অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-২৩+২৪

0
144

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
২৩তম_পর্ব
~মিহি

-“তোমার কি রিসেন্টলি ব্রেকাপ হয়েছে?”

তূর্যর প্রশ্নে তিরা ভ্রু কুঁচকালো। প্রথম সাক্ষাতে এমন প্রশ্ন সে কাউকে করতে দেখেনি, অপরিচিত কোনো মেয়েকে তো নয়ই!

-“এ ধরনের প্রশ্ন করার কারণ?”

-“ফাংশনে তুমি অসুস্থ হওয়ার পর আমি তোমায় রুমে রেখে এসেছিলাম। তোমার চোখে পানি ছিল, কোনো একটা নাম বিড়বিড় করছিলে বারবার। সেজন্য মনে হলো। তার মধ্যে তুমি আবার আমার কলেজেই পড়েছো। সিনিয়র বড় ভাই হিসেবে একটা দায়িত্ব আছে তো।”

-“আপনি আমার কলেজে পড়েছেন?”

-“নাহ! তুমি আমার কলেজে পড়েছো। আমি সিনিয়র তাই কলেজের উপর আমার অধিকার আগে।”

তিরা হেসে ফেললো। তূর্যর কথাবার্তা মানুষের দু মিনিটে মন ভালো করাতে যথেষ্ট।

-“আপনি আমার বড় ভাই হচ্ছেন তাহলে।”

-“অবশ্যই কিন্তু কান্নাকাটি করা ছোটবোন তো আমি নিব না। কেন কাঁদছিলে বলো। দরকার লাগলে তোমার এক্সের দুয়েকটা হাড় ভেঙে দিয়ে আসবোনি!”

তিরা সামান্য হাসলো। বাস জ্যামে পড়েছে। সময় বোধহয় আরেকটু বেশি লাগবে। তিরা ভেবেছিল তূর্যর সাথে যেতে তার অস্বস্তি বোধ হবে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কমফোর্টেবলি যেতে পারছে। ঐশি বলেছিল তাকে তূর্য মিশুক স্বভাবের তবে যথেষ্ট কেয়ারফুল। তিরার মনে হলো বাসে বসে বসে সে একটা বড় ভাই পেয়েছে। একজন বড় ভাইয়ের শখ কেন যেন সব মেয়েরই একটু বেশি থাকে। তিরারও ছিল। আজ সে শখ পূরণ হলো।

-“একা একা কী ভাবতেছো?”

-“কিছুনা। আসলে ফাংশনের দিন আমার এক্সের সাথেই দেখা হয়েছিল ভুলক্রমে।”

-“বুঝলাম! তো শুনাও কাহিনী।”

-“অনেক লম্বা কাহিনী!”

-“জ্যামও লম্বা, শোনাও শোনাও!”

তিরা শুরু থেকে অল্পবিস্তর কাহিনী শোনালো তূর্যকে। কথা শেষ করতেই তার মন বিমর্ষ হয়ে পড়লো। যতবার সে এসব কথা মনে করে ততবার তার মনে উদাসী বিকেলের ম্লান রঙ ভর করে।

-“এক্সকে মিস করতেছো?”

-“নাহ! ও ভালো থাকুক ওর মতো।”

-“ও মা গো টুরু লাব!”

তূর্যর বলার ভঙ্গিতে তিরা কটমট করে তাকালো তূর্যর দিকে। তিরা দুঃখে আছে আর সে কিনা মজা নিচ্ছে!

-“আরে আরে খেপো না! একটা ইন্টারেস্টিং কথা শোনো। তোমার শাশুড়ির নামে আমার একটা এক্স ছিল। অবশ্য একটা আর কী, একমাত্র এক্স। কয়েকদিন আগে ব্রেকাপ হয়েছে ভুল বোঝাবুঝির কারণে।”

-“তাহলে আপনি আমার না হওয়া শ্বশুর হচ্ছেন। এক কাজ করেন, আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিয়েন।”

-“আচ্ছা যাও ডিল ডান! আমার ছেলে হওয়া অবধি সিঙ্গেল থাকো, তারপর আমি নিজে দাঁড়ায়ে থেকে আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিব!”

