য চক্ষুজোড়া নিয়ে চমকিত কন্ঠেই বলল,

— ‘ স্যার সত্যিই বরফ দিব? ‘

তানবীর এবার রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকালো। অর্থটা এমন যে আর একটা কথা বলে মাথা খেলে তোকেই কাঁচা খেয়ে ফেলব। ছেলেটা দ্রুত নিজের জান বাঁচিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল।
তানবীর আবারও বিরক্তিভরা চাহনি নিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। এই মেয়েটার হাসি তার বরাবরই ভীষণ পছন্দের। কিন্তু এই মুহূর্তে কেন যেন সেটা তানবীরের কাছে বিষাক্ত পদার্থের ন্যায় মনে হচ্ছে। বড্ড বিদঘুটে!

_____________________

নীলা বেশ কিছুক্ষণ যাবত সাদিদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পায়চারী করছে। কিন্তু ভিতরে যেতে দ্বিধা কাজ করছে। কেননা তাদের বিয়ের বিষয়টা সবার মতো এখানেরও কেউ জানে না। তাই দুইজনে আলাদা রুমেই উঠেছে। সাদিদ-তানবীরের জন্য এই রুম বরাদ্দ। তাই নীলার এতো দ্বিধাদ্বন্দ্ব। যদিও তানবীরকে নীলা এইমাত্র বাহিরে দেখে এসেছে। তবুও কেউ যদি তাকে এমনকরে সাদিদের রুমে যেতে দেখে তাহলে হয়তো মন্দ ভাবতে পারে। কিন্তু এতভেবেও সে নিজেকে স্থির করতে পাড়ল না। অবশেষে মনের কাছে হার মেনে দরজায় নক করল।
কিন্তু না ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না৷ নীলা খানিকবাদে আবারও নক করল। কিন্তু এবারও ভিতর শব্দহীন।
সাদিদ-ই তো। সম্পর্কে নীলা তার বউ হয়। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে নীলা দরজার লকে হাত দিলো। ভিতর থেকে লক করা নেই। তাই লক ঘুরাতেই দরজাটা খোলে গেল।
কিন্তু ভিতরের দৃশ্য দেখে নীলার চোখ প্রায় কপালে। সে কয়েক মুহূর্ত বড়বড় চোখ করে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। পরমুহূর্তেই পেট চেপে শব্দ করে খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। সাদিদের মুগ্ধ হবার কথা থাকলেও আপাতত সে পাড়ছে না। নীলার দিকে সে চোখ গরম করে তাকালো। নীলা তার তাকানো দেখে মুখ চেপে ধরেছে। কিন্তু হাসি তার কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। সে বিছানায় বসে সাদিদের দিকে তাকিয়ে অনবরত হেসেই যাচ্ছে।
কেননা সাদিদ বেচারা কাজের চক্করে থ্রি কোয়ার্টারের উপর পুরোপুরি কোট-টাই পরে মিটিং এটেন্ড করছে। বেচারার ব্যস্ততা দেখে নীলা খানিকটা দুঃখবোধ করল।
এই কাজের জন্যই সাদিদ নীলাকে ঠিকমতো সময় দিতে পাড়ছে না। আর না পাড়ছে বন্ধুর বিয়েটা ঠিকঠাক এনজয় করতে। অপরদিকে তাদের বিয়েটাও পিছিয়ে গেল কেবলমাত্র এই কাজ নামক ব্যস্ততার জন্যই।
হাসিবুর রহমানকে এমারজেন্সিতে এভরোড যেতে হয়েছে। সেখানে মিনিমাম মাস খানেক তার থাকতে হবে। অফিস সামলানোর জন্য শাহেদ-সাদিদকের উপর পুরোপুরি দায়িত্ব পড়েছে। এতদিন নিজের ল্যাব সামলিয়ে সাথে অফিসে সময় দিয়ে সাদিদের হাতে বাড়তি কোনো সময়-ই থাকত না। তাই নীলার থেকে এই দুরত্ব।
এখন হাসিবুর রহমান ফিরে আসা অব্দি এভাবেই চলবে৷ বয়স হলেও অফিসের পুরো দিকটা এখনও তিনি-ই দেখে চলেছেন৷ ছেলেদেরকে এত দ্রুত অফিসের বেড়াজালে ফেলে ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ থেকে তিনি বঞ্চিত করতে চান না৷ তাই ধীরেসুস্থে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু তার হঠাৎ এমন অনুপস্থিতিতে শাহেদ-সাদিদকে বড্ড বেগ পেতে হচ্ছে। শাহেদ-নিধি এইজন্যই অর্ণবের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেনি। কেননা সাদিদকে এখানে অবশ্যই আসতেই হবে। সেখানে শাহেদও যদি চলে আসে অফিস কে দেখবে?
ঢাকাতে অর্ণব-প্রিয়তীর রিসিপশনের আয়োজন করা হবে। তাই শাহেদ কথা দিয়েছে তখন তারা উপস্থিত থাকবে। শেষ পর্যায়ে অর্ণবও পরিস্থিতি বুঝে মেনে নিয়েছে।
সাদিদ এখন সেই কাজেই ব্যস্ত। মিটিংয়ে তো আর এমন ক্যাজুয়াল লোকে এটেন্ড করা যায় না। তাই বাহির দিয়ে সব ঠিকঠাক দেখিয়ে তার এমন অদ্ভুত লুক।
নীলাও সেটা বুঝতে পাড়ছে। কিন্তু হাসি আসলে তার কি দোষ?
সাদিদ নীলার এমন হাসিতে বড্ড বিরক্ত। সে বারবার চোখগরম করে ইশারায় তাকে শাসিয়ে যাচ্ছে। ক্লাইন্ট ভিডিও কলে আছে বিধায় মুখে কিছু বলাও যাচ্ছে না। আর এই পরিস্থিতিটার-ই চূড়ান্ত ফায়দা নীলা উঠিয়ে নিচ্ছে।

