অপরিচিত প্রিয়জন পর্ব-১৬+১৭

0
326

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_১৬
#এম_এ_নিশী

মনুষ্যমনের অনুভূতি বোঝা দায়। এই কঠোরতা এই তো নম্র সরলতা। মেঘে ঢাকা আকাশে ঝুম করে এক পশলা বৃষ্টি নামার পর উদিত হওয়া সূর্যের ন্যায় অনূভুতি বিরাজমান, এই মুহুর্তে রূপসীর মনে। সে তো ইফাদকে এতোটা কাছাকাছি এভাবে আশা করেনি কখনো। নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশ খানিকটা সময় লাগছে তার। মিনমিন করে কোনোরকমে উচ্চারিত করলো দুটি শব্দ,

–ছাড়ুন, প্লিজ!

এতোক্ষণে হুঁশ ফিরলো ইফাদের। নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে রূপসীকে ছেড়ে দিয়ে ঝট করে সরে দাঁড়ালো। নিজেকে সামলে নিয়ে ঝাঁজালো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

–এসব কি রূপসী? এভাবে কেউ ড্রাইভ করে? মানলাম তুমি রেগে আছো তাই বলে এ ধরনের কাজ করবে তুমি? যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো?

–তো? কি হতো তাহলে?

ইফাদ এগিয়ে আসতেই এবার রূপসীর হৃৎস্পন্দনেের গতি দ্রুত হতে শুরু করে। রূপসীর মুখের কাছে ঝুঁকে এসে শান্ত স্বরে বলে,

–এখন কি তোমায় ব্যপারটা বুঝিয়ে দিতে হবে?

–আ..আমি কি বুঝিয়ে দিতে বলেছি নাকি শুধু জানতে চাইলাম। এই আর কি।

ইফাদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তেজিস্বরে বলে উঠে,

–আর যদি কখনো এমন করেছো তো ঠ্যাং ভেঙে রেখে দিব।

রূপসীও যেন রেগে বোম হয়ে যায়। দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলে,

–হু দ্যা হেল আর ইউ? আপনি আমাকে এসব বলার কেএএএএ?

ইফাদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই কানে তালা লাগানো শব্দে চমকে ওঠে দুজনেই। রাস্তাটা বেশ নির্জন। রাত খুব একটা গভীর না হলেও এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে গভীর রাত বলেই মনে হচ্ছে। শব্দের উৎস অনুসরণ করে পাশ ফিরে তাকাতেই আবারও সেই শব্দ। ইফাদ শক্ত করে রূপসীর হাত ধরে পিছিয়ে যায়। কারণ সে লক্ষ্য করেছে খুব সম্ভবত আড়াল থেকে কেউ গুলি ছুঁড়ে দুটো গাড়ির চাকাই নষ্ট করে দিয়েছে। ব্যপারটা বুঝতে ইফাদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না। রূপসীকে নিয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বলে,

–পালাতে হবে রূপসী। যতদ্রুত সম্ভব।

–কিন্তু কেন? আর এটা কিসের শব্দ ছিলো?

–এখন এতো প্রশ্ন করো না। জাস্ট রান!

