অন্তহীন বসন্ত পর্ব-০৭

0
205

#অন্তহীন_বসন্ত~৭
লিখা- Sidratul Muntaz

হেলেনের বাড়িতে ঈদের দাওয়াত প্রত্যেকবারই থাকে। অবন্তীরা সপরিবারে উপস্থিত হলো এবার। হেলেনের শ্বাশুড়ী বললেন,” কি খবর তোমাদের? আগে তো প্রায়ই আসতে। গত দু’বছর ধরে একদমই আসো না।”

বিলকিস বলল,” আসি তো খালাম্মা। শাওনের মুসলমানিতে এসেছিলাম না?”

” সে তো আরও ছয়মাস আগের কথা। আগে তোমরা ঘন ঘন আসতে তখন কত ভালো লাগতো!”

” এখন থেকে আবার ঘন ঘন আসবো খালাম্মা।”

হেলেনের শ্বাশুড়ী অবন্তীকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করলেন। সালামি হিসেবে পাঁচশো টাকাও দিলেন। হেলেন ভেতরে গিয়ে বলল,” সব নাটক! তোরা না এলে বুড়িটা খুশিই হয়। আগে ভাবতো তোদের আমি না জানি কতকিছু দিয়ে দেই। পেটভরা খালি হিংসা।”

অবন্তীর এই কথা শুনে একটু মনখারাপ হলো। নানু তো কত ভালো। তাও হেলেন খালামণি এরকম করে বলেন কেন? পৃথিবীর কোনো বউয়ের কাছেই কি শ্বাশুড়ী কখনও ভালো হতে পারে না? হেলেন ধমক দিয়ে বলল,” এই অবন্তী, তোরা আমার বাসায় আসা বন্ধ করলি কেন হঠাৎ? আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এই নিয়ে কত খোঁচা মা-রে আমাকে জানিস? বলে তোমার বোন একটা পাশেই থাকে অথচ তোমাকে তো দেখতে আসে না… হেন-তেন। ”

অবন্তী মায়ের দিকে তাকাল। বিলকিসের মুখ মলিন। সে সানভীর প্রসঙ্গটা নতুন করে আর তুলতে চায় না। গতবছর সানভী বিয়ে করেছে। তার বউ এখন প্রেগন্যান্ট। দেখাও হয়েছে। কি মিষ্টি চেহারা মেয়েটির! কিন্তু সে কি জানে তার জামাই একটা লম্পট! বিলকিস অবশ্য পুরনো কথা ভুলে থাকতে চায়। পাশ কাটানো গলায় বলল,” এখন অবন্তী বড় হয়েছে। লেখাপড়ার অনেক চাপ। সেজন্য আসা হয় না আর কি।”

হেলেন শুকনো মুখে বলল,” এবার তোদের ক’টা দিন থেকে যেতে বলতাম। কিন্তু কি করব? বাড়ি ভর্তি মেহমান।”

” কারা এসেছে?”

” কেন রিমা আপারা এসেছে খবর পাসনি? তোদের সঙ্গে দেখা হয়নি?”

” নাতো।”

বিলকিস অবাক। তার চেয়েও বেশি অবাক হলো অবন্তী। বিস্ময় চাপতে না পেরে প্রশ্ন করেই ফেলল,” তারা না কানাডায় চলে গেছিল?”

হেলেন বলল,” হ্যাঁ। এবার রোজার ঈদে বেড়াতে এসেছে। এক সপ্তাহ পর অবশ্য চলে যাবে।”

অবন্তীর বুকের ভেতর যেন ট্রেন ছুটতে লাগল৷ এতো অস্থিরতা, এতো অস্থিরতা! তার আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। নিশান্ত এই বাড়িতেই আছে। কতদিন পর দেখা হবে! অবন্তী উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,” আমি নিচে যাই। পলি আপুদের সাথে দেখা করে আসি।”

সাথে সাথে বিলকিস ধমক দিল,” এই, কি বলেছিলাম মনে নেই?”

অবন্তী থেমে দাঁড়ালো। এখানে আসার আগে বিলকিস বলেছিল অবন্তী যাতে একা কোথাও না যায়। এর প্রধান কারণ সানভী। অবন্তীকে চুপচাপ বসে থাকতে হলো। একটু পর ঈশিতা এলো। অবন্তীকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল,” কেমন আছো? কতদিন পর দেখা! তুমি তো আগের চেয়ে সুন্দরী হয়ে গেছো।”

অবন্তী লজ্জা পেল। ঈশিতা ওর হাত ধরে বলল,” চলো নিচে যাই। নিশান্ত ভাইয়ারা তো এসেছে। দেখা করেছো?”

” না। এখনও দেখা হয়নি।”

” তাহলে চলো।”

অবন্তী বিলকিসের থেকে অনুমতি নিয়ে ঈশিতার সাথে নিচে চলে গেল। নিশান্তকে ঘিরে সবাই বসে আছে। অবন্তী উপস্থিত হতেই নিশান্ত উঠে দাঁড়ালো। ঈশিতা রহস্য করে বলল,” দেখোতো ভাইয়া, এই মেয়েটাকে চেনো?”

নিশান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। অবন্তী জড়োসড়ো। চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। নিশান্ত একটু ভেবে বলল,” অবন্তী না?”

সবাই হেসে উঠল। অবন্তীর বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল অনেকখানি। নিশান্ত কাছে এসে বলল,

” হায়, অবন্তী। কেমন আছো?”

অবন্তীর কেমন নিঃশ্বাস আটকে আসার মতো অনুভূতি হচ্ছে। নিশান্ত কত লম্বা হয়ে গেছে! অনেকটাই পাল্টে গেছে। গালে দাড়ি গজিয়েছে। মনে হয় শেভও করে। তার চেহারার স্বাভাবিক কোমলতাটা আর নেই। কেমন একটা পুরুষালি কাঠিন্য চলে এসেছে। গলার আওয়াজটাও কেমন গম্ভীর! অবন্তীর মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটা জড়তা এসে ভিড়ল। নিশান্ত যে তার ছোটবেলার খেলার সাথী ছিল, এখন আর সেটা মনে হচ্ছে না। কেমন যেন লজ্জা লাগছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। মনে হচ্ছে কোনো অচেনা পুরুষ। সে কোনমতে বলল,” এইতো.. ভালো। ”

নিশান্ত হাত ভাঁজ করে তার পাশেই দাঁড়ালো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” অনেকদিন পর দেখা হলো। তাই না?”

” হুম।”

” কিসে পড়ো এখন তুমি?”

” ক্লাস সেভেন। ”

অবন্তী এই প্রথম নিজে থেকে জানতে চাইল,” তুমি কিসে পড়ো?”

” এইতো.. অনার্স ফার্স্ট ইয়ার।”

অবন্তীর চোখ কপালে উঠে গেল। এখন নিশান্তকে ‘তুমি ‘ ডাকতেও অস্বস্তি হচ্ছে তার। এতো বড় কবে হয়ে গেল নিশান্ত! অবন্তীকে নিশ্চুপ দেখে নিশান্ত ঠাট্টা করে বলল,” তুমি কি বড় হওয়ার পর অনেক চুপচাপ হয়ে গেছো অবন্তী? আগে তো খুব কথা বলতে!”

এই কথায় কি কিছু ছিল? অবন্তীর এতো লজ্জা লাগল কেন? লজ্জায় যেন কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ইশ, নিশান্তর কি আগের কথা সব মনে আছে! কত রকম পাগলামিই না করতো সে। ঈশিতা বলল,” তুমি কানাডা গিয়ে একদম গেটাপই চেঞ্জ করে ফেলেছো শান্ত ভাইয়া। সে অনুযায়ী অবন্তী আগের মতোই আছে। ”

নিশান্ত হাসল। অবন্তীর এতো অদ্ভুত লাগছে! সে ঈশিতার হাত ধরে বলল,” চলো আমরা অন্যকোথাও যাই।”

” অন্যকোথাও মানে? কই যাবে?”

” উমম… ছাদে?”

” আচ্ছা, চলো।”

অবন্তী যেন দ্রুত নিশান্তর থেকে পালিয়ে বাঁচল। যতক্ষণ সে সামনে ছিল, নিঃশ্বাসটা যেন সত্যি গলার কাছে আটকে ছিল। ছাদে এসে অবন্তী বুক ভরে শ্বাস নিল। কিন্তু এখানেও আরেক ঝামেলা। সানভী এক কোণায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। অবন্তীকে দেখেই সিগারেট ফেলে সে হাসল। উৎফুল্ল গলায় বলল,” আরে, অবন্তী না? কেমন আছো? কত বড় হয়ে গেছো দেখি!”

অবন্তী ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এই মানুষটা এতো নির্লজ্জ কেন? এতো কাহিনীর পরেও অবন্তীর সঙ্গে কথা বলছে! ঈশিতার সামনে অবন্তী কিছু বলতে পারল না। ছোট্ট করে জবাব দিল,” ভালো। ”

_________
“আমাদের অবন্তী তো ভালোই বড় হয়ে গেছে। এবার ওকে একটা বিয়ে দেওয়া দরকার।”

বিকালে সবাই ড্রয়িংরুমে চায়ের আড্ডায় বসেছিল। কথায় কথায় হঠাৎ কিভাবে যেন অবন্তীর বিয়ের প্রসঙ্গ চলে এলো। নানু অবন্তীর কাঁধে হাত রেখে রসিকতা করে বলল।

বিলকিসও ঠাট্টা করে বলল,” পাত্র খুঁজেন তাহলে।”

অন্যসময় বিয়ের কথা শুনলে অবন্তী রেগে যেতো। কিন্তু এই মুহূর্তে তার গাল, কান, সবকিছু লাল হয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে দূরের মাঠে দেখা যাছে নিশান্তকে। নিয়ন ভাইয়াদের সাথে ক্রিকেট খেলছে সে। অবন্তীর এতো লজ্জা পাওয়ার মূল উৎস এখানেই। ঈশিতা ফিসফিস করে বলল,” দাদু সবসময় এরকম করে। বিয়ে নিয়ে মশকরা শুনতে আমার একদম ভালো লাগে না।”

অবন্তী বলল,” আমারও না।”

” তাহলে চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই।”

” কোথায় যাব?”

” বাইরে। ভাইয়াদের খেলা দেখে আসি চলো।”

ঈশিতার সাথে অবন্তী বাগানে এলো। হাঁটতে হাঁটতে ঈশিতা হঠাৎ প্রশ্ন করল,” আচ্ছা অবন্তী, তোমার কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?”

” নাতো।”

” তাহলে বিয়ের কথা শুনে এতো লজ্জা পাচ্ছিলে কেন?” ঈশিতার ঠোঁটে দুষ্ট হাসি। অবন্তী আবার লজ্জায় গুটিয়ে গেল। নজর পড়ল নিশান্তর দিকে। বল ক্যাচ করার জন্য পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে সে। একসময় মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। চোখ-মুখ কুচকে চেঁচাতে লাগল। তার সবকিছুই মুগ্ধ করছে অবন্তীর কিশোরী মনকে। সে ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল,” আমি প্রায়ই কল্পনায় দেখি, আমার বিয়ে হয়েছে। আমি সংসার করছি। এজন্যই নানুর কথা শুনতে লজ্জা লাগছিল।”

ঈশিতা খুব আগ্রহী কণ্ঠে বলল,”তাই নাকি? আমারও মাঝে মাঝে এরকম কল্পনা আসে। আচ্ছা তুমি কি দেখো? একটা সুন্দর বাড়ি?”

” হুম৷ সুন্দর বাড়ি কিন্তু ছোট।”

” ছোট কেন?”

” আমার ছোট বাড়িই ভালো লাগে। সে প্রতিদিন অফিস থেকে আসে। আমি তার জন্য রান্না করি। তাকে খাবার বেড়ে দেই। গভীর রাতে আমরা ছাদে হাঁটতে যাই। সে আমার খোঁপায় কমলা ফুলের গাজরা পরিয়ে দেয়।”

” তোমার কল্পনার মানুষটিকে দেখতে কেমন?”

অবন্তী নিশান্তর দিকে চেয়ে বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলল,” প্রচন্ড সুন্দর।”

” নায়কের মতো? ”

অবন্তী ফিক করে হেসে উঠল,” ধূর, সিনেমার নায়ক তার কাছে কিছুই না। সে রাজপুত্রের মতো সুন্দর। ”

” বাহ, এতো সুন্দর! আমার তো এখন দেখতে ইচ্ছে করছে সেই রাজপুত্রকে। কোথায় থাকে? কি করে? তোমার স্কুলের কেউ?”

” না, স্কুলের কেউ না। সে তো আমার চেয়ে অনেক বড়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।”

ঈশিতা অবাক হয়ে বলল,” নিশান্ত ভাইয়ার মতো?”

অবন্তীর বুক কেঁপে উঠল। কানের লতি লাল হয়ে গেল৷ অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখা দিল চিত্তে। ঈশিতা সন্দিহান গলায় বলল,” এখন আবার বোলো না যে তোমার সেই রাজপুত্র নিশান্ত ভাইয়াই!”

অবন্তী চমকে উঠল। তীব্র লজ্জা মেশানো কণ্ঠে বলল,” ছি, একদম না। এসব তুমি কি বলছো? নিশান্ত ভাইয়া কেন হবে?”

ঈশিতা হাসতে হাসতে বলল,” আরে আমি মজা করেছি। তুমি রাগ করছো কেন? স্যরি, তুমি নিশান্ত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলে তাই এমন মনে হলো।”

অবন্তী রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,” মোটেও আমি তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলাম না। আমি শুধু খেলা দেখছিলাম।”

” ও আচ্ছা। আবারও স্যরি।”

চলবে