অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৩৬+৩৭

0
781

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩৬

গুলশানের এক কনভেনশন সেন্টারে ঝাঁক ঝমক পূর্ণ পরিবেশে প্রিয়তী আর অর্ণবের রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গলে সবাই উপস্থিত হতে পারেনি। তাই যেন ঢাকার আয়োজনে সবাই সেটা পুষিয়ে নিয়েছে। বেশ জনসমাগম চারপাশে।
সবাই সদ্য বিবাহিত কাপলকে বিয়ের সংবর্ধনা দেওয়াতে ব্যস্ত। প্রিয়তী অর্ণবও সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে অর্ণবের দুষ্টু হাসিটা প্রিয়তীর নজর এড়াচ্ছে না। সকাল থেকেই প্রিয়তীকে তার এই বাঁকাহাসিতে অনবরত লজ্জার সাগরে হাবুডুবু খাইয়ে যাচ্ছে। আর প্রিয়তীও দমবন্ধ করে সাগরের পানিতে ডুবে চলেছে।
সে এবার না পেরে কনুই দিয়ে অর্ণবের পেটে খোঁচা দিলো। কিছুটা রাগীস্বরে বলল,

— ‘ আরেকবার তোমার এই বিটকেল মার্কা হাসি দেখলে দাঁত ফেলে দিব। ‘
— ‘ তাই বুঝি? এত জোর? কিন্তু গতরাতে..
— ‘ একদম চুপ। আর একটা বেশি কথা বললে ঠোঁট সেলাই করে দিব। ‘

বলেই সে এলেমেলোভাবে মুখ লুকিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা চালালো। কিন্তু সফল হয়েও যেন ব্যর্থ। কেননা অর্ণব তার লালরঙা লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া রক্তিম মুখখানা ততক্ষণে দেখে নিয়েছে। তাই আবারও তার ঠোঁটের কোণ বিস্তৃত হলো।

.

ছোট্ট শাদমানের রাগ যেন এতক্ষণে পুরোপুরি দমেছে। ছোট্ট ছোট্ট পাগুলো নিয়ে সে অনবরত বড়দের মাঝে বিচরণ করে যাচ্ছে। ছেলের হাসি মুখখানা দেখে নিধি-শাহেদ দম্পতির ঠোঁটের কোণেও সরু হাসির রেখা। শাহেদ তো না পেরে বলেই উঠল,

— ‘ বুঝলে নিধি, এখন মনে হচ্ছে যত ব্যস্ততাই হোক না কেন ছেলের জন্য হলেও মাঝেমধ্যে কোথাও বেড়িয়ে আসা দরকার। আমাদের নিজেদের ব্যস্ততার ভিড়ে ছেলেটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। দেখ আজ বেড়িয়ে আসাতে কতটা খুশি। ‘

নিধি ঠোঁট এলিয়ে হাসল। নিঃশব্দেই যেন তার উত্তর শাহেদের প্রশ্নের বিপরীতে হ্যাঁ-বোধক জবাব দিয়ে দিলো। শাদমানকে এদিক-সেদিক টইটই করতে দেখে নীলা পাশ থেকে এগিয়ে আসলো। হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে বলল,

— ‘ এই যে পুঁচকো এদিক-সেদিক কি? ব্যাথা পাবে তো। ‘
— ‘ হোয়াট ডু ইউ মিন বাই পুঁপকো? আ’ম নট পুঁপকো খালামণি। আ’ম শাদমান ইবনে হোসাইন। ডোন্ট কল্ মি পুঁপকো। ‘

নীলা চোখ বড়বড় করে শাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এইটুকুখানি একটা পিচ্চি, কিন্তু কথা দেখ!
সাদিদ নীলার পিছনেই ছিল। তাই দুইজনের সবটুকু কথোপকথন শুনে বেশ উচ্চস্বরেই সে হেসে ফেলল। তার হাসির আওয়াজে নীলার এবার হুঁশ ফিরেছে। সে গাল ফুলিয়ে পিছনে তাকালো। সাদিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মুখশ্রীর হতাশার ভাব যেন আরও কয়েকদাপ বেড়ে গেল। এখন নিশ্চিত সাদিদ তাকে এইটা নিয়েও পঁচাবে। হলোও তাই৷ সাদিদ সামনে হেঁটে এসে শাদকে নিচ থেকে কোলে তুলে নিলো। তারপর শাদের গালদুটো আস্তে করে টেনে দিয়ে বলল,

— ‘ হ্যাঁ সেইটাই তো। কিন্তু এটা কি আর তোমার খালামণি বুঝবে বাবা? সে তো নিজেই পিচ্চি। তাই সবাইকেও তার মতো পিচ্চি-পাচ্চি মনে করে। ‘

শাদমান বিজ্ঞদের মতো সাদিদের কথাতে মাথা উপর নিচ করল। অর্থাৎ কথাটা তার মনে ধরেছে। তার খালামণি আসলেই ছোট মানুষ। নীলা তাদের কান্ড দেখে গাল ফুলিয়ে বলল,

— ‘ একদম আজেবাজে কথা বলবেন না। আমি মোটেই পিচ্চি নই। যথেষ্ট বড় আমি। পুরোপুরি এডাল্ট। ‘
— ‘ হ্যাঁ সেটা তো অবশ্যই। নতুবা কি আর পিচ্চির সাথে এডাল্টদের কাজকর্ম করা যায়? তুমি হলে এডাল্ট, কিন্তু পিচ্চি এডাল্ট। ‘

বলেই সাদিদ ঠোঁট এলিয়ে বাঁকা হাসল। নীলা দ্রুত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কেউ এসব শুনলে কি ভাববে? অথচ দেখ এই অসভ্য ছেলে কি সুন্দরভাবে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। নীলা সাদিদকে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে তার মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। আপাতত এই নির্লজ্জ পুরুষের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
সাদিদ নীলার গমনপথের দিকে তাকিয়ে আবারও হেসে ফেললো। এই মেয়েটার রাগ, অভিমান, লাজুকলতার সব রূপই সাদিদকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। কতবার যে একি মানুষের প্রেমে পড়া যায় এটা হয়তো সাদিদ থেকে শেখা উচিত।
শাদমান এখনও সাদিদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ তার হাসির রহস্য তার নিকট বোধগম্য নয়।
সাদিদ সেটা পরখ করে আবারও তার গাল টেনে ধরল। এবার শাদমান ভ্রুজোড়া বাঁকিয়ে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ পাপু গাল ছিঁড়ে যাবে। ‘
— ‘ বাহ্ বাবাটা দেখি খুব বুঝে। ভাবছি তোকে ঐ পিচ্চি মেয়েটার আরেকটার পিচ্চি দিয়ে দিব। ‘
— ‘ পিপ্পি, পিপ্পি এতগুলো পিপ্পি! ‘
— ‘ নারে বাপ। পিপ্পি না এটা হচ্ছে পিচ্চি বউ। কিরে, আমার রাজকন্যাকে সামলে রাখতে পারবি তো? ‘
— ‘ রাজকন্যা? ‘
— ‘ সেটা আমার৷ তোর হবে রাজরাণী। কিরে বাপ পারবি তো? মাইয়া কিন্তু আমার কলিজা। কলিজার টুকরোটারে তোরে দিয়ে দিবার কথা বলতাসি। ভাবতে পারিস কতবড় কথা? ‘

শাদমান আবারও বিজ্ঞদের মতো মাথা উপর নিচ করলো। অর্থাৎ সে বুঝতে পারছে এটা অনেক বড় কথা।
সাদিদ তার ভাবভঙ্গিতে খুশি হয়ে আদরে পিঠ চাপড়ে দিলো। অতঃপর কোলে নিয়েই সামনে এগিয়ে গেল। ছোট্ট শাদ অপরপাশে দাঁড়ানো নীলার দিকে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকালো। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করল,

— ‘ কলিজার টুকরা। ‘

__________________

শান্ত হালকা হলদেটে সাদার মিশ্রণে তৈরি গাউনের ডাবল স্লিভের একটা পার্ট নিয়ে অনবরত নড়িয়ে চড়িয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি তার পাশে দাঁড়ানো মোবাইল গিলে খাওয়া ছেলেটার দিকে। সে যে তার নজরে পড়তে এতশত কাঠখড় পোড়াচ্ছে সেই দিকে এই ছেলের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে একধ্যানে মোবাইলে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে।
শান্ত গতকাল অব্দি খুশিতে আটখানা ছিল। তার পরনের এই ড্রেসটা তানবীর-ই তার জন্য পাঠিয়েছে। তানবীরের থেকে এতবড় সারপ্রাইজ পেয়ে তার যেন রাত আর শেষ হয় না। কখন নিজেকে তার দেওয়া উপহারে তানবীরের সামনে দাঁড় করাবে এই অপেক্ষাতে যেন তার প্রহর কেটেছে। কিন্তু এখন?
যার জন্য এতটা অস্থির ছিল সে পুরোপুরি স্বাভাবিক। এমনকি হিসেবের থেকে একটু বেশি-ই স্বাভাবিক। সে শান্তকে এখন পর্যন্ত চোখ তুলে ভালো করে দেখেছে কি-না এটাতেই চরম সন্দেহ। গতকাল অব্দি যার রোমান্টিকতার কথা চিন্তা করে শান্ত লজ্জায় লাল-নীল হচ্ছিল, আজ তার এমন বেপরোয়া ভাব দেখে নিমেষেই তানবীরের প্রতি বিরক্ত হয়ে নিজের মনেই আওড়াল,

— ‘ শেষমেশ কি-না এমন একটা নিরামিষ মার্কা ছেলে কপালে জুটল! ‘

বিড়বিড়িয়ে লাভ হয়নি৷ কেননা তানবীর নিজের কানের তীক্ষ্ণতার বলে খুব সহজেই সেটা শুনে নিয়েছে। সে মুখটা অপরপাশ ঘুরিয়ে শান্তর চক্ষুর আড়ালে চেপে রাখা হাসিটুকু বের করে দিলো।
অতঃপর সবসময়কার ন্যায় বিরস কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ ভদ্র পোলা। তাই সঠিক সময় ব্যতিত নিজেকে প্রমাণ করতে পারুম না৷ একবার বিয়েটা হোক তারপর হাড়েহাড়ে বুঝাব আমিষ নাকি নিরামিষ। ‘
— ‘ আর বিয়েটা কবে হবে? ‘

শান্ত কথার পিছে কথাটা বলে নিজেই জিহ্বায় কামড় দিলো। মাত্রই কি বলে ফেলল ভাবতেই লজ্জায় তার শরীর হীম হয়ে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু যার সাথে চোখ মেলাতে সে এতটা লজ্জা চেপে ধরেছে সে ভাবলেশহীন। একেবারে অনুভূতিহীন হয়ে শান্তর মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। আচমকা তানবীরের এমন মুখশ্রী নজরে আসতেই লজ্জার সাথে এবার অনুতপ্ততাবোধও শান্তকে চেপে ধরেছে। একটু আগে কি বলেছে ভাবতেই তার নিজের কাছেই বড্ড খারাপ লাগছে। না জানি তানবীর এখন কেমন অনুভব করছে?
তানবীর মাথা নিচু করে শান্তর হাতটা চেপে ধরল। কি মনে করে আবার হুট করেই সেটা ছেড়ে এককদম পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর খুব নরম কন্ঠে বলল,

— ‘ একটু সাইডে আসবে? কিছু কথা ছিলো। ‘

শান্ত তানবীরের মলিন মুখটাতে নজর বুলালো। মনে হচ্ছে কথাটা সে জোরপূর্বক গলা দিয়ে বের করছে। বরাবরের মতো তার কন্ঠে বাউন্ডলে ভাবটা নেই। আর না আছে দুষ্টুমির কোনো বহিঃপ্রকাশ।
শান্ত সবসময় চাইত তানবীরের এই বেপরোয়া ভাবটার যেন উন্নতি ঘটে। শান্তর তার এমন আচরণে সমস্যা না হলেও তার মা-বাবা নিশ্চয়ই এমন বাউন্ডলে ছেলের হাতে নিজের মেয়ের হাত তুলে দিতে চাইবে না।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটু কষ্ট হলেও মা-বাবাকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তানবীরকে আর দশটা ছেলের ন্যায় গম্ভীর হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই৷ তাকে এমন খাপছাড়া চরিত্রেই বেশি মানায়। বেশি গুছিয়ে নিতে গেলে একেবারে ভালো হবে না। যাকে বলে অতি ভালোই মন্দ হয়।
শান্তর এমন নীরবতায় যেন তানবীর ভীষণ আহত হলো। তার মাথায় আপাতত পজিটিভ কিছু আসছে না৷ সব যেন নেগেটিভের ছড়াছড়ি। শান্ত যে তার এমন শান্তশিষ্ট রূপে নিশ্চুপ এটা তার বিন্দুমাত্র মনের গহীনে আসছে না। আসছে শুধু ভয়াবহ কিছু তিক্ততার রেশ জনিত ঘটনা।
সে আবারও মলিন মুখে একি প্রশ্ন করল,

