অবশেষে তুমি পর্ব-৯+১০

0
553

#অবশেষে তুমি
#লেখিকা—-Nazia Shifa
#পর্ব–০৯
————————
ঘুম ভাঙার পর নিজেকে বিছানায় দেখে চমকে গেলো নূর। কাব্য তখন ব্যালকনি থেকে রুমে আসছিল।নূরকে জাগতে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে বললো-‘ঘুম ভাঙলো তবে।

-‘আমি এখানে কীভাবে আসলাম?

-‘উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও তাড়াতাড়ি।

-‘এখানে আসলাম কিভাবে?

-‘আমি নিয়ে এসেছি।এখন যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।রাত আটটা বাজে।

-‘কিহ?রাত আটটা বাজে আর আপনি এখন বলছেন।সরুন।

বিছানা থেকে উঠে এক দৌড়ে ওয়াশরুমে গেল নূর।ফ্রেশ হয়ে সোজা মিসেস রেহানার রুমে গেলো সে।মিসেস রেহানা নামাজ শেষে বেডে বসে তবজি পড়ছিলেন।নূরকে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন -‘কিরে উঠেগেছিস এদিকে আয় বস।

মিসেস রেহানার ডাকে নূর যেয়ে ফ্লোরে বসে তার কোলে দুই হাত রেখে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো-

-‘মামনি জানো আজকে তোমার ছেলে আমাকে বকেছে।এত্তগুলা বকেছে।

-‘কি বলিস কাব্য তোকে বকেছে?

-‘হ্যা।আমি কিন্তু কিছুই করি নি।শুধু শুধু বকেছে।

-‘দাড়া আজকে।আচ্ছা করে বকে দিব।

মিসেস রেহানার কথা শুনে শয়তানি হাসি দিয়ে মনে মনে বললো-আমাকে ভুল প্রতি একটা করে চড় মারবে হুহ…এত সোজা।আমিও কম কিসে।আজকে আপাদত বকা শুনুন 🥱

-‘আমার আম্মুর কাছে আমার নামেই বিচার দিচ্ছ?

হঠাৎ কারো কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠলো নূর।ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল কাব্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।হায়রে নূর কবে যে তোর বুদ্ধি হবে।কার নামে বিচার দিতে আসছিস।এখন তোর অবস্থা কি হবে?

-‘ন,,না ক,কই কি,,কিছু ব,,বলি নি আমি।

-‘আচ্ছা। একটু রুমে আসো তো।

রুমে যেতে বলছে কেন?হায় হায় চড়াবে না তো?আল্লাহ এবারের মতো বাঁচিয়ে দেও।সামনে আরও সাবধানে বিচার দিব।প্লিজ।

-‘নূর!!

-‘হ্য,,হ্যা।

-‘রুমে আসতে বলেছি আসো তাড়াতাড়ি।

-‘জ্বী।
নূরকে আসতে বলে কাব্য চলে গেলো।এদিকে নূর-‘মামনি আমি যাবনা।তোমার রাক্ষস ছেলে আজকে আমাকে মেরেই ফেলবে।

-‘কিছু বলবে না যা।আর এখন না গেলে আরও রেগে যাবে।তাড়াতাড়ি যা।

-‘হুম।
.
.
রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নূর।ভেতরে যেতে ভয় হচ্ছে তার।বড় করে শ্বাস নিয়ে দরজা ঠেলে পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করলো।কিন্তু কাব্য তো রুমে নেই।

-‘যাহ বাবা মাত্রই তো ডাকলো।কোথায় গেলো?যাক ভালোই হয়েছে নেই(বিড়বিড় করে বললো)।
হঠাৎ পেটের ওপর ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো নূর।শাড়ী ভেদ করে নূরের পেটের ওপর হাত রেখে তার ঘাড়ে মুখ গুজে বললো -‘কি যেন বলছিলে,আমি বকেছি তোমাকে,তোমার কোনো দোষ নেই,শুধু শুধু বকেছি তোমাকে?বাহ তা মিথ্যা কথা যে বললে এখন শাস্তি তো পেতে হবে তোমাকে।

কাব্যের স্পর্শে স্তব্ধ হয়ে গেছে নূর।নড়ার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না।ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে সে।তাকে চুপ থাকতে দেখে কাব্য আবার বললো-

-‘কি হলো বলো….শাস্তি দিবো?

