অপেক্ষিত প্রহর পর্ব-১৯

0
316

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|১৯তম পর্ব |

মধ্যদুপুরে গরম একটু বেশিই হয়। সূর্য্যিমামা মাথার উপরে স্থির হয়ে বসে থাকে। এই গরমে নিজেকে বাঁচাতে অনেকে ঠান্ডা পানীয়দ্রব্য পান করে তো কেউ বরফগলিত আইসক্রিম খেয়ে শান্তি অনুভব করে।
বর্তমানে আমি আর ইফাজ শহরের ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে আছি প্রায় বিশ মিনিট যাবত।

– আমরা কোথায় যাচ্ছি ইফাজ?

– আমাদের বাড়ি।

– সেখানে কেন? আপনার মা তো আমাকে সহ্য করতে পারে না। শুধু শুধু অশান্তি হবে সেখানে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা কানিজ আছে সেখানে।

– আমি আর এখন কোন ভয় করি না হিবারাণী! এখন আমার কোন ভয় নেই আমার পাশে আমার হিবারাণী আছে এবং আমার বাবা সহিসালামতে আছেন। তোমাকে এখন বাসায় নিয়ে যাব আমার বাবাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য যে দায়ী তাকে শাস্তি দিতে।

– আমি ভয় পাচ্ছি ইফাজ। শাস্তি দিতে গিয়ে না জানি আমাদেরই আবার কোন ক্ষতি হয়ে যায়!

-কিছু হবে না হিবারাণী। আমার উপর ভরসা রাখো। এতদিন আমি একা ছিলাম, দুর্বল ছিলাম। সারা পৃথিবীর সামনে আমি একজন স্বনামধন্য কন্ঠ শিল্পী হয়েও ঘরের ভেতরে দুর্বল ছিলাম। তাঁর একটাই কারণ ছিল, সেই মহিলাটি আমার বাবাকে মারতে চায়। আমার অবর্তমানে বাবাকে বিভিন্ন হুমকি দিতো আমাকে নিয়ে। আমি গানের রেকর্ডিংয়ের জন্য বাহিরে থাকি সেই সুযোগে বাবাকে কষ্ট দিতো। এজন্য বাবা আমাকে প্রমিস করিয়েছিল এখন যেন কিছু না করি। সঠিক সময়ে যেন পদক্ষেপ নেই। এখন সঠিক সময় এসেছে, তুমি আর আমি মিলে শত্রুদের বিনাশ করব।

ইফাজের কথার প্রতুত্তর আর কিছু বললাম না। আমার মাথায় হাজার চিন্তা চলছে। আমি চিন্তা করছি আমার কথা, সেখানে গিয়ে আবারো কানিজ নামক পেত্নীর মুখোমুখি হতে হবে আমায়। তখন না হয় রাগের বশে থাপ্পড় মেরে দিয়েছিলাম কিন্তু সত্যি বলতে আমি একজন বোকা এবং দুর্বল মেয়ে। আমি কি পারব কানিজকে টক্কর দিতে!
গাড়ি থামতেই প্রশ্নবোধক চাহনিতে ইফাজের পানে তাকালাম। ইফাজ আমার চহনিতে মুচকি হেসে বলল,

– বাড়ি চলে এসেছি হিবারাণী। তোমার শ্বশুর বাড়ি। নামবে না?

ইফাজের কথা শুনায় আমার শরীরে প্রশান্তি বয়ে গেল। “তোমার শ্বশুরবাড়ি” বলাতে মনে হল এই বুঝি প্রাপ্য সম্মান পেয়ে গিয়েছি। কিন্তু না! পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল।

– আমার শ্বশুরবাড়ি সেই দিনই হবে যেদিন আপনি সকলের সামনে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবেন। যেদিন আমি আমার প্রাপ্য সম্মান পাবো, সেদিনই আমি মন থেকে মেনে নেব যে এই বাড়িটা আমার শ্বশুরবাড়ি এবং আমি শ্বশুর বাড়িতেই আছি।

– যথা আজ্ঞা আমার হিবারাণী আপনার কথাই চিরধার্য। কিন্তু এর আগে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে তো!

– আপনি পাশে থাকলে আমি এভারেস্ট জয় করতে পারবো, কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু আপনি যদি আমার হাত ছেড়ে দেন তাহলে ভেঙে পরবো।খুব ভেঙে পরবো।

– আমি তোমার পশে সব সময় আছি। এখন চলো বাসায় প্রবেশ করি।

বাড়ির কলিংবেলে চাপ দিয়ে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছি আমরা। ইফাজের হাত খুব শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। যেন কোন ঝড় তুফান আমাদের এই বন্ধন ভাঙতে না পারে।

সদর দরজা খুলে দিলেন আমার শাশুড়ি আম্মা। মুখটা বাংলার পাঁচ বানিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন আমাদের সামনে।
– কোথায় ছিলি তুই ইফাজ, এন নষ্টা মেয়েকে নিয়ে? তাও আবার এক রাত!