তিরা হাসতে লাগলো, মুখের মলিন ভাব আর নেই তার। তূর্য যে ভাই হিসেবে খারাপ হবে না তা তিরা উপলব্ধি করলো অথচ এই উপলব্ধি তো তিয়াসের বেলাতেও এসেছিল। এখন যোগাযোগই নেই তাদের। তিরাও দূরত্ব বাড়িয়েছে। আগে বড়রা বলতো বন্ধুত্ব নাকি স্কুললাইফ অবধিই টেকে, তিরা বিশ্বাস করেনি। এখন সত্যিই অনুভব করে স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর বন্ধুদের সার্কেলটা ভাঙে। সবার আলাদা বেস্টফ্রেন্ড থাকে যাদের সাথে হয়তো ন্যূনতম যোগাযোগটা বজায় থাকে।

-“তিরা জানো কলেজে এই বৃহস্পতিবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান?”

-“না। আমি কিভাবে জানবো?”

-“আমি তোমার দুই বছর আগে কলেজ ছাড়ছি তাও জুনিয়ররা ইনভাইট করছে অথচ তুমি মাত্র কলেজ থেকে বের হইছো আর এসবের খবর পাও না? লজ্জার ব্যাপার তো!”

-“আপনার মতো বিখ্যাত তো আমি নই, কলেজে নিজের ক্লাসের দশজনই আমারে চেনে না আর তো জুনিয়র!”

-“আচ্ছা আমি ইনভাইট করতেছি। আমার সাথে যাবে তুমি!”

-“বৃহস্পতিবারের আগেই আমি ফিরে যাবো হয়তো!”

-“বৃহস্পতিবার অবধি থাকো, শুক্রবার বিকেলে আমার সাথে ফিরো! বড়দের মানা করলে পড়াশোনা হবে না, বুঝছো?”

তিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কথোপকথন বেশিক্ষণ চললো না। মিনিট দশেকের মাথায় বাস স্ট্যান্ডে থামলো। তূর্য এবং তিরা নেমে পড়লো।

-“তোমায় রেখে আসি চলো!”

-“লাগবে না, আমি যেতে পারবো।”

-“আরেহ! বিয়াই-বিয়াইনের সাথে কথা বলে আসি। আমার ছেলেকে কেমন ঘরে বিয়ে দিচ্ছি দেখবোনা?”

-“আমার বাড়িতে গিয়ে কী বলবেন? আপনি আমার শ্বশুর?”

-“অবশ্যই!”

-“জুতোপেটা দুজনকেই করবে! আপনি বাসায় যান, আমি যেতে পারবো।”

-“আচ্ছা চলো রিকশাতে তুলে দিচ্ছি।”

তিরা আর আপত্তি করলো না। তূর্য তিরাকে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজেও খালার বাড়ির উদ্দেশ্যে এগোলো। রিকশায় বসে তিরা আশেপাশের রাস্তা দেখতে লাগলো। মাত্র কয়েকটা দিন সে এ শহর থেকে দূরে ছিল অথচ সব যেন পরিবর্তন হয়ে এসেছে। রাজশাহীর সৌন্দর্যের চেয়ে আজ এ চেনা রাস্তায় মিশে থাকা ধুলোর আস্তরণেও স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছে সে।

________________________________________

-“অফিস থেকে এসেই টিভি? তারান্নুম! তুমি আর তোমার ছোট মেয়ের চক্করে আমি টিভির রিমোট পাই-ই না! আমার বড় মেয়েটা থাকলে আমার দলও ভারি থাকতো এখন!”

-“এমনভাবে বলছো যেন তিরা আমার দলের বাইরে! তোমার দলে আসলে কেউই নাই। দুই মেয়েই আমার দলে!”

