অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0
190

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
অন্তিম_পর্ব
~মিহি

তিরার সুস্থ হতে সপ্তাহ চারেক সময় লাগলো। এক সপ্তাহ সে আইসিইউতে ছিল, প্রায় বেঁহুশ বলা চলে। এখন তাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। তিরার বাবাও মোটামুটি সুস্থ হয়েছেন। মেয়ের সুস্থতাতেই তিনি যেন নিজের বেঁচে থাকার তাগিদ ফিরে পেয়েছেন। সুস্থ হওয়ার পর তিরার মধ্যে অন্যরকম চাহনি লক্ষ করেছেন তারান্নুম বেগম। চোখে অন্যরকম একটা ঔজ্জ্বল্য! এ চাহনির অর্থ তিনিও ভেদ করতে পারেননি এখন অবধি তবে মেয়ের দিকে তার খেয়াল এখন সর্বোচ্চ। নিয়ন নামক অমানিশার ছায়াটাকে যে বিদেয় করা গেছে তাতেই তিনি সামান্য সন্তুষ্ট হয়েছেন। নিয়নের আকুতিগুলোও বড্ড মেকি মনে হয়েছে তার। তিরাও যদি বুঝতো একটু! মেয়েটা কি এখনি নিয়নের প্রতি দুর্বল? এতটা দুর্বল হতে পারে তার মেয়ে?

_________________________

হাসপাতাল থেকে ফেরার দ্বিতীয় দিনে নিশাত এলো তিরার সাথে দেখা করতে। নিশাতের মুখে হাসির রেশ নেই। তিরা নিশাতের এমন মলিন মুখ দেখে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো।

-“তুই এই পেঁচার মুখ নিয়ে কেন আসছিস? দরকার নাই যা!”

-“মজা নিস না। সিরিয়াস একটু কথা আছে।”

-“তো বল। আমি তো হার্টের রোগী না যে আমার সাথে সিরিয়াস আলোচনা করা যাবে না।”

-“তিরা! আমি আসলেই সিরিয়াস। নিয়ন ভাই তিন সপ্তাহ আগে আমাকে কল দিছিল।”

-“কী জানার জন্য? আমি বেঁচে আছি নাকি পুলিশ কেইস হয়নি কোনটা জানার জন্য?”

-“তুই সুস্থ আছিস কিনা এটা জানার জন্য। ভাইয়া একটা চিঠি পাঠিয়েছে আমার এড্রেসে। বলেছে তুই সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরলে যেন তোকে দিই চিঠিটা।”

-“কবে পাঠিয়েছে চিঠি?”

-“গত সপ্তাহে।”

-“কুরিয়ারে?”

-“হুম।”

-“দে।”

নিশাত দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও চিঠির খামটা তিরার হাতে দিল। তিরার হাতের ক্ষতও এখনো শুকায়নি। নিশাতের হাত থেকে খামটা নিয়ে সেটা খুললো তিরা। দুটো কাগজ ভেতরে। একটাতে তিরার চোখের স্কেচ করা, সাথে চিঠিটা। চিঠিটা পড়া শুরু করলো তিরা,

“তিরা,

আগে ভাবতাম মানুষ সম্বোধনহীন চিঠি কেন লেখে। আজ বুঝতে পারছি সম্বোধনহীন চিঠি লেখার চেয়ে যন্ত্রণার হলো খুব কাছের মানুষটির সম্বোধনহীন হয়ে যাওয়া। সুস্থ হয়েছো কি? আমি তো আর দেখতে পারবো না কখনো। শেষবার যখন গিয়েছিলাম, আমার আকুতি তোমার মায়ের মন গলাতে পারেনি। আমার ব্যর্থতা! যেখানে তুমিই আমার ভালোবাসা বাক্য শুনেও ফিরতে পারোনি সেখানে অন্য কেউ আমার আকুতি না বোঝাই স্বাভাবিক। তুমি সবসময়ই জানতে চেয়েছো কেন আমি তোমাকে হঠাৎ করে ছেড়ে দিলাম। বরাবরই প্রশ্নটা এড়িয়ে এসেছি। আজ সব উত্তর দিয়ে হারাতে চাই।

