অন্তহীন বসন্ত পর্ব-০৫

0
210

#অন্তহীন_বসন্ত~৫
লিখা- Sidratul Muntaz

বিলকিস একমাত্র মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে জানা গেছে অবন্তী আসলে নিশান্তদের গাড়িতে ছিল না। এই খবর শোনা মাত্রই অস্থিরতা শুরু হলো বিলকিসের। এইখানে আসার পর থেকে মেয়েটা তার একটা কথাও শোনেনি। সারাক্ষণ নিজের মতো ঘোরাঘুরি করছে; নিজের মর্জিমতো চলছে। এই বয়সেই এই অবস্থা। আরও বড় হলে কি করবে এই মেয়ে? আজ তাকে কঠিন শাসন করতে হবে। জাকির ভাই এসে জানাল,” বিলকিস আপা, চিন্তা করবেন না। রিমারা গাড়ি ঘুরিয়ে আবার বাসায় গেছিল। ওইখানে অবন্তীকে পাওয়া গেছে। এখন অবন্তীকে নিয়ে ওরা আসছে।”

এই কথা শুনে বিলকিস কিছুটা স্বস্তি পেলেও তার মেজাজ ঠান্ডা হলো না। একা বাড়িতে অবন্তী কি করছিল? যদি কোনো অঘটন ঘটতো? মেয়েটার খুব সাহস হয়েছে। তার সাহস ছোটাতে হবে।

রেস্টুরেন্টের প্রবেশ মুখেই বিলকিস কষে অবন্তীর গালে একটা চড় মা-রল। অবন্তীর চোখ টলমলে হয়ে গেল। নাকের ডগা ফুলে লাল। নিশান্ত এই দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে গেল। রিমা তাগাদা দিয়ে বলল,” ভেতরে চলো বাবা। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কিছু নেই।”

রিমা জোর করে ছেলেকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। বিলকিস অবন্তীর চুলের ঝুঁটি খামচে ধরে প্রশ্ন করল,” কোথায় ছিলি তুই? তোকে আবার গাড়ি ঘুরিয়ে আনতে হলো কেন? সবার সাথে গাড়িতে না উঠে তুই ঘরে কি করছিলি? এতো জ্বালাতনের মানে কি?”

অবন্তী সকলের সামনে কোনো জবাব দিতে পারল না। থমথমে মুখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। সানভী বলল,” আহা, বিলকিস আপা বাদ দিন না। ছোটমানুষ।”

সানভীর কণ্ঠ শুনে অবন্তী আঁড়চোখে তাকাল। তারপর দৌড়ে চলে গেল। পেছন থেকে বিলকিস ডাকল। অবন্তী শুনল না। মায়ের উপর তার অভিমান হয়েছে। এই ঘটনায় তার কোনো দোষ ছিল না। তবুও মা কেন তাকে বুঝল না!

কেক কাটার স্টেজ সাজানো হয়েছে কমলা, সাদা আর লাল বেলুন দিয়ে। টেবিলের মাঝখানে বিশাল বড় কেক। পুরোটাই কমলা রঙের। কে যেন বিস্ময় নিয়ে বলল,” ওয়াও, আমি কখনও জন্মদিনে কমলা রঙের কেক দেখিনি।”

পলি আলতো হেসে বলল,” নিশান্তর কমলা রঙ খুব পছন্দ। ” পলির কথাটি অবন্তীর মাথায় গেঁথে গেল। নিশান্তর কমলা রঙ পছন্দ! বাতাসে স্টেজ থেকে বেলুন খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে। অবন্তী শুধু কমলা বেলুনগুলো তুলে নিতে লাগল। সে ঠিক করেছে নিশান্তকে ষোলটি কমলা বেলুন উপহার দেবে। কারণ এটা নিশান্তর ষোলতম জন্মদিন। অবন্তী গুণে দেখল তার কাছে মোট চৌদ্দটা বেলুন। আরও দুইটা লাগে। ইশিতার হাতেও একটা কমলা বেলুন দেখা যাচ্ছে। অবন্তী বলল,” তোমার বেলুনটা আমাকে দেবে প্লিজ?”

” তুমি এতো বেলুন জমাচ্ছো কেন? কি করবে এগুলো দিয়ে?”

অবন্তী কাতর স্বরে বলল,” দাও না প্লিজ।”

ইশিতা বেলুন দিল। অবন্তী চিন্তিত কণ্ঠে বলল,” আরও একটা বেলুন লাগবে। ”

ইশিতা হাসতে হাসতে বলল,” আর বেলুন নাই৷ স্টেজ থেকে খুলে আনতে হবে এবার।”

” একটা এনে দিবে?”

” না বাবা, আমার ভয় লাগে। যদি কেউ বকা দেয়?”

অবন্তী নিজেই গেল বেলুন খুলতে। রিমা তাকে দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গেই ধমক দিয়ে বলল,” এই, এই, কি করছো? আরে! বেলুন খুলছো কেন?”

অবন্তী ভয় পেয়ে গেল। রিমা রাগী কণ্ঠে বলল,” এতোগুলো বেলুন কি তুমিই খুলেছো?”

