#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৪
– দাদী আপনার রাক্ষস নাতীর কাছ থেকে বাঁচার উপায় কী?
সেহেরিশের ব্যাকুল কন্ঠে চোখ ছোট করে তাকান ফাতেমা।হাতে থাকা পানটা মুখে পুরে গমগম সুরে বলেন,
– আমার কইলজার নাতিরে তুমি রাক্ষস কইলা কেন?দশ গ্রাম ঘুইরা এমন পোলা পাইবা কী না কে জানে?
– আমার দরকার নেই।কিন্তু আমি মুক্তি চাই। আমার ফুফির কাছে ফিরতে চাই দাদী।
সেহেরিশের কথায় মুখ ঘুরিয়ে নেন ফাতেমা।এই মূহুর্তে কোন কথা বলার জো নেই তার।ফাতেমার উদাসীন ভাবে বিরক্ত হয়ে সেহেরিশ জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে বিরস মুখে। কুয়াশার চাদরের আড়ালে আজ রোদের দেখা নেই।পুরো গ্রাম হাড় কাঁপানো শীতে তটস্থ।
তখনি রুমে প্রবেশ করে পারভিন।সেহেরিশের গুমরা মুখ দেখে কিছু টা আচঁ করতে পেরে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেন।ফাতেমার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলেন,
– বড় ভাই আপনাকে ডাকছে আম্মা।
– মাসুম বাড়ি ফিরেছে?আফীফ বাড়ি ফিরেনি?
– না।
পারভিনের উওর পেয়ে ফাতেমা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।সেই সুযোগটা লুফে নিলো পারভিন। দ্রুত সেহেরিশের সামনে দাঁড়িয়ে আশ্বাস সুরে বলে,
– এই যে মেয়ে শুনো ভালো খবর আছে,
– কী খবর আন্টি?
– কাল সবাই পাশের গ্রামে যাবে একটা বিয়ের দাওয়াত উপলক্ষ্যে। আর যার মেয়ের বিয়ে তার সাথে খুব ভালোই সম্পর্ক এই বাড়ির সবার।তাই সবাই যাবে বিয়েতে তুমি নিশ্চিত বাড়িতে থাকবে।কালকেই তোমাকে এই বাড়ি ছেড়ে পালানোর ব্যবস্থা করে দেবো।
শেষ কথা গুলো ফিসফিস করে বলে উঠলো পারভিন।তার কথা গুলো শুনে চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলো সেহেরিশের।
– সত্যি বলছো তুমি?
– হ্যা সত্যি।আর তোমার এই বাড়ি থেকে বের হওয়া যেহেতু নিষেধ সেহেতু তুমি বাড়িতেই থাকবে। বাকিটা আল্লাহ জানে, দোয়া করি পরিবারের কাছে ফিরে যাও।
পারভিন দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায় এদিকে সেহেরিশ আশার আলো ফিরে পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা।
আফীফ বেশ রাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে আজ।কেননা সেহেরিশের ফুফু মারুফার সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন তথ্য পায় নি সে।এমন কী অনন্তপুর গ্রামের কেউ তাদের খুব একটা চিনতে পারছেনা।যার দরুনে আফীফের সেহেরিশের সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া ও হলো না।
বাড়িতে এসেই প্রথমে সেহেরিশকে দেখার জন্য দু-চোখ ব্যাকুল হয়ে উঠলো।বাড়ির প্রত্যাকটা কক্ষে সেহেরিশে সন্ধান না পেয়ে ভয়ে তার আত্মা কেঁপে উঠে।বাড়ির বাকি সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।রান্না ঘরে ঢুকে দ্রুত আফীফের মা সেজুঁতিকে আফীফ প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসে,
– আম্মা তাকিয়া কোথায়?তাকে দেখছিনা কেন?সে কোথায়? তোমরা তার খেয়াল রাখোনি?
