অন্তরালে তুমি পর্ব-০৯

0
2521

#অন্তরালে_তুমি
#Part_09
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
— ইহাননন!!

আরিহার কন্ঠ কানে আসতেই ইহান সটান হয়ে দাড়িয়ে পড়ে। মুখটা একদম কাঁচুমাচু করে ফেলে। আরিহা এইবার ইহানের সামনে গিয়ে দাড়ায় আর তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আরিহা এইবার তিক্ত গলায় বলে উঠে,
— তুমি আমার পার্সে কি চেক করছিলে?

ইহান এইবার কিছুটা এনিয়ে বিনিয়ে বলে,
— আসলে.. ইয়ে মানে।

আরিহা এইবার শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলে,
— পেঁচানো কথা আমি একদম লাইক করি না ইহান। সে ইট স্ট্রেট ফোরওয়ার্ড।

ইহান এইবার এক দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বলে,
— আসলে নিজের ফোনটা খুঁজছিলাম। রুমে দেখলাম পেলাম না তাই ভাবলাম হয়তো তোমার পার্সে হবে। তাই আরকি!

আরিহা এইবার কিছুটা বিরক্তিকর সুরে বলে,
— লাইক সিরিয়াসলি! এমন একটা এক্সিডেন্ট করে তোমার মনে হয় যে তোমার ফোন আদো আস্ত আছে? রাস্তায় কোথায় না কোথায় পড়ে ভেঙে গিয়েছে অথবা কেউ উঠিয়ে নিয়েছে তা কে জানে। মানে নূন্যতম জ্ঞানবোধ বলেও কিছু আছে।

ইহান এইবার চিন্তিত কন্ঠে বলে,
— ফোনটা যদি বাই এনি চান্স কেউ নিয়ে থাকে তাহলে তো এখনই মানি ট্রান্সফারের সকল মাধ্যম কিছু সময়ের জন্য ব্লক করাতে হবে। তা না হলে প্রবলেম হয়ে যাবে।

আরিহা তখন কাবার্ডের সামনে গিয়ে ইহানের জামাকাপড় বের করতে করতে বলে,
— আমি আগেই সবকিছু করে ফেলেছি।

ইহান এইবার অবাক চোখে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে অপ্রস্তুত সুরে বলে উঠে,
— তুমি একা সব কিছু এত স্মুথলি কিভাবে হেন্ডেল করো? মানে কোন কাজে কখনো কোন খুঁত থাকে না। একটা ঘটনার সাথে জড়িত সকল কাজ একা অনায়েসে মনে রাখো প্লাস ওই গুলো সঠিক সময়ে করেও ফেলো। হাও?

আরিহা তখন সরু দৃষ্টিতে ইহানের দিকে তাকায়। তারপর তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে,
— ছোট থেকে একা হাতে সব হেন্ডেল করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আর এমনেও একা হাতে সবকিছু হ্যান্ডেল করার চর্চা আমায় করানো হয়েছে।

ইহান তখন বলে,
— নিশ্চয়ই এইসব তোমায় তোমার বাবা-মাই শিখিয়েছে। মেয়েকে একদম পুরিপূর্ণ বানিয়েছে।

বাবা-মার কথা শুনতেই আরিহার মাথায় ধব করে আগুন জ্বলে উঠে। পায়ের রক্ত মাথায় চড়ে বসে। চোখ দুটো ভীষণ লাল হয়ে উঠে। রাগে শরীর রি রি করে কাঁপতে থাকে। নিজের দুটো হাত মুষ্টি বদ্ধ করে চোখ দুটো বুঝে ফেলে। নিজের রাগকে কোন মত শান্ত করার চেষ্টা করে। দাঁতে দাঁত চেপে আরিহা বলে,

— আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি তার তোমায় চেঞ্জ করিয়ে দিচ্ছি।

আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়। মুখে অনাবরত ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিতে থাকে। মাথায় হাল্কা পানি দেয়। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। কোন মতে নিজেকে শান্ত করে আয়নায় তাকায়। চোখ দুটো এখনো লাল হয়ে আছে। আরিহা এইবার নিজের রাগকে সংযত করে বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের ড্রয়ার থেকে একটা চকলেট বের করে আর সাথে সাথে তা খুলে মুখে পুরে নেয়। পরপর চারটে চকলেট সে মুখে পুরে নেয়। তার বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে তা চিবুতে থাকে। মূলত এইটি নিজেকে শান্ত করার একটা মাধ্যম।
ইহান আরিহার এমন কান্ড দেখে ড্যাবড্যাব করে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর মনে মনে বলতে থাকে,

— মেয়েটা কি পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি? এমন পাগলামো করছে কেন?

