অন্তরিণ প্রণয় পর্ব-৮+৯

0
419

#অন্তরিণ_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৮

বাড়ির লিভিং রুমে বসে আছে সেহেরিশের পরিবারের সদস্যরা।তাদের মধ্যমণি হয়ে আছেন আহনাফ দেওয়ান।সবাই উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে তার দিকে।সেহেরিশ মারুফার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।বর্তমানে শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে তবুও এমন শীতে ঘামছে সেহেরিশ।তার চিন্তাররাজ্যে বার বার ভর করছে আফীফ দেওয়ান।সেই আট বছর আগেও ছিল এমন ডিসেম্বর মাস।বাংলাদেশ তখন প্রচন্ড কুয়াশায় ঢাকা।শীতের প্রকটে নিমজ্জিত জনজীবন।সেই পূবাহ্ণে আফীফের সাথে দেখা তার। সেদিন আফীফের থেকে মুক্তি চাইতে কত ছলা কলা কৌশল এটেঁছিল আর আজ সে নিজেই আফীফের দরবারে হাজির।

– আপনাদের সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি।মতাব্বরের ছেলে রমিজ মিয়া খুব একটা সুবিধার নয়।তবে আমাদের দেওয়ান বংশের সাথে কোন দিন বেয়াদবি কিংবা চালাকি করতে যায়নি।আমরা যখন যা বলেছি সে করেছে।আজ যেহেতু সৌদি চলে গেছেন সে হিসেবে আমার হাত ফাঁকা।এখন এই মূহুর্তে কোন সিধান্ত আমি নিতে পারবো না।

আহনাফ দেওয়ানের কথায় চিন্তায় মুখ ভার হয়ে গেলো খুরশীদের।
– তবুও আপনি আপনার চেষ্টার ত্রুটি রাখবেন না দয়া করে।আমি অনেক দূর থেকে এসেছি।আগামী সাপ্তাহ আমার আব্বা আম্মার মৃত্যু বার্ষিক আমি চাইছি এবারের আয়োজনটা বড় করে করা হবে।কিন্তু জমির সমস্যা নিয়ে আমার মনটাই নড়ে গেলো।
– আপনি যে সিধান্তে দেশে এসেছেন সেই সিধান্ত বজায় রাখুন।রমিজ সৌদি থেকে ফিরে আসলেই আমরা আলোচনায় বসবো।তাছাড়া এইসব ঝামেলার কাজ আমার নাতি দেখা শোনা করে।আমার তো বয়স হয়েছে এত কিছুর দখল সামলানোর সময় আমার নয়।
– আপনার নাতি?

-আফীফ দেওয়ান!আমার বড় ছেলের, বড় পুত্র।
আফীফের কথা শুনতেই নড়েচড়ে বসে মারুফা এবং সেহেরিশ।সেহেরিশের শঙ্কিত মুখ দেখে ইশারায় চুপ থাকতে বলেন মারুফা।

– যাই হোক খুরশীদ সাহেব আমাকে এখন উঠতে হবে!
আহনাফ দেওয়ানের কথা বিচলিত হয়ে যান খুরশীদ।
– কিন্তু আমাদের তো কথা শেষ হয় নি।
– একটু পর গ্রামের সার্লিশে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে।তাই এখন আর আপনার সাথে আলোচনা করতে পারছিনা আমি দুঃখিত।
– ঠিক আছে আপনার সাথে আমার পরে কথা হবে।আজ তবে আমরা আসি।
– এ কি আজ চলে যাবেন?দেওয়ান পরিবারের নিয়ম তো নেই মেহমান আপ্যায়ন ছাড়া বিদায় নেবে।আপনাদের আজ রাত এখানেই থাকতে হবে।বাইরে প্রচন্ড কুয়াশা।এমন শীতের মাঝে মোটেও এত দূর যাওয়া উচিত নয়।আপনারা আজ থেকে যান।

