অন্যরকম ভালোবাসা ২ পর্ব-০৭

0
675

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৭

— “ম্যাম; আমি ড্রেনের সাথে ধাক্কা খেয়ে কুকুরের উপর পড়েছিলাম। না মানে, কুকুরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ড্রেনের উপর পড়েছিলাম। তাই আসতে দেরী হয়েছে। “(হাত কচলাতে কচলাতে ইশরা)

ইশরা ভিত্তিহীন কথা শুনে বুকে হাত গুঁজে দু’পা এগিয়ে এলেন শর্মিলা শিকদার। ইশরার পা থেকে মাথা পরখ করে নীড়দ্ধিধায় প্রশ্ন করলেন ক্লাসে উপস্থিত বাকি ছাত্র- ছাত্রীদের.

— “তোমরা কেউ আজকের নিউজ দেখেছিলে, আমি জানতাম সিলেট আর চট্টগ্ৰামের ড্রেনগুলোর অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু ঢাকার ড্রেনগুলো যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, সেটা জানতাম না। তোমরা যদি কেউ জানো, আমাকে একটু জানাও.

ক্লাসের প্রতিটি কোণ সাক্ষী হলো আরো একটি হাসৌকর মুহুর্তের। অট্টহাসিতে শব্দের তালে মৃদু হাসলেন শর্মিলা শিকদার। মুখশ্রী ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম হলে এলো ইশরার। জনশূন্য থাকলে নিজের দু গালে দুটো নয়, বরং চারটা চড় মারত। সামান্য অনৃত কথাটাও বলতে পারছে না। মাথার অগ্রভাগ চুলকাতে চুলকাতে বলল.

— “আসলে ম্যাম। ড্রেনের সাথে না, কুকুরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ড্রেনের উপর পড়েছিলাম। হাতে একটু ব্যাথা পেয়েছি তাই।”

কনুর দেখিয়ে শেষের কথাটা উচ্চারণ করলো ইশরা। সূক্ষ চোখে কনুইয়ের দিকে তাকালেন শর্মিলা শিকদার। গাঢ় সবুজ রং ছাড়া কিছুই নজরে এলো না তার। ফুল হাতা দিয়ে হাতের ঘোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা। টেবিলের উপর থেকে ইস্টিলের স্কেল নিয়ে স্বজোড়ে আঘাত করলেন তিনি। রিনরিনে কন্ঠে বললেন.

— “এখন থেকে কুকুরে যে খাবার খায়, সেগুলো তুমি খাবে। যদি একটু শক্তি হয়। সামান্য একটা কুকুরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ড্রেনের উপর পড়ে। তোমাকে না দেখে আমি বিলিভ করতাম না। ভাগ্যিস তোমার মতো স্টুডেন্ট পেয়েছিলাম। তাই জানতে পারছি।”

তিনি ভালোভাবেই জানেন, এইসব ইশরার অমৃত কথা। গত কয়েক বছর ধরে দেখছেন। প্রতিদিন দেরী করে এসে একটা অজুহাত দিবেই। ইশরাকে ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দিয়ে, ক্লাস করাতে মন দিলেন শর্মিলা শিকদার। তিনি বই হাতে তুলে কিছু বলা আগে আয়ান উপস্থিত হলো সেখানে। তিনি ভ্রু কুঁচকে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন.

— “তোমার কেন লেট হলো আয়ান। আমি তোমার কাছ থেকে আনডিসিপ্লিন আশা করি নি।”

— “ম্যাম ইশরাকে কুকুরের থেকে বাঁচিয়ে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম।”

পুনরায় হেঁসে উঠলো সকলে। বিরাগী হলো ইশরা। অতিশয় ক্ষোভে ফোঁস ফোঁস করছে। আয়ান যে তাকে ইনসাল্ট করছে, বেশ বুঝতে পেরেছে সে।

