অন্তরিন প্রণয় পর্ব-১৪+১৫

0
423

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৪

ডিসেম্বরের শেষ সাপ্তাহ।চারিদিকে শীতের প্রবলতা বেড়েছে।গ্রামের মানুষগুলোর জন জীবন নির্জিত অবস্থা।সেদিনের পর কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন।আফীফ সম্পূর্ণ পালটে গেছে।তার মাঝে দেখা দিয়েছে গুরুগম্ভীর ভাব।সেহেরিশের সাথেও সামনা-সামনি কথা হয় না বেশ কয়েকদিন।অবশ্য সেহেরিশ নিজেই আফীফের সামনে ধরা দেয় না।নিজেকে পালিয়ে বেঁচেই সুখ পায় সে।গত কয়েকদিন আগের আফীফের সাথে বর্তমান সময়ের আফীফের কোন মিল পায় না সে।এ যেন আট বছর আগের গুরুগম্ভীর স্বার্থপর আফীফ।তার প্রতি আফীফের কেয়ারিং গুলো আরো ভয়ের সঞ্চার করছে।ঠিক আট বছর আগেও আফীফ তাকে আগলে আগলে রাখতো।তাই এই ছেলের কাছ থেকে যতটা সম্ভব পালিয়ে বাচঁতে হবে।

কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদে পাইচারি করছে আফীফ।ব্লাক হাউজের ছাদে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে ঠিকি সেহেরিশকে দেখতে পাচ্ছে সে।তুন্দ্র, কেইন,মৌ,সামী সবাই মিলে গোল মিটিংয়ে বসেছে।হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় জ্যাকেটের পকেট থেকে আফীফ দ্রুত ফোন বের করে,

– হ্যা জিউ বলো,
– কেমন আছো?কোন খবর নেই তোমার।তাকিয়াকে পেয়ে বুঝি ভুলে গেছো আমায়?

– না ভুলি নি।তবে সমস্যায় আছি।বাড়িতে যে সাম্প্রতিক একটা তুফান বয়ে গেছে তুমি তো জানো না।সেহেরিশকে নিয়ে আমায় হুমকি বার্তা পাঠানো হয়েছে!
– মানে কি?কী বলছো এইসব।সেহেরিশের কিছু হয় নি তো?
– না সে ঠিক আছে।তবে কেউ বা কারা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সেহেরিশ আমার দূর্বলতা।তাই তাকে দিয়েই তীর ছুড়েছে।

– তোমার এইসব শত্রু,যুদ্ধ,হামলা যাই হোক।আমার জানার দরকার নেই তবে সেহেরিশের যেন কিছু না হয় মাথায় রাখবে।সেহেরিশের সকল তথ্য টাইম টু টাইম আমি তোমায় দিয়েছি।একমাত্র তোমার ভালোর জন্য তোমার সুস্থতার জন্য এখন তোমার স্বার্থ উদ্ধারে মেয়েটির যেন কোন ক্ষতি না হয়।
– হুম,মাথায় আছে আমার।চলো রাখছি পরে কথা হবে।
– গুড বায়।

মতাব্বরের ছেলে রমিজ মিয়ার অপেক্ষায় দীর্ঘ দিন থাকার পরেও সৌদি থেকে তার আসার কোন নাম গন্ধ নেই।বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে খুরশীদকে।আদৌ কি তিনি জমি পাবেন?এদিকে আর কত দিন পড়ে থাকবে এই বাড়িতে।দেওয়ান বাড়ির লোক তাদের আপন হিসেবে গ্রহণ করলেও লোক লজ্জার ভয় আছে।তাই খুরশীদ সিধান্ত নিয়েছেন কাল পরসূর মধ্যেই ঢাকায় ফিরে যাবেন।

– কেমন কাটছে দিন খুরশীদ সাহেব?

