অপরিচিত প্রিয়জন পর্ব-২+৩

0
342

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_২
#এম_এ_নিশী

ট্রাক চলছে হেলেদুলে। রূপসীর এখন আর ভয় করছে না। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। মাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কাল মাছের তরকারি দিয়ে ঠিকমতো ভাত খেতে পারেনি বলে বাবা বলেছিলেন আজ গরুর মাংস কিনে আনবেন। সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বাবা হাটে গেলেন। সকাল সকাল হাটে গরুর মাংস পাওয়া যায়। মা হয়তো সেই গরুর মাংসের ঝাল ঝাল ভুনা রান্না করে বসে আছেন। মেয়েকে যত্ন করে খাওয়াবেন বলে। ভাবতে ভাবতে রূপসীর দু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার মোটেও উচিত হয়নি মিথ্যে বলে বেরোনো। আর কখনোই সে এমন কাজ করবে না। শুধু একবার সে বাড়ি ফিরে যেতে চায়। মা-বাবা আর মৌটুসীকে দেখতে চায়।

রফিকউদ্দিন গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা হাজার ছুটোছুটি করে, একে ওকে ধরেও মেয়ের খোঁজ উদ্ধার করতে পারলেন না। বাড়িতে ফিরে ধপ করে উঠোনে বসে পড়লেন। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। রফিকউদ্দিনের কান্নার আওয়াজে মরিয়ম বিবি, মৌটুসী দু’জনেই ছুটে আসে। দুজনের কেউই ঘুমোয়নি। রূপসীর চিন্তায় কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে এতক্ষণ। রফিকউদ্দিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

–মাইয়াটারে বুঝি হারাইয়া ফালাইলাম গো রূপসীর মা। আমার আম্মাজানডা বাঁইচা আছে তো?

মরিয়ম বিবি স্বামীর পাশে বসে হু হু করে কেঁদে দেন। তার কলিজার টুকরা মেয়েটাকে কি সত্যি আর ফিরে পাবে না। মৌটুসীও ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বুবুকে ছাড়া তার একমুহূর্তও ভালো লাগছে না।

__________

খন্দকার বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব। কতদিন পর ইফাদ বাড়ি ফিরেছে। ইফাদের মা খন্দকার আফিয়া নুর আহমেদ কত বলে বলেও ছেলেকে বাড়ি আনতে পারছিলেন না। ছেলে তার এতোই ব্যস্ত। আফিয়ার দিন বড় কষ্টে কাটে বললেই চলে। তিন ছেলে তার ইয়াদ, ইফাদ, ইমাদ। বড় ছেলে ইয়াদ জার্মানি থাকে বউ-বাচ্চা নিয়ে। ইফাদের পোস্টিং অন্য এলাকায় হওয়ায় সে ও সেখানেই থাকে। ইমাদ তো মেডিকেল পড়াশোনার জন্য হোস্টেলেই রয়েছে। এদিকে স্বামী খন্দকার ইউনুস আহমেদ সচিবালয়ে কর্মরত হওয়ায় তিনিও আফিয়াকে খুব একটা সময় দিতে পারেন না। বাড়িতে যদিও শ্বাশুড়ি আর ছোট জা রয়েছেন। তবে তাদের সাথে সময় কাটানো আর স্বামী সন্তানদের সাথে সময় কাটানোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। তার ভরা সংসার। শ্বাশুড়ি খন্দকার নুরজাহান বেগমের দৌলতে যৌথপরিবার হয়ে টিকে আছে এই খন্দকার পরিবার। তার দুই ছেলে এক মেয়েকে তিনি সেভাবেই মানুষ করেছেন। বড় ছেলে ইউনুস সচিবালয়ে কর্মরত হলেও ছোটো ছেলে ইদরীস খন্দকার বাড়ির ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক ব্যবসা সামলাচ্ছেন। বড় ছেলের ঘরে তিন তিনটে ছেলে হলেও ছোটোটার ঘরে দুটো মেয়ে। সবাইকে নিয়ে এই ভরপুর সংসারেও আফিয়ার নিজেকে একলা মনে হয়।
আজ ছেলে বাড়ি ফিরায় তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। কি করবেন আর কি করবেন না ভাবতে ভাবতে সব গুলিয়ে ফেলছেন। ইফাদ মায়ের দু বাহু জড়িয়ে ধরে তাকে সোফায় বসিয়ে দেয়। তারপর নিজে আরাম করে মায়ের কোলে মাথা রেখে শোয়। আফিয়া পরম মমতায় ছেলের মাথায় হাত বোলাতে থাকেন।