আরিহা এইবার কিছুটা শান্ত হয়ে উঠে। সে দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে দম ফেলে। তারপর চুপচাপ ইহানের গেঞ্জি আর পেন্ট হাতে নিয়ে ইহানের সামনে যায়। আর কিছুটা তিক্ত গলায় বলে,

— আসো তোমায় চেঞ্জ করে দেই আর ফ্রেশ করে দেই।

এমন কথায় ইহান কিছুটা বিব্রত হয়। তার অস্পষ্ট গলায় বলে,
— হোয়াট রাবিস! তোমায় এইসব করতে হবে না। আমি পারবো।

আরিহা এইবার কিছুটা বিরক্তিকর সুরে বলে,
— দেখ এখন ন্যাকামি করে লাভ নেই। তুমি নিজে চেঞ্জ হতে পারবে না তাই আমি করে দিচ্ছি। কিছুদিনের জন্য নিজের রাগ,ইগো, প্রেস্টিজ, হেডনেস পাশে রাখো। নিজে সুস্থ হও তারপর যা ইচ্ছে তা করো। আই হ্যাভ নো প্রবলেম। এখন আমায় আমার কাজগুলো করতে দাও।

?

ছাদের সুইমিংপুলে পা ভিজিয়ে বসে আছে। একটু আগেই ইহানকে খাবার আর ঔষধ খায়িয়ে দিয়ে এসেছে। বাসায় কিছু ভালো লাগছিল না বলে ছাদে এসে বসে পড়ে। আকাশটা এখন শান্ত হতে উঠেছে। একদম স্বচ্ছ পানির মত পরিষ্কার। তার মধ্যে দুই একটি তারার ঝিকিমিকি আলো ফুটে উঠেছে। ঢেউ খেলানো বাতাসে আরিহার সাদা ওরনাটি উড়ছে। ডান পাশ দিয়ে সাদা কামিজের কিনারাটি পানি ঢুবে মরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই পানির নাগালটা পাচ্ছে না। আরিহা মুখভঙ্গি শান্ত দেখা গেলেও ভিতরে তার বয়ে চলেছে এক অসীম ঝড়। শান্ত আরিহাটি আজ অশান্ত হয়ে উঠেছে। তাই তো নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে আরিহা ফোন লাগায় “আজমির সাহেব”-কে।
এত রাতে মেয়ের নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে আজমির সাহেব কিছুটা অবাকই হন। সাথে বিচলিত হয়ে উঠেন। মেয়েটা এইভাবেই কখনো নিজ থেকে ফোন করে না তার উপর আজ করেছে তাও এত রাতে। মেয়েটার কোন বিপদ হলো না তো। আজমির সাহেব এইবার দ্রুত ফোনটা তুলেন। তারপর বিচলিত কন্ঠে বলে উঠেন,

— কি হয়েছে মা এত রাতে যে ফোন দিয়েছিস।

আরিহা তখন কিছু না বলে সরাসরি একটা প্রশ্ন করে বসে,
— আমাকে আপনারা কেন এই পৃথিবীতে এনেছিলেন? এর মুখ্য উদ্দেশ্য কি ছিল?

মেয়ের এমন কথায় আজমির সাহেবের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। তিনি বুঝতে পারেন যে আজ হয়তো কিছু একটা ঠিক নেই। সে বিচলিত সুরে বলে উঠে,
— মা কি হয়েছে? এইভাবে কথা কেন বলছো?

আরিহা এইবার বুঝতে পারে সে কি বলেছে। আরিহা এইবার নিজেকে কিছুটা সংযত রেখে বলে,
— না কিছু হয় নি। সরি আপনাকে এত রাতে ডিস্টার্ব করার জন্য। শুভ রাত্রি।

এই বলে কট করে ফোনটা কেটে দেয় আরিহা। আজমির সাহেব কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বুঝতে দেরি নেই যে মেয়েটা আজ খুব কষ্টে আছে। কিন্তু কেন তা তার জানা নেই। আচ্ছা পুরানো ক্ষতগুলো কি আবার সতেজ হয়ে উঠেছে। না এইটা হতে পারে না। আজমির সাহেব দ্রুত কাউকে ফোন দেন।

?

আরিহা আনমনে বসেছিল এমন সময় জিসানের মেসেজ আসে ফোনে। আরিহা ফোনটা হাতে নিয়ে জিসানের মেসেজটি পড়তে শুরু করে,

” নেট অন কর আরু কি বাচ্চি। কখন থেকে ভিডিও কল দিচ্ছি তোকে। ”

আরিহা এইবার চুপচাপ ফোনের নেটটা অন করে। নেট অন হতেই জিসানের কল হামলে পড়ে ফোনে। আরিহা এইবার ফোনটা রিসিভ করে। সাথে সাথে জিসান ওর উপর কথার ঝুলি নিয়ে হামলে পড়ে,

— ওই মাইয়া বিয়া কইরা কি দুনিয়া দারি সব ভুলে বসে আছিস? নাকি আমাকে ভুলানোর মাস্টার প্লেন করছিস? এক কথা কান খুলে শুনে রাখ এই জন্মে তুই আমাকে ভুলাবার পারবি না। যদি ভুলার চেষ্টাও করোস না তাহলে তোকে ধরে হেমিড্যাকটিলাস ফ্রেনাটাসের জুস খায়িয়ে দিব বলে দিলাম।

আরিহা এইবার ভ্রুকুটি জোড়া করে বলে,
— “হেমিড্যাকটিলাস ফ্রেনাটাস” মানে টিকটিকি না?