এবার কোনোরকম মুখ খুললো নূর।বললো-

-‘দে,,দেখুন আ,,আপনি যা ক,,করেছেন তাই বলেছি।মিথ্যা বলিনি।যেতে দিন আমাকে।

-‘আচ্ছা তাহলে এখন যা করছি এটাও তো মিথ্যা না।এটাও বলে দিবে বুঝি।

-‘ছিহ,,,কিসব আজেবাজে বকছেন।ছাড়ুন।

হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে নূরকে নিজের সাথে আরও চেপে ধরে ঘাড়ে চুমু দিতে দিতে বললো-

-‘ছাড়বোনা।আজকে নো ছাড়াছাড়ি অনলি জড়াজড়ি।

কাব্যের স্পর্শে এক হাত কাব্যের হাতের ওপর রেখে আর এক হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল খামচে ধরলো নূর।

হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ঘোর ভাঙলো দুজনের।নূরকে ছেড়ে দিয়ে ফোন রিসিভ করলো কাব্য। ফোন রিসিভ করে-

-‘হ্যা রিদ বলো।

ওপাশ থেকে…….

-‘ঠিক আছে আমি আসছি।

কাব্য ফোন রেখে নূরকে বললো-নূর আমাকে একটু বেড়োতে হবে।

-‘এতো রাতে কোথায় যাবেন?

-‘যেতে হবে বউ।অফিসের একটা কাজ নিয়ে ঝামেলা হয়েছে।এসে পড়বো। আর তোমার শাস্তিটাও বাকি রইলো এসে বাকিটা শেষ করবো(চোখ মেরে)।তারপর
কপালে চুমু খেয়ে আবার বললো- আসি।

-‘জ্বী।

রিদ ভাইয়ার কথা বলায় আর কিছু বললামনা।

রিদ ভাইয়া কাব্য ভাইয়ার অফিসে কাজ করেন।তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক সে। কাব্য ভাইয়া সবসময় তাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসে।রিদ ভাইয়ার ফ্যামিলি বলতে শুধু তার মা ই ছিলো কিন্তু কাব্য ভাইয়ার অফিসে কাজ করার পর থেকে কাব্য ভাইয়া,মামনি,বাবা সবাই তার ফ্যামিলি।সবাই আপন করে নিয়েছে তাকে।কারণ মানুষটাই এমন।রিদ ভাইয়া মানুষটা অনেক মিশুক আর চঞ্চল স্বভাবের। তাই তার সাথে আমার আগে থেকেই বেশ ভাব।ছোট বোনের মতো ভালোবাসেন আমাকে।তার সাথে দেখা হলে সবসময় আমার জন্য একটা চকলেট বরাদ্দ থাকে।তবে অনেক দিন ধরে দেখা হয়না তার সাথে।হয়তো ব্যস্ততার জন্য সময় হয়ে ওঠেনা।যা-ই হোক ভাবনা বাদ দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে তন্নীর রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম।
.
.
চেয়ারে বসে সামনে থাকা লোকটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাব্য। লোকটার হাত-পা বেঁধে রাখা।তার দিকে দৃষ্টি রেখেই রিদকে জিজ্ঞেস করলো-‘রিদ ভালোমতো খাতিরদারি করেছো তো?

-‘জ্বী স্যার কিন্তু তবুও কিছু বলছেনা।

-‘আচ্ছা তেজ আছে দেখা যায়।সমস্যা নেই,,রড টা নিয়ে আসো এবার আমিও একটু মেহমানদারী করি।ভালো করে গরম করবে কিন্তু।কমতি যেনো না থাকে আপ্যায়নে।

-‘জ্বী।
কাব্যের কথা শুনে দরদর করে ঘামতে লাগলোো লোকটি।ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো-

-‘বিশ্বাস করুন স্যার আমি ইচ্ছে করে করিনি এসব।তারা জোড় করে করিয়েছে আমাকে।

চোখমুখ শক্ত করে লোকটার দিকে তাকালো কাব্য। তারপর বললো -আমার অফিসে চাকরি করে,আমার টা খেয়ে আমারই দুশমনের সাথে হাত মিলিয়ে ফেললি।মারার প্ল্যান করছিলি বুঝি।

-‘না স্যার আমাকে শুধু বলেছিলো ওই ডিলটা সাইন করাতে।বড় এমাউন্টের ডিল ছিলো করলে আপনার কোম্পানির বড় ধরনের লস হতো কারণ ওই নামের কোনো কোম্পানিই নেই।তার সাজানো লোক দিয়ে প্রপোজাল পাঠিয়েছে আমাদের কোম্পানিকে।আর কোম্পানির ম্যানেজার যেহেতু আমি তাই,,

-‘তাই তোকেই হাত করে নিয়েছে।আর ভুলটা যেহেতু তুই করেছিস এখন শাস্তিটাও পেতে হবে তোকেই।তার আগে বল কার জন্য করেছিস এসব?

