অন্তরিন প্রণয় পর্ব-১৮+১৯

0
403

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৮

দেয়ালের সাথে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেহেরিশ তার সামনে আফীফ তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।আফীফ কি রেগে আছে নাকি তাকে মারবে কিছুই বুঝলো না সেহেরিশ।শাড়ির আচঁলটা দু-আঙুলে পেচিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করছে তখনি শান্ত,নিবিড় রুমটায় সেহেরিশের ফোন ভাইব্রেট করতে থাকে।স্কিনের দিকে তাকিয়ে তুন্দ্রের নাম্বার দেখে বিরক্তে মুখ কুচকে যায়।নিশ্চই তার দেরি দেখে ফোন করছে।তুন্দ্রের কল কেটে সেহেরিশ আফীফের দিকে একবার তাকায়।আফীফ এখনো তার দিকে একই অঙ্গ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।সেহেরিশ সাহস সঞ্চার করে দু-হাতে শাড়ি তুলে দরজার দিকে হাটা শুরু করে।

দরজার নব ঘুরাতে গেলেই আফীফ তার হাত আকড়ে ধরে।
– সমস্যা কি আপনার?হাতটা ছাড়ুন।
– কথা আছে দাঁড়াও।
– আমার নেই আপনি আমার হাত ছাড়ুন।
– আফীফ দেওয়ান ভদ্র ভাবে কথা একবার বলে।দ্বিতীয় বার একই কথা বলতে ভদ্রতা রাখেনা।
– তো?

সেহেরিশের ত্যাড়া জবাবে আফীফ ক্রুদ্ধ হলো।কিন্তু প্রকাশ করলো না।তখনি সেহেরিশের ফোনে আবারো কেইনের কল এলো।মোবাইল হাতে নিয়ে কেইনের নাম দেখে আফীফ ভ্রু কুচকালো।সেহেরিশ আফীফকে সরিয়ে যেতে নিলেই আফীফ তার দু-হাত আকড়ে ধরে চেয়ারের সাথে বেঁধে দেয়।
– রুম থেকে বাইরে যেতে পারবে তবে এই সাজে না।সোজা রুমে গিয়ে সাজ পোষাক চেঞ্জ করবে।
– আপনার আদেশ মেনে চলবো না কি আমি?এতটা অধিকার দেখানো মোটেও পছন্দের না আমার।
– ওহ আচ্ছা তবে কেইন, তুন্দ্রের কথায় নাচতে নাচতে রেডি হয়ে গেলে বাহ্!
– ওরা আমার বন্ধু আপনি কে?
– তাদের থেকেও বেশি কিছু।যা বলছি ত..

আফীফের কথার মাঝে আবারো কেইনের কল এলো।সেদিকে তাকিয়ে রুষ্ট হলো আফীফ।সেহেরিশ দ্রুত ফোন কাটতেই আবারো কথা শুরু করে আফীফ।
– তুমি বড় হয়েছো কিন্তু যথেষ্ট ম্যাচিউর হওনি।এবার একটু ম্যাচি….

আবারো কেইন কল করায় বিকট শব্দে ভাইব্রেট হতে থাকে সেহেরিশের ফোন।কথার মাঝে এমন বার বার বাধা পাওয়ায় নিজের রাগ দমাতে পারলো না আফীফ।সেহেরিশের হাত থেকে এক টানে ফোনটি কেড়ে নিয়ে দেয়ালের সাথে ছুড়ে মারে।রাগের মাথায় আফীফ দেয়ালের সঙ্গে ফোনটা আছাড় মারতেই বিকশ শব্দে কেঁপে সেহেরিশ।দু-চোখ খিঁচে ভয়ার্ত চোখে আফীফের দিকে তাকাতেই আবার তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে জানালার সামনে দাঁড়ায়।তখনি তার কানে আসে সেহেরিশের তীক্ষ্ম কন্ঠ,

– আমায় বেধে রেখেছেন কেন?জমিদারের নাতি বলে কী গ্রামটাকে কিনে রেখেছেন? আপনার কথায় মানুষ কী উঠবে আর বসবে ?