— ‘ মিস্টার হেনরি, দ্যান ইমেইল মি রেস্ট অফ দ্য ডিটেইলস। আই উইল চেক এন্ড ইনফর্ম দ্য ফাইনাল ডিসিশন। ‘
— _____________ ‘
— ‘ গুড বাই। সিউ ইউ সুন। ‘

সাদিদ ক্লাইন্টের সাথে মিটিং শেষ করে লেপটপটা বন্ধ করল। নীলাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়ে সে সোফা থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা লক করল। সাদিদকে দরজা লক করতে দেখে নীলার এবার হাসি থেমে থেমে আসছে।
সাদিদ পরনের কোটটা খোলে সোফায় ছুঁড়ে ফেলল। গলার টাইটা লুজ করে শার্টের হাতাটা গুটিয়ে নিতে নিতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— খুব হাসি পাচ্ছিল? তাই না, খুব হাসি? ‘

নীলা ভয়ার্ত চোখে দ্রুত ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। কিন্তু সাদিদ থামল না। কটমট চাহনি নিয়ে নীলার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই সে এবার বিছানা ছেড়ে দৌড়ে অপর পাশে গেল। সাদিদও কি হার মানবার পাত্র নাকি?
পাখিকে কিভাবে খাঁচায় বন্দি করতে হয় সেটা তার খুব ভালো করেই জানা আছে।

— ‘ আরে তুমি এমন দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছ কেন? আমরা কি এখানে দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করছি নাকি? ‘
— ‘ এতসব বুঝি না। আপনার ভাব-ভঙ্গি আমার কাছে ঠিক ঠেকছে না। দূরে থাকুন আমার থেকে৷ ‘
— ‘ ওহ্ তাই? এতক্ষণে তোমার মাথা কাজ করতে শুরু করেছে? বাট সরি বেবি ইট’স টু লেইট। ‘