– না না তা হয় না আমরা অলরেডি হোটেল বুকিং করে ফেলেছি।
– আপনাদের ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি নেই?
– না আমার যা ছিল সব অনন্তপুরেই কিন্তু আজ সেই জমিও আমি হারাতে বসেছি।
– তবে বেশ আজ থেকে আপনারা এখানেই থাকবেন হোটেল বুকিং ক্যান্সেল করুন।আমার শেষ কথা এর পর আপনার আপত্তি থাকলেও আমার কিছু করার নেই। আপনার জন্য এখানে থেকে যাওয়াটাই ভালো হবে।

আহনাফ দেওয়ানের কথায় খলবলিয়ে উঠে সেহেরিশ।তাকে দাঁড়াতে দেখে বাদ বাকি সবাই দাঁড়িয়ে যায়।আহনাফ দেওয়ানের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দেয়,
– আ…আমরা গ্রামের পরিবেশের সাথে মানিয়ে উঠতে পারবো না। আমরা বরং ঢাকায় ফিরে যেতে চাইছি।
আহনাফ আপাদমস্তক সেহেরিশকে দেখে নিলেন।তার কথায় লীন হেসে তীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব দেয়,

– এই বাড়ি দেখে আশা করি এতক্ষণে বুঝে ফেলেছো কোন কিছুর কমতি নেই।ত্রুটিহীন বাড়িটাকে আরো নিটোল ভাবে সাজিয়েছে আমার দাদুভাই।তাছাড়া শহরে অনেক থেকেছো এবার না হয় গ্রামের হাওয়া গায়ে লাগাও।তা খুরশীদ আনওয়ার আপনি আপনার পরিবার স্বজন নিয়ে আজ থেকে এই বাড়িতেই থাকুন।
– আমার মেয়েটা যখন চাইছে না তখন আপনাদের আর কষ্ট দেবো না।আমরা আজ রাতের বেক করবো

খুরশীদ আনওয়ারের কথা শেষ হতেই সমীরণে ভেসে আসে এক গম্ভীর কণ্ঠ,
– আমার দাদাজানের কথা কেউ কখনো অমান্য করেনি আশা করি আপনিও করবেন না।

আফীফের কন্ঠে সহসা সবাই চকিতে তাকায়।
– আসসালামু আলাইকুম আমি আফীফ দেওয়ান। দাদাজান নিশ্চই আমার পরিচয়টা এতক্ষণে দিয়ে দিয়েছে।
– ওয়া আলাইকুমস সালাম।হ্যা তোমায় চিনতে পেরেছি।

আফীফ আর খুরশীদ সমান তালে কথা বলে যাচ্ছে, এদিকে সেহেরিশ অবাক হয়ে আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে আফীফের দিকে।আগের আফীফের উগ্রতার মাঝে বর্তমান আফীফের কোন মিল নেই।নির্মল,সচ্ছল চেহারার কথা বার্তায় মার্জিত।কে বলবে এই লোকটা উগ্র!রাগী!স্বার্থপর।
দ্রুত গায়ে থাকা হুড়ির টুপিটা এঁটো সেঁটো করে মাথায় জড়িয়ে নেয় সেহেরিশ।আফীফ যেন সহযে তার চেহারা চিনতে না পারে।

– আঙ্কেল আপনারা কোন চিন্তা করবেন না।আপনাদের জন্য পার্ফেক্ট থাকার জন্য রুম দেওয়া হবে।হোটেলের বুকিং ক্যান্সেল আমি করছি।আপনারা শুধু আমাদের অনুরোধ টুকু রাখুন

আফীফের সরলতা,ভদ্রতা দেখে ফাহমিদা সহসা সম্মোতি জানান।আর তার সম্মোতি পেয়ে সবাই হা তে হা মেলালেও একমাত্র মারুফা আর সেহেরিশ কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। তবুও সকলের চোখে সন্দেহের বাতি জ্বলার আগেই সেহেরিশ এবং মারুফা রাজি হয়ে যায়।
—-

