অন্তরিন প্রণয় পর্ব-৬+৭

0
477

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৬

ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আড্ডায় মেতে আছে চার বন্ধু।ধৌয়া উঠা গরম গরম কফির মগে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে সেহেরিশ।তার পাশেই বসে আছে জুহি।সেহেরিশের বেস্ট ফ্রেন্ড জুহি।গত সাত বছর থেকে তাদের সম্পর্ক।জুহির বাড়ি বাংলাদেশে।সেহেরিশের মুখোমুখি কেইন এবং তুন্দ্র।তুন্দ্র একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ছেলে তার বাড়ি ইন্ডিয়ায়।ইতালি শহরে চাচার সঙ্গেই তার বসবাস। সেহেরিশের সাথে বেশ কয়েক বছর থেকেই পরিচিত।নিরবতা ছেদ করে কথা তুললো কেইন,

– সেহেরিশ আজ তো আমাদের এক্সাম শেষ তোমার গুড নিউজটা দিয়ে দাও সবাইকে।
– ইয়াহ!আমরা এবার লং ট্যুরে যাবো ফ্রেন্ড উইথ ফ্যামিলি।
সেহেরিশের কথা শেষ করতেই জুহি আড় চোখে তাকায় তার দিকে।
– আমরা ট্যুরে যাবো এটা নতুন কী?এটা নিয়ে আলোচনা করার কিচ্ছু নেই বরং শপিং করতে নেমে পড়ি এটাই ভালো।
জুহির কথা তাল মেলালো তুন্দ্র,
– ইয়েস,জুহি ঠিক বলেছে।
– শপিং তো আমরা করবোই আচ্ছা যাই হোক।মেন্টালি প্রিপেইড থাক এটাই বড় কথা।

সেহেরিশ কথা শেষ করে উঠতে নিলেই তার ফোন বেজে উঠে।হাতে মোবাইল নিয়ে চেক করতেই খুরশীদের নাম্বার দেখে চোখে মুখে হাসির ঝলক ভেসে উঠে,
– হ্যা পাপা বলো,
– তুমি কোথায় মামনি?
– ভার্সিটিতেই আছি।
– তোমার বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে চলে আসো।বাকি কথা পরেই হবে।
– ওকে পাপা।

সেহেরিশ ব্যাগ পত্র গুছিয়ে দ্রুত সবাইকে তার সাথে যেতে বললো।বাকিরাও দ্বিমত পোষণ না করেই সেহেরিশের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো।

তুন্দ্র,কেইন,জুহি সেহেরিশদের বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মারুফার সাথে হাসি আড্ডায় মেতে উঠলো।মারুফার জীবনে ভাই ভাবী আর ভাই’ঝি ছাড়া কেউ নেই।স্বামী মারা গেলেন বেশ কয়েক বছর আছে।অন্যদিকে সেহেরিশের বন্ধুগুলো যেন তাদের পরিবারের আরেক দল সদস্য তাই প্রতিটা ইভেন্টে তুন্দ্র, কেইন,জুহি এই বাড়িতে হাজির হয়ে যায়।মারুফার সাথেও তাদের বেশ ভালো বন্ধুত্ব।

– ফুপ্পি আমাদের জন্য কী সারপ্রাইজ আছে বলনা?
কেইনের কথায় সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো মারুফার দিকে।মারুফা কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন সেহেরিশের মা ফাহমিদা।
– তোমাদের পাশাপাশি সেহেরিশের জন্য ও বিষয়টি সারপ্রাইজ তাই আগে তার পাপা আসুক তবেই বলবো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয় খুরশীদ আনোয়ার।মেয়ের মাথাটা বুকে জড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– বলতো কী সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্য?
– আঙ্কেল আমরা যেহেতু ঘুরতে যাবো নিশ্চই ভালো কোন জায়গায় যাবো?
কেইনের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেন মুরশীদ।

– আমরা বাংলাদেশে যাচ্ছি!
মুরশীদের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে সেহেরিশ। তার অবস্থা বুঝতে পেরে দ্রুত তার হাত চেপে ধরে মারুফা।