বলেই সাদিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে শয়তানি হাসি দিলো। তার এই বাঁকা হাসিতে নীলার বুকে মুচড় দেবার অবস্থা। ভয়ে তার হাত-পা ইতিমধ্যে কাঁপাকাপি শুরু করেছে। সাদিদ এবার একপা একপা করে নীলার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। নীলা ভয়ে পিছিয়ে আসছে। আর মনে মনে বলতে লাগল কোন কুলক্ষণে যে সেই এই রাক্ষসের রুমে আসতে গেল। এবং অন্যায়জনকভাবে হেসেও ফেলল।
সাদিদ এবার পায়ের গতি বাড়িয়ে পুরো বিছানার চারপাশে নীলাকে দৌড়ানি দিচ্ছে। নীলাও শেষপর্যন্ত বাঁচার তীব্র লড়াই করছে।
কিন্তু অবশেষে তাকে হার মানতে হলো। সাদিদ চোখের পলকে পিছিয়ে গিয়ে নীলার কোমড় জড়িয়ে তাকে উপরে তোলে নিলো। সে ক্রমাগত ছুটবার জন্য দাপাদাপি শুরু করেছে।
সাদিদ তার এসব পাত্তা না দিয়ে সোজা এনে তাকো বিছানায় ফেলল৷ তারপর নিজের ভরটুকু নীলার উপর দিতেই সে মৃদু আওয়াজ করল,

— ‘ আহ্। ‘
— ‘ এতটুকুতেই কাহিল? ‘
— ‘ এতটুকু! হাতির মতন শরীর নিয়ে পিঁপড়ার উপর উঠেছেন। তারউপর আবার বলছেন এতটুকু? ‘
— ‘ কি আমি হাতি? তোমার সাহস দিনদিন আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ‘

কথাটা বলেই সাদিদ নীলার হাতদুটো নিজের হাত দিয়ে বিছানায় শক্ত করে চেপে ধরল। হালকা ব্যাথায় নীলা আবারও ব্যাথাজনক শব্দ করল। তবুও হার মানল না। তেজ দেখিয়ে বলল,

— ‘ সত্যি কথা-ই বলেছি। ‘
— ‘ওহ্ তাই বুঝি? তাহলে সত্যবাদী নীলাঞ্জনা, এবার সত্যি সত্যি শাস্তিটুকুও ভোগ করেন। ‘
— ‘ মানে! কিসের শাস্তি? ‘
— ‘ যুগ পাল্টেছে। এতদিন পিঁপড়া হাতিকে কামড় দিয়ে আসলেও আজ হাতি পিঁপড়াকে কামড় দিবে। ‘
— ‘ মা..নে? ‘
— ‘ মানে হচ্ছে এই যে…

সাদিদ বাক্যটুকু শেষ না করেই নিজের মুখটা একেবারে নীলার মুখের কাছে এগিয়ে আনলো। নীলার চোখ-মুখ অনবরত কাঁপছে। সাদিদ নীলার গালে আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করতেই নীলা চোখ খিঁচে বন্ধ করল। সাদিদ সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। পরমুহূর্তেই করে ফেলল ভয়ংকর এক কাজ। নীলা ধরফরিয়ে চোখ খোলে চমকিত দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। গালটা রীতিমতো জ্বলছে তার। সে চোখ-মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠল,

— ‘ অসভ্য একটা। ‘
— ‘ এখনও শিক্ষা হয়নি? তোমাকে তো আজ সোজা করে তবেই আমি দম নিব। ‘

সাদিদ এবার নীলার অপরগালেও ভালোবাসার কামড় বসালো। কিন্তু তাকে শায়েস্তা করার জন্য অন্য সময়ের তুলনায় অনেকটা জোরে কামড় দিলো। নীলা ব্যাথা পেলেও এবার আর মুখে প্রকাশ করল না। তীক্ষ্ণ স্বরে আবারও সাদিদদের দিকে অপবাদের তীর ছুড়ল।

— ‘ অসভ্য। ‘

সাদিদ এবার নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসছে। জামাই যেমন জেদি বউও জেদি। কিন্তু বলে না স্বামীদের পাঁজরের হাড় দিয়ে স্ত্রীগণ তৈরি। সেহেতু স্বামী অবশ্যই একদাপ এগিয়ে থাকবে। এবং এইটাই স্বাভাবিক। তাই সাদিদের কাছেও যে নীলাকে হার মানতেই হবে। সাদিদ তাকে হার মানতে বাধ্য করবে।
সে এবার নীলার ডানগালে হাত দিতেই নীলা নড়েচড়ে উঠল। উঠে গিয়ে বাধা দিতে চাইল। কিন্তু সাদিদের সঙ্গে পাড়লে তো?
সাদিদ তাকে বিছানার সাথে আরও শক্ত করে চেপে ধরল। অতঃপর নীলার গালে হাতে রেখে নিজেদের উষ্ঠদ্বয় এক করল। সামান্য একটু ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে পরমুহূর্তেই ভালোবাসার-ই বিষ ঢাললো। নরম ঠোঁটে সাদিদের শক্ত কামড়ে নীলার আত্মা বেড়িয়ে আসার অবস্থা। কিন্তু তারপরও জেদ যে চেপেছে। তাই হার মানতে নারাজ।
সাদিদ উল্টো হাতে ঠোঁট মুছিয়ে নিতে নিতে বলল,