– আস্তে আস্তে প্রশ্ন কর আফীফ।এত অদৈর্য্য হয়ে যাচ্ছো কেন তুমি?তাকিয়া তোমার রুমেই আছে একটু আগে মর্জিনা তাকে দেখে এসেছে সেখানে।
– আমার রুমে?
– হ্যা আগে গিয়ে দেখো তারপর উতলা হবে।কোথাকার কোন মেয়ে এই ছেলের মাথাটা পুরো খারাপ করে দিয়েছে যতসব!
শেষ কথাটা বেশ রাগ নিয়ে বললেন সেজুঁতি।সেদিকে আফীফ পাত্তা না দিয়ে দ্রুত তার রুমের দিকে রওনা হয়।রুমে ঢুকেই সস্তির শ্বাস ছাড়ে আফীফ।সেহেরিশ চুপচাপ বিছানার উপর চাদর মুড়িয়ে বসে আছে।হাতে তার একটি বই অন্য হাতে আচারের বাটি।
– তাকিয়া!
আফীফের কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গে নি তাকিয়ার। সে এক মনে মুখে আচার পুরে নিচ্ছে অন্য হাতে ধরে আছে একটি গল্পের বই।আফীফ নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। ভালো করে নজর করতেই তাজ্জব বনে যায়।সেহেরিশের হাতে আচার তেলে পরিপূর্ণ। সেই তেল চুইয়ে চুইয়ে আফীফের বিছানার চাদর, সেহেরিশের জামায় দাগ লেগে আছে।বিষয়টি আফীফের কাছে ঘৃণার্হ লাগলেও সেহেরিশের নিষ্পাপ মুখখানা দেখে থমকে যায়।গাঢ় করে শ্বাস ছেড়ে সেহেরিশের পাশে ধুপ করে বসে যায়।
– ও তাকিয়া।
– হু
– তোমায় খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান আর তুমি আমার গুহায় এসে ঘাপটি মেরে আছো?
– কেন,কেন,কেন?আমায় কি বাঘ,ভাল্লুক নিয়ে যাবে নাকি?
– কি পড়ছো তুমি?আর হাতের মুখের জামার এই অবস্থা কেন?
আফীফের কথায় সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।হাতের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটে অনুনয় সুরে আফীফকে “সরি” বলে।তার ভাব ভঙ্গি দেখে আফীফ লাহমায় হাসে।
– যাও পারভিন আন্টির কাছে যাও সে তোমায় পরিষ্কার করে দেবে।বই তুমি পরেও পড়তে পারবে।
সেহেরিশ জটপট উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত আফীফের রুম থেকে বেরিয়ে পারভিনের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে।
অন্যদিকে শান্ত নির্মল সেহেরিশকে দেখে সারাদিনের ক্লান্তিটা দূর হয়ে যায় আফীফের।
গভীর রাত আফীফ গম্ভীর ঘুমে তন্দ্রাচ্ছন্ন।বাড়ি সকল সদস্য বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য পাশের গ্রাম অনন্তপুরে সেই শেষ বিকেলেই রওনা হয়েছে।গায়ে হলুদ উপলক্ষ্য সবাই সেখানেই থেকে যায়।বিস্তীর্ণ বাড়ি জুড়ে পারভিন আফীফ সেহেরিশ থেকে যায়।সেই সুযোগ লুফে নিতে পারভিনের সাথে সলাপরামর্শ করতে রুম থেকে আবারো বেরিয়ে যায় সেহেরিশ।
ঘুমন্ত আফীফের মুখের দিকে তাকিয়ে সেহেরিশ পীল পীল পায়ে আবারো রুম থেকে বেরিয়ে যায়।ঠান্ডায় সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে।তবুও সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করবে না সেহেরিশ।বাড়ির দোতলায় প্রত্যকটা রুমে অনুসন্ধান চালিয়ে পারভিনকে কোথাও পেলো না সে।
বিরক্ত হয়ে শেষ উপায় না পেয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে গেলেই হঠাৎ গায়ে থাকা চাদরটির টান পড়লে থমকে যায় সেহেরিশ।
পেছনে ঘুরে আফীফকে নজরে পড়তেই দু পা পিছিয়ে যায়।আরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আফীফের ডিম লাইটের আলোতে চোখে দুটো দেখে আত্মা কেঁপে উঠে তার।মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই আফীফ তার হাত ঝাকরা দিয়ে কাছে টেনে আনে।
– কোথায় যাচ্ছো তুমি?