তিরা তোমাকে মনে আছে একদিন তুমি রান্না করার সময় আমি কল করেছিলাম? তুমি রিসিভ করোনি। পরে যখন রিসিভ করলে তখন রুক্ষস্বরে জবাব দিয়েছিলে। আমি তোমার কণ্ঠে নিজের প্রতি অবজ্ঞা খুঁজে পেয়েছিলাম। তার উপর তোমার দাদী তোমার চাচাতো বোনের দেবরের সাথে তোমাকে মেলানোর কথা বলেছিল এটা শুনেও আমি আহত হয়েছিলাম। আমি এই বিষয়গুলো নিতে পারছিলাম না। বলতেও পারছিলাম না আবার ফেলতেও পারছিলাম না। এসবের মাঝখানে আবিরের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হলো, সব মিলিয়ে তখন আমি মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম। ফ্যামিলির প্রবলেম তো ছিলই, ক্যারিয়ারে তো তখন চৌদ্দটা বেজে ছিল। আমার একটু ব্রেক দরকার ছিল কিন্তু তুমি কখনোই আমাকে একা ছাড়তে না। প্রবলেমের সময় তো ভুলেও না! কিন্তু ঐ সময়টাতে আমার তোমাকেও বিরক্ত লাগছিল। বারবার মনে হতো আমি তোমার যোগ্য না! তোমার ফ্যামিলির কথা কানে বাজতো। সবসময় মনে হতো আমার সাথে থাকলে তোমার ক্যারিয়ারটাও নষ্ট হবে। এসব ভেবেই আমি ঠিক করেছিলাম তোমার থেকে দূরে সরে যাবো কিছু সময়ের জন্য। তোমার উপর খানিকটা বিরক্তও ছিলাম কারণ সোজাভাবে আমায় একা থাকতে দিচ্ছিলে না তুমি। সেজন্য তেহযীবের সাথে ছবি তুলে তোমায় দিয়েছিলাম। এসবের উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে রাগানো।

তিরা, তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা এটা সত্য! মাঝখানে আমার জীবনে মেয়েরা এসেছে তবে তোমার প্রতি আমার অনুভূতি সবচেয়ে বড় সত্য ছিল। লং ডিসট্যান্সে বিশ্বাস করাটা খুব টাফ আমিও জানতাম কিন্তু তোমার আচরণ সত্যিই আমার একটা সময়ে এসে বিরক্ত লাগা শুরু হয়েছে। এসব কিছু থেকে একটু শান্তি পাওয়ার জন্য আমি তোমার থেকে দূরে সরে গেছি।

পেয়েছো নিজের প্রশ্নের উত্তর? এখন নিশ্চয়ই কোনো বাহানায় আর আমাকে কল করতে হবে না? আর একটা কথা, আমি বিয়ে করেছি। তোমায় এ কথা না জানালেও চলতো। তবুও জানালাম। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার অধিকার সবারই আছে, আমিও তাই করলাম। ঢাকাকে আর ঘৃণা করতে হবে না তোমার। তোমার এক্স এখন আর ঢাকায় থাকে না! এমনকি এ সীমানাতেই থাকেনা। আমার প্রতি একটু হলেও দুর্বলতা তোমার ছিল কিন্তু এখন আর থাকবে না! কারণ এখন তুমি জেনেছো আমি অন্য কারোর স্বামী। বোধহয় অন্যের স্বামীর দিকে নজর দিতে চাইবে না।

তোমার এ স্কেচটা ছিল, ফেরত দিলাম। ভালো থেকো।

ইতি
তোমার অপ্রিয় প্রাক্তন ”

তিরা চিঠিটা পড়ে সামান্য হাসলো। তিরার ঠোঁটের রহস্যময় হাসি নজর এড়ালো না নিশাতের।

-“হাসছিস কেন? কী লিখেছে?”

-“আমাকে আজীবন জিলাপি বলে আসা মানুষটার জিলাপির মতো প্যাঁচানো চিঠি পড়লাম। সে বলেছে তার আমার থেকে ব্রেক প্রয়োজন ছিল! আমার সব প্রশ্নের উত্তর সে দিয়েছে নাকি! তার এক্স বৌ দাবি করা মেয়ে আমাকে তার সাথে বাইকে ঘুরতে দেখেছিল। আমি কখনো তার বাইকে উঠিনি। তাহলে এই মেয়েটা কে ছিল সে প্রশ্নের উত্তর এখনো দেয়নি। সুবিধাবাদী উত্তর দিয়েছে কেবল।”

-“এখন কি তুই আবার ঐ লোকটার কাছে উত্তর খুঁজবি?”

