অপরাজিতা ২ পর্ব-০৮

0
142

#অপরাজিতা_২(অপরাজিতা গল্পের পরের অংশ)
#৮ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

–“তুহিন ছেলেটা ওকে ভীষণ ভালবাসে! এটাই ও বুঝতে চাইছে না!”

নিয়নের কথা শুনে রাজিতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

–“কিন্তু তুহিনতো রিমিকে ভালই বাসে না! ওতো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য…”

ওকে থামিয়ে দিয়ে নিয়ন বলে,

–“ওয়েট! আমি তোদের একটা রেকর্ডিং শুনাচ্ছি।”

বলেই নিজের ফোন বের করতে থাকে নিয়ন৷ রিমি আর রাজিতা দুজনেই অবাক হয়ে বলে,

–“কিসের রেকর্ডিং? ”

–“তুহিন আমাকে যেটা পাঠিয়েছে তোকে শুনানোর জন্য। তোকেই পাঠাতে চেয়েছিলো, কিন্তু তুইতো ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছিস!”

কথাগুলো রিমিকে উদ্দেশ্যে করে বলে একটা ভয়েস রেকর্ডিং চালু করলো নিয়ন।

“রিমি আমাকে ক্ষমা করে দিও৷ তোমাকে আজ আমি যা বলতে চাই তা হয়তো তুমি বিশ্বাস করতে চাইবে না। তারপরেও তোমাকে বলতে চাই। আমি তোমার সাথে ভালবাসার অভিনয় করতে চাইলেও তোমার ভালবাসার কাছে আমি হেরে যাই। তুমি যেমন আমাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসো তেমনি আমিও তোমাকে মন-প্রাণ উজার করেই ভালবাসি৷ সেদিন তোমার সাথে ওভাবে কথা বলতে চাইনি! কিন্তু বলে ফেলেছি! আমি ভেবেছিলাম যে, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে তোমার ভাই আমার বোনকে মেনে নেবে! আমি জানতাম না যে, তারাতো এমনিতেই একে অপরকে ভালবাসে! আমি শুধু আমার বোনকে হ্যাপি দেখতে চেয়েছিলাম! তোমাকে হার্ট করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। তোমাকে আমি ভালবাসি, এটা কোনো নাটক নয়! বরং সেদিনের ব্যবহার গুলো নাটক ছিল! যেন তুমি তোমার ভাইকে নিয়ে আসো আর আমি আপু আর উনার মধ্যেকার সত্যিটা জানতে পারি! নিজের বোনের ভালো চাওয়াটা কি ভুল কিছু?
সেদিন তোমাকে ওই ছেলেটার সাথে দেখে আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো যে, ছেলেটাকে টুকরো-টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেই! তোমার মুখে হাসি দেখে চলে আসলাম। তুমি এত সহজে আমার ভালবাসা ভুলে অন্যকাউকে ভালবেসে ফেললে? আমিতো তোমাকে ভুলতে পারছি না! প্রতিটি রাত তোমায় ভেবে ঘুমাতে যাই! আর প্রতিটি সকাল তোমায় ভেবেই জেগে উঠি! ভুলতো মানুষেরই হয়! আমাকে আরেকবার সুযোগ দাও! কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমায় হার্ট করবো না! আর তুমি যদি ওই ছেলেটাকে সত্যিই ভালবেসে থাকো তাহলে আমি নিজে তোমার লাইফ থেকে চলে যাবো! অনেক দূরে! তোমার উত্তরের আশায় রইলাম!”

রেকর্ডিং টা শেষ হওয়ার পরেও সবাই চুপ করে আছে। রিমির চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে। ও দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেলো। নিয়ন রাজিতাকে বলতে লাগলো,

–“তুই শুনলিতো সব! তোর কি এখনো মনে হয় যে, তুহিন রিমিকে ভালবাসে না? রিমি অনেক বড় ভুল করছে! কয়েক বছর আগে আমি যে ভুল করেছিলাম! ”

বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিয়ন। তারপর আবার বলে,

–“ছোট্ট একটা ভুল বুঝাবুঝির কারণে সম্পর্ক শেষ না করে সেটাকে কাটিয়ে উঠতে হয়! তাহলেই সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। আর না হলে তা ঘৃণার সাগরে তলিয়ে যায়!”

–“আচ্ছা ভাইয়া আমি চেষ্টা করব রিমিকে বুঝানোর!”

রাজিতার কথা শুনে নিয়ন রাজিতার হাত ধরে বলে,

–“প্লিজ রাজি! একমাত্র তুই-ই পারিস…”

এটুকু বলতে না বলতেই ওখানে আনান এসে হাজির হয়। রাজিতার হাত নিয়ন ধরে আছে দেখে রাগে ধপ করে জ্বলে উঠে আনান। আনানের উপস্থিতি টের পেয়ে রাজিতা নিয়নের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। আনানের রাগী মুখটা দেখে রাজিতা বলে,

–“তুমি কখন এলে? এত দেরি হলো কেন?”

