অন্তহীন বসন্ত পর্ব-০৩

0
253

#অন্তহীন_বসন্ত~৩
লিখা- Sidratul Muntaz

অবন্তী মাথায় একটি ওরনা হিজাবের মতো বেঁধে বের হলো। তাকে দেখে নিশান্ত ক্ষণে ক্ষণেই মুখ টিপে হাসতে লাগল। অবন্তী রাগী চোখে তাকাচ্ছে। এমনিতেও নিশান্ত সারাক্ষণ তাকে টিজ করে। টাক্কু মাথার ব্যাপারটি জানার পর থেকে আরও বেশি বেশি টিজ করছে সে। তারা ড্রয়িংরুমে খেলছিল। নিশান্ত ঘুরে-ফিরে শুধু অবন্তীর চুলের ব্যাপারেই কথা বলছে। আর গা জ্বালানো ভঙ্গিতে হাসছে। অবন্তী অত্যন্ত বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” প্লিজ নিশান্ত, তুমি আমাদের বাসা থেকে চলে যাও।”

” একটু পর তো এমনিই চলে যাবো।”

” হ্যাঁ জানি। এখন আপাতত আমার সামনে থেকে যাও। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই না। তুমি আমাকে খুব জ্বালাতন করো।”

নিশান্ত চুপ করে রইল। অবন্তী তাকিয়ে বলল,” আমাকে কোনো রকম জ্বালাতন না করে যদি খেলতে পারো, তাহলে আমরা চোর-পুলিশ খেলব৷ ”

নিশান্ত হাসি দমিয়ে রেখে বলল,” তুমি কি হবে? চোর না পুলিশ? আমি কখনও টাক্কু পুলিশ দেখিনি।”

অবন্তী চোখ-মুখ লাল করে উঠে দাঁড়াল,” আবার?”

নিশান্ত ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। অবন্তী হাত-জোড় করে বলল,” ক্ষমা চাই। আমি তোমার সাথে খেলব না। এখান থেকে চলে যাও।”

নিশান্ত পা এগিয়ে দিয়ে বলল,” আমার পায়ে ধরে বলো, এক্ষুণি চলে যাচ্ছি।”

অবন্তী সত্যি সত্যি পায়ে ধরল। নিশান্ত অবাক। সে ভাবেনি অবন্তী আসলেই পায়ে ধরবে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে ঘরে চলে গেল। ঠিক তার নানুর পাশে গিয়ে ভদ্র ছেলের মতো বসে রইল। আশ্চর্যের বিষয়, এরপর সে আর একবারও অবন্তীকে বিরক্ত করতে এলো না। চলে যাওয়ার সময় নিশান্তর খুব বলতে ইচ্ছে হলো,” আমাদের সাথে চলো অবন্তী। আজ আমার জন্মদিন।”
কিন্তু লজ্জায় সে বলতে পারল না। গাড়িতে ওঠার পরেও তার মনে হতে লাগল হুট করে বলতে,” গাড়ি থামাও। আমি অবন্তীকেও সাথে নিতে চাই।” নিশান্ত বলতে পারল না। কেউ তার কথা শুনবে বলেও মনে হয় না।

_________
নিশান্তর ষোলতম জন্মদিনে অবন্তীরা এলো। কারণ এবার নিশান্তর জন্মদিন তার নানুবাড়িতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঈদের পরের দিনই জন্মদিন। অবন্তীরা এসেছিল ঈদের দাওয়াতে৷ আসার পর শুনল জন্মদিনের অনুষ্ঠান আছে। তারা থেকে গেল। এখন অবশ্য অবন্তী আর নিশান্তের খুব ভালো বন্ধুত্ব। দশ বছর বয়স্কা অবন্তীকে ছোটবেলার মতো বিরক্ত করা যায় না। বরং সে নিজেই নিশান্তকে নানাভাবে জ্বালাতন করে। নিশান্তের পছন্দের জিনিস নিয়ে লুকিয়ে রাখে। নিশান্ত ভাণ করে খুব বিরক্ত হচ্ছে, কিন্তু সত্যি বলতে তার ভালোই লাগে। অবন্তী যেন প্রতিশোধ নেয়। নিশান্তর ছোটবেলার খেলনার অভাব নেই। সবচেয়ে প্রিয় তার বানর। অবন্তী সারাদিন ধরে বানরটি লুকিয়ে রাখল। একপর্যায় নিশান্ত অধৈর্য্য হয়েই বলল,” কোথায় রেখেছো? দাও।”

অবন্তী অবাক হওয়ার ভং ধরে বলল,” কি কোথায় রেখেছি?”

” তুমি খুব ভালো করেই জানো যে আমি কিসের কথা বলছি।”

” নাতো, আমি কিছু জানি না।”

” অবন্তী, তুমি এইরকম কেন করছো? আমার সাথে তোমার প্রবলেমটা কি?”