– কোথাও না।
– তবে রুমের বাইরে কি করছো?
– আমি… আমি হাটতে বেরিয়ে ছিলাম।
– এত রাতে হাটতে বেরিয়েছো তাও চোরের মতো।আমাকে বোকা বানাচ্ছো তুমি?বাড়িতে কেউ নেই সে সুযোগে আবারো পালানোর মতলব আটঁছো বুঝি?
– ন… না আমি, আমি তো এমনেই বেরিয়েছিলাম।
– তোমায় আমি বিশ্বাস করি না। উফফ শীট আজকেও একই ভুল করেছি তোমার রুমের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিলাম।কিন্তু আর নয়।
আফীফ সেহেরিশকে টানতে টানতে তার রুমে নিয়ে যায়।দ্রুত সেহেরিশকে তার রুমে বন্ধী করে নিজের রুমে ফিরে আসে।রাগে সারা শরীরের রক্ত যেন টগবগ করছে।
এদিকে সেহেরিশের দৈর্য্যর সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে।তার জানা মতে বাইশ তারিখ তাদের ফিরে যেতে হবে বাবা মেয়ের কাছ আর আজ বিশ তারিখ।সে কি কোন দিন বের হতে পারবে না এই অভিশপ্ত বাড়ি থেক?
রাগের মাথায় হুঙ্কার দিয়ে কেঁদে উঠে সেহেরিশ।রাগ সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দুহাতের প্রহারে ভেঙ্গে ফেলে।হাতের কাছে কাঁচের যা পেয়েছে ইচ্ছে মতো গুড়িয়ে দিয়েছে।তার কান্ডে স্তম্ভিত হয়ে যায় আফীফ।দ্রুত দরজা খুলে সেহেরিশের রুমে ডুকতেই চমকে যায়।সেহেরিশের দু হাতেই অনর্গল রক্ত ঝরছে।আর সেই হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ খিঁচে রেখেছে সেহেরিশ।
– অসভ্য মেয়ে কি করেছো তুমি?
আফীফের ধমকে কান দিলো না সেহেরিশ।বরং এই মূহুর্তে নিজের জীবন বাচাঁনো দায় হয়ে গেছে।
– আমার রক্তে ভয় লাগে আমার রক্ত সহ্য হয়না।আমার বুমি পায় দ্রুত কিছু একটা করুন। আমার অস্বস্তি লাগছে।
আফীফ দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসে কিন্তু ততক্ষণে সেহেরিশ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে।তার দিকে তাকিয়ে আফীফের চলন শক্তি থেমে যায় ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্ত করে দ্রুত সেহেরিশকে কোলে তুলে নেয়।হাত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেধে দিয়ে চুপচাপ কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের মুখ পানে।
সেহেরিশের নিঃসার মুখের দিকে তাকিয়ে একরাশ মায়ায় গেঁথে গেলো আফীফ।নিজের হাতে লেগে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠলো তার।নিজের অজান্তেই বার বার কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটি।কিন্তু আফীফ তো স্বার্থপর সে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝেনা।বর্তমানে তার স্বার্থের মাঝে “তাকিয়া” নামটাও যোগ হলো।
আফীফ সেহেরিশের মাথায় হাত বুলাতে থাকে পরম যত্নে।কিছু সময় পর কপালে গাঢ়ত্ব চুমু খায়।ব্যান্ডেজ মুড়ানো হাতটায় ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়।দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে আলমারি থেকে একজোড়া নুপুর বের করে পরম যত্নে পরিয়ে দেয়।
– ব্যস এবার যেদিকেই যাও তোমার নুপুরের রিনঝিন শব্দে আমি বার বার জেগে উঠবো।
সেহেরিশের পা জোড়া আকড়ে ধরে আফীফ তার ঠোঁট ছোয়ালো।নিঃশব্দে সেহেরিশের পাশে বসে ফিসফিস করে শুধালো,
– সে রমণী তুমি?যে রমণীর পৃথিবী জুড়ে থাকবো শুধুই আমি!
