অন্তরালে তুমি পর্ব-১০

0
2451

#অন্তরালে_তুমি
#Part_10
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
— এরিনা!

এরিনা দৌড়ে ইহানের কাছে চলে যায়। তার পাশে বসে তাকে বিচলিত কন্ঠে বলতে থাকে।
— ভাইয়া তুই ঠিক আছিস তো? এইসব কিভাবে হলো? কত ব্যথা পেয়েছিস৷

ইহান এইবার বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠে,
— আমি তো ঠিক আছি কিন্তু তুই কানাডা থেকে একা কিভাবে আসলি? আর এই বাসা বা চিনলি কিভাবে?

এরিনা তখন মুচকি হেসে বলে,
— ভাবী এইখানে আসার সব ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল। তাই আসতে কোন প্রবলেম হয় নি।

ইহান এইবার বিস্মিত চোখে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। আরিহা বাঁকা হেসে দাড়িয়ে আছে। তখন এরিনা গিয়ে আরিহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— আ’ম সরি ভাবী। তখন ভাইয়ার টেনশনে তোমার সাথে কোন কথা না বলেই দৌড়ে ঢুকে এসে পড়েছিলাম। তুই রাগ করো নি তো?

আরিহা তখন মুচকি হেসে এরিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
— একদম না। এমন সুইট নন্দিনীর উপর কি রাগ করা যায়? তা এইখান পর্যন্ত আসতে প্রবলেম হয় নি তো? আমি যাদের পাঠিয়েছিলাম তোমাকে আনতে তারা তোমায় ঠিক মত এনেছে তো?

এরিনা মুচকি হেসে বলে,
— আমার কোন প্রবলেম হয় নি। আর ওরা ওদের কাজ ঠিক মতই করেছে। এই প্রথম আমি আমার জার্নিটা খুব এনজয় করেছি। থেংক্স টু ইউ ভাবি।

ইহান এতক্ষণ দুইজনের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন মনের মধ্যে কৌতূহল এসে ভর করে। ইহান এইবার তিক্ত গলায় বলে উঠে,
— এইখানে এইসব কি হচ্ছে? এরিনা তুই আরিহার কথা কিভাবে জানলি? আমার সাথে তো তোর ৪-৫ দিন ধরে কথা হয় না।

এরিনা তখন ইহানের দিকে চেয়ে বলে,
— আমি তো ভাবীকে শুরু থেকেই চিনি। তুই না বললে কি হবে? ভাবী আমায় ঠিক খুঁজে নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। আফটার অল আমি তার একমাত্র নন্দিনী।

ইহান এইবার সন্দেহ দৃষ্টিতে আরিহার দিকে তাকায়। আরিহা তা দেখে মুচকি হেসে ইহানের দিকে এগিয়ে আসে। তারপর টেবিল থেকে ঔষধগুলো নিয়ে ইহানের দিকে এগিয়ে দেয় আর শান্ত গলায় বলে,
— আগে ঔষধটা খাও। তারপর সব বলছি তোমায়।

ইহান এইবার ঔষধ গুলো খেয়ে নেয়। তারপর কৌতুহলি দৃষ্টিতে আরিহা আর এরিনার দিকে তাকিয়ে থাকে। আরিহা এরিনার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে বাঁকা হেসে বলে,
— তা কি বলো নন্দিনী! তোমার ভাইকে সব বলে দিব? কিভাবে তুমি আমায় সাহায্য করেছ। কিভাবে তুমি ইহানকে বাধ্য করেছ আমার সাথে এই বিয়েটা করতে।

এরিনা এইবার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
— বলো!