ইফাজের মায়ের কথাটা সহ্য হলো না। মুচকি হেসে শাশুড়ি মায়ের উদ্দেশে বললাম,

– কি বলছেন শাশুড়ি মা! শাশুড়ি বউমাকে এসব বলতে হয় নাকি? আগের দিন চলে গেছে বুঝলেন শাশুড়ি-আম্মা! আগে শাশুড়িরা বউদের উপর অত্যাচার করতো, কিন্তু এখন আর কেউ করে না। এখন যদি শাশুড়ি অন্যায় করলে তাকে পট্টি বাধাঁ হয়। আশা করি বুঝতে পারছেন।

ইফাজের মাকে কথাগুলো বলে চলে আসছিলাম কিন্তু মনে হল যে শাশুড়ি মায়ের কথার প্রতুত্তরে পরিপূর্ণ কথাগুলো আমি বলতে পারিনি। তাই আবারো ফিরে আসলাম,

– আর একটা কথা কি জানেন শাশুড়ি-আম্মা! নষ্টা কে তা সবাই ভালো করেই জানে। আমি যেই গ্রাম থেকে এসেছি না! সেই গ্রামের এক মহিলা বাস করত। শুনেছি! মহিলাটিকে পরকীয়ার জন্য গ্রাম থেকে বিতাড়িত করে দেয়া হয়েছিল। আপনি কি চেনেন মহিলাটিকে? আমি কিন্তু চিনি,কিন্তু আপনাকে বলতে পারব না। কারন তাহলে আপনিও নষ্টা হয়ে যাবেন।

আমার কথাগুলো বলার সময় শাশুড়ি মায়ের মুখখানা দেখার মত ছিল। শাশুড়ি মাকে কথাগুলো বলেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে আসলাম।

ইফাজের বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট। নিচ তলায় ডাইনিং, ড্রইং এবং একপাশে ইফাজের ফটো শুটের জন্য কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। আর উপর তলায় হয়তো ইফাজরা থাকে।

কেন যেন ইফাজের উপর আমার এখন খুব রাগ হচ্ছে। ইফাজের পানে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

– ইফু, আমি কি এখানেই থাকবো? আমাকে ঘরে নিয়ে চলো।

ইফাজ আমার কথায় চমকালো। অতঃপর মিনমিন করে আমাকে বলল,
– চলো তোমাকে উপরে নিয়ে যাই।

ইফাজের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যাচ্ছি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বাঁকা চোখে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকালাম। শাশুড়ি মা এখনো তীর্যক দৃষ্টিতে আমার পানে তাকিয়ে আছেন। এই বুঝি আমাকে খেয়ে ফেলবেন।
শাশুড়ি মায়ের তাকানো উপেক্ষা করে ইফাজের হাত শক্ত করে ধরে উপরে চলে আসলাম।

ইফাজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ইফাজ নিজের পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দরজার উপর রাখলো। বইয়ে পড়েছি এটা নাকি কার্ড লক অর্থাৎ আইসি কার্ড লক। কার্ডটা দরজার হাতলের উপর ছোট্ট একটা নিদ্দির্ষ্ট অংশে রাখা হয় আর সাথে সাথে ক্রিংক্রিং আওয়াজে লকটা খুলে যায়। তারপর দরজার হাতলের ঘুরালে দরজা খুলে যায়। খুব মনোযোগ সহকারে ইফাজের কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমার পর্যবেক্ষণ করা দেখে ইফাজ মুচকি হাসে। আমার হাত ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে আবারও দরজা আটকে দেয়।

কথায় আছে না! ” বড়োলোকের বিরাট কারবার” ঠিকই কথা। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা ঘর থাকে খুব ছোট। সেখানে একটা খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলনা আর একটা আলমারি থাকে। আর এই বদ শিল্পীটার গরে মনে হচ্ছে ফুটবল খেলা যাবে। ঘরের মাঝ বরাবর একটা খাঁট আর অপরপাশে একটা বড়ো আয়না যার নিচের অংশে একটা টেবিল রয়েছে।

– আপনি এত কিপ্টা কেন ইফাজ?

ইফাজ ঘরের জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে দিচ্ছিলেন। আমার কথা শুনে পর্দা সরানো বন্ধ করে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন।

– কিপ্টা মানে? আমাকে কোন দিক দিয়ে কিপ্টে মনে হলো তোমার?