খুরশীদ-ফাহমিদার জন্য নিচের তলার রুম ঠিক করা হয়েছে।
কেইন-তুন্দ্র,মারুফা-সামী,তাদের জন্য দোতলার বাম দিকের রুম দেওয়া হয়েছে।একমাত্র সেহেরিশের জন্য দোতলার ডানের রুমটি দেওয়া হলো।সবার থেকে বিচ্ছিন্ন রুমটি সেহেরিশের হওয়ায় তার ভীষণ রাগ লাগলো কিন্তু ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাগারাগি না করে নিজের রুমে গিয়ে ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে দেয়।দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার চোখ খুলতেই একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রুমের চারিপাশ।অদ্ভুত সুন্দর ডেকোরেশন পুরো রুম জুড়ে।কেউ দেখে বলবে এই গ্রামে এত সুন্দর রুমের ব্যবস্থা।সেহেরিশ পীল পীল পায়ে এগিয়ে যায় রুমের দিকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ধপ করে বসে যায় বিছানার উপর।

হাজারটা চিন্তার পাসরা রেখে সেহেরিশের মাথায় হুট করেই প্রশ্ন আসে আফীফ কী তাকে চিনতে পারেনি?সবার সাথে কথা বলার সময় আফীফ তার দিকে একটি বারেও তাকায় নি।তবে কি ফুফির কথাই ঠিক!আফীফ সব ভুলে গেছে।হয়তো বা ভুলেই গেছে জমিদারের নাতি হাজারটা কাজ তার ঘাড়ের উপর।তাতে এই সামান্য মেয়েটির কথা মাথায় রাখবে কী করে?

—-
রাতের ডিনার টেবিলে সেহেরিশের পরিবারের সকল সদস্য সহ আফীফ আহনাফ দেওয়ান বসেন।বাড়ির মহিলা সদস্যরা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।একে একে সেহেরিশের পরিবারের সঙ্গে সবার পরিচয় পর্ব শেষ।সেহেরিশ ঘুরে ঘুরে সব মহিলাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।আফীফের মা সেঁজুতি তাকে চিনতে পারছে না।বাড়ির কাজের মেয়ে মর্জিনা আফীফের দাদীজান আমেনা এবং আহনাফ দেওয়ান তাকে চিনতে পারলো না।সব কিছু কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে গেছে।কি করে সম্ভব মাত্র আট বছরে একটি মেয়েকে ভুলে যাওয়া। সেহেরিশতো তাদের ভুলতে পারেনি।

– আপনার নাম কি মিস?
মুনিফের কন্ঠে সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।
– স..সেহেরিশ!
– ওহ সামীর বোন আপনি।আপনার ভাই তো ভীষণ চটপটে তবে আপনি এমন শান্ত কেন?আসার পর থেকেই দেখছি কেমন যেন চিন্তিত?
সেহেরিশ কিছু বলার আগেই কেইন হড়বড়িয়ে কথা শুরু করে দেয়,
– হেই ব্রো সেহেরিশ মোটেও চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে নয়।সে কথা বলতে নিলেই দশজনের কথা একজনেই বলে দেয়।

কেইনের কথা শুনে সকলেই মৃদু হাসে।সকলের কাছে ডিনার টেবিলে করা আলোচনা স্বাভাবিক লাগলেও। পরিবেশটার সাথে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছেনা সেহেরিশ।আফীফের দিকে যতবার নজর গেছে ততবার তার শ্বাস আটকে আসার উপক্রম হয়েছে।সব কি তিক্ত অসহ্য লাগছে তাই বাড়ির সবার খাওয়ার মাঝেই সেহেরিশ দাড়িয়ে যায়,

– আমার খাওয়া শেষ মাম্মি আমি ঘরে যাই।
– কি বলিস তোর ভাত এখনো প্লেটে সম্পূর্ণটাই রয়ে গেছে।
– আমার ইচ্ছে করছে না। আমি গেলাম।
সেহেরিশ যেতে নিলেই আফীফের মা সেঁজুতি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফীফ চোখ ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলেন।সেহেরিশের অর্ধ খাওয়া থালাটার দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আফীফের।

তুন্দ্র এবং কেইন রাতে একসাথে আড্ডা দিতে বাড়ির স্টাডি রুমটি খুজে নেয়।সেখানে বসে কিছু দলিল দেখছিল আফীফ তাদের দেখে রুমের ভেতরে আসতে ইশারা করে,

