অন্তহীন বসন্ত পর্ব-০৬

0
214

#অন্তহীন_বসন্ত~৬
লিখা- Sidratul Muntaz

সকালে অবন্তী ঘুম থেকে উঠে আবার শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে এমন একটা ভাণ ধরল যেন সে ঘুমিয়েই আছে। বিলকিস ফোনে কথা বলছে তার বোনের সাথে। সেই কথা স্পষ্ট কানে আসছে অবন্তীর। সে জেগে থেকে এই ধরণের কথা শুনতে চায় না। তাই ঘুমানোর ভং ধরে শুনছে। বিলকিস ভারী স্বরে বলল,” অবন্তীর থেকে শোনার পর আমারও বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু আমার মেয়ে তো আর মিথ্যা বলবে না। তুই চিন্তা কর, সানভী কতবড় হারামজা*দা হলে আমার ফেরেশতা বাচ্চাটার সাথে এমন করে! ওর বাবাকে তো আমি এখনও কিছু বলিনি। যদি এসব জানে তাহলে আমাকে মে-রেই ফেলবে।”

ওই পাশ থেকে অবন্তীর ছোটখালামণি কথা বলছে। সেই কথাও অবন্তী শুনতে পাচ্ছে। বিলকিসের মোবাইলের একটা সমস্যা হলো, লাউডস্পিকার ছাড়া কথা বলা যায় না। নাজনীন বলল,” ওকে নিয়ে আর হেলেনদের বাড়িতে যাস না। মেয়েটা বড় হচ্ছে। তোর আরও সতর্ক থাকা উচিৎ ছিল। তুই খেয়াল রাখলে এসব হতো না।”

বিলকিস আতঙ্ক নিয়ে বলল,” আরও বড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারতো। আল্লাহ রক্ষা করেছে। এখন থেকে আমি আমার মেয়েকে ভুলেও একা ছাড়ব না।”

নাজনীন সানভীর উদ্দেশ্যে একটা অকথ্য গালি দিয়ে বলল,”ওর মুখোশ সবার সামনে যদি টেনে না খুলতে পেরেছি তাহলে আমার নামও নাজনীন না।”

” বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই নাজনীন। পরে যদি আরও ঝামেলা হয়? শত হলেও ও হেলেনের দেবর। শুধু শুধু হেলেনের শ্বশুরবাড়িতে একটা অশান্তির সৃষ্টি হবে। তোকে কথাটা বললাম যেন তুই ওর থেকে সাবধানে থাকতে পারিস।”

নাজনীন একটু বিভ্রান্ত স্বরে বলল,” আচ্ছা আমি বুঝলাম না। সানভীর সাথে আমি কতবার আলাদা দেখা করেছি, কত জায়গায় ঘুরেছি, ও তো কখনও আমার সাথে অসভ্যতা করেনি।”

” তোর সাথে করার কথাও না। তুই হলি ওর হবু বউ। তোর কাছে তো ও ভালো সাজবেই।”

” ওর ভালোগিরি আমি ছোটাচ্ছি। তার আগে অবন্তীর সাথে আমার একটু কথা বলা দরকার। আমি জানতে চাই ও অবন্তীর সাথে কি করেছে?”

বিলকিস শীতল গলায় বলল,” দরকার নেই। অবন্তী এমনিই সারারাত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। ওকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করে আরও বিব্রত করার মানেই হয় না।”

” আমি শুধু ওকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। এগুলোর উত্তর আমার জানা জরুরী। তুই ওকে ফোনটা দে।”

বিলকিস অবন্তীর বিছানার পাশে এসে মৃদু স্বরে ডাকল,” অবন্তী, এই অবন্তী!”

অবন্তী হঠাৎ ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার নাটকটি খুব সুন্দরভাবে করল। হকচকানো কণ্ঠে বলল,” কি হয়েছে মা?”

” উঠো, নাজনীন খালামণি তোমার সাথে কথা বলবে।”

অবন্তী জানে কি বিষয়ে কথা বলা হবে। তাই ইচ্ছে করেই বলল,” আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”

” তুমি যা ভাবছো তা না, অন্যবিষয়ে কথা বলবে। নাও ধরো।”

অবন্তী মুখ ভোঁতা করে মোবাইল হাতে নিল,” হ্যালো খালামণি, আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো আম্মু?”

” ভালো। তুমি কেমন আছো?”

” ভালো মা। তুমি আমাকে শুধু এইটুকু বলো, সানভী আঙ্কেল তোমার সাথে এরকম কয়বার করেছে?”

অবন্তী আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,” দুইবার।”

” কি কি করেছে?”