তিরার বাবা কিছু বলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। তিনি আর তর্কে না জড়িয়ে দরজা খুলতে গেলেন। তিরা পরপর তিন চারবার কলিং বেল বাজালো। বাবার আসার শব্দ পেয়েই সে দরজার পাশে লুকালো। তিরার বাবা দরজা খুলতে এসে কাউকে না দেখে অবাক হলেন। দরজা খুলে পাশে তাকাতেই তিরার হাসিমুখ দেখে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। মেয়েকে দেখে তিনি অশ্রু আটকানোর প্রচেষ্টা করলেন।

-“আব্বু! কান্নাকাটি করলে আমি চলে যাবো এখনি।”

-“ভেতরে আয় চুপচাপ! কান্নাকাটি করছি না, চোখে কী যেন পড়েছে!”

-“আমাকে দেখেই চোখে কিছু পড়লো? বুঝি বুঝি!”

তিরা হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকলো। তিরাকে দেখেই তন্বী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো নিজের বোনকে। তারান্নুম বেগম ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বলতে পারছেন না। তন্বী তখনো তিরাকে জড়িয়ে ধরেই আছে।

-“আপু জানো আব্বু এখনি তোমার কথা বলতেছিল! তুমি একশো বছর বাঁচবা। আব্বু বলতেছিল তুমি থাকলে নাকি আব্বুর দল ভারী হবে। এখন তুমি বলো তো তুমি আব্বুর টিমে নাকি আমাদের টিমে?”

-“আমি কারো টিমে না। অনেকদিন পর বাড়ি আসছি। তোমরা সরো, টিভির রিমোটে এখন আমার একচ্ছত্র আধিপত্য হবে আর আম্মু কী রান্না করছো বলো!”

তারান্নুম বেগম এতক্ষণ তিরার হাসিমুখ দেখছিলেন। তিরা প্রশ্ন করাতে ঘোর কাটলো তার।

-“কী খাবি বল, বানিয়ে দিচ্ছি। মাছের ঝোল রেঁধেছি, ঐটা তো খেতে পারবিনা।”

-“না, আজ যা রেঁধেছো তাই দাও। তোমার রান্না অনেক মিস করেছি।”

তারান্নুম বেগমের চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে এলো। মেয়েরা এত দ্রুত কেন বড় হয়? পড়াশোনার জন্য এখন দূরে থাকে, ক’দিন বাদে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। পরের ঘরে চলে যাবে তখন চাইলেই দেখা করা যাবে না, মেয়েকে রেঁধে খাওয়ানোর আর সুযোগ হবে না।

-“মা কী ভাবছো?”

-“কিছুনা তুই বস, আমি তোর জন্য ডিম ভাজছি!”

তিরাকে কিছু বলতে না দিয়ে তারান্নুম বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন। তিরা হাসিমুখে নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখলো ঘরটা ঠিক আগের মতোই আছে। তিরা ড্রয়ার খুলে দেখলো ডায়েরিও আগের মতোই পড়ে আছে ড্রয়ারে। ডায়েরিতে জমানো স্মৃতিগুলোও পড়ে আছে। সময় সব ক্ষতের মলম হিসেবে কাজ করে কথাটার সত্যতা তিরা বুঝতে পারছে। এখন এই ডায়েরি কিংবা নিয়নের কথা ভেবে ম্লান হয়ে যাওয়া মুখখানির অন্তরালে তীব্র জমানো যন্ত্রণা আর নেই, বুকের বাঁ পাশটা আর ক্ষীণ চিনচিন করছে না। তিরা ডায়েরি রাখতেই ফোনটা বেজে উঠলো। আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে। তিরা রিসিভ করবে কিনা বুঝতে পারছে না। ব্রেকাপের পর সব আননোন নম্বরগুলো নিয়নের নম্বর মনে হতো। ছোট্ট আশা থাকতো এই বুঝি নিয়ন কল করেছে। এখন সে আশা নেই তবে নিয়ন কি সত্যিই কল করলো? গতদিন দেখা হয়েছে বলে যে সে কল করবে এমনটা আশা করা কি উচিত?

চলবে…

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
২৪তম_পর্ব
~মিহি

-“তিরা পৌঁছেছো সেইফলি?”