– তুন্দ্র কেইন আপনারা ভেতরেই আসতে পারেন।
– থ্যাংস ব্রো।আপনার স্টাডি রুমের বইয়ের কালেশন তো প্রচুর।
– জি, আপনারা চাইলে নিয়ে পড়তে পারেন।
– অবশ্যই আমি যতদিন এখানে থাকবো অর্ধেক বই শেষ করার প্লানিং নিয়েই থাকবো।

তুন্দ্রের কথায় মৃদ্যু হাসে আফীফ।তুন্দ্র চেয়ার থেকে উঠে প্রতিটি আলমারিতে বইয়ের কালেকশন দেখতে থাকে।এদিকে কেইন তুন্দ্রের ক্যামেরায় সেহেরিশের ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছে।হঠাৎ একটি ছবিতে চোখে আটকে যায় কেইনের তুন্দ্রের দিকে তাকিয়ে উৎসাহ নিয়ে বলে,

– হেই তুন্দ্র গায়ে ফুল পড়া ছবিটায় সেহেরিশকে পুরো প্রিন্সেস লাগছে।
– আমি আগেই বলেছিলাম এই ছবিটা বেস্ট ছিল।
– হাহ!
কেইনের কথায় আড় চোখে তাকায় আফীফ।স্বাভাবিক ভাবে সেহেরিশের বন্ধু হিসেবে কেইনকে সম্মোহন করলেও এই মূহুর্তে তাদের সর্ম্পকটা বড্ড জটিল লাগছে আফীফের কাছে।তাই কেইনের মনের ভাব জানার জন্য আফীফ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেইনকে প্রশ্ন করে,

– আপনারা কি শুধু তিন জন ফ্রেন্ড?
– নো,আমরা চারজন।জুহি আসতে পারেনি তার বাবা অসুস্থ।তাই আমরা নিজেরাই চলে এলাম।
– ওহ!আপনার ফ্রেন্ড সেহেরিশ কেমন যেন অদ্ভুত! আসার পর থেকেই লক্ষ্য করছি।
– না সে ঠিকি ছিল তবে বিডিতে যেদিন আসার সিধান্ত হয় সেদিন থেকে সে অন্যরকম বিহেব করছে।যানি না কেন।

কেইনের আফসোস ভঙ্গির কথা শুনে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।আফীফের দিকে সহসা দৃষ্টি রেখে কেইন ফিসফিস করে বলে,
– হেই ব্রো ইউ আর লুকিং সো কিউট।গার্লফ্রেন্ড আছে তোমার?
– নো!
– পছন্দের কেউ?
-ইয়েস!
– ওয়াও কে সেই লাকি গার্ল?
– অন্যদিন বলবো।তোমার কেউ আছে নাকি কেইন?
– ইয়েস।মাই ক্রাশ,মাই হার্ট,মাই অনলি ওয়ান ফেইরি সেহেরিশ।
সেহেরিশের নামটা শুনতেই আফীফের মুখের রং পাল্টে যায়।হাতে থাকা দলিল গুলো ফাইলে গুছিয়ে রেখে কেইনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাটা শুরু করে।এই রাতে কি হবে কে জানে?

শব্দহীন পায়ে দোতলার ডানের সেহেরিশের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অজ্ঞাতে এক ব্যক্তি।গায়ে থাকা হুড়ির জ্যাকেটির পকেট থেকে হাত মোজা নিয়ে দ্রুত দুই হাতে পরে নেয়।দরজার নব ঘুরাতেই সহসা দরজাটি খুলে যায়।ঘোর অন্ধকার মিশ্রিত রুমটার দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে লোকটি।

#চলবে….

