অন্তরিন প্রণয় পর্ব-১২+১৩

0
390

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১২

সকালের শিশির বিন্দু চকচক করছে প্রতিটি গাছের পাতায়।দূর প্রান্তের দৃশ্যপট ঢেকে আছে কুয়াশার চাদরে।জানলা দিয়ে নিরিবিলি চুপচাপ কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে সেহেরিশ তার ঘাড়ের কিছুটা নিচের চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে বেধে নিলো।গায়ের চাদরটা ছুড়ে ফেলে সোফায় বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।এই মূহুর্তে জ্বর কমলেও শরীরের ক্লান্তি বেড়েছে দ্বিগুণ।তার খোঁজ নিতে তৎক্ষণাৎ রুমে প্রবেশ করে কেইন।
– সেহেরিশ!

কেইনের ডাকে চমকে তাকায় সে।মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই দ্রুত তার দুহাত জড়িয়ে ধরে কেইন তার সামনে হাট মুড়িয়ে বসে যায়।

– এখন কেমন লাগছে তোর?
– ভালো।তোর মুখ শুকনো লাগছে কেন?
– তোর চিন্তায় আমার ঘুম নরকে চলে গেছে।
– আমি ঠিক আছি।তুই নিচে যা আমি ফ্রেশ হয়ে আসবো।
– ওকে।
কেইন সেহেরিশের হাত ছেড়ে নিচে চলে গেলো।সেহেরিশ উঠে দাড়ালো জানলার বাইরে বাগানের সাইডে আফীফকে দেখে চাপা রাগটা যেন দিগুণ বেড়ে গেছে।গতকাল আফীফের উপর জেদ করেই পুকুর পাড়ের কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু কে জানতো বিপদ তার হাতের মুঠোয়।তাই তার মনে সম্পূর্ণ দোষ আফীফ দেওয়ানের।

নিচতলায় সবার তাড়াহুড়ো হৈইচইয়ের কারন বুঝতে পারলো না সেহেরিশ।আমান এবং সামীকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত আসে তার কাছে।
– আমান সবার এত তাড়াহুড়ো কারন কি?আজ কি কোন অনুষ্ঠান!
– কেন তুমি যানো না।তোমার দাদী,ফুফা এবং দাদাজানের মৃত্যু বার্ষিকী তাই এতিমখানার ছেলে মেয়েদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়ছে।আর আছরের সময় সবাই আনন্তপুরে যাবে কবর জিয়ারত করতে।
– এই রে জ্বরের তাড়নায় আমি ভুলেই গেছি।

সেহেরিশ বিড়বিড় করে কথাটি শেষ করে পেছনে ঘুরতেই তার সামনে এসে দাড়ায় আফীফের ফুফু চন্দনা।

– কিরে মেয়ে কি বিড়বিড় করছিস?
– না ত..তেমন কিছু না।
– কাল তো ভয় পাইয়ে দিয়ে ছিলি।তুই এত বেখেয়ালি কেন বলতো?আমার মৌ এই টুকুনি বাচ্চা কিন্তু তোর থেকেও নিজের খেয়াল ভালো রাখতে পারে।আয় তোকে কিছু খাইয়ে মেডিসিন দিতে হবে।

চন্দনা সেহেরিশের হাত টেনে তার রুমে নিয়ে যায়।চন্দনার রুমটা বেশ বড় তবে সেহেরিশের রুমের মতো আকর্ষনীয় নয়।সেহেরিশকে বিছানায় বসিয়ে মর্জিনাকে খাবার আনতে বলে চন্দনা।

– আন্টি আপনি মুনিফ আর মৌ এই বাড়িতে থাকেন তবে আঙ্কেল কোথায়?
– তিনি আছেন।ব্যবসার কাজে ঢাকায় থাকেন।মাসে দুই তিনবার আসা যাওয়া করে।