— ‘ এখনও বলবে? ‘
— ‘ অসভ্য, চরম অসভ্য। ‘

নীলা সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানিয়ে দিলো। সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। সাদিদ দুষ্টু হেসে নীলার গলায় মুখ গোঁজল। সেখানেও কামড় বসাল। কিন্তু নীলার জেদ কমাতে পারেনি। নিজের অপবাদ সে কোনোভাবেই ফিরিয়ে নিবে না।
সাদিদও উঠেপড়ে লেগেছে। সেও দেখবে তার প্রাণপাখি কতক্ষণ নিজের জেদে বহাল থাকে।
সাদিদ নীলার জামার হাতাটা টেনে কাঁধ থেকে কিছুটা নিচে নামিয়ে আনলো। কাঁধের এমন বাহুর নরম অংশেও ধারালো দাঁতের কামড় বসাল।
নীলার কন্ঠ এবার ধীরে ধীরে লেগে আসছে। সে দ্রুত শ্বাস ফেলে আটকে যাওয়া গলায় আবারও বলল,

— ‘ অ…সভ্য। ‘
— ‘ এখনও এতো জেদ? আ’ম ইমপ্রেসড বউ। সাদিদ ইবনে শাহরিয়ারের ওয়াইফকে এমন এটিটিউডেই মানায়। অন্য ক্ষেত্রে হলে বাহবা দিতাম। কিন্তু বিষয়টা আমি রিলেটেড তাই এখন বাহবা নয়, অনলি পানিশমেন্ট হবে। আমার ভালোবাসার পানিশমেন্টে তুমি হার মানতে বাধ্য সুইটহার্ট। ‘

কথাটা বলেই সাদিদ উপর থেকে নিচ নীলাকে একবার পরখ করল। বিয়ের আমেজে সবাই শাড়ি পরলেও নীলা হলুদ আর সবুজের মিশ্রণের একটা চুড়িদার পরেছে। শাড়ি-টাড়ি সে খুব একটা সামলাতে পারে না। তাই এই বিকল্প ব্যবস্থা।
সাদিদ নীলার বন্ধ আখিঁ পল্লবের দিকে তাকিয়ে আচমকা তাকে নিজের বুকের উপর উঠিয়ে নিলো।
এমন আকষ্মিক কান্ডে নীলা দ্রুত চোখ খোলে তাকালো। নিজেকে সাদিদের উপর দেখতেই প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তার বিরক্তিকর স্বামীর দিকে তাকালো। নীলাকে পুরোপুরি জ্বালিয়ে মারছে এই ছেলে। নীলার কুঁচকানো ভ্রুজোড়া দেখে সাদিদ ডেবিল হাসি দিলো। অতঃপর নীলার চুড়িদারের পিঠের ফিতাটা একটানে খোলে দিলো। নীলা এবার বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকাতেই সাদিদের স্বাভাবিক মুখভঙ্গি চোখে পড়ল। সাদিদের ভাবসাব কিছুটা এমন যে এখনও কিছুই হয়নি। হার না মানলে সামনে তার জন্য আরও বিপদ অপেক্ষা করছে।
নীলা নিজের শেষ চেষ্টাটুকু করল। কিন্তু সাদিদ তাকে ছাড়ল না। নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল। নীলার পরিহিত জামাটা কাঁধ থেকে কিছুটা নিচে নামিয়ে সাদিদ-ই বলে উঠল,

— ‘ এখনও অসভ্য বলবে? ‘

নীলার কন্ঠ মিইয়ে গেল। এই ছেলের সাথে পেরে উঠা তার সাধ্যের বাহিরে৷ নীরবতায় সম্মতির লক্ষণ প্রকাশ করে। নীলার ক্ষেত্রেও আপাতত সেইটাই বিবেচনা করা হচ্ছে। সাদিদ তাকে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল,

