অপেক্ষিত প্রহর পর্ব-১৭+১৮

0
321

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|১৭তম + ১৮তম পর্ব |

ঘন জঙ্গলের গা ঘেঁষে বহমান নদী বয়ে গিয়েছে। নদীর ঐপাড়েই অন্য গ্রাম। ইফাজের মামা আমাকে টেনে হিঁচড়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। বাসা থেকে যখন বের হই আর মামাকে দেখতে পাই মামা তখন আমাকে হাতে ধরে টেনে বাহিরে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। একজন পুরুষ মানুষের শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারছিলাম না তাই নিজেকে বাঁচাতে চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে মামা একটা বাজে গালি দিলেন। নিজের পকেট থেকে রোমাল বের করে আমার নাকে ধরে রাখলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আমার জ্ঞান ফিরে শেষ রাতে। ইফাজের মামা আমাকে কাঁধে ফেলে খুব দ্রুত হাঁটছিলেন। আমার অবস্থান বুঝতে পেরে হাত পা ছুঁড়তে লাগলাম যার ফলে লোকটি আমাকে নিচে ফেলে দিলেন। আমি চিৎকার করে কান্না করে যাচ্ছি। আমার কান্নায় জঙ্গলের পশু-পাখিরা গর্জে উঠছে। জঙ্গলের ঠিক মাঝ বরাবর এনে মামা আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। গাছের সাথে মোটা দঁড়ির সাহায্যে দুই হাত বেঁধে দেয়। লোকটি দুইহাত বেঁধে দিয়ে এবার আমার চোখের উপরও কালো কাপড় দ্বারা বেঁধে দেয়। হাত, চোখ বাঁধা অবস্থায় চিৎকার করে বলছি,
– আমাকে ছেড়ে দিন। দোহায় লাগে আমাকে মুক্ত করে দিন। আপনি সম্পর্কে আমার মামা হন এভাবে আমার ক্ষতি করবেন না। আপনার ভাগ্নে জানলে আপনাকে কোনদিনও ক্ষমা করবে না।

– আরে রাখ শা**। এখানে কে তোকে বাঁচাতে আসবে। যে আসবে তাঁকেও উপরে পাঠিয়ে দিবো।

আমার চিৎকার, আহাজারি কেউ শুনতে পারছে কি না জানি না। জানি না কতক্ষণ সময় এভাবে ছিলাম। ইফাজের মামার কন্ঠস্বরও শুনতে পাচ্ছিলাম না আর। পিছনের হাত খুলতে চেষ্টা করছি। আমি বুঝতে পারছি আজ নিজের আত্মরক্ষা নিজেরই করতে হবে।
আমার হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছি। জঙ্গলের শুকনো পাতার খচখচ আওয়াজে বুঝতে পারলাম কেউ আসছে। কোনরুপ নড়চড় না করে নিরবে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছি। আমার চোখে পানি দিয়ে চোখে বেঁধে রাখা রুমাল ভিজে গিয়েছে যার কারণে চোখে খুব খারাপ লাগছে। এদিকে হাত রশি থেকে খোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি যার ফলে হাতের অনেকটা জায়গায় ছিঁলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর আমার কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে ইফাজের মামার কন্ঠ শুনতে পেলাম। ইফাজের মামা কাউকে বলছে,

– এই যে তোদের মাল হাজির। কিন্তু তার আগে আমি টেস্ট করতে চাই। তোরা জঙ্গলের ঐ পাশে অপেক্ষা কর। আমার কাজ শেষ হলে এই বস্তিকে নিয়ে যাবি। আর তোদের মালিককে বলে রাখবি এই কাজের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লাগবে আমার। যেহেতু মেয়েটা তোদের মালিকের শত্রু তাই বেশি টাকা দিতে বলবি আমাকে। নয়তো এই মেয়েকে অন্য জায়গায় পাঁচার করে দিবো বলে দিলাম।

ইফাজের মামার কথা শুনে বুঝলাম আমাকে এখানে আনার জন্য বড় কোন ষড়যন্ত্র রটেছে। শুধু এই লোকটা না অন্য কেউ জড়িত আছে আজ আমার এই অবস্থার জন্য। আমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ কি হতে পারে? শুধু কি এই লোকটার লালসা? নাকি অন্য কিছু!