ইফাদ রূপসীর এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেই ছুটতে শুরু করলো। রূপসী কিছুই বুঝতে না পারলেও এই মুহুর্তে এভাবে ছোটা ছাড়া কিছুই করার নেই তার। কিছুদূর গিয়েই তারা জঙ্গলের পথ ধরলো। তেমন ঘন জঙ্গল নয়। আকাশে জ্বলজ্বলে পূর্ণিমার চাঁদ। চারপাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটুপরই রূপসী বুঝতে পারল তাদের পালানের কারণ। পেছন থেকে বেশ কয়েকটা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওদেরকে অনুসরণ করেই ছুটে আসছে। কিন্তু কারা এরা? ওদের পিছুই বা নিয়েছে কেন? বুঝে উঠতে পারছে না সে।
____________
রাতের খাবারটা একসাথেই খেতে বসেছে খন্দকার পরিবার। ইফাদের বাবা খন্দকার ইউনুস আহমেদ ধীরে ধীরে মাথা নীচু করে খাচ্ছেন। ইদানীং তার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে হার্ট দূর্বল হয়ে পড়ছে। তিনি বেশ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। বরাবরই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। এভাবে দূর্বল হয়ে পড়াটা তার কাছে ভালো ঠেকছে না। ডাক্তার দেখাবেন দেখাবেন করেও সময়ের অভাবে দেখানো হয়ে উঠছে না। আফিয়া তার স্বামীকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। মানুষটা এখন ঠিকমতো খেতে পারেন না। রাতে তো আরও পারেন না। তার সবসময় অস্থির অস্থির লাগে। চিন্তিত মন নিয়েই তিনি সবাইকে খাবার পরিবেশন করছেন। ইফাদের ছোট চাচা খন্দকার ইদরিস আহমেদ গলা খাঁকারি দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। খাবার টেবিলে উপস্থিত তার স্ত্রী সুমাইয়া, ছোটো মেয়ে মুনমুন, বড় ভাই, বড় ভাবি, তাদের ছোটো ছেলে ইমাদ সকলের দৃষ্টি এখন তার দিকেই নিবদ্ধ। তিনি শান্তভাবে এক লোকমা খাবার মুখে পুরে তা শেষ করেন। অতঃপর ধীর কন্ঠে বলেন,

–ভাইজান, আমি ঠিক করেছি ইফাদের সাথেই মুনমুনের বিয়ে দিব। আপনি কি বলেন?

বাবার কথা শুনে মুনমুনের গলায় খাবার আটকে যায়। জোরে জোরে কাশতে থাকে সে। সুমাইয়া উঠে এসে মেয়েকে পানি খাওয়ান। আফিয়া মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ইমাদ ইদরিসের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

–ছোটো চাচা, আপনি তো জানেনই মেজ ভাইয়া কেমন। ও কখনোই এটা মেনে নেবে না। তাছাড়া মুনমুনকে তো ও নিজের বোনের মতোই দেখে।

–তা আমি ভালোই বুঝি ইমাদ বাবা। আমি যা বলছি তোমার ভাইয়ের ভালোর জন্যই বলছি। তার তো বিয়েতে অনীহা, সংসারে মনটন থাকবে না। মুনমুনের সাথে বিয়ে হলে ও যতোটা ভালোভাবে খেয়াল রাখবে বাইরের মেয়ে ততোটা পারবে না। আবার ইফাদের যেমন চলাফেরা বাইরের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে সে তো দুদিনেই পালাবে। তাই মুনমুনের সাথে বিয়ে হওয়াটাই ভালো নয়কি।

ইদরিস কথা শেষ করে আফিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠে,

–আপনি কি বলেন ভাবি?

–আমি কি বলব ভাই। আমার ছেলের ইচ্ছের বাইরে আমি কিছুই করতে পারব না।

–ভাইজান, আপনি কিছু বলছেন না যে?

ইউনুস সাহেবের শরীরটা একটু বেশিই খারাপ করতে শুরু করে। তিনি আর খেতে পারেন না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলেন,

–যা ভালো বোঝো করো। আমার কোনো আপত্তি নেই।

ইউনুস সাহেব ধীর পায়ে হেঁটে ঘরের উদ্দেশ্যে চলে যান। আফিয়াও স্বামীর পেছন পেছন যান। ইমাদ বাবার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে, বাবার অবস্থা ভালো ঠেকছে না। তার ডাক্তারি চোখ বলছে কিছু একটা ঘাপলা আছে।
ইদরিস শান্তভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছেন। সুমাইয়া তাকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।
মুনমুনও উঠে পড়ে। বেশ তাড়াহুড়ো করে ঘরে চলে যায়। ঘরে ঢুকেই দরজা আঁটকে মাটিতে বসে কাঁদতে থাকে। বাবার মুখের ওপর সে কিছুই বলতে পারে না। যদি বাবার কথা শুনে তার ইফাদ ভাইকে বিয়ে করে ফেলতে হয় তবে সে কি করবে? মুখ চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
____________
দৌড়াতে দৌড়াতে বড় রাস্তায় এসে পড়ে ইফাদ, রূপসী। প্রচন্ড হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করে রূপসী,

–কোথায় যাচ্ছি আমরা? আর কতদূর ছুটবো?

