অন্যরকম প্রেমানুভূতী পর্ব-০৩

0
812

গল্পঃ_অন্যরকম_প্রেমানুভূতী
#Maisha_jannat_nura(লেখিকা)
#পর্ব_৩

আমি অনেক একা এই বিশাল পৃথিবীতে আমার আপন বলতে কেও নেই। এসব ভাবছিলাম আর চোখের জল ফেলছিলাম। বেশ কিছুসময় পর বেলকোনি থেকে রুমের ভিতর আসলাম বিছানায় নিজের শরীরটা এলিয়ে দিলাম কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারি নি। খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেলো, ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম তখনও কেও ঘুম থেকে উঠে নি।

ধীরপায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম, মায়ের সাথে টুকিটাকি কাজ করতাম তাই ধারনা খুব ভালো না থাকলেও অল্পস্বল্প আছে হয়তো করতে করতেই অভ্যাস হয়ে যাবে আর ভুলগুলোও সংশোধন হবে। ফ্রিজ খুলে দেখলাম অনেক সবজি, মাছ-মাংস রাখা আছে, সেখান থেকে কিছু সবজি আর মাছ বের করলাম রান্না করবো। রান্না প্রায় শেষের পথে তখন লক্ষ্য করলাম আন্টি (রাবেয়া বেগম) রান্নাঘরের দিকে আসছেন। রান্নাঘরের ভিতরে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন…

-তোদের মতো মেয়েদের জায়গা এখানেই,সব কাজ করবি কাজের
বুয়াদের মতো (হাসি দিয়ে)।

আমি কিছু বলি নি আমার বলারই বা কি আছে এখানে, একজন অনাথ মেয়ে যার একূল জুড়ে আপন বলতে কেও নেই তার জন্য এইসব কথা শোনাই প্রাপ্য। তিনি আবার ও বললেন..

-আমাকে এক কাপ চা করে দে মিষ্টি বেশি দিয়ে।
বলেই উনি ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসলেন। একটুপর আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসলাম ওনার কাছে। চা দিয়ে চলে আসতে নিলে উনি বললেন..
-আমার সামনে বস।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে, উনি আবারও বেশ উচ্চস্বরে বললেন..
-তোকে বসতে বলেছি আমার সামনে কথা কানে যায় না?

আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, উনার সামনে বসতেই উনি চা কাপের সম্পূর্ণ চা আমার শরীরের উপর ছুঁড়ে ফেললেন, গরম চা শরীরে পড়তেই আমি মা গো বলে চিৎকার দিয়ে উঠি, পুরো শরীর যেন জ্বলছে আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। আমার চিৎকারে আঙ্কেল ড্রয়িং রুমে আসলেন এসে আমাকে কান্না করতে দেখে বললেন..

-কি হয়েছে তৃপ্তি মা, কান্না করছিস কেন?
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আন্টি (রাবেয়া বেগম) আমাকে থামিয়ে বললেন
-আরে আর বলবেন না,ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখি ও সোফায় বসে আছে ওর পাশে বসতে বসতে বললাম মা রে আমার মাথাটা হঠাৎ খুব ব্যথা করছে এটা শুনেই ও বললো আমার জন্য আদা দিয়ে চা বানিয়ে আনবে আমি কতো নিষেধ করলাম আমার কোনো কথা শুনলো না চা বানাতে চলে গেলো, চা এনে আমাকে দেওয়ার আগেই টি-টেবিলের কর্নারে পা আটকে সম্পূর্ণ চা নিজের শরীরে ফেলে দিয়েছে।

আন্টির বলা এতো সময়ের কথায় আমি যেন অবাকের চরম মুহূর্তে পৌঁছে গেলাম মানুষ এতো গুছিয়ে মিথ্যে কথা কিভাবে বলতে পারে। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে, আঙ্কেল বললেন..