আহনাফ দেওয়ানের প্রশ্নে ঈষৎ হাসেন খুরশীদ।গলাটা ঝেরে কেশে সন্তর্পণে বলেন,
– ভাবছি অনেকদিন হয়ে গেছে এবার আমাদের ফেরা উচিত।আমাদের বরং এবার যাওয়ার অনুমতিটা দিয়ে দিন আপনি।

– যাবেন মানে?কোথায় যাবেন?
– ঢাকায় ফিরতে চাইছি আমরা।এইভাবে আর কতদিন থাকবো এখানে?আপনাদের বাড়তি ঝামেলা হিসেবে পড়ে আছি।

– ছি! এইসব বলে আমায় লজ্জায় ফেলবেন না আপনি।আমি ভালো করেই জানি আপনারা আরো বেশ কিছু মাস বাংলাদেশে থাকবেন বাংলাদেশে যতদিন আছেন ততদিন এখানেই থাকবেন।ঢাকা যান সিলেট যান যেখানেই যান আপনার নির্দিষ্ট বাসস্তান হবে এই দেওয়ান মঞ্জিল।

– মাফ করবে আমায়!আপনাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ আমি এবার আমার ফেরা দরকার।

খুরশীদ আনওয়ারের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আহনাফ।তিনি ভালো করেই যানেন আফীফ জানতে পারলে বেশ রেগে যাবে তাই খুরশীদ আনওয়ারের উদ্দেশ্য অনুনয় সুরে কিছু বলার আগেই আফীফের আগমন লক্ষ্য করা যায়।

– শুভ সকাল আঙ্কেল।শুভ সকাল দাদাজনা।
– তোমার আঙ্কেল কি বলছে যানো তুমি?সে নাকি চলে যেতে চাইছে এখানে তার কাছে বেশি দিন থাকতে অস্বস্তি লাগছে।
আহনাফ দেওয়ানের কথায় চোখ বন্ধ করে নিলো আফীফ।গাঢ় করে শ্বাস টেনে গমগম সুরে বলেন,

– আজকের মতো শেষ বার বলছি আপনাদের এখানেই থাকতে হবে।যদি কোন দিক দিয়ে কারো ব্যবহারে মনে কষ্ট পান তবে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।আপনাদের সুবিধার জন্য সকল ব্যবস্থা করা হবে তবুও এখানে থাকতে হবে।

আফীফের গমগম সুরের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান খুরশীদ।
____

দুপুরের খাওয়ার বাড়ির সকলেই শেষ করে যে যার কাজে চলে গেলেও সেহেরিশ ঘুমিয়ে থাকার কারনে আজ দেরিতে খেতে বসেছে।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো সামনে আফীফকে দেখে।বাইরের কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে আফীফ তার বরাবর চেয়ারটায় খেতে বসে।তারপর থেকেই সেহেরিশের দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সামনে বসে থাকা গুরু গম্ভীর মানুষটার দিকে তাকিয়ে কয়েকটা ঢোক গিললো সেহেরিশ।এই মানুষটাকে দেখলে কেন যে তার ভয়ে আত্না কেঁপে উঠে কে জানে?হয়তো অতীতের ভয়,নয় তো বা মনের ভ্রম!লোকটার ভাব গম্ভীর দেখে সেহেরিশের হাত কাঁপতে থাকার কারনে, হাতে থাকা কাটা চামচটা প্লেটের সাথে ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। এমন শব্দে সেহেরিশ নিজেও ভড়কে যায়।আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে দ্রুত খাওয়ার থালাটা রেখে উঠে যায় কিচেনের দিকে।
এই মূহুর্তে এখানে থাকা বিপদজনক।শুধু বিপদজনক নয় মহা বিপদজনক।

বেসিনের পানিতে হাত ধৌত করার সময় সে অনুভব করে তার গলায় ঘাড়ে কারো উত্তপ্ত শ্বাস-প্রশ্বাস আছড়ে পড়ছে।হঠাৎ সেহেরিশের অনুভূতি গুলো জেনো ভাঁতা হয়ে গেছে।ডানে-বামে না তাকিয়ে দ্রুত পেছনে ঘুরতেই আফীফকে তার সামনে দেখতে পায়।ছেলেটি একদম তার সামনে কিঞ্চিৎ দূরত্বে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে।

– খাওয়ার নষ্ট করে চলে এলে কেন?