–আপাতত বলতে পারছি না।

–আমি যে আর পারছি না।

ইফাদ মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকায় রূপসীর মুখপানে। ক্লান্ত মুখখানা বিবর্ণ দেখাচ্ছে ভিষণ। ইফাদ বলে,

–আচ্ছা, দেখছি কি করা যায়।

ইফাদ একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে থাকে কোনো গাড়ি পাওয়া যায় কিনা। আচমকা রূপসীর হাত কেউ পিছমোড়া করে চেপে ধরে আর এক হাতে তার মুখ চেপে ধরে পেছন দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রূপসী চাইলেও ইফাদকে ডাকতে পারছে না। ইফাদ সামনের দিকে গাড়ির খোঁজে ব্যস্ত। তার দৃষ্টি আকর্ষণও সম্ভব হচ্ছে না। রূপসী গোঙাতে থাকে। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তবে সে যতটা সম্ভব মাটির সাথে নিজেকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। হুট করে তার মাথায় এক চরম বুদ্ধি খেলে গেলো। সে তার পা দিয়ে পেছন দিকে তাকে ধরে রাখা ব্যক্তির দূর্বল জায়গায় কষিয়ে লাথি মারে। লোকটা ব্যথায় গুঙিয়ে উঠে। ছিটকে সরে যায়। রূপসী চিৎকার করে ডেকে ওঠে,

–ম্যাজিস্ট্রেট স্যাআআআররর!

ইফাদ চমকে ফিরে তাকায়, পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ছুটে আসে। রূপসীর পেছনে গোঙাতে থাকা লোকটাকে পরপর দুটো লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর রূপসীর হাত ধরে আবার ছুট লাগায়। সৌভাগ্যক্রমে একটা ট্রাকের সামনে গিয়ে পড়ে তারা। ট্রাক থেমে যায়। ইফাদ গিয়ে ড্রাইভারকে পরিস্থিতি বোঝাতেই ড্রাইভার ওদেরকে সঙ্গে নিতে রাজি হয়। ইফাদ রূপসীকে নিয়ে ট্রাকের পেছনে উঠে পড়ে। ট্রাক চলতে শুরু করে। ইফাদ, রূপসী দুজনেই দেখতে পায় কিছুদূর থেকে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা, হাতে রিভলবার নিয়ে ৪-৫ জন লোক ছুটে আসছে।

চলবে…….

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_১৭
#এম_এ_নিশী

বন্দুকধারী সেই ৪-৫ জন লোক ছুটে আসতে আসতে ট্রাক অনেকটাদূর এগিয়ে গেছে। লোকগুলো যেন হতাশ হলো। ওদের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছে ভেবে রূপসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে ইফাদ গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে আছে। সে বোঝার চেষ্টা করছে এরা কারা হতে পারে। ইফাদকে অন্যমনস্ক দেখে রূপসী জিজ্ঞেস করে,

–কি হলো? কি ভাবছেন?

ইফাদ অন্যমনস্কভাবে বলে,

–হুঁ

রূপসী এবার ইফাদকে আলতো ধাক্কা দিতেই সে ঝট করে ঘুরে তাকায়। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে?”

রূপসী পুনরায় বলে উঠে,

–কি ভাবছেন এতো?

ইফাদ মুচকি হেসে জবাব দেয়,

–ভাবছি এতো রাতে বউটাকে নিয়ে কোথায় যাব?

রূপসীর কিছুটা সময় লাগে বুঝতে ইফাদ কি বলতে চায়লো। পরক্ষণেই ইফাদের নজর তার দিকে পড়তেই ঠোঁটের কোণের দুষ্টু মিষ্টি হাসি দেখে রূপসীর আর বুঝতে বাকি রইলো না। সে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আস্তে করে সরে বসে। হুট করে ইফাদ এমন ধরনের কথা বলে ফেলতে পারে তা রূপসী ভাবতেও পারেনি। এখন লজ্জায় তার ইচ্ছে করছে ট্রাক থেকে লাফিয়ে পড়তে। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। মুখে তার লজ্জামাখা হাসি। রূপসীকে লক্ষ্য করে ইফাদের মুখেও হাসি খেলে যায়। ভালোবাসাময় হাসি।
____________
ঘন্টাখানেক ধরে ছেলেকে সমান তালে ফোন দিয়ে যাচ্ছেন আফিয়া। কিন্তু ছেলের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। ভিষণ চিন্তিত হয়ে শেষপর্যন্ত তিনি মারিয়াকে ফোন দেন। মারিয়া তার বড় মার ফোন দেখে আঁতকে ওঠে। সেই সন্ধ্যা থেকে ইফাদ, রূপসী দুজনেই গায়েব। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না তাদের। বড় মা নিশ্চয়ই ইফাদের খবর জানতে ফোন দিয়েছেন। এখন সে কি জবাব দিবে তাই ভাবছে। ভাবতে ভাবতে প্রথম কলটা কেটে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার বেজে ওঠে ফোন। মারিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে তোলে। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন আফিয়া,

