#অপরাজিতা_২(অপরাজিতা গল্পের পরের অংশ)
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
“ক্লাসরুমে শিক্ষককে প্রপোজ! অত:পর বিয়ে!”
নিউজটা দেখার সাথে-সাথেই রাজিতা আনানের রুমে চেয়ারের উপর ধপ করে বসে পড়ে! আনানতো রেগে আগুন হয়ে আছে৷
–“দেখেছো এইবার? সবকিছুকেই তোমার মজা মনে হয় তাইনা? ”
রাজিতা নিউজটার কমেন্টগুলো পড়ে আরো হতাশ হয়ে যায়!
–“এইরকম মেয়ের জন্যই পুরো মেয়ে জাতির বদনাম হয়! ”
–“কি বেহায়া মেয়েরে বাবা! স্যার হচ্ছে সম্মানিত ব্যক্তি! আর তাকে কিনা ভরা ক্লাসে প্রপোজ করে!”
–“এইসব মেয়েদের জন্যই মা-বাবা তাদের সন্তানকে ভার্সিটি পাঠাতেও ভয় পায় এখন!”
–“এত সুন্দর ছেলে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি! ভুলেই গিয়েছিলো যে, এটা স্যার! আর এতো সুন্দর স্যার হলে যে কেউ এটা ভুলে যাবে!”
–“মেয়েটার সাহস আছে! আই লাইক ইট!”
–“মেয়েটাও কিন্তু জোশ! নইলে কি আর স্যার পটে গিয়ে বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়!”
–“এমন মেয়ে প্রপোজ করলে কেইবা রিজেক্ট করবে!”
–“প্রপোজ কি শুধু ছেলেরাই করবে নাকি! মেয়েদেরও করা উচিৎ! ঠিক-ই আছে!”
–“প্রপোজ করছে ঠিক আছে! কিন্তু ক্লাসরুমে ব্যাপারটা কেমন যেন!”
–“জুটিটা কিন্তু দারুণ!”
–“এমন মেয়ে আমার ভাগ্যে যদি থাকতো! জীবনটা সার্থক হতো!”
–“মেয়েটাকে দেখে আমাদেরও শেখা উচিৎ! ”
–“আরে ভাই হতে পারে এটা র্যাগিং ছিলো! সবাই শুধু মেয়েটাকেই দোষ কেন দিচ্ছো ভাই! আমারতো মনে হয় মেয়েটা বাধ্য হয়ে কাজটা করেছে!”
এতো-এতো কমেন্টের ভীড়ে এই একটা কমেন্ট রাজিতার পছন্দ হলো৷ আসলেইতো ব্যাপারটা র্যাগিং টাইপেরইতো ছিলো! কিন্তু সেখানে এসেও অনেকে বাজে রিপ্লাই দিয়েছে!
তবে অনেকেই যে পজিটিভ কমেন্ট করেছে এটা দেখে রাজিতা কিছুটা স্বস্তি পেলেও আনান প্রচুর রেগে আছে! ওর বউকে অন্য সবাই শুধু দেখছে তা নয়! তাকে নিয়ে অনেকে বাজে-বাজে কমেন্টও করছে৷ কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিউজটা ভাইরাল হয়ে গেছে! মানুষ ভালো জিনিসের থেকে খারাপ জিনিস নিয়েই বেশি মাতামাতি করে থাকে!
আনান রাজিতার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ওর এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে ফোন করে বিষয়টি জানিয়ে বলল,
–“যতদ্রুত সম্ভব এই নিউজটা ডিলিট করে দিবি! যা করতে হয় কর! এই নিউজটা আমার চোখে যেন আর না পড়ে। ”
রাগে সারা রুমে পায়াচারি করতে থাকে আনান। আনানের এইরূপ দেখে রাজিতা অনেক ভয় পেয়ে যায়৷ কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না । আনান রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“জানো এই নিউজটা প্রথম কে দিয়েছে?”
রাজিতা আমতা-আমতা করে বলে,
–“কে দিয়েছে?”
–“তোমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু! সিনান! সিনানের আইডি থেকেই নিউজটা প্রথমে পাওয়া গেছে!”
রাজিতা বসা থেকে উঠে বলে,
–“অসম্ভব! সিনান এই কাজ কখনো করতে পারে না! ওকে আমি তিন বছর ধরে জানি! তুমি ভালো করে দেখেছোতো?”