আফীফ সেহেরিশের পাশে মাথা গুজে তাকিয়ে থাকে তার দিকে ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে দুচোখে ঘুম ভর না করে।
পরের দিন সকালে আফীফ সেহেরিশকে পারভিনের কাছে আমানতে রেখে আনন্তপুর গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হয়।বাড়ির প্রত্যাকটা দৌবারিক’কে কঠিন পাহারায় লাগানো হয়।সেহেরিশ যেন কিছুতেই বাড়ি থেকে না বেরুতে পারে।এদিকে পারভিন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কখন ঠিক বাড়ির সবাই বেরিয়ে যাবে আর পারভিন সেহেরিশকে পালাতে সাহায্য করবে।
-তাকিয়া!
– আমি কখন বাড়ি থেকে বের হবো আন্টি?দুপুর হয়ে এসেছে।
– দ্রুত শার্ট প্যান্ট গুলো পরে নে দেখি।
মেয়েটি দুই হাতে আকঁড়ে ধরে শার্ট আর প্যান্ট।তাজ্জব বনে অবাক সুরে বলে,
– আজব আমি এইসব পরবো কেন?আর এগুলো কার?
– যা বলেছি তাই কর আর এত প্রশ্ন করছিস কেন?তুই শার্ট আর প্যান্ট পরে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি।প্রত্যাকটা দারোয়ানের চায়ের সাথে আমি ঘুমের ঔষুধ মিশিয়ে দিয়েছি তারা এতক্ষণে ঘুমে বেহুশ।
– আর কুকুর গুলো?
– তাদের ব্যবস্তা করা আছে।তুই সোজা পশ্চিম দিকে নদীর পাড়ে যাবি যেখানে আফীফের সাথে তোর দেখা হয়েছে।মারুফা আপা সেখানেই দাড়িয়ে আছে।
– কী? খালামনি এসেছে আমাকে নিতে?
– হ্যা আর প্রশ্ন নয় দ্রুত বেরিয়ে যা।যতক্ষণ পর্যন্ত শহরের রাস্তায় না উঠবি তোদের বিপদ কাটবে না।তাই দেরি করিস না।
পারভিনের কথা মতো সেহেরিশ সব কাজ শেষ করে খুব সহজেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।বাড়ির গেট থেকে বের হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আবারো দেওয়ান মঞ্জিলের দিকে
– তোমাদের সাথে আর আমার দেখা হবে না।তোমরা ভীষণ পঁচা।আফীফ তোর সাথে আর জীবনেও দেখা করবো না। তোর কোন স্মৃতি আমার কাছে রাখবো না।তোকে মনেও রাখবো না।ভুলে যাবো আমি সব ভুলে যাবো, আলবেদা!
সেহেরিশ যাওয়ার সময় থুথু ছুড়ে দ্রুত দৌড়ে চলে যায়।এদিকে বোকা সেহেরিশ যানেও না তার পায়ে আফীফের দুটি নুপুর খুলে রাখলেও একটি নুপুর তার প্যান্টের পকেটে রয়ে যায়।
কেননা পারভিন তার হাতের কাছে নুপুরটি পেয়ে তাকিয়ার ভেবে পকেটে রেখে দেয়।স্মৃতি জড়িয়ে সেহেরিশ আবারো ছুটছে দূর দিগন্তে।
কিছু স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়!আবার সেই স্মৃতি আগলে রাখারো নয়।তবুও সেই স্মৃতির গুলো হুট হাট কল্পনায় আসে।শুধু পূরনো দিনের কথা ভেবে ব্যাথা দিতে।ভালো রাখতে নয়!