— ‘ কিছু বলছো না যে? আসবে একটু? ‘
— ‘ জ্বি। ‘

তানবীর যেন মলিন মুখেই কিঞ্চিৎ হেসে উঠল। তা দেখে শান্তর খুশি হবার কথা হলেও সে আবারও হতে পারল না৷ কেননা এই হাসি যে তানবীরের আসল হাসি নয়৷
তার হাসিতে প্রাণ থাকে। দুষ্টুমির আড্ডাখানা থাকে। সেখানে এই হাসি নির্জীব, প্রাণহীন। তাহলে কিভাবে খুশি হবে সে?
তানবীর তাকে নিয়ে কোলাহল থেকে বেশ অনেকটা দূরে এসে দাঁড়াল। একেবারে নীরব পরিবেশ বলা চলে।
তানবীর বারবার এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করছে। সে যে কোনো কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত এটা শান্তর আর বুঝার বাকি নেই। তাই শান্ত নিজেই গলা কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল,

— ‘ কি বলতে চেয়েছিলেন? ‘
— ‘ না মানে..
— ‘ আপনি কি জানেন? আপনাকে এই ইতস্ততবোধে একেবারেই মানায় না? ‘

তানবীর যেন টেনশনের মধ্যেও নিঃশব্দে হেসে ফেলল। তারপর দিনদুনিয়া সবকিছু ভুলে হেঁচকা টানে শান্তকে নিজের বক্ষপিঞ্জরের উপর এনে ফেলল। একটা হাত তার চুলের মধ্যে দিয়ে গলিয়ে মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল।
শান্ত পুরোপুরি হতবাক। এই ছেলের হঠাৎ হঠাৎ কি হয় সেটা মনে হয় সে নিজেও জানে না। কয়েক সেকেন্ড গড়াতেই সে নিজের হুঁশে ফিরল। এবং তানবীরের কাজে বড্ড লজ্জা পেল। শরীরে ক্রমশ শিহরণ বয়ে চলেছে। অবশেষে দীর্ঘ নীরবতার চাদর সরিয়ে তানবীর শান্তকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েই চাপা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ এতদিন এই কথাটা মনে পড়লে রাগ লাগলেও আজ যেন নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। কখনও ভাবিনি এই ঘটনার জন্য এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু আজ আমার বড্ড ভয় হচ্ছে শান্ত। খুব বেশি। ‘

শান্ত অবাক হলো। বরং একটু বেশি-ই। এই ছেলেটার থেকে এইসব ভিতুমার্কা কথা একেবারেই আশা করা যায় না। সে প্রতিউত্তরে কিছু বলবে তার আগেই তানবীর আবারও বলল,

— ‘ আমার ভয়কে প্লিজ জয় হতে দিও না। আমার যে তোমাকে প্রয়োজন। একটু বেশি-ই প্রয়োজন। ‘
— ‘ আচ্ছা কি হয়েছে সেটা তো বলবেন? এভাবে বললে বুঝব কিভাবে? ‘

তানবীর এবার নিজের বাহুবন্ধন হালকা করে দিলো। শান্তর থেকে একটু পিছিয়ে কন্ঠে যথেষ্ট আড়ষ্টতা নিয়ে বলল,

— ‘ সবার লাইফেই একটা অতীতের পৃষ্ঠা থাকে। কারও হয়তো সেটা ফুলে সজ্জিত বাগান৷ আবার কারও হয়তো সেটা ধ্বংসাত্বক মরুভূমি। আমার জীবনেও একটা অতীতের ধ্বংসাত্বক পৃষ্ঠা রয়েছে। সেটা নিয়ে আমার কোনো হতাশা নেই। আর নেই কোনো পিছুটান। কিন্তু আজকে আমার ভয় হচ্ছে। অমূল্য কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়৷ যেই অতীতের রেশ আমি এখনও অব্দি টেনে যাচ্ছি তার-ই রেশ আমার বর্তমানে এসেও নাড়া দিচ্ছে। আমার থেকে আবারও খুশি কেড়ে নিতে চাইছে। ‘

কথাটুকু বলে তানবীর চোখজোড়া দ্রুত নিচে নামিয়ে নিলো৷ শান্তকে নিজের অশ্রুসিক্ত আঁখিদ্বয় সে দেখাতে ইচ্ছুক নয়। শান্ত কয়েককদম এগিয়ে গেল। নিজেদের মধ্যে যতটুকু দুরত্ব তৈরি হয়েছিল সেটা মিটিয়ে লজ্জা ভুলে তানবীরের গালে নিজের কোমল হাতটা স্থাপন করলো। তানবীর সাথে সাথে চোখ তুলে তার চোখে চোখ রাখল। শান্ত কিঞ্চিৎ হেসে ভরসায় পরিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ ইশশ এতো বিশ্লেষণ! এটাও আমাকে দেখতে হবে? ‘

তানবীরের ঠোঁটের কোণ সরু হলো। তাই দেখে শান্ত আবারও বলল,

— ‘ এমন করছেন কেন? বলেন না কি বলবেন? এতো আড়ষ্টতাবোধ আপনাকে মানাচ্ছে না। ‘
— ‘ যদি বলি আমি বিবাহিত। কারও জীবনের সাথে এককালে আমার জীবন জড়িত ছিলো৷ তারপরও কি এমনভাবে বলতে পারবে? এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারবে? ‘

তানবীরের গালে থাকা শান্তর হাতটা আচমকা নড়েচড়ে উঠতেই তানবীর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। সে জানত সত্যিটা স্বীকার করা এতোটা সোজা নয়। মুখে বলা যতটা সহজ কাজে বলা ততটা নয়।
কিন্তু তানবীর তো আর প্রেয়সীর বর্তমান মনোভাব বুঝতে পারছে না। সব নেগেটিভের কারখানা এসে তার মস্তিষ্কে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে বসেছে। নতুবা প্রেয়সীর চোখের ভাষা সে অবশ্যই পড়তে পারত।

— ‘ বলেছিলাম পারবে না। আর দেখলে তো এমনটাই হয়েছে। ‘

কথাটুকু বলে তানবীর পিছিয়ে আসতে চাইলেই শান্ত তার হাত টেনে ধরল। সে এই অবুঝ ছেলেটাকে কিভাবে বুঝাবে সে তার বর্তমান আর ভবিষ্যতের সবটা জুড়ে থাকতে চায়। অতীতের নামেমাত্র জায়গার জন্য নিজেকে কখনও সে এই ছেলেটার জীবন থেকে দূরে সরাতে পারবে না। কি করে বুঝাবে তাকে?
তানবীর যেন অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেল। যখনই শান্ত তার সবকথার পিঠে মোহনীয় স্বরে বলল,

— ‘ আচ্ছা বাদ দেন৷ আমি এই নিয়ে কিছু শুনতে চাই না৷ চলুন ঐদিকটাতে গিয়ে বসি। অনেক বাতাশ আসছে। ‘

সে আর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। তানবীরকে পিছনে ফেলেই সামনে হাঁটা দিলো। তানবীর এতো ভয়ানক সত্যের পিঠে এত স্বাভাবিক একটা কথা যেন কিছুতেই মানতে পারল না৷ মনে হচ্ছে এই কথাটা শান্তকে বিন্দুমাত্র আঘাত করতে পারেনি। মুহূর্ত কয়েক ব্যয় হতেই তানবীর দ্রুত পা চালিয়ে সামনে গেল। পিছন থেকে শান্তর হাতে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ঘুরালো। ক্রমশ চমকিত কন্ঠেই বলল,

— ‘ কি বলছো তুমি? আমার কথা ভালো করে শুনতে পেয়েছ তো? আমি কি বললাম এর অর্থ বুঝতে পারছো তুমি? এসব জানার পরও এতটা স্বাভাবিক কিভাবে? ‘

শান্ত চুপ করে থাকল। সে তানবীরকে বলতে চায় না যে তার অতীত সম্পর্কে ইতিমধ্যে সে অবগত। বললে হয়তো এক বন্ধুর প্রতি আরেক বন্ধুর বিশ্বাস নষ্ট হবে। সেটা শান্ত কিছুতে করতে পারবে না।
হয়তো বা কোনো এক বিকেলের অতীতের মধুর স্মৃতি স্মরণ করার সময় অকপটে বলে চমকে দিবে। তখন রাগ করার পরিবর্তে প্রাণের বন্ধুকে হাসতে হাসতে সে গালমন্দ করবে৷ কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে সত্যটা বললে হয়তো ভুল বুঝার সম্ভাবনা রয়ে যাবে। এতটা ধাক্কা শান্ত একেবারে তানবীরকে দিতে ইচ্ছুক নয়। তাই পূর্বেকার ন্যায় অতি স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,

— ‘ সব শুনতে পেয়েছি। এবং এর অর্থও পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম। কিন্তু আপনার মনের সান্ত্বনার জন্য বলতে হচ্ছে যে, আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনোরূপ প্রশ্ন নেই। আমি শুধু আপনার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সবটা জুড়ে থাকতে ইচ্ছুক। বুঝতে পেরেছেন আপনি? আমি বললাম সবটা। মানে একবিন্দুও যেন নড়চড় না দেখি। ‘

তানবীর হাসল। প্রাণভরে মিষ্টি হাসল। এতটা সুখ যে তার ভাগ্য লেখা ছিল সেটা হয়তো সে কখনও কল্পনায় ভেবেও দেখেনি। কতকাল সে নিজের পোড়াভাগ্য নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করেছে। কতটা হতাশ হয়েছে। তাই যেন পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তা সবকষ্টের প্রতিধান হিসেবে তানবীরের ঝুলিতে এতটা সুখ কুড়িয়ে দিচ্ছে।
তাই বলাবাহুল্য ভাগ্যের উপরে কখনও হতাশ হতে নেই। কে জানে সামনে আপনার জন্য কি অমূল্য অপেক্ষা করছে? হয়তো আপনার ভাবনার থেকেও অধিক ভালো কিছু আপনার জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
তানবীর গভীর মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে শান্তর মুখপানে চোখ বুলালো। অতি সাধারণ মেয়ের আড়ালে কি অসাধারণ এক সত্তা। এইজন্যই বলে একজনকে দিয়ে বাদবাকি সবাইকে বিচার করা উচিত নয়। একজন মেয়ের জন্য যেমন পুরো মেয়েজাতীকে দোষারূপ করা অনুচিত, তেমনিভাবে একজন ছেলের কৃতকর্মের জন্য বাদবাকি ছেলেদের দোষারূপ করাও বেঠিক। তানবীর আজ মনে প্রাণে সেটা স্বীকার করতে চায়ছে। কেননা একটা মেয়ের জন্য সে এখন অব্দি পুরো নারী জাতিটাকেই ঘৃণার চোখে দেখে এসেছে।
সে আলতো করে শান্তর গালে হাত রাখল। গভীর আবেশে প্রেয়সীর কপালে ভালোবাসার চুম্বন আঁকলো। শান্তর চোখজোড়া যেন নিজ থেকেই বন্ধ হলো। দীর্ঘ চুম্বনের পর তানবীর তাকে ছেড়ে দিয়ে শান্তর ডানহাতটা মুঠো করে ধরল। নিঃশব্দে তাকে নিয়ে সামনে হাঁটা দিলো। শান্ত বিনাবাক্য তার পথ অনুসরণ করে গেল।
তানবীর তাকে নিয়ে এসে ছাদের রেলিং ঘেঁষে মেঝেতে বসে পরল। এবং শান্তর হাতে টান দিয়ে তাকেও নিজের সাথে বসিয়ে দিলো। শান্ত শুধু চুপচাপ তানবীরের করা কর্মকান্ডগুলো অবলোকন করে যাচ্ছে।
তানবীর শান্তর হাতের মুঠিটা এখনও ছাড়েনি। বরং আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে গলার স্বর খানিকটা নিচে নামিয়ে বলতে শুরু করল,