আরিহা এইবার মুচকি হেসে বলে,
— থাক তুমি এই বলো। আমি বললে হয়তো তোমার উপর বেশি রাগ করবে বরং তুমি এই বলো।

এরিনা এইবার দাঁত কেলিয়ে ইহানের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
— আসলে ভাইয়া ভাবী তোকে মিথ্যে বলে বিয়ে করেছিল। তোর বিয়ের দিন ভাবী আমায় কিডন্যাপ করে নি। সেই সব ছিল ড্রামা। যখন ভাবী আমায় বলে তুই নাকি ভাবীর সাথে রাগ ব্রেকাপ করেছিস আর ভাবীকে বিয়েও করতে চাইছিস না তখন খুব রাগ হয় আমার। তাই আমি আর ভাবী মিলে আমার কিডন্যাপিং এর নাটক করি আর ওই ভিডিওটা করি। যাতে তোর মনে হয় তুই আমায় বিয়ে না করলে ভাবী আমার ক্ষতি করবে।
আমি জানতাম আমার কথা আসলে তুমি না করতে পারবে না। তাই এমনটা করি। সরি ভাইয়া!

প্রথম তো আরিহার সাথে ব্রেকাপের কথা শুনে ইহান চমকে উঠে। আর সে মনে মনে বলতে থাকে, “আরিহার সাথে আমার রিলেশন ছিলই কবে যে ব্রেকাপ হবে।” অতঃপর বুঝতে দেরি নি এইটা আরিহার বানানো কোন মিথ্যে।
কিন্তু এরিনার কথা শেষ হতেই ইহান রাগে ফেটে যায়। মানে যার কথা চিন্তা করে সে এতকিছু করলো তার কোনটাই সত্য ছিল না। সবই মিথ্যে সাজানো এক নাটক।
ইহান এইবার চেঁচিয়ে বলে,
— এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলি তুই আমার সাথে? এই মেয়ের কথায় এসে নিজের ভাইকে ধোঁকা দিল।

এরিনা এইবার কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
— ভাইয়া এইভাবে বলছিস কেন?

ইহান তখন চেঁচিয়ে উঠে,
— তো কিভাবে বলবো? তোর এই এক কাজে আমি ঠিক কতটুকু কষ্ট পেয়েছি তা না বললেই নয়। কাজটা তুই ঠিক করিস নি এরিনা। আমার ইমোশন নিয়ে এইভাবে না খেললেও পারতি।

এই বলে ইহান গটগট করে রুমে চলে যায়। আর এরিনা ছলছল চোখে আরিহার সামনে তাকায়। আরিহা তখন মুচকি হেসে বলে,
— তোমার ভাইয়ের মাথাটা এখন গরম তাই এমন করছে। মাথা ঠান্ডা হলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপাতত এখন ফ্রেশ হয়ে এসো কিছু খাও তারপর ভাইয়ার কাছে যেও। কিউট করে সরি বললেই দেখবে সব রাগ ভুলে মাফ করে দিবে।

এরিনা আরিহার কথায় আশ্বস্ত হলো। তারপর আরিহার দেখানো রুমের দিকে চলে যায়। আর আরিহা চলে যায় তার স্টাডিরুমে চলে যায়।

?

বৈশাখ মাসের তিক্ত গরমের আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মাথার উপর জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ডটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আর তার তীক্ষ্ণ প্রভাব ফেলছে মানুষের উপর। সকলেই যেন আজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই আজ। গাছের পাতা গুলোও যেন নড়তে ভুলে গিয়েছে। স্থির হয়ে আছে তারা আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে ঠিক কখন এক দামকা হাওয়া এসে তাদের ছুঁয়ে যাবে আর তারা খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে। পাখিও যেন ক্লান্ত হয়ে অলস ভঙ্গিতে গাছের ডালে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। সব মিলিয়ে আজ এক তিক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে আজ।
ইহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। খুব কষ্ট করে একটা সিগারেট ধরায় সে। বা হাতের আঙুলের ফাঁকে মাঝে জলন্ত সিগারেটটি চেঁপে ধরে আছে সে। কিছুক্ষণ পরপরই ইহান তা ওষ্ঠ দুইটির মাঝে চেঁপে ধরছে টান দিচ্ছে আর বাতাসে বিষাক্ত নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ দুটো ভীষণ লাল। অতীতের স্মৃতি গুলো মনের কোনে নাড়া দিচ্ছে। সেই দিনের কথাটা বার,বার মনে পড়ছে যেইদিন ওর গায়ে ধর্ষকের ট্যাগটা লেগে যায়। হয়রানি সহ্য করতে হয় তাকে। সে আস্তে আস্তে ডুব দেয় সেই অতীতের পাতায়।