সেহেরিশ চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ চন্দনার দিকে তাকিয়ে রইলো তার তাকিয়ে থাকার কারন বুঝতে পেরে চন্দনা মিহি হেসে তার পাশে বসে।
– কি ভাবছো মেয়ে আমি বুঝতে পেরেছি।
– না মানে আপনি কি বুঝেছেন?
– আমি শশুড় বাড়ি ছেড়ে আব্বার বাড়িতে থাকি কেন?
– না মানে একটু জানার কৌতুহল হলো আর কি।

সেহেরিশের অপ্রতিভ মুখটা দেখে চন্দনা আবার হাসে শাড়ির আঁচলটা আঙুলে নিয়ে চিন্তিত সুরে বলে,

– আসলে আমার শশুড় ছিলেন ব্যবসায়ী।তার বড় বড় বেশ কয়েকটা আড়ত ছিল।কিন্তু তার প্রচুর পরিমানে সুদ ছিল।আমার শাশুড়ী মারা যান আমার বিয়ের সাত বছর পরে।আমার ননদেরো বিয়ে শাদী হয়ে গেছিলো।কিন্তু শশুড়ের মৃত্যুর পর এতটাই দেনা করে গেছিলেন যে আমরা আামাদের পাওনা টাও পাইনি।শেষে ভিটেমাটি বিক্রি করলে আমার আব্বা আমাদের এখানে নিয়ে আসেন।তারপর বাড়ির ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে আবার সাবলীল করে তুলেন।

চন্দনা এবং সেহেরিশ দুজনেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।আবার তাদের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করে।সেহেরিশের মাথায় আবারাও প্রশ্ন জাগতেই মিনমনিয়ে বলে,
– ঘটনা টা কত বছর আগের আন্টি?
– চার বছর হলো।
মনে মনে চুপচাপ অঙ্ক কষে নিলো সেহেরিশ।সে এই বাড়ি ছাড়ার চার বছর পরেই তবে চন্দনা এই বাড়িতে এসেছে।

নাস্তা শেষে কিছুক্ষণ সবার সাথে আড্ডা দিয়ে, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নিজের রুমের সামনে যেতেই আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আফীফের রুমের দরজার দিকে।তার রুমের পাশের রুমটাই আফীফের এছাড়া এদিকে আর কারো রুম নেই।যেহেতু এখন দোতলায় কেউ নেই সবাই ব্যস্ত সেই সুযোগে সেহেরিশ শব্দহীন পায়ে আফীফের দরজার সামনে দাড়ালো।বাইরে থেকে দরজাটা তালাবদ্ধ দেখে বেশ অবাক হলো সে।নিরস মুখটা নিয়ে পেছনে ঘুরতেই ধম করে বাড়ি লাগে কোন এক সুপুরুষের প্রশস্ত বুকের সাথে।

– চোরামির অভ্যসটা বুঝি আর যাবে না?

আফীফের গম্ভীর কন্ঠে তড়িৎ গতিতে তাকায় সেহেরিশ।দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত সরে দাঁড়ায় আফীফের সামনে থেকে।

– ভদ্র ভাবে কথা বলুন।চোর কি শব্দ?
– চোর একটি বাংলা শব্দ।যার অর্থ – যে ব্যক্তি না বলে অন্যের দ্রব্য হরণ করে।এর উচ্চারণ চোর্।বুৎপত্তি √চুর্+অ।আর উৎস সংস্কৃত।

– আরে আজব!আমি বলেছি আমায় কোন দিক থেকে আপনার চোর মনে হয়।
– আরে আসলেই তো আপনি কি চোর নাকি আপনি তো “চুন্নি”। ইয়েস চোরের ফিমেল ভার্সন “চুন্নি”।

আফীফের বাদানুবাদ কথায় বেশ রাগ লাগলো সেহেরিশের।আফীফের তর্কে সায় না দিয়ে সেহেরিশ সরে যেতে নিলেই আবারো পথ আটকায় আফীফ।
– আমার দরজার সামনে কী?
– ভুল করে এসেছিলাম এবার হয়েছে?সরুন সামনে থেকে।
– আগে দেখিতো জ্বর আছে কি না।

