#অপরাজিতা_২(অপরাজিতা গল্পের পরের অংশ)
#৭ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
রাজিতার প্রশ্ন শুনে নেহা ওকে অবাক করে দিয়ে বলে,
–“কারণ সিনান তোকে পছন্দ করতো! আর তোর অন্যকারো সাথে বিয়ে হয়ে গেছে দেখে রাগে ও এমনটা করেছে!”
রাজিতা গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে নেহার দিকে রাগে ক্ষুদ্ধ হয়ে তাকায়৷ আনানতো আরো রেগে গেছে। ও গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। রাজিতা নেহাকে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,
–“সিনান যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য! কিন্তু তুই কি করে জানলি যে, ও আমাকে পছন্দ করে?”
–“কারণ ও আমাকে একদিন বলেছিল৷”
–“আমার বিয়ের আগে না পরে?”
–“তোর বিয়ের আগেই বলেছিলো।”
–“কিন্তু আমাকেতো কখনো বলেনি। ”
–“কারণ আমি বলেছিলাম যে, তুই কারো সাথে রিলেশনে যাবি না!”
–“তো তুই আমাকে জানাস নি কেন আগে?”
রাজিতার এমন কথা শুনে আনান ওর হাতটা ধরে নিজের দিকে নিয়ে বলে,
–“জানালে কি করতে? রাজি হয়ে যেতে বুঝি?”
আনান রাজিতার হাত ধরায় আরো সবাই ওদের দিকে তাকায়। আনান সবার তাকানোর ভঙ্গি দেখে রাজিতার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
–“যা হওয়ার হয়ে গেছে। নিউজটা ডিলিট হয়ে গেছে। এইবার বাসায় চলো।”
রাজিতা জবাব দেয়,
–“সিনানের সাথে আমার কথা আছে। ও কেন এমনটা করলো! কেউ কাউকে পছন্দ করলে তার ক্ষতি করতে পারে?”
নেহা বলে উঠে,
–“হয়তো রাগে!”
–“কিন্তু আমার উপরে ওর কিসের রাগ! আমিতো ওর কোনো ক্ষতি করিনি! আমিতো ওকে বন্ধু ভেবেছিলাম!”
আনান গাড়ির দরজা খুলে ওকে গাড়ির মধ্যে যেতে বলে। তারপর নেহাকে বিদায় জানিয়ে ও নিজেও গাড়িতে গিয়ে বসে৷ ও এমন কিছুই সন্দেহ করছিলো তাই নেহার কথায় অবাক না হয়ে রাজিতাকে সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রাজিতা ভীষণ ভেঙে পড়ে এটা ভেবে যে, ও যাকেই বিশ্বাস করে সেই বিশ্বাস ভেঙে দেয়!
আনানদের গাড়িটা চলে যেতেই নেহার চোখেমুখে একটা বিজয়ের হাসি ফুঁটে উঠে। সিনান আর রাজিতা দুজন দুজনকে খুব ভালো বন্ধু ভাবতো! ও সবটা নষ্ট করে দিয়েছে!
আসলে নেহা, রাজিতা আর সিনান খুব ভালো বন্ধু ছিল৷ নেহা সিনানকে পছন্দ করলেও একদিন সিনান নেহাকে জানায় যে, ও রাজিতাকে প্রপোজ করতে চায়। নেহা ওকে বলে যে, রাজিতার অলরেডি বয়ফ্রেন্ড আছে। এতে সিনান রাজিতাকে আর প্রপোজ করে না। ভালো বন্ধু হিসেবেই থাকতে চায়। কিন্তু নেহার এটা সহ্য হতো না।
কাল ও সিনানকে ওর মনের কথা জানালে সিনান জানায় যে, নেহাকে ও শুধু ওর বন্ধু হিসেবেই দেখে! এর বাইরে আর কিছুই না! এইটা নেহা মেনে নিতে পারেনা৷ ওর এক হ্যাকার বন্ধুকে দিয়ে সিনানের আইডি হ্যাক করে নেয়। আর সকালে উঠেই আনান আর রাজিতার ছবিসহ নিউজটা ছড়িয়ে দেয়! আর সেই ছবিগুলোই দেয় যেগুলো সিনান ওকে পাঠিয়েছিলো!
রাজিতার মন খারাপ দেখে আনানের হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হতে থাকে৷ মেয়েটা কাঁদছে না। তারমানে কষ্টগুলো ভেতরে চেপে রাখার চেষ্টা করছে। এমন করলেতো আরো বেশি কষ্ট পাবে! তাই আনান রাজিতার হাত দুটো ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে থাকে,
–“আরে একটা নিউজ-ইতো! কিছুই হবে না। সবাই একটু মজা করতে পারলো আর কি! আমরাতো বিবাহিত! কে কি বলল না বলল সেদিকে নজর দিতে হবে না! বাদ দাও!”