আফীফের গুরুগম্ভীর ধারালো তীক্ষ্ম কন্ঠে হুশ ফিরে তার।

– আমার খিদে ছিল না!

সেহেরিশ দ্রুত তার চোখ নামিয়ে নেয়। হঠাৎ করেই সে অনুভব করে তার গালে ঠান্ডা ধারালো কিছুর আঁচড়।চমকে তাকাতেই আফীফের হাতে একটি ছুরি দেখতে পায়।যে টি আফীফ সেহেরিশের গালে স্লাইড করছে।

– কী করছেন কি আপনি?

– কৃষকের কষ্টের পরিশ্রমের খাদ্য নষ্ট আমি মোটেও পছন্দ করি না সেহেরিশ আনওয়ার।আমার নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাধ্যে কারো নেই।এই বাড়িতে এক চিমটে অন্ন ও এঁটো হয় না সেখানে তুমি অর্ধ-থালা ভাত… থাক,আজকের জন্য মাফ!কিন্তু আগামী দিন গুলোতে আর নয়।

সেহেরিশ মাথা নুইয়ে নেয়।কিছুক্ষণেই তার কপালে ঘামের রেশ দেখতে পাওয়া গেছে।সেদিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।হাতে থাকা ছুরিটি আলতো করে সেহেরিশের গলায় চেপে ধরে।মেয়েটি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে চমকে তাকালে,আফীফ আরেকটু ঝুঁকে বলে,

– রমণীর ভয়ার্ত চোখে এ’কোন জাদু আছে, যে সমীপে টানছে আমায়?ভয় পাচ্ছো কেন?আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ!কখনো বকেছি তোমায়?রাগ দেখিয়েছি?তবে ভয় কিসের?

সেহেরিশ মূঢ়তা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কী বলবে সে?কী করবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
আফীফ তার হাতের ছুরিটা আরেকটু জোরে ধরতেই সেহেরিশ চোখ বন্ধ করে নেয়।ভয়ে কাঁপাকাঁপা দুই হাতে আফীফের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দেয়।তৎক্ষণাৎ ধারালো ছুরিটি হাত ফসকে আফীফের পায়ে পড়ে যার ফলে পায়ের পাতার উপর কোপের মতো ছুরিটি দাঁড়িয়ে যায়।লাহমায় রক্তে আফীফের পা ভেসে যায়।সেদিকে তাকিয়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠে সেহেরিশ।

ভয়ে তার দু-চোখের পানি টলমল করছে।কিছু বলতে গিয়েও বার বার থেমে যাচ্ছে।

– খুন! খুন করতে চাইছো আমায় সেহেরিশ?খুনের শাস্তি কী জানো?মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।সাদৃশ্য খুন আমায় তুমি না করলেও অদৃশ্য খুন তুমি করেছো।তাই তো তোমার যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থায় আছি।উহু’হ,ভয় পেয়ো না আমার শাস্তিটা ভিন্ন মাত্রার। অন্তরিন,অন্তরিন…..
থাক বাকিটা পরে জানতে পারবে।

আফীফ সেহেরিশের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে।তার নাক এবং ঘামাক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

– বাঙালিরা কি যেন বলে?নাক ঘামালে বর বেশি ভালোবাসে,বেশি আদর করে?তোমার নাক তো দেখি নোনা সমুদ্র হয়ে গেছে।বরের এত আদর, ভালোবাসা সহ্য হবে তো তোমার?