আফীফ অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো সেহেরিশের কপালে হাত রাখলো চোখ গুলো অন্যদিকে ঘুরিয়ে মাথা নাড়িয়ে কি যেন বিড়বিড় করলো।এদিকে আফীফের স্পর্শে সেহেরিশের আট বছর আগের স্মৃতিগুলো বার বার মাথায় ঘুরছে-ফিরছে।সেই স্মৃতি গুলো তার জীবনে আতংক হলেও কোথাও যেন সুখ অনুভব করে।অন্যরকম সুখ।এই বাড়িতে আসার পর থেকেই খারাপ লাগাগুলো তার ভালো লাগায় পরিনত হয়েছে।বাড়ির প্রতিটা মানুষের আদর, কদর তার কাছে ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে।

– মিস সেহেরিশ কোথায় হারিয়ে গেলেন?
আফীফের প্রশ্নে সৎবিৎ বিরে আসে তার।পাশ কাটিয়ে আফীফকে সরিয়ে দিতেই কানে আসে আফীফের করা অদ্ভুত প্রশ্ন,
– কাল রাতের কথা মনে আছে?
– কাল রাত?
সেহেরিশের প্রশ্নবোধক চাহনিতে আফীফ ভালো করেই বুঝে নিয়েছে সেহেরিশের বিন্দু পরিমান ঘটানাও মনে নেই তাই কথা কাটিয়ে ভ্রু কুচকে ধমকের সুরে বলে,

– তোমায় নাকি আমি পুকুরে ফেলে দিয়েছি?বাড়ির সবাইকে এইসব কি বলে বেড়াচ্ছো তুমি?
– হ্যা মিথ্যে কি বললাম আপনি ফেলে দিয়েছেন আমায়।আপনার উপর রাগ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর তখনি পা ফসকে পগারপার।

সেহেরিশের উওরে বেশ রাগ লাগলো আফীফের তাই ধমকের সুরে আরক্ত দৃষ্টিতে বলে,

– এই যে মেয়ে রাগটাকে ভালো কাজে লাগাও এইসব আজাইরা কাজে আজাইরা মূহুর্তে না লাগালেও চলে।যাও সামনে থেকে।

সেহেরিশের বেশ রাগ লাগলো তবুও তর্কে না জড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর সেহেরিশ জানলার পর্দা সরাতেই মুনিফকে ব্লাক হাউজের গেট থেকে বের হতে দেখে বেশ চমকে যায়।এই বাড়ির রহস্যটা আজও তার অজানা।
এক মূহুর্ত আর দেরি না করে সেহেরিশ দ্রুত নিচে নেমে যায়।বাগানের দিকটায় দৌড়ে গিয়ে মুনিফের মুখোমুখি দাঁড়ায়।

– আরে সেহেরিশ এত দৌড় ঝাপ কেন করছেন,জ্বর কি ভালো হয়ে গেছে নাকি?
– ইয়াহ ফাইন।আমার কিছু জানার আছে।
– হ্যা বলুন।
– এই বাড়িটার রহস্য বুঝলাম না।সম্পূর্ণ কালো রঙের বির্লিং।তার উপর সবার প্রবেশ নিষেধ?
– না কিছু না।
– কিছু না বললে তো হবে না।আমার ওই বাড়িটায় যেতে মন চাইছে।আমি ছাদ থেকে ভালোভাবে ঠাহর করেছি কোন জানালা নেই সেখানে।এমন কি জানালার পরিবর্তে কোন কাঁচের ব্যবস্থা নেই।সবটাই অদ্ভুত।

সেহেরিশের প্যাচালো প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় মুনিফ।হঠাৎ করেই দুজনের কানে আসে সেই কাকাতুয়ার ডাক।
– ফুলপরি,ফুলপরি,ফুলপরি!রাজা তোমার ফুলপরি।
মুনিফ এবং সেহেরিশ উপরে তাকাতেই আফীফকে দেখতে পায়।প্রশস্ত বুকটাতে দু’হাত মুড়ি কাধে পাখিটিকে নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে একদৃষ্টিতে।তার দৃষ্টিতে নেই কোন অনুভূতি নেই কোন সচ্ছলতা।তখনি মুনিফের কাছে দৌড়ে আসে বাড়ির মালি রমিজ,

