অন্তরালে তুমি পর্ব-০৮

0
2451

#অন্তরালে_তুমি
#Part_08
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
“ইউটিউবার ইহান মাহমুদ একজন ধর্ষক”

ঘন্টা খানিকের মধ্যেই সকল টিভি নিউজের হেডলাইন হয়ে উঠলো কথাটি। সকল জনগণের মধ্যে কেমন এক মাতামাতি শুরু হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি চর্চিত হয়ে উঠলো বিষয়টি৷ ফেসবুকে একের পর এক ইহানকে নিয়ে পোস্ট হতেই থাকে। ব্যপারটা কিভাবে যেন লিক হয়ে যায় আর তা মিডিয়াদের কানে পৌঁছে যায়। তাদের কানে পৌঁছাতেই সাথে সাথে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আর ঘটনাটা তীল থেকে তাল হয়ে যায়। আপাতত আরিহার অফিসের সামনে প্রেস- মিডিয়ার ভীড় করে আছে। পুলিশ এখনো আসে নি। তারা নাকি এখনো রাস্তায়।
এইদিকে সকলেই ইহানকে একের পর এক অপবাদ দিয়ে চলেছে। ইহান এইসব সহ্য করতে না পেরে ওর চোখ বেয়ে দুই ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। সে না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সইতে। “সে নির্দোষ” কথাটি অনেকবার বলা সত্ত্বেও কেউ তার উপর বিন্দু মাত্র ভরসা করে নি।
অন্যদিকে আরিহা চেয়ারের উপর পা তুলে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। ডান হাতে মোবাইলে ফাইল চেক করছে। তার মধ্যে না আছে কোন ভাবান্তর না আছে কোন হেলদোল। সে বরাবরের মতই শান্ত। আরিহা থেকে বেশ কিছু হাত দূরে হিনা নিরব বসে আছে। যেন সত্যি তার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। অনেকেই ওকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে অপেক্ষার অবসান শেষ হলো পুলিশ এসে পৌঁছালো সেখানে। তাদের পিছু পিছু কিছু রিপোর্টারও ক্যামেরা নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। আরিহা এইবার বিরক্তিমাখা চোখে পুলিশদের দিকে তাকালো। আর ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

— পাংচুয়ালিটি বলেও কিছু আছে। এতটা দায়িত্বহীন কিভাবে হতে পারেন আপনারা? জাস্ট ডিসগাস্টিং!

পুলিশ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। কেন না তারাও মোটামুটি আরিহার সম্পর্কে জানে। তাই তারা আরিহাকে কিছু না বলে ইন্সপেক্টর কনস্টেবলকে ইশারা করে ইহানকে ধরতে। তারা কথামতো ইহানের দিকে এগিয়ে যায় ওকে ধরতে তখনই আরিহা গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

— আপনারা সেইদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

পুলিশ কনস্টেবল দাড়িয়ে যায় আর আরিহার দিকে ঘুরে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়। আরিহা এইবার আবার পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসে। তারপর ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলে,

— আপনাকে এইখানে কেন ডাকা হয়েছে?

ইন্সপেক্টর তখন থমথম গলায় বলে,
— কালপ্রিটকে গেরেফতার করার জন্য।

আরিহা তখন শান্ত গলায় বলে,
— তো কালপ্রিটকে?

ইন্সপেক্টর তখন কিছুটা জোর গলায় বলে,
— ইহান মাহমুদ। সে একজন নারীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে তাই তার জন্য আমরা তাকে গেরেফতার করতে এসেছি।

আরিহা তখন পায়ের উপর থেকে পা নামিয়ে ছোট ছোট চোখ করে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এখন আমি যদি বলি ইহান মাহমুদ কালপ্রিট না তখন?

আরিহার এই শান্ত বাক্যটি যেন পুরো পরিবেশটি কাঁপিয়ে তুলে। সকলেই এইবার হতভম্ব হয়ে যায়। তিব্র এক কৌতূহল জন্মাতে শুরু করে। ইহান এইবার ভ্রুকুটি একত্রিত করে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। আরিহা করতে কি চাচ্ছে তা বুঝার চেষ্টা করে। ইন্সপেক্টর তখন অবাক করা চোখে বলে,
— মানে?

আরিহা তখন পাশ থেকে একটা পেপসির বোতল হাতে নিয়ে একবার চুমুক দেয়। অতঃপর শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
— মানে খুব জলদি বলছি। তার আগে আপনি কষ্ট করে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন। একজন ধর্ষিতা বা ধর্ষণ হতে বাঁচার জন্য ঠিক কি কি করে?