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৯

ঘোর অন্ধকারের মাঝে লোকটি রুমে প্রবেশ করে দ্রুত ফোনের টর্চ অন করেন।দরজা বন্ধ করে ক্রমশ এগিয়ে আসে সেহেরিশের বিছানার দিকে। ক্লোরোফর্ম হাতে নিয়ে রুমালে তা স্পে করে সেহেরিশের নাকে চেপে ধরে।মূহুর্তেই সেহেরিশ অচেতন হয়ে গেলে লোকটি ধপ করে সেহেরিশের পাশে বসে পরে।বালিশের পাশে থাকা সেহেরিশের ফোনটা হাতে তুলে নিতেই ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি রেখা ফুটে উঠে।সেহেরিশের ফোনে কোন প্রকার লক নেই যার দরুনে লোকটি একে একে গ্যালারি সহ কল লিস্ট চেক করতে থাকে থাকে।কিছু কিছু তথ্য নিজের মোবাইলেও সংগ্রহ করে রাখে।কেইন এবং তুন্দ্রের সাথে সেহেরিশের বেশ কয়েকটি ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের ছবি দেখে মূহুর্তেই রাগ মাথায় চড়ে যায়।নিজের ফোন থেকে অন্য একজনকে ফোন করে রাগান্বিত স্বরে বলে,

– হোয়াটিস দিস জিউ?সেহেরিশের সাথে কেইন তুন্দ্রের কি সম্পর্ক?
-………….
– কোনটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক?তুন্দ্রের টা মেনে নিলাম বন্ধু কিন্তু কেইন?কেইন নিজের মুখে বলেছে সেহেরিশ তার ক্রাশ,হার্ট,ফেইরি।এত বছর তোমায় কেন রেখেছি আমি, সেহেরিশের কোন দিকটায় খেল রেখেছো তুমি।
-..………….
– ফ্রেন্ড!বললেই হলো আমি দেখে নেবো কেইনকে। মাইন্ড ইট।
অপর পাশের ব্যাক্তিটি কিছু বলার আগেই অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি ফোন কেটে দেয়।গাঢ় করে শ্বাস ছেড়ে বসে যায় শেহেরিশের মাথার পাশে।তার চুলে হাত বুলিতে বুলাতে ভাবতে থাকে হাজারটা কথা।

সকালের আলো ফুটতেই ঘুম থেকে ওঠে পড়েন খুরশীদ।আহনাফ দেওয়ানের সাথে গ্রামের পরিবেশ দেখতে তখনি হাটতে বের হন।ফাহমিদা আফীফের মা সেঁজুতি এবং ফুফু চন্দনার সাথে রান্না ঘরে আলাপচারিতা করছেন।সামী,কেইন এবং তুন্দ্র তাদের ক্যামরা নিয়ে ফটোগ্রাফির উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেছে সেই সাত সকালে।বাড়ির সবাই যখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত ঘড়ির কাটা যখন নয়টার ঘরে ছুঁই ছুঁই তখনি আফীফ ডেকে পাঠায় আমানকে।

– আমায় ডাকছিলে ভাইয়া?
– হ্যা।তোমার ভাবী কোথায়?
– রুম থেকে এখনো বের হয় নি।যত সম্ভব ঘুমেই আছে।
– এই বাড়ির নিয়ম সবার জন্য এক।সকাল আটটার পর কেউ ঘুমিয়ে থাকতে পারবে না তবে সে এখনো ঘুমিয়ে আছে তুই আমায় জানাস নি কেন?
– ভাবী আমাদের অতিথি ভাইয়া।শরীর হয়তো ক্লান্ত তাই উঠেনি।
– সকাল দশটার আগে মহারানীর ঘুম ভাঙ্গেনা আমি ভালো করেই জানি।যেহেতু আগামী দিন গুলোতে তাকে এই বাড়িতে থাকতে হবে সেহেতু এই বাড়ির নিয়মের সাথে তাকে মানিয়ে নিতে হবে।তুই বরং মৌ’কে ডাক।
– মৌ’কে দিয়ে কি হবে ভাইয়া?
– যা বলেছি তাই কর।

আমান এক ছুটে মৌ’কে ডেকে আনে।আফীফের ভক্ত মৌ।আফীফের কোন কথাই আজ পর্যন্ত অমান্য করেনি সে।বরং হেসে খেলে সবার মন মাতিয়ে রাখে,
– আমাকে ডেকেছো তুমি ভাইয়া?
– হ্যা তোমায় ডেকেছি।তোমায় আমি গতকাল কী বলছিলাম?
-উমমম কী বলেছিলে আমার তো মনেই পড়ছে না।
– তোমায় বলি নি সেহেরিশের দায়-দায়িত্ব তোমার।আমার যেমন মন জয় করেছো এবার সেহেরিশেরো মন জয় করো।
– উফফ আমি ভুলেই গেছিলাম।সামী ভাইয়ার সাথে মজা করছিলাম। এবার বলো ভাইয়া আমাকে কি করতে হবে?
– যাও সেহেরিশকে ঘুম থেকে উঠতে বলো আমরা একসাথে নাস্তা করবো।
-যথা আজ্ঞা।
মৌ মিষ্টি করে হেসে, সোজা সেহেরিশের রুমের দিকে হাটা শুরু করে।