– ভাইজান আফনেরে বড় কর্তা ডাকে।
– ওকে চলো।
মুনিফ বড় বড় পা ফেলে দ্রুত চলে যায়।তার দিকে সেহেরিশ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতেই রমিজ তার দিকে অনুনয় সুরে বলে,
– আফনারে আফনার ফুফু ডাকে।
– ঠিক আছে।

সেহেরিশ আবারো উপরের দিকে তাকাতেই আফীফকে দেখতে পেলো এখনো সে তাকিয়ে আছে তার দিকে একই অঙ্গভঙ্গিতে।
____

প্রায় সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।অন্ততপুরে কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে কেইন,তুন্দ্র,সামী,মুরশীদ,ফাহমিদা,মারুফা এবং আহনাফ দেওয়ান,আফীফ,মুনিফ,আমান এবং চন্দনা গেলেও দেওয়ান মঞ্জিলের মহিলা সদস্য কয়েকজন বাড়িতেই থেকে যায়।

আছরের পর কবর জিয়ারতে সবার কান্নাকাটির অবস্থা দেখে সেহেরিশের অবস্থা করুন।শীতের প্রকপ বেশি থাকায় জ্বরটা যেন আবারো কেঁপে উঠেছে। সেখানে সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকলেও হঠাৎ করেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাস্তার কিনারায় বসে যায়।তার দূর্বল শরীরের অবস্থা বুঝতে পেরে মুনিফ কাউকে কিছু না বলেই তার মা চন্দনার সাথে সেহেরিশকে চন্দনপুরে পাঠিয়ে দেয়।

চন্দনা সেহেরিশকে তার রুমে পৌছে দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে।প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজতে চললো এখনো কাউকে আসতে না দেখে সেহেরিশের মাথায় বুদ্ধি চাপলো সেই কালো বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করবে সে।যে ভাবা সেই কাজ সেহেরিশ দ্রুত বাগানের শেষ প্রান্তের গেটের সামনে দাড়ালো।

তখন দুপুরের পর সেহেরিশকে দেখে মুনিফ দ্রুত বেরিয়ে গেলে গেটে তালা লাগাতে ভুলে যায় যার দরুনে সেহেরিশ খুব সহজেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।

লম্বা সারি সারি তাল গাছ আর নারিকেল গাছের আকৃতি দেখে সেহেরিশের কাছে পুরো বাড়িটি ভুতুড়ে লাগেছে। ঘরের কোনায় শুধু মাত্র একটা সোডিয়াম লাইটের আলো চকচক করছে।পুরো বাড়িটি বেশ অন্ধকার।চারিদিকে ঝিঝিপোকা সহ পেঁচার ডাকে তার সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে।জ্বরের তীব্রতা বাড়তে থাকায় বার বার চোখে যেন ঝাপসা দেখছে সে।একবার ভেবেই নিলো চলে যাবে কিন্তু আবার মনে পড়ে যায় এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা চলবে না তাই বাড়ির চারিদিকে চক্কর দিয়ে দরজা খুঁজতে থাকে সেহেরিশ।

পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে থাকলো আফীফ।কিছুক্ষণ আগেই বাড়ির কেয়ারটেকার তাকে ইনফর্ম করে ব্লাক হাউজে কোন মেয়ে প্রবেশ করেছে।তখন আফীফের বিন্দুমাত্র ভাবতে দেরি হয়নি এটা সেহেরিশ।কেননা বিকেলে মুনিফের সাথে বলা কথা গুলো আফীফ বেশ ভালো করেই বুঝেছে।

নিরিবিলি অন্ধকার মিশ্রিত বাড়িটার চারদিকে চক্কর দিতে দিতে কোন কিছুই ঠাহর করতে পারলো না সেহেরিশ কেননা চারিদিকেই অন্ধকার।ক্লান্ত হয়ে পেছনে ঘুরতে যাবে তৎক্ষনাৎ কেউ তার দু’হাত পেছন থেকে মুড়িয়ে ধরে।সেহেরিশ চিৎকার দেওয়ার আগেই লোকটি তার মুখে হাত দিয়ে আটকে দেয়।

– সাহস তো কম না সেহেরিশ আনওয়ার!বারণ করা স্বত্তেও এখানে প্রবেশ করলে কেন?