— ‘ আমি যখন মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম তখন-ই আমার বিয়েটা হয়েছিল। আমার…
— ‘ প্লিজ, প্লিজ আমি কিছু শুনতে চাই না। দরকার নেই পুরোনো স্মৃতি মনে করার। ‘
— ‘ কিন্তু আমি যে বলতে ইচ্ছুক। বরং কথাগুলো আরও আগেই তোমাকে বলে দেওয়া আমার উচিত ছিল। কিন্তু জানো তো বিগত দিনগুলোতে এতটা খুশি ছিলাম যে অতীতের তিক্ততাগুলো একেবারেই ভুলে বসেছিলাম৷ আজকে তুমি হঠাৎ বিয়ের কথাটা বলতেই টনক নড়ল। ‘
— ‘ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি অজান্তেই আপনার কাটা গায়ে আঘাত করে বসলাম। ‘
— ‘ পাগলি মেয়ে। তুমি ক্ষমা চাচ্ছ কেন? তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি আমার নিকট ফুলে সজ্জিত পবিত্র বাগান। তাতে বিন্দুমাত্র দাগ আমি দেখতে পাই না। তাই আমি আমার এই ফুলের বাগানের কাছে কোনো কিছু গোপন রাখতে ইচ্ছুক নয়। তোমার সবটা জানার অধিকার রয়েছে। ‘

শান্ত আর না বোধক কিছু বলতে পারল না। চুপচাপ তানবীরের কথার সম্মোহন স্বরূপ মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।
শান্তর সমর্থন পেয়ে তানবীর এবার নিঃশব্দে মৃদু হাসল। অতঃপর আবারও বলতে লাগল,

— ‘ তুমি হয়তো জানো না। আমার মা নেই। ‘

শান্ত এবার চমকিত দৃষ্টিতে তাকাতেই তানবীর ভীষণ রকমের তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

— ‘ পৃথিবীতে অস্তিত্ব রয়েছে কি-না এটা জানতে চাইলে বলতে হবে আছে। কিন্তু আমার মনের কথা জানতে চাইলে বলব আমার মা নেই। আমার মা-বাবা সব হচ্ছে তৌহিদুর হাসান৷ তিনি-ই আমার সব। ‘

শান্ত যেন অবাকের উপরে অবাক হচ্ছে। অর্ণব শুধু তাদেরকে তানবীরের বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়টা সংক্ষিপ্ত আকারে বলেছিল। কিন্তু তানবীর এখন নতুন করে এসব কি বলছে?
শান্তর চমকিত দৃষ্টিটা তানবীরের নজর এড়ালো না। বিষয়টাই অবাক হওয়ার মতন। কিন্তু তারপরও সে নিজের মতো করে বলতেই থাকল,

— ‘ মা-বাবা আর তাদের একমাত্র সন্তান হিসেবে বেশ হাসিখুশি আনন্দের সাথেই আমার দিন কাটছিল। উচ্চবিত্ত হওয়ার কারণে ছোট থেকেই কোনোকিছুর অভাবে পরতে হয়নি। বলতে পারো চাওয়ার আগেই সবকিছু পেয়েছি। কিন্তু আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে যখন আমি ক্লাস সেভেনে অধ্যায়ন করি তখনই বাবা ব্যবসায় ভীষণ বড় রকমের লস খায়। এতবড় কোম্পানিটা নিমেষেই গড়িয়ে যেতে সময় লাগল না। ব্যাংকে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স থাকাতে সাংসারিক কোনো সমস্যা তখনও দেখা দেয়নি। কিন্তু ঢাকার মতো এমন একটা জায়গায় এতো বিলাসবহুল পরিবেশে চলতে হলে বেশ অর্থের প্রয়োজন। মা বাবার মতো উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলো৷ কিন্তু বাবার তেমন একটা ইচ্ছে ছিল না বিধায় মা কখনও বাহিরে চাকরি করেনি। বাবার কোম্পানিও তখন দেউলিয়া প্রায়। তাই বাবাকে রাজি করিয়ে মা চাকরি করার পারমিশন নেয়। বাবার অবস্থা তখন এমন একটা পর্যায়ে ছিল যে না করার সামর্থ্য ছিল না। যার দরুন মাকে আর মানা করতে পারেনি। বেশ কয়েকটা মাস ভালোই চলছিল। মায়ের উপার্জিত আয়ে সাংসারিক অবস্থা তখন আরও ভালো। সেই জন্য বাবা হয়তো একটু স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারছিলেন। মন ভালো থাকলে কাজের গতিও ভালো থাকে। তাই পুনরায় দ্বিগুণ উদ্যোগে বাবা ব্যবসার হাল ধরতে লেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু সব ভালো হয়েও যেন ভালো হলো না। মায়ের অবাধ চলাফেরার বিষয়টা বাবার প্রথমে নজরে না আসলেও আস্তেধীরে নজরে এসে গেল। কেননা এমনও দিন যেত মায়ের কোনো দেখা আমি পেতাম না৷ সারাদিন বাবার সঙ্গও পাওয়া যেত না। তাই অধির আগ্রহে মায়ের পথ চেয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু দশটা বাজে, এগারো বাজে মায়ের আসার নাম নেই। যেই জায়গায় মায়ের অফিস টাইম পাঁচটায় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। পুরোটা সপ্তাহ আমি মায়ের দেখা পেতাম না। কেননা মা এতো রাতে বাড়ি ফিরত যে আমার মতো ছোট্ট ছেলের পক্ষে জেগে থাকা সম্ভব হতো না। আবার মা লেইট করে ঘুমাতে যেতেন বলে সকালে আমি দেখা করার সুযোগ পেতাম না৷ কেননা মায়ের কড়া বারণ ছিল তার ঘুমে যেন কেউ বেগাত না ঘটায়। তাই আমিসহ কারও সাহস কুলাতো না মায়ের ঘুমে ডিস্টার্ব করার। তাই আবারও মায়ের আদর ব্যতিত স্কুলে যেতে হতো।
সাদি-অর্ণব আমার ছোট্ট বেলার ফ্রেন্ড। তাই স্কুলের সময়টুকু তাদের সাথে বেশ ভালোই কাটতো। কিন্তু দিনশেষে বাড়িতে ফিরে আসতাম এক আকাশ কষ্ট নিয়ে। কেননা বাড়িতে চাকর বাকরের কমতি না থাকলেও ভালোবেসে আগলে রাখার মানুষের বড্ড অভাব বোধ করতাম। মা-বাবার অভাব কি অন্য কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব? সারাদিন ছোট্ট একটা ছেলে চাকর বাকরের হাত ধরে সব করতো৷ বাবা হয়তো আমার মনোভাব বুঝতে পারতেন। কিন্তু হাতে কিছু করার থাকতো না। শুধু বাসায় ফিরে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমার হাত টুকু ধরে চুপ করে বসে থাকতেন। একটা সময় শত কাজ থাকার পরও কেবলমাত্র আমার জন্য বাবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা শুরু করে। সেই যেন আমার একলা জীবনে আবারও আনন্দের দেখা মিলতে শুরু করলো। আমরা বাপ-ছেলে সন্ধ্যার পর থেকে ঘুমানোর আগপর্যন্ত অনেক খেলা খেলতাম। টিভিতে বিভিন্ন হাসির কাটুন আর ছবি দেখতাম। বলতে পারো সময়টাকে পুরোপুরি হাসি আনন্দের মধ্যে দিয়ে ব্যয় করতাম। মায়ের অভাবটা পূরণ না হলেও বাবা যেন তার আদরে কমতিটুকু মুছিয়ে দিতে স্বার্থক ছিল।
কিন্তু এবারও যেন আমার আনন্দে কালোগ্রহণ লেগে গেল। বাবার সাথে মায়ের প্রায় ছোট ছোট জিনিস নিয়ে ঝগড়া বাড়তে লাগল। বাবার দিনশেষে আমার জন্য যেই হাসিটুকু বরাদ্দ রাখত সেটা যেন ক্রমশ-ই ঝগড়াঝাটির নিচে চাপা পড়ল। আমার ছোট মস্তিষ্ক এতসব ঝামেলা বুঝতে পারত না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারতাম আমাদের হাসিখুশি পরিবার আর আগের মতো নেই৷ পরিবর্তনের ছোঁয়া তাতে ইতিমধ্যে বেশ জোরালো ভাবেই লেগেছে। ‘

তানবীর জোরে একটা শ্বাস টানল। অনেকটা তিক্ত কথা সে আবারও মুখ ফুটে বলেছে। শান্ত অস্থির দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কিন্তু পানি বা সফটডিক্স জাতীয় কিছু পাচ্ছে না৷ তাই সে উঠতে নিলেই তানবীর পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো।

— ‘ কোথায় যাও? ‘
— ‘ মানে.. আপনার জন্য পানি নিয়ে আসি। ‘
— ‘ না লাগবে না৷ তুমি বসো। ‘
— ‘ বেশি সময় লাগবে না। যাব আর..
— ‘ বললাম না লাগবে না। শুধু তুমি থাক তাহলেই হবে। ‘

শান্ত আর দ্বিমত পোষণ করতে পারল না। চুপচাপ আবারও তানবীরের পাশ ঘেঁষে বসল। কিন্তু তানবীরের নিকট অনুরোধের সহিত আবদার করল,

— ‘ আচ্ছা যাব না। কিন্তু আমি আর কিছু শুনতে চাই না৷ আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই৷ ‘
— ‘ কিন্তু আমার যে আছে। আমার মতে তোমার এই কথাগুলো জানা উচিত। এমনকি আরও অনেক আগে। শুধু আমার কারণে তুমি এসব সম্পর্কে এখনও অবগত নও। আমি আর নিজের ভুলের মাত্রা বাড়াতে চাই না। সত্য জানার পর তুমি কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই আসল বিষয়। ‘
— ‘ শুনুন, এতক্ষণ বহুত বলেছেন। কিন্তু এই নিয়ে একটা কথাও শুনতে ইচ্ছুক নই। আপনার অতীত যতোই তিক্ততাময় হোন না কেন, এই শান্তা ইসলামের সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হবে না ইনশাআল্লাহ। বিশ্বাস না হলে বাজি ধরতে পারেন। নিঃসন্দেহে আপনি হেরে যাবেন। ‘

তানবীর খানিকটা ঠোঁট বাঁকালো। যেন জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখল। কেননা মন হাজারবার মানতে চাইলেও যে পরিস্থিতি মানতে দেয় না৷ শান্ত এখন অকপটে যেসব কথাবার্তা বলে ফেলছে হয়তো সবটা জানার পর এতটা নিঃসংকোচে বলতে পারবে না৷ এটাই তো হওয়া উচিত। তাই তানবীর ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে আবারও নিজের অতীতের পৃষ্ঠা উল্টালো,

— ‘ অতঃপর একদিন কানাঘুষাতে শুনলাম মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে নাকি উকিলের কাছে তারা গিয়েছেন। সেই বয়সে ডিভোর্সের কারণে পারিবারিক পার্শ্বঃপ্রতিক্রিয়া না জানলেও এর অর্থ বুঝতাম৷ তাই মা-বাবার আলাদা হয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না৷ খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবকিছু বাদ দিয়ে মা-বাবার কাছে আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসলাম৷ বাবাকে যখন মাকে দূরে সরিয়ে দেবার জন্য না করতাম বাবা তখন কেবল নিঃশব্দে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকতেন। কিন্তু মায়ের সম্পর্কে কিছু বলতেন না৷ আর না বলতেন তাদের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ডিভোর্স নিয়ে কিছু৷ আমিও হাল ছাড়িনি। বাবা না হোক মাকে অবশ্যই মানিয়ে নিতে পারব। তাই রাত জেগে মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ মা বাসায় ফিরার পর থেকেই তার কাছে গিয়ে ছোট্ট মনের অনুরোধ জানাতে থাকলাম।
কিন্তু বাবার মতো মায়ের মুখে কোনো অসহায়ত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হতো না৷ সেখানে কেবল একরাশ বিরক্তির ছোঁয়া দেখতে পেতাম। কিন্তু তারপরও আমি পিছু ছাড়িনি৷ একদিন না হয় একদিনতো মেনে যাবে-ই৷ নিজের সন্তানের এমন আকুল অনুরোধ রক্ষা করবে না এমন মা কোথায় আছে?
কিন্তু আমার মা আমাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করলো৷ আমার ছোট্ট মনটাকে ভেঙে দিয়ে আমার গায়ে হাত তুলে বসল। বাবা তখন বসার ঘরেই ছিলেন। আর আমার কান্নার আওয়াজে দৌড়ে এসেছিলেন। আমার অবস্থা আর মায়ের রাগী মুখশ্রী দেখে বাবার উপস্থিত পরিস্থিতি বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই এতদিনের নিজের জমানো সবটুকু রাগ উজার করে দিয়ে আমার সামনেই মায়ের গায়ে হাত তুলেছিলেন। সেদিনের বাবা-মায়ের কথাগুলো আমি এখনও ভুলতে পারি না,