মেয়েটির তীক্ষ্ণ ধারালো কন্ঠের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আফীফ।
– পাখি যখন অন্যর বাস গৃহে এসে ডানা ঝাপটায় তখন তাকে বেঁধে রাখাই শ্রেয়!
আফীফের কথা শুনে শুকনো কয়েকটি ঢোক গিলে সেহেরিশ কিন্তু তবুও দমে যায় নি বরং আরো বেশি রাগ নিয়ে চেচিয়ে বলে,
– আমি এত শত জানতে চাই না আমাকে বেঁধে রাখার কারন টা কী?

আফীফ পিলপিল পায়ে এগিয়ে আসে সেহেরিশের দিকে।ডান হাতটা দিয়ে সেহেরিশের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,

– মনে করে দেখো ফুলপরি আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা।অতীতের কথা,এই গ্রামে আসার কথা আমার কথা।আমি যানি তুমি ভুলে যাওনি সব মনে আছে।শুধু ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছো। ঠিক আমাদের মতো একই অঙ্গভঙ্গিতে।

আফীফের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সেহেরিশ। তার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস দিগুন বেড়ে গেছে।লোকটি আবারো তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মেয়েটি কয়েক বার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে তার চিরচেনা অতীত।যে অতীতে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আজ এতটা বছর…

বর্তমান…

কোমল দুইহাতে আফীফের ঠোঁটের স্পর্শে সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।তার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।অতীত ভাবলেই তার ভয় করে কান্না পায়।সব কিছু তিক্ত মনে হয়।তবে ফুফির কথাই ঠিক ছিল আফীফ তাকে চিনতে পেরেছে।এতদিন সেহেরিশের মতো আফীফ নিজেও নাটক করেছে সাথে তার পরিবারের সকলে।ইসস বোকা সেহেরিশ বুঝতে পারলো না আফীফের কূটকৌশল।

– কান্না করছো কেন ফুলপরি কান্না তোমায় মানায় না।তুমি হাসবে আগের মত সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলবে।
আফীফের শান্ত কন্ঠ মোটেও সেহেরিশের কাছে ভালো লাগছে না।নিজের করা কারসাজিতে অনুতপ্ত সেহেরিশ।তাই নিজেকে মুক্তি করতে আফীফের উদ্দেশ্য বলে,

– আমায় মাফ করে দিন।অতীতের ভুলে আমি অনুতপ্ত।আপনার সঙ্গে তর্ক কিংবা কাদাছোড়া কোনটাই করা আমার উচিত হয়নি।আপনি চাইলে আমি পা ছুঁয়ে মাফ চাইবো।তবুও আমার জীবনটা বিষিত করবেন না।আর হ্যা আমি আমার পরিবারকে নিয়ে চলে যাবো।আপনি আমায় মাফ করে দিন।অন্তত অতীতের রেশ ধরে আমার বর্তমানটা নষ্ট করতে চাই না।
সেহেরিশের নত মুখের কথায় ঠোঁট টিপে হাসে আফীফ।সেহেরিশের মুখোমুখি অন্য চেয়ারে বসে গলা খেকিয়ে বলে,
– মাফ আমি তোমায় কোন দিন করবো না তাকিয়া আনওয়ার সেহেরিশ।অন্তত সেই দিনের জন্য যেদিন আমাকে না জানিয়ে বাড়ির বাইরে কেন গেলে?জানো আজ এই দিনের সম্মুখে আমরা কোন দিন হতাম না যদি তুমি আমায় ছেড়ে যেতে।

– তবে আমি কি করবো?বন্ধি থাকবো আপনার কাছে সারাজীবন।আমার কি পরিবার নেই ভালোলাগা মন্দ লাগা স্বাধীনতা নেই?”
আফীফের কথা শেষ হতেই সেহেরিশ ধমকের সুরে রাগ দেখিয়ে কথাটি বলে আবার থেমে যায়।চোখ খিচে বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে কাদতে থাকে।বার বার এই ভুল কেন করছে সে?নিজের রাগ কিছুতেই বশে আনতে পারছে না।