অবন্তী চুপ করে রইল। নাজনীন কঠিন গলায় বলল,” চুপ করে থেকো না অবন্তী। এটা জানা খুব জরুরী আমার জন্য। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে সানভী আঙ্কেলের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। সে শুধুই তোমাকে আদর করছিল। আর ঘটনাবশত তার হাত তোমার বুকের কাছে চলে গেছে। এই ব্যাপারটাকে তুমিই খারাপ ভাবে দেখছো। এমন কি হতে পারে না?”

অবন্তী তীব্র কণ্ঠে বলল,” না। এরকম হতে পারে না। ওই লোকটা ইচ্ছে করে আমার বুকে হাত রেখেছিল। আমি ব্যথা পেয়ে কেঁদে ফেলার পরেও সে ছাড়ল না।”

অবন্তী বিলকিসের হাতে ফোন দিয়েই দ্রুত বারান্দায় চলে গেল। তার আবার বিশ্রী ঘটনাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। সে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল। বিলকিস আহত স্বরে বলল,” দেখলি, আমার মেয়েটার কি ভয়ংকর অবস্থা! ও তো কাল থেকে একদম কলাপ্স হয়ে গেছে।”

নাজনীন ক্রোধান্বিত কণ্ঠে আওড়াল,” জানোয়ার! ওর অবস্থা আমি খারাপ করে ছাড়ব।”

নাজনীন কথা রেখেছিল। সে সানভীকে ভয়ানক অপমান করে বিয়ে ভেঙে দিল। এই নিয়ে হেলেনের সাথে তার কিছুটা মনোমালিন্যও হলো। কিন্তু অবন্তীর সাথে ঘটে যাওয়া জঘন্য ঘটনাটা তারা গোপনই রেখেছিল। ঠিক তিনমাস পরের ঘটনা। নাজনীন তখন অবন্তীদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। একদিন নাজনীন আর অবন্তী বাজার থেকে ফিরছিল। পথিমধ্যেই হঠাৎ করে দেখা হলো সানভীর সাথে। সে এইখানে একটা কাজে এসেছিল। অবন্তী ভয়ে আৎকে উঠল। ভূত দেখলেও মানুষ এতোটা ভয় পায় না, অবন্তী সানভীকে দেখে ঠিক যতটা ভয় পেল। নাজনীন অবন্তীর কাঁধে হাত রেখে বলল,” ভয়ের কিছু নেই, মা৷ আমি আছি না?”

সে অবন্তীকে নিয়ে সানভীকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সানভী তাদের দেখে ফেলল।

” আরে, আরে, নাজনীন না? নাজনীন শোনো।”

সানভী দৌড়ে এলো। অবন্তী ভয়ে শক্ত করে নাজনীনের হাতটা চেপে ধরল। চাপা কণ্ঠে বলল,” খালামণি, লোকটা আসছে।”

” আসুক।” নাজনীন দায়সারা। সানভী তাদের পথ আটকে দাঁড়ালো,” কোথায় যাচ্ছো?”

” বাজারে এসেছিলাম। বাড়ি যাচ্ছি। কেন?” নাজনীনের মুখভঙ্গি কঠিন। সানভী নরম হাসি দিয়ে বলল,” তুমি কি এখনও রেগে আছো? বিয়ে ভেঙে গেছে বলে কি আমার সাথে কথাও বলা যাবে না?”

” তুমি এখনও কিভাবে এক্সপেক্ট করছো যে আমি তোমার সাথে কথা বলবো? সামনে থেকে সরো। নাহলে খুব খারাপ হবে।”

” একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। আমরা বসে আলোচনা করলেই সবটা ঠিক হয়ে যায়।”

” তোমার এখনও মনে হয় যে আমি আলোচনা করার মুডে আছি?”

সানভী অবন্তীর দিকে তাকাল। অবন্তী সাহসী কণ্ঠে বলল,” সামনে থেকে সরে যান।”

” খালা-বোনজীর হয়েছেটা কি? দু’জন মিলে আমার সাথে এমন করছো কেন?”

অবন্তী চেঁচিয়ে বলল,” এমন করছি কারণ আপনি একটা বাজে মানুষ। ”

সানভীর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। নাজনীন ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে বলল,” একটা বাচ্চা মেয়ে পর্যন্ত তোমাকে সহ্য করতে পারছে না। এমনই নোংরা তুমি। ছি!”

সানভী সবটা বুঝেও না বোঝার ভং ধরল। প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,” আমরা চলো কাছে কোথাও বসি। ”

নাজনীন জবাব না দিয়ে অবন্তীর হাত ধরে চলে আসতে লাগল। সানভী নাছোড়বান্দার মতো তাদের পিছু নিল। অবন্তী হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে বলল,” পাগল, বাজে লোক, নোংরা মানুষ, চলে যা! যা, নয়তো তোর গায়ে জুতা ছুড়ে মা-রব।”

অবন্তী সত্যি সত্যি পায়ের জুতো খুলে হাতে নিল। নাজনীন এই ঘটনা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। অবন্তী কিভাবে জুতো ছুঁড়ে মারে সেটা দেখার জন্য অতি উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আশেপাশের সব মানুষ তাকিয়ে আছে। সানভী বোকা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে থমথমে মুখে সোজা হেঁটে চলে গেল। অবন্তী হাতের জুতো নামিয়ে রাখল। নাজনীন হাসতে হাসতে অবন্তীর গাল টিপে দিয়ে বলল,” চল মামণি, আইসক্রিম খাবি?”

