অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-২৫+২৬

0
130

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
২৫তম_পর্ব
~মিহি

“তুমি কী পরিমাণ ক্যারেক্টারলেস! তোমার তো একজন দিয়ে হয়না। তোমার আমাকে লাগবে, নিজের ক্রাশকে লাগবে, ছোটবেলার বন্ধুকে লাগবে, খালাতো বোনের দেবরকে লাগবে এমনকি আমার বন্ধুকেও তোমার ভালো লাগবে! একটুও বুঝছো কোনদিন আমায়? সন্দেহ করতে পারছো শুধু! আমি নিশাতকে প্রপোজ করছি জেনে ব্লক করে দিলা। একবার জিজ্ঞাসা করছো আমাকে? তোমাকে জেলাস ফিল করানোর চেষ্টা ছিল ঐটা যাতে তুমি বোঝো অন্য কারো সাথে তুমি কথা বললে আমার কতটা জ্বলে! আমার ফ্রেন্ডলিস্টে একটা মেয়ে অবধি ছিল না তবুও তোমার সন্দেহ! আমার সবকিছুর এক্সেস তোমার কাছে ছিল তবুও বিশ্বাস করোনি আমায়। কখনো বোঝার চেষ্টা করেছো একটা ছেলে পরিবার থেকে দূরে নিজের ক্যারিয়ার বিল্ড আপ করার ট্রাই করে যাচ্ছে, সে কতটা সাফার করে? সেখানে তোমার প্যারা! তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলে তিরা কিন্তু সত্যি বলতে তোমার থেকে দূরে থাকাটাই ভালো ছিল আমার জন্য। তোমার ফ্যামিলি আমার ফ্যামিলিকে যত কথা শুনিয়েছে তারপর তো তোমার পরিবার আমার পা ধরলেও আমার আর তোমার লাইফে ফিরে আসা উচিত না! আমার সবকিছুতেই তো সমস্যা তাদের তো এখনো কেন আমার প্রতি ফিলিংস রেখেছো? এসবের মধ্যে এখন আমার বোনদের ব্যবহার করতেছো? আর কতটা নিচে নামবে তুমি তিরা?” নিয়ন একনাগাড়ে কথাটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তিরার চোখ এতক্ষণ অশ্রুসজল ছিল, এখন মুহূর্তে তা অঙ্গারের ন্যায় রক্তিম লাল বর্ণ ধারণ করলো। তিরা তূর্যকে ইশারা করলো বাচ্চাদের একটু আড়ালে নিয়ে যেতে। নিয়নের সে বোধটুকু না থাকলেও তিরার আছে।