– ঠিক আছে ভাই। আপনি আপনার কাজ করতে থাকুন। মেয়েটা খারাপ না আমরা একটা চান্স নিতে পারি। আপনি একটা কাজ করেন আমাদের সাথে একটু এপাশে আসুন। সব কথা তো আর এই মেয়ের সামনে বলা যাবে না। মেয়েটি শুনেছি খুব চালাক চতুর। আমাদের কথোপকথনে বুঝে উঠতে পারবে কার সম্পর্কে কথা বলছি।

ইফাজের মামার আর ঐ লোকটার কন্ঠস্বর আর শুনতে পেলাম না হয়তো দূরে চলে গিয়েছে। শুকনো পাতার খচখচ শব্দ কম হওয়ায় বুঝতে পারলাম। আবারও চেষ্টা করতে লাগলাম হাতের বাঁধন খুলতে কিন্তু ফলাফল শুন্য। এত শক্ত এবং মোটা দড়ি আমার দ্বারা খোলা সম্ভব না। কিন্তু তবু হার মানিনি চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আবারও কারো এখানে আসার শব্দ পেলাম যা শুকনো পাতার খচখচ আওয়াজে বুঝতে পারলাম। আস্তে আস্তে আমার কাছে চলে আসলো মানুষটা। আমার একদম কাছাকাছি এসে থেমে গেল সে। কেউ একজন আমার চোখের পাতা খুলে দিতেই দৃশ্যমান হলো লিলি বুড়ি মাকে।

– লিলি বুড়িমা তুমি এখানে?

– হরে মা! শেষ রাইতে খেজুরের রসের ঘটি পারতে উঠেছিলাম। এরপর জঙ্গলে কারোর চিৎকার শুনে পিছু নিলাম। এখানে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। আমি এতক্ষণ লুকিয়ে ছিলাম ঐ গাছটির আড়ালে। তোকে দেখে তো আমি চিনে ফেলেছি কিন্তু আমি তো বুড়ো মানুষ। রহিমা আমার লগে আছিলো। রহিমারে কইছি তোগোর রাড়িত গিয়া খবর দিতে। তোর বাপ মা মনে হয় শহরের খবর পাঠাইছে। তুই চিন্তা করিস না আমগোর ইফু এখনি চলে আসবে
কিন্তু তার আগে আমগোর পালাতে হইবো। খাড়া আগে তোর হাতের দড়ি কাঁটি।

কাচির সাহায্যে বুড়িমা হাতের বাঁধন খুলে দিলেন। আমি আর বুড়িমা জঙ্গলের উল্টো পথে দৌড়ে যাচ্ছি। যেভাবেই হোক জঙ্গল পার হতে হবে আমাদের নয়তো লোকদের কবলে পড়লে রক্ষে নেই।

দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অনেকদূর চলে এসেছি আমি আর বুড়িমা। বুড়িমা বয়স্ক মানুষ তাই বেশীদুর দৌঁড়ে যেতে পারছে না, একটা গাছের শিকড়ে বসে পড়লেন বুড়িমা। আর এদিকে আমি বুড়ি মাকে তাড়া দিচ্ছি জঙ্গল থেকে বের হওয়ার জন্য কিন্তু বুড়িমা দুর্বল কণ্ঠস্বর আমাকে উত্তর দিলেন।

– তুই আমাকে ফেলে চলে যা আহিবা। আমার বয়স হয়েছে কত দিন আর বাঁচব। আজ এ জঙ্গলে আমার কিছু হলে কোন আফসোস থাকবে না কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে তোর যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। তুই চলে যা আহিবা।

বুড়িমার কথা শুনে কান্না করে দিলাম। ছোটবেলা থেকে আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন বুড়ি মা। বাবা-মায়ের পর যদি কেউ আদর সোহাগ ভালোবাসা দিয়েছেন সে হচ্ছে লিলি বুড়ি মা। আমার মনের সব কথা বুড়ি মার কাছে অনায়াসে বলতে পারি।

– না বুড়িমা আমি এখান থেকে যাব না। বাঁচলে দুজন একসাথে বাঁচব আর মরলে একসাথে মরব। তুমি আমার সাথে আস্তে আস্তে আসতে থাকো। এদিকে যাই, এদিকে কেউ আসবে না।

বুড়ি মাকে হাতে ধরে এগিয়ে যাচ্ছি জঙ্গলের দক্ষিণ পাশে কিন্তু সেখানে যাওয়াই আমাদের ভুল ছিলো।