– বাংলাদেশ!বাংলাদেশ কেন বাবা?বাংলাদেশে কেন যেতে হবে আমাদের?এই ছাড়া কি আর কোন প্লেস নেই?
– আজব! তুমি এত রাগ দেখাচ্ছো কেন?ভুলে যেওনা তোমার জন্মস্থান বাংলাদেশেই।আগামী মাসে তোমার ফুফা এবং দাদা-দাদীর মৃত্যু বার্ষিক।গত কয়েকবছর আমাদের বিডিতে যাওয়া হয় নি এখন যেহেতু তুমি ফ্রি আছো তবে যেতে সমস্যা কোথায়?
– বাবা আমার শেষ কথা আমি যাবো না ,মানে যাবো না। নো নেভার।
সেহেরিশ রাগ দেখে মারুফা চোখ ইশারা দেন।তাতে আরো রেগে যায় সেহেরিশ,
– ফুফু তুমি জানতে বাবা-মা বিডিতে যাওয়ার প্লানিং করছে?তুমি জানো না আমি বিডিতে যেতে চাই না।তবে কেন নিষিধ করো নি তাদের?

সেহেরিশের রাগ দেখে বন্ধুরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে।শান্ত মেজাজের সেহেরিশের এমন রাগ আগে কখনো দেখেনি তারা।বাংলাদেশ নিয়ে রেগে যাওয়ার কোন কারন বুঝতে পারলো না তারা।মুরশীদ মেয়ের উগ্রতা দেখে রেগে যান আর তা বুঝতে পেরে ফাহমিদা সেহেরিশের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকায়।
– সমস্যা কি তোর সেহেরিশ?বিডিতে গেলে কি সমস্যা হবে তোর?
– আমি যাবো না মানে যাবো না।তোমাদের যেতে ইচ্ছা তো যাও।আমি একাই থাকবো বাড়িতে।

সেহেরিশের এমন হঠকারিতা দেখে দ্রুত নিচে নেমে আসে তার একমাত্র ভাই সামী।
– আপু তুমি রেগে গেলে কেন?

পনেরো বছরের দুরন্ত ছেলে সামী।সামী সেহেরিশের একমাত্র ছোট ভাই।বোনের এমন রাগ দেখে কিছুতেই কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলো না।
– সামী তোমায় বলেছিনা বড়রা কথা বললে তুমি তার মাঝে আসবে না।তবে কেন এলে?
মুরশীদের কথায় মাথা নামিয়ে চলে যায় সামী।

সেহেরিশ তার বাবার রাগ বুঝতে পেরে নিজেকে ধাতস্ত করে নেয়।
– লিসেন পাপা আমি যাবো না তোমাদের ইচ্ছে হলে তোমরা যাও।কিন্তু আমি না।

সেহেরিশ নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।রাগে তার সারা শরীর কাপছে।আবার সেই অনন্তপুর আবার সেই চন্দনপুরের স্মৃতি তাকে মুষড়ে দিচ্ছে।মাত্র দশটা দিনের দেখায় একটা মানুষের সাথে, সারাজীবন যে তাকে ভুক্তে করতে হবে কে জানতো?

এতক্ষণ হাতে ধরে রাখা আপেলটি ঝুড়িতে রেখে সোফায় বসে পড়লো কেইন।
– হোয়াটি’স দ্যা রিজন ফর সেহেরিশ এংরি?
কেইনের প্রশ্নে তার পাশে বসে যায় জুহি।গালের নিচে হাত দিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
– আই ডোন্ট নো কেইন।

খুরশীদ লজ্জিত ভাব নিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্য বলে,
– সেহেরিশের আচরণে তোমরা কিছু মনে করো না।তোমরা কী বিডিতে যেতে চাও?
– ইয়েস আই ওয়ান্ট টু গো আঙ্কেল।
কেইনের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলেন খুরশীদ।বাকি সবাই যাওয়ার জন্য মত পোষণ করলে ফাহমিদা আর খুরশীদ তাদের তৈরি থাকতে বলেন।এদিকে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন মারুফা।

বাড়ির সব কিছু আবারো তকতকে ঝকঝকে করতে উঠে পড়ে লাগলো আফীফ।সেই ভোর থেকেই বাড়ির বাগান,ছাদ পুরো ঘরটাই আবারো নতুন করে সাজানো হয়েছে।আফীফের রুমের পাশের সেই গোপন কক্ষটাকে আবারো অন্যভাবে সাজানো হয়েছে।বর্তমানে এটি গোপন কক্ষ নেই বললেই চলে,তবে সবার চক্ষু আড়ালে গোপনীয়তা এখনো বজায় আছে।চারিদিকে ফুল,পুতুল,তারা,ঝার বাতি,পেইনটিং, সাদা রঙের পর্দায় সাজানো পুরো কক্ষটি দেখলে যে কারো তাক লেগে যাবে।