——-
পশ্চিম গগনে সূর্যের অস্ত গেলে আফীফ ফিরে আসে তার বাসগৃহে।সারাদিন দখন সামলে উঠতে ক্লান্ত সে।রান্না ঘরে পারভিনকে দেখে সেহেরিশ সম্পর্কে জানতে চাইলে পারভিন জানায় সেহেরিশ ঘরেই আছে।
তখনি পিছন থেকে ডেকে উঠলেন আহনাফ দেওয়ান,
– দাদুভাই কোথায় যাচ্ছিস গাড়ি থেকে মাল গুলো নামাতে বল।
– দাদাজান তাকিয়াকে দেখে আসি।মেয়েটা আবার কি কান্ড করেছে কে জানে!
আফীফ দ্রুত নিজের রুম ডিঙিয়ে সেহেরিশের রুমে যায়।পুরো রুম জুড়ে তাকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে যায়।হঠাৎ মেঝেতে একটা নুপুর দেখতে পেয়ে সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে।বাড়ির সকল দারোয়ান, কাজের লোকদের ডেকে সেহেরিশকে খুজতে পাঠিয়ে দেয়।প্রায় বিশ মিনিট পর একজন দারোয়ান ফিরে আসে বাড়ির পিছনে সেহেরিশের জামা নিয়ে আফীফের বুঝতে বাকি নেই কেউ ইচ্ছে করে সেহেরিশকে পালাতে সাহায্য করেছে।
আফীফের নিরব স্তম্ভিত মুখ দেখে আহনাফ দেওয়ান মাথায় হাত রেখে বসে যান তিনি এখন ভালো করেই যানেন ধ্বংস লীলার পূর্ব পরিস্থিতি এটা।চোখের পলকেই এক দৌড়ে আফীফ নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে তান্ডব শুরু করে দেয়।এই তান্ডব ঠিক কবে থামবে কেউ যানেনা।বাড়ির সকলেই দরজায় কতাঘাত করলেও আফীফ তার রাগ মেটাতে ব্যস্ত।
#চলবে…..
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৫
সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়ে শুরু হলো আরেকটি দিন।আড়মোড়া ভেঙ্গে সেহেরিশ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে তার বারান্দার ছাদ বাগানের দিকে যায়।ফুল গাছ গুলোতে পানি দিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখা হয় তার ফুফু মারুফার সাথে।
– ফুফি দেখো দেখো আমার সব ফুল গাছে আজ ফুল ফুটেছে।ইয়েয়য়য় আজ পার্টি হবে পার্টি।
– আজব! সেহেরিশ তোর পাগলামী গুলো এখনো গেলো না।ফুল ফুটেছে বলে তুই পার্টি দিবি।যাই হোক ভাইজান আর ভাবী তোর অপেক্ষায় বসে আছে নিচে চল।
– আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ফুফি।তুমি যাও।
মারুফা রুম থেকে চলে গেলে সেহেরিশ ফ্রেশ হওয়ার জন্য ড্রেস নিতে আলমারি খুলে।ভার্সিটিতে যাওয়াত উদ্দেশ্য তাকের শেষ সীমানা থেকে একটি কুর্তি টেনে বের করতেই তার পায়ের কাছে ঝনঝন শব্দ করে একটি নুপুর গড়িয়ে পড়ে।
সেহেরিশ দু পা পিছিয়ে গিয়ে মেঝেতে তাকাতেই সেই নুপুরটি চোখে পড়ে।সঙ্গে সঙ্গে শান্ত মেজাজের সেহেরিশের রাগ তড়াক করে বেড়ে যায়।মেঝে থেকে নুপুরটি হাতে তুলে একমনে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।না চাইতেও বার বার কেন মনে পড়ে যায় আফীফ দেওয়ানের কথা!
