অন্তরালে কুয়াশার ধোঁয়া পর্ব-০১

0
1661

#অন্তরালে_কুয়াশার_ধোঁয়া
#পর্ব_1
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida

উনার ছেলে বাবু হয়েছে। কিন্তু আমরা দুঃখিত, আমরা বাচ্চার মাকে বাঁচাতে পারিনি।উনার অবস্থা আশার আগেই অনেক খারাপ ছিল।যার কারণে আমরা একজনকেই বাঁচাতে পেরেছি।(ডক্টর বাচ্চাটাকে আমার কোলে নিয়ে কথাটা বলে চলে গেলো)

আমি কথা শুনেই ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম। জয় আমার কাছ থেকে তারাতারি বাচ্চাটাকে নিয়ে নিলো।

ম্যাম।আপনি ঠিক আছেন?(আরিফ আমাকে ধরতে ধরতে)

আরিফ আমি এইসব কি করলাম?আমি একজনকে মেরে ফেললাম।একটা বাচ্চাকে আমি এতিম করে ফেললাম।এখন আমি এই বাচ্চার পরিবারকে কি করে খুজবো!আমি যে ওই মেয়ের সমন্ধে কিছুই জানি না।আমি কি করে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো!(আমি ফ্লোরে বসে কাদতে কাদতে)

বলেছিলাম এতো বেখেয়ালী হতে না।কিন্তু আপনি সব সময় নিজের মর্জি চালান।(জয় কঠিন গলায়)

আমি ফ্লোর থেকে উঠে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বললাম
আরিফ,জয় এক্ষুনি হসপিটালের ছাদে আসো তোমাদের সাথে কথা আছে। বাচ্চাটাকেও সাথে করে নিয়ে এসো।
বলেই আমি সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম


ছাদে
আরিফ বাচ্চাটাকে জয়ের কাছ থেকে নাও।(আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে।এখন অনেক রাত)

আরিফ জয়ের কাছ থেকে বাচ্চাটাকে নিলো।

আমি তখনই জয়ের কলার চেপে ধরলাম
আমি তোমার বস জয়।তুমি আমার বাবারে আন্ডারএ কাজ করো বলে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারবো এইটা ভেবো না।ভালোয় ভালোয় বলছি বলো আমার বাবা কোথায়?কি হচ্ছে বাংলাদেশে?কেনো আমাকে বুঝ হতে না হতেই বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে?আর কি এমন হয়েছে যে বাবা গায়েব হয়ে গেছে?আর তোমরা কেউই কিছু জানো না!
তুমি কি ভেবেছো আমাকে তোমরা আটকে রাখতে পারবে?ভুলে যেও না আমিও ঝুমুর চৌধুরী।পিয়াস চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে।তোমাকে মেরে গায়েব করতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না।

জয় ওর কলার থেকে আমার হাত ঝাড়া মেরে ফেলে দিয়ে তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বললো
হাহ! পিহুলি চৌধুরী!আমাদের কথা না মানার পরিণাম দেখতেই তো পেলেন।আপনি যদি আমাদের কথা মত বিদেশে চলে যেতেন তাহলে হয়তো এই বাচ্চার মা বেচেঁ থাকতো।কিন্তু না আপনি বেখেয়ালী ভাবে গাড়ি চালিয়ে এই বাচ্চার মাকে মেরে ফেলেছেন।

জয়। ম্যাম কিছু করে নি। ওই মেয়ে গাড়ির সামনে আসার আগেই জখম ছিলো।ডক্টর নিজে বলেছে ওই ছোটো একটা অ্যাকসিডেন্টে কখনই ওতো জখম হতে পারে না।(আরিফ)

না আরিফ।জয় ঠিক বলেছে।আমার গাড়ি চালানো ঠিক হয়নি।(আমি মাথা নিচু করে কাদতে কাদতে)