আফীফ সেহেরিশের কাধে থুতনি রাখতেই অপ্রস্তুত হয়ে যায় সেহেরিশ।নড়ে চড়ে উঠে পেছনে ঘুরতে গেলেও কোন ফন্দি আঁটতে পারলো না সে।

– এই বাড়ি নিয়ে এত কৌতুহল কিসের?শুধুমাত্র সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ বলে?আগেই বলেছি তুমি নিশ্চয়ই আততায়ী দলের কেউ।এত কৌতুহল কিসের তোমার?

আফীফের দাঁতে দাঁত চাপা প্রশ্নে সেহেরিশ কোন উত্তর দিতে পারলো না।ক্লান্ত শরীর তার উপর আফীফের কাছে বন্ধী অবস্থায় হার মেনে দুচোখ বন্ধ করে নিলো সে।কিছু মূহুর্তেই আফীফ বুঝতে পারে সেহেরিশ সেন্স লেস হয়ে গেছে।দ্রুত আফীফ তার বন্ধী থেকে সেহেরিশকে মুক্তি করে নেয়।সেহেরিশের মুখ খানা তার দুহাতে আবব্ধ করে বিড়বিড় করে রাগান্বিত স্বরে বলে,

– ছোট বেলার ভুলের শাস্তি এখনো বাকি কিন্তু বড় হয়ে আবারো ত্যাড়ামি করে শাস্তির পরিমান বাড়িয়ে কি লাভ!এত শাস্তি সহ্য করার ক্ষমতা আছে তো?

#চলবে…

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৩

সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমের সাগরে ভাসমান চোখ দুটি নিয়ে সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে আফীফ।ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই ঘড়িটি ঢং ঢং করে বিকট শব্দে বেজে উঠলো।ঘরির দিকে তাকিয়ে আফীফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।সারাদিনের ব্যস্ততায় আজ এক মূহুর্তের জন্যেও বিশ্রাম নেওয়া হয় নি তার।

তখন ব্লাক হাউজে সেহেরিশের সামনে আফীফ নিজের রাগটা দমন করলেও পররর্তীতে তা যেন আরো চওড়া দিয়ে উঠছে।একে তো জ্বর তার উপর সেন্স লেস।বারন করা স্বত্তেও একই কাজ বার বার করতে কি করে সাহস পায় এই মেয়ে ভেবে পায়না সে।সেহেরিশকে তার রুমে চন্দনার কাছে রেখে গিয়ে নিজের রুমে চলে যায় আফীফ। পরবর্তীতে বাড়ির বাকি সবাই চন্দনপুর থেকে ফিরে এলে চন্দনা নিজে সেহেরিশের খেয়াল রাখবে বলে বাদবাকি সবাইকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দেয়।এদিকে বাড়ির সবাই যখন ক্লান্ত শরীরে অতি শীঘ্রই ঘুমে কাবু তখন আফীফ চন্দনাকে পাঠিয়ে দিয়ে,নিজে সেহেরিশকে জলপট্টি দিতে থাকে।আফীফের শরীর যখন ক্লান্তিতে মুষড়ে যায় তখন সোফায় হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের দিকে।

– আরে আপনি এখানে কি করছেন?
ভাঙ্গা গলায় সেহেরিশের ফ্যাচফ্যাচে আওয়াজে চমকে যায় আফীফ।
– দু-চোখ তবে খুলেছেন আপনি!কি অবস্থা এখন?
আফীফ দ্রুত এগিয়ে আসে তার দিকে কপালে হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত শুরে বলে,