– আমি তোকে ঘৃণা করি আফীফ।তবুও তুই আমার মন থেকে কেন যাচ্ছিস না।তোর আর আমার দূরত্ব হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে তবুও কেন ভুলিনি তোকে।
সেহেরিশ হাতের নুপুরটা আবারো ছুড়ে মারে আলমারিতে।ড্রেসটা হাতে তুলে ওয়াশরুমে ডুকে বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে সেহেরিশের বেহায়া মন আনমনেই ভাবতে থাকে আবারো আফীফের কথা।
সেদিনের পর কেটে গেছে আট বছর!দূরত্ব বেড়েছে সমান তালে সেহেরিশের বর্তমান অবস্থান ইতালির বলুনিয়া শহরে।সেদিন ফুফু মারুফার হাতে হাত রেখে চন্দনপুর গ্রাম ছেড়েছিল সেহেরিশ।তারপর শহর থেকে সোজা ইতালি।এর মাঝে আর কোন খোঁজ পায়নি চন্দনপুরের, পায়নি আফীফের।তার বন্ধি দশা জীবনের ঘটে যাওয়া দশটি দিনের কথা জানে না তার মা বাবা।শুধু মাত্র ফুফি মারুফা ছাড়া।এই আটটি বছর একটি মূহুর্তের জন্য সেহেরিশ তার অতীতের কথা ভুলে গেলেও হুট হাট আবারো মনে পড়ে যায় আফীফ নামের কোন এক রাগী ছেলের কথা।যে কী না নিজের স্বার্থকে মূল্যায়ন করতো।
—–
ফ্রেশ হয়ে সেহেরিশ নিচে নামতেই সবাই একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে।সেহেরিশের বাবা খুরশীদ আনোয়ার তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– গুড মর্নিং মামনি।
– গুড মর্নিং পাপা।
– তোমার এক্সাম কবে শেষ হবে?
– এইতো আর মাত্র দুটো দিন আছে তার পরেই আমি ফ্রি।এবার কিন্তু আমরা লং ট্যুরে যাবো পাপা।ফ্যামিলি ইউথ ফ্রেন্ড’স।
-ওকে। আগে তোমার এক্সামটা শেষ করো।
সেহেরিশ খাওয়া দাওয়া সেরে বাসা থেকে বের হতেই তার মা ফাহমিদা তাকে পেছন থেকে ডেকে উঠে।
– সেহেরিশ শোন..
– বলো মাম্মী
– তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
– সারপ্রাইজ?
– ইয়াহ।এবার এক্সাম দিতে যাও।পরে কথা হবে।
সেহেরিশ দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।তার জন্য রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছে তার বন্ধু কেইন।কেইন একজন খ্রিস্টান ধর্মের ছেলে।তার সাথে সেহেরিশের বন্ধুত্ব প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকেই।
– হেই কেইন হোয়াটস’আপ?
– ফাইন।ইউ?
– অল সো গুড।কেইন তোমার জন্য একটা ভালো নিউজ আছে।ইভেন তোমার না আমর ফ্রেন্ড সার্কেল সকলের জন্য।
– কি সেই নিউস সেহেরিশ?
– আমরা সকলে মিলে ট্যুরে যাবো কেইন।সাথে তোমারাও।
– ওয়াও ইট’স আল সো গুড নিউজ।
– ইয়াহ।
সেহেরিশ অনন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যায়।এদিকে কেইন সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে একমনে।পকেট থেকে একটি ফুল বের করে আবারো ছুটে আসে সেহেরিশের কাছে।
– হেই সেহেরিশ স্টপ!