জিসান এইবার একটা ইনোসেন্ট ফেস করে বলে,
— হু!

আরিহা এইবার হো হো করে হেসে উঠে বলে,
— তুই পারোসও বটে। এই জন্যই বলে ডাক্তারি পড়া মানুষদের সাথে কখনো বন্ধুত্ব রাখতে নেই। এরা হয়ই আধাপাগল সাথে নিজের বন্ধুদেরও বানায় পাগল।

জিসান এইবার মুখ ফুলিয়ে বলে,
— তুই আমায় পাগল উপাধি দিতে পারলি? নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে পাগল বলতে তোর একবারও বুক কাঁপলো না? আল্লাহ তোমার কাছে বিচার দিলাম!!

আরিহা তখন মুচকি হেসে বলে,
— ড্রামাকিং! এতটা ঢং কিভাবে করিস বল তো? তোকে না ছেলের চেয়ে বেশি আমার মেয়ে মনে হয়।

জিসান এইবার মুচকি হেসে বলে,
— হু! তা এখন ঠিক আছিস তো?

আরিহা মলিন হেসে বলে,
— কিছুক্ষণ আগে ছিলাম না কিন্তু এখন আছি।

জিসান তখন দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— নিজেকে ভালো রাখতে হলেও অনেক সময় কাঁদা উচিৎ। কষ্ট যখন মন-মস্তিকে ভারী হয়ে আসে তখন তাকে হাল্কা করার জন্য কান্নায় শ্রেষ্ঠ উপায়।

আরিহা তখন স্মিত হেসে বলে,
— কান্না কখনোই কোন উপায় হতে পারে না। এইটি শুধু দূর্বলতার প্রতিক। আর এমনেও হুমায়ূন আহমেদ তো বলেছেনই,
” পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ সম্ভবত কষ্ট পাবার জন্যই জন্মায়। টাকা-পয়সার কষ্ট নয় — মানসিক কষ্ট।”
আর কষ্ট আমি তো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

জিসান এইবার নিরবে শুধু এক দীর্ঘ শ্বাস নেয়। অতঃপর কথাটা না বারিয়ে আরিহার সাথে অন্য কথায় মেতে উঠে।

?

ঘুমের ঘোরে ইহান নিজের বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব করে। সে আদো আদো করে চোখ খুলে দেখে আরিহার ওর বুকের বা পাশে ঘুটি মেরে শুয়ে আছে। বুকের এক পাশে মাথাটা রেখে বাহিরের দিকে পুরো শরীরটা রেখেছে যাতে ইহান হাতে প্রেসার না পড়ে। ইহান এইবার বিরক্তিকর একটা ভাব নিয়ে আরিহার দিকে তাকায়। তারপর কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠে,

— মানে এখন একজন অসুস্থ রোগীকেও ছাড় দিবে না তুমি? দেখতেই পারছো আমার এক
হাত ভাঙ্গা তার উপর আহত আমি। এর মধ্যে বুকে শুতেই হবে তোমায় তাই না? আর কত কষ্ট দিতে চাও?

ইহানের কন্ঠ আরিহার কানে আসতেই সে সতেচন হয়ে উঠে। কিন্তু চোখ খুলে না। চোখ না খুলে বলে,

— কষ্ট হোক আর যাই হোক তোমায় সহ্য করতে হবে। এই বুকে এখন শুধু আমার অধিকার। এখানে এখন মাথা না রাখলে যে আমার ঘুম হবে না। আমি যে নিরুপায়। আর এখন কোন কথা নয়।

ইহান এইবার মুখে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বিরবির করে বলে,
— ইরেটেটিং!
এই বলে সেইভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে।

দেখতে দেখতে ২দিন কেটে যায়। আরিহা বেশ ভালোই খেয়াল রাখছে ইহানের। সব কাজ সে করে দিচ্ছে। বাসা থেকেই অফিসের কাজ দেখছে। পুষ্পিতা প্রতিদিন আরিহার বাসায় আসে আর দুইজন এক সাথে কাজটা ঘুছিয়ে নেয় আর নীরা অফিসের দিকটা সামলায়৷ প্রতিদিন বিকেলের দিকে রাতুল, সোহেল ও তীব্রও আসে ইহানকে দেখতে। বেশ ভালো ভাবেই যাচ্ছে দিন।
সকালে ইহান সোফায় বসে আছে আর টিভিতে নিউজ দেখছে। আরিহা মাত্র ওকে সকালের নাস্তা খায়িয়ে দিয়ে ঔষধ গুলো রুম থেকে আনতে গিয়েছে। এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠে। ইহান চেঁচিয়ে আরিহাকে ডাক দেয় গেট খুলার জন্য। আরিহা ঔষধগুলো টেবিলে রেখে চলে যায় গেট খুলতে। গেট খুলার সাথে সাথে এক কিশোরী মেয়ে বাসায় হুরহুর করে ঢুকে পড়ে। ইহান মেয়েটিকে দেখে বলে উঠে,

— এরিনায়া!!

#চলবে