?
বাসায় এসে ইহান সেইদিন নিজের রুম থাকা সকল জড়বস্তু ভেঙ্গে ফেলে। নিজের রাগকে শান্ত করার একটা প্রক্রিয়া স্বরুপ এই কাজটি করে সে। কিন্তু তাতেও তার রাগ যেন কমেই নেই। ড্রয়িং রুমের সোফায় মাথা চেঁপে বসে সে। চোখ দুটো দিয়ে আগুন ঝড়ছে। টিভি অন করতেই একটা নিউজ চোখে পড়ে,
” ইউটিউবার ইহান মাহমুদ একজন ধর্ষক। তার চরিত্র খারাপ। সে পশু হতেও অধম।”
পুরা সত্যিটা বেরিয়া আসার পরও মিডিয়ার লোকেরা নিজের চ্যানেলের রিচ বাড়াতে সেই আগের নিউজটি আঁকড়ে রাখে। কয়েকটি চ্যানেলে ইহানকে নির্দোষ বলা হলেও অনেকটিতে এখনো তাকেই ধর্ষকের উপাধি দিয়ে রেখেছে। ইহান ফোন বের করে নেট অন করতেই হাজারো নোটিফিকেশন এসে ভীড় জমায় তার ফোনে। ৫০০+ মেসেজ এসে জমা হয় ইনবক্সে। সবটিতে তাকে অশ্লীল ভাষায় গালি গালাজ করা হয়েছে। তার প্রত্যেকটা পোস্টে তাকে আজে বাজে কথা বলা হয়েছে। তাকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। ওর বাবা-মা, জাত-ধর্ম, ওর চরিত্র নিয়ে অনেক বাজে মন্তব্য করা হয়েছে। এমন কি তার ইউটিউব চ্যানেলেও একই মন্তব্য দেখা গিয়েছে। ফেসবুকে ওকে নিয়ে হাজারো ট্রল শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে।

বাঙালি জাতি এমনই। তারা আসল সত্যিটা না জেনেই আগে ভাগেই মাতামাতি শুরু করে দেয়। মিথ্যেকেই তারা বানিয়ে ফেলে চিরতর সত্য। সেই মিথ্যে নিয়েই তারা মাতামাতি করে। আসল সত্যি যখন বেরিয়ে আসে তখনও তারা সেই মিথ্যেটার পিছেই ছুটে। এইটাই হচ্ছে এই দেশের ট্রেন্ড। যখন যে বিষয় একবার সকলের মাঝে ছড়াবে তখনই তারা সেই বিষয়টি নিয়ে মাতিয়ে উঠবে। সত্য নাকি মিথ্যে তা কখনোই যাচাই-বাচাই করে না।
ইহানের বেলায়ও ঠিক তাই হয়েছে। সেই ১ ঘন্টার মাঝে এই নিউজটা যে এইভাবে ছড়িয়েছে যে আসল সত্যটা এখন তার নিচে চাঁপা পড়ে যায়। কেউ আসল সত্যের প্রতি গুরুত্বই দেই নি। বরং দোষারোপ করে গেছে ইহানকেই।
ইহান এইবার মাথা চেপে বসে। চোখ দিয়ে তার টুপটুপ করে পানি পড়ছে। সে বলতে থাকে,