পুরো দেওয়ান মঞ্জিল জুড়ে এমন নিটোল রুম শুধু মাত্র দুটি আছে একটি আফীফের রুম এবং অন্যটি আফীফের গোপন কক্ষ।আফীফ সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই মর্জিনাকে চোখে পরে,

– মর্জিনা খালা আপনাকে বলেছিলাম মায়ের কাছে যেতে এখানে কী আপনার?
– বড় আম্মা পাঠাইছে তোমার কাছে।আম্মার কি যানি কথা আছে।
-ঠিক আছে দাদীজানকে বলে দাও আমি আসছি।

আফীফ সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে নিজের রুমে যায়।গায়ে থাকা ধূলো জমা শাটটা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়।আলমারি থেকে অন্য একটি শার্ট নিয়ে গায়ে জড়াতেই দেয়ালের দিকে লক্ষ্য যায়।সেহেরিসের হাস্যউজ্জ্বল ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে যেন সৎবিৎ হারিয়ে ফেলে আফীফ।ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ছবিগুলোতে হাত বুলায়।

– আমার ছোট্ট তাকিয়া এখন তুমি সেহেরিশ!আমি অধীর আগ্রহে, তোমায় কখন এই দেওয়ান মঞ্জিলে আবারো স্বাগতম করবো।যত রাগ আছে সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো।আর বন্ধী করবো না আর বকবো না।তবুও ফিরে এসো…তুমি জানো গত আট বছর আমার কি অবস্থায় পার হয়েছে?উহুহ যানো না।তোমার উপর রাগ দেখিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়েছি।দিনের পর দিনে ওষুয় সেবনে আমি যে মৃত্যুর পথ যাত্রী হয়ে গেছিলাম তা কি তুমি জানো?উহু’হ যানো না।তবে যানবে ধীরে ধীরে আগের মতো তাড়াহুড়ো নয়।একটু সবুর করো।

সেহেরিশের ছবিতে হাত বুলিয়ে আফীফ সেখান থেকে চলে যায়।খুব শীঘ্রই তার জীবনে নতুন দিনের সূচনা হবে।

গভীর রাতে মনমরা হয়ে বসে আছে সেহেরিশ।তার সব সুখ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।ফুল গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ে কানে গুজে গালে হাত দিয়ে চিন্তায় মগ্ন সে।তখনি তার রুমে প্রবেশ করেন মারুফা।
– তুমি কেন আমার ঘরে এসেছো ফুফু?
– রেগে যাচ্ছিস কেন তুই?
– তুমি জানো আমি ফিরতে চাই না বিডিতে তবে কেন পাপার সাথে তালে মেলালে?

– তোকে কিছু কথা বলি শোন!আমরা ঢাকায় যাবো সেখানে হোটেল বুক করে কয়েকদিন থেকে অনন্তপুরে যাবো।তোর ফুফা দাদাভাই দাদীর কবর জিয়ারত করে আবার ফিরে আসবো। এতে চন্দনপুরের ভয় আসছে কেন?আর আট বছর আগের ঘটনা আট বছর পর ফিরে আসবে না।গিয়ে দেখ গ্রামের জমিদারের নাতি এতদিন বিয়ে শাদী করে সংসার সামলাচ্ছে।এটাও তো হতে পারে চন্দনপুরের সেই জমিদারের সব রাজস্ব হারিয়ে ফেলেছে।তুই চিন্তা নিচ্ছিস কেন?তাকিয়া নামের কোন মেয়ের কথা হয়তো বা তাদের মনেও নেই।সব ভুলে গেছে।এই আট বছরে তুই পাল্টেছিস তোর জীবন পাল্টেছে ঠিক তাদেরো।তাই তোর ভালোর জন্য বলছি ভাইজানের মনে কষ্ট না দিয়ে বিডিতে চল।

– যদি আবারো ফিরে আসে আফীফ দেওয়ান?আর আমায় বন্ধী করে নেয় গোপন কক্ষে?
– দূর বোকা মেয়ে!তখন তুই ছিলি একা এখন তোর সাথে আমরা আছি।সেদিন যদি পারভিন না থাকতো তবে যে কি হতো?আমি হয় তো তোকে ফিরেই পেতাম না।টাকা কি না করতে পারে।টাকার লোভে দেওয়ান বংশের সাথে পাল্লা দিয়ে পারভিন তোকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।টাকাই সব!

– তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমি যাবো?
– কেন নয়?তোর সাথে কেইন,জুহি,তুন্দ্র যাবে তবে তুই কেন যাবি না?
– ঠিক আছে আমি পাপার সাথে কথা বলে নেবো।
– তাহলে আমাদের লং ট্যুর বিডি?
– ইয়েস!
সেহেরিশ হাসি মুখে সবটা সমাধান করলেও মনের ভেতরটায় জমে থাকা ভয় টা এখনো কাটে নি।
#চলবে…

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৭

– এইসব কোন ধরনের কথা জুহি?তুই বলেছিলি আমাদের সঙ্গে যাবি তবে এখন কেন যাবি না?
– দেখ সেহেরিশ আমারো যাওয়ার ইচ্ছা ছিল বিডিতে,কিন্তু বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছেন আমি যেতে পারবো না।তুই কেইন, আর তুন্দ্রকে নিয়ে যা। আমার জন্য মন খারাপ করে থাকতে হবে না।

জুহির আশ্বাসে শান্ত হলো না সেহেরিশ।বরং রাগ দেখিয়ে আলমারির সব জামা ছুড়ে মারলো।সেহেরিশের রাগ দেখে জুহি প্রত্যুত্তর করলো না।বরং সব জামা গুলো তুলে ট্রলিতে একে একে সব ভাজ করে রাখলো।

– এমন রাগ দেখিয়ে লাভ নেই।আমি সত্যি যেতে পারবো না।যেহেতু লং ট্যুরে যাচ্ছিস চিন্তা করিস না বাবা সুস্থ হলে আমি একাই চলে যেতে পারবো।
আর তুই…

জুহি কথার মাঝেই থেমে যায়।আলমারির কর্ণার থেকে একটি নুপুর বের করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,
– ওয়াও! এই গোল্ডের নুপুরটা কখন কিনলে সেহেরিশ?দেখে মনে হচ্ছে তোর পায়ে ঠাসা হয়?
বিরস মুখ নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েই সেহেরিশ চমকে যায়।
– এই নুপুর বাইরে ছুড়ে মার।অসহ্য লাগে আমার।
– আজব!এত সুন্দর একটা নুপুর তোর অপছন্দ মানতে পারলাম না।যাই হোক তোর জামা কাপড় প্যাকিং করা শেষ।আর এইভাবে গোমড়া মুখে থাকিস না প্লিজ।

সেহেরিশ এখনো মুখ ভার করে বসে আছে তার অবস্থা দেখে জুহি মিহি হাসে।পেছন থেকে সেহেরিশকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,
– কথা দিচ্ছি আমি যাবো বিডিতে তবে এখন না।আমি ছাড়া বাবা মায়ের কে আছে বল তাদের দেখার দায়িত্ব আমার। তাই এখন যেতে পারছি না তবে আমি খুব শীঘ্রই যাবো।এবার অন্তত হাস প্লিজ!

জুহির হাতে হাত রেখে হেসে উঠলো সেহেরিশ।সেহেরিশ ভালো করেই যানে জুহি কখনো তার কথা ফেলতে পারে না।

—–
অবশেষে কেইন,তুন্দ্র,সামী,মারুফা,সেহেরিশ,ফাহমিদা এবং খুরশীদ আনোয়ার বাংলাদেশে পৌছে যায়।ঢাকায় এসে বিলাসবহুল একটি হোটেল বুকিং করে সবাই সেখানেই উঠে।কেইন সহ সবার মুখে আনন্দের আভাস থাকলেও আনন্দ নেই সেহেরিশের চোখে মুখে।এখনো আতঙ্কগ্রস্ত সে।বেশ কিছুক্ষণ তুন্দ্র আর কেইন ছবি তুলে সেহেরিশের কাছে ফিরে আসে।সেহেরিশের ভার মুখ দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় কেইন,