–কতদিন হলো তোমার এই আদর খাইনা বলোতো মা। এখন তুমি আমাকে এভাবেই আদর করে যাবে শুধু।

–বা রে। তা করলে কি হয়। তোর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো। তোর পছন্দের ছোট মাচের চচ্চড়ি করি। নাকি খিচুড়ি খাবি। নইলে বল একটু পরোটা বানিয়ে দেই। তুই তো পরোটা খেতে বেশি ভালোবাসিস।

–আহ মা। রাখো তো সব। খাওয়া দাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই মুহুর্তে তোমার আদরটার ভিষণ প্রয়োজন। খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই। বারোটার পর একটা মিশনে যেতে হবে।

–কিইই! মাঝরাতে তুই মিশনে বের হবি? কখনোই না। আমি কিছুতেই তোকে যেতে দেব না। বিপদ আপদ বলা যায় না। ওতো রাতে আমি তোকে ছাড়ছি না।

ইফাদ উঠে বসে। মায়ের গালে দু হাত রেখে বলে,

–আমার মিষ্টি আম্মাজান। এটাই তো আমার কাজ মা। তুমি নিজের সন্তানের বিপদের আশংকা করছো। ওদিকে কত কত মায়ের সন্তানদের উদ্ধার করার দায়িত্ব যে আমার ওপর পড়েছে তা তুমি আন্দাজ করতে পারবে না। আর তুমি তো ভালো করেই জানো তোমার ছেলে তার দায়িত্ব কতোটা নিষ্ঠার সাথে পালন করে।

–কিন্তু এই মাঝরাতে কেন? সকালে করলে হয় না।

–সকালে হলে তো সকালেই করতাম। আচ্ছা ছাড়ো তো। বেশ ক্ষিদে ক্ষিদে পাচ্ছে এখন। একটু গরুর মাংস দিয়ে ভাত নিয়ে এসো তো।

–কিইই! তুই গরুর মাংস খাবি। তোর না অ্যালার্জি।

–হা হা হা। মজা করছিলাম মা। শুধু কি অ্যালার্জি গরুর মাংস জিনিসটাই আমার পছন্দ নয়। তুমি বরং যা আছে তাই নিয়ে এসো। খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিব।

ইফাদ উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। আফিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবেন তার এই ছেলে জান হাতে নিয়ে কাজ করে। না জানি কখন কি বিপদ এসে হানা দেয়। ইফাদের কথা ভেবে মাঝে মাঝে বুক কেঁপে ওঠে আফিয়ার। কিন্তু ছেলেকে মানাও করতে পারেন না। আফিয়ার যেন বড্ড জ্বালা হয়েছে।

___________

হুট করে ট্রাক থেমে যাওয়ায় রূপসীর মনে ক্ষীণ আশার আলোর সঞ্চার হলো। ভাবলো, বুঝি তার গ্রামে এসে থেমেছে গাড়ি। এখন হয়তো সে বাড়ি ফিরতে পারবে। মায়ের কাছে। কিন্তু রূপসীর আশার আলো দপ করে নিভে গেলো যখন ৪-৫ জন হাট্টাকোট্টা লোক এসে রূপসীসহ বাকি মেয়েদের টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামালো। এসব মেয়েদের মধ্য থেকে কয়েকজনের কাছে সে শুনেছে তারা কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার স্বীকার হয়ে এই যায়গায় এসে পড়েছে। কিন্তু রূপসী ভেবে পায়না আজমল ভাই তার সাথে এমনটা কেন করলো। সে তো তার কোনো ক্ষতি করেনি। ভাবনার মাঝেই রূপসী দেখতে পায় লোকগুলো একে একে সবার হাত আর চোখ বেঁধে দিচ্ছে। রূপসীর গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অজানা আশঙ্কায় হৃদপিণ্ড ক্রমাগত লাফিয়ে যাচ্ছে। হাত পা কাঁপছে ভয়ংকরভাবে। লোকগুলো তাদের কোথায় নিয়ে যাবে? তাদের কে কি মেরে ফেলা হবে? ভাবতে ভাবতেই একজন এসে রূপসীকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে ঘুরায়। হাতদুটো পিছমোড়া করে শক্ত করে বেঁধে দেয়। ব্যথায় কোঁকিয়ে উঠে সে। চোখ দিয়ে টুপ করে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। তীব্র কষ্টে ভিতরটা শুধুই “মা, মা” করছে তার। চোখ বাঁধা শেষে ঠেলে ঠেলে তাদের কোথাও একটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রূপসী আন্দাজ করলো আবার একটা গাড়িতে হয়তো তাদের তোলা হচ্ছে। তার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো যখন কিছু সময় পর গাড়ি চলতে শুরু করে।

