অন্যরকম প্রেমানুভূতী পর্ব-০২

0
926

#গল্পঃ_অন্যরকম_প্রেমানুভূতী
#Maisha_jannat_nura(লেখিকা)
#পর্ব_২

উনার এমন কথায় আমি স্তব্ধ হয়ে যাই, মাথা তুলে উনার দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করি, চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়ছে নিজের কথা বলার সব শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। উনি আবারও বললেন..

-এক্সিডেন্টে তুমি অটো থেকে বাহিরে পরে যাওয়ায় অনেক চেষ্টার ফলে তোমাকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে কিন্তু গাড়িটি খুব বাজে ভাবে অটোটিকে ধাক্কা দিয়েছিলো তোমার বাবা-মা সহ বাকি যারা অটোতে ছিলেন তারা ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছেন।

উনার এতোসময়ের বলা কথাগুলো যেন আমার কান দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে না চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে তারপর আর কিছু মনে নেই আমি আবারও সেন্সলেস হয়ে পড়ি। অনেকসময় পর আমার ঙ্গান ফিরে, আস্তে করে চোখ মেলে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি আঙ্কেল এখনও বসে আছেন আমার পাশে, নিজেকে আর আটকে রাখতে পারি না তারদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিরবে কান্না করতে থাকি। উনি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন..

-দেখো মা আমাদের সবার জীবনই অনিশ্চিত কিন্তু সবার জন্য মৃত্যু নিশ্চিত কখন কিভাবে কোথায় আমাদের মৃত্যু হবে তা আমরা কেও ইই জানি না, তোমার বাবা-মায়ের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো তারা যেন জান্নাতবাসী হতে পারেন।

আমি কোনোভাবেই আমার মনকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছিনা। এইতো কিছুঘন্টা আগেও একটি হাস্যোজ্জ্বল পরিবার ছিলো আমার, চোখের সামনে বাবার আদর মায়ের স্নেহভরা শাষন এর মাঝে কাটানো মুহূর্তগুলো ভাসছে এইটুকু সময়ের ভিতর আমি সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি মনে হচ্ছে একটা ঝড় এসে আমার পুরো জীবনটা ভেঙেচুড়ে দিয়ে গেলো। এসব ভাবতে ভাবতে চোখের পানি মুছে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করতেই আঙ্কেল আমাকে বসতে সাহায্য করলেন। আর বললেন..

-আমার মেয়ে হয়ে আমার সাথে আমার বাসায় থাকবে মা?

উনার এমন কথায় আমি যেন অবাকের চরম মুহূর্তে পৌঁছে যাই, মাথা উঠিয়ে ছলছল চোখে ওনার দিকে দৃষ্টি স্থির করি বুঝার চেষ্টা করি উনি একটু আগে এমন কথা কেন বললেন,আমার এমন চাহনিতে উনি একটু হাসি দিয়ে বলেন..

-ভয় পেও না মা, আমাকে তোমার বাবার মতো ভাবতে পারো আর তুমি আমার ছোটো মেয়ে হয়ে আমার বাসায় থাকবে।

আমার থাকার আর কোনো জায়গা নেই, এতো অল্প বয়সে কোথায় যাবো কি করবো এসব ভেবে না পেয়ে উনার কথায় সম্মতি জানাই।

এভাবেই কেটে যায় ৪দিন……
৪ দিন পর আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেয়। আঙ্কেল আমাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়েন তার বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়ির ভিতর বসে আছি দৃষ্টি আমার জানালার কাচ ভেদ করে বাহিরেই স্থির, বেশকিছু সময় পর গাড়িটি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায়। একটা বড় গেইট পার করে গাড়িটি ভিতরে প্রবেশ করলো আমি অবাক নয়নে চারপাশটা দেখছি বিশাল এড়িয়া জুড়ে বাড়িটি স্থাপিত।

আঙ্কেল আমাকে গাড়ি থেকে নামতে বললেন আমি গাড়ি থেকে নেমে ধীরপায়ে হাটছি বাড়ির ভিতরে যেতে। আঙ্কেলের সাথে বাড়ির মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে, হঠাৎ লক্ষ করলাম একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা পান চিবোতে চিবোতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। আঙ্কেল হাসিমুখ নিয়ে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন..

-রাবেয়া ওর নাম তৃপ্তি আর ও আজ থেকে আমাদের সাথে এই বাসায় থাকবে।

আঙ্কেলের এমন কথায় উনি আমার দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আর আমার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত এক নজর দেখে নিয়ে আঙ্কেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন..

-নতুন কাজের মেয়ে লাগবে সেটা অনেকদিন থেকেই আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম, বলবো বলবো করে আর বলা হয়ে ওঠে নি।

উনার মুখে আমাকে কাজের মেয়ে বলায় আমি ছলছল নয়নে আঙ্কেলের দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করি কিছুসময় পর অন্যত্র দৃষ্টি ঘুরিয়ে ডান হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নেই। আঙ্কেল রাগান্বিত কন্ঠে বলেন ও কোনো কাজের মেয়ে না, ও আমার ছোটো মেয়ে হয়ে আজ থেকে এ বাড়িতে থাকবে ওর সাথে বিন্দুমাত্র খারাপ আচারণ করবে না মনে থাকে যেন। ওকে উপরে রেজিয়ার পাশের রুমে নিয়ে যাও ও ওখানেই থাকবে, এই বলে আঙ্কেল সেখানে থেকে উপরে চলে যান।

আমাকে উপরের রুমে নিয়ে যান উনি (রাবেয়া বেগম)। রুমটা অনেক সুন্দর ঘুরে ঘুরে দেখছি তখনই উনি আমাকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন..