–“তো আমি কি তোমায় মিথ্যা বলছি? আমাকে এখন মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চাইছো? ওই সিনানের উপরে তোমার এত বিশ্বাস? ”
রাজিতা ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে জন্য নিজেই নিজেকে গালি দিতে থাকে। তারপর আনানকে শান্ত করার জন্য বলে,
–“আমি কথাটা ওভাবে বলিনি। আমিতো…”
ওকে থামিয়ে দিয়ে আনান বলে,
–“তা তুমি কীভাবে কথাটা বলেছো? আমি তোমাকে বারবার বলেছি যে, সবার থেকে সাবধানে থাকবে! নাহ! তুমিতো দয়াবতী! যে যাই করুক না কেন একটা সরি বললেই সাত খুন মাফ করে দাও! ”
রাজিতা গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
–“সিনান এই কাজটা করে থাকলে আমি কখনো ওকে ক্ষমা করবো না! ”
–“ঢং! দেখা যাবে একটু পর এসে বলবে, ‘ সরি রাজিতা! আমার ভুল হয়ে গেছে! আসলে নিউজটা আমি দেইনি! আমার আইডি হ্যাক হয়ে গেছে! কে দিয়েছে ছবিগুলো আমি জানিনা! আমাকে মাফ করে দে! আমার উচিৎ ছিলো ছবিগুলো ডিলিট করে দেওয়া!’ আর তখনি তুমি ‘ ইটস ওকে’ বলে দয়াবতীর মতো হাসতে-হাসতে ক্ষমা করে দেবে!”
রাজিতা এইবার আনানের উপরে রেগে গিয়ে বলে,
–“আমাকে তোমার কি মনে হয়? হার্টলেস? নাকি ইমোশনলেস? দুঃখ-কষ্ট, মন খারাপ এগুলো কি আমার নেই নাকি! আমি কেন ওকে ক্ষমা করতে যাবো! যদি ও এত বড় একটা ভুল করেই থাকে!”
আনান কিছুটা শান্ত হয়ে বলে,
–“ইটস ওকে! তুমি বুঝতে পারছো না আমার মাথা এখন কতটা গরম হয়ে আছে! ওই সিনানকে এখন সামনে পেলে কি যে করবো আমি নিজেও জানিনা!”
একথা বলতে না বলতেই আনানের অফিসরুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। আনান দরজা খুলে সিনানকে দেখতে পেয়েই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। সিনানের দিকে আনানকে যেতে দেখেই রাজিতা আনানের সামনে গিয়ে বলতে থাকে,
–“প্লিজ শান্ত হোন! এখানে বসুন!”
রাজিতা আনানকে তুমি করে বললেও ভার্সিটিতে সবার সামনে আপনি করেই বলে! হাজার-হোক শিক্ষক বলে কথা!
রাজিতার কথায় আগুন চোখে আনান রাজিতার দিকে তাকায়৷ সিনান রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,
–“রাজিতা!তোকে কীভাবে সরি বলবো বুঝতে পারছি না! আসলে আমার আইডি থেকে তোর ওই নিউজটা আমি দেইনি! বিশ্বাস কর! কাল রাত থেকে আমি আমার আইডিতে লগ-ইন করতে পারছিলাম না! আমার আইডি হ্যাক হয়ে গেছে! কে দিয়েছে ছবিগুলো আর কেনই বা দিয়েছে আমি কিচ্ছু জানিনা! আমি বুঝতে পারিনি ওই ছবিগুলোর জন্য এতকিছু হয়ে যাবে! আমাকে মাফ করে দে! আমার উচিৎ ছিলো ছবিগুলো তখনি ডিলিট করে দেওয়া!আমিতো শুধুমাত্র তোদের স্মৃতি হিসেবে ছবিগুলো রেখে দিয়েছিলাম! আমি কখনোই এমনটা চাইনি!আমি আমার এক বন্ধুকে বলেছি পোস্টগুলো সব জায়গা থেকে ডিলিট করে আমার আইডিটা ঠিক করে দিতে! ওর হ্যাকিং সমপর্কে অনেক জানাশোনা আছে! দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে! সরি রাজিতা!”
সিনানের কথাগুলো শুনে রাজিতা আনানের দিকে তাকায়। আনান হাতের মুঠো শক্ত করে পাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যে, সিনানকে এক্ষুনি একটা ঘুষি মেরে দেবে৷ কিন্তু আনান সিনানের গায়ে হাত তুললে সেটা নিয়ে আবার আরেক ঝামেলা সৃষ্টি হয়ে যাবে। তাই রাজিতা সিনানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“প্লিজ সিনান, তুই এখন এখান থেকে চলে যা! আমি তোর এইসব এক্সকিউজ শুনতে চাইনা!প্লিজ তুই চলে যা এখান থেকে।”
–“প্লিজ রাজিতা, বোঝার চেষ্টা কর! আমি কোনো এক্সকিউজ দেখাচ্ছি না! সত্যি বলছি! আমার আইডিটা…”
এটুকু বলতেই আনান সিনানকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“রাজিতা তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছে! কানে যাচ্ছে না কথাটা! তারপরেও এখানে বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছো!আর কক্ষনো যেন তোমাকে রাজিতার আশেপাশে না দেখি!”
–“স্যার প্লিজ!”
রাজিতা এইবার ধমকের সুরে সিনানকে বলে,
–“তুই যাবি এখান থেকে!”