এতক্ষণ নিজের অনুভুতিগুলো জমিয়ে বরফের মতো শীতল আর কঠিন বানিয়ে রেখেছিলো রাজিতা। আনানের ভালবাসার একটু উষ্ণতা পেতেই তা গলে গেলো। রাজিতা কান্না করতে-করতে বলল,
–“সিনানও আমাকে বন্ধু ভাবে না? কেন সবাই আমার সাথে এমন করে? আমিতো কখনো কারো ক্ষতি চাইনা! তাহলে আমার সাথেই কেন সবাই এমন করে!”
আনান রাজিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
–“তোমাকে এখন কার মতো লাগছে জানো?”
রাজিতা আনানের সাথে তাল মিলিয়ে নির্মল স্বরেই আস্তে করে বলে,
–“কার মতো!”
–“বটগাছে থাকা পেত্নীদের মতো!”
–“তুমি কি বটগাছে থাকা পেত্নীদের দেখেছো নাকি? আর আমি পেত্নী হলে তুমি ভূত!”
আনান একটা হাসি দিয়ে বলে,
–“তোমার মতো পেত্নীর জন্য আমি হাজারবার ভূত হতেও রাজি আছি!”
রাজিতার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। আনান মিজানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“আজ কিন্তু আমরা আমাদের স্পেশাল জায়গায় যাবো! ক্লাসতো করা হলো না! ওখানেই দিনটা কাটিয়ে দেবো!…৷ আর কিছুদিন পরতো ঘুরতে যাচ্ছিই! মনে আছেতো মহারানীর?”
শেষের কথাগুলো আনান রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল। মিজান মুচকি হাসলো৷ কারণ ও জানে যে ওদের স্পেশাল জায়গা কোনটা। রাজিতা বলল,
–“হুম মনে আছে৷ আর থ্যাংকস আজকের জন্য! কিন্তু আমি যে ওদের বলেছিলাম যে, নেক্সট যাওয়ার সময় পুডিং বানিয়ে নিয়ে যাবো! তার কি হবে! ওরাতো আমাকে দেখলেই ছুটে আসবে! আর ভাববে যে ওদের জন্য পুডিং বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি!”
–“তুমি আমাকে থ্যাংকস দিচ্ছো! বাপরে বাপ! আচ্ছা ঠিক আছে। আর পুডিং খাবেতো ওরা? তার ব্যবস্থা আমি করছি! তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা! ”
রাজিতা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে দেখে আনান নিজেও কিছুটা স্বস্তিবোধ করলো।
দুপুর পর্যন্ত বাচ্চাদের সাথে মজা করে আনান আর রাজিতা বাসায় ফিরলো৷ বাসায় ফিরে দেখলো যে, শিমলা ভাবি ওদের বাসায় আনানের মায়ের সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছে। আনান আর রাজিতা বাসায় প্রবেশের সাথে-সাথে ওর মা আনানকে জিজ্ঞেস করলো,
–“তোকে আর রাজিতাকে নিয়ে নাকি কি নিউজ বের হয়েছেরে, আনু? শিমলা এসব কি বলছে?”
আনান রাজিতাকে রুমে যাওয়ার ইশারা করে শিমলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“কি হয়েছে ভাবি? আপনি কোন নিউজের কথা বলছেন?”
শিমলা ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল,
–“একটু আগেও আমি একটা নিউজ দেখলাম। তোদের দুজনের ছবি ছিল। কি যেন একটা শিরোনাম ছিল…”
আনান ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–“আরে ভাবি আপনি কি দেখতে কি দেখেছেন কে জানে! আমরা কি কোনো সেলিব্রেটি নাকি যে আমাদের নিউজ আসবে!”
শিমলা কিছু বলার আগেই ওর মা বলে উঠলো,
–“আমিওতো সেটাই বলছি! ওদের নিয়ে যদি নিউজ হয়েও থাকে তাহলে মুহুর্তের মধ্যে সেটা উধাও হলো কি করে?”