-“আমি ক্যারেক্টারলেস? আচ্ছা, তোমার এক্স যখন আমাকে নক দিয়ে বললো তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে সে কথা আমি বিশ্বাস করেছিলাম নাকি তুমি যা বলেছিলে সেটা বিশ্বাস করেছিলাম? আমার পরিবার যখন বলেছিল তোমার মধ্যে সমস্যা আছে। আমি তাদের কথা শুনেছি নাকি তোমার উপর বিশ্বাস করেছিলাম? তোমার সেই এক্স যখন বলল সে তোমার সাথে বাইকে একটা মেয়েকে ঘুরতে দেখেছে, আমি একবারো জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে আমি তো কখনো তোমার সাথে বাইকে ঘুরিনি তবে মেয়েটা কে? তুমি জেলাস হয়ে নিশাতকে বলেছো আমাকে না বলে আর আমি জেলাস হয়ে ব্লক করলেই দোষ? নিয়ন, তুমি সারারাত জেগে নিশাতকে টেক্সট করেছিলে, এটা দেখার পরও আমার স্বাভাবিক থাকার কথা? হোক নাটক তবুও আমি কোনো ছেলের সাথে এমন করলে তুমি ঠিক থাকতে? আমি তোমাকে জেলাস করার চেষ্টা করেছি কিন্তু সেটা তুমি আমার কাছে প্রকাশ না করে অন্যকে বলেছো! তার সামনে আমাকে থার্ড ক্লাস বলছো অথচ এটা আমাদের মধ্যে মিটমাট করার কথা ছিল। অথচ আমি যখন সরাসরি প্রশ্ন করেছি তুমি কখনো উত্তর দাওনি। নিশাতকে যখন তুমি প্রপোজ করেছিলে ঐসময় আমার পরিবারে কী পরিমাণ ঝামেলা চলতেছিল সেটাও আমি তোমাকে বলতে পারি নাই! অথচ আমার জীবনের নব্বইভাগ জেনেও তুমি আমারে এক ফোঁটা চেনোনি। আমার বাবা-মাও জানেনা আমি অ্যাবিউজড হয়েছিলাম, সেটাও তুমি জানতে। অথচ আমাকে একটুও চিনোনি! তোমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড আমি রাখতাম অথচ আমার হোয়াটসঅ্যাপটাও তো তোমার নম্বর দিয়ে খোলা ছিল। সেটা ভুলে গেছো? আমি এসব নিয়ে আর কিছু বলতে চাইনা নিয়ন আর না নিরা নাফসীকে আমি কিছু বলেছি। ওদের নিয়ে প্লিজ এখান থেকে চলে যাও!”

-“হ্যাঁ তা তো যাবোই। তোমার প্রেমিক অপেক্ষা করছে তো, যাও যাও কোলে গিয়ে বসে পড়ো।”

-“নিয়ন মুখ সামলে কথা বলো। আমি তোমার মতো না যে কলিগ বলে বলে কলিগ উইথ বেনিফিটস বানিয়ে রাখবো।”

-“মানে?”

-“মানে তোমার তেহযীব! আমার চেয়ে তো তুমি ভালো জানো সেসব। আমার আর কিছু জানার ইচ্ছে নেই নিয়ন। তোমাকে চিটার বলছি না আমি যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করাই লাগবে। আমি চরম মাত্রার গাধা, আমি গাধার মতো ভাবতাম তুমি বাধ্য হয়ে সব করেছো। আমি সেই গাধাই থাকতে চাই। মাঝেমধ্যে সবটা সত্যি না জানা, না বোঝাই মঙ্গলের।”

-“তিরা আমার কথা শোনো।”

তিরা নিয়নকে এড়িয়ে সামনে এগোতে নিলে নিয়ন পেছন থেকে তিরার হাত টেনে ধরে তাকে সামনে আনে। দূরে থেকে তূর্য এটা দেখে তৎক্ষণাৎ এগিয়ে আসে।

-“ওর হাত ছাড়ো!”

-“ওহ হো! তোমার প্রেমিকের তো জ্বলতেছে তিরা! খুব পসেসিভ বুঝি?”

তূর্য শর্ট টেম্পার্ড স্বভাবের। নিয়নের অঙ্গভঙ্গি তার মোটেও ভালো লাগলো না। ধাক্কা দিয়ে নিয়নকে সরিয়ে দিল সে। নিয়নের মাথায়ও তখন রাগ চড়ে বসে আছে। দুজনের রাগারাগি মারামারিতে রূপ নিতে সময় লাগলো না। তিরা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে তূর্যকে সরানোর চেষ্টা করলো,”ভাইয়া প্লিজ সরে আসেন, ভাইয়া!” তূর্য তিরার কথা শুনলো না। অন্যদিকে নিয়ন তূর্যর প্রতি তিরার উৎকণ্ঠা মেনে নিতে পারছে না। দুজনের মারামারি আরো বাড়লো। তিরা উপায় না পেয়ে দুজনের মাঝে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই সামনে থেকে একজোড়া হাতের ধাক্কা লেগে সে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। রাস্তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়েছিল তারা তিনজন। ধাক্কা লাগার কারণে তাল সামলাতে না পেরে তিরা রাস্তার মাঝখানে গিয়ে থামলো। নিজেকে স্থাবর করার প্রচেষ্টা করার আগেই পাশ থেকে একটা মাইক্রো এসে ধাক্কা দিল তিরাকে। তিন হাত দূরে ছিটকে পড়লো তিরা। মাথার পেছনের অংশে আঘাতটাও লাগলো মারাত্মক। মুহূর্তেই পিচঢালা রাস্তা রক্তে লাল হয়ে এলো। অকস্মাৎ এ ঘটনায় ঘোর কাটলো তূর্য এবং নিয়নের। নিয়ন ছুটে এসে তিরার মাথা নিজের কোলে রাখলো। নিয়নের হাত কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। ক্ষণিক না ভেবে তিরাকে কোলে তুলে নিয়ে একটা গাড়িতে উঠলো নিয়ন। তূর্যও এগিয়ে এলো।