— ‘ চরিতহীন মহিলা, খবরদার যদি তুই আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার সাহস দেখিয়েছিস তো। এতদিন তোকে শুধু মুখে বুঝিয়েছি। কিন্তু আমার ছেলের গায়ে সামান্য একটা আঁচড় লাগলে আমি তোর ছাল শুদ্ধ তোলে নিব। মনে রাখিস তোর সাথে যতটুকু ভদ্রতা বজায় রেখেছি সবটুকু আমার ছেলের কারণে। কেননা হাজার হলেও তুই তার গর্ভধারী মা। তাই এতটুকু সম্মান তোকে দিতে আমি বাধ্য। কিন্তু নিজের সীমানাতে থাক। নতুবা আমি সম্পর্কের লেনদেন ভুলে যাব। ‘
— ‘ এত যে ছেলে ছেলে করছো তোমার পুরুষত্ব আমার জানা আছে। ডক্টর সাফ সাফ বলে দিয়েছে আমার আর বাচ্চা না হওয়াতে সম্পূর্ণ দোষ তোমার। তারপরও এত গলার জোর কোথায় থেকে পাও? তার উপর আবার আমার গায়ে হাত তুলেছ। জামাল জানতে পারলে তুমিসহ তোমার চৌদ্দ গুষ্টিকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে। ‘
— ‘ তাহলে বল গিয়ে তোর প্রেমিকপুরুষকে। আমিও দেখি সে কেমন বীরপুরুষ। যার কি-না এমন একটা নিষ্পাপ ছেলের কাছ থেকে তার মাকে কেঁড়ে নিতে বুক কাপেঁনি। আমার কথাতো না হয় বাদ-ই দিলাম। ‘
— ‘ অবশ্যই সে বীরপুরুষ। তোমার মতো নয়। তার এনার্জি তোমার থেকে হাজারগুণ…

তানবীর হাতের উল্টোপিঠে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখযুগল মুছে নিলো। তখন হয়তো সবগুলো কথার অর্থ পুরোপুরি না বুঝতে পারলেও এখন সবকিছুই পরিস্কার।
সেই জন্য হয়তো কষ্টের মাত্রাটা আরও বেশি। মা হয়ে সন্তানের সামনে কিভাবে এসব কথা অকপটে বলে ফেলে? ভীষণ আশ্চর্য লাগে!

— ‘ জানো, সেদিন বাবা আমাকে জোর করে মায়ের রুম থেকে নিয়ে এসেছিল। মায়ের পিছন থেকে আরও কথা শুনা যাচ্ছিল। সেগুলোর সবকিছুই আমার বয়সের জন্য ঠিক ছিল না৷ তাই বাবা বাধ্য হয়ে মায়ের কথার মাঝপথে আমাকে নিয়ে চলে আসে। তারপর আমার রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা লক করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,

— ‘ লক্ষ্মী ছেলে আমার, ঘুমিয়ে পর। সকালে আবার স্কুল আছে। ‘
— ‘ বাবা, মা ঐসব কি বলছিল? ‘
— ‘ আর একটাও কথা নয়৷ চুপচাপ বিছানায় আস। আমি আজ তোকে ঘুম পারিয়ে দিব। ‘

তানবীরের চোখজোড়া আবারও ম্লান হয়ে আসলো। আজ তার এতো কান্না পাচ্ছে কেন? সাথে সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষ উপস্থিত বলে? হবে হয়তো। তানবীরের কাছে তো এমনটাই মনে হচ্ছে।

— ‘ তারপর থেকে বাবা-ই আমার সবকিছু হয়ে উঠেছিল। মায়ের কাছে যেতে চাইতাম৷ কিন্তু মা যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠত। তাই বাবা আমাকে সবসময় চোখে রাখার চেষ্টা করতেন৷ নিজের কাজের বাহিরে সবটুকু সময় আমার জন্য বরাদ্দ ছিল। এইভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল।
আর একদিন অবশেষে আইনিভাবে মা-বাবার বিচ্ছেদও ঘটে গেল। আমি কেবল নীরব দর্শক ছিলাম। বাবারও মুখেও ছিল অসহায়ত্বের ছাপ। কিন্তু মা দিব্বি ছিল। আর সেদিনই প্রথমবারের মতো আমি শেখ জামাল চৌধুরীকে দেখতে পেয়েছিলাম৷ মা খুশিতে গিয়ে তাকে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরেছিল। তার যে একটা সন্তান এসব নিজের চোখে দেখছে এদিকে তার বিন্দুমাত্র নজর নেই। সে ব্যস্ত নিজের পরকীয়ার সম্পর্কে। বাবা কোনোদিন তাদের ডিভোর্স নিয়ে আমাকে কিছু বলেনি৷ কিন্তু লোকজনের কানাঘুঁষাতে জানতে পারি মায়ের অফিসের বস ছিলেন এই জামাল চৌধুরী। আর তার সাথেই মা নিজের ছেলে-স্বামীকে ভুলে গিয়ে পরকীয়াতে লিপ্ত হয়েছিল। যার শেষ পরিণতি হাসি-খুশিতে ভরা একটা পরিবারের অকাল মৃত্যু।
মায়ের এই বিশ্বাসঘাতকার পর বাবা হঠাৎ-ই যেন অসুস্থ হতে শুরু করে। একসময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরে। তারপরও আমাকে সামলাতে ভুলেনি৷ নিজে খাওয়ার আগে আমাকে পাশে রাখত। মা-বাবার সবটা দায়িত্ব যেন বাবা একাই পালন করতে উঠেপড়ে লেগেছিল।
কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল আমার বেপরোয়া ভাব ততটাই বেড়ে যাচ্ছিল। সেটা বাবার অনাদরে নয়। বরং বাবার এই করুন অবস্থাতে৷ না চাইতেও মায়ের করা কৃতকর্মের প্রতি আমার ঘৃণা জাগতে শুরু করে। তারপর এই কর্ম করা ব্যক্তির উপর। একসময় জন্মদাত্রী মা-ই আমি নিকট পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হলো৷
বাবা আমাকে বুঝাতেন। মায়ের ভালো কাজগুলো সবসময় আমার চোখের সামনে তোলে ধরতেন। আমাকে মায়ের পজিটিভ দিকগুলো দেখিয়ে শান্ত রাখতে চাইতেন।
কিন্তু যত বড় হচ্ছিলাম আমি যেন আরও উগ্র হতে শুরু করি৷ একসময় সেটা বাবাসহ সব বন্ধু বান্ধবের নজরে পর্যন্ত চলে আসে। এক নারীর উপর ঘৃণা পোষণ করে আমি পুরো নারূজাতটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করি৷ এর থেকে আমার লেডি টিচার্সগুলোও বাদ পরেনি। ‘

শান্ত চোখ বড় বড় করে তানবীরের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। কি ভয়ানক কথাবার্তা। তানবীর তার অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলল,

— ‘ হ্যাঁ এমনটাই৷ আর সবকিছু বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু টিচার্সদের সাথে এমন উগ্র ব্যবহারে বাসায় রীতিমতো বিচার আসতে শুরু করে। বাবার তখন মাথায় হাত। মা হয়ে পেটের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একি খেলা খেলল তিনি, এটাই বাবা বুঝতে পারত না৷
কিন্তু সবার চিন্তার অবসান ঘটল। এক নারী জীবন ধ্বংস করল, আবার আরেক নারী এসেই যেন আমার জীবনটা শুধরিয়ে দিতে শুরু করল। জানতে চাইবে না সেই মহান নারীটির নাম কি? আমিই বলছি তোমাকে।
প্রিয়তী, প্রিয়তী জাহান। আমার জীবনের দ্বিতীয় প্রধান নারী ভুমিকা।

#চলবে..

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩৭ 💕❤💕

রাত ততটা হয়নি। কিন্তু শীতের প্রকটে যেন প্রকৃতিতে হীম শীতলভাব। গায়ে কাটা দেওয়ার অবস্থা। কিন্তু আজকে শান্তর যেন প্রকৃতির এই ভিন্ন আবহাওয়ার তাপে শরীর হীম হচ্ছে না। বরং তানবীরের মুখ নিঃসৃত একেকটা বাক্য যেন তাকে পুরোপুরি ঠান্ডা বরফে পরিণত করছে। এই চঞ্চল – বেপরোয়া ভাব নিয়ে চলা ছেলেটা যে নিজের মন গহীনে এত কষ্ট চেপে রেখেছে সেটা হয়তো তানবীর আজ নিজের মুখে না বললে শান্ত কখন-ই বিশ্বাস করতো না। সত্যিই মানুষকে কখনও উপর দিক দেখেই চরিত্র এঁকে ফেলা বোকামি। কার ভিতরে কি সুপ্ত অবস্থায় লোকায়িত আছে সেটা কেবল তারা-ই ভালো জানে। শান্ত তার কাঁপা হাতটা তানবীরের কাঁধে রাখল। তানবীর মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই সে আকুতিভরা কন্ঠে বলল,

— ‘ অনেক বলেছেন৷ অনেকটুকু জেনেছি। আর জানতে চাই না৷ প্লিজ এসব মনে করে নিজেকে আর কষ্ট দিবেন না। ‘
— ‘ বলা যে প্রয়োজন। নতুবা তোমাকে ধোয়াশায় রেখে নিজে শান্তি পাব না৷ ‘
— ‘ আমার কোনোকিছু নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ‘
— ‘ কিন্তু আমার যে আছে। ‘

তানবীরের হঠাৎ দৃঢ় গম্ভীর কন্ঠে শান্ত ধমে গেল। তার বিরুদ্ধে আর কোনো বাক্য উচ্চারণ করতে পারল না। তানবীর সামনের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আবারও অতীতের স্মৃতি আওড়াতে লাগল,

— ‘ সেই মমতাহীন মহিলা শুধু আমাকে নষ্ট করেই ক্ষান্ত থাকল না৷ আমার শেষ সম্বলটুকুও আমার থেকে কেঁড়ে নিলো। ‘

তানবীরের কন্ঠস্বর এবার যেন আটকে যেতে চাইছে। এই নির্মম সত্য কথাটা তার গলা দিয়ে বাহির হতে চায়ছে না। সে অবশেষে জোর খাটিয়ে বলে উঠল,

— ‘ আমার বাবাকে আমার থেকে কেঁড়ে নিয়েছে উনি। আমাকে পুরোপুরি এতিম বানিয়ে দিয়েছে। ‘

শক্ত হৃদয়ের আদলে গড়া ছেলেটে যেন এবার চুপসে গিয়েছে। ছেলেদের কান্না হয়তো এই সমাজের চোখে বেমানান। তাই নিঃশব্দে গাল বেয়ে কষ্টের বিষাদময় অশ্রুকণাগুলো গড়িয়ে পড়তে লাগল। শান্ত এই পরিস্থিতিতে কিভাবে সামলাবে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। তার চোখজোড়াতেও জলধারা এসে ভিড় জমিয়ে। সে স্বান্তনার ভরসা দিয়ে নিজের হাতটা তানবীরের বাহুতে রাখল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চাইল। যেন নিঃশব্দেই বলে দিচ্ছে আমি আছি। আর কেউ না থাকলেও আমি আছি।
তানবীর মলিন মুখে ঈষৎ হাসল। শান্তর নরম কোমল হাতটা টেনে এনে নিজের মুঠিদ্বয়ে আবদ্ধ করলো। খানিকটা গলা কেশে পরিস্কার করে বলল,