– যাক জ্বর তবে কমেছে।দেখতে হবে না সেবা যত্ন কে করছে!
শেষ কথাটা আফীফ ফিসফিস করে বললেও সেহেরিশের কর্ণকুহরে ঠিকি পৌছে যায়।
– কে সেবা করছে মানে কি?আর এত রাতে আপনার এই রুমে কী?রাতের বারোটা বেজে গেছে।

সেহেরিশের কথায় আফীফ প্রত্যুত্তর করলো না।বরং গলার মাফলার টা ভালোভাবে জড়িয়ে সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে,
– দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি খাওয়ার গরম করে আনছি।
– কেন বাড়ির সবাই কোথায় আপনি যাবেন মানে কি?
– এত রাতে তোমার জন্য নিশ্চই কেউ জেগে থাকবে না।এবার আর একটা কথাও না বাড়িয়ে দ্রুত যাও।
– তো আপনি জেগে আছেন কেন?
– আমার এখনো হিসাব নেওয়া এবং দেওয়া বাকি তাই।

আফীফের কথাগুলো মাথায় ডুকলো না সেহেরিশে।আফীফ যাওয়ার পর ওয়াশরুমে ঢুকতেই মনে পড়ে যায় সে তো ব্লাক হাউজে ছিল।

খাওয়ার শেষে হাতে ওষুধ নিয়ে বিরস মুখ নিয়ে বসে আছে সেহেরিশ।তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে আছে আফীফ দেওয়ান।

– কি হলো ওষুধ মুখে দাও এত নাটক করছো কেন?
আফীফের ঝাঝালো কন্ঠে সেহেরিশ দ্রুত ওষুধ মুখে পুরে নেয়।
– কাল ব্লাক হাউজে কেন গেছিলে?
– দেখতে গেলাম কি আছে তার মাঝে যার জন্য আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
সেহেরিশের রুষ্টতা বুঝতে পেরে আফীফ বাঁকা হাসলো।
– জানার খুব শখ বুঝি মিস সেহেরিশ আনওয়ার?
– ইয়েস।
– তাহলে বলছি।আগে তুমি বলো, তুমি শেষ কবে গ্রামে এসেছিলে?

আফীফের এমন প্রশ্নে বিমূঢ় হয়ে যায় সেহেরিশ।তার থতমত মুখ লুকোনো অবস্থা বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।নিজেকে লুকাতে আবারো মিথ্যা কথার আশ্রয় নেয় সেহেরিশ,

– আব..আমি যখন ছোট ছিলাম দাদা-দাদী,ফুফা মারা যাওয়ার পর ইতালি চলে যাই এর পরে আমি আর বাংলাদেশে আসি নি।তবে গ্রামে আসবো কি করে।
– ওহ!যাই হোক তবে শুনো।জিনের কথা শুনেছো নিশ্চই?
– হ্যা শুনেছি বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য সঞ্চার করে এমন ক্রোমোজোম।

আফীফের সিরিয়াস মুডের কথায় সেহেরিশের এমন উত্তর কিছুতেই আশা করেনি সে।দু-হাত মুষ্টি করে কপালে ঠেকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– আমি সেই জিনের কথা বলিনি মিস। আমি আমাদের ইসলাম ধর্মের যে অদৃশ্য দেহধারী জিন আছে তার কথাই বলছি।
– হ্যা শুনেছি আমি মামনি এবং ফুফির কাছ থেকে।
– ওই ব্লাক হাউজে জিন আছে।
– কি?
– জি।
সেহেরিশ আতংক নিয়ে আফীফের দিকে তাকিয়ে আছে।বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে বসলেও হঠাৎ গা ছমছমে করায় দ্রুত এক লাফে বিছানা থেকে নেমে আফীফের পাশে সোফায় বসে পরে।
– কি হলো এখানে কি?
– আমার হঠাৎ কেমন জেন লাগছে।
– এই টুকু শুনেই কুপ কাত মিস সেহেরিশ।আর এই সাহস নিয়ে আমার ব্লাক হাউজে যাও বাহ। প্রসংশার তারিফ করতে হয় দেখছি।

– মজা করবেন না প্লিজ সত্যিটা বলুন।
– ওই বাড়িটাতে একটা জিনের সন্ধান পাওয়া গেছে।কিন্তু জিনটা বড্ড দুষ্টু।আর সেই জিনটা মেয়ে জিন আমাদের বাড়ির ছেলেদের প্রতি তার বরাবরি আকৃষ্ট তাই সেই বাড়িতে কোন মেয়ে মানুষ দেখলেই জিনটা ক্ষেপে যায়।তাই সেই বাড়িতে সব মহিলা প্রবেশ নিষিদ্ধ।কিন্তু তুমি কাল রাতে সেখানে কেন গেলে?যদি জিনটা কিছু করে ফেলতো?