-তোকে না নিষেধ করেছিলাম কোনো কাজ করতে হবে না, তবুও কেন এসব করতে গিয়েছিলি মা, আমার রুমে চল আমি ঔষধ দিচ্ছি যেসব জায়গায় জ্বালা করছে এখনি সেখানে ঔষধ লাগিয়ে নিবি আয়।

আমি আঙ্কেলের থেকে ঔষধ নিয়ে রুমে চলে আসি, রুমের দরজা আটকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি নিজেকে। গলার নিচে বেশখানিকটা জায়গা লাল হয়ে আছে ঔষধ টা লাগিয়ে নিলাম ভিষণ জ্বালা করছিলো চোখের পানি মুছে জামা ঠিক করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুসময় সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম তখনি নিচে লক্ষ করলাম একটা বড় গাড়ি বাড়ির ভিতর প্রবেশ করছে। একটুপর গাড়ি থেকে একজন মেয়ে আর একজন ছেলেকে নামতে দেখলাম ভাবলাম হয়তো উনি আঙ্কেলের বড় মেয়ে আর উনি জামাই। তারা বাড়ির ভিতর চলে গেলেন আমিও বেলকোনি থেকে রুমে চলে আসলাম। বিছানায় বসে ছিলাম নিচ থেকে বেশ হাসিঠাট্টার আওয়াজ আসছে আর রুমে বসে না থেকে বের হয়ে নিচে আসলাম দেখলাম আঙ্কেল ছাড়া সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছেন। আমাকে দেখে ঐ আপু আন্টিকে বললেন..

-মা ও কে?
-নতুন কাজের মেয়ে (আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন)
-ওহ কবে নিলে আবার ওকে?
-সবকথা তোকে পরে বলবো, যা জামাইকে নিয়ে ভিতরে যা, কতোদূর থেকে এসেছিস একটু রেস্ট কর আমি তোদের জন্য চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-আচ্ছা ঠিক আছে।

উনারা দুজন উপরে রুমে চলে গেলেন, আন্টি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন..
-এভাবে সং এর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমার মেয়ে জামাইয়ের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আয়, আবার রান্না বাকি আছে।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে রান্নাঘরে চলে আসলাম। চা বানিয়ে নিয়ে উপরে ওদের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, দরজায় নক করে বললাম..
-আসবো আপু?
-হ্যা আয়। (রেজিয়া সুলতানা)
আমি ভিতরে এসে বললাম
-আপু চা এনেছি।
-ওকে আগে দে।

আপু ওয়াশরুমে চলে গেলেন, আমি ভাইয়ার কাছে এসে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলাম। উনি চায়ের কাপ নিতে গিয়ে আমার হাত ধরার চেষ্টা করলেন যা আমার মোটেও ভালো লাগে নি আমি চায়ের কাপটা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলাম কেমন করে যেন দেখেন উনি আমাকে, আমি আপুর চা টেবিলে রেখে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম।

এদিকে রেজিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তার মায়ের রুমে আসলেন,
-মা কি করছো?
-কি আর করবো রে তোর কপাল তো পুড়লো। (ন্যাকা কান্না ভাব করে)
-উফফ মা এতো ভঙিতা না করে বলো কি হয়েছে?
-ঐ যে নতুন মেয়েটাকে দেখছিস না..
-হুম কি হয়েছে তো!

-তোর বাবা ২দিন আগে কোথা থেকে যেন মেয়েটাকে নিজের সাথে এনেছে আমাকে বলে ঐ ছোটোলোক মেয়ে আজ থেকে তার ছোট মেয়ে হয়ে এ বাড়িতে থাকবে, তোর বাবা তো ঐ মেয়ের উপর ভিষণ মায়া আর দূর্বল, কিছু বলাই যায় না তার সামনে।

-কিহহ,, কোথাকার কোন ছোটোলোক ঘরের মেয়েকে আমার বোনের জায়গা দিয়েছে,সত্যি মা বাবার রুচিবোধ দেখলে আমার এখন অনেক রাগ হয়।

-শোন, তোর বাবা যখন থাকবে তখন মেয়েটার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করবি না যখন উনি থাকবেন না তখন যা করার করিস।