-“নাহ! প্রশ্ন অনেক আছে, যেসবের উত্তর ও কখনো দিতে পারবে না। সত্যকে এত প্যাঁচানো যায় না! তাছাড়া যে মানুষ যত কম বোঝার চেষ্টা করে সে তত সুখী হয়। আমিও আর কিছু বুঝতে চাইনা। অবুঝ থাকার মধ্যে যতটুকু অতৃপ্তি আছে তার চেয়ে বেশি মানসিক প্রশান্তি আছে।”

-“এই না হলে আমার বান্ধবী! এখন শোন তোর আসলে একটা…”

-“টিপিক্যাল ফ্রেন্ডদের মতো বিয়ে করতে বলবি না একদম!”

-“ছাগল শোন আগে! এসব বিয়ের চিন্তা পরে। এখন তোর জীবনটা হলো প্রোডাক্টিভ হওয়ার, সময়টা উপভোগ করার। ট্যুর দে, ভার্সিটির মজা নে। দিনশেষে যদি এমন কেউ আসে যে তোর দোষগুলোতে তোকে জাজ না করে তোকে কারেক্ট করবে, তার গলায় মালা ঝুলাস!”

তিরা মুচকি হাসলো। এখন লাঠিতে ভর করে ধীরে ধীরে হাঁটতে পারে সে। তিরা উঠে ড্রয়ার থেকে ডায়েরিসহ অন্য সবকিছু বের করে আনলো। চিঠি এবং স্কেচটাও মেঝেতে ফেলল অন্য জিনিসগুলোর সাথে। বিছানার পাশের টেবিল থেকে দিয়াশলাই এনে তড়িৎ গতিতে আগুন ধরিয়ে দিল জিনিসগুলোতে। মুহূর্তের মাঝে ধীরে ধীরে পুড়তে লাগলো কাগজগুলো। তিরা নুপুর দুটোও আগুনে ফেলল। স্মৃতি সব একবারে মুছে যাওয়াটাই ভালো।

-“এই আগুনে কী দেখতে পাচ্ছিস নিশু?”

-“তোর অতীত দাউদাউ করে জ্বলছে! তুই কী দেখতে পাচ্ছিস?”

-“আমার প্রত্যাবর্তন! এতদিন এই আগুনটাই লাগানো উচিত ছিল আমার, পারিনি! সময় সব শেখায়। আজ আগুন লাগাতে শিখিয়েছে, কাল এ আগুনে পুড়েই খাঁটি হতে শিখাবে। আফসোস এটুকুই যে আমি আমার পরিবারকে ভুল বুঝেছি দীর্ঘসময় ধরে।”

-“আফসোস করিস না। প্রেম বস্তুটাই এমন। প্রেমে পড়া মানুষের কাছে প্রেমবিরোধী কোনো উপদেশ কখনোই ভালো লাগে না, সায়ানাইডের মতো বিষাক্ত লাগে সবকিছু। দিনশেষে সবাই বুঝতে পারে সবকিছু।”

তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আগুনের উত্তাপ কমে এসেছে। কাগজগুলোর ইতোমধ্যে ছাই হয়ে গেছে। তারান্নুম বেগম এসে দেখলে কি তিরাকে বকবেন? নাকি খুশির ঝিলিক দেখা যাবে তার চোখে? তিরা ভাবনায় পড়লো। পরক্ষণেই তার মনে সে অনুভূতি করলো প্রশান্তির মন্দমধুর পবন। চোখ বন্ধ করে কেবল ‘শুকরিয়া’ উচ্চারণ করে ঠোঁটজোড়া সামান্য প্রসারিত করলো সে। এ হাসি অকৃত্রিম, প্যাঁচানো এক সূত্রক থেকে মুক্তি পাওয়ার হাসি এটি! তিরা আনমনে আওড়ালো,

“মানা কাভি কাভি সারে জাহান মে আন্ধেরা হোতা হ্যায়, লেকিন রাত কে বাদ হি তো সাভেরা হোতা হ্যায়….”

সমাপ্ত