— ‘ মায়ের এই বিশ্বাসঘাতকায় বাবার কিছু যায় আসেনি। সে এমনটাই সবার চোখের সামনে প্রকাশ করতো। বড়রা দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বললেও অকপটে নাকচ করতো। খুবই স্বাভাবিক চলাফেরা ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন সেটা কখনও বুঝতে দেননি। এক দিকে আমাকে সামলিয়েছেন। নিজের সব দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু শরীরও যে মনের সঙ্গে পরিপূরক। তাই বেশিদিন এই অভিনয় চালিয়ে যেতে পারেননি। আকষ্মিক মেজর হার্ট অ্যাটাকে বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমি না তখন পুরোপুরি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। জানো, বাবার মৃত্যুতে কান্না পর্যন্ত করতে পারিনি। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছিলাম দমটা গলা অব্দি এসে আঁটকে যাচ্ছিল। সেই সময়টা সাদি-অর্ণব পুরোটা সময় আমার পাশে থাকত। পড়াশোনাসহ সবকিছু বাদ দিয়ে আমার বাসাতেই পড়ে থাকত। আমিও কোনোরূপ বাঁধা দিতে পারতাম না। নিজেকে তখন কেবল একটা প্রাণহীন জড়বস্তু মনে করতাম। কিন্তু এইভাবে তো আর দিন চলবে না৷ তাই দাদি জোর খাঁটিয়ে আমাকে আমাদের দাদার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। দাদি দাদার ভিটে ছেড়ে আমার সাথে ঢাকায় এসে থাকতে পারবে না। আর মা-বাবা ছাড়া একটা ছোট ছেলের পক্ষে একা জীবন কাটানোও সম্ভব নয়। তাই আমাকেও একপর্যায়ে তার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কাছে হার মেনে চাঁদপুরে যেতে হলো। সাদি-অর্ণবও তাতে বেশ খুশি হয়েছিল। যাক তাহলে অবশেষে আমার এই অবস্থার কিছু একটা উন্নতি হবে।
দাদির সাথেই চাঁদপুরে থাকতে লাগলাম। নিজের ভিতরকার উগ্র মনোভাবটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। একেবারে চুপচাপ বাক্যহীন একটা ছেলেতে পরিণত হতে লাগলাম। দরকারেও কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হতো না। বৃদ্ধ দাদি বহুত চেষ্টা করতো আমার মন ভালো করার। কিন্তু তারপরও আমি যেন আমার রঙহীন দুনিয়াতেই মগ্ন থাকতাম৷
অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে দাদি এক মস্ত বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
আমার ছোট ফুফির পাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল। তাই দাদির জরুরি তলবে দাদার বাড়িতে এসে উপস্থিত। সঙ্গে তার স্বামীসহ ছেলে-মেয়ে সবাই।
গ্রামে এখনও বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। কানাঘুঁষাতে আইনের কান পর্যন্ত গেলে হয়তো আটকে যায়। কিন্তু এখনও আইনের আগোচরে এমন অগণিত ঘটনা ঘটে আসছে৷ আমার দাদি যদিও তখনকার যুগ অনুসারে শিক্ষিত ছিলেন তারপরও আমার এই অবস্থায় অশিক্ষিতদের মতন-ই কাজ করে বসেন।
সবাইকে উপস্থিত রেখে তার ঘোষণা জানান দেন যে, ফুফির বড় মেয়ে যে কি-না আমার-ই সমবয়সী তার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়া হবে। এবং সেটা ঐদিন-ই।
ফুফি-ফুফা প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে মেনে যায়। হয়তো কেউ কেউ বুঝিয়েছে বাবা-মায়ের অবর্তমানে সব ধন-দৌলত আমার। তাই সম্পত্তির লোভে হোক আর যায় হোক বিয়েতে তারা আর না করতে পারেনি।
বিয়ে নিয়ে সবার এতো ব্যস্ততার মধ্যে আমি নির্বাক ছিলাম। হ্যাঁ বা না কিছুই বলিনি। শুধু দাদিকে এতটুকু বলেছিলাম আমার জীবনে কোনো মেয়ের অস্তিত্ব আমি রাখতে চাই না। তাই এই বিয়ে আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু দাদি তাতে ঘোর অমত পোষণ করেন। আমাকে মৃত্যু বাবার কসম দিয়ে বিয়েতে রাজি হতে বলে৷ তখন আর আমি না করতে পারিনি। কেননা তখন আমার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দোহায় আমাকে দেওয়া হয়েছিল।
গ্রামের মানুষজন এমনকি কাকপক্ষীর অনুপস্থিতিতে একেবারে সাধারণভাবে কাজি ঢেকে আমাদের বিয়েটা পড়ানো হয়। তখন যেহেতু দুইজনই অপ্রাপ্তবয়সের ছিলাম, তাই আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ে সম্ভব হয়নি। শুধু ধর্মমতে বিয়েটা হয়।
আমার সদ্য বিবাহিত বউয়ের সাথে আমার তখনও কোনোরকম কথাবার্তা হয়নি। এমনকি সেইদিন রাতেও না। পুরোটা রাত আমি গ্রামের ক্লাবঘরে কাটিয়ে পরের দিন দুপুরবেলায় বাড়ি ফিরি। কিন্তু অবাক করার বিষয় ছিল কেউ আমাকে এই নিয়ে কিছু বলেনি। আমিও তাই আর মাথা ঘামায়নি।
এরপরের দিন-ই দাদি বউসহ আমাকে ঢাকায় ফিরে আসতে বলেন। আমি কিছুটা অবাক হলেও কোনোরূপ প্রশ্ন করেনি। আসলে কিছু জানা বা বুঝার তখন একেবারেই ইচ্ছে ছিল না।
তাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসলাম৷ গ্রামের মেয়েদের এইট-নাইনে উঠলেই বিয়ে দেওয়ার অগণিত ঘটনা রয়েছে। তাই আমার বউয়ের এই নিয়ে খুব একটা জড়তা দেখতাম না। সবটুকু জড়তা কেবল আমার মধ্যেই কাজ করতো। কেননা কম বয়সী মেয়েদের বিয়েটা অনেক হলেও কমবয়সীদের ছেলেদেরটা সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র পরিসরের।
আমি ঢাকায় ফিরেছি জেনে সাদি-অর্ণব সেদিনই বাসাতে এসে হাজির। কিন্তু আমার সাথে তাদের-ই সমবয়সী এক ছোট্ট মেয়েকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক জেনে তারা যেন বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। পরে অবশ্য এই নিয়ে তারা অনেক হাসাহাসি করে। আমার প্রাক্তন বউ, মানে কেন প্রাক্তন বলছি সেটা একটু পরেই জানতে পারবে। সে গ্রামের মেয়ে হলেও বেশ মিশুক ছিলো। অর্ণব, সাদিদ সাথে খুব সহজেই ভাব জমে গেল। যেহেতু আমাদের তিনজনের-ই সামনে পরীক্ষা ছিল তাই গ্রুপে পড়া শুরু করি। আগে আমি অনিচ্ছা প্রকাশ করলে শুধু সাদি-অর্ণব জোর খাটাতো। কিন্তু তখন তাদের সাথে নতুন করে যুক্ত হয় প্রিয়তী, আমার কিশোরী বউ। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও মুখ বুঁজে সহ্য করার চেষ্টা করতাম৷ কিন্তু একসময় বিরক্ত হয়ে অকারণেই তার সাথে রাগারাগি করতাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর দূরসম্পর্কেরও কোনো সম্পর্ক ছিল না। সে নিজের দুনিয়াতে এবং আমি নিজের দুনিয়াতে মগ্ন থাকতাম। একসাথে থাকবো কি, নিজের ত্রি-সীমাতে তাকে আমার সহ্য হতো না। এমনকি আমার রুম তো দূরে থাক দ্বিতীয় তলাতে তার উঠা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। এভাবেই দিন কাটতে থাকে। সে চাকর-বাকর আর পড়াশোনা নিয়েই সারাদিন সময় পার করত। দেখতে দেখতে আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসলো। আর তাকে গ্রামে ফিরে যেতে হলো। কেননা সে তখনও গ্রামের স্কুলেই রয়েছিল। আমিও আগ বাড়িয়ে টান্সফারের কথা তুলেনি। কেননা তাকে সহ্যই করতে পারতাম না। তাই যত দূরে থাক ততই যেন ভালো।
সে যেদিন পরীক্ষার জন্য গ্রামে ফিরে যাবে তখনই কেবল একবার সাহস করে আমার রুমে পা দিয়েছিল। আমি তখনও রেগে কয়েকটা কটু বাক্য শুনাতে পিছুপা হয়নি। কিন্তু জানো, সে একদম রাগ করেনি। কিন্তু তার চকচক করা চোখ আমার নজর এড়াতে পারেনি৷ সে নিজের মতো করে পরীক্ষার জন্য শুভকামনা এবং আমাকে নিজের যত্ন নেবার কথা বলে চলে গেল।
কয়েকটা দিন গায়ে মাখলাম না। কিন্তু একটা সময় বাড়িতে খানিকটা একাকিত্ববোধ করতে শুরু করি। প্রথমে কারণটা স্বীকার করতে না চাইলেও পরে মেনে নিতে হয় আমি প্রিয়তীকে মিস করছি। কেননা সবতো আগের মতোই রয়েছে। কেবল প্রিয়তী অনুপস্থিত। তারপরও তাকে ফোন বা দেখা করার চিন্তা মাথাতেও আনেনি। একপ্রকার নিজের উপর জোর খাটিয়ে পরীক্ষাগুলো শেষ করলাম।
কিন্তু রাগ তখন হলো যখন দাদির কাছ থেকে জানতে পারলাম প্রিয়তী না-কি ঢাকায় আসবে না। পরীক্ষা শেষ তারপরও কেন আসবে না এই বিষয়টা আমি একদমই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই কোনোকিছু চিন্তা না করে সেদিন-ই ডাইভার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদপুরের উদ্দেশ্য রউনা দিলাম। আমাকে হঠাৎ চাঁদপুর দেখে সবাই খানিকটা অবাক হলেও আমার অগোচরে মিটমিটিয়ে হাসছিল। সেগুলো একপ্রকার দেখেও পাত্তা দেয়নি। তার পরের দিন প্রিয়তীকে সহ ঢাকাকে ফিরে আসি। আমার এককথাতেই প্রিয়তী হাসিমুখে চলে আসতে রাজি হলো।
তারপরের দিনগুলো যেন বেশ স্বাভাবিক কাটতে লাগলো। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের কোনোরকম উন্নতি না হলেও অবনতির চেয়ে অনেকটা ভালো। প্রিয়তী সবসময় বড় মানুষের মতো আমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করত। কি লাগবে না লাগবে এসব নিয়ে পিছনে ঘুরঘুর করতো। আগে এসবে বিরক্ত হলেও তখন আর হতে পারতাম না। কেন যেন না চাইতেও ভালো লাগত। আপন বলতে কেউ ছিল না তো, তাই প্রিয়তীর অল্প খেয়ালটুকুতেই ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করে।
অল্প অল্প ভালোলাগা, অল্প অল্প মুগ্ধতায় একসময় তার মায়াতে পরে যেতে বাধ্য হলাম। কিন্তু তখনও স্বীকার করেনি। চলতে দিয়েছিলাম যেভাবে চলছিল।
আমাদের রেজাল্টও ততদিনে পাবলিশ হয়ে যায়। আমরা চারজন-ই ভালো গ্রেডে পাস করলাম। এবার আমার ইচ্ছেতেই প্রিয়তীসহ আমরা একই কলেজে এডমিশন নিলাম। কিন্তু গ্রুপ আলাদা হওয়াতে কলেজে আমাদের একসাথে সময় খুব কম-ই কাটত। এটাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যাটা উপলব্ধি করি প্রিয়তীর মনোভাব দেখে। কেননা কলেজে এডমিশন নেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই প্রিয়তী যেন হুট করেই পাল্টে যেতে শুরু করে। আগে যেমন আমার সাথে সময় কাটানোর জন্য বাহানা খুঁজে চলত, এখন আমি পাশে থাকলেও সে উধাও। আমাদের রেগুলার ল্যাবে কাজ থাকত। তাই প্রিয়তীকে বলতাম ডাইভার নিয়ে চলে যেতে। কিন্তু সে একরোখা হয়ে না করত। আর আমার ছুটি হলে একেবারে আমাকে নিয়ে বাসায় আসত। প্রথমে তার কথা ভেবে না করলেও পরে যেন আমিও এটাতে অভ্যস্ত হতে লাগলাম। মেয়েটা নিজেকে আমার অভ্যাসে পরিণত করেছিল। যার ধরুন একটা মুহূর্ত তাকে ছাড়া ভালো লাগত না৷
কিন্তু এই মেয়েটাই এখন ছুটি হলে বাসায় যাওয়ার জন্য অস্থির হতে শুরু করত। তাই কলেজে অদেখা, আসা-যাওয়াতে অনুপস্থিতির জন্য আমাদের মধ্যে বেশ দূরত্ব চলে আসে। বাসাতেও প্রিয়তী রুম থেকে বের হতো না৷ আর আমিও কখনও ওর রুমে পা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতাম না। তাই কখনও ডেকে এনে কথা বলা বা গল্প করা হতো না। সময় যত বাড়ছিল দুইজনের দুরত্ব যেন ততই বহুগুণে বেড়ে চলছিল। আর আমাকে বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হয়েছিল যে আমি তার প্রতি দুর্বল। পবিত্র সম্পর্ক বলে না অন্যকিছু সেটা আমার জানা ছিল না। কিন্তু মানতে আমি বাধ্য ছিলাম, নিজের বিবাহিত বউয়ের প্রতি আমার ততদিনে টান তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাকে আমি চাই। ‘