আফীফের ঠোঁট কাটা কথায় সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।লাহমায় কিছু বলতে নিলেই আফীফ খুড়ে খুড়ে সেখান থেকে চলে যায়।সেহেরিশ লজ্জায় মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো।এই মানুষটাকে সে বুঝে না।কেমন কেমন কুটিলতা তার মাঝে।

লজ্জায় আড়ষ্টতায় সেহেরিশকে মুড়িয়ে দিয়েছে আজ।আফীফের ব্যবহার তবে সত্যি পাল্টেছে।আগের মতো হাসে না আগের মতো ভয় দেখায় না কেমন যেন কথার মারপ্যাঁচে বার বার ফেলছে তাকে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বার বার মাথায় ঘুরছে তার।মারুফার রুমে বসে চিন্তায় মগ্ন সে।
– কি রে সেহেরিশ তোর চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?
– কেমন ফুফি?
– তুই কী কোন বিষয়ে ভয় পেয়েছিস?তোকে আতংক গ্রস্ত দেখাচ্ছে।

সেহেরিশ থামে চুপচাপ মারুফার কোলে সটান করে শুয়ে তার দু হাত টেনে নেয়।
– ফুফি আফীফ কেমন যেন হয়ে গেছে।
– কেমন?
– ঠিক আগের মতো।এক চোখে রাগ অন্য চোখে ভালোবাসা,যত্ন।
– এইসব তোর মনের ভ্রম। যত তাড়াতাড়ি এই বাড়ি থেকে যেতে পারবো তত তাড়াতাড়ি মুক্তি।
– হুম তাই যেন হয়!

#চলবে…

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৫

আফীফের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাইচারি করছে সেহেরিশ।দুপুরের পর আফীফের আর দেখা মিলেনি কোথায় আছে কে জানে।তখন পা’য়ে এমন ভাবে ছুরিটা কোপ পড়ছে ভাবতেই সেহেরিশের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।মানবিক কারনে হলেও আফীফকে এই মূহুর্তে একবার দেখা জরুরি।কিন্তু আফীফের দরজাটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া কোথায় আছে কোন খোঁজ পাচ্ছে না সেহেরিশ।বাড়ির কাউকে জিজ্ঞেস করতে গেলে এখন বিষয়টি কেমন যেন দেখায় তাই আফীফের রুমের সামনেই পায়চারি করছে সে।

কিছুক্ষণ পর আমানকে দেখে সেহেরিশ এক ছুটে তার কাছে যায়।
– আমান!আমান!
– হ্যা আপু বলো।
– তোমার ভাইয়া কই?আই মিন আফীফ।
– ভাইয়া তো মনে হয় ছাদে গেছে।
– আজ তো প্রচুর শীত,শৈত্যপ্রবাহ। এমন ঠান্ডায় ছাদে কি করছে?
– তা তো আমি জানি না আপু।ভাইয়া আমাকে বলেছিল তার জন্য কফি নিয়ে যেতে আর ছাদের দিকে যেন কেউ না আসে।ভাই একা থাকতে চায়।
– আমি গেলে কি কিছু হবে আমান?

সেহেরিশের ভীতু মুখখানা দেখে ঠোঁট চেপে হাসে আমান।
– কি বা হবে তুমি বলো?
– যদি ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় আমায়?তখন কি করবো?
– তবে আবার ভাইয়া তুলে নেবে সমস্যা নাই তুমি যাও বাকিটা তোমার দেওর সামলে নেবে?
– মানে?
– না না না না কিছু না কিছু না তুমি যাও আপু।সন্ধ্যা নেমে এসেছে।

সিড়ি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছাদে প্রবেশ করবে কি করবে না বলে দ্বিধা সংশয়ে ভুগছে সেহেরিশ।আড়াল থেকে আফীফের অস্তিত্বর দেখা মিললো না।সংশয়কে দূরে ঠেলে দ্রুত ছাদে প্রবেশ করে সে।চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা ভিড়ানো দেখে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে আসে।

আফীফ পুরোনো একটি সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।পায়ের রক্তে ভিজে আছে ব্যান্ডেজটা।শার্টের হাতা ফোল্ড করে বাম হাত কপালের উপর ঠেকিয়ে রেখেছে।তাকে দেখে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে সে কোন কারনে বেশ চিন্তিত।কিন্তু রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ দেখে সেহেরিশের গা শিউরে উঠে।

– একি আপনি এখনো এই পা নিয়ে বসে আছেন?ডাক্তারের কাছে কে যাবে?