তার অবস্থা বুঝতে পেরে আফীফ ঈষৎ হাসে।

– বিস্তারিত কোন কিছু না জেনে সিধান্ত নেওয়া কিংবা বলা উচিত না।আমি তোমার কোন দিন খারাপ চায় নি আর প্রতিশোধ?মায়াময়ী সেই ছোট্ট তাকিয়ার কাছে প্রতিশোধ আমি নেবো কি করে?আমার তো সেই সাধ্য নেই।তোমাকে বন্ধী করেছি আমার বর্শে আনার জন্য।রাগের মাথায় আমি ঠিকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তুমি আমার কাছে থাকবে কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম এভাবে তোমায় বন্ধি করা উচিত নয়।তোমার বাকিটা জীবন পড়ে আছে।তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তোমায় তোমার বাড়িতে ফিরিয়ে দেবো।তোমার ফুফুর সাথে আমার দেখা করার কথা ছিল কিন্তু তিনি দেখা করেন নি বরং শহরে তোমায় ছেড়ে চলে যান। আমি অপেক্ষায় ছিলাম তার।কিন্তু গ্রামে তিনি আসেন নি।ওইদিন বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত থাকলেও আমি ব্যস্ত ছিলাম তোমার পরিচয়ের খোঁজে।ছলে বলে কৌশলে তোমার অবস্থান পরিবার সম্পর্কে জানতে পারি।এবং এটাও জানতে পারি তোমার ফুফি গ্রামে ফিরছেন।কিন্তু আমি বাড়ি দেখলাম তুমি নেই।সেদিনের সেই রাগ তিক্ত অনুভূতি তুমি কখনো বুঝবে না ফুলপরি। বেইমানি করা হয়েছে আমার সাথে।তুমি চলে যাওয়ার পর তিনটে মাস যে কত ভয়ংকর ছিল আমার জন্য তুমি নিজেও জানো না।অবশ্য জানার দরকার নেই।শুধু এটা জেনে রাখো আমি তোমাতে আসক্ত।

সেহেরিশ চমকায়।কিছু বলতে গেলেও থেমে যায়।তপ্ত শ্বাস ছড়ে বিড়বিড় করে বলে,
– আল্লাহ পাগলের পাল্লায় পড়লাম আমি।এখন কি হবে!
– হ্যা পাগল আমি অন্য কিছুতে নয় তোমাতে।যাই হোক রুমে যাও চেঞ্জ করে তারপর রুম থেকে বের হবে।কেইন তুন্দ্রের সাথে মেলামেশা করবে ঠিকি তবে এতটাও ঘনিষ্ট হবে না যতটা দেখলে আমার রাগ লাগে।
সেহেরিশ চুপচাপ অন্যদিকে মুখ করে বসে আছে।আফীফ তার হাতের বাধন খুলতে গেলেই চমকে যায়।সেহেরিশের দু-হাত মাত্র অতিরিক্ত গরম হয়ে আছে।দ্রুত আফীফ তার হাত মেয়েটির কপালে ঠেকাতেই বিস্ময় হয়।
– হঠাৎ জ্বর এলো কেন?
– হাতের বাধন ছাড়ুন আমার অসহ্য লাগছে।
আফীফ ছেড়ে দিলো।সেহেরিশ শাড়ি তুলে হাটতে শুরু করে হেলেদুলে।গলার পাশটায় বেশ খানিকটা শাড়ি সরে আছে।দরজার নব ঘুরিয়ে ঘাড় কাত হয়ে তাকায় সে।

– আফীফ দেওয়ান পাগলা গারদে যান।আমার প্রতি পাগল হয়ে লাভ নেই।বিকজ আই ডোন্ট লাইক ইউ।
– তুমি ও পাগলী হয়ে যাবে এই পাগলের প্রতি।
– তার আগে আমার মৃত্যু হোক।