তারপর মাথাটা নিচু করে সিনান ওখান থেকে চলে যেতেই আনান রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“যাও ব্যাগ নিয়ে আসো। ”
–“কেন?”
–“বাসায় চলো!”
–“কিন্তু ক্লাস!”
–“এখনো তোমার মাথায় ক্লাসের চিন্তা! যাও তাড়াতাড়ি। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি!”
রাজিতা বের হয়ে যেতেই আনান নিজের অফিসরুমে তালা দিয়ে আজ আর ক্লাস নেবে না বলে গাড়িতে গিয়ে রাজিতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে৷ আর রাজিতার দেরি হচ্ছে জন্য রাগে ফুসতে থাকে।
রিমি ভার্সিটি থেকে বের হয়ে তুহিনকে দেখতে পায়। ও তুহিনকে এড়িয়ে চলে যেতে লাগলে তুহিন ওর হাত ধরে বলে,
–“সরি রিমি! আমার তোমার সাথে এমনটা করা উচিৎ হয়নি! আমাকে মাফ করে দাও। প্লিজ…”
বলেই রিমির হাত ছেড়ে সবার সামনেই ও দুইহাতে নিজের কান দুটো আলতো করে ধরে সরি বলতে থাকে রিমিকে৷ রিমি মলিনমুখে একটা হাসি দিয়ে বলে,
–“সরি! তোমার কি মনে হয় তুহিন? তোমার এইকাজটা ক্ষমার যোগ্য?”
–“প্লিজ! আমি আর কখনো এমন করবো না!”
–“তোমার বোনের সাথে আমার ভাইয়ের কি হয়েছিল না হয়েছিল তা না জেনেই তুমি আমার উপরে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে তাইনা? এখন তুমি আমার সাথে যেটা করেছো এটার জন্য আমার ভাই যদি তোমার বোনকে বিয়ে না করে?”
তুহিন আবার রিমির হাত ধরতে গেলে রিমি এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তুহিন দুইহাত জোর করে বলতে থাকে,
–“প্লিজ রিমি, আমার শাস্তি তুমি আমার বোনকে কেন দিবে!”
রিমি একগাল হেসে বলে,
–“এই কথা কি তুমি বলছো তুহিন? ভাইয়ের শাস্তি বোন কেন পাবে? তাহলে আমিই কেন? আমার সাথে কি করেছো তুমি?”
–“সরি! ”
–“তোমার সরি তোমার কাছেই রাখো! আর ভালোভাবে নিজের বোনের বিয়ে দেখতে চাইলে আমার সাথে কোনোরকম কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না!”
একথা বলায় তুহিন চুপচাপ ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ আর রিমি ওখান থেকে চলেই যাচ্ছিলো তখন রনকের সাথে দেখা হয়ে যায়। রনক রিমিকে দেখে অবাক চোখে প্রশ্ন করে,
–“আপনি রিমি না?”
রিমি রনকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিনতে পারলে বলে,
–“হ্যাঁ, আর আপনি রনক! তাইনা?”
রনক হেসে বলে,
–“হ্যাঁ, আমার কথা আপনার মনে আছে দেখছি!”
–“হুম, আমি আবার সহজে কিছু ভুলি না! তা আপনি এখানে?”
–“আমার ভার্সিটি! আমিতো এখানেই পড়তাম! তুমি?”
–“আমিওতো এখানেই পড়ি! কোনো দরকারে এসেছেন?”
–“না, বাইরে থেকে এসেছি! তাই স্যার আর জুনিয়রদের সাথে একটু দেখা করতে আসলাম আর কি! তুমি চাইলে এখন থেকে তোমার সাথেও দেখা করতে চলে আসবো!”
–“কি যে বলেন না! আর আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন! সিনিয়রের মুখে আপনি ডাক শুনতে কি আর ভালো লাগে!”
–“অনুমতি পেলেতো বলতেই পারি!”
বলেই হেসে ফেলে রনক। রিমি পিছনে ফিরে তুহিনকে একবার দেখে নেয়। ও তখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে দেখে রনকের সাথে আরো হেসে-হেসে কথা বলতে থাকে।
তুহিন রিমিকে অন্য একটা ছেলের সাথে হেসে কথা বলতে দেখে মন খারাপ করে ওখান থেকে চলে যায়।আর রিমিও রনকের সাথে গল্প করতে-করতে আবার ভার্সিটি চলে যায়।
রাজিতা গাড়ির কাছে আসতেই দেখতে পায় যে, আশেপাশের অনেকগুলো চোখ তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ও তাড়াতাড়ি করে গাড়ির দরজা খুলতেই নেহা দৌড়ে ওর সামনে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলে,
–“রাজিতা….ওয়েট! তুই কি জানিস সিনান এসব কেন করেছে?”
রাজিতা অবাক হয়ে ওখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর নিরবভাবে বলে,
–“কেন?”
চলবে…?