অতীত
আমি ঝুমুর চৌধুরী।বয়স সবে মাত্র সতেরোতে পা দিলাম।দেখতে যথেষ্ট সুন্দর।আজকে বুঝ হওয়ার পর প্রথম দেশের মাটিতে পা রাখলাম। অবশ্য রাখিনি,রাখতে বাধ্য হয়েছি।আমার বাবার জন্য।
আমি রাত এগারোটায় এয়ার পোর্ট এ দাড়িয়ে আছি।তখন দুটো কালো গাড়ি দিয়ে কিছু লোক আসলো।যাদের মধ্যে দুজন হলো আরিফ আর জয়।

(আরিফ বয়স ছাব্বিশ।দেখতে সুঠাম দেহের অধিকারী।আর জয়ের বয়স আঠাশ। উনিও সুঠাম দেহের অধিকারী।)

আরিফ আর জয় আমার বাবার ডান হাত আর বাম হাত।আমার বাবা পিয়াস চৌধুরী।উনি কি কাজ করেন, আজ পর্যন্ত আমি জানতে পারলাম না!আমি যখন খুব ছোটো তখনই আমাকে বিদেশে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।মাঝে মাঝে কয়েকবার উনার সাথে আমার দেখা হয়েছে।উনি বিদেশ এসে আমার সাথে দেখা করে গেছে কিন্তু উনি কখনও আমাকে দেশে আসতে দেননি।যদিও উনি আমাকে খুব ভালোবাসত।
পরিবার বলতে আমি শুধু উনাকেই চিনি।আমার মা কোথায়?কে?আমি জানি না। পৃথিবীতে বাবা ছাড়া কেউ আছে কিনা তাও জানি না।
তবে মাস কয়েক হলো বাবার কোনো খোঁজ নেই।উনি রোজ একবার হলেও আমাকে ফোন করতো।কিন্তু কয়েকমাস উনি কোনো ফোনও করেননি।উনাকে যদি আমি ফোন করতাম তখন হয়তো আরিফ ধরতো আর না হয় জয়।আরিফ কিছু একটা বুঝ দেয়ার চেষ্টা করতো কিন্তু জয় সব সময় ব্যাস্ত আছে বলে ফোন কেটে দিতো।
অবশেষে আমি নিজেই ওদের না বলে দেশে চলে আসলাম।আমার বাবার কি হয়েছে জানতে? কিন্তু আরিফ আর জয়ের নেটওয়ার্ক খুবই স্ট্রং আমি এয়ার পোর্ট এ আসতেই ওরা আমাকে ধরে ফেললো।

ম্যাম আপনি কেনো এসেছেন?(জয় কঠিন গলায়)

এখন আমাকে কি আমার বাবার কাজের লোককে কৈফিয়ত দিতে হবে?(আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে)

ম্যাম প্লিজ আপনি চলে যান!(আরিফ বিনয়ী হয়ে)

আমি যাওয়ার জন্য আসি নি আরিফ।(আমি কড়া গলায়)

আপনি এখান থেকে যাবেন না আমি আপনাকে জোর করে পাঠাবো?(জয় আমার সামনে দাঁড়িয়ে)

আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি।আমি জানি আরিফ আর জয় আমার কাছ থেকে কিছু লুকচ্ছে।কিন্তু কি?আমার বাবার সাথে কি হয়েছে, তা না জানার পর্যন্ত আমি শান্ত হচ্ছি না।(আমি মনে মনে)

আমি আলিফ আর জয়ের কাছ থেকে পালাতে একজন কালো সুট পড়া লোক যে ওদের সাথেই এসেছে।এসে পাশে দাড়িয়ে আছে তার থেকে আচমকা গাড়ির চাবি নিয়ে গাড়ির ভিতরে উঠে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলাম।বিষয়টা এতো তাড়াতাড়ি হলো যে আরিফ আর জয় কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি ওদের সামনে থেকে হাওয়া।

সবাই ম্যামের পিছু নাও?(বলেই জয় হন্তদন্ত হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো)

জয়ের সাথে গাড়িতে উঠলো আরিফও।


ম্যাম দাড়ান?আপনার এখনও গাড়ি চালানোর মতো বয়স হয়নি।আপনি গাড়ি চালাতে পারবেন না।কোনো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে!(আরিফ গাড়ির জানালা দিয়ে চিৎকার করে)