কেইনের কথায় সেহেরিশ দাঁড়িয়ে যায়।তখনি কেইন হাতে থাকা সাদা ফুলটি নিয়ে সেহেরিশের কানে গুজে দেয়।কেইন তার দুহাতে সেহেরিশের মুখদ্বয় আবব্ধ করে আবেগী সুরে বলে,
– সেহেরিশ ইউ আর সো ফ্লাফি।
– থাংকু মাই কিউটি ফ্রেন্ড।
সেহেরিশের মজার কথায় হেসে দেয় কেইন।দুজনেই আবার তাদের গন্তব্যের যাত্রা শুরু করে।
প্রায় দু-বছর আগে থেকেই কেইন সেহেরিশের প্রতি দূর্বল কিন্তু বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে “ভালোবাসি” নামক শব্দটি ভুলেও মুখ থেকে বের করে নি সে।
—–
একজন রমণীর হাজার’টা ছবি দিয়ে একটি দেয়াল সুসজ্জিত করে রেখেছেন একজন যুবক।
গুটিয়ে রাখা শার্টের হাত পকেটে ঢুকিয়ে
সেই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন আরক্ত দৃষ্টিতে।ক্ষণিকেই চোখ বন্ধ করে গাঢ় করে নিশ্বাস ছাড়েন।দু-ঠোঁট চেপে ধরে আবারো চোখ খুললেন। ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি অভিপ্রায় হাসেন।
তৎক্ষণাৎ তার কানে আসে বাড়ির কোলাহল। দ্রুত পর্দা সরিয়ে সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নির্মিত হলে আবারো ঘুরে তাকায় সেই দেয়ালের দিকে ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি রেখা টেনে দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।
দু কদম এগিয়ে যেতেই সামনে তার দাদাজানের চনমনে অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে যান।
– দাদাজান এত শোরগোল কিসের?
– তোমার দাদীমা আবার অসুস্থ হয়ে গেছে আফীফ!এইভাবে আর কত দিন শুধুমাত্র তোমার উদ্দেশ্য পূরণে আমার ছেলে, ছেলের বউ’কে দেশের বাইরে থাকতে হচ্ছে।তোমার দাদীমা যে দু-চোখে দেখে যেতে চায় তাদের। শেষ কবে সামনা সামনি দেখা হয়েছে তাদের মনে আছে তোমার?
আফীফ গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লেন।নিজেকে ধাতস্ত করে দাদাজানের দিকে নিরুদ্যম চোখে তাকালেন।তার দাদাজান আহনাফ ভয়ার্ত কন্ঠে আক্ষেপ সুরে বলেন,
– ছোট্ট মেয়েটাকে মাফ করে দিলে হয়না আফীফ?বাচ্চা মেয়ে ভুল করেছিল সেই ভুলের শাস্তি, শোধ কি তুমি এই প্রাপ্ত বয়সে তুলবে?
– কে বলেছে আমি প্রতিশোধ নেবো।আফীফের শাস্তি অন্তত ভয়ানক! আর আফীফ কখনো তার হৃদয়বতী’কে শাস্তি দেয় না বরং অন্তরিন ভাবে ভালোবেসে যায়।এত সব আয়োজন মোটেও তার বিষাক্ত শাস্তির নয়! তবে হ্যা অন্যরকম শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করছে।তার শাস্তিটা হবে অন্তত সুমিষ্ট।
আফীফ তার গমগম সুরের বাক্য শেষ করেই বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
কিন্তু বৃদ্ধ আহনাফ ঘামছে, কি চলছে এই ছেলের মাথায় এত বছর ধরে?এই ছেলের কান্ডকীর্তিতে বাধা দেওয়ার সাধ্যে কারো নেই। সে যে অন্তত ভয়ানক একজন সুপুরুষ!