___________________
মৃদু মৃদু হাওয়া বইছে। সমান তালে রাস্তার ধুলাবালি উড়ছি। কখনো ময়লা আবর্জনা গুলো আঁচড়ে পড়ছে গ্লাসের ফাঁকে। আবার দমকা হাওয়া সরিয়ে দিচ্ছে সেই আবর্জনা গুলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে দিনের আকাশ। যেকোনো সময় বর্ষনের ধারা বেরিয়ে আসবে আকাশ চিরে। কারো বাড়িতে যাওয়া হবে।কেউ প্রবল আগ্ৰহে অপেক্ষা করবে বৃষ্টি থামার জন্য। চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছে দুজন মানব। পিনপিনে নিরবতা বিরাজমান দুজনের মাঝে। মুখের অফুরন্ত বুলিগুলো মনের কোণে জড়ো হয়ে আছে। বলার শতচেষ্টা করেও বলতে সক্ষম হচ্ছে না। দুজনের কথার সূচনা করতে চাইলে ঘটল তৃতীয় ব্যক্তির আগমন। ওয়েটার দুকাপ কফি টেবিলে রেখে চলে গেলেন। মেঘ কপির কাপ হাত নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে চুমুক বসালেন। ইশরা কাপ তুললো না। এক ধ্যানে চেয়ে রইল ধোঁয়া ওঠা কাপের দিকে।

অর্ধকাপ ফাঁকা করে মেঘ বলল.

— “ইশরা আমি সব শুনেছি। আয়ান সকালে ফোন করে তোমাদের ব্যাপার-টা আমাকে জানিয়েছে।”

আশে পাশের টেবিলগুলো ফাঁকা। তবুও কিছুটা চাপা স্বরে বলল. — “সব জানিয়েছে।”
মাথা নাড়িয়ে সংক্ষেপে প্রতিউত্তর দিলো মেঘ.– “হম।”

কেটে বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা। অধীর আগ্রহে মেঘের কথাগুলো শোনার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে ইশরা। এই বুঝি বলে উঠলো,– “ইশরা আমি তোমাকে ভালবাসি। এই থেকে বড় সত্যি আর কিছু নেই। তুমি আমার কাছে ফিরে এসো। এতেই সন্তুষ্ট আমি।”
কিন্তু ইশরাকে হতবাক করে দিয়ে বিপরীত বাক্য উচ্চারণ করলো মেঘ.

— “ইশরা! তোমাদের বিয়েটা যেহুতু হয়ে গেছে, এখন সেটাতেই ফোকাস করো। আমি একজন সাধারণ মানুষ আর সাধারণ একজনের সাথেই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই।”

ভাবনার মাঝে ডুবে কফির কাপে চুমুক দিয়েছিলো ইশরা। মেঘের কথা হালকা হয়ে এলো হাতে বাঁধন। কফির কাপ পড়লো না তবে অধরের বেশ কিছুটা অংশ সাক্ষী হলো সেই কষ্টদায়ক ব্যাপারে। দু ঠোঁট চেপে সেই কষ্টটা দমিয়ে রাখল। তবে মেঘের দেওয়া আঘাতটার সহ্য ক্ষমতা হলো না। বিরবির করে উচ্চারণ করলো, “দ্বিতীয় আঘাত।”
সেদিন আয়ানের দেওয়া সিগারেটের ছ্যাকার সাথে ছিল প্রথম বেদনা আর কফির সাথে দ্বিতীয় আঘাত। অস্ফুট স্বরে বলল.

— “মেঘ আমি অতি সাধারণ একটা মেয়ে।”

— “ছিলে, এখন নেই। এখন তোমার দেহের প্রতিটি স্পর্শ আয়ানকে ঘিরে। ব্যবহৃত কিছু আমি ব্যবহার করি না।”

দৃঢ় মনোবল সঞ্চয় করে ইশরা। অশ্রুসিক্ত নয়নে মেঘের দিকে তাকি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল.– “আমি ব্যবহৃত জিনিস মেঘ।”

— “তা নয়তো কি! তোমাদের বিয়ে হয়েছে। কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেছে। এখনো আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, তুমি ভার্জিন। তোমাদের মাঝে কিছু হয় নি।”

পরের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে উঠলো ইশরার কাছে। নয়ন জোড়া বেষ্টিত করে নিল ঘন কালো অন্ধকারে। নিজেকে সংযত করে উঠে দাড়ালো সে! ব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার নোট বের করে রেখে দিলো কাপের নিচে। ব্যাগটা কাঁধে তুলে বলল.