-“ভা…ভাইয়া প্লিজ আপনি নিরা নাফসীকে একটু দেখে রাখবেন? আমায় তিরার সাথে যেতে দিন প্লিজ!”

নিয়নের নমনীয় গলার আকুতি না চাইতেও মেনে নিতে হলো তূর্যর। নিয়ন কাছের হাসপাতালে তিরাকে নিয়ে এলো। স্ট্রেচার অবধি কোলে করে তিরাকে নিয়ে গেল। তিরার রক্তে নিয়নের সমস্ত শার্ট ভিজে উঠেছে। স্ট্রেচারে তিরাকে রাখার পরেও নিয়ন তিরার হাত ছাড়লো না। নিয়নের নিঃশ্বাস থেমে এসেছে। তিরার চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে সে নিঃশ্বাস আরো ক্ষীণ হয়ে আসছে নিয়নের। কেবিনে ঢোকার কিছু মুহূর্ত আগে তিরা নিয়নকে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো,”আমার বা … বাবা-মা আ..আসার আগে দয়া করে এখান থেকে আর আ..আমি মারা যাওয়ার আগে আমার জীবন থেকে চলে যা… যান প্লিজ!” নিয়ন তিরার হাত ছেড়ে দিল। তিরাকে কেবিনে নেওয়া হলো। নিয়ন সামনে থাকা চেয়ারে বসে দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো। তিরার বলা শেষ বাক্যটা তার কর্ণকুহরে এত মাত্রায় কম্পন সৃষ্টি করছে যে নিয়ন সহ্য অবধি করতে পারছে না।

____________________________

-“নিরা এবং নাফসীকে আমি বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি। তিরার কী অবস্থা?”

তূর্যর প্রশ্নে নিয়ন মুখ তুলে তাকালো। প্রত্যুত্তর করার শক্তিটুকুও যেন অবশিষ্ট নেই তার মাঝে।

-“জানিনা ভাইয়া! সব আমার দোষ! আমি ওর লাইফে একটা ব্যাড লাক ছাড়া কিছু না। আমি যতবার ওর ভালোর জন্য দূরে সরে যেতে চেয়েছি ততবার ওর জন্য খারাপ কিছু হয়ে ফিরেছি। ও বলেছে আঙ্কেল আন্টি আসার আগে এবং ওর মৃত্যুর আগে যেন আমি ওর সামনে থেকে চলে যাই। আমি নিশাতের নম্বর দিচ্ছি ভাইয়া, ওকে একটু আসতে বলেন। আমি চলে যাচ্ছি। তিরা আমার মুখ দেখলে হয়তো বেঁচে থাকার অবশিষ্ট ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলবে।”

নিয়নের চোখের দিকে তাকাতে পারলো না তূর্য। চোখ কি কখনো মিথ্যে বলে? নিয়নের চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে মনের কোনো এক কোণে আজও তিরার জন্য একটু অনুভূতি পসরা করে সাজানো। এ অনুভূতি কি আদৌ সত্যি নাকি মেকি?