-‘আমি জানিনা স্যার।তাকে একদিনই দেখেছি আমি তাও হুডি পড়েছিলো কালো রঙের।মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাবস পড়া ছিল।

-‘স্যার ও এভাবে মানবেনা ওকে আরও..

রিদের কথা শেষ হওয়ার আগেই কাব্য বললো –

-‘আর কিছু করতে হবে না রিদ।ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দাও।আগামি দুই দিনেও যাতে না ওঠে।

কাব্যকে কিছু বলতে নিয়েও বললো না রিদ কারণ তার ওপর বিশ্বাস আছে।সে যা করে ভেবেচিন্তেই করে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ইনজেকশন পুশ করে মুখ বেঁধে গার্ডদের সব বুঝিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসলো।
.
.
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে কাব্যের দিকে তাকালো রিদ।তার দৃষ্টির মানে বুঝতে পেরে কাব্য বললো-

-‘রিদ ওর চোখে তখন ভয় দেখেছি আমি।ও ভালো করেই জানে যে আমি কি করতে পারি তাই ওই সময়ে মিথ্যা বলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।সে যা বলেছে সত্যি। আর কাব্য চৌধুরীর চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না।সে যেই হোক আমাদের কোম্পানির কোনো ক্ষতি করতে পারেনি আর না ভবিষ্যতে পারবে।

-‘কিন্তু স্যার ম্যানেজার স্যারকে কি ছেড়ে দিবেন?

-‘না ওকে আটকে রাখবে।ওর দিকে নজর রাখবে ভালো করে।

-‘জ্বী স্যার।
——————
রাত প্রায় বারোটা ছুইছুই।কাব্য আজও দেরি করছে ফিরতে।ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে একবার ঘড়ির দিকে তো আর একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে নূর।মিসেস রেহানা কয়েকবার বলেছেন খেয়ে নিতে কিন্তু নূর খায়নি।কাব্য আসলে খাবে বলেছে।রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার।কলিং বেলের আওয়াজ পেতেই ঝড়ের বেগে যেয়ে দরজা খুললো নূর। দরজা খুলেতেই কাব্যের ক্লান্তিমাখা চেহারাটা চোখে পড়লো নূরের। কাব্য তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।কিন্তু নূর মুখ গোমরা করে হালকা রাগ দেখিয়ে বললো-‘আজকেও বুঝি জ্যাম ছিলো রাস্তায়।

-‘না আজকে জ্যাম ছিলোনা কিন্তু..

কাব্যকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সে নিজেই বললো-থাক আর বাহানা দিতে হবেনা।রোজরোজ দেরি করে আসবেন আর বাহানা দিবেন।

ভেতরে আসতে আসতে কাব্য বললো-‘বাহ আমার বউ রাগ দেখাতেও জানে।রাগলেতো আরও বেশি সুন্দর লাগে।একদম জলজ্যান্ত স্ট্রবেরি।বলেই শব্দ করে হেসে ফেললো।

-‘আপনার সাথে কথা বলাই বেকার।যান ফ্রেশ হতে যান।
.
.
কাব্য ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখলো নূর খাবার নিয়ে বসে আছে। তাকে দেখেই বললো-‘তাড়াতাড়ি আসুন নাহলে আবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।
তার পাশে বসতে বসতে কাব্য বললো-‘দুইটা প্লেট নিয়েছো কেন?