আফীফের প্রশ্নে প্রত্যুত্তর করলো না সেহেরিশ।ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আফীফের পাশে আরেকটু খিচে বসে যায়।
– আপনি কি সত্যি বলছেন?
– তোমার সাথে মিথ্যা বলার সময় আমার নেই।যা হয়েছে তা শেষ। ভবিষ্যতে আর এমন দুঃসাহস ভুলেও করবেনা।আমি গেলাম দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাও।

আফীফ উঠে যেতে নিলেই সেহেরিশ তার হাত টেনে ধরে নেয়।
– প্লিজ যাবেন না আমার ভিষণ ভয় করছে আমি একা থাকতে পারবো না।যদি ওই দুষ্টু জিনটা চলে আসে তখন?
– আমি জানি না সব দোষ তোমার কে বলেছিল সেখানে যেতে?
– আর যাবো না সত্যি বলছি আমায় ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।
– প্রমিস করো আর যাবে না?
– প্রমিস,প্রমিস,প্রমিস কোন দিন না।

সেহেরিশের ভীতু মুখখানা দেখে আফীফের বেশ মজাই লাগলো।প্রায় এক ঘন্টা ব্লাক হাউজে জিন সম্পর্কে আফীফের মুখ থেকে মিথ্যা ধারণা শুনতে শুনতে সেহেরিশ যে কখন ঘুমিয়ে গেছে তার হুশ নেই।

সেহেরিশকে রেখে আফীফ তার রুমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাত ১ টা ১২ মিনিট দেখে আফীফ দ্রুত তার রুমে যায়।সারাদিনের দখলে আজ বড্ড ক্লান্ত সে।

—-
শেষ রাতের পর একসঙ্গে পাঁচটি কুকুরের চিৎকারে কেঁপে উঠে দেওয়ান মঞ্জিল।বাড়ির ঘুমন্ত মানব গুলো আবারো জেগে যায় সচকিতে।আহনাফ দেওয়ান,আফীফ,মুনিফ,মাসুম বাড়ির পুরুষ গুলো দ্রুত সদর দরজা খুলে বাইরে আসতেই সবাই হতবিহ্বল হয়ে যায়।পুরো বাড়িটি নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে আছে।একে একে সেহেরিশ,কেইন, তুন্দ্র,খুরশীদ সবাই নিচে নেমে আসে।

আফীফ আর মুনিফ দ্রুত টর্চ নিয়ে বাড়ির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে,
– এই বাড়িতে রাতের জন্য ছয় জন দৌবারিক সবগুলো কোথায়?
আফীফের প্রশ্নে মুনিফ সহসা জবাব দেয়,
– দুইজন ছুটিতে আছে ভাই।বাকি চারজন তো পাহারায় ছিল তারা কোথায়?
– দ্রুত বাড়ির সার্কিট চেক কর।লাইটের ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি।

মুনিফ মাসুমকে নিয়ে পুরো বাড়ির লাইট গুলো আবারো মেরামত করে।আফীফ তরান্বিত তার কুকুর গুলোর বিশাল আকৃতির খাচার সামনে দাড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করে। ঠিক তখনো তার সন্দেহে তেমন কিছু লাগেনি।কিন্তু বাড়ির গেইটের সামনে গেলেই সে বিমূঢ় হয়ে যায়।বাড়ির সম্পূর্ণ গেইট খোলা।এবং মাটিতে লুটিয়ে আছে নয়টি কুকুরের মৃত দেহ।
– মুনিফ!