সেহেরিশের কথা শেষ হতে দেরি হলো কিন্তু আফীফের প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেরি হলো না।হেচকা টানে সেহেরিশকে নিজের কাছে এনে দু হাতের মুঠোয় বন্ধি করলো।
– বাজে কথা ছাড়ো।তৈরি থেকো খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হবে।
– কোন দিন না।কে রাজি থাকুক আর না থাকুক আমি অন্তত রাজি হবো না।আমার সাথে আপনার কোন দিক দিয়ে যায় না।

– ওহ আচ্ছা তাই নাকি।তা কেমন ছেলে চাই তোমার।
– আমার যে বর হবে তাকে হাসি-খুশী স্বভাবের হতে হবে। আপনার মতো গোমড়া মুখো ছেলে না।আর আমায় শ্রদ্ধা, সম্মান এবং অফুরন্ত ভালোবাসবে।
– হুম,আসলে আমার দাদীজান কি বলে জানো আমার হাসিটা বড্ড বেহায়া স্বভাবের।যে কোন মেয়েকে সহজে বেহায়া করে তুলে কিন্তু আমার সেদিকে তাকিয়ে লাভ নেই আমি তো একজনে আসক্ত।এবার থেকে আমি হাসবো দেখি তুমি নিজেকে সামলাও কী করে।দেখবে তুমি নিজেই ফেসে যাবে।আর ভালোবাসা!যাকে কাছে না পেয়ে আট বছর যাবৎ ভালোবেসেছি আর তাকে কাছে থেকে ভালোবাসতে পারবো না।এই যে দেখো প্রচন্ড শীতেও তোমার নাম ঘামছে বাঙালিরা বলে নাক ঘামলে বরের আদর বেশি পায়।তবে প্রমান হলো তো?

আফীফের কথায় তৎক্ষনাৎ সেহেরিশের হাত নাকে চলে যায়।হঠাৎ জ্বর আসায় তার সারা শরীরে কাপুনি শুরু হয়ে গেছে।আফীফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সে।সেহেরিশের কাপড়টা পেটের দিকটায় কিঞ্চিৎ সরে যাওয়ায় আফীফের চোখে সহসা সেহেরিশের কাঁটা দাগ সাদৃশ্য হয়।
– একি এতটা কাটলো কি করে তোমার?
– ক..কিছু না।ছেড়ে দিন আমায় আমি চলে যাবো।
– আবার মিথ্যা, সত্যিটা বলো সেহেরিশ।
– ছাড়ুন আমায়।

সেহেরিশ রাগ দেখাতে নিলেই আফীফ তার পেটের কাটা দাগটায় চেপে ধরে।সহসা চাপা আর্তনাদ করে উঠে সে।আফীফ তার কানের সামনে মুখ বিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– আমায় মিথ্যা বলবে না সেহেরিশ।মিথ্যা আমার দুশমন।

নিয়ন বাতির আলোয় আফীফের দিকে সেহেরিশ তাকিয়ে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।তখন অন্ধকার রুমটায় আফীফ নিয়ন বাতির আলো জ্বালিয়ে দেয় কিন্তু পুরো রুমটা জুড়ে আফীফের এত লুকোচুরি কিসের সেহেরিশ বুঝতে পারছেনা।স্পষ্ট আলোর ছোয়া এখনো সে পায় নি।

আফীফ সেহেরিশের কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়।
– এবার যাও।কেউ যেনো অতীত সম্পর্কে কিচ্ছু না জানে আর মারুফা ফুফির সাথে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে লাভ নেই তিনি যদি আজকের এই ঘটনা সম্পর্কে বিন্দু পরিমান জানে তবে বিপদ তোমার বাড়বে।সো বি কেয়ার ফুল।