–মারিয়া, তোর ভাই কোথায় রে? ফোন বন্ধ কেন? ও ঠিক আছে তো? তোদের বাড়িতে গেলো অথচ একটিবারও ফোন দিলো না। ছেলেটা তো এমন করে না কখনো। কি হয়েছে বল তো? কোথায় ও?

–আহা বড় মা! তুমি এতো উতলা হচ্ছো কেন? ভাই ঠিক আছে। তুমি চিন্তা করো না।

–তা কোথায় সে? ওকে ফোনটা দে একবার। আমি কথা বলবো। ও ফোন বন্ধ রেখেছে কেন আমি জানতে চায়।

মারিয়া যেন বিপদেই পড়ে গেলো। বড় মায়ের সাথে সে কিভাবে ইফাদের কথা বলিয়ে দিবে এবার। ঢোক গিলে কোনোরকমে বড় মা কে বলে উঠে,

— না না, বড় মা ওকে তো এখন ফোন দিতে পারবো না। ও তো ঘুমোচ্ছে। কেউ যেন ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব না করে তাই হয়তো বন্ধ রেখেছে ফোন।

— তাই বলে যাওয়ার পর আমাকে একবারও ফোন দিবে না ও।

–আসলে ওয়াহাব ও এসেছে তো। সবার সাথে আড্ডা দিতে দিতে ভুলে গেছে হয়তো। তুমি চিন্তা করো না। সকালে উঠলে আমি কথা বলিয়ে দিব তোমার সাথে, আচ্ছা। আমি রাখছি এখন।

মারিয়া দ্রুত ফোন কেটে দেয়। আফিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবতে থাকেন, “ছেলেটাকে নিয়ে টেনশনে একদিন পাগল ই হয়ে যাব।”

মারিয়া উঠে গিয়ে মেইন দরজার কাছে দাঁড়ায়। ওয়াহিদ, ওয়াহাব দুজনেই গিয়েছে ইফাদ, রূপসীকে খুঁজতে। কিন্তু এখনো কেও ফিরলো না। এমনকি কোনো খবর পর্যন্ত জানালো না। মারিয়ার নিজেরই এবার টেনশনে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা হতে লাগলো।
__________
ট্রাক বহুদূর চলে এসেছে। এটা কোন জায়গা তাদের জানা নেই। না জানলেও আপাতত কিছুই করার নেই। রূপসী, ইফাদ ট্রাক থেকে নেমে পড়ে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটতে থাকে। এখন রাত ঠিক কতো জানার কোনো উপায় নেই। কারোর সঙ্গেই ফোন নেই। তাড়াহুড়োতে ফোন গাড়িতেই রয়ে গেছে। ইফাদ, রূপসী পাশাপাশি হাঁটছে। মাথার ওপর গোল চাঁদের উপস্থিতি। চারপাশ কি পরিষ্কার ঝকঝকে। সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা বুঝতে পারলো তারা কোনো এক গ্রামে চলে এসেছে। এই গ্রামের নাম তারা জানে না। নীরবেই হাঁটছে দুজন। কিছুসময় ইতস্তত করতে করতে রূপসী বলে উঠলো,

–শুনছেন?