– হোয়াটি’স ইউর প্রব্লেম সেহেরিশ?
– নাথিং।
– তবে এইভাবে মনমরা হয়ে বসে আছো কেন?আমরা বাংলাদেশে এসেছি বলে কি তুমি খুশি নয়?
কেইনের প্রশ্নে সহসা জবাব দিলো তুন্দ্র,
– আমারো তাই মনে হচ্ছে কেইন।আমি ভাবছি ফিরে যাবো।তুই চাইলে আমার সাথে ইন্ডিয়া যেতে পারিস।সেখানে তোকে কাশ্মীর,দার্জিলিং,যগ ফলস,দিল্লি, সিকিমে নিয়ে যাবো আশা করি তোর ভালো লাগবে।

তুন্দ্রের কথায় চোখ ছোট করে তাকায় সেহেরিশ।গমগম সুরে রাগ দেখিয়ে বলে,
– সমস্যা কি তোদের?এমন নাটক করার মানে কী?
– নাটক তো আমরা করছিনা। নাটক করছিস তুই।আসার পর থেকেই মুখটা পেঁচার মতো করে রেখেছিস তবে আমরা নিশ্চয়ই ভেবে নেবো আমরা আসাতে তোর এমন রিয়েকশন।
– দূর তা না।আসলে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবো।

সেহেরিশ কথা শেষ করতেই তাড়াহুড়ো করে রুমে ডুকে সামী।তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ।তা দেখেই তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সেহেরিশ।
– কি হয়েছে সামু?তোকে এমন লাগছে কেন?
– বাবার কি যেন হয়েছে আপুনি।বাবা কার সাথে কথা বলেই চিন্তায় ডুবে যান। ফুফু,মামনির একই অবস্থা আমায় কেউ কিছু বলছে না।আমার কোন কিছুই স্বাভাবিক লাগছেনা।

সামীর প্রশ্নে তুন্দ্র আর কেইন একে অপরের দিকে ইশারা দিলো।সেহেরিশ দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে মারুফার রুমে প্রবেশ করে,

– ফুফি কি হয়েছে তোমার চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?
– দ্রুত রেডি হয়ে নাও সেহেরিশ।আমাদের এখনি অনন্তপুর যেতে হবে।
– অনন্তপুর কিন্তু কেন?
– আমাদের সব জায়গা জমি অনন্তপুরের মতাব্বরের ছেলে দখলে নিয়ে গেছে।এখন তারা অস্বীকার করছে।তুমি দ্রুত রেডি হয়ে আসো।
– কিন্তু ফুফি…
– কোন কথা শুনতে চাই না সেহেরিশ।এখন তোমার ছিঁচকাঁদুনে কথা শোনার টাইম আমার নেই।তোমার পাপার ভালো চাও তো সবাইকে বলো তৈরি হয়ে আসতে।

মারুফার কড়া নির্দেশে দ্বিমত পোষণ করলো না সেহেরিশ।বরং সবাইকে নিয়ে তৈরি হতে নিজ নিজ রুমে চলে যায়।সবাই যখন সেহেরিশের জন্য অপেক্ষা করছিল তখন সেহেরিশ ফিরে আসে, আর তাকে দেখেই রেগে যান ফাহামিদা।

– এইসব কী সেহেরিশ?তুমি কি ড্রেস পড়ছো এইসব?
– কেন?জিন্স টপ্স,সমস্যা কোথায়?
– বিদেশের কালচার তুমি বিদেশে দেখাবে এখন আমরা গ্রামে যাবো দ্রুত ড্রেস চেঞ্জ করে এসে শালীন পোষাক পরো।
– আমি পারবো না। যা পরেছি তাই আমার কাছে ঠিক লাগছে।

সেহেরিশের তর্ক দেখে বিরক্ত হয়ে যান ফাহমিদা।এদিকে প্রায় দুপুর শেষ হতে চললো।অনন্তপুর গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে তিন ঘন্টা সময় লাগবে।আজকে খোজে খবর নিয়ে আজকেই তাদের ফিরতে হবে তাই খুরশীদ আনোয়ার মা মেয়ের তর্ক থামিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বললো।