তানবীর থামল। এতক্ষণ একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে সবটা বলছিল। এখন ঘাড় ঘুরিয়ে শান্তর মুখপানে তাকালো। মেয়েটার মুখটা মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। তানবীর সেটার কারণ সম্পর্কেও অবগত। কিন্তু করার কিছু নেই। সত্য বরাবরই তিক্ত হয়। আর সেটা যদি তিক্ত অতীত সেটা তা আরও ভয়াবহ। কিন্তু মাঝপথে এসে থেমে গেলে যে হবে না৷ অতীতের জন্য নিজের বর্তমানকে ঠকানো উচিত নয়। আর সেটা যদি হয় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তাহলে সেখানে ধোয়াশার রেশ পর্যন্ত থাকতে দেওয়া ঠিক নয়। নতুবা বারবার এই অতীতের বিষাক্ত তিক্ততা এসে ভবিষ্যৎকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যাবে। তাই সে আবারও বলতে লাগল,

— ‘ কিন্তু আমি চাইলেই তো সবকিছু হবে না। প্রিয়তীরও আমাকে চায়তে হবে। কিন্তু তার আচরণে এমন কিছুই আর অবশিষ্ট দেখতে পেতাম না। নিজের আপন পরিবার বলতে কেউ ছিল না। তাই আপনের থেকেও আপন দুই বন্ধুকেই তখন নিজের সমস্যাটা খোলে বলি। তারা সবকিছু শুনে প্রিয়তীর সাথে সরাসরি কথা বলতে বলে৷ কেননা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা আর বাকিসব সম্পর্কের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সামান্য কিছু ভুল-বোঝাবুঝি, মান-অভিমানের জন্য পাহাড় সমান দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাই সেই সমস্যাগুলোই কখনও নিজেদের মধ্যে আসতে দেওয়া ঠিক নয়। আর আসলেও যত দ্রুত সম্ভব সমস্যার সমাধান বের করা উচিত। তাই আমিও এমটাই ঠিক মনে করলাম। প্রিয়তীর সাথে কথা বলতে হবে৷ দুইজনে বসে কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলোর পথ খুঁজতে হবে।
এমনটাই মনোভাবনা সাজিয়েছিলাম। প্রিয়তী আগেই বাসায় চলে গিয়েছিল। তাই আমরাও কলেজ শেষ করে বাড়ির পথে রউনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু পথিমধ্যে এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমরা তিনজনই থমকে গিয়েছিলাম। নিজের কানকেই তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
প্রিয়তী আর আমার বিয়ে সম্পর্কে কলেজের কেউ জানত না। শুধু আমাদের একসাথে আসা যাওয়াতে রিলেটিভ মনে করতো। আর আমরাও কখনও সম্পর্কের বিষয়ে খোলাসা করিনি। কিন্তু সেদিন আমাদের ক্লাসের-ই কয়েকজন প্রিয়তীকে জড়িয়ে একটা ছেলের সাথে আজেবাজে বকছিল। তাদেরকে না-কি প্রায়-ই কলেজের পিছনের গাছতলায় দেখা যায়। কয়েকজন না-কি লুকিয়ে তাদেরকে বেশ আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছে। এসব নিয়েই কয়েকজন বেশ হাসাহাসি করছিল। যেহেতু আমাদের সম্পর্কে কিছু জানে না তাই অকপটেই বন্ধু হিসেবে আমার সামনেই কিছু বিশ্রি কথা বলে ফেলছিল। সাদি-অর্ণব আমার পাশেই ছিল। তাই সেখান থেকে একপ্রকার জোর খাটিয়েই নিয়ে আসে। আর অনবরত বুঝাতে থাকে শুনা কথায় কান না দেওয়ার জন্য। প্রিয়তীর সাথে সরাসরি যেন এই নিয়ে আলোচনা করি।
মাথা গরম করে গিয়েছিল। তারপরও বহুত কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বাসায় আসি। কোনোদিন যা করিনি বাধ্য হয়ে সেদিন সেই কাজটাই করে বসি। বাসায় ফিরে নক না করেই সোজা প্রিয়তীর রুমে ডুকে পরি। যেহেতু নক করেছিলাম না তাই প্রিয়তীও বুঝতে পারেনি। সে সদ্য গোসল করে বেড়িয়েছিল। ওড়নাটা বিছানায় রাখা। তাকে প্রথম এই অবস্থায় দেখে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিলাম। শত হলেও তখনতো আর ততটা ছোট নয়। নিজের বিয়ে করা বউকে এই অবস্থায় দেখলে কার মাথা ঠিক থাকে? ভিতরে অস্থিরতা চরম ছিল। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিলাম না। প্রিয়তীও আমার হঠাৎ এমন আগমনে বেশ বিব্রতবোধ করছিল। তাই আমি যেই কথা বলতে এসেছিলাম সেটা আর বলা হলো না। চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে আসি। কিন্তু নিজের মধ্যকার অস্থিরতা কোনোভাবেই কমছিল না। একতো প্রিয়তীর সাথে সরাসরি কথা হলো না, দ্বিতীয়ত রুমে ঘটে যাওয়া সেই পরিস্থিতি। বারবার প্রিয়তীর সেই অবস্থাটা চোখের সামনে এসে আমাকে বেশ বিরক্ত করছিল। সেদিন আর দুইজনের কেউ কারও সামনে আসিনি। আমি নিজের কারণটা সম্পর্কে অবগত। কিন্তু প্রিয়তীরটা জানা ছিল না। রাতটা আমার বেশ কষ্টে পার হয়। সবকিছু ভেবে অতঃপর আমি নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নিব। বাকি দশটা কাপলের মতো আমিও এখন প্রিয়তীকে নিজের পাশে চাই। তার সান্নিধ্যে চাই। তাকে আর দূরে রাখার মনমানসিকতা আমার নেই।
এইভেবে নিজেকে খুব হালকা লাগছিল। বেশ খুশিও ছিলাম৷ অন্যদিন তাড়াতাড়ি কলেজে যেতে হলেও সেদিন আমি বসে থেকেই প্রিয়তীকে নিয়ে একসাথে বের হই। নিজের মনকে সামলাতে না পেরে প্রথমবার প্রিয়তীর হাতটা নিজের হাতের মুঠিতে নিয়েছিলাম। আমার মধ্যে ভালোলাগা কাজ করছিল। কিন্তু প্রিয়তীর চোখে-মুখে সেটা পরখ করতে পারলাম না। বরং সেখানে ছিল যেন আতংকের ছাপ।
কিন্তু সে হাতটা সরিয়ে নেয়নি। পুরোটা রাস্তা গাড়িতে চুপচাপ বসেছিল।
আমাকে হাসিখুশি দেখে সাদি-অর্ণবও ভেবেছিল আমাদের মধ্যে বোধহয় সবকিছু ঠিক আছে। তাই তারাও নিজেদের ক্লাসে মনোযোগী হলো। কিন্তু আজকেও ক্লাসের পিছন থেকে কিছু ছেলের ফুসুরফাসুর শুনে আমাদের দৃষ্টি সেদিকে গেল। তারা গতকালকের ছেলেগুলো-ই ছিল৷ তাই না চাইতেও আমার মন সেদিকে ছুটছিল। কিন্তু তাদের কাছে গিয়ে যেসব দেখি আমার যেন মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা। প্রিয়তীর সাথে আমাদের-ই সিনিয়র একজনের ঘনিষ্ঠ কিছু মুহূর্তের ছবি নিয়ে তারা হাসাহাসি করছিল। মাথা তখন আর ঠিক নেই। সজোরে তাদের ফোনটা নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে মারি। আর যা হবার সেটাই হলো৷ মারামারি, কথা-কাটাকাটিতে একসময় আরও তিক্ত কিছু কথা সামনে চলে আসে। আমিও আর একমুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা করিনি৷ এইসব ক্লিয়ার না হলে আমি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাব। তাই দৌড়ে কলেজের পিছনে গাছতলায় যাই। আমার পিছনে পিছনে সাদি-অর্ণবও ছুটে আসে। ছেলেগুলো মিথ্যা বলেনি।
আমার-ই চোখের সামনে আমার-ই বউ অন্যকারও বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। শুধু এতটুকুই নয়। তারা একে-অপরের মধ্যে নিজেদের উষ্ণতা বিলিয়ে দিতে ব্যস্ত।
এই অবস্থায় দুইজনকে দেখে আমার পৃথিবী যেন থমকে গিয়েছিল। আবারও পরকীয়া!
যা আমার সোনালী অতীতের বিনষ্টকারী, সেটা আবারও আমার বর্তমানকে জ্বালিয়ে দিতে চলে এসেছে? আর পারছিলাম না। শরীরে রীতিমতো আগুন জ্বলছিল। আমাদের উপস্থিতি ততক্ষণে তারাও বুঝে যায়। আর প্রিয়তী সেখানে আমাকে দেখে রীতিমতো বেশ ঘাবড়ে যায়। কিন্তু আমি কোনো রিয়েক্ট করিনি। শুধু সবার সামনেই টেনেহিঁচড়ে তাকে গাড়িতে এনে ফেলি। চারপাশ থেকে অনেক প্রশ্ন আসলেও সেগুলোর উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না।
বাসায় এনে সোজা তাকে আমার রুমে নিয়ে যাই। এতক্ষণের পুষিয়ে রাখা সবটুকু রাগ-ক্ষোভ তাকে আঘাত করে যেন কমাতে চেষ্টা করি। অন্য সময় হলে নিজের কাছে অনুতপ্ত হতাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে রাগে আমার শরীর রীতিমতো কাঁপছিল। প্রিয়তী প্রথম অবস্থায় ভয়ে চুপ থাকলেও যখনই আমি রেগে গিয়ে তার গায়ে হাত তুলি তখন আর নিজের রাগটা ধমন করতে পারেনি। এককথায় – দুইকথায় আমাদের সম্পর্কটার সেদিন-ই ইতি ঘটে। কেননা প্রিয়তীর ভাষ্যমতে মেহেদী ভাইয়ের সাথে সে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে। আমি যখন প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক জেনেও সে কিভাবে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে? তখন সে খুবই স্বাভাবিক স্বরে বলেছিল,
— ‘ এটাকে কোনো সম্পর্ক বলে? বিয়ে হয়েও তুমি আমার থেকে দশহাত দূরত্ব বজায় রেখে চলো৷ আমিও একজন মেয়ে। ছেলে সান্নিধ্যে আমিও চাই৷ কিন্তু নিজের স্বামী যদি এতটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে তাহলে যে বাহিরে যেতে বাধ্য। ‘

আমার তখন তার কথাগুলো জাস্ট আগুনের মতো লাগছিল। যার তাপ সহ্য করা ভীষণ কষ্টদায়ক। এটা কোনো কথা? আমাদের দুইজনের তখন অল্প বয়স। তারউপর আমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে তার সবটুকুই প্রিয়তীর জানা। তাহলে কিভাবে আমার সামান্য একটু দূরত্বে সে নিজের জীবনে অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দিবে? কেন? অল্প একটু সময় অপেক্ষা করলে কি হতো? এমন তো নয় যে আমাদের বিয়ের বয়স পার হয়ে গিয়েছে! নরমালি যেই সময়ে ছেলেমেয়েদের সম্পূর্ণ মনোযোগ পড়াশোনা নিয়ে থাকে সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমাদের বিয়েটা হয়। তাহলে তখনই কি আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করে দেওয়া উচিত ছিল? আমার এত কেনোর উত্তরেও প্রিয়তীর মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখিনি৷ বরং সে বেশ গম্ভীর ভাবে নিজের প্রতিউত্তর জানিয়েছে, গ্রামে তার বয়সী মেয়েদের না-কি বিয়ে হয়ে বাচ্চা-কাচ্চা পর্যন্ত হয়ে যায়। সেখানে তার স্বামী যদি একবাড়িতে থেকেও হাজার মাইল দুরত্বে থাকে তাহলে সে পরকীয়াতে যাবে না তো কে যাবে?
এমনটাই তার সোজাসাপটা উত্তর ছিল।
আর তাতেই যেন আমাদের সম্পর্কটা শুরু হবার আগেই অনলের দহনে পুড়ে ছারখার হলো।
বড়দের কানে কথাটুকু গেলে তারা আমাকে বুঝিয়েছে প্রিয়তীকে ভালোভাবে বুঝাবে। স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কে এমন টুকিটাকি ঝামেলা নাকি হয়। কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। স্ত্রীর হাজার সমস্যা নিয়ে সংসার করা যায়। কিন্তু আর যাই হোক চরিত্রহীন স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করা যায় না।
যেহেতু আমাদের বিয়ের সময়ে রেজিস্ট্রি হয়নি তাই বিচ্ছেদের সময়ে এতসবের ঝামেলার দরকার ছিল না। কিন্তু আমি আর কোনোরকম ঝামেলা রাখতে রাজি ছিলাম না। নিজ দায়িত্বে আমাদের প্রাপ্তবয়স হলে ধর্মমতে এবং আইনিভাবেও তালাক সম্পূর্ণ করি। ‘

তানবীর থেমে গেল। এতক্ষণের সবগুলো বাক্য এতটায় বিষাক্ত ছিল যে তার গলা ধরা আসছে। অতীতটা যেন আমারও এসে শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। শান্তর মুখেও শব্দ নেই। সবসময় দুষ্টুমি খুনসুটিতে মেতে থাকা একটা ছেলের হাসিখুশি মুখের পিছনে যে জীবনের এতটা তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সেটা হয়তো তানবীরকে না দেখলে কখনও বিশ্বাস করতে পারত না। সত্যিই মানুষের ভিতর না দেখে যারা বাহির যাচাই করে থাকে তাদের এই মনোভাব বর্জন করা উচিত।
দীর্ঘ শব্দহীন মুহূর্তের পর তানবীর ঘাড় ফিরিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। তার মুখভঙ্গি দেখে বুঝা যাচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিটা সেও সহজে মেনে নিতে পারছে না। তারপরও সে তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

— ‘ তাহলে এখন বলো, পারবে এইরকম একটা ছেলের সাথে নিজের ভবিষ্যৎ এগিয়ে নিতে? তোমার মা-বাবা রাজি হবেন আদরের মেয়েকে এইরকম একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে? পারবে আমার এতগুলো তিক্ততা মেনে একটা এতিম ছেলেকে নিয়ে পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিতে? ‘

শেষ বাক্যটুকুতে শান্তর যেন দম আটকে যাবার অবস্থা। কি বলছে তানবীর এগুলো?
সে তানবীরের মুখে হাত চেপে ধরল। ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। ভরা আত্মবিশ্বাসের কন্ঠে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলল,

— ‘ পারব। আমি সবকিছু পারব। কিন্তু আর কখনও যেন নিজেকে এতিম বলে উল্লেখ করতে না দেখি। আমি আছি না? তাহলে এতিম কিভাবে হলেন? ‘

তানবীরের বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেলে। এতক্ষণের যে শ্বাসগুলো গলা পর্যন্ত এসে আটকে ছিল এখন যেন সবগুলো নিজেদের উল্লাসে বেড়িয়ে আসতে চায়ছে। তানবীর নিজের মুখের উপর শান্তর হাতটা সরিয়ে নিলো। নিজের দুইহাতের মুঠিতে শান্তর নরম হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞাসা কন্ঠে বলল,

— ‘ কিন্তু তোমার পরিবার? তারা কি আমার সম্পর্কে এতসব জেনে রাজি হবে? তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। আমি ছেলেটাই এমন। ‘
— ‘ ওহ্। এবার কিন্তু আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। শুনুন, লাইফে কিছু ইন্টারেস্টিং বিষয় থাকা প্রয়োজন। পরিবার ঝামেলা না করলে ভালো। আর যদি করে তাহলে আরও বেশি ভালো। নাতি-নাতনীদের বুড়ো বয়সে গল্প শুনানোর মতো কিছুতো থাকা প্রয়োজন। ‘

বলেই শান্ত দুষ্টু হেসে ভ্রুজোড়া নাচালো। দুষ্টুর শিরোমণি তানবীর যেন এবার চুপসে গেল। বলে কি এই মেয়ে!
কিন্তু পরমুহূর্তেই উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। তার বউ যদি তার মতো না হয় তাহলে কিভাবে হবে?
শান্তও হাসছে। এতক্ষণ তানবীরকে স্বাভাবিক করতে এতসব অকপটে বললেও এবার বেশ লজ্জা লাগছে। যার ধরুন তার মুখশ্রীতে লাজুক আভা ফুটে উঠেছে।
তানবীর তার মুখপানে তাকালো। তার লজ্জা পাওয়ার কারণ সবটাই বুঝতে পারল। সে হাসিমুখে শান্তর কাঁধ আগলে তাকে নিজের বুকে নিয়ে আসলো। শান্তও চুপচাপ তানবীরের বুকে মাথা রাখল। অনেকটা সময় নীরবে কেটে গেল। শুধু দুটি মানুষ অনুভব করলো নিজেদেরকে। অনুভব করলো একে অপরের অস্থির হৃদস্পন্দনকে।
তানবীর মাথা নিচু করে শান্তর মাথায় গভীরভাবে চুমু খেল।
শান্ত যেন লজ্জায় আরও গুটিয়ে গেল। এরিমধ্য শান্তর ফোনে তার বাবার কল আসাতে কাপলযুগলের প্রেমঘন মুহূর্তে বিগ্ন ঘটল। তানবীর ছেড়ে দিতেই শান্ত উঠে দাঁড়াল। তানবীরও উঠে দাঁড়াল। শান্ত কয়েককদম সামনে এগিয়ে কল রিসিভ করবে তার আগেই পিছন থেকে তানবীরের রাশভারি কন্ঠ শুনে থেমে গেল,

— ‘ এই মেয়ে শুন। ‘

শান্ত যেন একটু চমকে উঠল। এতক্ষণের এতো গম্ভীর কথাবার্তার পর এমন কন্ঠ শুনে চমকিত ভাবটা সত্যিই লুকাতে পারল না। তানবীর তার দৃষ্টি বুঝল। কিন্তু পূর্বেকার ন্যায় একি স্বরে বলল,

— ‘ আমি কিন্তু তোকে ভালো-টালোবাসিনা। নির্ঘাত ফেঁসে গেছি। ‘

শান্ত প্রথমে থতমত খেলেও পরমুহূর্তে হেসে ফেলল। কিন্তু নিজের হাসিটাকে দমন করার সম্পূর্ণ চেষ্টা করে বলে উঠল,

— ‘ আর শুনুন, আমিও কিন্তু আপনাকে ঐসব ভালো-টালোবাসিনা। নির্ঘাত মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি। ‘

দুইজনই হাসল। কিন্তু কারও হয়তো বুঝার বিন্দুমাত্র বাকি নেই যে এই হাসিতে কতটা তৃপ্তি লোকায়িত। কতটা প্রশান্তি মিশ্রিত৷

_______________

রাতের ঢাকা বরাবরই নীলার বেশ পছন্দ। দিনের কোলাহল শেষে রাতের এই নিস্তব্ধতাটুকুই যেন এখানে বসবাসরত মানুষগুলোকে একটু শান্তিতে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। নীলা গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে অপলক দৃষ্টিতে নীরব রাস্তাটার সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
আচমকা গাড়ি ব্রেক করাতে নীলার দৃষ্টিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলো। সে পাশ ফিরে ডাইভিং সিটে বসা সাদিদের মুখপানে তাকালো। তার নীরব দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছে এখানে কেন থামিয়েছেন। সাদিদ নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে গেল। নীলার পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে কথা নেই বার্তা নেই তাকে কোলে তুলে নিলো।

— ‘ আরে, আরে কি করছেন কি? কোলে নিচ্ছেন কেন? ‘

সাদিদ প্রতিউত্তর জানালো না। চুপচাপ নীলাকে কোলে নিয়েই গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলল। নিজে প্রথমে সীটে বসে নীলাকে তার কোলো বসালো৷ নীলা যেন নীরব দর্শক। এইছেলের হুটহাট কর্মকান্ড তার এখনও মাথায় আসে না।
নীলাকে কপাল কুঁচকে রাখতে দেখে সাদিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। একহাতে নীলার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরল। আরেকটা হাত নীলার ঘাড়ে রাখল। এতক্ষণ নীলা কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও এখন যেন বুঝার আর বাকি নেই৷ সাদিদের ঐ চোখজোড়া-ই যেন নীলাকে তার উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। সাদিদের মনোভাব বুঝে উঠতে পেরে নীলা সরে যেতে চাইল। কিন্তু সাদিদ কি নিজের পাওয়া না বুঝে এত সহজে ছাড়বে?
নীলার খোলা চুলগুলোকে আলতো হাতে মুঠো করে সাদিদ অধরজোড়া মিলিয়ে নিলো। নীলা ক্রমশ শিহরিত হয়ে সাদিদের পিঠ আঁকড়ে ধরতে চাইল। নিস্তব্ধ সড়কে যেন শুধু একজোড়া দম্পতির উষ্ণ নিঃশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। সাদিদের তৃষ্ণা যেন থামবার নাম নেই৷ এই রমণীর সান্নিধ্যে আসলে যেন তার পিপাসা শুধু বাড়তেই থাকে। শুধু যেন আরও চাই, আরও চাই৷ নীলার শ্বাস আঁটকে আসছে। তাই দম ফেলার জন্য সাদিদকে মৃদুভাবে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। সাদিদের যেন এবার রাগ লাগল। এই মেয়েটা সবসময় এমন করে। নিজেতো কখনও আগ বাড়িয়ে কাছে আসেই না, যখন সাদিদ কাছে টেনে নিতে চায় তখনও তার যতসব বাঁধা। তাই কিছুটা রাগ নিয়েই সে নীলার ঠোঁটে জোরে কামড় বসাল। তারপর এক ধাক্কায় দূরে ঠেলে দিলো।
নীলার ঠোঁট একদিকে জ্বলছে আর অপরদিকে সাদিদের এই রাগ। সে কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল। অতঃপর সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝতে পেরে আর কষ্ট পেল না৷ নিঃশব্দে হেসে সাদিদের গা ঘেঁষে বসল। সাদিদ তাকালো না পর্যন্ত। বরং একটু সরে বসল। নীলার এই মুহূর্তে চরম হাসি পাচ্ছে। সাদিদের এই ছোট্ট রাগ-অভিমানগুলো নীলার বড্ড কিউট লাগে। ইচ্ছে করে গালগুলো জোরে টেনে দিতে৷ কিন্তু এখন এমনটা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই নিজের মধ্যকার ইচ্ছেকে দমন করে আবারও সাদিদের পাশে বসল। সাদিদ এবার রাগ সামলাতে না পেরে গাড়ির দরজা খোলে বেড়িয়ে যেতে লাগল। নীলা দ্রুত তার হাত চেপে ধরল। সাদিদ রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই সে একটা শুকনো ঢুক গিলল। ভয়ে কাচুমাচু হয়ে সাদিদের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। সবটুকুই যেন সাদিদের রাগ ভাঙানোর নিনজা টেকনিক। কিন্তু সাদিদ এইসবের ধার ধারল না৷ আবারও হাত ছাড়িয়ে নিলো৷ সবসময় এইসব ভালো লাগে না৷ আর সবসময় এসব সহ্য করার মুডও থাকে না। ভালোবেসে কাছে টানলে যদি ছুটাছুটি শুরু করে এমনটা সহ্য হয়? তাও যদি সেটা নিজের বিয়ে করা বউ?
নীলা বুঝতে পারল পরিস্থিতি এবার বেশ গরম। তাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুদ্ধি বাহির করার চেষ্টা করছে। কি করা যায়?