ইন্সপেক্টর তখন অপ্রস্তুত গলায় বলে,
— তার প্রতিপক্ষকে আঘাত করে। যেমন আঁচড় কাটে বা তার দূর্বল জায়গায় আঘাত করে বা অনেক সময় তার গায়ে কামড় বসায়। অনেক সময় কোন ভারী জিনিস দিয়ে তার প্রতিপক্ষকে আঘাত করে।

আরিহা আবার পেপসিতে চুমুক দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
— কিন্তু মি. ইহান মাহমুদের মধ্যে আপনার বলা সেইসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোনটাই নেই। না আছে কোন আঁচড়ের দাগ, না আছে কোন কামড়ে দাগ আর না আছে তার শরীরে কোন আঘাত। একবার ভালো মত দেখুন তাকে। সে একদম ফিট। তো কথা হচ্ছে মিস হিনা নিজেকে কিভাবে সেফ করলো?

আরিহার কথায় যেন সকলের মাথায় বিষয়টা খেলে যায়। সকলেই এইবার ইহানকে উপর থেকে নিজ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। সত্যি ইহানের গায়ে বিন্দু পরিমাণ কোন দাগ বা আঘাত নেই। আরিহা এইবার পুরো পেপসিটা খেয়ে ফেলে বলে,
— তার থেকেও বড় কথা একজন ধর্ষক সর্বদা অস্থির থাকে। যা চোখ মুখ দেখেই বুঝা যায়। কিন্তু মি. ইহানের বেলায় তেমন কিছুই আমরা দেখে নি। তিনি শান্তই ছিলেন সাথে তার মধ্যে কিছুটা বিষ্ময়কর ভাব ছিল। এম আই রাইট এভ্রিওয়ান?

সবাই এইবার ইহানের মুখভঙ্গি মনে করার চেষ্টা করে। অতঃপর মনে পড়তেই সকলেই আরিহার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলায়। আরিহা এইবার হিনার দিকে তাকিয়ে বলে,
— যার সাথে আপত্তিকর কিছু হয়ে থাকে তার মুখে সর্বদা ভয় ঝুলে থাকে। আর যে তাকে নষ্ট করার চেষ্টা করেছে তাকে চোখের সামনে কোন মেয়েই সহ্য করতে পারে না। সে তাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে আর ভয়ে কাঁপতে থাকে। বার বার নিজের শরীর ঘষতে থাকে সেই স্পর্শ গুলো মুছার জন্য। কিন্তু মিস হিনা তার মধ্যে কিছুই করছে না। এমনকি তার শরীরে কোন দাগ পর্যন্ত নেই।

এইবার সকলের দৃষ্টি গিয়ে হিনার উপর স্থির হয়। হিনা তো ভয়ে এখন ঘামতে থাকে। কিছু চেয়েও বলতে পারছিল না। সকল কথা যেন গলায় দলা পাকিয়ে আসছিল।
আরিহা তখন আবার বলে উঠে,
— তো আপনরাই এখন বলেন কাকে আপনাদের আসল দোষী মনে হয়? অবশ্য আমার কাছে যথার্থ প্রমাণ আছে যে কে দোষী আর কে না। তবুও যুক্তি দিয়ে ঠিক কতটুকু ভেরিফাই করা যায় যে কে কালপ্রিট।

সবাই তখন হিনার দিকে সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকায়। ১০০% এর মধ্যে ৮০% এই হিনার নাম নেয়। আরিহা তখন মুচকি হেসে মি. কালামকে কিছু একটা আনতে বলে। অতঃপর মি. কালাম আসতেই আরিহা নিজের ল্যাপটপে কিছু একটা ফিট করে। অতঃপর সকলের কানে ভেসে আসে হিনা আর ইহানের কথা বার্তা। রুমে থাকা কালিন যেইসব কথাবার্তা তাদের মধ্যে হয়েছিল সবই পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। সকলেই এইবার শকড হয়ে যায়।
আরিহা তখন সকলের দিকে তাকিয়ে বলে,

— আপনাদের অগচোরে সকলেরই চেঞ্জিং রুমে একটি করে অডিও-বাগ লাগানো হয়েছিল যাতে আপনারা যদি আমাদের অফিসের ইম্পোর্টেন্ট নিউজ কাউকে দেন বা দেওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে যাতে আমরা তা জানতে পারি। এই অডিও-বাগ আমাদের অফিসের বিভিন্ন আনাচে-কানাচেতে আছে। এইটা আমাদের কোম্পানির সেফটির জন্য করা হয়েছে।
কিন্তু এইটা যে এই কাজেও আসবে জানতাম না। সো নাও অল ইজ ক্লিয়াল মি. ইহান ইজ ইনোসেন্ট এন্ড মিস. হিনা ইজ কালপ্রিট।