— ‘ মনে থাকে যেন৷ এইবার মাফ করলাম। কিন্তু নেক্সট টাইম কখনও এমন দেখলে পুরোপুরি শেষ করে দিব। মাইন্ড ইট। ‘

সাদিদ বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। নীলার চোখের দিকে তাকাতেই খানিকটা অশ্রুর সমাগম দেখল। সাথে নীলার অভিমানী চেহারাটাও পরিলক্ষিত হলো।
সে গালে হাত দিতেই নীলা সেটা ঝটকা মেরে ফেলে দিলো। আবারও হাত দিলে আবারও এমন করল। তৃতীয়বারের মতো সাদিদ আর তাকে সেই সুযোগটা দিলো না। নিজের তৈরি করা ব্যাথাযুক্ত সব জায়গাতে ঠেসে চুমু খেল। অতঃপর অধরকোণে আদর দিয়ে সাদিদ তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বয়ছে তার। নীলাও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত হাঁপিয়ে যাচ্ছে। সাদিদ লম্বা কয়েকটা শ্বাস টেনে বলল,

— ‘ এমন রাগী লঙ্কাদেবী কবে হলে? এমনিতেই কি কম জ্বালাও, যে এখন আবার নতুন করে শুরু করেছ? ‘
— ‘ রাবণের রাজ্যে বসবাস করছি তো তাই সঙ্গ দোষে হয়ে যাচ্ছি। ‘
— ‘ তবে রে পাঁজি মেয়ে…

নীলাকে এবার আর পায় কে? সাদিদের বুক থেকে উঠে এক দৌড়ে সে দরজায়। বাহিরে গিয়েও সে আবার ভিতরে মুখ এনে দ্রুত গতিতে বলল,

— ‘ অসভ্যের উপরের যদি কিছু থাকে তবে সেটা আপনি। ইউ সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার, ইউ। ‘
— ‘ ফাজিল মেয়ে দাঁড়া…

সাদিদ বিছানা ছেড়ে নীলাকে ধরতে গেলেই সে হাওয়া। নীলা সমানে দৌড়াচ্ছে আর সাদিদকে মুখ দিয়ে ভেংচি কাটছে। প্রাণপাখির দুষ্টুমিভরা চেহারা দেখে সাদিদ এবার হেসে ফেলল।

— ‘ দুষ্টু পাখি। ‘

__________________

রাতের শেষ পহরে বিয়ের লগ্ন পড়েছে। তাই এখন অর্ণব-প্রিয়তীর উপোসভোগ চলছে। তারা বিবাহ সম্পূর্ণ হওয়া অব্দি অন্ন গ্রহণ করতে পারবে না। তাই হবু দম্পতি এখনই শেষ আহার করবে। দুইপরিবারের মেয়েগুলো শঙ্খ বাজাচ্ছে আর মুখ দিয়ে ক্রমাগত ওলু দিচ্ছে। অর্ণব প্রিয়তীর হাস্যউজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সবার সামনেই নিজের প্লেটের থেকে মুরগীর পিসটা পোলাওয়ের সাথে মেখে তার দিকে ধরল। সমবয়সীরা জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে। প্রিয়তী সবার সামনে এমন কান্ডে লজ্জা পেল। কিন্তু মুখ এগিয়ে খাবারের লোকমাটা নিজের মুখে নিলো। অর্ণব তার ঠোঁটের আশেপাশে হালকা ছড়িয়ে যাওয়া ভাতের কণাগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে। সেটা দেখে আবারও একবার হাসির ঝিলিক পড়ল।
নীলা-শান্ত সেদিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসছে। অল্প কয়েকদিন হলেও প্রিয়তীর সাথে তাদের বন্ডিংটা বেশ জোরালো। শান্ত-ই প্রথমে বলল,

— ‘ একে অপরকে খুব ভালোবাসে। তাই না? ‘
— ‘ হুম সেটা আর বলতে। ‘
— ‘ আমি কি কম বাসি শালিকা? নিজের বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করে দেখ, ভালোবাসায় কমতি আছে নাকি নেই? ‘