-“জ্বী ভাইয়া। কিন্তু আপনি আমার নম্বর কোথায় পেলেন?”

-“ঐশির থেকে নিলাম। একা গিয়েছো, ঠিকঠাক পৌঁছাতে পেরেছো কিনা জানার জন্য। ভাই ভেবেছো যখন, একটু দায়িত্ব তো পালন করতে হবে। রেস্ট নাও তুমি।”

তিরা বিদায় জানিয়ে কল কেটে দিল। ততক্ষণে তারান্নুম বেগম খাবার বেড়েছেন, তিরাকে খেতে ডাকলেন তিনি। তিরা ফোন রেখে খেতে গেল। খাবার টেবিলে গল্পের আসর বসলেও তিরা সেদিকে মনোযোগ ধরে রাখতে পারলো না। ফেলে আসা সময় হঠাৎ পথ আটকালে যেমন দ্বিধা গ্রাস করে মানবমনকে ঠিক তেমন করে নিয়নের অকস্মাৎ আগমন গ্রাস করেছে তিরার শান্তিটুকু।

____________________________

সকালবেলা উঠেই তিরা নিশাতকে আগে কল করলো। পরপর কয়েকবার রিং হলেও নিশাত কল রিসিভ করলো না। তিরা অবাক হলো। নিশাতের ফোনে রিং হচ্ছে অথচ সে কল ধরেনি এমন সময় খুব কমই এসেছে। তিরা মন খারাপ করে ফোনটা পাশে রেখে বসে রইল। তিরার বাবা এবং তারান্নুম বেগম অফিসে গেছেন, তন্বীও স্কুলে। একা থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না তিরার। ভেবেছিল নিশাতের সাথে বের হবে কিন্তু সেও তো ফোন ধরছে না। বিরক্ত হয়ে টিভি অন করলো তিরা। চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ নিশাতের নম্বর থেকে কল আসলো। তিরা চটজলদি রিসিভ করলো।

-“কী রে? আমি রাজশাহী গেছি বলে এখানে নতুন বান্ধবী পাইছিস? কল ধরতেছিলি না কেন?”

-“আরে বিয়ে খাইতে আসছি।”

-“কার বিয়ে?”

-“অর্ণব ভাইয়ার। স্যরি হুদাই তোরে ভাইয়ার সাথে মেলানোর ট্রাই করছি। ভাইয়া তো তার এক্সের প্রেমেই ছিল। আজ বিয়ে করতেছে দুইজন। হঠাৎ করেই সব ঠিকঠাক হয়েছে গত সপ্তাহে। তুই যখন কল দিছিলি তখন বিয়ে পড়ানো হচ্ছিল, ওখানে ছিলাম। সেজন্য কল রিসিভ করতে পারিনি।”

-“আচ্ছা তুই বিয়ে উপভোগ কর। পরে ফ্রি হয়ে আমাকে কল দিস।”

-“আচ্ছা!”

তিরা কল কেটে দিল। অতঃপর অনলাইনে ঢুকে অর্ণবকে সব জায়গা থেকে ব্লক করলো। তিরা চায় না অর্ণবের বিষয়ে কোনো কিছু নিয়ে সে কোনভাবে রিগ্রেট ফিল করুক। তবে অর্ণবের কাজে তিরা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। মানুষের মন কত দ্রুত রঙ বদলায়! প্রাক্তনকে বিয়ে করার সংবাদটা তিরার মনে অন্যরকম দাগ কাটে। মানুষ প্রাক্তনের সাথেও সুখী হয় অথচ তিরা! তার জীবনে যে আসে, সে-ই যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে বিদায় নেয়।

একাকীত্ব আর পরিবারের আদরের মিশেলে দুটো দিন কাটিয়ে ব্যাগপত্র গোছানোর সময় তিরার মনে পড়লো তূর্যর কথা। সে বলেছিল কলেজে অনুষ্ঠান আছে, সেটা এটেন্ড করতে। তিরা বুঝে উঠতে পারছেনা অনুষ্ঠানে যাবে কিনা। দোনোমনা করতে করতে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল কলেজ থেকে একবার ঘুরে আসবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। তূর্যর নম্বরে কল করলো সে।

-“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম। কলেজের জন্য বের হয়েছো?”

