অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৬+৭

0
892

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ০৬

” নীলাঅঞ্জনা, আমার কথা শুনতে পারছ? ”

রাতের প্রথম প্রহরের বৃষ্টির কণাগুলো এসে নীলার চোখের পাতায় ভিড় জমিয়েছে। আধখোলা চোখে সাদিদকে তার কাছে এক মায়ার জাল মনে হচ্ছে। যে জালে নীলা ক্রমশ নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে। সাদিদ যেন তার মায়াজালে নীলাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যেতে বাধ্য করছে। আর নীলা তাকে বাধা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত শক্তি খোঁজে পাচ্ছে না।
নীলাকে এমন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদিদ আবারও বলে উঠল,

—- ” এই যে ভাবুকরাণী কোথায় হারালেন? ”

বাহুতে সাদিদের মৃদু ধাক্কায় নীলা এবার বাস্তবে পদার্পণ করল। এতক্ষণ যে সে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করেছে। সাদিদকে ঘিরে একঝাঁক সুখ কল্পনা। সাদিদের দিকে তাকাতেই সে ভ্রু নাচিয়ে আবার বলল,

—- ” অবশেষে বাস্তবে ফিরলে তাহলে? আমিতো ভেবেছিলাম নিজের প্রেমিক পুরুষকে ছেড়ে এই জন্মে আর আসবে না। কল্পনার রাজ্যেই প্রেমিকযুগল বাসা বাধবে। তোমাদের সাক্ষাৎ এই জীবনে পাব, এমনটার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম। ”

সাদিদের কথায় আর নিজের বর্তমান পরিস্থিতিতে নীলার গাল ঈষৎ লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। অনবরত বৃষ্টির জল আর আধো আলো-অন্ধকার অবস্থায়ও নীলার সে রক্তিম মুখের আভা সাদিদের নজর এড়ায়নি। সে নীলার চোখের আড়ালে অপরদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসল।
নীলা এতক্ষণ কি করছিল ভাবতেই সে লজ্জায় মিইয়ে গেল। নিজের বোকামি চিন্তা করে সে এবার মাথা নিচু করে নখ খুঁটে যাচ্ছে।
একি হয়ে গেল তার? যাকে মনে মনে এত অপছন্দ-ঘৃণা করে তাকে নিয়েই কল্পনায় এত গভীর চিন্তা-ভাবনা!
দুইজনের কল্পনায় দেখা ঘনিষ্ঠরত অংশগুলো চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই, নীলা আবারও লজ্জায় কেঁপে উঠল।
চোখ উপরে তুলে আড়চোখে একবার সাদিদকে পরখ করতে চায়ল। হিতে আরও বিপরীত হলো।
কেননা সাদিদ মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে প্রাণপাখির লজ্জায় লাল হওয়া মুখটার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে তার নেশা-মুগ্ধতার এক মিশ্র সংমিশ্রণ।
নীলা আর সহ্য করতে পারল না। ফিরে যাবার জন্য পিছু ঘুরতেই সাদিদ তার হাত টেনে ধরল।
অন্যসময় হলে নীলা হয়তো ঝাঁকি দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিত। কিন্তু এইমুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। একঝাঁক লজ্জা এসে নীলাকে ঘিরে ধরেছে। সাদিদের জন্য এতদিন রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা বরাদ্দকৃত থাকলেও লজ্জার আভাস ছিল না।
কিন্তু আজ যেন এক চিলতে লজ্জা দিয়ে সাদিদ তার সমস্ত অপরাধ, নিজের করা ভুল শুষে নিচ্ছে। সে যেন বিন্দু পরিমাণ দোষের কণা রাখতে চায়ছে না। এবং নিজের শোষনে নীলাকে সে পুরোপুরি নিংড়ে দিচ্ছে।
সাদিদ বিনাবাক্য নীলার হাতের মুঠোয় তার ফোনটা দিয়ে দিলো। তারপর এককদম এগিয়ে এসে নীলার পিছনে দাঁড়ালো। স্পর্শ না করেই সে বুঝতে পারছে নীলার শরীরের প্রবহমান কম্পন।
সাদিদ মাথা নুইয়ে পিছন থেকেই নীলার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচুস্বরে বলে উঠল,

—- ” লজ্জায় রাঙা রক্তিম বর্ণে মেয়েদের যে এতটা মায়াবী লাগে, সেটা আজই প্রথম বুঝতে পারলাম। কিন্তু, লজ্জার কারণটা কি আমি? ”

সাদিদের মোহনীয়স্বরের তীরটা যেন একেবারে নীলার বুকে এসে লেগেছে। নীলা আর একমুহূর্তে সেখানে দাঁড়ালো না। দৌড়ে বাসার গেট পেড়িয়ে সে ভিতরে ঢুকল।
সাদিদ একদৃষ্টিতে তার গমনপথে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আজ তার চোখে কোনো না পাওয়া কষ্ট নেই। অবহেলায় জর্জরিত বুকে রক্তক্ষরণ নেই।
আজ বুকে বয়ছে প্রশান্তির শীতল বায়ু। তার প্রাণপাখির চোখে সে আজ নিজের জন্য অনুভূতি দেখেছে। তার কল্পনাজুড়ে কেবল সাদিদ বিচরণ করেছে। কল্পনায় সাদিদের স্পর্শে সে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছে। আজ যেন সাদিদ সবকিছুই পেয়ে গিয়েছে।
নীলাবিহীন মৃদু অন্ধকারভরা ফাঁকা এই রাস্তার দিকে তাকিয়েই সাদিদ উচ্চস্বরে বলে উঠল,

—- ” আমি জানি প্রাণপাখি। এমনকি আগেও জানতাম।
কিন্তু না তোমার উপর জোর খাটাতে চেয়েছি, না নিজে জোরপূর্বক কিছু করতে চেয়েছি। অতিতের নিয়ন্ত্রণহীন ভুল আরও একবার করতে চাইনি। তাই তোমাকে এই সময়টুকু উপহার দেওয়া।
রাগ-ক্ষোভের আড়ালে নিজের অনুভূতিগুলোকে বুঝে উঠবার জন্য, আমার এই ক্ষীণ মুহূর্ত অপেক্ষা। আমার বিশ্বাস তুমি নাম না জানা সেই অনুভূতিগুলোর অর্থ খোঁজে নিবে।
আর না পারলে আমিতো আছি। তোমার এই প্রেমিক পুরুষ নিজের প্রাণপাখির পথ চেয়ে বসে আছে অহর্নিশি। কেবল হাতটা বাড়িয়ে দাও, বুকে আগলে নিতে প্রস্তুত। হৃদমাঝারে ঘর বানিয়েছি পাখি। ঘরের মালকিন হয়ে নিজের ঘর গুছিয়ে নাও। ”

বলে সাদিদ নিজেই হাসল। ফাঁকা রাস্তায় তার শেষের কথাগুলো এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
ভিজে চুলগুলো একবার ঝেড়ে নিয়ে সে গাড়িতে গিয়ে বসল। শার্ট, ট্রি-শার্টেরও নাজেহাল অবস্থা। এই অসময়ের বৃষ্টিতে জ্বর আসার সম্ভাবনায়, সাদিদ হাত উঁচিয়ে গায়ের জামাগুলো খোলে নিলো। লুকিং গ্লাসের দিকে খেয়াল যেতেই সাদিদের ঠোঁটের কোণে আবারও মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল।
সিটে হেলান দিয়ে সে চোখ বন্ধ করল। তারপর ডানহাতটা বুকের বা পাশে ঠেকিয়ে ধরল। কিছুসময় আগেও এই জায়গায় তার প্রাণপাখির অবস্থান ছিল। সে ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত করে নিজের মনে আওড়াল,

—- ” চলে আস পাখি, খুব দ্রুত চলে আস। এই বুকের মালিক তোমার অপেক্ষায় অধির আগ্রহে অপেক্ষমান। ”

.

নীলা রুমে ঢুকে দরজাটা ঠাস শব্দের আওয়াজে বন্ধ করে দিলো। হাঁটু গেড়ে দরজায় ঠেস দিয়ে বসেই সে জোরে জোরে শ্বাস টানতে লাগল। আজকের প্রতিটা মুহূর্তের কথাগুলো ভাবতেই নীলার শরীরে আবারও মৃদু কম্পনের আবির্ভাব দেখা দিচ্ছে।
সে চোখজোড়া বন্ধ করতেই আবারও সাদিদকে নিজের কল্পনার রাজ্যে আবিষ্কার করল। সাদিদের হৃদয় কাঁপানো স্পষ্টগুলো সে কেঁপে কেঁপে অনুভব করছে। কল্পনায় বিরাজমান থেকেও সে যেন নীলার সর্বাগ্রে শিহরণের ঝড় তুলছে।
নীলা কাঁপা হাতগুলো নিয়ে নিজের গাল ছুঁয়ে দিলো। এখানেই তো সাদিদ তখন নিজের বলিষ্ঠ হাতটা রেখেছিল। বলেছিল মনের কিছু অব্যক্ত কথা।
কিন্তু সবটাই কেবলমাত্র কল্পনা। নীলার এই সুখরাজ্যের ভবিষ্যৎ কেবলমাত্র কল্পনায় সীমাবদ্ধ।
নীলা চোখ খুলল৷ আর তার বুক চিড়ে বেড়িয়ে আসলো এক দীর্ঘনিঃশ্বাস।
সাথে মনের কোঠাতে জমা হলো, সমস্ত শরীর অস্থির করা কিছু অনুভূতি। কষ্টময় কিছু না পাওয়া প্রশ্নের উত্তর।

নীলার হাতের মুঠোতে এখনও সাদিদের তুলে দেওয়া মুঠোফোনটা রয়েছে।
বুকে সীমাহীন ঝড় নিয়ে নীলা মোবাইলের কনটাক্ট লিস্টে ঢুকে শান্তকে কল করল। নীলার যে এই অজানা অনুভূতির বেড়াজাল থেকে পরিত্রাণ চাই। নিষ্কৃতি চাই নামহীন এই তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা থেকে।
দুইবারের মাথায় শান্ত কল রিসিভ করল। নীলা এতটা অস্থির ছিল যে তাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই নিজের প্রশ্নভান্ডার খোলে বসল,

—- ” কখনও কি ঘৃণাকারীকে আপন ভাবা যায়? নিজের কৈশোর নষ্টকারী সেই মানবকে নিয়ে কল্পনার সুখ রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া যায়? হয় কি কখনও রাগ-ক্ষোভের বাহিরে গিয়ে তার প্রতি কোমল অনুভূতির সৃষ্টি? ”

নীলার আটকে আসা অস্থির কন্ঠে শুনে, শান্ত ফোনের অপরপাশে নিঃশব্দে হাসল। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না।
বান্ধবী বললে হয়তো সম্পর্কের গভীরতাটা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পাবে না। যদি বোন সম্বোধনে সম্পর্কের সেই গভীরতা প্রকাশ পায়, তাহলে সেটাই গ্রাহ্য। নিজের বোন সমতুল্য প্রিয় বন্ধুর এমন অস্থির কন্ঠে শান্ত অবাক বা বিচলিত কিছুই হচ্ছে না।
সে সম্পূর্ণ স্থির এবং স্বাভাবিক। দেখে মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ বর্ণনায় আঁকা দৃশ্যপটগুলো তার চোখের সামনে ভাসছে। তাই নিজের পূর্বের জানা কথাগুলো শুনে সে এখন বিচলিত নয়।
শান্তর থেকে কোনোরকম উত্তর না পেয়ে নীলা আবারও ব্যাকুলতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল,

—- ” প্লিজ সাহায্য কর। আমার মনে হচ্ছে আমি নিজের অনুভূতি বুঝতে পারছি। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন মন-মস্তিষ্ক সেটাকে মানতে রাজি নয়। শান্ত আমি তাদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছি না, হাত বাড়িয়ে সাহায্য কর।
তুই আমাকে জানিস, কোনোকিছুই তোর কাছে অজানা নয়। তার সর্ম্পকেও তোর সবকিছু জানা। এইমুহূর্তে তোকে ছাড়া আমি আর কারও কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত এই প্রশ্নের উত্তর পাব না। প্লিজ উত্তর দে, কেন হচ্ছে এমন? নিজের এই অপরিচিত-অজানা, নামহীন অনুভূতি আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। আমি এলেমেলো হয়ে যাচ্ছি। অনুভূতিগুলোর নাম জানতে আমাকে সাহায্য কর। সেই কঠিন শব্দটা আমি মুখে উচ্চারণ করতে পারছি না। কন্ঠস্বরটা আটকে আছে।
আমি কি সত্যিই তাকে…..
প্লিজ চুপ করে থাকিস না, আমাকে সাহায্য কর

—- ” আমি সর্বজান্তা নই, নই কোনো প্রেম-ভালোবাসায় ডিগ্রিধারী মহান কোনো মানবী। আমি এক অতিসাধারণ সত্তা। আর তোর জন্য সবথেকে বড়, রক্তের সম্পর্ক না থেকেও আমি তোর বোন। শরীরে রক্তের ভিন্নতা থাকলেও অন্তরের নেই। তোর হৃদমাঝারের গভীরে উঁকি দিয়ে দেখতে আমাকে কোনো পাহারাদার আটকাতে পারবে না। নীল, তুই আমার কাছে পানির ন্যায় স্বচ্ছ। ”

শান্ত এবার থামল। ফোনের অপরপাশে কানে ধরে রাখা ফোনটা নিয়ে, নীলাও লম্বা করে শ্বাস টানল। বন্ধুর ন্যায় সমতুল্য এই বোনটা কখনও এত সিরিয়াস ভঙ্গিতে তার সাথে কথা বলে না। হাসিঠাট্টায় নীলাকে মানাতে বাধ্য করে সে অবুঝ-পাগলাটে। কিন্তু সে যে তা নয়।
মুখে অবুঝপনা হলেও অন্তরে তার বিশাল গম্ভীরতা। যা নীলাকে আরও আতংকিত করে তুলছে। কি উত্তর আসবে? শান্ত তাকে কি বলবে?
এখন যে শান্তর কথা সে বেখেয়ালিপনায় এড়িয়ে দিতে পারবে না। শান্ত যে তার অস্বীকার করার সমস্ত রাস্তা সূচনাতেই বন্ধ করে দিয়েছে।
শান্ত ফোনটা নিয়ে উঠে বিছানা থেকে বারান্দায় গেল। বৃষ্টিস্নানরত প্রকৃতিপানে তাকিয়ে বলে উঠল,

—- ” তখন অবুঝ ছিলাম। সম্পূর্ণ কৈশোর পেরিয়ে যখন যুবতীর ঢেউ ছুঁয়ে গেল শরীর-মন তখন থেকেই উপলব্ধি করি।
কিন্তু তুই সবসময় অস্বীকার করতি, অনুভূতিকে পেরিয়ে জোরপূর্বক ঘৃণাকে সামনে নিয়ে আসতি। চাই চুপ ছিলাম। বলতে গেলে তোকে আশায় রেখে নিরাশা করার ইচ্ছা ছিল না। তাই বুঝতে পারলেও কখনও মুখ ফুটে তোকে বলিনি। তোর মতোই অবুঝের ভান ধরতাম।
কিন্তু সত্যিই যদি, তুই তাকে ভালোবাসিস নীল। আমি আবারও বলছি তুই তাকে ভালোবাসিস। এবং এটা বিশুদ্ধ পানিয় জলের ন্যায় পরিষ্কার। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের ন্যায় চিরন্তন সত্য।
বোন, তুই তাকে ভালোবাসিস। শুধু আজ থেকে নয়, তাকে তুই সেই কৈশোরবেলা থেকেই ভালোবাসিস। ”

শান্তর কথাগুলো নীলার কর্ণকোহরে পৌঁছাতেই নীলার হাত থেকে ফোনটা ধপ করে নিচে পড়ল।
শরীর জুড়ে বয়ে গেল শীতল একটা বাতাশ। সর্বাগ্রের লোপকূপগুলো শিহরিত হয়ে দাঁড়িয়ে শরীরে কাটা দিলো।
নীলা কয়েক মুহূর্ত স্থির থেকে, তার অসার হয়ে যাওয়া পা-গুলো তুলে সামনে এগিয়ে গেল। আলমারি খোলে নিজের লকারটা খুলল।
কাঁপা হাতে নিজের নীল রঙের ডাইরিটা হাতে নিলো। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখা মিলল কাঙ্ক্ষিত সেই মুখ। নীলা ভেজা শরীরেই ছবিটা হাতে তুলে নিলো। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল ক্ষণিকের আগের বৃষ্টিস্নানরত বারান্দায়।
নীলা নিচু হয়ে বারান্দায় দেয়ালে ঠেস দিলো।
ছবিটা আবারও চোখের সামনে মেলে ধরল। সাদিদের বাংলাদেশে থাকাকালীন সম্ভবত বুয়েটে পড়াকালীন একটা ছবি।
সিলেটের বিছানাকান্দিতে বড় পাথরের উপর দাঁড়িয়ে, প্রকৃতির সৌন্দর্যগুলো সে আপনমনে ক্যামেরাবন্দি করছে। নীল শার্টে তাকে নীল আকাশের ন্যায় বিশালতায় ভরা স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের প্রতিবিম্ব মনে হচ্ছে। চারপাশের এত নীলের সমারোহে, সেই সৌন্দর্য যেন মাথাতুলে দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
জিন্সের নিচুভাগ মুড়িয়ে উপরে তুলে রাখাতে, বয়ঃসন্ধিতে বেড়ে উঠা লোমশ পা-গুলো খানিকটা দৃশ্যমান।
প্রকৃতিতে মুগ্ধ থাকা তার-ই মুগ্ধতায় ঘিরা দীপ্তিময় এই মুহূর্তটা কেউ যে ক্যামেরাবন্দি করছে, সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।
নীলা নিজের অজান্তেই ছবিটা বুকে চেপে ধরল। সাথে সাথে শরীরজুড়ে আবারও বেয়ে গেল হিমশীতল একটা হাওয়া।
নীলার ঠোঁটের কোণে এবার মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। এবং ক্রমানয়ে সেটা বিস্তৃত হলো।
নীলা ছবিটা বুকে শক্ত করে চেপে ধরে মুখে হাসি নিয়ে বলে উঠল,

—- ” আপনি খুব-ই খারাপ। জঘন্যতম খারাপ। নিজে অনুপস্থিত থেকেও সারাটা সময় আমাকে জ্বালিয়েছেন। পুড়িয়ে-পুড়িয়ে অঙ্গার করেছেন। আর দেখুন, অবশেষে ভদ্র মেয়েটাকে চোর উপাধিও দিয়ে দিয়েছেন। ”

বলেই নীলা আবারও নিজের মনেই হাসল। ছবিটা মুখের সামনে ধরে কান্নারুদ্ধ অভিমানী কন্ঠে বলে উঠল,

—- ” আপনার এই ছবিটা আপনাদের বাড়ির অ্যালবাম থেকে, সবার দৃষ্টির অগোচরে নিজের কাছে এনে লুকিয়ে রেখেছি। সেই বহুবছর আগে। এতটা আগে যে দিনক্ষণ ভুলে গিয়েছি।
দেখেছেন আপনাকে ঘৃণা করি, অথচ আপনার ছবি-ই এনে নিজের কাছে জমা রেখেছি। কি অদ্ভুত না?
কিন্তু জানেন, ছবিটা কেন রেখেছিলাম তার উত্তর সেদিনও খোঁজেছি। কিন্তু পাইনি। তখন আপনার উপর রাগের পরিমাণটা আরও বেড়েছে। অভিমানের পাহাড়টা আরেকটু নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। আজ সেই কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সমাধান খোঁজে পেলাম। কিন্তু অঙ্কটা বড্ড কঠিন ছিল। করতে বহুত কসরত হয়েছে।
শুধু আমি নয়, অদ্ভুত তো আপনিও। আমাকে এত যন্ত্রণায় একা ফেলে চলে গিয়েছেন। আপনার পিছনে কেউ যে প্রতিটা মুহূর্তে দগ্ধ হয়েছে সেই খবরটা আপনি রাখেননি।
আপনি শুধু অদ্ভুত-ই নন আপনি একটা পাষাণ। ছোট্ট একটা মেয়েকে এতটা বছর প্রশ্নের বেড়াজালে রেখে কষ্ট দিয়েছেন। ক্রমাগত বুকের বামপাশে রক্তক্ষরণ করেছেন।
তাই শুনুন, আপনাকে আমি ক্ষমা করব না। ”

বলেই নীলা ছবিটা নিজের থেকে দূরে সরিয়ে নিলো। চোখগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন চাঁদহীন আকাশে সীমাবদ্ধ করে আবারও অভিমানী কন্ঠে বলে উঠল,

—- ” আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন, অনেক কষ্ট। নামহীন অনুভূতির বেড়াজালে প্রতিটা মুহূর্ত আপনি আমাকে পুড়িয়েছেন।
এত কেন কষ্ট দিয়েছেন? ”

নীলার অভিমানী কন্ঠের কাঙ্ক্ষিত উত্তর আসে না। ঝুমঝুম বৃষ্টির আওয়াজে নীলার অভিমানের কণ্ঠস্বরে ভাটা পড়ছে। ক্ষীণ হয়েছে চোখের পাপড়ির চলমান গতি। রাতের দ্বিতীয় প্রহরের শেষভাগের আঁধারে ছেয়ে গেছে চারপাশ।
নীলা তখনও সাদিদের ছবি হাতে বারান্দায় বসে। চোখ বন্ধ করেই ডানহাতে ধরে রাখা সাদিদের ছবিটা এনে সে বুকে ঠেকালো। আটকে যাওয়া কন্ঠে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করল,

—- ” ভালোবাসা। ”

__________________

ডাইনিং টেবিলে লোকসমাগম না দেখে সাদিদ কিছুটা অবাক হলো। সাতসকালে বাড়ির পরিবেশ এতটা নিস্তব্ধ দেখে সাদিদের ঠিক মনে হচ্ছে না। শাদ, নিধি, শাহেদ কাউকে না দেখে তার ভ্রুজোড়া খানিকটা কুঁচকে এলো। মাকেও দেখা যাচ্ছে না। তাই গলা ছেড়ে ডাক ছাড়ল,

—- ” মা, এই মা বাড়ির সবাই কোথায়? ”

শায়লা রহমান ডাইনিং রুমের পাশের রুমে ছিলেন। তাই সাদিদের ডাক শুনে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলেন। হাতের ফোনটা টেবিলে রেখে খাবারে হাত দিতে দিতে বললেন,

—- ” তুই এসে গেছিস? বস আমি এখনই খাবার দিচ্ছি। ”

—- ” মা, সেই জন্য ডাক দেয়নি। বাড়ির সবাই কোথায়? কাউকে যে দেখতে পাচ্ছি না! ”

—- ” আর বলিস না রে। নীলা মামনির শরীরটা ভালো না। তোর ভাইয়া-ভাবী, শাদকে নিয়ে মিরপুর গেছে। আমিও যেতাম কিন্তু নিধি মা বলল চিন্তা না করতে। হসপিটাল নেওয়ার প্রয়োজন হলে তখন জানাবে। মাত্রই সেই কথা-ই বলে আসলাম। ”

সাদিদ পুরো তব্দা বনে গেছে। একরাতের ব্যবধানে তার প্রাণপাখির কি হয়েছে?
কালতো লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিল, দৌড়ে সাদিদের থেকে পালিয়েছে। তাহলে আজ?
সাদিদ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াতেই শায়লা রহমান বলে উঠলেন,

—- ” কিরে উঠছিস কেন? নাস্তা করবি না? ”

—- ” মা আমি আসছি। ”

শায়লা রহমান পিছন থেকে নাস্তা করে যাওয়ার জন্য বলছেন। কিন্তু সাদিদ আর পিছু ফিরল না। দ্রুত পায়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে গেল।

.

প্রচন্ড জ্বরের কারণে নীলার শরীর নিধি বারবার ঠান্ডা পানি দিয়ে মুছে দিচ্ছে। শাহেদ পাশে বসেই তার কন্ডিশন খেয়াল করছে।
তারা নীলার খবর জানার পর একেবারে সকাল সকাল-ই এখানে চলে এসেছে। তখন জ্বরে গা পুড়ে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। আরিফ মাহমুদ এবং নার্গিস খাতুন মেয়ের হঠাৎ এমন খারাপ অবস্থা দেখে প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কি করবেন না করবেন কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে, শাহেদকে কল দিতেই তারা এখানে এসে হাজির হয়।
শাহেদ মেডিসিন দেওয়াতে এখন টেম্পারেচার একটু নিচে নামছে। নীলাও দুর্বল শরীরে কিছুক্ষণ আগে চোখ বন্ধ করেছে।

তাদের নীলাকে নিয়ে এমন ব্যস্ততার মধ্যেই কেউ একপ্রকার হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করল।
সাদিদ এসেছে, তার পিছন পিছন আরিফ মাহমুদও রুমে প্রবেশ করলেন।
নীলার শুকনো মুখটা দেখে সাদিদের বুকে তীক্ষ্ণ ফলার ন্যায় অনুভব হচ্ছে। সে ধীর পায়ে নীলার দিকে এগিয়ে গেল।
নীলার চোখজোড়া বন্ধ। কপালে সাদা পাতলা সুতি কাপড়ের পট্টি দেওয়া। সাদিদ বুঝতে পারছে না তার এখন কি করা উচিত।
নীলার উপরে তার অধিকার নেই। এমনকি তার অনুভূতির কথা গুটিকয়েক সদস্য ব্যতিত সবার জন্য অজানা। এমতাবস্থায় সাদিদের বুকে নীলার জন্য যে অস্তিরতা হচ্ছে সেটা প্রকাশ করা কি উচিত হবে? সেটা নিয়েই সাদিদ সন্দিহান।
সাদিদ একপলক শাহেদের দিকে তাকালো। শাহেদের এদিকে খেয়াল নেই। সাদিদ লম্বা শ্বাস টেনে নিধির উদ্দেশ্য বলল,

—- ” ভাবীমণি সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। কফি দিতে পারবে? ”

—- ” এমা! এতক্ষণ বলনি কেন? তুমি একটু বসো আমি নাস্তা দিচ্ছি। ”

বলেই নিধি তড়িঘড়ি করে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। আরিফ মাহমুদ দরজা খোলে দিয়ে সাদিদের সাথে এসেছিলেন। এবার তিনিও প্রস্থান করলেন।
সাদিদ এবার নীলার পাশে চেয়ার টান দিয়ে বসল। একদৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে থেকেই শাহেদের উদ্দেশ্য বলে উঠল,

—- ” ভাইয়া ওর শরীরের এখন কি কন্ডিশন? ”

—- ” এখন একটু উন্নতির দিকে। আমরা সকালে যখন এসেছিলাম তখন বেশ খারাপ ছিল। হসপিটালে নেওয়ার চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ”

—- ” আমাকে জানাওনি কেন? ”

সাদিদের শান্তস্বরের মধ্যে যে প্রবল রাগ প্রকাশ পাচ্ছে, শাহেদের সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। আর সাদিদের এমন করাটাও অস্বাভাবিক নয়। কেননা শাহেদের যে, নীলার প্রতি সাদিদের অনুভূতি অজানা নয়। তাই শাহেদ ভাইয়ের রাগ কমাতে স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল,

—- ” তোকে গতকাল বেশ রাত করে, ছাদ থেকে নিচে যেতে দেখেছিলাম। আর নীলার খবর জানতে পারি খুব ভোরে। তাই তোকে আর বলিনি। ভেবেছিলাম পরে জানাব। ”

—- ” তুমি ভেবেছিলে…

সাদিদের প্রচন্ড রাগ লাগছে। কিন্তু রাগের মাথায় সে ভাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চায় না। তাই বারকয়েক লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলল,

—- ” হঠাৎ করে এতো জ্বরের কারণ কি? কিছু বুঝতে পেরেছ? ”

—- ” আসলে…

—- ” থামলে কেন? বলো কিভাবে হয়েছে। ”

—- ” ভোরে আম্মু নামাজ পড়ে এসে, নীলাকে বারান্দায় সেন্সলেস অবস্থায় পেয়েছিল। ধারণা করা যাচ্ছে সারারাত হয়তো বৃষ্টিতে ভিজেছিল। আর ঠান্ডায়, অতিরিক্ত জ্বরে জ্ঞান হারিয়েছে। ”

সাদিদ একদৃষ্টিতে শাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখের ভঙ্গিতে ভিতরে চলমান মনের অবস্থা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।
কিন্তু ধীরে ধীরে মুখের কিঞ্চিৎ চমকিত ভাবটা কেটে গিয়ে, রাগের আভাস ফুটে উঠল।
শাহেদ তার দিকেই তাকিয়েছিল। তাই দ্রুত বলে উঠল,

—- ” প্লিজ সাদি, পাগলামি করিস না। সবকিছু চিন্তা করে তারপর কিছু করবি। ”

—- ” ভাইয়া, একটু একা ছেড়ে দাও। ”

—- ” দেখ সাদি…

—- ” ভাইয়া প্লিজ। ”

সাদিদের গম্ভীরস্বরের সামনে শাহেদ আর কিছু বলতে পারল না। শাদমানকে কোলে নিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেল।
যাওয়ার আগে দরজাটা সে হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে গেল। শাহেদ রুমের বাহিরে রাখা পাশের সোফায় গিয়ে বসল। কেননা সাদিদ-নীলাকে এইরকমভাবে একরুমে দেখলে, কেউ বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে হয়তো নিবে না। আর এইমুহূর্তে অযথা ঝামেলা বাড়ানোর ইচ্ছে শাহেদের নেই।
তার বিশ্বাস সাদিদ যেহেতু বলেছে সঠিক সময়ে সবাইকে সবটা বলে দিবে, তারমানে বলে দিবে। আর নিজের ভাইয়ের উপর তার শতভাগ বিশ্বাসও রয়েছে। তাই সাদিদকে আর বাধা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না।

সাদিদ নীলার বন্ধ চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার এখন মায়া-রাগের এক মিশ্র সংমিশ্রণের অনুভূতি হচ্ছে। একদৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, তার ক্ষোভের পাল্লাটা এবার নিচে নেমে গেল।
চোখজোড়াতে এসে ভিড় করল প্রাণপাখির জন্য একসমুদ্র মায়া। মুঠো করে রাখা শক্ত হাতদুটো ক্রমশ হালকা হয়ে এলো।
সাদিদ নীলার কপাল থেকে সাদা কাপড়টা নিয়ে আবারও সেটা জলে ভিজিয়ে কপালে দিলো।
ডান হাতটা দিয়ে নীলার গলায় স্পর্শ করতেই, নীলা ঘুমের ঘোরেই খানিকটা কেঁপে উঠল।
সাদিদ জ্বরের অবস্থাটা চেক করে ভালোভাবে কাথাটা তার শরীরে দিয়ে দিলো।
নীলার চোখ-মুখ খানিকটা ফুলে আছে। মুখটা একটু শুকনোও লাগছে। ঠোঁটগুলো রুক্ষ হয়ে আছে কিন্তু জ্বরের তুপে ঈষৎ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে।
সাদিদ নীলার গালে হাত রেখে নিজের মুখটা খানিকটা নিচে নামিয়ে আনলো। কপালের কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে, নীলার ছোট চুলগুলো মাথায় হাত বুলিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দিলো। তারপর উষ্ণ ঠোঁটদুটো দিয়ে নীলার কপালে স্পর্শ করল। গভীর ভালোবাসায় প্রাণপাখির কপালে দীর্ঘ চুমু খেল।
সাদিদের স্পর্শে নীলার ঘুমন্ত শরীরেও রক্তগুলোর চলাচল দ্রুত হলো। শিরা-উপশিরায় শিহরণের স্পর্শের জানান দিলো।

নীলা চোখ খোলে তাকালো। মাথাটা ভার হয়ে আছে, খানিকটা ব্যাথা করছে। সে চারপাশে নজর বুলালো, কিন্তু রুমে সে ব্যতিত আর কারও দেখা মিলল না। রুমের বাহির থেকে নিধির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।
নীলা দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে বসতে গেল। তারমধ্যেই নিধি দরজা ঠেলে রুমে ঢুকল।
নীলা উঠে বসতে চায়ছে দেখে নিধি দ্রুত এগিয়ে এসে সাহায্য করল।

—- ” এখন কেমন লাগছে রে পিচ্চু? ”

নীলা উত্তর না দিয়ে অবাক চোখে নিধির দিকে তাকিয়ে আছে। নিধির হঠাৎ আগমন, তার উপর কেমন প্রশ্ন করছে!
নীলার মনোভাব বুঝতে পেরে নিধি এবার অভিযোগের স্বরে বলে উঠল,

—- ” এমন কেউ করে? তুই জানিস আমরা সবাই কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? তোকে ঐ অবস্থায় দেখে আম্মুতো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল। ”

নীলা কেবল চমকিত দৃষ্টিতে নিধির দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলছে নিধি এসব? সব নীলার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। নীলাকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে এমন বিচলিত দেখে, নিধি তার অগোচরে কি কি হয়েছে বলতে লাগল।
সবকিছু শোনার পর নীলার মন খারাপটা আবারও বেড়ে গেল। চোখের সামনে আবারও সবকিছু ভেসে উঠল। আর সাথে সাথেই যুক্ত হলো বুকে এক তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা।
নীলা নিজের মনের অবস্থা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। তাই সবকিছু সাইডে রেখে অপরাধী কন্ঠে বলল,

—- ” সরি আপুনি, তোমাদের সবাইকে টেনশনে ফেলে দিলাম। ”

—- ” ধ্যাত! বোকা মেয়ে একটা। তুই বস আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি। খেয়ে ঔষধও খেতে হবে। ”

নিধি উঠে যাওয়ার জন্য দাঁড়াতেই নীলা পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরল। ইতস্ততভাবে বলে উঠল,

—- ” তুমি আসার আগে, না মানে এই রুমে কি কেউ…

নীলার কথা না বুঝতে পেরে নিধি বলে উঠল,

—- ” কি বলছিস পিচ্চু? বুঝতে পারছি না। ভালোভাবে বুঝিয়ে বল। ”

—- ” না মানে তুমি আসার আগে এই রুমে কেউ ছিল? ”

—- ” হ্যাঁ ছিল তো…

নিধি আর কিছু বলে উঠতে পারল না। শাহেদ দরজা ঠেলে রুমের ভিতরে প্রবেশ করল। নিধিকে তাড়া দিয়ে বলল,

—- ” নিধি, নীলার জন্য হালকা কিছু খাবার নিয়ে আস। ঔষধ খেতে হবে। ”

শাহেদের কথা শুনে নিধিও খাবার নিয়ে আসতে চলে গেল। তাই নীলা ভিতরে হাসফাঁস করতে লাগল।
কেননা তার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। ঘুমের মধ্যেও তার শরীরজুড়ে শিহরণ বয়ে গেছে। তাই নীলা যতক্ষণ উত্তর না পাবে নীলার শান্তি লাগছে না।
শাহেদ নীলার শেষের কথাটা শুনেছিল। তাই কিছু একটা ভেবে বলে উঠল,

—- ” কি যেন বলছিলে? ও রুমে কেউ ছিল কিনা?
জিজু তোমার পাশে বসা ছিলাম। কেন, কোনো প্রয়োজন? ”

—- ” না জিজু এমনি। ”

নীলা প্রসঙ্গ পাল্টালো। শাহেদের কথায় আস্বস্ত হলেও মন তার অন্যকিছু বলছে।
আচ্ছা নীলার মন যা বলছে সেটা কি সঠিক হতে পারে? কোনোভাবে কি সে?
নীলা নিজেকে ধমকালো। নিজের এমন বোকামিমার্কা ভাবনায় সে এখন নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত।

_______________________

ছোট্ট শাদ নীলার বিছানায় তার গাড়ি দিয়ে খেলা করছে। নীলা হেলান দিয়ে বসে তার এসব দুষ্টুমিভরা চঞ্চলতা দেখে মৃদু হাসছে। শাহেদ আবারও দুপুরে এখানে আসবে। তাই নিধি নার্গিস খাতুনের সাথে রান্নাঘরে সাহায্য করছে। আরিফ মাহমুদকে নীলা অনেকক্ষণ যাবত দেখছে না। হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত, তাই নীলাও আর খোঁজ করেনি।
শাদের খেলা দেখতে দেখতেই নীলার আচমকা কিছু মনে হতেই মুখে আতংক ফুটে উঠল। দ্রুত সে বিছানা থেকে নামল।
মাথাটা একটু ব্যাথা করছে তারপরও নীলা দেয়াল ধরে ধরে বারান্দায় আসলো। এদিক-ওদিক তাকিয়েও কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা খোঁজে না পেয়ে নীলার চোখে-মুখে ভয়ার্তের ছাপ ভেসে উঠল। কিন্তু কিনারায় একটা ফুলগাছের টবের পিছনে নজর যেতেই নীলার মুখে হাসি ফুটল।
সে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে সাদিদের ছবিটা হাতে তুলে নিলো।
ছবিটাতে বৃষ্টির পানি দেখেই নীলার বুক ফেটে কান্না করতে মন চাচ্ছে। গায়ের ওড়না দিয়ে ঝাপসা চোখে সে ছবিটা মুছতে লাগল। ছবিটার এই অবস্থা দেখে, কষ্টে যেন নীলার সমস্ত শরীর জ্বলে উঠছে।

—- ” নীলাঅঞ্জনা? ”

নীলার এমন অবস্থার মধ্যে পিছন থেকে খুব পরিচিত কারও গম্ভীরস্বরে নীলা আতংকে পিছনে ফিরল।
সাদিদের চোহারায় রাগ স্পষ্ট। নীলা দ্রুত ছবিটা ওড়নার পিছনে লুকিয়ে মাথা নিচু করল।

—- ” এই অবস্থায় এখানে কি করো? ”

নীলা উত্তর না দিয়ে এখনও মাথা নিচু করে আছে। সাদিদ হঠাৎ করে নীলার এত জড়তা বুঝে উঠতে পারছে না। তাই আবারও বলল,

—- ” শরীর ভালো না তোমার, রুমে আস। ”

—- ” আপ..নি যান আ..মি আসছি। ”

সাদিদ নীলার আচরণে কিছুটা অবাক হলেও আর প্রশ্ন করল না। কিন্তু হঠাৎ নীলার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

—- ” তোমার হাতে কি? আমার থেকে কি লুকাতে চাইছ? ”

নীলা এবার ভয়ার্ত চোখে সাদিদের দিকে তাকাল। সাদিদ তার হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে। তাই দ্রুত ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলল,

—- ” কই? কি..ছু না আমা..র হাতে। ”

বলে নীলা আবারও ছবিটা ভালোভাবে ওড়নায় পেচিয়ে নিলো।
সাদিদ ধীর পায়ে নীলার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আর নীলা ধরা পড়ে যাবার ভয়ে পা টিপে পিছনের দিকে যেতে লাগল। বারান্দার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেতেই নীলা আতংকিত দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। ততক্ষণে সাদিদ তার নিকটে চলে এসেছে।
নীলার শরীর মৃদু কাঁপতে লাগল।
সাদিদের কাছে সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে চায় না। তার ধারণা সাদিদ তাকে ভালোবাসে না। সে শুধু নীলাকে কষ্ট দিয়েছে। অতিতে কষ্ট দিয়েছে নিজের স্পর্শ দিয়ে, আর বর্তমানে কষ্ট দিচ্ছে অনুভূতি দিয়ে।
তাহলে নীলা কেন নিজের অব্যক্ত অনুভূতি তাকে জানাবে?
সাদিদ এগিয়ে এসে নীলার দিকে দুইহাত বাড়িয়ে, তাকে স্পর্শ না করেই নিজের বাহুবন্ধনে আটকে নিলো।
নীলা মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। তার নিঃশ্বাসের আওয়াজ সাদিদের কর্ণকোহরে স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে। সাদিদ নিঃশব্দে মৃদু হাসল।
তারপর আচমকা সে নিচু হলো।
সাদিদের তপ্ত নিঃশ্বাস জামার উপর দিয়েও নীলার পেটে গিয়ে লাগছে। নীলা সর্ব শক্তি দিয়েও যেন চোখ খোলতে পারছে না। আর না দৌড়ে এখান থেকে চলে যেতে পারছে। তাই ডান পায়ের পাতা দিয়ে বাম-পা শক্ত করে চেপে ধরেছে। কিছু মুহূর্ত পর সাদিদ উঠে আসলো।
নীলার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। তারপর নীলার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠল,

—- ” এই যে হ্যালো? দিনদুপুরে ঘুমিয়ে গেলে নাকি? ”

সাদিদের কন্ঠস্বরে নীলা এবার চোখ খোলে তাকাল। লজ্জা-অস্বস্তি সবকিছু তাকে জেঁকে ধরেছে। নীলার এমন অবস্থার মধ্যেই সাদিদ তার মুখের সামনে নিজের হাত এনে বলল,

—- ” প্রজাপতি। ”

নীলা এবার স্বাভাবিক হয়ে সাদিদের হাতের দিকে তাকালো। সাদিদ একটা ছোট্ট প্রজাপতি ধরে রেখেছে।
নীলার মুখে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠতেই সাদিদ বলে উঠল,

—- ” ছোটবেলায় একটা কথা শুনেছি। প্রজাপতি ঘরে আসা নাকি দুটো অর্থ বহন করে। এক হলো নতুন অতিথি আর দুই হচ্ছে বিয়ে।
আপাতত নতুন অতিথি আসার তো কোনো লক্ষণ দেখছি না। তাহলে কি বিয়ে? ”

বলেই সাদিদ ভ্রুজোড়া নাচালো। নীলা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে সাদিদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কি বলল সাদিদ? আর তার মুখের সেই হাসি! এগুলোর অর্থ কি?
সাদিদ নীলাকে এমন অস্থিরতায় ফেলে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। আর নীলা এখনও বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। সে না এই ছেলেকে বুঝতে পারে, আর না তার মুখ নিঃসৃত বাক্য।
ধোঁয়াশার অপর নাম হিসেবে সে সাদিদ ইবনে শাহরিয়ারকে ন্যস্ত করল।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ০৭

ভাওয়াল রিসোর্টের উদ্দেশ্য পদ্মালয়ার সামনের বড় রাস্তাটায় এসে সবাই উপস্থিত হয়েছে। রিসোর্টটা গাজীপুরে অবস্থিত বিধায় তারা বেশি লেইট করেনি। সকাল সকালই সবাই রউনা দেবার প্ল্যান করেছে। নতুবা জ্যামে আটকে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। তাই হালকা নাস্তা খেয়েই সকাল সাতটার মধ্যে সবাই এখানে উপস্থিত।
আঠারো সিটের এসিযুক্ত মিনিবাসে সকলের যাত্রা নিশ্চিত করা হয়েছে। নিজস্ব গাড়ি হলে সবাই ভাগাভাগি হয়ে আলাদা হয়ে যাবে। আর সেই জন্য হয়তো পিকনিক টাইপ ফিলিংসটাও পুরোপুরি আসবে না। তাই এই ভিন্ন উদ্যোগ।

নীলা এদিক-ওদিক দৃষ্টি রেখে মায়ের পিছনে ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে গাজিপুর যেতে হচ্ছে। শুধু মাকে একবার বলেছিল সে যাবে না, তৎক্ষনাৎ মায়ের বকা শুনতে হয়েছে। নীলাকে ইচ্ছা মতো ঝেড়ে তিনি শান্ত হয়েছেন। নীলার বিরক্তি আকাশছোঁয়া।
সে বুঝে উঠতে পারছে না সাদিদসহ তার বন্ধুরা রিসোর্টের শেয়ার কিনুক বা রিসোর্ট ভেঙে ফেলুক তাতে নীলার কি? তাকে কেন টইটই করে সেখানে যেতে হবে?
কিন্তু নীলার মনের এই দুঃখটা কেউ বুঝল না। বাবাকে বলেও লাভ বিশেষ করতে পারেনি। সাদিদ তাদের কি জাদু-টুনা করেছে আল্লাহ মালুম। এই ছেলের কথা শুনলেই তারা গলে পুরোপুরি বরফ। তাই জোরপূর্বক ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনে হিঁচড়ে নীলাকে গাজিপুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মূলত কথা হচ্ছে নীলার রিসোর্টে যেতে কিন্তু কোনো প্রবলেম নেই। বরং সে ঘুরাঘুরি বেশ পছন্দ করে। তার একমাত্র প্রবলেম হচ্ছে সাদিদকে নিয়ে।

সেদিনের পর থেকে আজ প্রায় ছয়দিন যাবত সে সাদিদকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেছে। রাগ কিংবা ভয়ে নয়, লজ্জায়। নিজের অনুভূতির নাম জানার পর থেকে নীলা এখন সাদিদের মুখোমুখি হতে পারছে না। একঝাঁক লজ্জা এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। কেবল লজ্জায়ও সীমাবদ্ধ নয়, আরও সাথে আছে চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস। ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা না হতে পারার দীর্ঘশ্বাস।
সবমিলিয়ে নীলা সাদিদের সম্মুখীন হতে চায় না। বিগত কয়েকদিন সাদিদ তাদের বাসায় বেশ কয়েকবার আসলেও নীলা নানা অযুহাতে তার সামনে একবারও আসেনি।
কিন্তু আজ তাকে সাদিদের মুখোমুখি হতেই হবে। আর নীলা সেটা চায় না। সাদিদের থেকে যত বেশি দুরত্ব বজায় রেখে চলা সম্ভব নীলা এখন সেটাই করতে চায়।
কিন্তু আজকে সাদিদের সামনে সে কিভাবে নিজেকে লুকাবে সেটা ভাবতেই নীলার ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
এমন অবস্থায় আচমকা পিছন থেকে কেউ ঝাপটে ধরতেই নীলা চমকিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরল।

—- ” তুই এখানে? ”

—- ” তা নয়তো কি? তুই আমাকে ভুলে গেলে কি হবে! আমার দুলাভাই ঠিক-ই মনে রেখেছে। ”

—- ” দুলাভাই! ”

—- ” বারে, বান্ধবীর জামাইতো দুলাভাই-ই হবে। ”

—- ” কি আজগুবি কথা বলছিস? কোন বান্ধবী, কার জামাই? ”

—- ” ধ্যাত! তুই কিছু বুঝিস না। আরে আমি সাদিদ জিজুর কথা বলছি। ”

—- ” থাপড়িয়ে তোর দাঁত ফেলে দিব ফাজিল মেয়ে। উনি তোর জিজু কিভাবে হয়? ”

—- ” তারমানে বলছিস হয় না? তাহলে তো আমি আরও বেশি খুশি। অবশেষে আমার ক্রাশবয়কে ফিরে ফেলাম। ”

নীলা রাগী চেহারায় শান্তর দিকে তাকাতেই শান্ত আবারও তাকে ঝাপটে ধরল। আর মুহূর্তেই নীলার রাগ গলে পানি। শান্ত তাকে জড়িয়ে রেখেই বলল,

—- ” অনুভূতির থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? ভাইয়াকে এবার বল। অনেকদিন তো হলো। ”

—- ” না শান্ত। আমি আগেও তোকে বলেছি, আমি উনাকে কিছু বলতে চাই না। তার জন্য আমি অনুভব করলে কি হবে? সে তো আমাকে অনুভব করে না। ”

—- ” তুই জানিস? তোকে সে এই কথা একবারও বলেছে? ”

নীলা এবার চুপ করে গেল। এই নিয়ে আর কথা বলতে চায় না। তাই সে পা বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
সবাই এক এক করে বাসে উঠে বসল। নীলা এবং শান্ত সেকেন্ড লাস্ট সিটে গিয়ে বসেছে। সামনে বসা মানেই ফ্রিতে বড়দের বকা খাওয়া, তাই তাদের এই মিলিত সিদ্ধান্ত। নীলা এতক্ষণ ভয়-টেনশনে থাকলেও শান্তকে পেয়ে এখন বেশ ভালো লাগছে। তাই দুইজনই বেশ হাসিখুশি।
কিন্তু প্রাণের বন্ধু হয়ে যে শান্ত মীরজাফরের কাজ করবে সেটা কে জানত!
সাদিদ তানবীর আর অর্ণবকে নিয়ে বাসে উঠতেই শান্ত বলে উঠল,

—- ” জি.. মানে ভাইয়া আপনার সিটের সাথে আমারটা এক্সচেইঞ্জ করবেন? আসলে আমার ওয়েনডো সিট পছন্দ। অর্ণব ভাইয়াকেই বলতাম, কিন্তু উনার সাথে তো প্রিয়তী আপু রয়েছে। ”

—- ” নো প্রবলেম, তুমি এখানে চলে আস। ”

নীলা তাদের কথোপকথন শুনে আতংকিত কন্ঠে বলে উঠল,

—- ” এই না, না তুই আমাকে আগে বলবি তো। আমি এখনই সিট পাল্টাচ্ছি। ”

বলেই নীলা দ্রুত দাঁড়িয়ে সিট পাল্টাতে গেলেই শান্ত তাকে বাধা দিলো।

—- ” আরে বসতো। আমি এত পিছনে বসতে পারব না। ভাইয়া আপনি আসেন তো৷ ”

নীলা অসহায় চোখে শান্তর দিকে তাকালো। আর শান্ত প্রতিউত্তরে তাকে একটা কুটিল হাসি ফিরিয়ে দিলো। নীলার আর বুঝতে বাকি রইল না সবটাই শান্তর জেনে-বুঝে করা।
শান্ত সাদিদের সিটে গিয়ে বসতেই সাদিদ এসে নীলার পাশে বসল।
নীলার বাহুতে সাদিদের হালকা স্পর্শ লাগতেই নীলা শিউরে উঠে জানালার পাশে আরও লেগে বসল।
সাদিদ একপলক তাকিয়ে নীলার ইতস্ততবোধ খেয়াল করল। কিন্তু সে দূরে সরে না গিয়ে বরঞ্চ বেশ আয়েশ করে বসল।
নীলা পারলে এবার জানালা দিয়ে বাসের বাহিরে চলে যায়। সাদিদের শরীরের ঘ্রাণ নীলার নাকে স্পষ্ট লাগছে। আর মাঝেমধ্যে শরীরের স্পর্শগুলোতে নীলার শরীর প্রায় জমে যাচ্ছে। গায়ে বারবার কাটা দিচ্ছে।
সাদিদ সবটাই আড়চোখে খেয়াল করছে। তাই সে ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হাসল।

.

নীলাদের দুই সিট সামনেই শান্ত বসেছে। শান্ত জানালা দিয়ে রাস্তায় গাড়িদের চলাচল দেখছিল, তার মধ্যেই হুট করে পাশে কেউ বসতেই সে ফিরে তাকালো।
উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের সেই ছেলেটা।
দেখেই শান্তর ভ্রুজোড়া অটোমেটিকলি কুঁচকে গেল।
আজ সকালে রিক্সা থেকে নেমে সাদিদদের বাসার দিকে আসতেই, এই আপদটটার সাথে তার দেখা হয়েছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবে তানবীরের পায়ে শান্তর হিল জুতার খোঁচা লাগে।
তারপর শান্তকে সরি বলার সুযোগটুকু না দিয়েই, সে একচুট ঝগড়া শুরু করেছিল।
কেবল ঝগড়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে মাফ করা যেত কিন্তু সে শান্তর আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। গেঁয়ো হয়ে স্টাইলিশ হবার ট্রাই করছে এসব হাবিজাবি বলে অপমান করছে।
আর শান্তও কি চুপ থাকবে নাকি? এরপর জায়গায় দাঁড়িয়েই তানবীরের সাথে কোমরবেঁধে ঝগড়া করেছে। তানবীরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তবে সে ক্ষান্ত হয়েছে।
পরবর্তীতে যখন দুইজনের সামনাসামনি পরিচয় হয়েছিল, তখনও দুইজনের মধ্যে খুব একটা আত্মীয়সূচক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়নি। মানে হচ্ছে তারা এখনও ঝগড়াতেই সীমাবদ্ধ।
কিছুক্ষণ আগের কথা মনে হতেই শান্তর আবারও বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো। তাই বেশ রাগীস্বরে বলে উঠল,

—- ” আপনি এখানে বসেছেন কি জন্য?
উঠুন বলছি। ”

—- ” মানে! আমি কি তোমার কথায় উঠ-বস করব নাকি? ”

—- ” দরকার হলে তাই করবেন। আমি আপনার সাথে যেতে পারব না। সরুন বলছি। ”

—- ” এহ্, আমি মনে হয় তোমার সাথে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি? তোমার পাশে বসা তো দূর দাঁড়ানোরও আমার ইচ্ছা নেই। কিন্তু চোখগুলো একটু কাজে লাগাও বাসের সব সিট ইতিমধ্যে ফিলাপ। যেগুলো খালি আছে সেগুলোতে সবার ব্যাগপত্র রাখা। ”

—- ” আমার চোখ জায়গাতেই আছে। বরং আপনি নিজেরগুলো কাজে লাগান। ব্যাগের উপর গিয়ে বসার মতো যথেষ্ট জায়গা ফাঁকা আছে? ”

—- ” কি? আমি ব্যাগের উপর গিয়ে বসব? ”

—- ” দরকার হলে ব্যাগের নিচে গিয়েও বসতে পারেন। ”

—- ” আর যদি না যাই? ”

—- ” যাবেন না কেন? আপনার সাথে এক সিটে বসে গাজীপুর পর্যন্ত যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”

—- ” তাহলে তো আমি অবশ্যই যাব না। পৃথিবী উল্টিয়ে গেলেও আজ আমি এই সিট ছাড়ছি না। ”

শান্তর রাগে মাথা ফেটে যাবার অবস্থা। ইচ্ছে করছে তানবীরকে তুলে সজোরে একটা আছাড় দিতে। সে দাঁতে দাঁত কেটে বলল,

—- ” গাড়কাটা লোক। ”

—- ” তোমার থেকে কম। ম্যানার্স ভুলে গিয়ে ফাজিল হয়েছ। ”

—- ” খবরদার বাজে কথা বলবেন না। ”

—- ” তুমি পুরোপুরি বাজে। আমি এতটাও গুছিয়ে বলতে পারছি না। ”

—- ” কি! আমি বাজে? তাহলে আপনি আমার বড়টা। ”

—- ” অবশ্যই বড়। তোমার গুরুজন, তাই পা ধুয়ে ধুয়ে পানি খাও। ”

—- ” ছিঃ ”

—- ” ছিঃ বলার কিছু নেই। হটি মেয়েরা আরও অনেক কিছুর জন্য ওয়েট করে বসে থাকে। ”

শান্ত ভ্রু কুঁচকাল। আশেপাশে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে নিচু স্বরে বলল,

—- ” যে যেমন তার জন্য তেমন মানুষ-ই বসে থাকে। ”

শান্তর ফিসফিসানি তানবীরের কর্ণকোহরে ঠিকই স্পষ্টভাবে পৌঁছে গেছে। তাই সে শান্তর দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে কন্ঠ তার থেকেও খাদে নামিয়ে বলল,

—- ” ঠিক ধরেছ, যে যেমন। আমিও ফাস্ট ক্লাস তারাও ফাস্ট ক্লাস। মধ্যে থেকে তোমার মতো মিডেল ক্লাসের জায়গা নেই। ”

—- ” ফাস্ট ক্লাস বলেই জামা-কাপড়ের এত অভাব? ”

—- ” সেটা তোমার বুঝার বাহিরে। ফ্যাশনের ‘ফ’ বুঝ না আস আবার ড্রেস নিয়ে কথা বলতে। ”

শান্ত আর কথা বাড়ালো না। এই বাচাল ছেলের সাথে কথা বললেই কথাকে টেনে-টুনে চুইংগামের মতো লম্বা করে। তাই প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সে জানালার পাশ ঘেঁষে বাহিরের দিকে তাকালো।

__________________

বাস ইতিমধ্যে উত্তরা পেরিয়ে গেছে। এতক্ষণ সবাই শান্তভাবে বসে থেকেই বাস জার্নিটা এনজয় করছিল। কিন্তু এবার তানবীর প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠল,

—- ” ভাই, আমরা পিকনিকে যাচ্ছি না শোকসভায় যাচ্ছি? এত নীরবতা কেন? ”

—- ” তুই রাজি থাকলে তোর শোকসভার আয়োজন করতে পারি। কি রে তানবীর, হয়ে যাবি নাকি শোকসভার পাত্র? ”

—- ” শালা তুই কথা মারাইস না। প্রিয়ুকে পাইয়াতো বাসের মধ্যেই অন্দরমহলে ডুইককা যাইতাসছ। ফ্যামেলি পিকনিকে যাইতাসি না তোদের রঙ্গলীলা দেখতে? ”

বাসে উপস্থিত বড়দের সামনে তানবীরের এমন লাগামছাড়া কথায় নীলা-শান্ত কেশে উঠল। বড়দের অনেক কেই ইতস্ততবোধ করতে দেখে সাদিদ এগিয়ে এসে তানবীরের পিঠে জোরে চাপড় বসাল।

—- ” হারামি মুখ সামলাইতে পারস না? ”

—- ” দোস্ত আরেকটু জোরে লাগা। পারলে হেতের মুখটাত লাগা। ”

—- ” শালা তুই মাঝখান থাক্কাইকা কথা কইলেই ধাক্কা দিয়া ফালাই দিমু। ”

—- ” বাবু এসব কি বলে তানবীর? ”

—- ” প্রিয়ু বেবি সে অনেক কিছু বলে। এতসবে কান দিয়ে তোমার লাভ নেই। ”

অর্ণবের আর তার বেবির আদিখ্যেতা দেখে তানবীরের গায়ে যেন ফোসকা পরল। তানবীর দাঁত চেপে বলে উঠল,

—- ” যতসব বাল ছাল। ”

সাদিদ হাসল। তারপর বন্ধুর মন ভালো করতে পিছন থেকে গিটারটা তুলে এনে সুর তুলল। তানবীরের রাগ এবার থেমে গেল। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সেও হাতে আরেকটা গিটার তুলে নিলো।

কৃষ্ণচূড়ার লাল, পদ্মপাতার জল
অঙ্গে মেখে আজকে সখি
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

কৃষ্ণচূড়ার লাল, পদ্মপাতার জল
অঙ্গে মেখে আজকে সখি
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

দ্বিধা-দ্বন্দ ভোল, মনের আগল খোল
রক্ত-আবির অঙ্গে মেখে
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে মনের গহিন ঘরে
চিত্রপটে তোরই ছবি, তোরে মনে পড়ে
(তোরে মনে পড়ে)
তোরে মনে পড়ে

রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে মনের গহিন ঘরে
চিত্রপটে তোরই ছবি, তোরে মনে পড়ে
(তোরে মনে পড়ে)
তোরে মনে পড়ে

সবাই এতক্ষণ পাশ থেকে তাদের উৎসাহ দিচ্ছিল। কিন্তু এবার সাদিদের সাথে সবাই জোরে একসঙ্গে গেয়ে উঠল।

দ্বিধা-দ্বন্দ ভোল, মনের আগল খোল
রক্ত-আবির অঙ্গে মেখে
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

সবার মুখে হাসি। করতালি দিয়ে বাসের সবাই ইতিমধ্যে পরিবেশ গরম করে ফেলেছে। ছোট্ট শাদমানও সিটে দাঁড়িয়ে ছোট্ট হাতগুলো দিয়ে সবার দেখাদেখি হাততালি দিচ্ছে। আর খিলখিলিয়ে হাসছে। আর চলন্ত বাসে পড়ে যেন না যায় শাহেদ তাকে শক্ত করে আগলে ধরেছে। তার মুখে হাসি, পাশে বসে নিধিও হাসছে।
সাদিদ পাশে বসা নীলার দিকে তাকিয়ে আবারও সুর তুলল।

মনের ভেতর দ্বিধা, পা বাড়াতে বাঁধা
শেকল পড়া পায়
ক’দিন বাঁচা যায়, বেঁচে থাকা যে দায়
(বেঁচে থাকা যে দায়)
বেঁচে থাকা যে দায়

মনের ভেতর দ্বিধা, পা বাড়াতে বাঁধা
শেকল পড়া পায়
ক’দিন বাঁচা যায়, বেঁচে থাকা যে দায়
(বেঁচে থাকা যে দায়)
বেঁচে থাকা যে দায়

দ্বিধা-দ্বন্দ ভোল, মনের আগল খোল
রক্ত-আবির অঙ্গে মেখে
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

কৃষ্ণচূড়ার লাল, পদ্মপাতার জল
অঙ্গে মেখে আজকে সখি
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল (২)

কৃষ্ণচূড়ার লাল, পদ্মপাতার জল
অঙ্গে মেখে আজকে সখি
সূর্যস্নানে চল
(সূর্যস্নানে চল)

দ্বিধা-দ্বন্দ ভোল, মনের আগল খোল
রক্ত-আবির অঙ্গে মেখে
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল
(সূর্যস্নানে চল)
(সূর্যস্নানে চল)

সবাই হাসছে। কেননা এতক্ষণ সবাই বয়স-সম্পর্ক ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে সাদিদের সাথে গান গেয়েছে। সুর কেমন হয়েছে সেটা বড় কথা নয়, সবাই যে আনন্দ করেছে এইটাই মোক্ষম।
সাদিদ নীলার দিকে তাকালো। তার মুখে এখনও হাসি লেগে আছে। এতক্ষণের সব জড়তা কেটে গিয়ে সবার সাথে সাথে সেও আনন্দে সামিল ছিল। সাদিদের মুখেও হাসি ফুটল। কেননা সাদিদতো এমনটাই চেয়েছিল। আর তারজন্যই এতকিছুর আয়োজন। প্রাণপাখির রাগ-ক্ষোভ, মধ্যকার সকল দুরত্ব কমাতে সাদিদ কোনো কমতি রাখতে চায় না। শীঘ্রই পাখিকে নিজের খাঁচায় আটকানোর পুরো ব্যবস্থা করে ফেলেছে সাদিদ।

তাদের গানের শেষেই আকস্মিকভাবে বাহিরে সূর্যের তাপে ভাটা পরল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে মুহূর্তের মাঝেই বাসের ছাদে আওয়াজ হতে লাগল ঝুম বৃষ্টির রিনিঝিনি।
তাই তানবীর ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে উঠল,

—- ” কিরে সাদি তুইতো মারাত্মক কুফা!ভালা-টালা দিনটারে বৃষ্টিতে চুবাইয়া দিলি। ”

সাদিদ মাথা চুলকে হাসল। একপলক পাশে বসে থাকা নীলার দিকে তাকাতেই নীলার হাসিমুখটা নজরে আসলো। সাদিদকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীলার পূর্বের ন্যায় আবারও দৃষ্টি এড়ালো।
সবাই বৃষ্টিস্নাতরত প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত।
বাহিরে দেখতে গিয়ে শান্তর শরীরের সাথে তানবীরের আচমকা স্পর্শ লাগতেই শান্ত তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাল।

—- ” গায়ে পড়া লোক, দূরে সরুন। ”

—- ” ইশশ আসছে আমার প্রিন্সেস ডায়না! কি আমার শরীর, আবার এটা নিয়েই রংচং। ”

—- ” খারাপ কি দেখলেন? ”

—- ” ভালোর কি আছে? ”

—- ” আপনার মাথা আছে। ”

—- ” সেটা তুমি না বললেও জায়গায় আছে। ”

শান্ত বিরক্ত হয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠল,

—- ” ড্রাইভার ভাই জোরে একটা গান চালান তো। পাশে বসা পাগলটা আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছে। ”

—- ” কাকে পাগল বললে? ”

—- ” আপনাকেই বললাম। এনি ডাউট? ”

তানবীর উত্তর না দিয়ে কি মনে করে বাঁকা হাসল। শান্ত তার হাবভাব না বুঝে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। আপাতত এই আপদের মুখ দর্শন করার তার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই।

শ্রাবনের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে
অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়ে। (২)

নীলা চমকিত দৃষ্টিতে পাশ ফিরল। বুকটা তার ধুক করে উঠল, কেননা সাদিদ অপলক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নীলা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। তার চিন্তা হচ্ছে সাদিদ কি চলন্ত বসে তার কাঁপুনি বুঝে যাবে নাকি? নতুবা বাসের সিট যে হারে নড়ছে, সাদিদ বুঝতে পারলে লজ্জায় পরতে হবে। ভাবতেই নীলার এখন ভয় করছে।

আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে,
আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে।

কবিতার বই সবে খুলেছি
হিমেল হাওয়ায় মন ভিজেছে,
জানালার পাশে চাঁপা মাধবী
বাগান বিলাসী হেনা দুলেছে। (২)

আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে,
আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে।

এত অস্থিরতায় বুঝি থাকা যায়? নীলার ইচ্ছা করছে এইমুহূর্তে শান্তর মাথায় জোরে একটা ইট ফাটাতে। তার জন্যই নীলার এখন এই অবস্থা। এমনিতে এসব গানে সমস্যা না হলেও সাদিদ পাশে থাকায় নীলা কোনোভাবেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।
তাই কিছু না পেয়ে সে পানির বোতলটা হাতে তুলে নিলো। কিন্তু এখানেও বিপত্তি ঘটল। তার হাত এত বেশি পরিমাণ কাঁপছিল যে মুখে-গলায় পানি পরে জামা কিছুটা ভিজে গেছে।
সাদিদ এবার এগিয়ে আসলো। নীলাকে বুঝতে না দিয়ে, টিস্যু হাতে নিয়ে নীলার মুখের আর গলার পানিটুকু মুছিয়ে দিতে লাগল।
নীলার অস্বস্তি যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। পানি মুছিয়ে দিয়ে সাদিদ বোতলটাতে হাত দিতেই নীলা তার দিকে চোখ উঠিয়ে তাকালো।
কিন্তু সাদিদের চোখে চোখ পরতেই নীলা আবারও মাথা নিচু করল। এই চোখে যে নীলা তাকাতেই পারে না। নেশার মায়াজাল যেন এই চোখজোড়া আর এই চোখের মালিক। সাদিদ নীলার অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসল।

তারপর নীলার থুতনিতে হাত দিয়ে তার মুখটা একটু উঁচু করে নিজেই পানি খাইয়ে দিতে লাগল।
নীলার অবস্থা যে কেমন হবে সেটা বলাবাহুল্য।
সাদিদ তাকে পানি খাইয়ে আবারও মুখ মুছিয়ে দিলো।
নীলা সবটুকু সময় শুধু মাথা নিচু করে রাখল। সাদিদের দিকে তাকালোর মত সাহস সে খোঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু বারবার মনে এসে ভিড় জমাচ্ছে কতগুলো প্রশ্ন। যে প্রশ্নের উত্তর সাদিদ ব্যতিত আর কারও পক্ষে হয়তো দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সাদিদ কি দিবে সেই প্রশ্নের উত্তর? নীলার অবুঝ মন বলে দিলে ক্ষতি কি?
কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন মস্তিষ্ক বলে এমনটা চিন্তা করাও পাপ। নীলার আবারও বু্ক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। ভালোবাসা শব্দটাই কষ্টের। কষ্ট ব্যতিত আর কিছুই তাতে আশা করা যায় না।

মেঘেদের যুদ্ধ শুনেছি
সিক্ত আকাশ কেঁদে চলেছে,
জমেছে হাঁসের জলকেলী
পথিকের পায়ে হাঁটা থেমেছে। (২)

আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে,
শ্রাবনের মেঘ গুলো জড়ো হলো আকাশে
অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়ে।

শ্রাবনের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে
অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়ে,
আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে ..

গানটা শেষ হতেই নীলার আড়চোখে একবার সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ বোতলের শেষ পানিটুকু মুখ লাগিয়ে শেষ করছে।
এই দৃশ্য দেখে নীলার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সাদিদ তার মুখ লাগানো যায়গায় মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছে বিষয়টা মাথায় যেতেই অজান্তেই নীলার হাত তার ঠোঁটে চলে গেল।
আর এমন সময়ই সাদিদ আবারও নীলার দিকে
তাকালো। নীলাকে ঠোঁটে হাত দিতে দেখেই সে এগিয়ে আসলো।
মাথা নুইয়ে খানিকটা ঝুঁকে ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে নিচুস্বরে বলল,

—- ” ইট’স টেস্ট লাইক সুইট। কিন্তু পানির স্বাদতো এমন হবার কথা নয়। কিছু মিশিয়েছ? নাকি ঠোঁটের মিষ্টি পানিতে দিয়ে দিয়েছ? ”

নীলা সাদিদের এমন কথায় লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। কিসব বলছে সাদিদ? কিন্তু তার এমন কথার অর্থ কি? সাদিদকে বড্ড অদ্ভুত লাগছে নীলার।
ক্রমশ যেন নিজের চারপাশে নতুন বেড়াজাল তৈরি করছে সে। নীলা তাকে একমুহূর্ত বুঝে উঠলেই পরমুহূর্তেই সম্পূর্ণ নতুনরূপে সে ধরা দিচ্ছে। এত অদ্ভুত কেন ছেলেটা?

#চলবে…

[ প্রিয়পাঠক আজকের পর্বের জন্য ব্যবহৃত গানগুলো হচ্ছে,

গানের নামঃ সূর্যস্নানে চল
কন্ঠশিল্পীঃ বাপ্পা মজুমদার

Song Name: Sraboner Meghgulo
Original Song by Different Touch. Different Touch is a Bangladeshi band in the early 1990s
But today I used (New Version) song by Saif Zohan. ]