মনছুর আলী শঙ্কিত দৃষ্টিতে বারবার এদিক ওদিক দেখছেন। মেয়ে পাচারের এই ব্যবসা তার দীর্ঘদিনের। কিন্তু কখনো পাচারকরা মেয়েদের সাথে তিনি থাকেন না। সবটা আড়ালে থেকেই করেন। কখন কোথা থেকে পুলিশ, গোয়েন্দাদের আক্রমণ এসে পড়বে। যদিও তার যথেষ্ট প্রটেকশন থাকে। মন্ত্রী মিনিস্টারদের সাথেও সখ্যতা রয়েছে তার। তবুও ভয় তো থেকেই যায়। আজ নেহাৎই বাধ্য হয়ে তার এদিকটায় আসা। তাই মেয়েদের এই গাড়িতেই তাকে যেতে হচ্ছে। তার ওপর আজ তার ডান হাত মন্টু গায়েব। সকাল থেকে মন্টুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় যে হারালো! সে না থাকায় ভয়টা যেন একটু বেশিই তীব্র হচ্ছে। গাড়ি চলতে থাকে। মনছুর আলী ভালোই ভালোই পার হওয়ার চিন্তা করতে থাকেন।

___________

রাত ১২.৪৫। চারপাশে সুনসান নীরবতা। শহরের বড় রাস্তাটির ধারে সারি সারি গাছ। সবকটাই বিশাল দীর্ঘদেহী। আশেপাশে লোকালয় বা জনমানবের কোনো চিহ্ন নেই। কিছুক্ষণ পর পর রাস্তাটি দিয়ে কেবল বড় বড় মালবাহী ট্রাক, কার্গো কিংবা দূরপাল্লার বাসের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। এরইমাঝে এই রাতের আঁধারে সেসব গাছ আর ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে নীরবে লুকিয়ে রয়েছে প্রায় ১৫-২০ জন মানুষ। ঠিক সাত মিনিটের মাথায় একটি বড় কার্গো গাড়ির দেখা পাওয়া মাত্রই সকলেই সতর্ক হয়ে দাঁড়ায়। বন্দুক তাক করা গাড়ির চাকা বরাবর। ইফাদের ইশারা পাওয়া মাত্রই পরপর বেশ কয়েকটা গুলির আওয়াজে নিস্তব্ধ এই পরিবেশের নিস্তব্ধতার ভয়াবহ ভাঙন ধরে। গাড়ির চারটি চাকায় নষ্ট হয়ে যায় গুলির আঘাতে। যার ফলে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। মনছুর আলী ঠিক এই আশংকাটাই করেছিলেন। তিনিও তার প্রস্তুতি বেশ ভালেভাবেই নিয়ে রেখেছেন। গাড়ির সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়ায় চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে যায়। ইফাদের টিমের সকল সদস্যরা নিজেদের হাতে থাকা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে পুনরায় জায়গাটি আলোকিত করে দেয়। চারিদিক থেকে ঘিরে রাখা হয়েছে গাড়িটি। যেন একজনও পালাতে না পারে। আচমকা এক পুলিশ সদস্যের হাঁটু বরাবর গুলি লাগায় আর্তনাদ করে ওঠে। সকলের দৃষ্টি ও মনোযোগ তার দিকে পড়তেই ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়ি থেকে দুজনকে পালাতে দেখা গেলো। ইফাদ দ্রুত পিছু নেয়। সাদমানকে বলে আহত পুলিশটিকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে আর গাড়িতে থাকা মেয়েদেরও যেন উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায়। মনছুর আলী তার আরেক সাগরেদ কাশেমকে নিয়ে ছুটে পালাচ্ছেন। তার গাড়ি তৈরি আছে। কোনোরকমে একবার সেই গাড়িতে উঠে পালাতে পারলেই তাকে আর ধরার সুযোগ থাকবে না। তবে মেয়েগুলোকে হয়তো নিয়ে যাওয়া হলো না। মনছুর আলী মনে মনে মন্টুকে বিশ্রী ভাষায় দু একটা গালি দেন। কারণ তিনি বুঝে গিয়েছেন মন্টু ধরা পড়েছে। আর সে-ই সব তথ্য দিয়ে দিয়েছে। মনছুর আলী প্রাণপণ ছুটছে। তার পিছন পিছন ইফাদও ছুটছে। এই জায়গাগুলো জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় এখানে ল্যাম্পপোস্ট নেই। যার জন্য খুব একটা আলোর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আর আলো না থাকায় ইফাদ গুলি করতে পারছে না কারণ অন্ধকারে পা বরাবর তাক করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই লোক আজ হাতছাড়া হয়ে গেলে পরবর্তীতে আরো বহু মেয়েকে এভাবে হারিয়ে যেতে হবে। মনছুর আলী দৌড়াতে দৌড়াতে ফোন করে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে আসতে বলেন। জঙ্গলের পথ ধরেই যেতে হবে তাদের। ফোনে কথা বলতে গিয়ে মনছুর আলীর দৌড়ের গতি কিছুটা কমে যায়। যার দরুন ইফাদ তার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। পেছন থেকে খপ করে তার পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরে৷ তাল সামলাতে না পেরে উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই হাঁটু দিয়ে তার থুতনি বরাবর সজোরে আঘাত করে ইফাদ। “ও বাবা গো!” বলে চিৎকার করে ওঠে মনছুর আলী। ইফাদ তাকে সোজা দাঁড় করায়। মুখ বরাবর পরপর কয়েকটি ঘুষি মারে। মনছুর আলী দু’হাতে মুখ চেপে ধরে গোঙাতে থাকে। ইফাদ তখন তার পেট বরাবর লাথি মারায় মাটিতে ছিটকে পড়ে গেলো সে। ইফাদ দ্রুতগতিতে এসে তাকে তুলতে যাবে তখনই তার মাথার পিছনে কিছু একটার আঘাতে আর্তনাদ করে সরে যায় সে। আবছা আলোতে বুঝতে পারে মনছুর আলীর সাথে থাকা লোকটা তাকে শক্ত কোনো লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। ইফাদ লোকটিকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু তার চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসায় সে ঠিকমতো নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছে না। নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই আরো একটা আঘাত এসে লাগে তার কপালে। এবার সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ঢলে পড়ে যায়। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে তার। চোখ বুজে যায়। মনছুর আলী আর কাশেম এই সুযোগে তাদের নির্ধারিত গাড়িতে করে নিরাপদে পালিয়ে যায়।