—–
সন্ধ্যা পর সেহেরিশের জ্বরের তাপ কিছুটা কমেছে।চুপচাপ নিরিবিলি নিজের রুমে মেঝেতে বসে আছে সে।এখনো লাল শাড়িটি গায়ে তার।মুখের সাজসজ্জা কিছুই ধৌত করেনি।তুন্দ্র আর কেইনের মাঝে চাপা দ্বন্দের সৃষ্টি।সেহেরিশকে চুপ থাকতে দেখে তুন্দ্র এগিয়ে আসে।
– তোর ফোন কই সেহেরিশ আমি কতবার কল করেছিলাম।তোকে রুমেও খুজেছি ছিলি না তুই।আর হঠাৎ জ্বর আসলো কেন?
তুন্দ্রের প্রশ্নে রাগ দেখায় কেইন।
– সে বলেছিল শাড়ি চুড়িতে সে অভস্ত নয় তুই কেন জোর করলি?এখন অসুস্থতা দায় তুই নিবি।বাড়াবাড়ি করা মোটেও ঠিক না তুন্দ্র।তোর শখের কারনে সেহেরিশের ক্ষতি মানতে পারবো না।

দুজনের তর্কে রাগ লাগলো সেহেরিশের মাথা তুলে তাকাতেই দরজার আড়ালে আফীফকে দেখে রাগটা যেন দিগুন বাড়ে সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের চুড়ি ভর্তি দুই হাত মেঝেতে আছাড় দেয়।ঝনঝন করে লাল চুড়ি গুলো ভেঙ্গে সেহেরিশের হাতে বিঁধে যায়।রক্তমাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে ছুটে আসে কেইন তুন্দ্র।দূর থেকে তার কার্যকলাপ দেখে রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিড়বিড় বিড়বিড় করে আফীফ বলে,
– তোমার মাঝে রাগ,ক্ষোভ বড্ড বেমানান!

#চলবে….

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৯

দিনের আলোর সমাপ্তি ঘটে আফীফের জন্য শুরু হয়েছে আরেকটি বিষন্নতার সন্ধ্যা।সামী,মৌ সবাই আমানের রুমে আড্ডার আসর জমাতে ব্যস্ত তখনি রুমে প্রবেশ করে আফীফ।তাকে দেখে বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আমান।
– আরে ভাইয়া তুমি আমার রুমে?
– দেখতে এলাম তোরা কি করিস।

আফীফ কথা শেষ করেই সামীর পাশে বসে পড়ে।সামীর দিকে তাকিয়ে মিহি হাসে আফীফ।তার প্রত্যুত্তরে সামীও হাসলো।
– এখানে দিন কাল কেমন কাটছে সামী?
– খুব ভালো ভাইয়া।চলে যাওয়ার পর আমি তোমাদের সবাইকে মিস করবো।
– আমরাও তোমায় মিস করবো।তোমাকে কিছু প্রশ্ন করি আই মিন আমার তোমার পরিবার সম্পর্কে জানার ইচ্ছে।তুমি কি আমায় প্রশ্ন গুলোর উওর দিয়ে সাহায্য করবে?
– অবশ্যই ভাইয়া বলো কি জানতে চাও।
– না তেমন কিছু না পরিবারের মাঝে তোমার প্রিয় ব্যক্তি কে?
– বাবা-মা,ফুফি, আপুনি সবাই আমার প্রিয় তাদের ছাড়া আমার আর কে বা আছে।
– তোমাদের পরিবারে সবচেয়ে রাগী সদস্য কে?
– আমার পাপা!
– কেন তোমার আপুনি না?
– সেহেরিশ আপু তো রাগারাগি করে না।সারাদিন প্রফুল্ল থাকে।মাঝে মাঝে রাগে তবে আবার ঠিক হয়ে যায়।তবে যানো সেদিন…

সামী থেমে যায় তার মুখটা কেমন চুপসে গেছে।আফীফ তার চুপসে যাওয়া ভাবটা ধরতে পেরে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
– সেদিন কি হয়েছিল সামী?
– পাপা যখন বিডিতে আসার কথা বললো তখন আপুনি হঠাৎ রেগে যায়।পাপার সাথে মিস বিহেভ করে। কিন্তু আপুনি এর আগে কখনো এমন করে নি।সেদিনের কান্ডে আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম।সে কিছুতেই গ্রামে আসবে না।যদিও ফুফির কথায় রাজি হয়ে আসলো তখন অনন্তপুর থেকে কিছুতেই এই গ্রামে আসবে না।