” কোনো প্রবলেম নেই। তুমি নিজেই উল্টা-পাল্টা ভাবছো নিশান্ত।”

কিছুক্ষণ পর নিশান্তর বন্ধুরা চলে এলো। সারাদিন নিশান্ত অবন্তীর সাথেই ছিল। যদিও তারা কখনও একসাথে আড্ডা দেয়না৷ তাদের মধ্যে যা চলে তা হলো ঝগড়া আর কথা কাটাকাটি। মাঝে মাঝে নীরব সংঘাত। এই যেমন.. সবাই একসাথে আড্ডা দেওয়ার সময় নিশান্ত অবন্তীকে খুঁচিয়ে কথা বলে। আজ বন্ধুরা আসতেই নিশান্ত তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বিকালে তারা ছাদে একটা মজার খেলা খেলতে বসল। পলি অনেকগুলো টোকেন বানালো। সবাইকে একটা করে টোকেন তুলতে হবে। যার ভাগ্যে যেটা আসবে তাকে সেটাই করে দেখাতে হবে৷ প্রথমেই টোকেন তুললো অবন্তী। সেখানে লেখা ছিল,” হাসি।” অর্থাৎ অবন্তীকে এমন কিছু করতে হবে যাতে সবাই হাসে। না পারলে তার পয়েন্ট কাটা যাবে। অবন্তী একটা মজার কৌতুক বলল। স্কুলেও সে এই কৌতুকটি অনেকবার বলেছে। সকলে অবন্তীর কৌতুক শুনে হেসে উঠল। হাসল না কেবল নিশান্ত। চোখে-মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে বলল,” আমি এর আগে কখনও এতো বাজে জোকস শুনিনি।”

অবন্তী কটমট স্বরে বলল,” আমার জোকস বাজে? তাহলে সবাই হাসল কেন?”

নিশান্ত গম্ভীর মুখে বলল,” জোক্স শুনে কেউ হাসেনি। সবাই হেসেছে তোমার ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন দেখে।”

অবন্তী গরম চোখে তাকাল,” তুমি বলতে চাও আমার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন জোকারের মতো? ”

পলি পরিস্থিতি সামলাতে উদ্যত হলো,” আচ্ছা,আচ্ছা, বাদ দাও। এখানে ঝগড়াঝাঁটির কিছু নেই। এবার নিশান্তর টার্ণ। একটা টোকেন নে নিশু।”

নিশান্ত টোকেন তুলে দেখল তাতে লেখা,” গান।”

সবাই হৈ-হৈ করে উঠল। নিশান্ত সঙ্গে সঙ্গে কাগজটি ফেলে জড়োসড়ো হয়ে বলল,” অসম্ভব। আমি গান-টান গাইতে পারব না।”

অবন্তী হাসতে হাসতে বলল,” সেই ভালো। এমনিতেও এখানে কেউ কাকের গর্জন শুনতে চায় না।”

নিশান্ত রক্তাভ দৃষ্টিতে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,” আমি গান গাইবো।”

অবন্তী ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল। নিশান্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” কিন্তু অবন্তীকে এইখান থেকে যেতে হবে। আমি ওর সামনে গান গাইবো না।”

সবার চেহারা থমথমে হয়ে গেল। সানজিদা বলল,” ধূর, এটা ঠিক না৷ ও ছোট মানুষ, তুই ওর উপর রাগ করছিস কেন?”

” রাগ না। কিন্তু যে আমার গলাকে কাকের গর্জন বলে তার সামনে আমি গান গাইবো না। ইম্পসিবল।”

অবন্তী বলল,” ইটস ওকে। তোমার এতোই অসুবিধা হলে আমি চলে যাচ্ছি।”

ইশিতা অবন্তীর হাত ধরে বলল,” কেন চলে যাবে? বসো প্লিজ। আচ্ছা এই রাউন্ড বাদ। শান্ত ভাইয়া, তুমি আরেকটা টোকেন তোলো।”

সবাই ইশিতার কথায় সম্মত হলো। কিন্তু নিশান্ত দৃঢ়স্বরে বলল,” না। আমি গানই গাইবো। নাহলে আমি আর এই গেইম খেলব না।”

সবার মুখ থমথম করছে। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। সানজিদা আর পলি সম্পর্কে নিশান্তর খালা। অর্থাৎ নিশান্তর মায়ের কাজিন। কিন্তু বয়সে তারা নিশান্তর সমবয়সী। অনেকটা বন্ধুর মতো। তারা হেসে নিশান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু নিশান্ত সহজ হলো না। অবন্তী বলল,” আচ্ছা বাবা, আমি চলে যাচ্ছি। এমনিতেও আমার মনে হয় মা আমাকে খুঁজছে।”

অবন্তী দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এলো। তার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিল। লিভিংরুমে কেউ ছিল না। অবন্তী এসে বসতেই হেলেন ডাকল,” এই অবন্তী, এদিকে আয়।”

অবন্তী এগিয়ে গেল,” খালামণি, বলো।”

” কাঁদছিস কেন? তোর কি হয়েছে?”

অবন্তী জবাব দিল না। হেলেনও এই বিষয়ে আর প্রশ্ন করল না। বাচ্চা মানুষের কান্নার হাজারটা কারণ থাকতে পারে। আর অবন্তী এমনিতেও একটু ছিচকাঁদুনে।

” ভেতরে আয়। তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে।”

আজরাতের পার্টিতে পরার জন্য হেলেন অবন্তীর জন্য অত্যন্ত সুন্দর একটা সাদা গাউন কিনেছিল। সেটিই অবন্তীকে দেখালো।

” পছন্দ হয়েছে?”