জানলার কাঁচে শিশিরের আস্তরণ জমাট বেঁধে আছে।হালকা আলোয় আলোকিত হয়ে আছে রুমটা।ছোট্ট মৌ খুঁজে খুঁজে লাইটের সুইচ খুঁজে বের করে লাইট অন করে দেয়।বিড়ালছানার মতো কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।

– এই যে মিষ্টিপু উঠো।আর কত ঘুমিয়ে থাকবে?উঠনা প্লিজ।তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।ওওওওও আপুনি উঠে যাও প্লিজ।
মৌয়ের এমন আবদার ভঙ্গি কথায় চমকে উঠে বসে সেহেরিশ।

– শুভ সকাল মিষ্টিপু।
– গ..গুড মর্নিং।তোমায় তো চিনলাম না।
– উফফফ আমায় ভুলে গেলে কালকেই তোমার সাথে কথা হয়েছিল।আমি মৌ।
– ওহ হ্যা,মনে পড়েছে।
– যাও দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো।তোমার সাথে আমার আজ আলোচনা আছে।
– কিসের আলোচনা?
– তুমি তো এই বাড়ির নিয়ম রীতিনীতি কিছুই জানো না।তোমায় আজ সব শেখানো হবে।যাও বলছি দ্রুত যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি এখনো নাস্তা করিনি।
– ওকে পিচ্চি বুড়ি আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তুমি এখানেই থাকো।

কুয়াশাকে মাড়িয়ে সূর্যের তাপ অবশেষে গাছগাছালিকে গ্রাস করেছে।ভর দুপুরে সেহেরিশ এবং মৌ বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে থাকা জলপাইয়ে মরিচ মিশিয়ে কামড় বসাতেই চাপা আর্তনাদ জরে উঠে সেহেরিশ।

– আহহহ এমন টক কেউ খায়।আমার দাত শেষ আজ।
– ধীরে সুস্থে খাও দেখবে ভালো লাগবে।যানো কাল যখন তোমার গায়ে ফুল গুলো পড়ছিল তখন তোমায় একদম ফুলপরির মতো লাগছিল।

“ফুলপরী” শব্দটা শুনেই নড়ে উঠে সেহেরিশ।তড়িৎ গতিতে আবারো মনে পড়ে গেলো আফীফ দেওয়ানের কথা।আফীফ দেওয়ান তাকে ফুলপরী বলেই সম্মোধন করেছিল।ভাবনার মাঝেই সেহেরিশের চোখ চলে যায় একটি ঘরের দিকে।দেওয়ান বাড়ির বিশাল প্রাচীরের বাইরেই ঘরটি।ঘরের চারিপাশে সু-উচ্চ তালগাছ,সুপারি গাছ,নারিকেল গাছের ভরপুর।সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় পুরো দোতলার ঘরটি সম্পূর্ণ কালো রঙে আবৃত।ছাদ থেকে বাড়ির যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বেশ ভালো করেই সেহেরিশ বুঝে নিয়েছে এই বির্লিংটার কোন জানালা নেই।

– এই বাড়িটি কার মৌ?কেমন যেন অদ্ভুদ।পরিবেশটা নিরিবিলি কেউ কি থাকে না এখানে?