দেওয়ান মঞ্জিল আজ সাজ সাজ রব রব।রান্না-বান্না থেকে শুরু করে পুরো বাড়িতেই ছড়িয়ে আছে নব্যতা।মুনিফকে বাকি সব দায়িত্ব দিয়ে আজ আফীফ অধীর আগ্রহে বসে আছে তার ফুলপরীকে দেখার ইচ্ছায়।বাড়ির সাতটি কুকুর একে একে মৃতবরণ করায় আফীফ আবারো বাড়ির জন্য কুকুরের ব্যবস্থা করে।বর্তমানে তার তরতাজা অন্যদেশীয় কুকুর পাচঁটি এছাড়াও গ্রামের এলাকার কুকুর গুলো বেশির ভাগ সময় দেওয়ান মঞ্জিলের আশেপাশে পাহারাদার হিসেবে দেখা যায়।
আফীফের ভাষ্যে মতে, ” যে মানু্ষের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, সে মানুষটাও একটা সময়ে বেইমানি করে কিন্তু এই কুকুর গুলোর মুখে এক পিস পাউরুটি তুলে দিলেই সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকে”

তার দৃষ্টান্ত আফীফ নিজে পেয়েছে তাই বর্তমানে মানুষ নামের প্রানী গুলোকে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

বাগানে থাকা বেঞ্চিতে বসে কুকুর গুলোর দিকে পাউরুটি ছুড়ে মারছে আফীফ আর সেই পাউরুটি মুখে তুলে নিচ্ছে কুকুর গুলো।সব কুকুরকে একসঙ্গে দেখে আফীফের সেহেরিশের কথা মনে পড়ে যায়।বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার শর্ত দিয়ে কুকুর গুলোর হাতে কিভাবে যে শায়েস্তা করেছিল তাকে ভাবলে এখনো হাসি পায়।

– ভাইয়া আমার আর মৌ’য়ের সব ফুলের পাপড়ি ছেড়ে শেষ কিন্তু কাজটা করবো কখন?সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তুমি যানো না সন্ধ্যায় আমার ছাদে যেতে ভয় করে।

আমানের কথায় ধ্যান ভাঙ্গলো আফীফের।আমান আফীফের ছোট ভাই।এবার ক্লাই নাইনে পড়াশোনা করছে।আফীফ যেমন রাগী,তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আমান তার উলটো।সহযে যে কাউকে বিশ্বাস করে নেওয়া আমানের বাজে স্বভাব।যার কারনে আফীফ তাকে বার বার শাস্তির কাঠগড়ায় দাড় করায়।

অন্যদিকে মৌ,মুনিফের একমাত্র ছোট বোন।বয়স মাত্র সাত বছর।কিন্তু বাড়ির সবাইকে নিজের মায়ায় বেধে রেখেছে।বাড়ির সবাই তাকে পাকা বুড়ি বলেই ডাকে।

– এই ভাইয়া কি ভাবছো তুমি?
– দেখ আমান এত উতলা হচ্ছিস কেন?তোর ভাবী আসবে তার এইটুকু কাজ করতে পারবি না?আসলে তুই আমায় ভালোই বাসিস না।
– কি যে বলনা তুমি।যাই হোক নো টেনশন।ভাবীরা নাকি চন্দনপুরে পৌছে গেছে তবে এইগ্রামে কখন আসবে?
– অপেক্ষা কর আমান।অপেক্ষা কর।আমি যদি আট বছর পারি তুই পারবি না কেন?এমন ব্যবস্থা করেছি এই গ্রামে না এসে থাকতে পারবেনা।

—-

অনন্তপুরে মতাব্বরের ছেলে আজ দুপুরে সৌদি চলে গেছেন।তাই জায়গা জমির বিষয়ে আজ কোন আলচনা সভা বসবে না।এদিকে গ্রামের মুরব্বিদের নানান জনের নানান মত।সবার এক কথা চনন্দপুরের জমিদারের কথায় একটা সমাধান হতে পারে তাই তারা যেন চন্দনপুরে যায়।সব আশার আলো যখন নিভে গেছে তখন জমিদার আহনাফ দেওয়ানের উদ্দেশ্য সবাইকে নিয়ে পৌছে যায় দেওয়ান মঞ্জিলে খুরশীদ আনওয়ার।

সেহেরিশ এবং তার বন্ধুরা অন্য গাড়িয়ে রওনা দিয়েছে।সেহেরিশের আতঙ্কিত মুখ দেখে কেইন,সামী আর তুন্দ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