বড়ো বড়ো দুই দুইটা জীপ গাড়ি দাঁড়ানো আর তার পাশে কিছু ছেলেপেলে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। তার মানে এই লোক গুলোই আমাকে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য এখানে এসেছে আর আমরা জঙ্গলের গ্রামের পাশের রাস্তায় না এসে শহরের রাস্তায় চলে এসেছি। এই রাস্তা শহরে চলে যায়।

লোকগুলো দেখে বুড়িমা ভীত কণ্ঠস্বর আমাকে বললেন,
– এবার কি করবি আহিবা?আমাদের দেখে ফেললে বিপদ হবে।

– কিছু হবে না বুড়ি মা। তুমি আমার সাথে আসো আমরা ঐপাশের রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে চলে যাব। তাহলে কেউ টের পাবে না।

ছেলেরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার অপরপাশে আমি আর বুড়ি মা দৌঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
আমাদের দৌঁড়ের মাঝে ইফাজের মামা আমাদেরকে দেখে ফেলে। আমাদের দেখে বলতে থাকে ,

– আরে মেয়েটা পালাচ্ছে তো ছেলেরা? আর এই বুড়ি আসলো কোথায় থেকে। আজ দুইটাই মরবে আমার হাতে। এই ধর এই দুইটাকে।

ইফাজের মামার কথা আমার কানে প্রবেশ করতেই ঘামতে শুরু করলাম। বুড়ি মাকে টানতে টানতে রাস্তায় উঠে গেলাম। দৌঁড়াতে লাগলাম শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। বুড়ি মা বার বার থেমে যাচ্ছেন। অনেক দূর চলে আসাতে ছেলেগুলো পিছনে পড়ে রইলো। আমি আনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছি। মাথার উপর সূর্য স্থির হয়ে বসে আছে। আজ আমাদের রক্ষা করতে কেউ আসবে না মনে হচ্ছে। এর মাঝেই একটা কালো গাড়ি আমাদের সামনে এসে থামলো। গাড়ি দেখে আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম।আজকে কোনক্রমে রক্ষা পাবো না আমরা। আমাদের ভাগ্য কি এতই খারাপ! আমার ভাবনা মাঝেই গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে কাইফ ভাই। আমাকে দেখা মাত্রই কাইফ বাই বিচলিত কন্ঠস্বরে প্রশ্ন করলেন,

– আহিবা বোন আমার, তুই এখানে এই অবস্থায় কেন? এই রাস্তা তো শহরের রাস্তা। কোথায় যাচ্ছিস তুই?

কাইফ ভাইয়াকে দেখে হিচকি তুলে কান্না করে যাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ সহায় হয়েছেন।
– আমাদের বাঁচাও ভাইয়া।আর কিছু বলতে পারব না।

– আমার গাড়িতে উঠে আয়।
কাইফ ভাইয়া গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিলেন। প্রথমে আমি গাড়ির ভেতর ঢুকে গা এলিয়ে দিলাম।শরীর আর সায় দিচ্ছে না মনে হচ্ছে এখনই জ্ঞান হারাবো। আমার পিছনে বুড়ি মা গাড়িতে উঠতে যাবেন তাঁর আগেই বুড়ি মার আর্তনাদ শুনতে পেলাম। চোখ জোড়া খুলে বুড়ি মার পানে দৃষ্টিপাত করে দেখলাম বক্ষ বরাবর স্থান থেকে রক্ত বের হয়ে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। বুড়ি মার অবস্থা দেখে আতকে উঠলাম। লাল টকটকে রক্ত দেখে ভাবশূন্যহীন হয়ে গেলাম। কাইফ ভাই বুড়ি মার এই অবস্থা দেখে সামনে তাকান। ততক্ষণে লোকজন পালিয়ে গিয়েছে।
এদিকে রহিমা দূর থেকে বুড়ি মার আহত অবস্থা দেখে চিৎকার করে উঠে। রহিমার চিৎকারে আমারও হুস আসে। গাড়ি থেকে নেমে বুড়ি মাকে ঝাপটে ধরলাম। রহিমার পিছনে ইফাজকে আসতে দেখে কান্না করে দিলাম।
ইফাজ আসতে এত দেরি করল কেন? ইফাজ আমাদের এখানে এই অবস্থায় দেখে কাছে এসে বিচলিত কন্ঠস্বরে বললেন,

– তোমরা এখানে এভাবে কেন? গ্রাম থেকে এতদূর এসেছো যে?
ইফাজের কথার মাঝে কাইফ ভাই বলে উঠলেন,

– আপাতত কোন কথা না বলে উনাকে উঠাতে সাহায্য করুন। হাসপাতালে নিতে হবে।

পিছনের সিটে আমি আর রহিমা বুড়ি মাকে শায়িত করে বসলাম আর সামনে ইফাজ আর কাইফ ভাইয়া।
আমাদের গ্রামের হাসপাতাল ততটা উন্নত না কিন্তু এখানের চিকিৎসার কোন ত্রুটি নেই।
হাসপাতালে পৌঁছাতেই ডাক্তার নার্স চলে আসেন। প্রাথমিক চিকিৎসার সেবা প্রদাম করে ডাক্তার আহত কন্ঠস্বরে আমাদের জানালেন,
– দুঃখিত। উনি আর বেঁচে নেই।

বুড়ি মার মৃত্যুর কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

————-

আমার জ্ঞান যখন ফিরে আসে তখন চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো সাদা দেয়াল, সাদা পর্দায় মোড়ানো ঘরে শায়িত আছি। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে বুঝতে পারলাম আমি হাসপাতালে।
চারদিকে নজর ঘুরিয়ে পরিচিত মানুষদের খুঁজে যাচ্ছি। পেয়েও গেলাম। ঘরের ঠিক কোণায় কাঠের চেয়ারে বসে বাবা ঝিমুচ্ছেন। আমি হয়তো বাবাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আস্তে করে বাবাকে ডাক দিলাম।

– বাবা।

আমার ডাকে বাবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চেয়ার থেকে উঠে বিচলিত কন্ঠস্বরে বললেন,

– জ্ঞান ফিরেছে তোর মা? এখন কেমন লাগছে মা। আর কখনো রাত বিলাতে এভাবে বের হবি না বলে দিলাম। কে তোকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল বল আমায়।

বাবার কথায় কিছু বললাম না। এখন যদি বাবাকে বলি যে আমাকে ইফাজের মামা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তো বিশ্বাস করবে না। বাবার কথায় পাল্টা বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,

– বাবা লিলি বুড়ি মা?
আমার কথায় বাবা তপ্ত শবাস ফেলে উওর দিলেন,
– তুই বাহাত্তর ঘন্টা যাবত অজ্ঞান হয়ে এই হাসপাতালে পড়ে আছিস। শরীরের দুর্বলতা আর অতিরিক্ত চাপের জন্য তোর এই অবস্থা। তোর বুড়ি মাকে বুড়োর পাশেই দাফন করা হয়েছে।

বাবার কথা শুনে নিশ্বব্দে কিছুক্ষণ কান্না করলাম। হঠাৎ ইফাজের কথা মনে হতেই বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,

– বাবা, ইফাজ কোথায়? ইফাজ তো আমাদের সাথে ছিলো।

আমার কথার জবাবে বাবা কিছু বলবেন তার আগেই মা ঘরে প্রবেশ করেন।

– তোর মুখে ঐ ছেলেটার কথা যেন আর না শুনি। আমি আগেই বুঝেছিলাম এই ছেলেটা আমাদের সহ মেয়েটাকে কষ্ট দিবে। কীভাবে এই কাজ করতে পারল ইফাজ? মানছি যে আমরা তোদের বিয়ে মেনে নিয়েছিলাম তাই বলে এভাবে তোকে,,,,
মায়ের কথা শেষ না হতেই বাবা মাকে ধমকে দিলেন,

– আহ্ আহিবার মা! চুপ থাকবে তুমি? ইফাজ আহিবাকে ঠকাবে না এটা আমি নিশ্চিত। ছেলেটা হয়তো পরিস্থিতির চেপে পরে এই পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগ নিয়েছে।

বাবা মার কোন কথা আমি বুঝতে পারছি না। কীসের পদক্ষেপ কিসের ধোঁকা কি বলছে বাবা মা?

– কি বলছো তোমরা? কি হয়েছে ইফাজের?
আমার কথার প্রত্যুওরে মা বলতে শুরু করলেন,

– তোর ইফাজ তোকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে চলে গিয়েছে। যতই গ্রামে জন্ম নেক না কেন, শহরে তো বড়ো হয়েছে! গায়ে শহরের বাতাস বইছে না! শহরের মানুষদের মতো তোর স্বামীও তোকে ধোঁকা দিয়েছে। চলে গিয়েছে তোকে ছেড়ে। আর যাওয়ার আগে একটা চিঠি ছেড়ে গিয়েছে।

মা রাগে হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে গিয়েছেন। একমাত্র মেয়ের সাথে এত বড়ো ধোঁকা দেয়া মেনে নিতে পারছেন না। মা নিজের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ আমার হাতে তুলে দিলেন। চার ভাজের কাগজখানা খুলে দেখতে পেলাম সেখানে গোটা গোটা অক্ষরের চার পাঁচ লাইন লিখা।

” আমাকে ক্ষমা করো হিবারাণী। তোমার এই দুঃসময়ে তোমার পাশে থাকতে পারলাম না। জীবনের আনন্দময় মুহূর্তের পর যে এমন বিষাক্ত সময় আসবে ভাবতে পারিনি। আমি অপারগ আজ। আমার অপারগতা জানান দিচ্ছে আমি তোমাকে সুখী রাখতে পারব না। ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই আমাদের মিল হবে। অপেক্ষা করবে তো হিবারাণী?”

ইফাজের চিঠিখানা পড়ে ধোঁয়াশায় রয়ে গেলাম। ইফাজ কি বলতে চাইছে! সে কি আমাকে মেনে নিবে না? আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু কেন? ইফাজ কি জানে না আমার এই অবস্থার জন্য ইফাজের মামা দায়ী! হয়তো না। ইফাজের মামা তো আর ইফাজের সামনে আসেনি আর না আমি সময় পেয়েছি ইফাজকে সব জানানোর। আমি অপেক্ষা করব ইফাজের জন্য।

সেদিনের পর থেকে মা ইফাজের কথা শুনলেই রেগে যেতেন। কিন্তু বাবা সবসময় আমার পাশে ছিলেন। বাবার ভরসায় দেড় বছর সব সহ্য করেছি। কলেজে আর পা দেইনি। প্রিন্সিপাল স্যারের সহায়তায় ঘরে বসে পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিয়েছি।
পরীক্ষা শেষ হতেই মা বিয়ে দিবে বলে চিল্লিয়ে যাচ্ছিল। শেষে উপায় না পেয়ে নিজেই চলে আসি ইফাজের কাছে।

————–

বর্তমানে,

– এই হিবারানী, কি চিন্তা করছো?
– চিন্তা করছি অতীতের সেই ঘৃণিত দিনের কথা। আচ্ছা ইফাজ! আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
– হুম করো।
– আপনার কি জানতে ইচ্ছে করে না সেই দেড় বছর আগের দিনটির কথা! যেদিন আপনি আমাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে রেখে এসেছিলেন?
আমার কথায় ইফাজ মন খারাপ করে ফেললেন।
– আমি সব জানি হিবারাণী!
ইফাজের কথায় অবাক হয়ে গেলাম। ইফাজ সব জানে মানে?
– আপনি কীভাবে জানলেন?
ইফাজের পানে তাকিয়ে দেখলাম, ইফাজের চেহারার রং পরিবর্তন হচ্ছে। রেগে চোখ মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে।
– তোমার অজ্ঞান হয়ে যাবার পর তোমাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করাই আমি। তারপর চলে যাই তোমাকে যে জায়গায় পেয়েছিলাম সেখানে। রহিমা আমাকে বলেছিল তোমাকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক টেনে-হিঁচড়ে নাকি জঙ্গলের দিকে নিয়ে গিয়েছে আর সেখানে বুড়িমা আছেন।

– রহিমা আপনাকে কোথায় পেল?

– গ্রামের সীমানা পার হতেই মনে হল তোমার কাছ থেকে ভালো ভাবে বিদায় নিয়ে আসিনি। তখন আবার ফেরত আসি গ্রামের দিকে। আর গ্রামে আসতে আসতে শেষ রাত হয়ে যায়। তোমাদের বাড়ির মোড়ে গাড়ি ঘুরাবো এমনসময় রহিমার দেখা মিলে। রহিমা দৌঁড়ে তোমাদের বাসার দিকে যাচ্ছিল। রহিমাকে দেখে ফেলি তাই ডাক দেই। তারপর যখন জিজ্ঞেস করি তখন জানতে পারি তোমার বিপদের কথা। আমি রহিমাকে নিয়ে গাড়ি চড়ে আসতে উদ্যোগ নেই কিন্তু রহিমা বারণ করে দেয় যে, সেখানে ঘন জঙ্গলে গাড়ি নিয়ে যাওয়া মানে তোমার বিপদ। রহিমার সাথে পায়ে হেটে চলি জঙ্গলের দিকে। রহিমা সাহায্যে জঙ্গলের অন্য পথে আমরা আগাতে থাকি আর সেখানেই তোমাকে কাইফ ভাইয়ের সাথে দেখতে পাই।

– তারপর কি হয়েছিল? আপনি কিভাবে জানলেন, এত কিছুর পিছনে কে দায়ী?

– আমি সব জানি। আমি আবার ফেরত আসি সেই জঙ্গলে। সেখানে এসে দেখি আমারই মামা কিছু লোক সেখানে উপস্থিত। মামার আর লোকেদের কথোপকথনে বুঝতে পারলাম সবকিছুর পিছনে মামা দায়ী। মামাকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। মামা আমাকে রেখে আরো কয়েক ঘণ্টা আগেই বের হয়ে যান শহরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য যে এতটাই খারাপ ছিল তা জানতাম না। আমার অবর্তমানে আমার হিবারাণীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর অপরাধে শাস্তি পেয়েছে সে।

ইফাজের কথায় অবাক হয়ে গেলাম। শাস্তি পেয়েছে মানে? কি করেছে ইফাজ ঐ লোকটির সাথে?

– শাস্তি মানে? কি করেছেন আপনি?

ইফাজ আগের থেকেও কঠিন হয়ে আমার কথার উত্তরে বললেন,

– মেরে ফেলেছি। ঐ লোকটা যেই হাত দিয়ে আমার হিবারাণীর দিকে হাত বাড়িয়েছিল সেই হাত আমি কেঁটে ফেলেছি। যে চোখ দিয়ে আমার হিবারানীকে দেখেছে খারাপ উদ্দেশ্যে, সে চোখ আমি উঠিয়ে ফেলেছি। যেই জিহ্বা দিয়ে তোমাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেছে, সে জিহ্বা কেঁটে ফেলেছি। সারা শরীর টুকরো টুকরো করে জঙ্গলের বন্যপ্রাণীদের দিয়ে আহার করিয়েছি।
ইফাজের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। এতোটা নির্দয় কবে থেকে হল আমার ইফাজ ভাবতে লাগলাম।

– আমি আপনাকে খুব ভয় পাচ্ছি ইফাজ?

ইফাজ আমার কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেন। আমার পানে আগাতে আগাতে বললেন,

– একদম ভয় পাবে না হিবারাণী। সে মানুষটা খারাপ ছিল। সে মানুষটা আর আমার সৎ মা মিলে আমার বাবাকে সেদিন মেরে ফেলতে চেয়েছিল। দেড় বছর আগে আমার শহরে ফিরে আসা তা কোন এক্সিডেন্ট ছিল না, ষড়যন্ত্র ছিল।

বাবাকে মেরে ফেলে আমাকে দুর্বল করতে চেয়েছিল এবং দেখো দেড় বছরে আমি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলিনি ঐ শয়তান মহিলাকে। কিন্তু আমার জীবনে আমার হিবারাণী চলে এসেছে। আমার মনে সাহস সঞ্চয় করে দিয়েছে। এখন আর আমি কাউকে ভয় পাইনা। তোমার কাছে একটাই অনুরোধ আমাকে ফেলে যাবে না কোথাও। প্রমিস করো হিবারাণী!

ইফাজের কথায় মুচকি হাসলাম। এতটা ভালবাসে ইফাজ আমাকে। আমিও যে আমার ইফাজ ছাড়া অচল। ইফাজের গালে হাত রেখে বলতে লাগলাম,

” ভালোবাসি খুব ভালোবাসি প্রিয়তম,
জন্ম-জন্মান্তরের প্রেম কখনো ফুরাবে না আমার প্রিয়তমের জন্য।
সারা জীবন তোমার পাশে রয়ে তোমাকে ভালোবেসে যাবো এইভাবে।
আমার অপেক্ষার প্রহর এর দিন শেষ হয়েছে যে তবে”

চলবে…….