কাব্যের প্রশ্নে অবাক হলো নূর,বললো-একটা আপনার আর একটা আমার।

নূরের হাত থেকে খালি প্লেটটা নিয়ে কাব্য বললো-‘ আমাদের মধ্যে তোমার আমার বলতে কিছু নেই এখন।সবকিছুতেই দুজনের সমান অধিকার।তোমার প্লেটেও আমার অধিকার আছে।তাই আমি ওখান থেকেই খাবো।

কাব্যের এমন উদ্ভট কথা শুনে কেমন রিয়েক্ট করা উচিত তা বুঝতে পারছেনা নূর।তাই বললো-‘আপনি কি বলছেন কিছু বুঝতে পারছি না আমি।

-‘এটাই যে তোমার প্লেট থেকে খায়িয়ে দাও।

-‘কিহ?খায়িয়ে দিব কেন আপনি কি বাচ্চা।

-‘ঠিক আছে তুমি খাও তাহলে।আমি খাবোনা।বলে উঠে যেতে নিলে হাত ধরে নিলো নূর।তারপর বললো-‘খাবেননা মানে,,কোথায় যাচ্ছেন?

-‘ঘুমাতে,,,তুমি খায়িয়ে দিবে না তাই খাবোনা।

-‘বসেন খায়িয়ে দিচ্ছি।

নূরের বলার সাথে সাথেই কাব্য আসে পড়লো আর বললো -তাড়াতাড়ি দাও ক্ষুধা পেয়েছে অনেক।কাব্যকে খায়িয়ে দেওয়ার সাথে সাথে নূরও খেয়ে নিচ্ছে। খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে কিচেনে রেখে রুমের দরজার সামনে আসতেই হেচকা টান দিয়ে রুমে নিয়ে দরজার সাথে চেপে ধরলো কাব্য। এক হাত কোমরে রেখে আর এক হাত দিয়ে নূরের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো-‘বলেছিলামনা রাতে এসে বাকি কাজ শেষ করবো।তোমার শাস্তি দেইনি তখন এখন দিব।
নূরের সারা মুখে চুমু খেলো কাব্য।ঠোঁটের কিনারে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো।কোলে তুলতেই নূর বললো-‘ক,,কি করছেন?কোলে নিয়েছেন কেন?নিচে নামান।

-‘উহুম।আজকে বাসরটা সেরেই ফেলবো।

কাব্যের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলো নূর।চোখ বড় বড় করে তাকালো তার দিকে।ভয় হচ্ছে তার সে তো এখন এসবের জন্য তৈরি না।তার অনুমতি ছাড়াই কাব্য তার কাছে আসবে?ভয়ে কাব্যের টি-শার্ট খামচে ধরলো সে।কিন্তু নূরের ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিল কাব্য।

নূরকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে তার কপালে চুমু দিয়ে তার পাশে শুয়ে পরলো কাব্য।তাকে বুকে নিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল-‘তোমার অনুমতি ছাড়া আমি কিছু করবোনা নূর।এতটুকু বিশ্বাস তো রাখতেই পারো।

কাব্যের কথা শুনে হাসলো নূর তবে সেটা কাব্যের অগোচরে।নূর নিজে থেকেই কাব্যকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।তা দেখে কাব্যের মুখেও হাসি ফুটলো।

চলবে…ইনশাআল্লাহ।

#অবশেষে তুমি
#লেখিকা–Nazia Shifa
#পর্ব-১০
————————
ভোরের আলো চোখেমুখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো কাব্যের।ঘুম ভাঙতেই দেখলো তার বুকের সাথে লেপ্টে বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে নূর।নূরের মাথায় চুমু খেলো কাব্য।খানিকবাদেই নড়েচড়ে উঠলো নূর।চোখ পিটপিট করে তাকালো সে।কাব্যের চোখে চোখ পড়তেই কাব্য বললো–‘গুড মর্নিং বউ।

মুচকি হেসে বললো-‘গুড মর্নিং।তারপর ধীর কণ্ঠে বললো-‘ছাড়ুন,,ফ্রেশ হবো।

-‘হুম।
নিজেকে কাব্যের কাছ থেকে ছাড়িয়ে উঠতে নিলে হেচকা টানে নূরকে নিজের ওপর ফেলে দিলো কাব্য।তার মুখের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো-‘এবার যাও।