-“ভাইয়া অনুষ্ঠান কখন?”

-“এইতো আধঘণ্টার মধ্যে। তোমাকে নিতে যাবো আমি?”

-“না ভাইয়া, আমার বাসা কাছেই। আপনি পাঁচ মিনিট পর একটু কলেজের গেইটে আসেন। আমি যাচ্ছি।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

তিরা জলদি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলো। যেতে পাঁচ মিনিটের মতোই লাগলো। দরজায় বেশ ভীড়। তিরা আশেপাশে লক্ষ করে তূর্যকে খোঁজার চেষ্টা করলো। আচমকা কারো সাথে ধাক্কা লাগায় তিরা খানিকটা পিছনে পড়ে যেতে ধরলো। নিজেকে সামলে সামনে তাকাতেই নিরাকে দেখে খানিকটা অবাক হলো তিরা। নিরা এখানে কেন?

-“নিরা? ভালো আছো?”

-“তুমি তিরা আপু না? নিয়ন ভাইয়ার ফোনে তোমার ছবি ছিল।”

-“তুমি এখানে কী করছো?”

-“আমি নাফসীকে সাথে নিয়ে আমার স্কুলে এসেছিলাম। ভাইয়া বলেছিল এখান থেকে আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে কিন্তু …”

-“কী হয়েছে?”

-“নাফসী হঠাৎ করে আমার হাত ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে আপু। আমি খুঁজে পাচ্ছি না।”

-“আচ্ছা দাঁড়াও, টেনশন করো না। আমি দেখছি।”

নিরার চোখ অশ্রুসজল। তিরাও বুঝতে পারছে মেয়েটার মনের অবস্থা। নাফসী ছোট, তার মধ্যে এখানে এত ভীড়! তিরা দূরে তাকিয়ে তূর্যকে লক্ষ করতেই তূর্যও তাকে দেখে এগিয়ে আসলো।

-“তিরা এতক্ষণ? আমি পঁচিশ মিনিট ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”

-“ভাইয়া, একটা হেল্প দরকার।”

-“কী হয়েছে বলো।”

-“এটা নিরা, আমার আত্মীয়। ও হঠাৎ করে ওর ছোট বোনকে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের ওকে খুঁজতে হবে।”

-“ছবি আছে তোমার কাছে?”

-“ছবি? এক মিনিট!”

তিরা ফোন বের করে নিজের একটা আইডি থেকে নিয়নের প্রোফাইলে ঢুকে নাফসীর ছবি বের করে তূর্যকে দেখাল। তূর্য কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখলো। পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে ভেতরে চলে গেল। তিরা কিছুই বুঝতে পারলো না কী হলো। তূর্য হঠাৎ এভাবে ভেতরে চলে গেল কেন? একটু পর তূর্য নাফসীর হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো। নিরা নাফসীকে দেখতে পেয়েই তাকে জড়িয়ে ধরলো। তিরা তখনো বুঝতে পারছেনা হলোটা কী এখানে। তূর্য নাফসীর খোঁজ পেল কোথায়?

-“ভাইয়া আপনি নাফসীকে কোথায় পেলেন?”

-“ও অনুষ্ঠানে ছিল একা বসে। আমি ওর পাশেই বসেছিলাম। অনেকক্ষণ ট্রাই করেও কথা বলতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম বড় কারো সাথে এসেছে, কথা বলতে চাইছেনা। তারপর তোমার কল পেয়ে বাইরে আসলাম। শেষে যখন তোমার কথা শুনলাম তখন বুঝতে পারলাম ও ভীড়ের মধ্যে সবার সাথে ভেতরে চলে গিয়েছিল।”

-“ওহ আচ্ছা! নিরা তুমি আমাকে আন্টির নম্বর দাও, আমি ওনাকে কল করছি।”