আফীফের চিৎকারে মুনিফ সহ বাড়ির সবাই ছুটে যায়।কুকুর গুলোর মৃত অবস্থা দেখে সবার মাঝেই চাপা আতংক বিরাজ করছে।সেহেরিশ মারুফার হাতটা ধরে আছে আতংক গ্রস্ত হয়ে।

—-
ফজরের আযান শেষে আলো ফুটতে শুরু করেছে।দেওয়ান মঞ্জিলের বাইরে আজ গ্রামের মানুষের ভিড়।আফীফ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে হাত গুটিয়ে তার সামনে ভীতগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চার দৌবারিক।

– কোথায় ছিলি তোরা?
-……..
– কি হলো কথা বলছিস না কেন?
-……..
– উওর দে।আমায় আর রাগা’স না আমি যদি একবার রেগে যাই কি হবে ভালো করেই জানিস তোরা।
– আ..আমরা নদীর পাড়ে ছিলাম ভাইজান।
– নদীর পাড়ে,কিন্তু কেন?
– আসলে…
– যা বলেছি উওর দে।যত কথা প্যাচাবি ততই বিপদে পড়বি।

দৌবারিক গুলো কিছু বলার আগেই মুনিফ আফীফের কানের সামনে বলে,
– ভাই খোঁজ নিয়ে জেনেছি এরা নদীর পাড়ে ছিল।সন্ধ্যার পর সারারাত সেখানে পিঠা উৎসব হয়।আর তারা সেখানেই ছিল।

মুনিফের কথায় অবজ্ঞার হাসি হাসলো আফীফ।
– তোদের সাহসের তারিফ কর‍তে হয় আমার বাড়িটাকে বিপদের আশঙ্কায় রেখে তোরা নদীর পাড়ে যাস।মুনিফ এদের নিয়ে যা এদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা কর আর মৃত কুকুর গুলোকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা কর
– ঠিক আছে ভাই।

আফীফ পুরো বাড়িতে আবারো চোখ বুলিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে।প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই একটি কাগজ তার হাতের মুঠোয় চলে আসে যেটা কিছুক্ষণ আগেই আফীফ বাগানের কোনায় পেয়েছে পুটলি বাধা অবস্থায়।পুটলি থেকে কাগজটা বের করে আফীফ দ্রুত পড়া শেষ করে।লাইন গুলো আফীফের জন্য ছিল বুলেটের মতো সুচালো। কাগজে লেখা লাইন গুলো ছিল,

– শত্রু পক্ষের পতন ঘটানোর সহজ মাধ্যেম তার ভালোবাসার মানুষ অথাৎ তার দূর্বল মানুষকে আঘাত করা!
আমরা অপেক্ষায়……

আততায়ীর হামলায় আফীফ ভয় না পেলেও বর্তমানে যে তাকে সেহেরিশের উছিলায় হুমকি দেওয়া হয়েছে সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে যার দরুনে ভীত হীন আফীফ আজ ভীতিবিহ্বল।তবে সন্দেহ মাথা থেকে এখনো কাটেনি সেহেরিশের ব্যাপারটা বাড়ির সবাই যানলেও বাইরের কেউ কিছু জানে না।তবে শত্রুপক্ষ কী ঘরেই আছে?

কেইন,তুন্দ্র, সেহেরিশ একসাথে দাঁড়িয়ে আছে বসার ঘরে।তাদের মাঝে তুন্দ্র বলে উঠে,
– আজ যেহেতু ভোরে ভোরে উঠেছি তবে চলে আজ আবারো গ্রামটা ঘুরে আসি।

তুন্দ্রের কথা শেষ হতেই বজ্রকন্ঠে আফীফের গলায় উপস্থিত বাড়ির সবাই চমকে যায়।

– আমার অনুমতি বিহীন এই বাড়ির বাইরে আজ থেকে যে পা রাখবে ভবিষ্যতে হাটার জন্য তার আর পা রাখবো না আমি।মাইন্ড ইট!কথাটা সবার জন্য প্রযোজ্য।

#চলবে…..