অবন্তী দুইপাশে মাথা নাড়ল। মিনমিন করে বলল,” না। এগুলো এমনি খুলে গেছিল।”

” একটা থাপ্পড় দিবো আরেকবার মিথ্যা কথা বললে। রাখো সব বেলুন। এগুলো আবার লাগাতে হবে। রাখো বলছি! এখনও ছবি তোলা হলো না আর সে বেলুন খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য! ”

সবাই অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। ক্যামেরাম্যান পর্যন্ত ছবি তোলা বাদ দিয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে। বকা খেয়ে অবন্তীর চেহারা লজ্জায় লালবর্ণ ধারণ করল। রিমার মা বললেন,” থাক, বাচ্চামানুষ। এতো রাগারাগির কি আছে?” হেলেন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” অবন্তী, এখান থেকে যাও।”

অবন্তী মাথা নিচু করে চলে গেল। এই ঘটনা সে কিছুতেই ভুলতে পারল না৷ তার খুব কান্না পেতে লাগল। রিমা আন্টি কেন তাকে একদম পছন্দ করে না! তার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে নিশ্চয়ই এইভাবে বকা খেতো না। অবন্তী বলেই বকা খেয়েছে। কারণ তার বাবার টাকা-পয়সা নেই। তাকে ইচ্ছে করলেই যে কেউ বকতে পারে।

_________

অবন্তীর বাবা সিএনজি ভাড়া করে এনেছে। রাত প্রায় বারোটা বাজে। এতোরাতে বাসে ওঠার মানেই হয় না৷ তারা সিএনজি করে বাড়ি চলে যাবে। হেলেন একবার বলল,” হাকিম ভাই, আজরাতটা থেকে যান।”

অবন্তীর বাবা হাকিম হেসে বলল,” দরকার নেই। শুধু শুধু তোমরা ঝামেলায় পড়বে।”

অবন্তীরা চলে যাওয়ার সময় নিশান্ত ছুটে এলো।

” অবন্তী, দাঁড়াও।”

অবন্তী থামল। নিশান্তর হাতভর্তি বেলুন। সবকয়টি একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে অবন্তীর হাতে দিয়ে বলল,” এগুলো তোমার জন্য। ”

অবন্তী অবাক হয়ে গেল,” আমার জন্য?”

” হ্যাঁ। তুমি নাকি বেলুন খুলতে গিয়ে আম্মুর কাছে বকা খেয়েছো? আমাকে বললেই হতো। তোমার কি বেলুন খুব পছন্দ?”

অবন্তী অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। সে নিশান্তকে কিছুতেই বলতে পারল না, কমলা রঙের বেলুন সে নিশান্তকে উপহার দিতে চেয়েছিল। এছাড়া বেলুন খুলতে যাওয়ার অন্যকোনো কারণ নেই। পেছন থেকে জাকির আঙ্কেল ডাকছে,” নিশু, শুনে যা।”

” আসি অবন্তী। ভালো থেকো। বাই।”

অবন্তী বলল,” বাই।”

যাওয়ার আগে নিশান্ত ফিরে এসে আবার বলল,” তুমি কিন্তু আমাকে একবারও উইশ করোনি।”

অবন্তী মৃদু হেসে বলল,” হ্যাপি বার্থডে। এটা তোমার জন্য গিফট।”

সে একটা কমলা বেলুন বের করে নিশান্তকে দিল। নিশান্ত উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” আরে, অরেঞ্জ! আমার ফেভারিট কালার!”

“জানি।”

” কিভাবে জানো?”

” তোমার কেকের রঙ অরেঞ্জ ছিল। সেটা দেখেই মনে হলো।”

” তোমার তো দারুণ বুদ্ধি।” নিশান্ত বিস্মিত। অবন্তী আর বলল না যে সে পলির থেকে নিশান্তর প্রিয় রঙের ব্যাপারে জেনেছিল।

___________
বাড়ি ফিরে আজকের ভয়ংকর সন্ধ্যার ঘটনা অবন্তীর বার-বার মনে পড়ছিল। এতো অস্থির তার আগে কখনও লাগেনি। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে সানভীর নাম শুনলেও সে আঁতকে উঠছে। কিছুক্ষণ আগে অবন্তীর বাবা সানভীর ব্যাপারে কি যেন বলছিল। অবন্তী কেঁপে উঠল। বিলকিস মেয়ের পরিবর্তন লক্ষ্য করল। পরে নিজেই অবন্তীকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল৷ অবন্তী প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। কিন্তু পরে বলেছে। বিলকিস সবকিছু শুনে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ বসে রইল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,” এজন্য তোকে আমি মেরেছি। আমাকে ক্ষমা করে দে, মা।”

অবন্তী মায়ের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল। কিন্তু বিলকিস সারারাত একফোঁটা ঘুমাতে পারল না। তার ছোটবোন নাজনীনের সাথে সানভীর বিয়ের কথা চলছে। যে-কোনো সময় বিয়ে পাকাপাকি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এতোবড় একটা ঘটনার পরে এই বিয়ে অসম্ভব।

চলবে