ইফাদ ফিরে তাকায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রূপসী এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,

–আমার ভিষণ পিপাসা পেয়েছে।

রূপসীর কথা শুনে ইফাদও আশেপাশে চোখ বুলাতে থাকে। দূর দূরান্তেও কোথাও পানির কল চোখে পড়ছে না। ইফাদ বলে,

–আরেকটু সামনে এগিয়ে যাই চলো। এখানে কোথাও পানির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সামনে এগোলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। চলো।

রূপসী মাথা নাড়িয়ে সামনে এগোতে থাকে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। কিছুদূর যাওয়ার পরই একটা পানির কল নজরে পড়ে। ইফাদ এগিয়ে গিয়ে কল চাপতে শুরু করে। রূপসীকে ইশারায় আসতে বলে। রূপসীও একপ্রকার ছুটে গিয়ে তৃষ্ণার্ত গলার পিপাসা মেটালো। এবার রূপসী এগিয়ে এসে নিজে কল চাপতে লাগলো আর ইফাদকে যেতে বলে। ইফাদও এসে পানি খেয়ে সেই সাথে হাত মুখ ধুয়ে নিলো। রূপসী কল চাপছে ইফাদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। রূপসী বুঝতে পারে। তার খুব অস্বস্তি হতে থাকে, লজ্জায়। পেটের ভেতর পাক দিচ্ছে যেন বারবার। ছুটে পালিয়ে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগছে। আচমকা রূপসীর মুখে পানির ঝাপটা পড়তেই সে ফিরে তাকিয়ে দেখে ইফাদ তাকে পানি ছুঁড়ে মারছে। সে এবার হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করে বলে,

–কি করছেন কি আপনি? ভিজে যাচ্ছি তো আমি।

–ভিজে যাও। আজ তোমায় ডুবিয়ে ছাড়বো।

এই বলে ইফাদ আরো পানি ছুঁড়ে মারতে থাকে। রূপসী এবার কল ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যায়। কিন্তু ইফাদ ছাড়বার পাত্র নয়। সে নিজে কল চেপে পানি নিয়ে রূপসীর দিকে এগিয়ে যায়। রূপসী “না, না” করতে করতে এদিক ওদিক ছুটতে থাকে। ইফাদও কম যায় না। সে ও ছুটে গিয়ে আরো একগাদা পানি ছুঁড়ে মারলো। রূপসীর চোখ, মুখসহ গলা পর্যন্ত বেশ অনেকটা ভিজে গিয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে এবার রূপসী দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ইফাদকে বলে,

–আচ্ছা ঘাগু ম্যাজিস্ট্রেট! আপনি একাই ফাজলামো করতে পারেন তাই না? আমার হাত তো পঙ্গু। দাঁড়ান দেখাচ্ছি মজা।

এই বলে রূপসীও কল থেকে পানি নিয়ে ইফাদের দিকে ছুৃঁড়ে মারতে থাকে। ইফাদও নিজেকে হাত দিয়ে আড়াল করতে চায়। কিন্তু বাঁচাতে পারে না। শেষপর্যন্ত সে ও অনেকটা ভিজে যায়। রূপসী খিলখিল করে হেসে ওঠে। ইফাদ আবার এসে ওকে পানি ছুঁড়ে মারতে থাকে। রূপসীও সমান তালে মারতে থাকে। থেকে থেকে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঝংকার তুলছে রূপসীর খিলখিলিয়ে ওঠা হাসি।
___________
খন্দকার বাড়ির পেছনের বাগানে তীব্র মশার কামড়ের অত্যাচার সহ্য করেও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে ওয়াহাব। মুনমুনের জরুরি তলব। সে গিয়েছিল তার ভাই ওয়াহিদের সাথে ইফাদ আর রূপসীকে খুঁজতে। হঠাৎ মুনমুনের ফোন। খুব কাঁদছিলো। কান্নার দমকে কথাই বলতে পারছিলো না। কোনোরকমে হেঁচকি তুলতে তুলতে ওয়াহাবকে এখানে আসতে বলে। রূপসী, ইফাদকে খোঁজা ছেড়ে কিভাবে আসবে তাই ভাবছিলো ওয়াহাব। আবার মুনমুনের কান্না শুনে ছুটে আসার জন্য মন ছটফট করতে থাকে। দোনোমোনো করতে করতে শেষপর্যন্ত মুনমুনের কাছেই এলো সে ভাইকে কোনোরকম বুঝিয়ে। মুনমুনকে ইফাদ, রূপসীর গায়েব হওয়ার ব্যপারে কিছুই জানায়নি সে। কারণ আগে তার মনের অবস্থা জানাটা জরুরি। কেন সে এতো কাঁদছে। আর কেন এভাবে ডাকলো।
অস্পষ্ট পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওয়াহাব বুঝতে পারে মুনমুন এসে পড়েছে। আবছা আবছা ছায়া স্পষ্ট প্রকট হলো ওয়াহাবের সামনে। সে কিছু একটা বলার জন্য এগিয়ে আসতেই আচমকা মুনমুন ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়াহাবের বুকে। পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে তার দম আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা। ওয়াহাবের এবার সত্যিই ভিষণ ভয় হতে থাকে। সে মুনমুনের মাথায় হাত বুলিয়ে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,