চলবে…

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
২৬তম_পর্ব
~মিহি

তারান্নুম বেগমের মনে হচ্ছে তার সমস্ত পৃথিবী থমকে গেছে। মেয়ের এ অবস্থা, মেয়ের কথা শুনে স্বামীরও মাইনর স্ট্রোক করা সব মিলিয়ে তিনি অকুল পাথারে ভাসছেন। মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস বন্ধ করে কেবল সামনে ঘটে যাওয়া সবকিছু দেখে যাচ্ছেন তিনি।

নিশাত তারান্নুম বেগমের পাশেই আছে। এই মানুষটাকে সে একসময় ভিলেন মনে করতো যখন তিনি নিয়নের থেকে তিরাকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। আজ নিশাত নিজের ভুল বুঝতে পারছে। নিয়নই বোধহয় তিরার জীবনের সবচাইতে অপয়া বস্তু যে তিরাকে কেবল যন্ত্রণা ছাড়া অন্য কোনো স্থায়ী অনুভূতি দিতে পারেনি। নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তিরার অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। ডাক্তার বলেছেন ইন্টারনাল আঘাত না থাকলেও আঘাতটা মারাত্মক, এখন আইসিইউতে রাখা হয়েছে তিরাকে।

-“আন্টি আপনি আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, সব ঠিক হবে ইনশাআল্লাহ।”

-“নিশাত, তুমি বলেছিলে এক্সিডেন্টের সময় তুমি ছিলে তিরার পাশে। এটা কি সত্যি বলেছো? অন্য কোনো ঘটনা নেই তো?”

তারান্নুম বেগমের প্রশ্নে হকচকালো নিশাত। মায়েদের মন কেন যেন বড্ড চালাক! তাদের কাছ থেকে কিছু লুকোনো যায় না। কিন্তু নিশাত কোনভাবেই তিরার মাকে সত্যিটা জানাতে পারবে না। তিরা কখনোই চাইবে না নিয়নের নামটাও আর কখনো তার পরিবেশ সামনে উচ্চারিত হোক। নিশাতের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিয়নের উপর। একটা মানুষ এতটা স্বার্থপর কী করে হতে পারে? তিরাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো সুযোগ কি বাকি রেখেছে সে? নিয়তিই বা কেন এত নিষ্ঠুর যে বারংবার তিরাকে তার সেই করুণ অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে?

________________________________________

আঞ্জুমান আরা তিরাকে দেখতে এসে বোধহয় মুসিবতেই পড়লেন। তারান্নুম বেগম অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন দীর্ঘসময় ধরে।

-“ভাবী কী হয়েছে? আপনি কিছু বলবেন?”

-“আঞ্জু, তিরা কি ঠিক হয়ে যাবে তো?”

-“ইনশাআল্লাহ ভাবী।”

-“তোমার ফোনটা দাও তো আঞ্জু, মাকে কল করি একটু। আমি এখানে, তন্বী একা বাড়িতে আছে। মায়ের….”

-“নেন ভাবী!”

আঞ্জুমান আরা ফোন তারান্নুম বেগমকে দিয়ে নিজের ভাইয়ের কেবিনের দিকে এগোলেন। তারান্নুম বেগম ফোন থেকে নিয়নের নম্বরটা দেখলেন একবার। অতঃপর নিজের মাকে ফোন করে তন্বীর কাছেই থাকতে বললেন। আঞ্জুমান আরাকে ফোন ফেরত দিলেন একটু পরেই।

-“আঞ্জু, তুমি হাসপাতালে থাকবে একটু? মা আসা অবধি আমি একটু তন্বীর সাথে দেখা করে আসি? সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মেয়েটা এ সময় একা থাকতে পারবে না।”