-তোদের মতো ছোটলোক ঘরের মেয়েরা টাকার জন্য বড়লোক দেখলে তাদের ঘাড়ে কিভাবে চেপে বসা যায় সেই সুযোগ খুঁজিস। আমার স্বামী নেহাতই নরম দয়ালু মনের মানুষ তাই তোদের মতো ছোটলোকদের কষ্ট দেখলে নিজেকে সামলাতে পারেননা, হ্যা রে তোর বাবা-মা কি তোরে বড়লোকদের কিভাবে ফাঁসিয়ে টাকা আদায় করতে হয় সেই শিক্ষাই দিয়েছে!

উনার এতো সময়ের বলা সবকথা যেন তীরের মতো বুকের এপাশ ছিদ্র করে ওপাশে চলে গেছে, চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পরছে। কোনোভাবে নিজেকে আসস্ত করে ধীর গলায় বললাম..

-আমার বাবা-মা বেঁচে নেই, ৫দিন আগে এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।
আমার কথা শুনে উনি বললেন
-মুখপুড়ি, অপয়া, অলক্ষী নিজের বাবা-মা কে এতো তাড়াতাড়ি খেয়েছিস এখন আমার স্বামীর দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে এসেছিস আমাদের সুখের সংসারে আগুন লাগাতে।
এই বলে হন হন করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন উনি। আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না বিছানার পাশে নিচে বসে হাঁটুর ২ভাজে মুখ লুকিয়ে হুহু করে কেঁদে দিলাম, কাঁদতে কাঁদতে ভাবতে লাগলাম দুনিয়াতে বাবা-মা ছাড়া সবাই অসহায়, বাবা-মায়ের মতো কেও ভালোবাসে না, আগলে রাখে না সময় থাকতে আমরা তাদের মূল্য বুঝি না যখন হারিয়ে যায় তখন তাদের শূণ্যতা আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।

কাঁদতে কাঁদতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো বুঝতে পারি নি, হঠাৎ মনে হলো অনেকগুলো জিনিস আমার উপর কেও ছুঁড়ে দিয়েছে, মাথা তুলে হালকা ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি ঐ আন্টিটা আমার উপর অনেকগুলো কাপড় ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। বিষ্ময় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি তিনি উচ্চস্বরে বললেন..

-তোর জন্য আমার মেয়ের পুরোনো কাপড় ইই যথেষ্ট।

কথাটি বলে তিনি চলে গেলেন। কাপড়গুলো হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখছি বেশ পুরোনো হয়ে গেছে আর অনেক জায়গায় সেইল খুলে গেছে জায়গা গুলো সেইল না করলে কাপড়গুলো পড়া যাবে না। তাচ্ছিল্ল্যের হাসি দিয়ে মনে মনে বললাম বাবা কখনও একটু ছিঁড়ে যাওয়া জামা সেইল করে পড়তে দিতেন না আজ আমাকে সেই পরিস্থিতি তে মানিয়ে নিতে হবে। কষ্টকরে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, রুমের সাইডে একটা বেলকোনি আছে সেখানে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো আমার পিছনে কেও দাঁড়িয়ে আছেন, পিছন ফিরে দেখি আঙ্কেল দাঁড়িয়ে আছেন। আঙ্কেল কে দেখে বললাম..

-আঙ্কেল কিছু বলবেন?
-তোর এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো মা?
-না আঙ্কেল আমি অনেক ভালো আছি (জোড়পূর্বক হাসি দিয়ে)
-নিচে চল রাতের খাবার খেয়ে নিবি।
-আচ্ছা।

নিচে এসে খাবার টেবিলে বসলাম, আন্টি তখন আমার সাথে অনেক আদুরে সুলভ ভাবে কথা বললো আমি যেন কিছুসময় আগে স্বপ্ন দেখেছি তিনি আমার সাথে এতোটা খারাপ আচার করেছিলেন এখন স্বপ্ন টা নেই। খাওয়া শেষ করে আঙ্কেল রুমে চলে গেলেন, একটু পর আমি চলে আসতে নিলে আন্টির কথায় থেমে গেলাম..

-এই যে নবাবজাদি একরাশ গিলে এখন কোথায় যাচ্ছিস তোর এঁটো করা প্লেট কি আমি পরিষ্কার করবো আমাকে এবাড়ির ঝি মনে করেছিস নাকি?

হঠাৎ আবার তার ব্যবহারের পরিবর্তনে বুঝতে পারলাম উনি আঙ্কেলের কাছে নিজেকে ভালো রাখতে ততোটা সময় আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেন আঙ্কেল চলে গেলেই তার আসল রূপ প্রকাশ পায়। পিছনঘুরে বললাম..

-না আন্টি আমি সব পরিষ্কার করে দিচ্ছি।
-তো যা কর।
-জ্বি।
এই বলে উনি চলে গেলেন, আমি সব পরিষ্কার করে রুমে চলে আসলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, চিরুনি টা হাতে নিতেই মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো, চুল বাধার সময় মা বলেছিলো “” আমি যখন থাকবো না তখন কে তোকে চুল বেঁধে দিবে”” কথাটা মনে পড়তেই চোখ ভিজে গেলো। কোনোভাবে চুল চিরুনি করে ব্যালকোনি তে এসে দাড়ালাম। দৃষ্টি আমার দূর সেই তারা ভরা আকাশের দিকে। আজ আমি অনেক একা এতো বিশাল পৃথিবীতে আমার আপন বলতে কেও নেই। এসব ভাবছিলাম আর চোখের জলে ফেলছিলাম……..

#চলবে….