লাজুক হেসে বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেলো নূর।নূরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কাব্যও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।রোজকার মতো দুজন একসাথে নামায পড়ে ব্যালকনিতে চা নিয়ে বসলো।নিস্তব্ধ পরিবেশে নিশ্চুপ দুজন মানব মানবি পাশাপাশি বসে সকালের প্রকৃতি দেখছে।মাঝেমাঝে আঁড়চোখে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে দেখছে কাব্য। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশের মতোই স্নিগ্ধ সে।
.
.
.
এক হাতে পানির গ্লাস আর এক হাতে ঔষধ নিয়ে দাড়িয়ে আছে নূর।আর তন্নী তার দিকে পিঠ করে বেডে বসে আছে।জ্বর উঠেছে তার কিন্তু সে ঔষধ খাবেনা।মিসেস রেহানা এতক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারেননি তাই নূরের কাছে দিয়ে গেছেন।

-‘উফফ তন্নী আর কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবো এভাবে?ভার্সিটি যেতে হবে তো।ঔষধটা খেয়ে নে।

-‘বলেছিতো খাবোনা।

-‘না খেলে জ্বরটা কমবে কিভাবে শুনি।

-‘কমে যাবে এমনেই।তবুও আমি ঔষধ খাবোনা।

-‘আমিতো ভেবেছিলাম আমার একমাত্র নন্দিনীর জন্য তার পছন্দের গার্লিক টোস্ট আর চিকেন ফ্রাই করে দিবো সন্ধ্যায় কিন্তু তারতো জ্বর খেতে পারবেনা আর ঔষধও খাচ্ছেনা।থাক করবোনা।

নূরের কথা শুনে চট করে তার দিকে ফিরলো তন্নী।তারপর বললো-‘না আমার জ্বর কমে যাবে খেতে পারবো।

-‘ঔষধ না খেলে বানিয়ে দিবোনা।

আহ্লাদী কন্ঠে বললো- দাও না ভাবি।তুমিতো আমার একমাত্র ভাবি আমাকে দিবেনা তো কাকে দিবে।

-‘ঔষধ না খেলে দিবোনা।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে তন্নী বললো-‘ঠিক আছে দাও।নূরের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঔষধ খেয়ে নিলো।তাকে শুয়িয়ে দিয়ে কাঁথা টেনে দিয়ে বললো-‘তুই রেস্ট নেয় আমি ভার্সিটি যেয়ে নোটসগুলো নিয়ে আসি।

-‘আচ্ছা,,সাবধানে!

—————————-
ভার্সিটির ক্যান্টিনে মন খারাপ করে বসে আছে নূর।তার পাশেই রিতু বসে আছে।এ পর্যন্ত কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে তাকে যে কি হয়েছে?কিন্তু সে কিছু বলেনি।তাই আবার জিজ্ঞেস করলো-

-‘নূর কি হয়েছে বলবিতো।কখন থেকে জিজ্ঞেস করছি আমি।কিছুতো একটা বলবি।

এবার মুখ খুললো নূর। শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো রিতুর দিকে।তারপর বললো-‘রিতু আজকে রিয়ার সাথে দেখা হয়েছে।ভার্সিটিতে এসেছে আজকে।

-‘কিহ?কখন?

-‘হ্যা।তখন তুই ওয়াশরুমে গিয়েছিলি না তখনই এসেছিলো।

-‘কিছু বলেছে তোকে?

-‘হ্যা,,বলছিলো আমার মধ্যে নাকি কমতি আছে তাইতো আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও রাজ তাকে ভালোবেসেছে আর তার কথাতেই বিয়ে ভেঙে দিয়েছে।আর আফসোস করছিলো আমার বিয়ে ভেঙে গেছে বলে।আর আমার সম্মান রক্ষা করতে কাব্য ভাইয়া দায়ে পড়ে আমাকে বিয়ে করেছেন।

-‘ওর এত বড় সাহস।আমি সামনে থাকলে না চড়িয়ে গাল লাল করে দিতাম।মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে এত বড় কাহিনি করার পর তোর সামনে এসে আবার এই ধরনের কথা বলে।ও কি আদৌও আমাদের ফ্রেন্ড ছিলো নাকি শত্রু?তুই ও-ই মেয়ের জন্য মন খারাপ করে বসে আছিস?বাদ দে তো ভালোই হয়েছে এরকম একটা মুখোশধারী মানুষ আমাদের জীবন থেকে বিদায় হয়ে গেছে।

-‘হুম।আচ্ছা আমি বাসায় চলে যাবো।তুই ক্লাস করবি?

-‘কি বলিস মাত্র তো একটা ক্লাস করলাম আর এখনই চলে যাবি?