বেগবান গতিতে সেহেরিশের কথায় তড়াক করে তাকায় আফীফ।কপালে ছুঁয়ে থাকা চুল গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে।

– এখানে কেন এসেছো তুমি?
– আপনার পায়ের এই অবস্থা আর আপনি নরমাল ভাবে ব্যান্ডেজ করে বসে আছেন?আপনার কুইকলি স্টেচ করা প্রয়োজন।তা না হলে ইনফ্যাকশন হবে।
– হলে হবে আমার কোন সমস্যা নেই।
– আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি আপনি আমার উপর রেগে আছেন।বিশ্বাস করেন আমি জানতাম না ছুরিটা এইভাবে আপনার পায়ে লাগবে।
– ইট’স ওকে।সমস্যা নেই।

– তাহলে ডাক্তার দেখাচ্ছে না কেন?
– মাঝে মাঝে নিজের শরীরে আঘাত দিয়ে মনের চাপা রাগ মেটানো যায়।আর মনের চাপা রাগ কেটে গেলে প্রফুল্ল লাগে।যানো তো মেঘ কেটে গেলে আকাশটা কেমন পরিষ্কার শুভ্র লাগে!

আফীফের এমন উওরে ফস করে শ্বাস ছাড়লো সেহেরিশ।সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে আফীফ এখন তর্কে লেগেছে সহজে এই তর্ক ছাড়বেনা।

– আপনি উঠুন প্লিজ।ব্যান্ডেজ করা স্বত্তেও এখনো রক্ত ঝরছে।আম সরি আসলে বিষটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটে গেছে।

সেহেরিশের কথায় পাত্তা দিলো না আফীফ।বরং পায়ে থাকা ব্যান্ডেজটা সহসা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়।আফীফের রক্তাক্ত ক্ষত স্থান দেখে আর্তনাদ করে উঠে মেয়েটি।

– প্লিজ প্লিজ এমন করবেন না।দ্রুত পা ঢাকুন আমার রক্ত সহ্য হয় না মাথা ঘুরায় এক কথায় রক্তে আমার ফোবিয়া আছে প্লিজ আপনি এসব পাগলামি করবেন না।

সেহেরিশ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো শেষ করে।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ হাসে।মনে মনে আফসোস সুরে বলে,
– এখনো তবে রক্ত ভয় পাও।

– মি.আফীফ আপনার সমস্যাটা কি বলবেন আমায়?কাটা পা নিয়ে এভাবে বসে থাকার মানে কি প্লিজ আপনি ডাক্তারের কাছে যান।

সেহেরিশের ধমকের সুরে কথায় সৎবিৎ ফিরে আফীফের।গায়ের চাদরটা ছাড়িয়ে নিয়ে আরাম করে গা এলিয়ে বসে।আফীফের এমন অঙ্গ ভঙ্গিতে বেশ রাগ লাগে সেহেরিশের।বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে আবারো বলে উঠে,
– ঠিক আছে আপনার যা ইচ্ছে আপনি করুন আমি মুনিফ ভাইকে ডাকছি তিনি আপনার জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করবেন।

সেহেরিশ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আফীফ দ্রুত উঠে দাঁড়ায় এবং তাকে হেচঁকা টান দিয়ে সোফায় ছুড়ে মারে।পকেট থেকে চাবি নিয়ে দরজায় দ্রুত তালা মেরে দেয়।আফীফের কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে যায় সেহেরিশ।এদিকে পায়ে চাপ লাগায় ব্যাথায় চোখ মুখ খিচে নেয় আফীফ।