অবন্তী সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। আজকে তার মনটা অনেক ভালো লাগছে।

____________
অনেক দিন হয়ে গেছে হেলেনদের বাড়ি যাওয়া হয় না। মূলত অবন্তীর সেই দূর্ঘটনার পর থেকেই বিলকিস সেই বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছে। সানভীর মুখোমুখি হওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ তাছাড়া বিলকিসের ভয় লাগে। সানভীকে সরাসরি দেখলে সে হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবে না৷ নির্ঘাত কিছু একটা ঘটিয়ে বসবে।

নিশান্তর জন্মদিনে সেই যে দেখা হলো, এরপর কতমাস কেটে গেছে। আর তাদের দেখা হয়নি। একটা ড্রয়ারে নিশান্তর দেওয়া বেলুনগুলো অবন্তী সামলে রেখেছিল। সব বেলুন চুপসে গেছে। তাও অবন্তী সযত্নে রেখে দিয়েছে। মাঝে মাঝেই সে ড্রয়ার খুলে বেলুনগুলো বের করে দেখে। কমলা রঙের বেলুন সে আলাদা করে রেখেছে। আজ-কাল অবন্তীর কমলা রঙের প্রতি বিশেষ দূর্বলতা তৈরী হয়েছে। সে সবকিছু কমলা রঙের কেনে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, তার কমলা রঙের জামা পরতে খুব লজ্জা লাগে। ধীরে ধীরে অবন্তীর শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সে যেন হুট করেই অনেকটা বড় হয়ে গেছে। এখন আর চাইলেই আগের মতো দৌড়-ঝাঁপ করতে পারে না৷ তাকে খুব সামলে চলতে হয়। চেহারায় আলাদা লাবণ্য যোগ হয়েছে। অবন্তীর এখন তেরো বছর। সে সপ্তম শ্রেণীতে উঠে গেছে৷ একদিন হঠাৎ করেই বিলকিস বলল,” নিশান্তর কথা মনে আছে তোর?”

অবন্তী ভাত খাচ্ছিল। তার খাওয়া থেমে গেল। গালে লালচে আভা পড়ল। এসব কিছুই বিলকিস লক্ষ্য করল না। সে মনোযোগ দিয়ে একটা ছেঁড়া জামা সেলাই করছিল। অবন্তী নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,” কে? ও মনে পড়েছে। রিমা আন্টির ছেলের কথা বলছো?”

বিলকিস এবার সরাসরি অবন্তীর দিকে তাকাল,” ছেলের নাম মনে নেই, কিন্তু মা’র নাম তো ঠিকই মনে আছে। নিশান্তর কথা এতো সহজে ভুলে গেলি? যে ত্যাঁদড় ছিল ছেলেটা! সারাক্ষণ তো তোর পেছনেই লেগে থাকতো।”

” হ্যাঁ মনে পড়েছে। কিন্তু তুমি হঠাৎ ওর কথা বলছো কেন?”

” তোর হেলেন খালামণির সাথে কথা হচ্ছিল। ওরা নাকি কানাডা চলে গেছে দুইবছর আগে।”

অবন্তীর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। মুখ শুকিয়ে গেল। ভাত খাওয়ার ইচ্ছেটাও যেন ম-রে গেল। কেমন একটি বিষণ্ণতা আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে মুহূর্তে। সে ঘোরমাখা কণ্ঠে শুধালো,” আর আসবে না?”

” আসবে না কেন? বেড়াতে নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু আগের মতো তোর খালামণির বাড়ি গেলে ওদেরকে আর দেখা যাবে না। এই আর কি!”

অবন্তী করুণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মা কত সহজভাবে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। কিন্তু অবন্তীর বুকে যেন চাবুক পেটা হচ্ছে! তখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ ছিল না। যদি থাকতো তাহলে এতোদিনে নিশ্চিত অবন্তী একটা স্মার্টফোন যোগাড় করে ফেসবুকে আইডি খুলতো। নিশান্তর নাম লিখে সার্চ করতো। কিন্তু ওই সময় ফেসবুকের ব্যাপারে অবন্তী কিছুই বোঝে না। সেদিন সারাক্ষণ অবন্তীর ছোটবেলার কথাগুলো মনে পড়তে লাগল। কতদিন নিশান্তর সঙ্গে তার দেখা হয় না। ইশ, আর কোনোদিন বুঝি দেখা হবেও না! নিশান্ত কি তাকে ভুলে যাবে?

চলবে