আনান রাগী কন্ঠে বলল,

–“আরেকটু দেরি হলে হয়ত তোমার আরো ভালো হতো!”

–“এসব কি বলছো তুমি? দেরি হলে ভালো হতো মানে?”

–“না তোমাদের পার্সোনাল গল্পে ব্যাঘাত ঘটতো না!”

বলেই ওখান থেকে চলে যায় আনান। নিয়ন কিছু বলতে গেলে রাজিতা ওকে থামিয়ে দিয়ে আনানের পিছনে যেতে থাকে। আনান মেইন দরজার কাছে পৌঁছালে রাজিতা বলে,

–“রুমে চলো! নাকি সবার সাথে দেখা না করেই চলে যাবে?”

দরজা খুলতে-খুলতে আনান বলে,

–“তোমার ইচ্ছে হলে তুমি থাকতে পারো। গাড়ি পাঠিয়ে দিবো তোমাকে নেওয়ার জন্য। ”

বলেই দরজার বাইরে চলে আসে আনান। রাজিতা আনানের রাগ করার কারণটা বুঝে যায়। ও আনানকে শান্ত করার জন্য বলে,

–“তুমি এখনো আমাকে সন্দেহ করো?”

আনান এইবার রেগে গিয়ে বলে,

–“সন্দেহ? তুমি এই চিনলে আমাকে? আমি তোমাকে আগেই বলেছি যে, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি! আর অনেক বিশ্বাস করি! কিন্তু এতকিছু ঘটার পর তোমার আশেপাশের মানুষগুলোকে আমার মোটেও বিশ্বাস হয়না! জানো আমার না সব সময় তোমাকে নিয়ে ভয় হয়! তোমাকে একা ছাড়লেই মনে হয়, এই বুঝি কেউ তোমার ক্ষতি করলো! আমার মনের অবস্থাটা তুমি বুঝতে পারলেতো!”

রাজিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিশাদ বাইরে এসে আনানকে উদ্দেশ্য করে হাসতে-হাসতে বলে,

–“কি ব্যাপার ভাইরা ভাই! গাড়িতে কিছু ফেলে এসেছো মনে হয়!”

আনান কিছু বলার আগেই রাজিতা বলে উঠে,

–“আমাকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছিলো৷…. চলো এবার ভেতরে।”

পরের কথাগুলো রাজিতা আনানকে উদ্দেশ্য করে বলে। আনান নিশাদকে দেখে আরকিছু না বলে ভেতরে চলে যায়। কিন্তু ওখানে বেশিক্ষণ থাকার কোনো ইচ্ছে আনানের নেই৷ তাই একটা মেসেজ এসেছে এমন ভান করে আনান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–“সরি! আমার একটা জরুরি মেসেজ এসেছে৷ এক্ষুনি যেতে হবে। আর বাসায়ও যেতে হবে একটু! আমাদের বের হতে হবে।”

আনানের কথাশুনে সবাই ওদের চলে আসতে আর কোনো বাধা দেয় না। আনান আর রাজিতা সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে আসে। রিমিকে না দেখতে পেয়ে রাজিতা নিলাকে বলল,

–“আপু রিমিকে দেখেছো?”

নিলা এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল,

–“না। অনেকক্ষণ থেকেই ওকে দেখছি না!”

রিমির মা তখন বলল,

–“ওকে তখন ছাদে যেতে দেখলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, এখন ছাদে কেন? ও কিছু না বলেই চলে গেলো। মাঝেমধ্যে মেয়েটার কি যে হয়! বুঝি না বাপু!”

তারপর আনান আর রাজিতা ওখান থেকে চলে আসলো। গাড়িতে উঠার একটু পর রাজিতা আনানকে বলল,

–“মাত্র কাজ শেষ করে আসলে। আবার এখন কিসের কাজ?”

আনান মলিন মুখে জবাব দিলো,

–“কোনো কাজ নেই! তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরবো আজকে!এটাই আমার জরুরি কাজ!”

–“তাই এভাবে চলে আসলে! নিশাদ ভাইয়েরা কি ভাবলো বলোতো! ”

–“তোমার কাছেতো সবার ভাবনাটাই আগে! নিজেকে নিয়ে কখনো ভাবো একটু! সবাইকে এত বিশ্বাস করো, এত ভালবাসো বলেইতো সবাই তোমাকে এতো ধোঁকা দেয়! এখনো সময় আছে! মানুষ চিনতে শিখো! আর নিজের খেয়াল রাখতে শিখো!”