– এইসবের মানে কি মি.আফীফ?
– কোন মানে নেই।
– তাহলে দরজা বন্ধ করলেন কেন?
আফীফ প্রত্যুত্তর করলো না।সেহেরিশের পাশে আবারো আয়েশ ভঙ্গিতে বসে যায়।কিন্তু পায়ের ব্যথায় মুষড়ে উঠছে সে।চোখে মুখে লালভাব ছড়িয়ে আছে।সেহেরিশ আহাম্মক বনে আফীফের দিকে তাকিয়ে আছে।আফীফ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে নেয়।

– জানো সেহেরিশ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে পায়ের ব্যাথায় পা নাড়াতেও পারছি না।
– আগেই বলেছিলাম এইসব নাটকের কোন মানে নেই ডাক্তারকে খবর দিন।সন্ধ্যা নেমে এসেছে আমার শীত করছে তাছাড়া রুমটাও অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে আমি বাইরে যাবো চাবি দিন।মুনিফ ভাইয়ে পাঠিয়ে দেবো।
– আমার কিন্তু খুব কষ্ট সেহেরিশ তুমি এমন না করলেও পারতে।

আফীফের ঠোঁট খিচে আসা কথায় সেহেরিশ ভয় পেয়ে যায়।আফীফের পায়ের দিকে তাকিয়ে আবারো ভয়ে কুঁকড়ে উঠে।

– প্লিজ আপনি চাবিটা দিন আপনার পায়ের অবস্থা মারাত্মক খারাপ।আমার উপরে রেগে আছেন আপনি তা আমি বুঝতে পারছি তাই বলে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না।

– আমি বাইরে যাবো তবে একটা শর্ত আছে।

সিরিয়াস মুডে আফীফের এমন কথা কিছুতেই সহ্য হয়নি সেহেরিশের।ধুপ করে মাথায় চেপে যাওয়া রাগটা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে তার।যার দরুনে আফীফের কলার টেনে ধরতেও দ্বিধা করে নি সে।

– তোর সমস্যা কি?পায়ের এমন বেহাল দশা করে আমার উপরে দোষ ফেলতে চাস?একা আছিস মেরে তক্তা করে দিতেও দু’বার ভাববো না।

– বাহ বাহ সাহস দেখি তাল গাছে উঠে গেছে।আমাকে তুই করে বলা হচ্ছে।এই মেয়ে এই আমাকে তুমি চিনো কলার ছাড়ো দ্রুত!

আফীফের ধমকে সেহেরিশের সৎবিৎ ফিরে আসে।তার আচরণে সে নিজেই লজ্জিত।হাটুতে হাত রেখে মাথা নুইয়ে বিড়বিড় করে আফীফকে বকতে থাকে।আফীফ তার মাথায় হাত রেখে রাগান্বিত স্বরে বলে,

– আমার একটা শর্ত আছে মিস সেহেরিশ তবেই আমার পায়ের আঘাতের বিষয়ে আপনাকে দোষ দেবো না আর আমি ডাক্তার দেখাবো।
– বলুন আপনার কি শর্ত?

– আমাকে আলিঙ্গন করে দুইটা শব্দ বলবেন।
– ছিহহহ এই ছিল আপনার মনে?আপনাকে আমি আলিঙ্গন করবো কোন দুঃখে?
– কেন কেইন, তুন্দ্রকে হুট হাট যে জড়িয়ে ধরো তখন বুঝি ছিহহ লাগেনা?
– ওরা আমার বন্ধু।বোকার মতো কথা বলবেন না।
– আমিও তোমার বন্ধু, বিশেষ বন্ধু। নাও জড়িয়ে ধরো।না হলে আজ পায়ের চিকিৎসা করাবো না।দায় তোমার আর আমার পরিবার আমার প্রতি ভিষণ ইউক এবার যদি আমার কিছু হয়ে যায় তুমি ফাসবে।

সেহেরিশ গোমড়া মুখে আফীফের দিকে তাকায় আফীফের তার দিকে তাকিয়ে আছে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে।
– আপনার শর্তটা চেঞ্জ করুন আফীফ দেওয়ান।এটা ছাড়া বাকি সব শর্ত মেনে নেবো।
– সত্যিত?
-পাক্কা সত্যি।
– ঠিক আছে।এবার থেকে আমার সব কথা শুনে চলবে যাও চাবিটা নিয়ে দরজা খুলো।