অবন্তী মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,” ওয়াও, এতো সুন্দর! আমার কেন পছন্দ হবে না? খুবই পছন্দ হয়েছে।”

” অনেক দামী গাউন কিন্তু এটা। যত্ন করে রাখবি। আজকের পার্টিতে সবাই সুন্দর সুন্দর জামা পরে ঘুরবে আর তুই আমার বোনজি হয়ে তিনশো টাকার ফ্রক পরে ঘুরবি এটা আমার ভালো লাগবে না। এজন্যই কিনেছি। যা, এখন চেঞ্জ করে আয়।”

গাউনটি পরার পর অবন্তী নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিল না। তার বয়স দশ বছর৷ কিন্তু তাকে দেখাচ্ছে তেরো-চৌদ্দ বছরের ফুটফুটে কিশোরীর মতো। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় পলি অবন্তীকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। দুইপাশে ঝুঁটি করে চুল বেঁধে দিল৷ যে তাকে দেখছে, সে-ই বলছে, ‘ আরে অবন্তী, তোমাকে তো ফ্যান্টাস্টিক লাগছে!’ অবন্তীর খুব লজ্জা করছিল। যে রেস্টুরেন্টে জন্মদিনের অনুষ্ঠান হবে সেখানে যাওয়ার জন্য মাইক্রো ভাড়া হয়েছে। সবাই মাইক্রোতে উঠে গেল। শেষ মুহূর্তে পলির মনে হলো, তার জামাটা ভালো লাগছে না। সে জামা বদলে অন্যটা পরল। অবন্তীও তার সঙ্গে অপেক্ষা করছিল। কাজেই বের হতে দেরি হয়ে গেল। সদরে সানভী দাঁড়িয়ে ছিল। অবন্তী আর পলিকে ছুটে আসতে দেখে সে হাস্যমুখে বলল,” পলি, তোমার জন্য রিকশা ওয়েট করছে। তুমি, সানজিদা আর নিয়ন রিকশায় যাবে।”

অবন্তী অসহায় কণ্ঠে বলল,” তাহলে আমি?”

” তোমার আম্মু তো গাড়িতে উঠে গেছে তোমার খালার সাথে।”

অবন্তী খুব অবাক হলো। মা তাকে না নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়বে এই কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। পলি বলল,” অবন্তী তুমি তাহলে আমাদের সাথে চলো।”

সানভী বাঁধা দিয়ে বলল,” আরে না, না, এক রিকশায় এতোজন কিভাবে যাবে? পরে একটা এক্সিডেন্ট ঘটবে।”

পলি হাসিমুখে বলল,” কিছু হবে না ছোটভাইয়া। অবন্তী না হয় আমার কোলে বসবে।”

” তুই নিজেকেই তো সামলাতে পারিস না। আবার অবন্তীকে কি সামলাবি? অবন্তী, তুমি আমার সাথে চলো।”

অবন্তী বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো কেঁপে উঠে বলল,” না। আমি যাবো না।”

পলি বলল,” কেন অবন্তী? চলে যাও ভাইয়ার সাথে। নাকি ভাইয়াকে ভয় পাচ্ছো? ভয়ের কিছু নেই। ভাইয়া খুব ভালো।”

অবন্তী কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে সে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে। পলি তার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করল না। সানজিদারা রিকশা থামিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকে ডাকছিল। পলি দ্রুত চলে গেল। সানভী অবন্তীর হাত ধরে বলল,” চলো আমরা যাই।”

” আমি আপনার সাথে যাবো না। আমি ঘরে থাকব।”

এই কথা বলে অবন্তী দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, সানভীও তার সঙ্গে ঢুকছে। পুরো বাড়িতে শুধু সে আর সানভী এই কথা ভেবেই অবন্তীর গা কাটা দিল। তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মা তাকে না নিয়ে কিভাবে গাড়িতে চলে গেল? অথচ অবন্তীর মাকে বলা হয়েছিল অবন্তী সামনের গাড়িতে নিশান্তর সাথে বসেছে। নিশান্তর সাথে যে অবন্তীর ঝগড়া হয়ে আছে এই কথা বড়রা কেউ জানে না।সানভী অবন্তীর কাঁধে হাত রেখে বলল,” মামণি, চলো।”

অবন্তী ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে বলল,” আমি যাবো না।”

সানভী আরাম করে সোফায় গা এলিয়ে বলল,” ঠিকাছে। তাহলে আমিও যাবো না।”

অবন্তীর মনে হচ্ছে, এটি তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক সময়। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল,” আমাকে বাঁচাও, কেউ বাঁচাও। ”

সানভী অবন্তীর গাঁ ঘেঁষে বসল। সেদিনের মতো আবার আদর করার ছলে অবন্তীর বুকে হাত রাখতেই অবন্তী শব্দ করে কেঁদে উঠল৷

চলবে