আনানের কাঁধে মাথা রেখে রাজিতা আস্তে-আস্তে জবাব দেয়,

–“আমার খেয়াল যদি আমার নিজেকেই রাখতে হয় তাহলে আনান সাহেব কেন আছেন! তিনিতো আছেন আমার খেয়াল রাখার জন্য! তাই আর নিজের দিকে নজর দেইনা! আর আমি কীভাবে জানব কোন মানুষ কেমন! আমার কি অন্তর দেখার জন্য কোনো মায়াবী চোখ আছে নাকি! থাকলেতো ভালই হতো! সর্ব প্রথম আমি তোমার মনটাই পড়তাম!”

–“সব সময় কি আর কথা দিয়ে কাজ চলে ম্যাডাম! কথাতো ভালই শিখেছেন! ”

বলেই রাজিতার মাথায় আলতো করে একটা চুমু দেয় আনান। তারপর হেসে ফেলে৷ এই মেয়েটার উপরে ও কখনো রাগ করে থাকতে পারবে না! কথা শুনলেই বা মুখটা দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়, সাথে রাগ-অভিমান গুলোও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়!”

আনান আর রাজিতা একটা শপিং মলের সামনে এসে নামে। তারপর কিছুক্ষণ শপিং করে। আনান আর রাজিতার নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পরে রাজিতা ওর শশুর আর শাশুড়ীর জন্য কিছু জিনিস নেয়। তারপর আনানের মামাতো ভাইয়ের ছেলে শিমুলের জন্যও একটা ড্রেস নেয়।

শপিং শেষে আনান রাজিতাকে নিয়ে একটা সিনেমা হলে যায়। বিয়ের পর এই প্রথম ওরা একসাথে সিনেমা হলে বসে মুভি দেখে। রাজিতা আজ আনানের সাথে অনেক মজা করে।

মুভি শেষ হতে-হতে রাত হয়ে যায়। আনান ওর মাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে, ওরা আজ বাইরে ডিনার করবে। আর উনাদের জন্যও বাইরে থেকেই খাবার নিয়ে যাবে। ওর কথা শুনে রাজিতা পাশ থেকে বলে,

–“মা-বাবার জন্য নিয়ে যাবে যখন আমাদের খাবারটাও নিয়ে চলো!”

আনান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

–“কেন?”

–“সবাই একসাথে খাওয়ার মজাই আলাদা!”

তারপর রাজিতার কথা শুনে আনান তাই করে। তারপর বাসায় গিয়ে সবাই একসাথে ডিনার করে। আর রাজিতা সবাইকে সবার গিফটগুলো দিয়ে দেয়। ওর শশুর শাশুড়ী অনেক খুশি হয়৷

আজ সারাদিন রাজিতা আর আনান যেমন মজা করেছে তেমন ক্লান্তও হয়েছে। দুজনেই ফ্রেস হয়ে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ে। রাজিতা আনানের মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে জিজ্ঞেস করে,

–“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

আনান ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর দেয়,

–“কাল বলো৷ আজ খুব ঘুম পাচ্ছে। তুমিওতো বললে ঘুম পাচ্ছে! এখন শোয়ার পরে ঘুম পালিয়েছে নাকি?”

–“হুম! এখন আর ঘুম পাচ্ছে না! আর আমি জেগে থাকতে তোমাকে ঘুমোতে দেই কি করে!”

–“দিস ইজ নট ফেয়ার! আমি কিন্তু কখনো এমনটা করিনা! প্লিজ এখন ঘুমাতে দাও! তোমার যত যা জানার আছে কাল বলো!”

–“না! আমার আজকেই জানতে হবে। নইলে ঘুমাতে দেবো না এটাতো জানোই!”

আনান ঘুম জড়ানো কণ্ঠেই চোখ না খুলে বলে,

–“আচ্ছা বলো। কি এমন জানতে চাও!”

–“তোমার আর সুবহার ব্যাপারে! ”

রাজিতার মুখে সুবহার নামটা শুনেই আনান লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়ে। তারপর রাজিতাকে উঠিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

–“তুমি ঠিক আছো? আবার কি কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? বলো?”

রাজিতা আনানকে শান্ত করে বলে,

–“আরে শান্ত হও! আমার কিছুই হয়নি! আর নাতো কেউ কিছু বলেছে! আমিতো এমনিই জানতে চাইলাম! তোমার আর সুবহার লাভ স্টোরিটা আমার খুব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

–“আর কখনো এই কথা মুখে আনবে না! তুমি পাগল হয়ে গেছো!”

–“না আমি সত্যিই শুনতে চাই৷ প্লিজ!”

–“তুমি সহ্য করতে পারবে না।”

–“পারবো। বলো তুমি!”

–“পারবে না। কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ”

রাজিতা আবার বলে উঠে,

–“প্লিজ….”

চলবে….?