– মাই কিউটি সিস তোমায় এমন লাগছে কেন?
সামীর কথায় গলা খেঁকিয়ে উঠে সেহেরিশ। “কিছু না” বলে কথা ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।কেইন আর তুন্দ্র দুজন দুজনকে ইশারা করে চুপ হয়ে যায়।দেওয়ান মঞ্জিলে সেহেরিশের গাড়ি থামতেই একে একে নেমে আসে সামী,কেইন তুন্দ্র।

– ওয়াও,এই গ্রামে এমন বাড়ি!মাই গুড নেস।
তুন্দ্রের কথায় তাল মেলালো কেইন।
– ইয়েস ব্রো।বাই দা ওয়ে তোর ফটোগ্রাফির জন্য গ্রামটা পারফেক্ট,এই বাড়িটাও পারফেক্ট।
– হুম ঠিক বলেছিস।
সবাই যখন বলা বলি করছিল কিন্তু তখনো সেহেরিশ গাড়িতে বসে ঘামাচ্ছিল।
– কিরে আপু গাড়ি থেকে নাম। পাপা তো আগেই চলে গেছে।আমরা যাবো না?
সেহেরিশের কান্ডে সবাই হতবিহ্বল!চঞ্চল সেহেরিশের এমন চনমনে অবস্থা কিছুতেই মানায় না।

সবার বিমূঢ় অবস্থা বুঝতে পেরে সেহেরিশ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায় এবং কেইন, সামী তুন্দ্রের পেছনে হাটতে থাকে।
বাড়ির দারপ্রান্তে প্রবেশ করতেই সেহেরিশসের সারা শরীরে অনামিক শিহরণ বয়ে যায়।এই তো আট বছর আগেই এই দারে সে থুথু ছুড়ে চলে যায়।আজ আবার সে ফিরে এসেছে আফীফ দেওয়ানের দারপ্রান্তে।

সেহেরিশ গেটে প্রবেশ করতেই সবাই তড়াক করে তাকায় তার দিকে।মাঝ উঠনে দাঁড়িয়ে আছে তার পরিবারের বাকি সদস্যরা।কেইনের সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে হাটতে সেহেরিশ মাঝ উঠনে দাঁড়িয়ে যায়।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।তাই গ্রামে শীতের প্রকপটাও বেশি বেড়ে গেছে।চারিদিকে আসমানটা আজ লালাভাব ছড়িয়ে আছে।সেহেরিশের বুকের ভেতরটায় ধুকপুক শব্দ কম্পন পাশে থাকা কেইন যেন শুনতে পারছে।এমন অপ্রতিভ অবস্থায় সেহেরিশ আগে কখনো পড়েছে কী না তার জানা নেই।

দেওয়ান বাড়ির সবাই খুরশীদ,ফাহমিদা মারুফাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়।বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেইন সহ দেওয়ান বাড়ির কিছু সংখ্যাক লোক।সেহেরিশ এগিয়ে যেতেই তখনি তার মাথায় ঝাকে ঝাকে ফুলের পাপড়ি আছড়ে পড়তে থাকে।অকস্মাৎ কান্ডে উজবুক হয়ে যায় সেহেরিশ।কেইন লাফিয়ে পেছনে সরে যেতেই সামীর সাথে ধাক্কা লাগে।সেহেরিশ অবাক হয়ে উপরে তাকাতেই সেই মূহুর্ত গুলো ক্যামেরায় বন্ধী করে নেয় তুন্দ্র।

– হেই হোয়াটি’স দিস?
সেহেরিসের ধমকে তিনতলার ছাদ থেকে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে আমান বলে,
– সরি আপু ভুলে সব পাপড়ি পড়ে গেছে।
সেহেরিশ চুল থেকে গোলাপের পাপড়ি সরাতেই আফীফের কথা মনে পড়ে যায়।মনে পড়ে যায় আফীফের বলা সেই কথা,
–“শুভ রজনী ফুলপরি”

মূহুর্তেই সব অনুভূতি যেন ভোঁতা হয়ে গেছে সেহেরিশের।

অন্যদিকে আড়লে কেউ একজন দুচোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত।কত বছরের অপেক্ষার অবসান আজ ঘটলো তার হিসাব শুধু সে নিজেই যানে।
সেহেরিশের বিরস মুখশ্রী দেখে লোকটি কিঞ্চিৎ হাসে,

– প্রিয় তোমার শহরে আমি নামক ভয়ে’রা তবে এখনো হানা দেয়!

#চলবে…