— “তুমি সোজাসুজি বললেই পারতে। তুমি ভার্জিন চাও আমাকে নয়। তাহলে অন্তত এতো সময় নষ্ট হতো না।”

মনে কোণে জমে থাকা অভিযোগগুলো নিজের সাথে নিয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো ইশরা। ক্লান্ত শরীরটা এই অভিযোগ গুলোর ভাড় বইতে পারছে না।

__________
বাইরে বৃষ্টির ধারা বহমান। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টির বেগ বেড়ে চলেছে। ভিজে বাড়িতে ফিরেছে আয়ান। আলোকহীনতায় নিস্তেজ হয়ে আছে তার প্রিয় ঘরটা। ইশরার জন্য কিনে আনা জামা কাপড়ের শপিং ব্যাগগুলো বেডের উপর রেখে দিল। সুইচ অফ করে অন্ধকারের আবরন সরিয়ে দিলো। কিন্তু কোনো রুপ লাভ হলো না। প্রচন্ড শব্দে ভাঁজ পড়লো অদূরে। বিদ্যুৎ চলে গেল মুহূর্তেই। ফ্রেশ হতে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল আয়ান।

মিনিট পাঁচেক পর বেরিয়ে এলো সে। বেডের উপর পড়ে থাকা ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে পুরো রুমে নজর বন্দী করে নিল। ক্লান্ত নজরে দৃষ্টি গোচর হলো না ইশরাকে। সময় অবিলম্ব না করে টর্চের আলোয় রুম প্রস্থান করলো সে।

তিথি খাবারের টেবিল স্বযত্নে গুছিয়ে নিচ্ছে। অনেকক্ষন যাবৎ তনয়াকে ডাক দিচ্ছে, কিন্তু তার দেখাই নেই। হয়তো বজ্রপাতে তার ডাক দোতলায় অবস্থান করা তনয়ার ঘর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। মাঝপথে দেখা হলো আয়ানের সাথে। সেও তড়িগড়ি করে নিচে ছুটছে। তিথি কে দেখে সামনে এসে দাড়ালো আয়ান। সংকোচ নিয়ে কিছুক্ষণ আমতা আমতা করলো সে। অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেন তিথি। বিরক্তিকর কন্ঠে বললেন.

— “আয়ান ফাজলামো না করে, সামনে থেকে সর

সরলো না আয়ান। ইতোহস্ত বোধ করে বলল..

— “মা, ইশরাকে দেখেছো?”

— “জানি না মেয়েটার কি হয়েছে। ভার্সিটি থেকে ফিরে দরজা বন্ধ করে বসে ছিল। এখন হয়তো দরজা খুলেছে। হয়তো তোদের মাঝে সমস্যা ছিল। যা মিটিয়ে নে.

চলে গেলেন তিথি। আয়ানও সময় অবিলম্ব না করে রুমে প্রবেশ করলো। অন্ধকার রুমে পুনরায় নজর দিলেন। নজরে এলো না কাউকে। তদানিং বজ্রপাতের আলোয় পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। বেলকেনিতে ছায়ামূর্তি নজরে এলো তার। এগিয়ে গেল সেদিকে। বেলকেনির প্রবেশদ্বার খুলতেই দমকা হাওয়ায় পিছিয়ে গেল সে। ফোঁকট দিয়ে মাথা হেলিয়ে আবার উঁকি দিলো সেদিকে। বেলকেনির প্রতিটি কোণা ভিজে চুপচুপ হয়ে আছে। সেখানে মানুষের থাকার কোনো অবকাশ নেই। প্রবেশদ্বার বন্ধ করে ভেতরে যেতেই কাশির শব্দ শ্রবণপথে এলো আয়ানের। থেমে গেল চরণ। কাশির শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে গেল সে। তদানিং বজ্রপাতের আলোয় ইশরার দেখতে পেল আয়ান। মাথা হাঁটুতে মুড়িয়ে বসে আছে দেয়াল ঘেঁষে। ঘন কালো কেশের জন্য মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে না। ইশরার মুখোমুখি বসে, স্বল্প ধাক্কা দিলো। কেঁপে উঠলো সে। কম্পনের মাত্রা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে গেল। মাথা তুলে আয়ানকে গভীর ভাবে অবলোকন করলো। একদম বিধস্ত লাগছে তাকে। অগোছালো চুলগুলো পুরো শরীরে ছড়িয়ে আছে। চোখগুলো টকটকে রক্তিম। এই ইশরাকে কখনো দেখে নি সে। কিছু বলার আগেই হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো আয়ানের উপর।

__________ যদি শব্দ-বিহীন এক যুগল নয়নই অজস্র কথার উৎস হয়,
তাহলে বর্ণ-গুলোর ব্যবহার ভিত্তিহীন।
— ইফা 🌿

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)