সেহেরিশ হাফ ছেড়ে বেঁচে যায়।আটকে আসা শ্বাসটা ছেড়ে চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আবার হঠাৎ হেঁচকা টান খায়।তৎক্ষনাৎ আফীফ তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।আফীফের মুখে সেহেরিশের পড়ে থাকা চুল গুলোতে গাঢ় করে শ্বাস নেয়।কানের কাছে ফিসফিস করে আবেগী সুরে বলে

– মিস সেহেরিশ ইয়া তেবয়া লিউব্লিউ!
– এহহহ
– হ্যা।

—–

সকাল সাতটায় আফীফের নির্দেশে ঘুম ভাঙ্গে সেহেরিশের।আফীফের পরিবারের কিছু সংখ্যাক সদস্য ঘুম থেকে উঠে গেলেও সেহেরিশের পরিবারের কেউ এখনো উঠে নি।আর তাই সেই সুযোগটা কাজে লাগায় আফীফ।সেহেরিশ ফ্রেশ হয়ে আসলে তাকে পাঠিয়ে দেয় কিচেনে চা তৈরির জন্য কিন্তু বেচারি সেহেরিশ এই জীবনে প্রথম চা বানানোর উদ্দেশ্য রান্না ঘরে প্রবেশ করে।দরজায় মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে সেহেরিশের কান্ড দেখছে আফীফ।

– আজকে সকালের চা টা কি আমি সত্যি পাবো নাকি না?
আফীফের কথায় আড় চোখে তাকায় সেহেরিশ।
– এত কথা বলছেন কেন?আপনি জানে না আমি চায়ের “চ” পারি না আর আপনি আমায় সাত সকালে চায়ের জন্য কিচেনে পাঠিয়ে দিলেন।অদ্ভুত লোক আপনি কোন জনমের শত্রু ছিলাম আপনার বলুন তো?
– কোন জনমের শক্র ছিলে জানি না তবে এই জনমের প্রিয়তমা হয়ে থেকো।

আফীফের ফিসফিসে কন্ঠের কথা সেহেরিশের কর্ণকুহরে পৌছালো না।

দুজনে দুইকাপ চা হাতে পুকুর পাড়ের সিড়িতে বসে।আফীফ নিরিবিলি সেহেরিশের তৈরি পানসে চা টা আনন্দের সাথে গিলছে কিন্তু সেহেরিশ একবার মুখ কুচকে চায়ের দিকে তাকায় অন্য বার আফীফের দিকে তাকায়।

– পুকুর পাড়ে শীত বেশি চলুন আমরা বাগানের দিকটায় যাই।
– চলো তবে।

সেহেরিশ এবং আফীফ দুজনে বাগানের দিকটায় কিছুক্ষণ আড্ডা দেয় হঠাৎ মাঝারি আকারের একটি ইটের টুকরো দেয়ালের বাইরে থেকে কেউ সেহেরিশের মাথায় ছুড়ে মারে।সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠে সেহেরিশ।কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত তার চোখ নাক ভাসিয়ে দিচ্ছে আর সেদিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে যায় আফীফ।সেহেরিশের মাথাটা দ্রুত চেপে ধরতেই তার পায়ের সামনে একটি কাগজের দলা পড়ে।

আফীফ দ্রুত কাগজটি তুলে পড়া শুরু করে,

” খুব শীঘ্রই প্রিয় মানুষ হারানোর আর্তনাদে ছড়িয়ে যাবে বাতাসের বেগে!”

আফীফ চিঠিটার মানে বুঝতে পেরে দ্রুত সেহেরিশকে আঁকড়ে ধরে।এদিকে রক্তের ফোয়ারা দেখে সেন্সলেস হয়ে যায় সেহেরিশ।

#চলবে…