সাদিদ নীলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে উঠল। নীলাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আবারও নিজের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করল,

— ‘ কি শালিকা, জিজ্ঞেস করো নিজের বান্ধবীকে৷ কিগো বউ, আদর-সোহাগে কমতি আছে? ‘

নীলা নিজের নির্লজ্জ বরটাকে পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো। শান্ত পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। তাদের এই অবস্থার মধ্যেই রিয়াদ এসে শান্তর পাশে দাঁড়াল।

— ‘ তুই এমন মাথামোটা কেন? জিজু এখন নীলকে নিয়ে ব্যস্ত। আর তুই কি-না কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হয়ে বসেছিস? ‘
— ‘ মাইর খাবি না রিয়াদ। দুইদিনে জিজু জিজু শুরু করেছিস? ‘
— ‘ তোকে দেখে বিরক্ত। তাই এখন জিজুকে দেখার পালা। তাই না জিজু? ‘

সাদিদ মৃদু হাসল। রিয়াদ শান্তকে একপ্রকার টানতে টানতে নিজের সাথে নিয়ে গেল। নীলা-সাদিদ বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখেছিল। যতক্ষণ না পর্যন্ত তানবীরকে রাগী দৃষ্টিতে তাদের পিছনে যেতে দেখে। নীলা-সাদিদ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

.

রিয়াদ শান্তকে নিয়ে সোজা রিসোর্টের খালি জায়গায় এসে দাঁড়াল। অর্ণব-প্রিয়তীর বিয়ের কার্যক্রমের জন্য এখানে ছাঁদনাতলা সাজানো হচ্ছে। দুইজন-ই বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে নিজেদের ধর্মের বাহিরে আলাদা এই সাজসজ্জা দেখছে। আচমকা শান্তর চোখে কিছু পড়তেই সে চোখ কচলাতে লাগল। পাশ থেকে রিয়াদের অস্থির কন্ঠ,

— ‘ এই ঠিক আছিস তুই? চোখে কি হয়েছে? ‘
— ‘ কি জানি একটা পড়েছে। বড্ড জ্বালা করছে। ‘

রিয়াদ আর দেরী করল না। শান্তর হাতটা সরিয়ে দিয়ে তার চোখ পরখ করতে লাগল।
তানবীর মাত্রই সেখানে এসেছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সে শান্তকে খোঁজার চেষ্টায় রয়েছে। তৎক্ষনাৎ সামান্য একটু দূরে চোখ যেতেই রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এসেছে তার। রক্তলাল চোখে সে সামনের দিকে তেড়ে গেল।

— ‘ কিরে এখন ঠিক আছিস? ‘
— ‘ হ্যাঁ এখন ঠিক আছে। পোকাটুকা কিছু পড়েছিল হয়তো। ‘
— ‘ আচ্ছা ভিতরে গিয়ে চোখে পানি দে। দেখবি ভালো লাগবে। ‘

শান্ত বেঞ্চ ছেড়ে কেবল উঠে দাঁড়াতেই নিচ্ছিল। কিন্তু সেই সুযোগটুকু আর পাওয়া গেল না। তানবীর তার বাহুতে শক্ত করে চেপে ধরে তাকে দাঁড় করাল। এত জোরে ধরেছে যে শান্তর মাংস প্রায় হাড়ের সাথে লেগে যাবার অবস্থা। সে বিরক্তিমাখা কন্ঠে কিছু বলবে তাই আগেই তার দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটল।
তানবীর কষিয়ে তার গালে নিজের হাতের পাঁচ আঙ্গুল বসিয়েছে।

— ‘ নির্লজ্জ মেয়ে! তোকে আমি আলাদা মনে করতাম। কিন্তু তুইও এক৷ সব তোরা একই গোয়ালের গরু। নির্লজ্জ তুই, নির্লজ্জ তোদের এই নারীসমাজ। ‘

তানবীরের এমন অপমানসূচক বাক্য শান্তর শরীরে বিষাক্ত সুচের মতো ফুটছে৷ চোখজোড়া তার গালের ব্যাথা ভুলে এখন কষ্টে জর্জরিত। তার অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে তানবীর আরও ক্ষেপে গেল। ক্রমশ রাগীস্বরে চেঁচিয়ে বলল,