-“আচ্ছা ভাবী যান, চিন্তা করবেন না একদম। আমি আছি এখানে, মাও আসবে একটু পর। ভাইয়ারাও আসছে। আপনি নিশ্চিন্তে যান।”

তারান্নুম বেগম মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে একবারো তিরার কেবিনের দিকে তাকালেন। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ব্লাডব্যাংক থেকে রক্ত দেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে দুইবার। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ডাক্তাররাও পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না। তারান্নুম বেগম অনুভব করতে পারছেন নিজের বুকে জমে উঠা শুন্যতা। পরক্ষণেই সে বুকে পাথর রেখে তিনি নিজের ফোন থেকে নিয়নের নম্বর ডায়াল করলেন। কল রিসিভ হলো না। তারান্নুম বেগম জানতেন রিসিভ হবে না। শুন্যতম সম্ভাবনা নিয়ে তিনি দ্বিতীয়বার নিয়নের নম্বর ডায়াল করলেন। দ্বিতীয়বারে নিয়ন কল রিসিভ করলো যার প্রত্যাশা তারা বেগম করেননি।

-“আসসালামু আলাইকুম।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম। আমি জানি তুমি জানো আমি কে। অযথা নাটক করে প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। তোমার সাথে দেখা করতে চাই আমি। তিরা যে হাসপাতালে এডমিট আছে তার নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আগামী দশ মিনিটের মধ্যে এখানে আসবে।”

তারান্নুম বেগম কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলেন। নিয়ন স্বভাবতই তাকে খুব ভয় পায়। বোধহয় তারান্নুম বেগমের গাম্ভীর্য তাকে ভীত করে তোলে। তারান্নুম বেগম ইচ্ছে করেই গম্ভীর কণ্ঠে নিয়নকে আসতে বলেছেন। নিয়নের সাথে মুখোমুখি কথা বলা দরকার তার!

দশ মিনিটের আলটিমেটাম দিলেও নিয়ন এলো সাড়ে সাত মিনিটের মাথায়। বেশ হাঁপাতে হাঁপাতে তারান্নুম বেগমের সামনে দাঁড়ালো সে। তারান্নুম বেগমের হাতে পানির বোতল ছিল। নিয়নের দিকে তা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। নিয়ন খানিকটা সংকোচবোধ করে শেষমেষ পানির বোতলটা নিল। কয়েক ঢোক পানি পান করে বোতলটা যথারীতি তারান্নুম বেগমকে ফেরত দিল।

-“তো কেমন আছো নিয়ন?”

-“আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। আল্লাহ যেমন রেখেছেন আর কী!”

-“তো বগুড়ায় কবে এসেছো?”

-“দুইদিন আগে।”

-“তিরার সাথে আজই প্রথম দেখা করেছো?”

এ প্রশ্নে নিয়ন ভড়কালো। তারান্নুম বেগম অতি ঠাণ্ডা মেজাজে প্রশ্ন করছেন অথচ নিয়ন ক্রমাগত ঘামছে। কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। তিরার সাথে দেখা করার কথা সে স্বীকার করতে পারবে না।

-“কথা বলছো না যে?”

-“আমার তিরার সাথে দেখা হয়নি আন্টি।”

-“ওহ আচ্ছা। সেটাই তো, তিরা তো হাসপাতালে। ও কী করে তোমার সাথে দেখা করবে? ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা যাও তুমি।”

-“আ..আচ্ছা আন্টি।”

-“তোমার কাছে তো ঐশিবাণী এসেছিল যে তিরা এই হাসপাতালে, তাইনা?”

-“মা …মানে?”

-“তোমাকে আমি কলে শুধু এটুকুই বলেছিলাম তিরা যে হাসপাতালে আছে তার নিচে আসতে। হাসপাতালের নাম তো আমি বলিনি তবে তুমি কী করে জানলে তিরা এই হাসপাতালে আছে?”