– বাড়িটি নানা জানের।জানো এই বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না।সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ।
– মানে?কেউ যদি না যায় তবে এত সুন্দর ঘরটি করার মানে কী?
– তা তো আমি জানি না।তবে এই বাড়িতে নানাজান,মামা, মুনিফ ভাইয়া আর আফীফ ভাইয়া যায়।বাদ বাকি কাউকে যেতে দেখিনি আমি।
মৌ তার কথা শেষ করতেই নিচ থেকে তার মা ডেকে উঠে।যার দরুনে দ্রুত সেহেরিশকে রেখেই নিচে নেমে যায়।

ছাদের চারিদিকে বেশ কিছুক্ষণ হেটে সেহেরিশ চিলেকোঠার ঘরের সামনে দাঁড়ায়।সেদিকটায় রঙবেরঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুল দেখে অভিপ্রায়ে তাকিয়ে থাকে।ফুলের সৌন্দর্যে সেহেরিশ এতটাই মোহিত হয়েছে লোভ সামলাতে না পেরে তুরন্তে চারটা ফুল ছিড়ে নেয়।নাকের সামনে রেখে গাঢ় করে শ্বাস টানতেই তার কানে আসে কারো পায়ের শব্দ।

সিড়ি ঘর থেকে পায়ের শব্দটা আরো নিখুঁত ভাবে এদিকেই আসছে সেই সাথে গলার স্বর শুনে সেহেরিশ চনমনিয়ে উঠে।গলার স্বরটা যে আফীফের তা বুঝতে লীন মাত্র দেরি হলো না তার।এই মূহুর্তে একা আফীফের সম্মুখে কিছুতেই যাবে না সে।তাই দ্রুত চিলেকোঠার দরজা খুলে দ্রুত রুমে প্রবেশ করে একটি ভাঙ্গা আলমারির আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।

মৌয়ের ভাষ্য মতে সেহেরিশ ছাদে একাই আছে।তাই সুযোগ বুঝে আফীফ ছাদের দিকে এগিয়ে আসলো।কানে ফোন নিয়ে মুনিফের সাথে কথা বলতে বলতে যখন ছাদে প্রবেশ করলো তখন পুরো ছাদটাই ফাঁকা।সেহেরিশের অস্তিত্ব না দেখে চুপচাপ ধীর গতিতে এগিয়ে যায়।লাহমায় তার চোখে পড়ে চিলেকোঠার দরজাটা অর্ধেক খোলা আর দরজার সামনেই একটি ফুল পড়ে আছে।আফীফ বেশ ভালো করেই বুঝে নিয়েছে সেহেরিশ তার পদ শব্দে পালিয়েছে তাই আবারো জোরে জোরে সিড়ি ঘরের দিকে হাটা শুরু করে।

আফীফের চলে যাওয়ার শব্দ বুঝতে পেরে চোখ বন্ধ করে গাঢ় করে শ্বাস নিলো সেহেরিশ।নিশ্চিন্ত মনে ধীরে সুস্থে চোখ খুলে তার সামনে আফীফকে দেখে চক্ষুচড়ক গাছ।

– এমন চোর পুলিশ খেলছেন কেন আপনি?আপনি কি চোর?আসার পর থেকেই চোরের মতো বিহেভ করছেন।
আফীফের কথায় মূহুর্তেই মাথায় রাগ চড়ে যায় সেহেরিশের
– কি?আমাকে দেখতে আপনার চোর মনে হয়?
– তা নয় তো কী?এমন চোর পুলিশ খেলছেন কেন?
– আমি চোর পুলিশ খেলবো মানে?কি বলছেন এইসব।

– সত্যি করে বলুন কি চুরি করেছেন এই বাড়ির?
– আরে আজব!
– সত্য করে বলুন, আপনি দেওয়ান বংশের আততাতী নয় তো?কে আছে আপনার আড়ালে?কে পাঠিয়েছে এই চন্দনপুরে?
– এই আপনি সকালে ড্রিংস করেছেন, কি সব যা তা বলছেন। আমি চন্দনপুরে আসিনি আমি অনন্তপুরে এসেছি আর কি সব আততায়ী বলছেন সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

– আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে আপনার উপর আমার নজর থাকবে চব্বিশ ঘন্টা।
– এবার আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন।নিজেরা এই বাড়িতে আমাদের জোর করে রেখে এখন অপমান করছেন।আমি এক্ষুনি পাপাকে গিয়ে সবটা বলে দেবো।