— ‘ একদম মায়া কান্না কাঁদবি না৷ তোরা এই রূপ আর কান্না দিয়েই ছেলেদের বশ করিস। এই মেয়ে, এই লজ্জা করে না তোদের? একটা পুরুষে হয় না তােদের? নিজের তৃপ্তি মেটানোর জন্য কয়টা পুরুষকে তোদের প্রয়োজন? বল, কয়টাকে পেলে তোদের পুষাবে? ‘

অপমান-ঘৃণায় শান্তর এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সে আকষ্মিক এমন কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। কন্ঠস্বরও হয়েছে বাকরুদ্ধ। রিয়াদ অবাক দৃষ্টিতে এতোক্ষণ সবটা দেখলেও এবার সে রাগীস্বরে বলল,

— ‘ আপনার সাহস কি করে হয় আমার ফ্রেন্ডকে এসব বলার? কে দিয়েছে আপনাকে এতো অধিকার? ‘
— ‘ অধিকার! তাহলে তুই কোন অধিকারে ওর ঠোঁটযুগলে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিস? বল কোন অধিকারে? ‘

তাকে আর উত্তর বলার সুযোগ দেওয়া হলো না। তানবীর বাক্যটুকু সমাপ্ত করেই নিজের রাগের ঝাঁঝ তার উপর প্রয়োগ করতে লাগল। সাদিদ এবার আর সবটা দাঁড়িয়ে দেখতে পাড়ল না। দৌড়ে এসে তানবীরকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরল। নতুবা এই ছেলে নির্ঘাত এখন রিয়াদকে মেরে ফেলবে।

— ‘ সাদি ছাড় আমাকে। এই কুত্তাটাকে আমি মেরেই ফেলব। তারপর দেখব মরে গিয়ে কিভাবে মেয়েদের ঠোঁটের স্বাদ নিতে পারে। ‘
— ‘ দোস্ত চুপ কর। পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? ‘
— ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। পুরোপুরি পাগল হয়ে গিয়েছি। তুই কি ঠিক থাকতি? যদি নিজ ব্যতিত অন্য কাউকে নীলার ওষ্ঠযুগলে আবদ্ধ দেখতি? ‘
— ‘ তানবীর…

সাদিদের হাতটা কাঁপছে। কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান তৈরি করতে না পাড়লে এখন সেটা তানবীরের গালে অবস্থান করত। সাদিদের লাল চোখজোড়া আর কাঁপা হাত দেখে তানবীর মলিন হাসল।

— ‘ পাড়বি না। আর সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু দেখ, আমি পাড়ছি। একবার নয় একাধিক বার এমন ঘটনার সম্মুখীন আমি হয়েছি। দেখ আজকেও আবার হলাম। আই হেইট দোস গার্লস। আই হেইট দেম। ‘

শেষোক্ত কথাটা তানবীর ঘৃণাভরা চাহনি নিয়ে শান্তর দিকে তাকিয়েই বলল। তারপর গটগট পায়ে জায়গা থেকে প্রস্থান করল। শান্ত নীলার বুকে মুখ লুকিয়ে হেঁচকি তুলে কান্না করছে৷ জীবনে এত অপমানিত সে কখনও হয়নি। সাদিদ নিচে থেকে রিয়াদকে তুলল। বেচারার অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নয়। সাদিদ অপরাধী কন্ঠে বলল,

— ‘ আ’ম এক্সটেমলি সরি রিয়াদ। তানবীরটা না..
— ‘ হি ইজ ক্রেজি। সার্চ এ মেন্টাল পার্সন। ‘

সাদিদ হাতের মুঠি শক্ত করে নিজের রাগ সংবরণ করল। বিয়ের মতো জমজমাট একটা পরিবেশকে এই ঘটনায় বিষিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই নীলাকে ইশারায় শান্তকে ভিতরে নিয়ে যেতে বলল।
আর তাকে এখন অন্যকাউকে সামলাতে হবে। যেমনটা বিগত দিনগুলোতে সামলিয়ে এসেছে। আজও আবার ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে এই পাগল রূপের ভাইটাকে সামলাতে হবে।

#চলবে…