শিমলা আমতা-আমতা করে বলল,
–“আমিওতো সেটাই ভাবছি! উধাও কি করে হলো? তাহলে নিশ্চয়ই এই শিরোনাম আর ছবির সব নিউজ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কেউ ডিলিট করে দিয়েছে।”
তারপর আশাভঙ্গের মতো শিমলা আনান আর ওর মায়ের কাছে সরি বলে বাসায় চলে গেলো।
কেটে গেছে কয়েকটা দিন। রাজিতা ভার্সিটি গিয়ে চুপচাপ থাকে৷ কারো সাথে তেমন কথা বলে না। সিনানের ধারে-কাছেও যায় না। সিনান প্রথম কয়েকদিন চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে রাজিতার সাথে কথা বলার আশা ছেড়ে দিয়েছে। আনানও ওকে বারণ করবছে রাজিতার সাথে কথা বলতে।
সিনান আর রাজিতার মনোমালিন্য দেখে নেহা ভীষণ খুশি। যদিও উপরে-উপরে ওদের জন্য আফসোস করছে৷ সিনান আর রাজিতার কাছে আজও অজানা যে, সেদিনের ওই কাজটা নেহা করেছিল!
তুবা আর নিয়নের বিয়ের কথা চলছে। রাজিতা ওর চাচার বাসায় এসেছে আজ। আনানের কাজ থাকায় ও আসতে পারেনি।
রিমির সাথে আর কথা বলেনি রাজিতা। রিমি কথা বলতে চাইলে রাজিতা ওকে এড়িয়ে যায়৷ নিলা আর নিশাদও এসেছে। রাজিতা বসে নিলার সাথে সাংসারিক গল্প শুরু করে দেয়। নিলা বলে,
–“তুই সংসার সামলিয়ে ক্লাস, পরীক্ষা আর পড়াশোনা কীভাবে করিসরে রাজি! আমিতো কয়দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছি!”
রাজিতা হাসতে-হাসতে বলে,
–“সব কাজ বুঝি তোমাকেই করতে হয়?”
–“আরে না! মায়ের সাথে রান্নাবান্নায় টুকিটাকি হেল্প করি! আমি কি রান্না-বান্না তেমন পারি নাকি! তবে আস্তে-আস্তে শিখছি। মায়েরতো বয়স হচ্ছে। একমাত্র বউ হিসেবে আমাকেইতো সব করতে হবে!”
–“তাতো অবশ্যই! আমিও মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে হেল্প করি। তবে নিয়তি আন্টি আর মা আমাকে বেশি যেতে দেয় না রান্নাঘরে! আর ক্লাস, পড়াশোনা থাকে বলে আমিও জোরাজুরি করি না!”
–“জানিস ওই বাড়িতে গিয়ে একটুর জন্যও খারাপ লাগে না! নিশাদের মা-বাবা একদম আমার মা-বাবার মতোই আদর করে। আর রিমাও ছোটবোনের মতো আমার আশেপাশেই থাকে! তবে মা মাঝেমধ্যে একটু বকাঝকা করে!”
–“কেন?”
–“আরে কাজে এত ভুল করি! উনি তাও কম বকেন। আমার মা হলেতো আরো কথা শুনাতো। যে ভালবাসে তার শাসনটুকুওতো নিতে হবে নাকি!”
বলেই হেসে ফেলে নিলা। আর রাজিতাও হেসে ফেলে৷ তখন নিশাদ রুমে ঢুকে বলে,
–“দুই বউরানীর কি গল্প হচ্ছে শুনি! আমাদের কি বলা যাবে!”
রাজিতা আমতা-আমতা করে বলে,
–“তেমন কিছু না ভাইয়া। আপনারা বসুন, আমি আসছি একটু!”
–“আরে শালী! সরি ভাবি! কোনটা রেখে কোনটা বলব! বসো। চলে যাচ্ছো কেন?”
–“না, দেখি আনান আসলো কিনা! ওর আসার কথা আছে।”
বলেই রাজিতা নিলার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। ও রিমির রুমের পাশে যেতেই নিয়ন আর রিমির কথা শুনতে পায়। কি নিয়ে আলোচনা করছে বুঝতে না পেরে রিমির দরজার কাছে যেতেই দরজাটা খুলে যায়। ও চলে আসতে গেলে নিয়ন ওকে লক্ষ্য করে বলে,
–“রাজি তুই-ই ওকে একটু বুঝা! আমার কথা শুনছে না!”
আসলে নিয়ন এখনো জানে না যে, রিমি আর রাজিতার মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। রাজিতা রিমির সাথে কথা বলছে না। রাজিতাও এ ব্যাপারে কিছু বলে না। সেইদিনের বিষয়ে কথা বলার আর কোনো ইচ্ছে রাজিতার নেই। কিন্তু নিয়ন ওকে কি বুঝাতে বলছে তার কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
–“কি বুঝাবো আমি?”
চলবে…?