সামীর কথায় আফীফ বেশ ভালো করেই সেহেরিশের সম্পর্কে উপলব্ধি করেছে।

‘প্রসঙ্গ যখন বারুদ আফীফ দেওয়ান,সেহেরিশ তখন আগুন হয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠে।’
এই আগুন আর বারুদ এক সঙ্গে থাকলে নির্ঘাত
বিষ্ফোরণ হবে।একদিকে সেহেরিশের বিরোধ ভাব অনুভূতি অন্যদিকে আফীফের হৃদয়ের অব্যক্ত ভালোবাসা কি করে প্রকাশ করবে সে!
যদি বিষ্ফোরণ থেকে আফীফের হৃদজমিনে ভালোবাসা নেমে আসে তবে বিষ্ফোরণি হোক!

___

আজ দুপুরের পর মেয়েকে দু-চোখে না দেখে মনটা খচখচ করছে খুরশীদ আনওয়ারের।ফাহমিদাকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে মেয়ে রুমেই আছে।তাই তিনি সেহেরিশকে দেখার উদ্দেশ্য তার রুমে পা বাড়ায়।

লালাটুকটুকে শাড়িটি এখনো সেহেরিশের গায়ে।গায়ে কম্বোল জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সে।তার পাশে তুন্দ্র এবং কেইন অপরাধী মুখ করে বসে আছে।
– আ’ম সরি সেহেরিশ।শাড়ি পড়া নিয়ে তোর উপর জোরাজোরি করা আমার মোটেও উচিত হয়নি।
– আহ্ তুন্দ্র এবার আমার ভীষণ রাগ লাগছে কতবার বলেছি নিজেকে অপরাধী বলবি না।আমি তো রেডি হয়ে ছিলাম মাঝ থেকে কি হয়ে গেলো নিজেও জানি না।।
– কিন্তু সবটা তো আমার কারনেই হয়ছে।

তুন্দ্রের কথায় পাত্তা দিলো না কেইন বরং সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।
– তুন্দ্র তুই চুপ থাক।সেহেরিশ তুই তখন হাতে এই ভাবে বারি দিলি কেন?তুই জানিস আঙ্কেল আন্টি জানলে আজ রক্ষে থাকবে না।
সেহেরিশ থতমত মুখ করে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে।এই মূহুর্তে কি বলবে সে?মিথ্যা প্রশ্ন সাজিয়ে সোজাসাপটা বলতে থাকে,

– আসলে এত চুড়ি ধীরে ধীরে খুলতে অসহ্য লাগছে তাই আছাড় মেরে ভেঙ্গে দিয়েছি।
– বোকার মতো কথা বলবি না।হাতে যে এতটা কেটেছে কষ্টটা এবার সহ্য কর।

– কার হাত কেটেছে?

দরজার পাশ থেকে খুরশীদ আনওয়ারের কথায় লাফিয়ে উঠে তুন্দ্র এবং কেইন।সেহেরিশ চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে।
– কি রে তোরা এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?
– আ..আঙ্কেল ভেতরে আসুন।আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম।
খুরশীদ রুমে প্রবেশ করেই সেহেরিশের দিকে চোখ বুলায়।মেয়েটির কান্নারত ফোলা নাক মুখ চোখ দেখে তিনি বুঝেই যান কিছু একটা চলছে এই তিনজনের মাঝে।
– কি রে আম্মু তুই এইভাবে বসে আছিস কেন?
– কিছু না পাপা।হঠাৎ আমার খোঁজে কোন জরুরি কথা আছে নাকি?
– না তোকে দেখতে এলাম।