-কিন্তু মেয়েটা যদি বাবাকে নালিশ জানায়?
-এতো সাহস হবে না, যে করেই হোক ঐ মেয়েকে তোর বাবার চোখে দোষী বানিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে নয়তো দেখবি তোর বাবাকে আরো দূর্বল করে সব সম্পত্তি নিয়ে ঐ মেয়ে আমাদের বাড়ি ছাড়া করবে।

-হুম এসব রাস্তার মেয়েরা তো এমন ইই হয়।

-আচ্ছা জামাইয়ের কাছে যা এখন দেখ কিছু লাগবে নাকি ওর, আমি পরে ভেবে দেখতেছি কি করা যায়।
-আচ্ছা।

রেজিয়া সেখান থেকে বের হয়ে তার রুমে চলে গেলেন। অন্যদিকে রাবেয়া বেগম তৃপ্তিকে দুপুরের সমস্ত খাবার রান্না করার দায়িত্ব দিয়েছেন। কাজের একটু অভ্যাস থাকলেও এতোটা পারদর্শী এখন ও সে হয়ে ঔঠে নি তাই রান্নার কাজ শেষ করতে বেশ সময় লাগছে তৃপ্তির। এ বাড়িতে ২য় কোনো কাজের লোক ও উপস্থিত নেই যে একটু সাহায্য চাইবে। এতোসময় নিয়ে রান্না শেষ না হওয়াতে রাবেয়া বেগম রান্নাঘরে আসলেন আর তৃপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেন..

-কি রে নবাবজাদী, তোর এতো ধীরগতির কাজের জন্য আমার মেয়ে জামাই কি না খেয়ে থাকবে নাকি?

আমি মাথানিচু করে বলি
-এর আগে কখনও এতোকাজ একসাথে করি নি তো তাই সময় লাগছে কিছুদিন করলে অভ্যাস হয়ে যাবে (তৃপ্তি)
-কাজ করা বাদ দিয়ে আবার মুখে মুখে তর্ক করিস,
তোর সাহস তো কম নয় (রাবেয়া বেগম)।

আমি আর কিছু বলি নি চুপ করে শুনলাম তার বলা কথাগুলো। উনি আবারও বেশ উচ্চস্বরে বললেন
-তাড়াতাড়ি রান্না শেষ কর, কোনোরকম ভুল যেন না হয়।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই, উনি রান্নাঘর থেকে চলে যান। কিছুসময়পর রান্না শেষ করে সবাইকে খাওয়ার জন্য আসতে বলি, আঙ্কেল দিনের বেশির ভাব সময় অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকেন এখনও বাহিরে আছেন নয়তো আমাকে এতো কাজ করতে দেখলে রাগ হইতেন আর কতো যে বকা দিতেন, সেসব ভাবতে ভাবতেই একটু হাসি দিয়ে দেই। আমি খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে নিলাম, একটুপর সবাই নিচে নামলেন। খাবারগুলো পরিবেশন করে দিচ্ছি, খাওয়া শুরু করেছেন সবাই এমন সময় রেজিয়া সুলতানা বললেন..

-ছিঃ কি বাজে রান্না, এসব কি খাওয়ার যোগ্য? মা তুমি এ কোন অকাজের মেয়েকে রেখেছো সামান্য রান্না ঠিকভাবে করতে পারে না।

কথাগুলো বলেই তরকারীর বাটি উঠিয়ে আমার শরীরে ছুড়ে ফেলে দিলেন, সকালের গরম চা লেগে পুড়ে যাওয়া জায়গায় এবার গরম তরকারী পরে অসহ্যকর জ্বালা শুরু হয়েছে, কোনো ২য় বাক্য উচ্চারণ না করে সেখানে থেকে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসি। ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার অন করে নিচে বসে পড়ি, হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না করছি আর ভাবছি আল্লাহ আমার থেকে সবকিছুই কেড়ে নিয়েছেন তবুও এ কেমন শাস্তি দিচ্ছেন কি অন্যায় করেছিলাম আমি…….

#চলবে…………