সেহেরিশ যেতে নিলেই আফীফ তার সামনে এসে ঠেসে দাঁড়ায়।তাদের মাঝে খুব একটা দূরত্ব নেই বললেই চলে।
– এত চনমনে কেন আপনি?
– সরে যান আমার সামনে থেকে আপনাকে দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।প্লিজ দুরে সরুন।
– কী?আমায় দেখলে আপনার দম বন্ধ হয়ে আসে মানে কি?আপনার সাথে আমার মাত্র কাল দেখা হয়েছে আর তাতেই এমন রিয়েকশন।এখনো তো আমায় এক বিন্দুমাত্রও চিনলেন না।
– প্লিজ আপনি সরুন। আপনার সাথে আমার আর কোন কথা বলার ইচ্ছে নেই।
– আমার আছে।আপনি আমার গাছের ফুল ছিড়লেন কোন সাহসে।এই বাড়ির ফুল ছেড়া নিষেধ।

শেষ কথাটা বেশ ধমকের সুরেই বললো আফীফ।আফীফের একের পর এক তর্কে নিঃস্পৃহ অবস্থা সেহেরিশের।
– আমি জানতাম না।আর জানলে এমন কাজ কখনোই করতাম না সরি।
– ভুল যখন করেছেন তখন তার দাম দিতেই হবে।
– মানে?

আফীফ তার হাতে থাকা ফুলটি সেহেরিশের কানে গুজে দেয়।
-এবার একদম ফুলপরির মতো লাগছে।
“ফুলপরি” শব্দটা শুনেই চনমনিয়ে উঠে সেহেরিশ।তৎক্ষনাৎ আফীফ সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে দেয়ালের দিকে ইশারা করে।তার ইশারা অনুসরন করে সেহেরিশ তাকাতেই এক চিৎকারে লাফিয়ে উঠে সহসা আফীফকে জাপটে জড়িয়ে ধরে।সেহেরিশের কান্ডে আফীফ নিজেই তার সৎবিৎ হারিয়ে ফেলে।

দেয়ালের দিকে তেলাপোকা দেখলে সর্বোচ্চ সেহেরিশ হয়তো ভয়ে চিৎকার দেবে এটাই ভেবেছিল সে কিন্তু সেহেরিশ যে তাকে দশ গুন অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরবে কে জানতো?
আফীফ সেহেরিশের মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
– সেহেরিশ আপনি এতটাই ভীতু আমি তো জানতাম না।
– ত..তেলাপোকা কি চলে গেছে।
– আপনার চিৎকারে তেলাপোকা সহ আমার কানের পোকা গুলোও উড়ে গেছে।

আফীফের ঠাট্টা সুরের কথায় ছিটকে দূরে সরে যায় সে।মাথাটা নিচু করে আফসোস ভঙিতে বলে,
– সরি!
– সরি?কয়টা কারনে সরি বলবেন!আমাকে অনুমতিহীন জড়িয়ে ধরায় নাকি আপনার কর্কশ কন্ঠের চিৎকারে আমার কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায়?নাকি আমায় গায়ে
কলঙ্ক দেওয়ায়?
– কলঙ্ক?
– এই যে দেখুন আমার পাঞ্জাবিতে আপনার লিপস্টিকের দাগ।এটা যদি বাইরের কেউ দেখে ফেলে তবে সবাই ভেবে নিবে উলটা পালটা কিছু, তখন আমি মানুষের মুখ বন্ধ করবো কি করে?

সেহেরিশ ভ্রু কুচকে আফীফের বুকের দিকে তাকাতেই ভড়কে যায়।ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিটায় লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে সেদিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে সেহেরিশ।
– সরি এবারের মতো মানিয়ে নিন এই ভুল আমি আর জীবনেও করবো না।

আফীককে আর কোন কথার সুযোগ না দিয়ে সেহেরিশ দ্রুত হেটে নিচে নেমে আসে।আফীফ তার লজ্জার কারন বুঝতে পেরে বাকা হাসে।

– আমি চাই তুমি এমন ভুল বার বার করো।আমি চাই এমন লজ্জায় তুমি আবারো পড়ো।
তোমার ভুলেই একদিন আমি আমার কূলে ফিরবো।

#চলবে….