ওদিকে পুলিশের বাকি সদস্যরা গাড়িতে থাকা সবকটা লোককে আটক করে ফেলে। সাদমান পেছনে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। সব মেয়েদের নামানো হয়৷ একে একে সবার হাত ও চোখের বাঁধন খুলে দিতেই এক অদ্ভুত কান্ড ঘটে যায়। রূপসীর হাতের বাঁধন খোলা মাত্রই সে ছুট লাগায়। দিগবিদিক শূণ্য হয়ে দৌড়াতে থাকে। সে ঠিক করে রেখেছিলো একবার গাড়ি থেকে নামার সুযোগ পেলেই সে দৌড় লাগাবে। হাতের বাঁধন খোলা হোক বা না হোক। যা হয় হবে তবুও সে পালানোর একটা শেষ চেষ্টা করবেই। এতোগুলো মেয়ের দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে রূপসীকে আলাদা করে খেয়াল করে না কেউ। তবে যে বাঁধন খুলে দিয়েছিলো সে কিছুক্ষণ আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে রূপসী অনেকটা দূর চলে গিয়েছে। অবশেষে তার হুঁশ ফিরলে চিৎকার করে বলে “আরে আরে মেয়েটা পালিয়ে গেলো।” দুজন লোক তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে ছুটলো কিন্তু রূপসীর টিকিটিও নাগাল পেলো না তারা।
রূপসী ছুটতে ছুটতে হঠাৎ কিছু একটা পায়ে লাগায় হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও তার মনে হয় এটা কোনো মানুষের শরীর। যার ওপর সে পড়ে আছে। রূপসী গ্রামের মেয়ে হওয়ায় তার ভুতের ভয়টাও একটু বেশিই। “ওরে আল্লাহ!” বলে লাফিয়ে উঠে সে।

–আল্লাহ গো আল্লাহ বদ মাইনষের হাত থেইকা পালাইয়া আবার কোন জ্বীনের হাতে পড়লাম। ইয়া মাবুদ! রক্ষা করো মাবুদ।

দুর থেকে আসা গাড়ির আলো পড়তেই রূপসী ভালো করে দেখে এক সুদর্শন পুরুষ চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে। রূপসীর হুট করে কি হলো কে জানে। এই অপরিচিত মানুষটার জন্য তার মায়া কাজ করতে শুরু করে। লোকটার কি এক্সিডেন্ট হয়েছে? নইলে এভাবে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে কেন? রূপসীর মন বলে উঠে, লোকটাকে তার বাঁচানো উচিত। সে দাঁড়িয়ে পড়ে মাঝরাস্তায়। গাড়ি থামানোর চেষ্টায়। ভাগ্যক্রমে গাড়ি পেয়েও যায়। এক প্রাইভেট কারের মালিক এভাবে এতোরাতে একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে আসে। ইফাদকে দেখে দ্রুত গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করে। রূপসী সহ হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়। রূপসী জানে না এই মানুষটা কে? কি তার নাম? তবুও নিজের এই বিপদের মাঝেও মানুষটিকে রাস্তায় ফেলে আসতে পারে না। ইফাদের অল্প অল্প জ্ঞান ফিরতে থাকে। আবছা আবছা ভাবে বারবার এক মায়াবী মুখ তার নজরে আসছে যে মুখে উদ্বিগ্নতার ছড়াছড়ি। কোনো কারণ ছাড়াই তার এই মুখখানা দেখতে বেশ ভালো লাগছে। তবে চোখদুটো সায় দিতে নারাজ। পুনরায় বুজে যায়।

চলবে…..

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_৩
#এম_এ_নিশী

ইফাদকে হসপিটালে ভর্তি করানোর পর সেই কারের মালিক তার ফোনটা নেয়। কল লিস্টের শুরুতে থাকা সাদমানের নাম্বারে ডায়াল করে। কল রিসিভড হতেই লোকটি বিস্তারিত খুলে বলে। সাদমান দ্রুত দুজন পুলিশ নিয়ে সেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বাকি পুলিশ সদস্যরা উদ্ধারকৃত মেয়েদের একটি নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায়। হসপিটালে পৌঁছানো মাত্রই সাদমানের সাথে থাকা এক পুলিশ সদস্য রূপসীকে দেখে বলে ওঠে,

–আরে এই তো সেই মেয়ে যেটা পালিয়ে গেছিলো।

ভাগ্যক্রমে এই লোকটিই রূপসীর হাতের বাঁধন খুলেছিলো তাই তাকে চিনতে পারে। রূপসী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পুলিশটির দিকে। সাদমান এগিয়ে এসে ধমকে ওঠে,

–এই মেয়ে! ওভাবে পালিয়ে গিয়েছিলে কেন? আমরা এত কষ্ট করে তোমাদের ওই নারী পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করলাম। আর তুমি পালিয়ে আরো বিপদের মধ্যে ঢুকতে গিয়েছিলে।

“নারী পাচারকারী!” শব্দটা শুনে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় রূপসী। সে স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে এই ব্যাপারে অনেককিছু শুনেছে। তবে এরা কেমন হয়? কিভাবে নারী পাচার করে? নারী পাচার করেই বা কি করে? এসবকিছু সে জানতো না, বুঝতোও না। অথচ আজ এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই গেলো সে। ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে তার।

–এ্যাই মেয়ে। চুপ করে আছো কেন? কথা বলতে জানো না?

–আপনেরা পুলিশ! মাইয়্যাগো বাঁচান?

–শুধু মাইয়্যাদের না আমরা সব বিপদগ্রস্ত মানুষদেরই বাঁচানোর চেষ্টা করি। তুমি এখন উনার সাথে যাও।

–কই যামু? আপনেরা আমারে আবার পাচার কইরা দিবেন না তো?

–আরে নাহ! মহাজ্বালা হলো তো। আমরা তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিব। তোমার সাথে আরো যেসব মেয়ে ছিলো এখন তাদের সাথেই থাকবে। কাল সকালে যার যার ঠিকানা মতো সবাইকেই পৌঁছে দেওয়া হবে।

বাড়ি ফিরার কথা শুনতেই রূপসীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। আনন্দ উত্তেজনায় হসপিটালে নিয়ে আসা মানুষটার কথা বেমালুম ভুলে বসে। লাফিয়ে উঠে পুলিশটির হাত ধরে বলে,

–ওওও চাচাজান আমারে লইয়্যা যান। আমি বাড়িত যামু।

রূপসীর কথা শুনে পুলিশটি বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকে।

–এই মেয়ে আমাকে দেখে কি তোমার চাচা মনে হয়? ইশ! আমার মতো টগবগে যুবককে চাচা বানিয়ে দিলো। এখনও মেয়েরা আমাকে দেখলে ক্রাশ খায়।

সাদমান ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে বলে,

–৪০ এ পড়লেন আব্দুর রাজ্জাক সাহেব। চাচা বলবে না তো কি ওগো! বলবে?

বলেই চোখ টিপে দেয় সাদমান। আব্দুর রাজ্জাক লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন,

–আমি তবে মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছি সাদমান সাহেব। রেখে আসি।

–হুম! হুম! যান। আমি এদিককার ফর্মালিটিগুলো দেখি।

সাদমান নামটি শুনেই ইফাদকে হসপিটালে পৌঁছে দেওয়া লোকটা এগিয়ে এসে বলে,

–আপনিই সাদমান সাহেব? যাকে নিয়ে এসেছি হসপিটালে উনি আপনার কে হন?

–উনি তো আমার বস। আই মিন উনি একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আমি উনার অ্যাসিসট্যান্ট বলতে পারেন।

হসপিটালে নিয়ে আসা মানুষটা একজন ম্যাজিস্ট্রেট এ কথা শুনে রূপসী থমকে যায়। সে পুলিশ সদস্যটিকে জিজ্ঞেস করে,

–ঐ মানুষটাই কি আমাগো বাঁচাইলো?

–হ্যা উনিই তো সব করেছেন। উনি না থাকলে আজ হয়তো তোমরা উদ্ধার হতে পারতে না।

রূপসী ম্যাজিস্ট্রেট মানে পুরোপুরি বোঝে না। কিন্তু তার বাবার স্বপ্ন তাকে ম্যাজিস্ট্রেট বানাবে। সে শুধু এটুকুই জানে ম্যাজিস্ট্রেটরা বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। অন্যায়কারীদের শাস্তি দেয়। এই মানুষটাও একজন ম্যাজিস্ট্রেট শুনে রূপসীর মনে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানে ভরে যাচ্ছে তার ভিতরটা। সে ঝট করে দাঁড়িয়ে বলে,

–চাচা আমি আপনের লগে যামু না।

–যাবে না মানে? কেন যাবে না?

–আমি ওই ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের লগেই যামু। আমি উনার লগেই বাড়িত যামু আর কারোর লগে না।

–তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো স্যার তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার মতো অবস্থাতে নেই। তাই জেদ করিওনা। চলো আমার সাথে।

–নাআআ। আমি কোনো কথা শুনমু না। আমি স্যারের লগেই যামু।

পুলিশ লোকটা প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। এই মেয়েটাকে নিয়ে তিনি বারবার বিপাকে পড়ছেন শুধু। কিন্তু এই হসপিটালে কোনো সিনক্রিয়েট ঘটাতে চাইছেন না। তাই আদুরে স্বরে রূপসীকে বললেন,

–ঠিক আছে। তুমি স্যারের সাথেই যেও। এখন তো উনি অসুস্থ। একটু সুস্থ হোক তারপর তোমাকে নিয়ে যাবে। তুমি এখন আমার সাথে চলো। তোমার ক্ষিদে পায়নি? ঘুম পায়নি?

সত্যিই রূপসীর বড্ড বেশি ক্ষিদে পেয়েছে। আবার শরীর ক্লান্ত থাকায় ঘুম ঘুমও পাচ্ছে বেশ। তাই সে আর বাড়তি কথা না বলে পুলিশটির সাথে হাঁটতে লাগলো।

সাদমান হসপিটালের সব ফর্মালিটি পূরণ করে। শুনেছে ইফাদ স্যার এখন অনেকটা সুস্থ। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। সাদমান আপাতত ইফাদের বাড়ির কাওকে খবরটা জানানোর সাহস করছে না। কারণ ইফাদের কড়া নির্দেশ ছিলো সে যত সমস্যায় পড়ুক না কেন তার বাড়ির লোকদের যেন কখনোই কিছু জানানো না হয়। যা কিছু জানানো জরুরি বলে মনে হবে তা ইফাদ নিজেই জানিয়ে দেবে পরে। রাতটা সাদমান হসপিটালেই কাটায়।

____________

সকালের কাঁচা সোনা রোদের তেজে চোখ বুজে রাখা কঠিন। তাই বাধ্য হয়েই চোখ খুলে ইফাদ। চোখ থেকে তার ঘুমের রেশ কাটছে না। সম্ভবত ঘুমের ওষুধের প্রভাব। চোখ খুলার পর বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে সে। মাথার পিছনের ব্যথাটা ওতোটা গাড়ো না হলেও কপালটা দপদপ করছে ব্যথায়। মনছুর আলীর মতো ভয়ংকর এক নারী পাচারকারী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কষ্টের কাছে ওসব ব্যথা তার কিছুই মনে হচ্ছে না৷ তীরে এসে তরী ডুবে গেলো তার। আবার সবটা নতুন করে সাজাতে হবে। একদম গোড়া থেকে। হসপিটালের বেড থেকে নেমে বাইরে এলো সে। সাদমানকে দেখামাত্রই গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠে,