আমি আরিফের প্রতিটা কথাই শুনতে পারছি,বুঝতেও পারছি।কিন্তু এখন আমায় থামলে চলবে না।আমায় বাবাকে খুঁজতেই হবে।
অবশ্য আমি তেমন ভালো গাড়ি চালাতে পারিনি না।আমার কাছে লাইসেন্সও নেই।বিদেশে একটু একটু শিখেছি তাই দিয়ে কোনমতে গাড়ি চালিয়ে পালাবার চেষ্টা করছি।ধরা পড়লে জানি ওরা আমাকে জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দেবে।কিন্তু এখন আমার বাবাকে খোঁজাটা জরুরি।আমি ভয়ে ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে গাড়ি চালাচ্ছি।অন্যদিকে জয় আর আরিফ আমার পিছু নিচ্ছে!
এরইমধ্যে আমাদের গাড়ি একটা নীরব জায়গাতে এসে পড়লো।তখন বাজে রাত বারোটা।চারদিকে ঘন জঙ্গল।কোথায় যাচ্ছি তা আমি নিজেও জানি না।হটাৎ জঙ্গল থেকে একটা মেয়ে আচমকা আমার গাড়ির সামনে এসে পড়লো।আমি ব্রেক কষতে কষতে উনি আমার গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে গেলো।
আমি এতটাই ভয় পেয়ে গেলাম যে গাড়ি থেকে নামার কোথাও ভুলে গেছি।আমি গাড়ি থামিয়ে সিটে কাচুমাচু হয়ে বসে রইলাম।
পেছনে গাড়ি থামিয়ে জলদি করে আরিফ আর জয় মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেলো।ওদের দেখে মনে একটু সাহস হয়েছে।পড়ে আমি আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটার কাছে গেলাম।
গিয়ে যা দেখলাম,তাতে আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো।মেয়েটার শরীরের বেশিভাগ অংশই রক্তে ভেজা,শরীরে অনেক আঘাত রয়েছে।দেখে মনে হচ্ছে 21 কি 22 হবে তার বয়স।আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হলো মেয়েটা আট কি নয় মাসের প্রেগনেট।মেয়েটা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল
প্লিজ আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান।
আমি উনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।আমার হাত পায়ে যেনো কোনো জোর নেই।উনার কথার জবান আমি কি করে দেবো জানা নেই?

আরিফ,উনাকে ধরো।হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে!
বলেই জয় আর আরিফ উনাকে তুলে গাড়িতে উঠালো।

আমি সেখানেই স্থির দাড়িয়ে আছি।

ম্যাম।আপনি কি দাড়িয়েই থাকবেন?(জয় চিৎকার চেঁচামেচি করে)

না।আমি আসছি।
বলেই আমিও গাড়িতে উঠে মেয়েটার পাশে বসলাম।উনার মাথাটা আমার কোলে নিলাম।কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে, গালে অসংখ্য আঁচড় আর থাপ্পড়ের দাগ স্পষ্ট কালোও হয়ে আছে।ঠোঁটের কোণ ফেঁটে রক্ত পড়ছে।উনার এই অবস্থা দেখে আমার চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি পড়তে লাগলো।

উনি কাপাকাপা হাতে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,,
আমার বাচ্চাটার খেয়াল রাখবেন প্লিজ।ওকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যান।আর ওকে একটা ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন।আর একটা কথা ওকে কোনো দিন প্রতিশোধ পরায়ন করে তুলবেন না প্লিজ। প্রতিশোধ খুব বাজে জিনিস।

মেয়েটি কাপা কাপা গলায় আমাকে কথা গুলো বললো।

আপনি এইভাবে বলবেন না।আপনি আর আপনার বাচ্চা একসাথে থাকবেন।আপনি নিজে ওকে,নিজের মতো করে মানুষ করে তুলবেন!(আমি কাদতে কাদতে)

আমি জানি আমার শেষ সময় চলে এসেছে।(মেয়েটি কাদতে কাদতে)

একদম বাজে কথা বলবেন না।আপনার পরিবারের নম্বর দিন। আমি এখুনি তাদের ফোন দিচ্ছি।আপনার হাসব্যান্ড কোথায়?(আমি ফোন খুঁজতে খুঁজতে)