-‘হ্যা ভালো লাগছেনা।লাইব্রেরি থেকে নোটস গুলো নিয়ে বাসায় চলে যাবো।

-‘আচ্ছা ঠিক আছে চল তাহলে।

ভার্সিটি থেকে বাসায় এসে সোজা তন্নীর রুমে গেলো।জ্বর কমে গেছে অনেকটা।তার সাথে কথা বলে রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনির মেঝেতে বসে পড়লো সে।মাথায় তার রিয়ার বলা কথাগুলো ঘুরছে।
মানুষ কত যত্ন করে ধোকা দিতে পারে।কাছের মানুষগুলোর ওপরও বিশ্বাস করা যায়না।কারণ পিঠ পিছে ছুড়ি চালাতে পারদর্শী তারা।আচ্ছা সত্যিই কি কাব্য ভাইয়া দায়ে পড়ে আমাকে বিয়ে করেছেন?কিন্তু উনি তো বলেছেন যে উনি নিজের ইচ্ছেতেই বিয়ে করেছেন আমায়।তাহলে?নাকি মিথ্যা বলেছেন উনি,,দায়িত্ব পালন করছেন?আপন মনে মনে বিড়বিড় করছে নূর তখনই দুটো শক্তপোক্ত হাত নূরের দুই বাহু চেপে ধরে বসা থেকে দাড় করিয়ে তার গালে ঠাটিয়ে একট চড় মারলো।আচমকা এমনটা হওয়াতে চমকে গেলো নূর।চোখমুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো সে।ভয়ে বুকের ভেতর টিপটিপ আওয়াজ হচ্ছে তার।চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো কাব্য তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট তার।তবে এই রাগের কারণ বুঝতে পারছেনা সে নূর।নূরের দুই বাহু আরও শক্ত করে চেপে ধরে চিল্লিয়ে বললো-

-‘বলছিলামনা অপেক্ষা করতে নিয়ে যাবো এসে।বলেছিলাম?তারপরও পাকামো করে একা একা বাসায় এসে পড়েছো।একটা ফোন পর্যন্ত দিতে সময় পাওনি আমাকে।তা দিবে কেন সারাদিন উড়নচণ্ডীর মতো ঘুরে বেড়ানো,লাফালাফি করা ছাড়া আর কি পারো।তোমার জন্য যে কেউ টেনশনে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলো সে খবর আছে?তা রাখবে কেন আমি তো কেউ না টেনশন করলেই কি চর পাগল হলেই কি।কথাগুলো বলে থামলো কাব্য।বড় করে শ্বাস নিয়ে নূরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো।

কাব্যের শক্তপোক্ত হাতের চড় আর বাহু চেপে ধরায় ব্যথায় আগেই কান্নাকরে দিয়েছে নূর।কাব্য চলে যাওয়ার পর কান্নার পরিমান আরও বেড়ে গেলো।
এতক্ষণে নূরের খেয়াল হলো যে কাব্য তাকে ভার্সিটি দিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিল তার জন্য অপেক্ষা করতে সে এসে নিয়ে যাবে।কিন্তু নূর বেমালুম ভুলে গেছে।সে যে বাসায় এসে পড়েছে সেটাও বলেনি কাব্যকে।ব্যালকনিতেই কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো নূর।ছোটবেলা থেকে এ পর্যন্ত তার গায়ে একটা ফুলের টোকাও পড়েনি আর সেখানে কাব্য তাকে চড় মেরেছে।বিষয়টা হজম করতে সময় লাগছে নূরের।কিছুটা অভিমানও হয়েছে কাব্যের ওপর।এভাবে চড় মারাটা কি দরকার ছিলো?বুঝিয়েও তো বলতে পারতো।কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের ওপর রাগ হলো তার।সে কিভাবে পারলো এমন দায়িত্বহীনের মতো কাজ করতে?একটাবার ফোন দিয়ে বলে দিলে তো আর এমন হতো না।একা আসার জন্য না-হয় একটু ব’কা’ই দিতো।ঠিকই করেছেন চ’ড় মেরেছেন বোঝানোর কিছু নেই এখানে। এখন যেভাবেই হোক কাব্যের রাগ ভাঙাতে হবে। মনে মনে এসব ভেবে চোখ-মুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে রুমে গেলো নূর।কাব্য রুমে নেই ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে মানে কাব্য শাওয়ার নিচ্ছে।মিসেস রেহানার ঔষধ আছে বিধায় তাড়তাড়িই খেয়ে নেন আর তন্নীও অসুস্থ তাই খেয়ে শুয়ে আছে।নূরকে কয়েকবার ডাকা হয়েছে কিন্তু সে মাথাব্যথা তাই ঘুমানোর কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছে খায়নি।নূর কিচেনে যেয়ে খাবার গরম করলো।টেবিলে সাজিয়ে রুমে আসলো আবার কাব্যকে ডাকতে।রুমে এসে দেখলো কাব্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে।তার পেছনে যেয়ে দাড়ালো নূর।ভয় কাটিয়ে নিম্ন স্বরে কোনোরকম বললো-খাবার দিয়েছি টেবিলে খেতে আসুন।