–সাদমান সাহেব যা যা ফর্মালিটি আছে শেষ করে আসুন। আমি বাড়ি ফিরবো।

ইফাদের কথা শুনে সাদমান ছুটে এসে বলে,

–সে কি স্যার। আপনি তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন। ডক্টর আপনাকে আরো একদিন হসপিটালে থাকতে বলেছে।

–হসপিটালে থাকার মতো মনমানসিকতা কিংবা সময় কোনোটাই আমার নেই। যা বলেছি তা জলদি করুন।

–ওকে স্যার। আমি দেখছি।
—-
সাদমান গাড়ি ড্রাইভ করছে। ইফাদ তখনো গম্ভীর হয়ে বসে রয়েছে। সাদমান গলা খাঁকারি দিয়ে ইফাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,

–সরি স্যার। আপনি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছেন অথচ সেই সময় আমি আপনার পাশে থাকতে পারলাম না। আই এম রিয়েলি ভেরি সরি স্যার।

–ইটস ওকে সাদমান সাহেব। আমি ভেবেছিলাম আমি একাই ম্যানেজ করতে পারব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অযোগ্য হয়ে যাচ্ছি আমি।

–ছিহ ছিহ স্যার এভাবে কেন বলছেন? ওই মনছুর আলীকে আজ ধরা গেলো না। একদিন নিশ্চয়ই ধরে ফেলবেন আপনি আমি জানি। সেই বিশ্বাস আমার আছে আপনার প্রতি। কিন্তু মেয়েগুলোকে তো বাঁচাতে পেরেছেন। সেটাও তো অনেক বড় কাজই।

–ভালো কথা মনে করিয়েছেন সাদমান সাহেব। মেয়েগুলোকে ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়া হয়েছে তো? কোথায় রেখেছেন ওদের?

–আপনার কথামতো ওদেরকে কোয়ার্টারে রাখা হয়েছে। সম্ভবত বেশিরভাগ মেয়েদেরই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

–ঠিকাছে আমাকে তবে ওখানেই নিয়ে চলুন।

–কিন্তু স্যার আপনি না বললেন আপনি বাড়ি যাবেন।

–না। আগে ওখানকার পরিস্থিতি বুঝে আসি। তারপর বাড়ি ফিরব।

–স্যার, কাল রাত থেকে আপনার মা অনেকবার ফোন করেছেন। অনেক ভুজুংভাজুং বুঝ দিয়ে ম্যানেজ করে রেখেছি। আপনি যদি বাড়ি না ফিরেন তবে উনার সাথে একবার কথা বলে নিন।

–আমার ফোনটা দিন।

সাদমান ফোনটা দিতেই ইফাদ তার মা আফিয়াকে ফোন করে আরো একবার ভুজুংভাজুং বুঝ দিয়ে রাখলো। ফোন রেখেই সাদমানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে,

–কাল আমাকে হসপিটালে কে নিয়ে এসেছিলো?

–এনেছিলেন এক ভদ্রলোক। আমি তার ফোন নাম্বার, ঠিকানা নিয়ে রেখেছি। আপনি চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

–হুম যোগাযোগ তো করতেই হবে। এটলিস্ট থ্যাংকসটা তো জানানো জরুরি।

–লোকটা না থাকলে আমরা হয়তো আপনাকে সহজে পেতাম না। পেলেও বেশ দেরি হতো। ততক্ষণে আপনার যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারতো। সত্যি লোকটার কাছে গ্র্যাটফুল হয়ে রইলাম তাই না স্যার।

সাদমানের কথার প্রত্যুত্তরে ইফাদ কিছু বলে না। শুধু হাসি ছুঁড়ে দেয়। দুজনেরই অজানা থেকে যায় ইফাদের মূল উদ্ধারকারী তো রূপসী নামক ছোট্ট এক গ্রামের মেয়ে ছিলো।