— ‘ আউচ। আমার ঠোঁট ব্যাথা করছে। বোধহয় রক্তও বের হচ্ছে। ‘

সাদিদ দ্রুত নীলার দিকে তাকালো। রাগ এখনও বজায় রেখেছে। তাই নিজের তীক্ষ্ণ চোখে সম্পূর্ণ ঠোঁট পরখ করল। অতঃপর রক্ত না দেখে নীলার অগোচরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সাদিদ আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলাতে নীলা এবার অভিযোগের কন্ঠে বলল,

— ‘ আমি ব্যাথা পাচ্ছি। খুব জ্বলছে। ‘
— ‘ জ্বলার জন্যই দেওয়া হয়েছে। ‘
— ‘ ইশশ কি নিষ্ঠুর! ‘

সাদিদ নীলার বাহু শক্ত করে ধরে হেঁচকা টান দিলো৷ কিছুটা গম্ভীর মিশ্রিত রাগী কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আর তুমি? তুমি নিজে কি? সবসময় এসব ভালো লাগে? তুমি আমার স্ত্রী না? তাহলে আমার চাওয়া-পাওয়া তোমাকে বুঝতে হবে না? কেন সবসময় আমি-ই কাছে আসব? তুমি আসলে সমস্যাটা কোথায়? একবারও তো নিজে কাছে এসে দেখ না। উল্টো আমি যখন কাছে টানি তুমি এইসব শুরু করো৷ সবসময় কি একরকম মনোভাব থাকে? তোমার এইসব বুঝা উচিত না? ‘

সাদিদ নিজের বাক্যটুকু সম্পূর্ণ করেই নীলাকে আবারও ধাক্কা দিলো। আর বিড়বিড় করে বলল,

— ‘ পাষাণ একটা। ‘

নীলা নিচুস্বরটা শুনতে পেল। তখন তাল সামলাতে না পেরে গাড়ির দরজায় হালকা লেগেছে। ব্যাথাও খানিকটা পেয়েছে। কিন্তু আপাতত কোনো ব্যাথা গায়ে লাগছে না। মনে যে ব্যাথা সাদিদ তৈরি করেছে তার সামনে এগুলো খুব সামান্য।
সাদিদের থেকে এইসব শুনে নীলার কষ্টে বুকটা ফাটছে।
হ্যাঁ সে একটু অবুঝ৷ অনেকটা লজ্জায় মিইয়ে থাকে। তাই কখনও নিজে থেকে সাদিদের কাছে এগিয়ে যেতে পারে না। সাদিদ তো সবসময় বুঝে তার না বলা কথাগুলো। তাহলে আজ কি হলো?
কান্নাগুলো এসে গলায় দলা পাকাচ্ছে। আর নীলা
সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সেগুলোকে আটকে রাখার প্রয়াসে ব্যস্ত। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না। গাল বেয়ে টুপটুপ করে অশ্রুকণা ঝড়তে লাগল।
সাদিদের এদিকে খেয়াল নেই৷ সে চোখ বন্ধ করে ইতিমধ্যে সিটে হেলান দিয়েছে। প্রাণপাখিটার সাথে রাগ দেখিয়ে সে নিজেও পুড়ছে। চোখ বন্ধ থাকাতে নীলার ব্যাথাটুকুও দেখতে পায়নি৷ নতুবা হয়তো এতক্ষণে অস্থির হয়ে পড়ত। সাদিদ অভিমান করেছে। তাই নীলাও যদি এখন অভিমানের পর্ব নিয়ে বসে থাকে সেটা কি ঠিক হবে? কখনই নয়।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, মান-অভিমান অবশ্যই হবে৷ তাই বলে একজনে রাগ করলে অপরজনকে তখন পানি হতে হয়। নতুবা ছোট্ট একটা বিষয় বৃহৎ আকারে গিয়ে দাঁড়ায়। নীলাও তাই করলো। চুপচাপ সাদিদের কাছে গিয়ে তার বুকে মাথা রাখল। সাদিদ সাথেসাথেই চোখ খুলে তাকালো। নীলা কান্নারুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ প্লিজ আপনার বুকটায় একটু মাথা রাখি? আমার নিজের বুকটা বড্ড ব্যাথা করছে। ‘

সাদিদের সব রাগ যেন মুহূর্তেই পানি হলো। দুইহাতে নীলাকে আঁকড়ে নিলো। চোখে-মুখে অগণিত আদর দিলো। আদর দিতে দিতে যেন একপ্রকার হাঁপিয়ে যাওয়ার অবস্থা। তারপরও যেন প্রিয়তমার কষ্টগুলোকে একআকাশ ভালোবাসা দিয়ে দূর করতে চাইছে। এতক্ষণ কান্না আটকে রাখতে পারলেও এখন যেন সাদিদের ভালোবাসা পেয়ে সেটা আর সম্ভব হলো না। নীলা ডুকরে কান্না করে উঠল। সাদিদ তার কপালে চুমু খেয়ে বুকে আগলে নিলো। শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

— ‘ হুঁস। একদম কান্না নয়। ‘

কিন্তু চোখের পানি কি আর এসব মানে? নীলার কান্না থামছে না দেখে সাদিদ এবার আকুতিভরা কন্ঠে বলল,

— ‘ প্লিজ জান, আর কান্না নয়। আমি সরি বলছি৷ এভাবে রাগ দেখানোটা আমার ঠিক হয়নি। এবার চুপ করো। তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না পাখি৷ ‘

ধীরে ধীরে নীলার কান্নার বেগ কমে গেল। সে নিজেও নিচুস্বরে সাদিদের বুকে নাক ঘষে বলল,

— ‘ আমিও সরি। আপনি আর রাগ করে থাকবেন না। ‘

সাদিদ হাসল। নীলার মাথায় চুমু দিয়ে বলল,

— ‘ আচ্ছা রাগ করব না। কিন্তু পাখি এবার কিন্তু আমি সিরিয়াসলি বলছি, তাই মনোযোগ দিয়ে শুনো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটাতে কিন্তু বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷ তারপরও মানুষ হিসেবে সবার-ই কিছু চাহিদা রয়েছে। আর স্বামী হিসেবে তোমার কাছে অবশ্যই আমি কিছু আশা করি৷ এখন না হয় ঠিক আছে।
কিন্তু বাবা আসার পর যখন তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব তখন? সারাদিন ব্যস্ততায় কাটিয়ে সবসময় হয়তো মন-মেজাজ ঠিক নাও থাকতে পারে। তখন যদি তোমাকে আমার প্রয়োজন হয়। একান্ত কাছে চাই৷ আর সেইসময় যদি তুমি এমনটা করো আমার মাথা কি ঠিক থাকবে? হয়তো বা রাগ দেখাব না। কিন্তু যদি দেখায় তাহলে কষ্টটা কে পাবে? একদিকে তুমিও পাবে আরেকদিকে আমিও পাব। তাই আজ বাধ্য হয়ে এই কথাগুলো বলছি। তুমি যদি মাঝেমধ্যে এমনটা করতে তাহলে আমি হয়তো বলতাম না। কিন্তু তুমি এই কাজটা সবসময় করো। ‘

সাদিদ এবার থামল। নিচে তাকাতেই নীলাকে নতজানু হতে দেখল৷ অর্থাৎ সে নিজের সবসময়কার কথাগুলো ভেবেই অনুতপ্ত হচ্ছে। সাদিদ ছোট্ট একটা শ্বাস টানল। তারপর নীলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আবারও বলল,

— ‘ পাখি, তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। জীবনপথের সবটুকু পথ আমি তোমাকে নিয়েই পাড়ি দিতে চাই। তাই একদিনের প্রসঙ্গ হলে হয়তো বা এভাবে বললাম না। কিন্তু এখন বলতে হচ্ছে। কেননা তুমি এখনও বড্ড অবুঝ৷ সবগুলো মানতে পারলেও কিছু কিছু হয়তো আমার তোমাকে বলে দেওয়া উচিত। যেগুলো তুমি চেষ্টা করলেই শুধরিয়ে নিতে পারবে৷
মেয়েরা বরাবরই ছেলেদের তোলনায় লাজুক হয়। সেই জায়গায় তো আমার বউ আরও একদাপ এগিয়ে। ‘

— ‘ আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। ‘
— ‘ চুপচাপ যা বলছি শুনো। কথা না বুঝে কথা বললে মাইর দিব। ‘
— ‘ হুহ্ মাইর। মামার বাড়ির আবদার? ‘
— ‘ না গো সুন্দরী। আপনার জামাইয়ের আবদার। এখন আরেকটা কথা বলে বাধা দিলো মেরে তক্তা বানাবো। ‘

নীলার আর সাহসে কুলালো না কিছু বলার। এই ছেলের বিশ্বাস নেই৷ সাদিদ তাকে চুপসে যেতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকালো। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে সবটা বুঝিয়ে বলা উচিত। তাই আবারও বলল,

— ‘ তাই বলছি লজ্জা অবশ্যই পাবে৷ কিন্তু তাই বলে সবসময় যে লজ্জাকেই প্রাধান্য দিবে এটাতো ঠিক নয়৷ আমি তোমার স্বামী। তাই দিনশেষে আমারও কিছু চাওয়া আছে৷ যেগুলো পূরণ করার জন্য দিনশেষে অবশ্যই আমি তোমার কাছেই আসব। তখন যদি তুমি নিজের এই অবুঝপনায় আমাকে দূরে সরিয়ে দাও সমসময় কি আমি মেনে নিতে পারব? মানুষ হিসেবে রাগতো সবার-ই রয়েছে। তাই আমারও হয়তো বা রাগ লাগবে৷ তখন তোমার সাথে আজকের মতো খারাপ ব্যবহার করে ফেলব। যেটা আমি কখনও চাই না৷ আমি বরাবরই চেষ্টা করব এমনটা কখনও না করার। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে তোমারও তো কিছু দায়িত্ব রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী যদি দায়িত্বটা ভাগাভাগি করে নেই তাহলেই না সংসারটা সুখের হবে। তাই নয় কি? আর তাছাড়া আরেকটা কথা কি জানো? স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক। তাই যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সেটা সময় থাকতেই নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নেওয়া উচিত। যেন কখনও সেই সমস্যা সমাধানের সঙ্গী হিসেবে তৃতীয় পক্ষ না আসতে পারে। বুঝেছেন মহারাণী? ‘

নীলা মাথা উপর নিচ করল। অর্থাৎ এমনটাই৷ সাদিদ যেমন তার দিকটা খেয়াল করে। নীলাও সবসময় না পারুক কিন্তু সাদিদের দিকটা খেয়াল করার চেষ্টা করা তার অবশ্যই উচিত। আর আজ না হোক কাল তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি যে ঘটবে না সেটা কে বলতে পারে? তাই সময় থাকতেই নিজেদের সমস্যা একে-অপরের সহায়তায় মিটিয়ে ফেলা উচিত।
সাদিদ মৃদু হাসল। নীলাকে বুকে চেপে ধরে বলল,

— ‘ এইতো আমার পাখিটা বুঝে গিয়েছে। এখন দেখি ঠোঁটটা। আহ্ লাল হয়ে রয়েছে। এখনও ব্যাথা আছে? ‘
— ‘ বেশি না অল্প। ‘

সাদিদ হাসল। আলতো করে ঠোঁটটা ছুঁয়ে দিলো। বরাবরের ন্যায় বলল,

— ‘ ব্যাথাটুকু শুষে নিয়েছি। আর যন্ত্রণা হবে না। ‘ ‘

নীলা হেসে ফেলল। সাদিদও মৃদু হাসল। সাদিদ তাকে আবারও বুকে আগলে নিয়ে খনিকের জন্য আঁখিদ্বয় বন্ধ করল। একটু অবুঝ, একটু চঞ্চল। কিন্তু দিনশেষে যেন এই মেয়েটাতেই যেন সাদিদ প্রশান্তি খুঁজে পায়। আর সে এটাতেই খুশি৷ আর সারাজীবন যেন তারমধ্যেই প্রশান্তি অনুভব করতে পারে এমনটাই নিজের কাছে তার একমাত্র চাওয়া।

চলবে…