নূরের কথায় পেছন ফিরে তাকালো কাব্য তারপর শক্ত কণ্ঠে বললো-খাবোনা আমি তুমি খেয়ে নাও।

-‘খাবেন না কেন?দেখুন খাবার নিয়ে তো কিছু হয়নি না খেয়ে থাকবেন কেন।শরীর খারাপ করবে প্লিজ খেয়ে নিন।

-‘সেই চিন্তা করতে হবে না কারো।ঘুমাবো এখন কেউ যেনো ডিসটার্ব না করে।বলে কাব্য চলে যেতে নিলে তার হাত টেনে ধরলো নূর।তারপর বললো-প্লিজ এমন করবেন না।আমি সত্যি সরি।ভুল হয়ে গেছে আমার।এবারের মতো মাফ করে দিন।

কাব্য কিছু না বলে নূরের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বেডে শুয়ে পরলো।কাব্যের এমন আচরণে কষ্ট পেলো নূর।মনের কোণে অভিমান জমলো কাব্য নামের মানবের প্রতি।সেও আর খেলোনা,টেবিলের খাবারগুলোও সেখানেই পড়ে রইলো।বিষন্ন মনে রুম ত্যাগ করে ছাদে আসলো নূর।মন খারাপ হলে সে ছাদে এসে একা একা বসে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে।অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও মন খারাপের কথাটা ভুলা যায়।

—————————
কাব্য ডাইনিং টেবিলে বসে একটু পরপর আড়চোখে৷ দেখছে নূরকে।পিংক কালারের শাড়ি পড়েছে নূর।চুলগুলো হাত খোঁপা করা।সামনের ছোট ছোট চুলগুলো বারবার মুখের উপর পড়ছে আর সে বারবার হাত দিয়ে সরাচ্ছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে চুলগুলো বিরক্ত৷ করছে তাকে।তা দেখে হাসলো কাব্য।তন্নীর জন্য চিকেন ফ্রাই করছে নূর।ফ্রাইপ্যানে মাংস গুলো ছেড়ে দিয়ে হাত ধুতে পেছনে ঘুরতেই কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেলো।মাথা উঁচু করে দেখলো কাব্য দাড়িয়ে আছে তার সামনে।নূর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।তারপর বললো-

-‘একটি রুমে আসবে?কাজ ছিলো।

নূর কাঠ কাঠ গলায় বলল-

-‘কাজ আছে আমার এখন আসতে পারবোনা।

ঠিক আছে কাজ শেষ করেই আসো।

নূর কিছু বললো না শুধু মাথা নাড়ালো।কাব্যও রান্নাঘরেই টুল টেনে বসে পড়লো।তাকে সেখানে বসতে দেখে নূর বলল-

-‘এখানে বসলেন কেন রুমে যান।

-‘যাবোনা,,তোমার কি?আমার বউয়ের কাছে বসেছি আমি।

কিছু না বলে নিজের কাজে মন দিলো নূর।
.
.
এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে বসে আছে কাব্য। নূর এই কাজ সেই কাজ আছে বলে বলে বাহানা দিচ্ছে।সে যে ইচ্ছে করেই এমনটা করছে তা ঢেড় বুঝতে পারছে কাব্য।বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে জিজ্ঞেস করলো-

-‘নূর এখনো কি আরও কাজ আছে তোমার?

-‘হ্যা এখনো তো….

পুরো কথা শেষ করার আগেই নূরকে পাজা কোলে করে রুমের দিকে পা বাড়ালো কাব্য।

চলবে…..ইনশাআল্লাহ।