মুরশীদ মেয়ের পাশে বসেন।হাত বাড়িয়ে সেহেরিশের কপালে হাত রাখতেই ভ্রু যুগল কুচকে নেয়।
– তোর গায়ে তো জ্বর।আমাদের বলিসনি কেন?
– আমি মেডিসিন নিয়েছি পাপা।সমস্যা নেই।বলছিলাম কি আর কয়দিন থাকবো এখানে চলো না ফিরে যাই আমরা।
সেহেরিশের কথায় তাল মেলালো কেইন।
– ইয়েস আঙ্কেল সেহেরিশ ঠিক বলছে।ডিসেম্বর শেষ হয়ে এলো আমার ক্রিসমাস আছে।আমাকে তো মাস্ট ফিরতে হবে।
– শুনেছি রমিজ মিয়া দুই সাপ্তাহ পর আসছে।মানে কি বুঝতে পারছো বাবা, কাটায় কাটায় ৩ তারিখে তিনি আসছেন তখনি আমাদের আলাপ-আলোচনা শুরু হবে।তোমার অনুষ্ঠান পচিঁশ তারিখ।কিছু না মনে করলে একটা কথা বলি।তুমি থেকে যাও বাবা।সেদিন বরং তোমরা ঢাকায় চলে যাবে ঘুরবে ফিরবে দিনটি উর্যাপন করবে দিনটি।

মুরশীদের কথায় সহমত জানালো কেইন।মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করে নিজের রুমে ফিরে যান খুরশীদ আনওয়ার।তার বাবা হাতের ব্যান্ডিজ না দেখায় সেহেরিশ যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলো।

রাতের খাওয়ারে সেহেরিশ আর নিচে নামলো না।ক্লান্ত শরীর নিয়েই ঘুমিয়ে গেলো।কেইন যাওয়ার আগে সেহেরিশের দরজা ভিড়িয়ে চলে যায় আর সেহেরিশ মগ্ন গভীর ঘুমে।দরজা খোলা পেয়ে সেহেরিশের রুমে ঢুকে যায় অজ্ঞাত কোন ব্যাক্তি।পিলপিল পায়ে এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়ায় বিছানার সামনে নিয়ন বাতির আলোয় সেহেরিশের মায়াবী মুখ মন্ডল তাকে অন্যরকম ঘোরে টানছে।
– ইসস কি যে মায়া এই মুখে সহযে আকৃষ্ট করে।আই নিউ ইউ সেহেরিশ।তবে সম্মুখে তোমায় চাইবার বহিঃপ্রকাশ আমি করতে পারবো না।যা করবো সব আড়ালে।আমি অপেক্ষায়!

অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

রাত তিনটার কাছাকাছি।আফীফ আজ দু-চোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারেনি।আহনাফ দেওয়ান তাকে খুব অল্প সময় দিয়েছে সেহেরিশকে মানাতে কিন্তু কি করে করবে সে।গায়ের চাদরটা জড়িয়ে আফীফ নিঃশব্দে সেহেরিশের রুমে প্রবেশ করে।ড্রিম লাইটের আলো চারিদিকে স্তব্ধ নিরিবিলি পরিবেশে কোথাও যেন ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ।আফীফ সর্তক হয় চারিদিকে আবারো চোখ বুলায় ফিফফিসে আওয়াজের উৎস খুঁজতে গিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।

রাতে হঠাৎ ঘুম কেটে যাওয়ায় ঘুমন্ত জুহিকে ফোন করে বসে সেহেরিশ।শুরু হয়ে যায় দুজনের ফুসুরফাসুর।কম্বোলের নিচে গুটিসুটি মেরে কথা বলছিল সেহেরিশ।হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কারো তপ্ত শ্বাসে নড়ে সে।তড়াক করে পেছনে ঘুরে তাকাতেই কম্বোলের নিচে আফীফকে দেখে লাফিয়ে উঠে।তাকে বসতে দেখে আফীফ দ্রুত সেহেরিশের ফোন হাতে নিয়ে নেয়।মোবাইল চেক করতেই আফীফ বুঝতে পারে এটি ফাহমিদার ফোন।সেহেরিশের ফোন তখন আফীফ নিজেই ভেঙ্গেছিল।
– এই আমার ফোন দিন অসভ্যতার লিমিট ক্রস করছেন আপনি।
ভিডিও কলে জুহি অন্ধকারের মাঝে কিছুই বুঝতে পারছে না।আফীফ তড়িৎ গতিতে রুমের লাইট অন করতেই সেহেরিশকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়।সেহেরিশ নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে দ্রুত কম্বোল গায়ে জড়িয়ে নেয়।আফীফ চোখ বন্ধ করে ছোট্ট করে শ্বাস ছাড়ে।