— এমনটা কেন করলেন আরিহা? কেন! সত্যিটা যখন জানতেই তখন আগে বলে দিলে হয়তো এখন আমায় এতকিছু সহ্য কর‍তে হতো না। সেই ১ ঘন্টা আমার জীবনের সব কেড়ে নিয়েছে। সত্যিটা সকলের সামনে আশার পরও আমি ধর্ষক। আমি অপরাধী। আগেই যদি সব ক্লিয়ার করতেন তাহলে আজ আমার গায়ে এই ধর্ষকের ট্যাগটা লাগতো না। এত অপদস্ত হতে হতো না। আই জাস্ট হেট ইউ মিস আরিহা আহমেদ। আই জাস্ট হেট ইউ। আমার সকলের কষ্টের দাম আপনাকে দিতেই হবে। দিতেই হবে।

এই বলে সামনে থাকা কাঁচের টি-টেবিলটা সে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। চোখ বেয়ে পড়তে থাকে অজস্র অশ্রুর ধারা।

[ আপনারা বলেছেন ইহান বেশি করছে। আরিহা তো ওর উপকারই করেছে। ইহান এখন বেশি দেমাক দেখাচ্ছে। তাহলে আমি বলবো আপনারা ভুল।
আরিহা ইহানের সাহায্য করেছে ঠিকই কিন্তু তাতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। সত্যটা জানার আগেই চারদিকে সেই মিথ্যেটা ছড়িয়ে পড়ে। আর অপদস্ত হতে হয় ইহানকে। ইহান যেহেতু সেলেব্রিটি থেকে কম নয় তাই নিউজটা শুনা মাত্র সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপরে। একজন পাবলিক ফিগার যদি সামান্য ভুলও করে তাহলে সেটা মূহুর্তেই তিল থেকে তাল হয়ে যায়। সেখানে এমন এক বিষয় তো এলাহিকান্ড। ইহানকে যা যা সহ্য করতে হয়েছে তাতে রাগ করাটা স্বাভাবিক। আপনারায় বলেন, আপনাদের যদি কেউ বিনা দোষে একটা সামান্য গালিও দেয় তাহলে কি আপনাদের ভালো লাগবে? একদম না! রাগে তখন পুরো শরীর রি রি করবে। তাহলে ইহান কিভাবে এত কিছু সহ্য করবে শুনি? সেও তো মানুষ নাকি? ওর এমন মনোবল একদম স্বাভাবিক।
কিন্তু এইখানে দুই পক্ষেরই দোষ নেই। না আরিহার না ইহান। আরিহা সঠিক সময়ে সব কিছু ক্লিয়ার করতে চেয়েছিল কিন্তু তাতে হয়তো দেরি হয়ে যায়। আর এইখানে আরিহার প্রতি ইহানের রাগ ও ঘৃনাও অহেতুক নয়।
আশা করি এইবার সকলেই বুঝেছেন। ]

?

হুট করে কেউ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরায় ইহানের ধ্যান ভাঙ্গে। সে পাশে ফিরতেই দেখে এরিনা ওকে জড়িয়ে ধরে আছে৷ ওর ফর্সা মুখটা একদম লাল হয়ে আছে। একদম কাঁদো কাঁদো হয়ে আছে সে। এখনই যেন ওর চোখে বর্ষণের ধারা শুরু হবে। যত যাই হোক একটা ভাই কখনো নিজের বোনের চোখে পানি দেখতে পারে না। ইহানের বেলায়ও তাই। রাগ ধরে রাখতে না পেরে এরিনাকে বা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। এরিনা এইবার ফুঁপিয়ে উঠে বলে,

— সরি ভাইয়া! আমার করা কাজের জন্য তুই যে এতটা কষ্ট পাবি তা বুঝি নি। সরি আমায় মাফ করে দে।

ইহান এইবার বলে,
— আরেহ কাঁদছিস কেন? আমি তোর থেকে রাগ নেই। তুই এখন চুপ কর।

এরিনা অস্পষ্ট সুরে বলে,
— সত্যি!!

ইহান মুচকি হেসে বলে,
— তিন সত্যি!

তখনই কিছু পড়ে যাওয়ায় দুইজনে পিছে তাকায়। রক্ত দেখে তারা স্থির হয়ে যায়।

#চলবে
রি-চেক করা হয় নি তাই ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।