সকলেই এইবার নির্বাক হয়ে যায়। হিনা যে এমন একটা কাজ করবে কেউ কল্পনাও করতে পারে নি। সকলেই হিনার দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। মিডিয়ার লোকেরা তো যেন তাজা নতুন খবর পেয়ে যায়। তারা এইবার হিনার দিকে ফোকাস করতে থাকে। নিউজটিকে কিভাবে আরও হিট করা যায় সেই নিয়ে তাদের যত চিন্তা ধারা। আরিহা এইবার নিজের নিজের শেষ উক্তিটি রাখে।

— এন্ড মি. ইহান তখন আপনাকে থাপ্পড় মারার জন্য দুঃখিত। তখন আপনার বোকামো দেখে রাগ উঠে যায়। আপনি নিজের দিকে কোন খেয়াল না করে এই মেয়ের পিছে পিছে ছুটে আসলেন তাই তখন আপনার অবস্থা দেখে রাগ উঠে যায়। যার জন্য নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে থাপ্পড়টা মেরে বসি।
আর ইন্সপেক্টর প্লিজ দ্রুত এই আবর্জনাকে এইখান থেকে নিয়ে যান। আই গিভ ইউ ৫ মিনিট।

এই বলে আরিহা আর এক মিনিটও না দাড়িয়ে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে যায়। ইন্সপেক্টর তখন হিনাকে গেরেফতার করে নিয়ে যায়।

নিজের কেবিনের ইজি চেয়ারে আরিহা গা এলিয়ে বসে থাকে। তার মাথাটা ধরেছে। এত ঝামেলা আর ভালো লাগে না তার। এইসব উটকো ঝামেলার জন্য কাজটা অর্ধেক রয়ে গেল। কত কাজ বাকি। যখন সে এইসব ভাবছিল তখনই ইহান তার কেবিনে প্রবেশ করে আর চেঁচিয়ে বলে উঠে,

— এতো ড্রামা করার কি দরকার ছিল? আগে বললে কি হতো আমি নির্দোষ। যখন সকলেই আমায় ধর্ষকের ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছিল তখন আর নিজেকে দুধে ধোয়া তুলশি পাতা প্রমাণ করে কি লাভ ছিল? যত অপদস্ত হওয়ার তো হয়েই গিয়েছিলাম আমি।

ইহানের চেঁচানো শুনে আরিহা চোখ খুলে তার দিকে তাকায়। অতঃপর বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলে,
— সকল সত্য বেরিয়ে আসার নির্দিষ্ট একটা সময় থাকে। সেই নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত সত্যটা যখন অসময়ে বেরিয়ে আসলে তখন এর মাধুর্যটাই নষ্ট হয়ে যায়। অসময়ের সত্যের কোন ভেলু নি। আর এমনেও সাসপেন্সের পর যখন আসল সত্য বেরিয়ে আসে তখন সকলের মুখভঙ্গিটা দেখার মত থাকে।

ইহান এইবার কিছুটা চেঁচিয়ে বলে,
— স্টোপ দিস ননসেন্স। আপনি এইসব ইচ্ছে করে করেছেন জানি। অন্যের ফিলিংস নিয়ে খেলতে খুব ভালো লাগে তাই না? অন্যের মান- সম্মান ধুলোয় মিশে যাক তাতে আপনার কিছুই যায় আসে না। এই এক ঘন্টা আমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে আপনার কোন ধারণা আছে? কতটা লাঞ্চিত হয়েছি আমি।

আরিহা এইবার গম্ভীর গলায় বলে,
— হোয়াট এভার! বাই দ্যা ওয়ে আপনার আমায় ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। আপনার নাম থেকে এতবড় একটা অপবাদ মুছে ফেললাম আমি।

ইহান এইবার চেঁচিয়ে বলে,
— থেংক্স মাই ফুট। আই জাস্ট হেট ইউ। হেট ইউ আ লোট।
?

দরজায় নাড়া পড়তেই আরিহা অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলতেই দেখে তীব্র দাঁড়িয়ে আছে। আরিহাকে দেখার সাথে সাথে তীব্র একটা মিষ্টি হাসি হেসে বলে,
— আমরা চলে যাচ্ছি। তুমি প্লিজ ইহানের একটু খেয়াল রেখো।

আরিহা তখন স্মিত হেসে বলে,
— হ্যাঁ অবশ্যই।

অতঃপর তীব্র আরিহাকে বিদায় জানিয়ে সকলের সাথে বেড়িয়ে যায়৷ আরিহা এইবার ধীর গতিতে রান্নাঘরে যায়। সেখানে গিয়ে ইহানের জন্য রাতের খাবারটা রান্না করতে থাকে। রান্না শেষে সে রুমে যেতেই আরিহার ভ্রুকুটি একত্রিত হয়ে যায়। সে এইবার তিক্ত গলায় বলে,

— ইহাননন!!

#চলবে