“আরে হচ্ছে টা কি?এই যে আপনি কে”

ভিডিও কলে জুহির প্রশ্নে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে আফীফ।
– হেই মাই শালিকা।
– শালিকা?
– ইয়েস তোমার জিজু হই।সেহেরিশ তোমার ফ্রেন্ড আমার হবু বউ খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করছি।

আফীফের বেল্লিক কথায় রেগে যায় সেহেরিশ।
– কি হচ্ছে কি আপনি এইসব কি বলছেন।একদম উলটা পালটা কথা বলবেন না।

আফীফ সেহেরিশের কথায় পাত্তা দিলো না বরং জুহির সাথে কথা চালিয়ে গেলো।
– তুমি জানো না শালিকা।সেহেরিশ হয়তো লজ্জায় বলেনি।
– কি বলেন এইসব আমি কিছুই জানলাম না।কেইন তুন্দ্র আমাকে কিছু বলেনি।
– আরে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি।তাদের বলার দরকার নেই।তোমার ফ্রেন্ড আমার সাথে রেগে আছে বুঝলে এখন বলছে বিয়ে করবে না।একটু বুঝিয়ে বলো আমার মতো সুদর্শন ছেলেকে বিয়ে না করে থাকা যায়?
– হেই সেহেরিশ তুই বিয়ে করিস না।ছেলেটাকে আমার দিকে ছুড়ে মার।

জুহির কথায় ফোন কেটে দিলো আফীফ।সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে বলে,
– দেখলে তোমার ফ্রেন্ড আমায় দেখে ফিদা আর তুমি আমায় পাত্তা দাও না। হাউ ফানি।
– এইসব পাগল ছাগলকে দেখলে কোন ভালো মেয়ে ফিদা হয় না যত্তসব।এত রাতে আমার রুমে কি?
– দেখতে এলাম তুমি কি করছো।
– দেখা হয়েছে এবার যান।

আফীফ গেলো না বরং সেহেরিশের সামনে এগিয়ে আসলো।
– বলেছিলাম শাড়িটা চেঞ্জ করতে তবে এখনো পরে আছো কেন?একটু আগে তো আমার হাট এট্রাক করিয়ে ছাড়তে।
– ইচ্ছে হয়নি তাই করিনি।
– তখন হাতে এইভাবে চুড়ি গুলো আছাড় দেওয়ার কারন কি বুঝাতে চাইছো তুমি রাগী তোমার রাগ বেশি?
সেহেরিশ উওর দিলো না বরং আফীফের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,
– আপনার দাদাকে আমি বিচার দেবো।কেমন নাতি তার রাত দুপুরে অন্য মেয়ের রুমে না বলে চলে আসে।
– আমার দাদাজান কি বলেছে জানো?বলেছে তোমায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করে যেন বাড়িতে আনি।আর যদি তোমার বাবা রাজি না হয় তবে তোমাকে আর তোমার বাবাকে তুলে আনবে বিয়ের আসরে।

সেহেরিশ উওর দিলো না।রাগ দেখিয়ে কম্বোল টেনে বিছানায় শুয়ে যায়।হঠাৎ করেই মাথাটা ধরেছে ভীষণ তাই এই মূহুর্তে সেহেরিশের তর্ক করার মুড নেই।আফীফ সেহেরিশের পাশে সটান হয়ে শুয়ে যায়।
– এসব কি এখানে শুয়ে আছেন কেন?
– তোমার হাতটা দাও।
সেহেরিশ ভ্রু কুচকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো।তৎক্ষনাৎ আফীফ তার পাচঁ আঙুল সেহেরিশের আঙুলে মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।
– আর একটা সাউন্ড করলে তোমার আম্মুর মোবাইলটাও ভেঙ্গে দেবো চুপচাপ ঘুমাও!
– ইডিয়ট।
#চলবে…