আফীফ দ্রুত তার দাদীজানের কক্ষে প্রবেশ করে।অচেতন ফাতেমার মুখটা দেখে তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠে।দাদীজানকে তো সে ভালোবাসে।আর ভালোবাসার মানুষ গুলোর কষ্ট আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা।আবারো রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের উদ্দেশ্য রওনা হয়।যাওয়ার আগে হাত দিয়ে ইশারা করে মুনিফকে ছাদের দিকে যেতে বলে।
মুনিফ আফীফের একমাত্র ফুফুর ছেলে।গত কয়েক বছর তারা সবাই এই বাড়িতেই আছে।মুনিফ আর আফীফ সমান বয়সের তাদের বন্ধুত্বের অবস্থাটাও বেশ দৃঢ়।
– মুনিফ দাদীজানের জন্য একজন নার্সের ব্যবস্থা কর।বাড়িতে থেকেই সেই নার্স দাদীজানের সেবা করবে।
– কিন্তু নানীজান মামা মামীকে দেখতে চেয়েছে আফীফ।তাদের দেশে আসতে বল।এভাবে আর কতদিন চলবে?
– উতলা হচ্ছিস কেন তোরা?আমি যদি আমার প্রাণ পাখির জন্য দেখা হীন কথা হীন দৈর্য্যর সাথে থাকতে পারি তবে তোদের এত সমস্যা কিসের?চাচাজন,চাচিআম্মার সাথে তো সবার ভিডিও কলে কথা হচ্ছেই।আর দাদীজানের এইসব মনের ভুল একটু অসুস্থ হলেই মরে যাবো মরে যাবো যতসব জাস্ট বিরক্তকর।তিনি একবার ভাবেন না আমরা তার কথায় কতটা কষ্ট পাই।
– আচ্ছা বাদ দে।তোর তাকিয়ার খবর কী?
– উহুহ সে তাকিয়া নয় সে তো এখন সেহেরিশ!
– যাই হোক। কী খবর তার?
– সে তো মুক্ত আকাশে উড়ছে।উড়তে থাকুক।পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।
কথাটি শেষ করেই গাঢ় করে শ্বাস ছাড়ে আফীফ।তার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে মুনিফ বলে,
– এত কিপটামি করছিস কেন আফীফ?আমি তোকে কতবার বলেছি সেহেরিশকে আমায় একটু দেখা কি এমন মেয়ে যার জন্য আফীফ দেওয়ান, দেওয়ানা হয়ে গেছে।
মুনিফের কথায় বাকা হাসে আফীফ।
– আফীফের পছন্দের জিনিসের দিকে তাকাস না। ভুলেও না,তাহলে চোখ দিয়ে আর তোর এই সুন্দর পৃথিবী দেখা হবে না। সো বি কেয়ারফুল।
গত আট বছরে পাল্টে গেছে আফীফের জীবন।সেদিন রাগ দেখিয়ে দরজা বন্ধ করলে শত চেষ্টার পরেও আফীফ দরজা খুলেনি।কোন উপায়ন্তর না পেয়ে আহনাফ দেওয়ান দরজা ভাঙলে আরো উগ্র হয়ে যায় আফীফ।একে একে পুরো বাড়িতে তান্ডব চালায়।তার হিংস্রতা ঠিক দু-মাসেও কমে নি।চাপা রাগ থেকে থেকে এখনো মনের ভেতর জ্বলে উঠছে।
মুনিফ চলে গেলে আফীফ মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায় নি সেহেরিশ বরং উদ্দীপ্ত হয়ে আরো বাড়ছে।তাকে পাওয়ার তৃষ্ণা জাগছে মনে।
– তাকিয়া আনওয়ার সেহেরিশ!নিজেকে খুব চালাক ভাবো?অবশ্য আমিও মানি তুমি চালাক।খুব চালাক।তবে আমার থেকেও নয়।তুমি কী ভেবেছো আট বছর আগের কাহিনি আট বছর আগেই শেষ?উহু’হ ভুল।সেই আট বছর আগের কাহিনি এখনো চলছে তোমার অন্তরালে।আশা করি খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে নতুন আঙ্গিকে নতুন পরিচয়ে।
#চলবে….