ইফাজের কথা শুনে বিছানায় আরাম করে বসলাম।
ইফাজও আমার পাশে বসলো। ইফাজের হাতে আঁকিবুঁকি করে বলতে লাগলাম,
– এই যে আপনার এত বড়ো নাম, এত বড়ো মাপের মানুষ আপনি! মানুষ আপনাকে কত ভালোবাসে, কত ভক্ত আপনার।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইফাজ ধমকে বলল,

– সোজা কথা বলো। নাম, ধাম, কাম সবই আছে আমার, তা জানি। কিন্তু তুমি কি বলতে চাইছো সেই কথা বলো।

– মানে আমি বলতে চাচ্ছি যে, আপনি এত বড়লোক, এত বড় বাড়ি আছে আপনার। কিন্তু আপনার ঘরের জিনিসপত্র একটু নেই।

আমার কথায় ইফাজ অট্টহাসিতে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে একদম আমার পাশে ঘেসে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

– সিরিয়াসলি হিবারাণী! তুমি এই কথা বলছো! মানে ইফাজের বউ এই কথা বলছে? এতদিন আমার সাথে থেকেও কি তোমার বরকে একটু জানতে পারোনি! বুঝতে পারোনি? তোমার বর বড়ো মাপের মানুষের সাথে বড় মনের মানুষ বুঝলে! তুমি তোমাদের বাড়ির দু’তলা দেখে বুঝোনি! এসো আমার সাথে।

ইফাজ আমাকে নিয়ে ঘরের একপাশে দেয়ালের কাছে নিয়ে গেলো। খুব ভালভাবে খেয়াল করে দেখলাম দেয়ালের গা ঘেঁষে বক্স আকারে কি যেন আটকে রয়েছে দেয়ালের সাথে। ইফাজ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

– এইযে আমার ঘরের জিনিসপত্র। এখানে আমার কাপড়, ওয়ালেট, ঘড়ি সবকিছুই থাকে। আর এই যে বিশাল বড় আয়না দেখছো সেটার নিচে যেই টেবিল আছে সেখানে পারফিউম এবং অন্যান্য জিনিস থাকে এবার বুঝলে তো হিবারাণী!
ইফাজ এক এক করে বক্সগুলো খুলে আমাকে দেখাতে লাগলো।

– হ্যাঁ বুঝেছি, বড়লোকের বিরাট কারবার।

– জ্বি ম্যাডাম, আপনারও এমন হবে। শুধু কিছু ঘন্টার অপেক্ষা।

ইফাজকে আরো কিছু বলবো এর আগে আমাদের দরজায় করাঘাত করে কেউ। দরজার করাঘাতে ইফাজ বিরক্ত হলো খুব যা ইফাজের চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম। ইফাজ এগিয়ে এসে ঘরের দরজা খুলে দিলেন,

– ইফাজ কি হয়েছে তোমার সোনা? আমাকে ইগনোর করছো কেন? তুমি জানো না আমি তোমাকে কত ভালোবাসি! তোমার জন্য আমি সব ছাড়তে রাজি আছি। এই যে দেখো আজকের গানের রেকর্ডিং ছিল কিন্তু আমি রেকর্ডিং ছেড়ে চলে এসেছি। তারপর রাতে আমার একটা কনসার্টে ছিল কিন্তু কনসার্টও আমি ক্যানসেল করে দিয়েছি শুধুমাত্র তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য।

ইফাজ আর আমি দুই জনের একজনও এই মুহূর্তে কানিজকে এখানে আশা করিনি। ইফাজ নিজের হাত দ্বারা কপালে ঘর্ষণ করে কানিজৈর দিকে ফিরে পরপর কয়েকটা থাপ্পড় দিলেন কানিজের সেই নরম তুলতুলে গালে। থাপ্পড় খেতে খেতে কানিজ বসে পড়লো জমিনে।
এদিকে আমি কানিজের থাপ্পড় খাওয়া দেখে জোরে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে কানিজের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

– ইফাজ আর আহিবার মাঝে আসলে পরপর থাপ্পড় খেতে খেতে তোর জীবনটা শেষ হবে রে কানিজ! তুই যতবার আসবি আমাদের মাঝে ততোবারই থাপ্পড় খাবি। আমার হাতে খাবি না হয় ইফাজের হাতে খাবি। পরবর্তীতে যদি আমার আর ইফাজের কাছে আসার চেষ্টা করিস তাহলে তোর হাত পা ভেঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করে রাখবো।

আমার কথা শুনে কানিজ আসছিলো আমার কাছে কিন্তু তার আগেই ইফাজ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। কানিজের উদ্দেশ্যে শক্ত কন্ঠস্বরে বলে উঠে,

– খবরদার আমার বৌয়ের দিকে হাত বাড়ানোর আগে দশবার ভেবে নেবে যে কার দিকে হাত বাড়িয়েছো। যেই হাত দিয়ে আমার বউকে আঘাত করতে চেষ্টা করবে সেই হাত হাত থাকবে না একদম বেহাত হয়ে যাবে বলে দিলাম।

কানিচ আমাদের দুজনের কথা শুনে কান্না করতে করতে আন্টি আন্টি বলে চিল্লাতে চিল্লাতে বাহিরে চলে গেল। আমরা দুজন একসাথে বলে উঠলাম

“যেমন কর্ম, তেমন ফল।”

চলবে……..