-“আ.ন্টি…লোকেশন ট্র্যাক করা…”

-“হ্যাঁ লোকেশন ট্র্যাক করা তো তোমার কাছে ডালভাত কিন্তু তোমার বাড়ি এখান থেকে ন্যূনতম দশ কিমি দূরে। দশ মিনিটের আগেই এতদূর আসলে কী করে? আমাকে শেখাচ্ছো এসব? তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না? কেন তিরার ক্ষতি করতে চাইছো?”

-“আমি তিরার ক্ষতি করতে চাইনি আন্টি আর না কখনো চাইব।”

-“প্রতিমুহূর্তে ওর ক্ষতি করে গেছো তুমি। আমার মেয়ে শেষ কবে মন খুলে হেসেছে আমি নিজেও দেখিনি। এর দায়ভারটা কার জানো? তোমার! ম্যানুপ্যুলেট করে ফেলেছিলে তুমি আমার মেয়েটাকে আর তারপর হঠাৎ অবহেলা ছুঁড়ে দিলে। কী ভেবেছো? এসব জানিনা? বাবা-মা জানেনা এমন কিছু সন্তানের জীবনে কখনো ঘটে না। তোমাকে শাস্তি দিলে কি আমি তিরাকে ফিরে পাবো নিয়ন? আমার মেয়েটা জীবন মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলছে। এর দায়ভার অস্বীকার করতে পারো তুমি? তোমাকে আমি খুন করে টুকরো টুকরো মাটিতে পুঁতে ফেললেও আমার রাগ কমবে না। তবুও আমি ঠাণ্ডা মাথায় তোমাকে বলছি আমার মেয়ের নাগালের বাইরে চলে যাবে তুমি। ওর যোগাযোগের মধ্যে আসার চেষ্টা করবে না। ও যেন চাইলেও তোমার সাথে যোগাযোগ না করতে পারে। আমি জানি আমার মেয়ে দুর্বল তবে তোমার সাথে আবার যোগাযোগ করার মতো দুর্বলতা বোধহয় সে আর দেখাবে না। বুঝতে পেরেছো?”

-“জ্বী!”

-“যার জন্য আমার মেয়েকে ছেড়েছো তার কাছে থেকো। মাঝরাস্তায় তাকে ফেলে যেও না আবার। নয় মাস লেগেছে আমার নিজের মেয়েকে এ পৃথিবীতে আনতে, আট সপ্তাহ লেগেছে ওর হৃদস্পন্দন তৈরি হতে। তোমার কয়েক মুহূর্ত সে হৃদস্পন্দন থামিয়ে যন্ত্রণার রক্তরস আমার মেয়ের শিরা উপশিরায় বাহিত হবে এটা আমি থাকতে সম্ভব না। ভালোমতো ওয়ার্ন করছি মনে রেখো। দ্বিতীয়বার যেন এসব বলতে না হয়।”

-“আন্টি শেষবারের মতো একটাবার একটু তিরাকে দেখতে দিবেন প্লিজ? এরপর আমি কখনো ওর সামনে দাঁড়াবো না, কোনদিন না। আমি সবকিছু ছেড়ে চলে যাবো কিন্তু একবার একটু ওর সাথে দেখা করতে পারি। শুধু কিছু সেকেন্ড! একটু ওর পাশে বসবো। প্লিজ?”

-“নাহ!”

নিয়নের করুণ আকুতির বিপরীতে তারান্নুম বেগম প্রত্যাখ্যান বাক্য শোনালেন অতি সহজে। তিনি নিজের মনকে পরিপূর্ণ কঠোর করেছেন। কারো আকুতি মিনতিতে তিনি আর গলবেন না, নিয়নের কথাতে তো মোটেও নয়। বিষকে কাছে এনে তা দূরে সরানো সহজ হয়না আর সেখানে নিজের মেয়ের শিয়রে নিজিই বিষ অর্পণ তারান্নুম বেগম কখনো করতে পারবেন না।

চলবে…