উনি আমার হাত ঝাপটা দিয়ে ধরে বললো,,
নাহ॥আমার পরিবারকে কখনও আমার বাচ্চাটাকে দিবেন না।ওয়াদা করুন।প্লিজ।আপনি ওকে নিয়ে যাবেন আপনার কাছে।

কিন্তু,,,!(আমি)

কোনো কিন্তু না!এই উপকারটা করুন।(মেয়েটা)

ঠিক আছে।(আমি)

আমি জানি না তখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাকে কিভাবে কথা বলা দরকার ছিল।কিন্তু আমার যা ভালো মনে হলো আমি তাই করলাম।পরেরটা পড়ে দেখা যাবে।

আপনার নাম কি?
বলেই উনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি অজ্ঞান হয়ে গেছে।


ম্যাম আমরা এসে পড়েছি।তাড়াতাড়ি উনাকে ভিতরে নিয়ে যেতে হবে।
বলেই আরিফ ভিতরে ডক্টর ডাকতে গেলো।

আর জয় এসে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে হসপিটালের ভিতরে জুটলো।আমিও ওদের পিছু পিছু গেলাম।তখন বাজে রাত দেড়টা।উনাকে তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো।
এক ঘন্টা পর ডক্টর এসে বাচ্চাকে আমার কোলে দিয়ে বললো মা মারা গেছে।


বর্তমান
এখন কি করবি জয়?(আরিফ)

কি আর করবো?অ্যাকসিডেন্ট কেস। ডক্টরা তো এতক্ষণে পুলিশকে ফোন করে দিয়েছে।আমাদের যে করেই হোক ম্যামকে বাঁচাতে হবে।তাই ম্যাম আপনাকে এখান থেকে যেতে হবে।(জয়)

আমি কোথাও যাবো না।যে অপরাধ করেছি তার শাস্তি তো আমাকে পেতেই হবে।আর আমি বাবাকে না দেখে যাবো না।(আমি জেদ ধরে)

আপনি কেনো বু,,,
আরো কিছু বলতে যাবে জয় তখনই ওর ফোনে একটা ফোন আসে।ফোন আসার পরই জয় যেনো পাথর হয়ে জমে গেলো।

কি হয়েছে জয়?(আরিফ জয়কে ধাক্কা দিয়ে)

পিয়াস স্যার মারা গেছে!উনার দেহ এখন পুলিশ স্টেশনে।উনারাই তদন্ত করছে।কে যেনো স্যারকে মেরে ফেলেছে।(জয় আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম।আমার যেনো পুরো পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে।

ম্যাম,আপনাকে এখন এখান থেকে যেতেই হবে।যারা স্যারকে মেরেছে।তারা আপনাকেও মারতে পারে।(জয়)

কিন্তু বাবা?(আমি কাদতে কাদতে)

কোনো কিন্তু নয়, ম্যাম।স্যার বেচেঁ নেই কিন্ত আপনি বেচেঁ আছেন।আমাদের আপনাকে রক্ষা করতে হবে।প্লিজ ম্যাম আপনি চলে যান।নিজের কথা না হয় বাচ্চাটার কথা ভাবুন।আর এই বাচ্চাটাকেও সাথে করে নিয়ে যান।ওর মাকেও কেউ মারার চেষ্টা করেছে।হয়তো এই বাচ্চাটাকেও মারার চেষ্টা করবে।তাই আপনি আর এই বাচ্চাটা এক সাথে থাকুন।সুরক্ষিত থাকুন। ম্যাম আর জেদ করবেন না।(আরিফ আমার হাতে বাচ্চাটাকে দিয়ে)

কিন্তু এখনকার এইসব?(আমি ভয়ে ভয়ে কান্না করতে করতে)

আমি আর আরিফ সব সামলে নেবো।কিন্তু আপনি কিন্তু কোনোদিন এই দেশে আসবেন না।(জয় কড়া গলায়)

আমি শুধু চুপ করে ওদের কথা মেনে নিলাম।তবে শুধু তাৎক্ষণিক সময়ের জন্য।আমি ফিরে আসবো আবার।শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর নিতে।আর বাচ্চার পরিবারকে খুঁজে বের করতে।


চলবে,,,