–কি হয়েছে মুনপাখি? কাঁদছো কেন? বলো আমাকে।

মুনমুনের কোনো জবাব নেই। সে একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। ওয়াহাব এবার জোর করে বুক থেকে মাথা তুলে দেয় মুনমুনের। প্রেয়সীর ক্রন্দনরত মুখখানা ওয়াহাবের মন ব্যথিত করছে। সে মুনমুনের থুতনি ধরে মুখটা তার দিকে তুলে ধরে। আবেগী স্বরে বলে উঠে,

–বলো না গো পাখি? কি হয়েছে? তোমাকে এভাবে দেখতে আমার যে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে।

মুনমুন কান্না থামিয়ে দেয়। তবে ফোঁপানো বন্ধ করতে পারে না। ওভাবেই ফুঁপিয়ে বলে উঠে,

–বাবা, বাবা আমার বিয়ে ইফাদ ভাইয়ার সাথে ঠিক করেছে।

পরিষ্কার আকাশে হঠাৎ বাঁজ পড়লে মানুষ যেভাবে চমকে কেঁপে ওঠে ঠিক সেভাবেই কেঁপে ওঠে ওয়াহাব মুনমুনের কথাটা শুনে। সে যেন থমকে গেছে। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কিছু সময় স্থির দৃষ্টিতে মুনমুনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেঁচকা টানে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। অতঃপর ধীর অথচ ভরসামাখানো কন্ঠে বলে উঠে,

–কিচ্ছু হবে না। তোমাকে কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না মুনপাখি। কেউ না। আমি আছি তো। আমি সব ঠিক করে দিব। তুমি শান্ত হও।
____________
পানি পানি খেলা শেষে ক্লান্ত দুজন। রূপসী তখনও হেসে যাচ্ছে। ইফাদ হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। দৃষ্টি রূপসীর মুখপানে। ভেজা মুখে কি স্নিগ্ধ মায়াবীই না লাগছে মেয়েটিকে। বাচ্চা এই মেয়েটা দুবছরে যেন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। চোখে মুখে সব জায়গায় ধীরে ধীরে যৌবনের ছাপ পড়ছে। রূপসীর কানের পাশ থেকে কিছু ভেজা চুল এসে গালে লেপ্টে রয়েছে। ইফাদ এগিয়ে এসে রূপসীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। রূপসী ফিরে তাকায়। মুখে হাসি নিয়ে ভ্রু নাচায়। ইফাদ আলতো হাতে রূপসীর গালের ওপর লেপ্টে থাকা চুলগুলোকে সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয়। হঠাৎ ইফাদের স্পর্শে কেঁপে ওঠে রূপসী। চোখ নামিয়ে নেয় সে। হাত পায়ের শীতলতা অনুভব করতে থাকে সে। বুকের ভেতর বোধহয় ঢিপঢিপ আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। বারবার ঢোক গিলে নিজেকে স্থির রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার সকল চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে আচমকা ইফাদ তার ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দেয় রূপসীর ভেজা গালে। চক্ষু বিশাল আকৃতি ধারণ করলেও হৃৎপিণ্ড বেড়িয়ে আসার যুদ্ধ শুরু করে দেয় রূপসীর। এবার বুঝি সে জ্ঞানই হারাবে। তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের প্রেমিকপুরুষ রূপখানা তাকে আজ ছিন্নভিন্ন করে দিতে প্রস্তুত।

চলবে….