___________

কোয়ার্টারে ঢুকে ইফাদ দেখতে পায় এখনো ৩-৪ জন মেয়ে রয়েছে। তবে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এখন। তাকে দেখামাত্র সবাই দাঁড়িয়ে স্যালুট করে। ইফাদ মাথা ঝুঁকিয়ে সামনের দিকে আগায়। সাদমান গিয়ে কথা বলছে মেয়েদের ঠিকমতো পৌঁছে দেওয়া হলো কি না সেই ব্যাপারে। ইফাদ এদিক ওদিক নজর বুলাতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখ গিয়ে আটকে যায় জানালার ধারে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা এক বাচ্চা মেয়ের দিকে। আন্দাজ করে নেওয়া যায় ১৬-১৭ বছর বয়সী হবে। আনমনে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি হয়তো বিশাল আকাশের বুকে। মেয়েটাকে দেখা মাত্র কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় ইফাদ। পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে যায় তার। ভাবতে থাকে কোথায় যেন দেখেছে সে মেয়েটিকে! তার ভাবনার সুতো ছিঁড়ল সাদমানের ডাকে।

–স্যার, শুনলাম ওই মেয়েটি নাকি জেদ ধরে বসে আছে আপনি পৌঁছে না দিলে সে নাকি বাড়ি যাবে না।

ইফাদ অবাক হয়ে যায় এমন কথা শুনে।

–স্ট্রেঞ্জ! সম্ভবত আমরা পরিচিত নয়। সম্ভবত কেন বলছি, আসলেই আমরা পরিচিত নয় তবে মেয়েটি এমন অদ্ভুত আবদার কেন করছে?

–তা তো জানি না স্যার। মেয়েটাই ভালো বলতে পারবে। কিন্তু আপনি এখন কি করবেন স্যার? মেয়েটার গ্রাম তো এই শহর থেকে বেশ অনেকটা দূরে। আজ গেলে কাল সকালের আগে ফেরা সম্ভব না। তাছাড়া আপনার মা কিন্তু খুব অস্থির হয়ে আছেন। আজ বাড়ি না ফিরলে উনি হয়তো আরো হাইপার হয়ে যেতে পারেন।

ইফাদের কানে কথাগুলো প্রবেশ করলো কি না বোঝা গেলো না। সে একদৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটিকে দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে তার। কিন্তু সেই অনূভুতির কারণ কিংবা ব্যাখ্যা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না সে। রূপসী জানালা থেকে দৃষ্টি সরাতেই ইফাদের দিকে চোখ পড়ে তার। কয়েক সেকেন্ড কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুট করে লাফিয়ে দাঁড়ায় সে। তারপর একপ্রকার ছুটে আসে ইফাদরে দিকে।

–আপনি আইসা পরছেন ম্যাজিস্ট্রেট স্যার। এইবার আমারে নিয়া চলেন। এই লোকগুলান ম্যালা খচ্চর। আমারে কিছুতেই আপনের লগে যাইতে দিতে চায় না। হাহ! আমার লগে পারবো। আমি তো আপনের লগেই যামু।

ইফাদ মেয়েটির কথায় বেশ মজা পাচ্ছে মনে হলো। ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথা। রেলগাড়ীর মতোই যেন ছুটছে তার মুখের বুলি। থামবার নাম নেই। ইফাদ মোটেও এতো কথা বলা পছন্দ করে না। কিন্তু মেয়েটির এতো কথা বলা দেখেও তার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ কোনো বিরক্তি কাজ করছে না। রূপসীর কথা থামতেই ইফাদ বলে উঠে,

–আচ্ছা! তো কেন আমারই সাথে যেতে চাও তুমি, শুনি?

–আপনে তো ম্যাজিস্ট্রেট। ম্যাজিস্ট্রেট স্যার! আমার আব্বারও স্বপ্ন আমারে ম্যাজিস্ট্রেট বানাইবো।

–শুধু এই কারণেই আমার সাথে যেতে চাও? আর কোনো কারণ নেই?

ইফাদের প্রশ্ন শুনে রূপসী বোকা চাহনি দিলো। যেন সে কোনো অদ্ভুত প্রশ্ন করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবলো। তারপর আনমনে আঙুল দিয়ে মাথা চুলকিয়ে বলতে থাকে,

–আর কি কারণ থাকবো?

রূপসীর বিরবির করে বলা কথাখানা ইফাদের কর্ণগোচর হতেই সেখানে উপস্থিত সকলকে বিস্মিত করে দিয়ে ইফাদ হো হো করে হেসে ওঠে। ইফাদের মতো গম্ভীর মানুষকে আজ পর্যন্ত মুচকি হাসিতেই দেখেছে সবাই। তার এমন প্রাণখোলা অট্টহাসি দেখে সকলেই হা করে তাকিয়ে রয়েছে। শুধু রূপসীই বোকা বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

চলবে……