-“ভাইয়াকে কল করো আপু। ভাইয়া মনে হয় আশেপাশেই আছে।”

তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিয়নের নম্বর ব্লকলিস্টে। তিরার নম্বরটাও বোধহয় নিয়নের ব্লকলিস্টে। নিরাকে সে কথা কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারলো না সে।

-“নিরা, হতে পারে তোমার ভাইয়া রাস্তায় আছে। কল করলে যদি শুনতে না পায়? আমি তোমার বাড়িতে জানাচ্ছি, আন্টি তোমার ভাইয়াকে জানিয়ে দিবে।”

-“আচ্ছা আপু, আম্মুর নম্বর নাও।”

নিরার থেকে নম্বরটা নিয়ে তিরা নিয়নের মায়ের নম্বরে কল করলো। তিরার হাত কাঁপছে। একসময় নিয়ন বলতো আন্টি নাকি তার সাথে কথা বলার জন্য উৎসুক কিন্তু নিয়ন বলতো তিরা লজ্জা পাবে। তখন কথা বলা হয়ে উঠেনি। আজ সবকিছু শেষ হওয়ার পরও যেন শেষ হচ্ছে না। সেই নম্বরটাতেই কল করতে হচ্ছে তিরার যে নম্বরে আগে কল করার সাহস করেনি।

-“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম। কে?”

-“আন্টি আমি তিরা, আমি…”

-“চিনতে পেরেছি। ভালো আছো মা তুমি?”

-“আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। আসলে একটা জরুরি কথা ছিল। নিরা এবং নাফসীর সাথে আমার দেখা হয়েছে হঠাৎ। ওরা নিয়ন…ভাইয়াকে খুঁজে পাচ্ছে না। আপনি একটু দয়া করে ভাইয়াকে বলবেন গভর্মেন্ট কলেজের গেইটে আসতে?”

-“আচ্ছা আমি বলছি মা, তুমি একটু ওদের সাথে ওখানে থেকো আচ্ছা?”

-“আচ্ছা আন্টি।”

তিরা কল রেখে নিরা এবং নাফসীর দিকে তাকালো। দুজনেই রীতিমতো ভয় পেয়েছে।

-“নিরা নাফসী, তোমরা ভয় পেয়ো না। তোমাদের ভাইয়া একটু পরেই চলে আসবে। তোমরা এসো, ছাউনিতে বসো।”

তিরা দুজনকে বসালো। তূর্য এখনো বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে তিরার দিকে।

-“ননদদের সেবা করতেছো?”

-“সাহায্য করা উচিত! আত্মীয় হয় তো।”

-“আমি বুঝিনা যার নিজের দুইটা বোন আছে, সে কী করে অন্য একটা মেয়েকে এতটা আঘাত দিতে পারে?”

তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিয়ন একটা রহস্য! এ রহস্যের ভেদ তিরা এখনো করতে পারেনি। নিরা এবং নাফসীকে বসিয়ে রেখে তিরা এবং তূর্য অন্যপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। একটু পর নিয়ন এসে সে দৃশ্য দেখলো। নিরা এবং নাফসীর চোখেমুখে দুশ্চিন্তা তখনো কমেনি, ভীত আবহ রয়েই গেছে। নিয়নকে তার মা কল করে শুধু এটুকু বলেছে যে নিরা এবং নাফসী কোথায় আছে, তিরার কথা তিনি বলেননি। তিরাকে দেখেই নিয়নের মাথায় রাগ উঠলো। উপরন্তু নিরার অশ্রুসজল চোখ দেখে নিয়ন ভাবলো তিরা তাকে উল্টোপাল্টা কিছু বলেছে। এক সেকেন্ড সময় নিলো না নিয়ন ভাববার জন্য। তিরার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল তিরার গালে। তিরা অকস্মাৎ এ ব্যবহারে খানিকটা ভড়কে গালে হাত দিয়ে নিয়নের রুদ্রমূর্তি রূপের দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে…