অবাধ্য বাঁধনে পর্ব-১১+১২

0
236

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১১]
__________________
২২.
সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই।প্রখর রোদ আর অসহ্য গরমকে বিদায় জানিয়ে আকস্মিক নেমেছে বারিধারা।এই বৃষ্টিসজল পরিবেশটা হয়তো কেউ জানলার পাশে এক কাপ কফি হাতে উপভোগ করছে, কেউ বা উপভোগ করছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার বাহানায়।কেউ কেউ উপভোগ করছে টিনের চালার ঝমঝম শব্দে।হয়তো দস্যি কোন মেয়ে এই সন্ধ্যার বৃষ্টিতে ভিজতে কার্পণ্য করেনি।কিন্তু একদল মানব-মানবীর কাছে এই অসময়ের বৃষ্টিটা বড্ড বিরক্তকর।যেমনটা ঈশার কাছে। নতুন একটা টিউশনি হয়েছে তার।যদিও বাসা থেকে একটু দূরে তবুও বারণ করেনি ঈশা।হাতে থাকা পুরোনো টিউশনি গুলো হারিয়ে সে যখন দিশাহীন তখন এই টিউশনি তার কাছে যেন আর্শ্বীবাদ স্বরূপ।
চারিদিকে ঝাপিয়ে নামছে অন্ধকার কংকর ঢালা বর্ষণসিক্ত রাস্তাটা দেখতে বড্ড সুন্দর লাগছে!কয়েকটি সিএনজি,প্রাইভেট কার,সাই সাই ছুটে চলেছে।রাস্তাটা বড্ড জন মানবহীন শুনশান।একটা রিক্সা পেলে বড্ড ভালো হয় তাই তো টং দোকান থেকে আশেপাশে জহুরি চোখে রিক্সা খুঁজছে ঈশা।বৃষ্টির সাথে সাথে বাতাসের ঝাপটায় তাকে অর্ধেকটা ভিজিয়ে দিয়েছে, তবুও নিজেকে বাঁচাতে কতই না চেষ্টা।ফোনে চার্জ নেই মা বাবা নিশ্চয়ই ফোন করতে করতে ক্লান্ত।মাগরিবের আযান পড়েছে ভয়ে এবার কান্না করার অবস্থা মেয়েটার।আশেপাশে অন্ধকার হয়ে এসেছে আকাশের ডাক ক্রমশ বাড়ছে, আকাশটাও ছেয়ে গেছে কালো মেঘে।

মনকে শক্ত করলো ঈশা এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সে বাড়ি ফিরবে, সারাদেহ তার ভিজে যাক, শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসুক তবুও নিরাপত্তা আগে।নিজের মনকে শক্ত করে কংকর ঢালা রাস্তায় নেমে পড়লো ঈশা দ্রুত পায়ে ছুটলো সামনের দিকে।

.
” সকাল থেকে কড়া রোদ আর এখন দেখ ঠান্ডায় কাঁপুনি এসে যাচ্ছে।দ্রুত গাড়ি চালা বাড়ি ফিরতে হবে।এই ঈশান তোর স্যুট’টা আমায় দে না।”

রাসেলের স্বর মিহিয়ে এলো।ছেলেটা সিটের সাথে লেপ্টে গেছে এত আহামরি ঠান্ডা লাগছে না যতটা রাসেল দেখাচ্ছে।ভাবতেই হাসি পেলো ঈশানের।রাসেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” আমার স্যুট খুলে তোকে দিব ?”

” দিলে কী হবে?”

” নাটক করিস না আহামরি ঠান্ডা লাগছে না।”

” শা* তোর কপালে বউ নাই।তোর বউ যদি কোনদিন তোর সাথে বের হয় আর বেচারি যদি শীতে কাঁপে তাহলে তুই কাপুষের মতো দাঁড়িয়েই থাকবি।”

” কেন আমাকে কী করতে হবে?”

” সিনেমায় দেখিস না?হিরো তার জ্যাকেট খুলে হিরোইন’কে দেয়।তুই তো এসব জীবনেও পারবি না।ব্যাটা আনরোমান্টিক ”

” তা সময় বলে দিবে।”

“সময় কচুও বলবে না।বাই দা ওয়ে আজ খিচুড়ি খাওয়া চাই বাসা….”

থেমে গেলো রাসেল।ঝাপসা গ্লাসে একটি নারীর অবয় দেখে সন্দিহান গলায় ঈশানকে বলে,

” ঈশান মেয়েটা ঈশা না? একা একা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে কোথায়?”

” হুম ওর মতোই লাগছে।”

” সামনে গিয়ে গাড়ি থামাইস।”

” তুই কি ঈশাকে গাড়িতে তুলতে চাইছিস?দেখ এই মেয়েকে আমি আমার গাড়িতে কিছুতেই নিব না প্রয়োজনে তুই তোর গাড়ি এনে তারপর ওঁকে নিবি।”

বিরক্ত হলো রাসেল।ঈশানের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করে বলে,

” প্লিজ ঈশান এভাবে বেচারিকে ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না।ওই তো চলে এসেছি গাড়ি থামা।”

আকস্মিক একটি কালো গাড়ি ঈশার সামনে থামতে ভয়ে ছিটকে দাঁড়ায় সে।জুহুরি চোখে গাড়ির দিকে তাকাতে নজরে আসে ড্রাইভিং সিটে থাকা ঈশানের মুখ।ততক্ষণে রাসেল গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেছে।ছেলেটা দ্রুত এসে ঈশার সামনে দাঁড়ায়।

” এভাবে ভিজে কোথায় যাচ্ছো?গাড়ি নাওনি কেন?”

” বাসায় ফিরছিলাম।রিক্সা পাইনি।”

” তাহলে গাড়িতে উঠো তোমার বাসার সামনে ছেড়ে আসবো।”

” তার প্রয়োজন নেই আমি চলে যেতে পারবো আপনি যান।”

” পা/গল হয়েছো তুমি এখনো অনেক রাস্তা।”

ঈশার হাত টেনে ধরলো ছেলেটা।দ্রুত দরজা খুলে পেছনের সিটে ঈশাকে জোর করে বসিয়ে দিল।রাসেল গিয়ে বসলো ঈশানের পাশে।ঈশান একবারো ঘাড় ঘুরিয়ে ঈশার দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলো না বরং সামনের মিররে চোখ রাখতে ঈশার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় ফলে দ্রুত নিজের চোখ সরায় ঈশান।

” এখানে কী করছিলে ঈশা?তাও আবার একা?”

” টিউশন ছিল।”

“তোমার ফ্রেন্ড অনু ভালো আছে?”

” হুম ভালো।”

ঈশার কণ্ঠ মিলে এলো।ভেজা জামায় ভীষণ ঠান্ডা লাগছে তার।নরম দুই ওষ্ঠ আপনা-আপনি কাঁপছে।ভেজা জামায় এবার ভীষণ লজ্জা লাগলো তার সামনে দু’জন ছেলে তাকে একা পেয়ে মাথায় কী চলছে কে যানে।ওড়নার সাহায্যে নিজেকে যতটুকু পারা যায় ঢেকে নিলো ঈশা।তার হাঁশফাঁশ আড় চোখে সামনের মিররে দেখছিলো ঈশান।মেয়েটার অনবরত কাঁপা ঠোঁট দেখে বেসামাল হয়ে পড়লো ঈশান।নিজের ভাব গম্ভীরতা বজায় রেখে বড় বড় শ্বাস ছাড়লো ঈশান।পাশে বসে থাকা রাসেলের একের পর এক বকবক তার যেন কানে ঢুকলো না।পুণরায় মিররে তাকিয়ে ঈশাকে পরখ করলো সে মেয়েটা এখনো কাঁপছে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত রাস্তার সাইডে ব্রেক কষলো সে।হঠাৎ গাড়ি থামায় সামনের দিকে ঝুঁকে গেল ঈশা এবং রাসেল।

” গাড়ি থামালি কেন?”

রাসেলের প্রশ্নে প্রত্যুত্তর করলো না ঈশান।বরং দ্রুত হাতে নিজের কোট খুলে এগিয়ে দিল রাসেলের হাতে।কোটটা দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে রাসেল বলে,

” থ্যাংকস রে আমি জানতাম তুই আমার কথা ভাবিস।এবার ঠান্ডা ঘুচবে।”

” কোট তোর জন্য নয় পেছনে কাক ভেজা এক কাক বসে আছে তার জন্য।”

রাসেলের আনন্দে যেন এক বালতি জল ঢেলে দিলো ঈশান।আশাহত চোখে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দাঁত চাপলো সে।দ্রুত হাতে ঈশার দিকে কোট এগিয়ে দিতে তা প্রত্যাখ্যান করলো ঈশা।

” আমার লাগবে না রাসেল ভাই।যার স্যুট তাকে ফিরিয়ে দিন।”

” রাসেল তাকে বলে দে স্যুট না পরলে সামনে ডোবা আছে সেখানে চুবিয়ে রাখবো।”

ঈশা দ্রুত হাতে স্যুট এগিয়ে নেয়।যতই রাগ দেখাক নিজের শরীর ঢাকতে কোটটা তার প্রয়োজন ছিল।রাসেল হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে ঈশানের দিকে কিছুক্ষণ আগে সে বলেছে ঈশান তার বউকে জ্যাকেট খুলে দিবে না,ঈশান আনরোমান্টিক,এখন তো বউ লাগলো না একটা মেয়ের জন্য স্যুট খুলে ফেলেছে অথচ এই বন্ধু?বন্ধুর চাওয়ার দাম দিল না।

ঈশাকে দ্রুত স্যুট জড়িয়ে নিতে দেখে নিশ্চিন্ত হলো ঈশান।রাসেল পাশে বসে ঠোঁট চেপে হাসছিল।তার হাসি দেখে ভ্রু কুচকায় ঈশান।রাসেল এগিয়ে এসে ঈশানের কানের কাছে বলে,

” তোর ভাবীর খেয়াল রাখছিস?মরে গেলেও শান্তি পাবোরে।আমার বউয়ের একটা খাঁটি দেওর আছে।”

.

ঈশা যখন বাড়ি ফিরলো তখন সম্পূর্ণ অন্ধকার বিরাজ করছিল এই শহরের আকাশে।
গায়ে থাকা স্যুটটা খুলতে মেয়েটা বেমালুম ভুলে বসেছিল।দরজা খুললেন মাহমুদা মেয়েকে সুরক্ষিত দেখে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন।তবে তার কান্না এখনো থামলো না ঈশার হাত ধরে হয়তো কান্নার সমাপ্তি জানাচ্ছিলেন।

” উফ মা এত কাঁদছো কেন?বাবা কই?”

” তোকে খুঁজতে বেরিয়েছে ফোন ধরিস নি কেন?”

“চার্জ ছিল না।বাবাকে এক্ষুনি ফোন করে বাসায় ফিরতে বলো তুমি দেখছো না আকাশ ডাকছে।”

ঈশা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেল তখনি ডেকে উঠলো তার মা।

” ঈশা তোর গায়ে এই পোষাক কার?”

” এ…এটা দিহানের আম্মু।”

“দিহানকে কোথায় পেলি?”

” মাঝ রাস্তায় সে দিয়ে গেল।”

” দিহানকে বাসায় আসতে বললি না কেন?তোর কি আর কোন দিন বুদ্ধি হবে না?”

ঈশা মায়ের কথায় পাত্তা দিল না।দ্রুত প্রবেশ করলো তার রুমে।ঠান্ডায় শরীরটা কাঁপছে।শরীর থেকে ঈশানের স্যুট খুলতে নাকে বারি খেল অন্যরকম খুশবু।গায়ের স্যুটটা খুলে আরেকবার নাকের কাছে নিল সে নিজের কান্ডে আপনা-আপনি হেসে ফেললো ঈশা।তখনি দরজা দিয়ে প্রবেশ করে অনু মেয়েটার হাতে দুই মগ কফি।

” সত্যি করে বল স্যুটটা কার?দিহান চিকনার এই জামা না সেটা আমি ভালো ভাবেই জানি।”

অনুকে দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে গেল ঈশা দ্রুত কোট রেখে বলে,

” তুই এখানে কখন এলি?”

” আযানের আগে আন্টি কাঁদছিলো ফোন করে তাই চলে এলাম।রান্না ঘর থেকে আমি কিন্তু সব কথা শুনেছি।আন্টির সাথে মিথ্যা বললেও আমার সাথে পারবি না এবার বল জামাটা কার?”

” ঈশানের।”

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অনু।ঈশার কাঁধ ঝাঁকড়ে বলে,

” ঈশানের মানে?”

শুরু থেকে সব ঘটনা খুলে বললো ঈশা।মনে মনে রাসেলের জন্য কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো অনুর মন।রাসেল ছিল বলে ঈশা ঠিকঠাক ভাবে বাড়ি ফিরেছে।

২৩.

রুমার হাজবেন্ড ‘রেদোয়ান’।তিনি বেশ কয়েক বছর পর দেশে ফিরেছেন। সেই উপলক্ষ্যে একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করে ঈশান।ঈশানের শূণ্য হাতে পূর্ণতা পৌঁছে দেওয়ার মূল কারিগর রেদোয়ান।জেদের মাথায় বাবার সাথে রাগ করে দেশে ফিরে আসে ঈশান।তার সাথে ছিলো রাসেল।রুমার তখন নতুন বিয়ে।ঈশানের ইচ্ছে ছিল নিজের বিজনেস দাঁড় করাবে নিজেকে এমন পর্যায়ে তাকে নিতে হবে যেন কোনদিন বাবার মুখোমুখি না হতে হয় বরং বাবার সেদিনের কাণ্ডে যেন নিজে লজ্জিত হন।বাবার প্র‍তি রাগ,জেদ এখনো বিন্দুমাত্র কমেনি ঈশানের।রেদোয়ান ঈশান এবং রাসেলকে নিজের সাথে রেখে বেশ কয়েকমাস খুটিনাটি ব্যবসা সম্পর্কে জ্ঞান,বুদ্ধি,ধারণা দিয়েছে, এবং একটা পর্যায়ে বিশ্বাস রেখে ঈশানকে মোটা অংকের টাকা ধার দেন।সেই টাকাকে কেমন করে দুইগুণ বাড়ানো যায় সেই প্রয়াসে ছিল ঈশান এবং রাসেল। একটা সময় সফলতার তার দুয়ারে কড়া নাড়ে তারপর আর কখনো পিছনে ফিরতে হয়নি তাদের।রেদোয়ানের সাথে সামনাসামনি ঈশানের শেষ দেখা হয় ব্যবসায়ের শুরুতে আর আজ আবার।

আজকের আয়োজনে রুমার বন্ধু বান্ধব,আত্মীয় সজনরা সবাই এসেছে।একটি রিসোর্টে গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়।ধীরে ধীরে রিসোর্ট’টা মুখোরিত হয় মানুষে।রুমার পছন্দ অনুযায়ী আজকের গেট টুগেদারের থিম ছিল কালো।মেয়েরা কালো শাড়ি পড়েছে এবং ছেলেরা কালো স্যুট।ঈশান আশেপাশে পরখ করছিল বেশির ভাগ মেয়েদের একটাই কাজ সেলফি সেলফি আর সেলফি।বিরক্ত হয়ে দম ছাড়লো ঈশান।রাসেল এক গাল হাসি দিয়ে তার কাছেই আসছিলো ছেলেটাকে আজকে একটু বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে।রাসেল হাসতে হাসতে ঈশানকে পাশে তাকাতে ইশারা করে।
ঈশান পাশে তাকাতে ঈশার হাস্যজ্বল মুখ দেখে থমকে যায়।মেয়েটাকে কালো শাড়িতে আজ পরিপূর্ণ লাগছে কালো চুড়িগুলো নাচিয়ে নাচিয়ে অনুকে কি যেন ইশারা করছে।ঈশানের হঠাৎ কেমন যেন অনুভূতি হয়,তার হাঁশফাঁশ লাগছে গলায় থাকা টাই টা দ্রুত হাতে আলগা করার প্রয়াস চালায়।রাসেল ততক্ষণে তার পাশে এসে দাঁড়ায়।পকেট থেকে রুমাল নিয়ে ঈশানের কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে,

” কুল ঈশান কুল।এত ঘামছিস কেন?”

ঈশানের সৎবিৎ ফিরে।নিজেকে সংযত করে বলে,

” কিছু না এমনি।”

” বাথরুম চেপেছে?লজ্জা পাচ্ছিস কেন?তুই যা আমি আছি এখানে।”

” উলটা পালটা কথা বলিস না
রাসেল।রুদবাকে খুঁজে আন বাচ্চাটা কোথায় আছে কে যানে।”

” সে কিড জোনে আছে।তুই চিন্তা করিস না।”

ঈশান মাথা দুলালো গম্ভীর স্বরে বলে

” ঈশা অনুকে ইনভাইট করেছে কে?”

” রুমা আপু করেছে,তারপর আমি।যতই হোক আমাদের পরিবারের সদস্য হতে চলেছে সে।আর তোর ভাবি।”

শেষ কথাটা স্বগোতক্তি স্বরে বললো রাসেল।ঈশাকে নিয়ে ঈশানকে বেশ ভালোই শায়েস্তা করছে রাসেল।ঈশাকে ভাবী ভাবতেই ঈশানের মুখে কেমন আঁধার নেমে আসে।মনে মনে হাসতে হাসতে রাসেল চলে গেল।

ঈশান কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঈশাকে দেখছিলো।কিছুক্ষণ পর ঈশার সাথে দেখা হলো তিয়াশের।ঈশা কি সুন্দর ছেলেটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে ঈশানের হাঁসফাঁস পুণরায় বাড়ে।তিয়াশের সাথে ঈশাকে সে সহ্য করতে পারছে না।তিয়াশ যতক্ষণ এখানে থাকবে ঈশার সাথে থাকবে মনে মনে বেশ রাগ লাগলো ঈশানের।কিছু একটা করতে হবে, তিয়াশকে এখান থেকে বিদায় করতে হবে।নিজের ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তিয়াশের ড্রাইভারকে আয়ত্তে আনলো ঈশান।লোকটার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বুঝিয়ে দিল তাকে কি করতে হবে।

ড্রাইভার টাকা পেয়ে আর দ্বিরুক্তি করলো না ঈশানের কথা মতো এগিয়ে গেল তিয়াশের কাছে।

” তিয়াশ স্যার আপনার মায়ের শরীরটা নাকি খারাপ হয়ে গেছে বাসা থেকে কল এসেছে।”

” কি বলছো দ্রুত গাড়ি বের করো আমি আসছি।”

তিয়াশ রুমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।ঈশা আর অনু দুজনের মাঝে পুণরায় কথা চলতে থাকে।ঈশাকে একা দেখে নিশ্চিন্ত হয় ঈশান।তবে তার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে কিছু প্রশ্ন, ‘ঈশাকে নিয়ে সে এত বাড়াবাড়ি করছেই বা কেন?’এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মাথা ফাঁকা হয়ে এলো তার।এসব প্রশ্নের উত্তর জানে না ঈশান নিজেও।”
#চলবে__

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১২]
____________________
এই অসময়ে যানজটে আটকে গেল তিয়াশ।মায়ের টেনশনে এই জ্যামটাকে বড্ড বিরক্ত লাগছে তার কাছে।পাশে বসে ড্রাইভার সাহেব ঘামছেন।টাকার জোরে মিথ্যা তিনি বলেছেন কিন্তু এবার বাড়ি ফিরে কি হবে?

” ড্রাইভার সাহেব আপনাকে ফোন করেছে কে?”

” ফুলি ফোন করছে।”

” মা বড্ড জেদি মানুষ এতবার বলেছি শরীর খারাপ লাগলে আমায় বলবে কিন্তু মা ভাববে সারাদিন কাজ করে আমি ক্লান্ত তাই তো সবসময় অসুস্থতার কথা লুকিয়ে যান।অথচ আমি জানি পান থেকে চুন খসলেই মা অসুস্থ হয়ে পড়েন।”

তিয়াশ মাথাটা ছেড়ে দিল সিটে।চিন্তায় তার মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে একেরপর এক ফোন করে যাচ্ছেন কিন্তু মা কিছুতেই ফোন তুলছেন না।তিয়াশের ঘাবড়ানো মুখখানা দেখে মনে মনে অপরাধবোধ হলো ড্রাইভারের।তাই জ্যামে গাড়ি রেখে, গাড়ি থেকে বেরিয়ে ফোন করেন কাজের মেয়ে ফুলিকে।

” ফুলি, ম্যাডাম কোথায়?”

” ম্যাডাম ঘুমায় ম্যাডামের শরীর আজ আবার খারাপ হইছে ওষুধ দিলাম কিছুক্ষণ আগে এখন ঘুমায়।”

” ওহ ফোন রাখ।”

ড্রাইভার সাহেব গাড়িতে ফিরলেন।কিছুক্ষণ আগে তার চেহারায় যে মেঘের আভাস ছিল তা কাটিয়ে যেন রোদের দেখা মিলেছে।তিয়াশের দিকে তাকিয়ে বলে,

” স্যার ম্যাডাম ঘুমাইতেছে।এখন তিনি আগের থেকেও সুস্থ।আরেকটা কথা আপনারে যে আমরা খবর দিসি এই কথা ম্যাডামরে বইলেন না আমাদের তাহলে খুব বকবেন।”

ড্রাইভারের কথায় হেসে ফেললো তিয়াশ।মায়ের সুস্থতার কথা শুনে তার বুকের পাথরটা সরে গেছে।

” ঠিক আছে আমি বলবো না।”

তিয়াশের প্রত্যুত্তরে ড্রাইভার সাহেব খুশি হলেন।মনে মনে ভাবলেন টাকার কারণে মাঝে মাঝে বেইমানি করা খারাপ কিছু নয়।
.
ঈশানকে বিরক্ত করতে রাসেলের বড্ড ভালো লাগে।যে ঈশা তার ছিল চোখের শূল সেই ঈশার সাথে এখন কথা বলতে দুইবার ভাবে।ভাববে না কেন?বন্ধুর বউ বলে কথা যতই হোক ভাবীকে সম্মানের চোখে দেখতে হবে।ঈশানের সাথে কথা বলতে বলতে গাছ থেকে গোলাপ ছিড়লো রাসেল।

” এই ফুল কেন নিয়েছিস?”

ঈশানের প্রশ্নে মিষ্টি হাসে রাসেল।গোলাপটা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ টেনে বলে,

” তোর ভাবীর জন্য।কালো চুলে এই গোলাপটা সুন্দর লাগবে না?”

” অসহ্যকর।”

শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে বললো ঈশান।তবে তা রাসেলের কানে গেলো না।রাসেল ঈশার কাছে গিয়ে বলে,

” ঈশা চুল বেধে গোলাপ গুজে দাও তবে তোমাকে মারাত্নক লাগবে।”

ঈশা অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় হেসে উঠে।অনু পাশে বসে ভ্রু কুঁচকে আছে।অনুকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলো রাসেল।ঈশা দ্বিধাদ্বন্দে হাত বাড়িয়ে ফুলটা নিয়ে নিলো।

” চুল বেঁধে নাও ঈশা সুন্দর লাগবে।”

কথার মাঝে অনুকে ঈশারা করলো রাসেল।রাসেলের ঈশারা বুঝতে পেরে অনু বলে,

” হ্যাঁ চুল বেঁধে ফেল ঈশা সুন্দর লাগবে।ফুলটা দেখ কত সুন্দর!”

ঈশা দ্রুত হাতে খোপা করে নেয় খোপার পাশে গুজে দেয় গোলাপ।রাসেল অনুর পাশে বসে কথা বলতে শুরু করে।তিন জনের আড্ডা টেবিল জমে উঠেছে বেশ।ঈশান দূর থেকে ঈশাকে দেখছিলো।মেয়েটার বাঁধা চুল দেখে বিদ্রুপের হাসি হেসে ঠোঁট বাঁকায়।

” চুল বাঁধায় নাকি সুন্দর লাগছে এটা হাস্যকর।”

ঈশান বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ সুযোগ খুঁজছিলো কি করা যায়।একদল বাচ্চা ঈশাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা একে অপরের সাথে কথা বলছিল।সেই সুযোগটা কাজে লাগায় ঈশান।কানে ফোন নিয়ে এগিয়ে এলো সে, ঈশার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় দ্রুত হাতে গোলাপটা টেনে পকেটে পুরে নিলো।গোলাপ সরে যেতে পিঠে ছড়িয়ে পড়লো ঈশার চুল।আকস্মিক চুলে টান পড়ায় পেছনে ঘুরে তাকালো ঈশা, মাথায় হাত দিয়ে দেখলো গোলাপটা নেই।পাশে থাকা বাচ্চারা হাসতে হাসতে দৌঁড়ে পালালো। ঈশা তখন ভেবে নিলো হয়তো তারাই ফুলটা নিয়েছে।

২৪.
ঈশান বাড়ি ফিরেছে মধ্য রাতে।সারাদিনের ক্লান্তিকে বিদায় জানাতে এই মুহুর্তে একটা গভীর ঘুমের দরকার।কিন্তু সেই ঘুম আসছে না। মন মস্তিষ্কে শুধু ঈশাকে নিয়ে শত শত প্রশ্ন ঘুরছে।হাতে এক মগ কফি নিয়ে ঈশানের রুমে আসে রাসেল ছেলেটার চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে।

” ঈশান কফিটা নে ভালো লাগবে।”

” এই কফি খেলে তো আর ঘুম আসবে না।”

” তোর ঘুম এমনিতেও আসবে না সেটা আমি জানি।নে ধর।”

ঈশান হাত বাড়িয়ে কফি মগটা টেনে নিলো।রাসেল সিঙ্গেল সোফাটায় বসে টিভি অন করতে ঈশান তার কাছে খানিকটা এগিয়ে আসে এবং স্বগোতক্তি স্বরে বলে,

” রাসেল আমার শরীরটা ইদানীং ভালো লাগছে না।”

” কেন তোর কী হয়েছে?আগে তো বললি না।”

” অস্থির হচ্ছিস কেন?তেমন কিছু না।”

” তেমন কিছুনা মানে?কি হয়েছে? ”

” রাসেল প্রেমে পড়লে কেমন ফিল হয়রে?”

ঈশানের বেহুদা প্রশ্নে ঠোঁট উল্টায় রাসেল।ঈশানের কাছে এমন প্রশ্ন আশা করেনি সে।

” কেমন হবে আবার।অস্থির লাগবে তাকে সামনাসামনি দেখলে ভালো লাগবে তবে সে যদি অন্য কাউকে বেশি গুরুত্ব দেয় বড্ড জেলাস ফিল হবে।সারাদিন তার কথা মাথায় ঘুরবে।প্রেমে পড়ার অসুখটা বড্ড মারাত্মক’রে একবার হলে সহজে ছাড়ে না।”

ঈশান মাথা দুলালো।সিরিয়াস মুহুর্তে রাসেল টিপ্পনী কেটে বলে,

” দেখিস না আমি কেমন অস্থির থাকি।ঈশার ভাবনায় সারাটা দিন পাগল পাগল লাগে।”

” তুই মন থেকে ঈশাকে ভালোবাসিস?সত্যি করে বলবি কিন্তু। ”

রাসেল নড়ে চড়ে বসলো।ঈশানের সাথে মিথ্যা কী করে বলবে?সে ঈশাকে ভালোবাসে না আর বাসবেও না।সে তো শুধু ঈশানের থাবা থেকে ঈশাকে বাঁচাতে এসব নাটক করছে।রাসেলের মৌন থাকাটা দ্বিধার দুয়ারে ঠেলে দিল ঈশানকে।নিশ্চিত হতে পুণরায় বলে,

” রাসেল তুই ঈশাকে সত্যি ভালোবাসিস?”

” ইয়ে….হ….হ্যা মিথ্যা মনে হচ্ছে তোর?আসলে তোর বড্ড বিরক্ত লাগছে তাই না?ঈশাকে যদি আমার ওয়াইফ হিসেবে না চাইতাম তাহলে নিশ্চয়ই এতদিনে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়তি।ঈশাকে শায়েস্তা করতি।এসব বাদ দে ঈশান তুই বরং ঘুমা আমি যাই।”

ঈশানের অনুভূতি জোয়ার আসার আগেই যেন থেমে গেল।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো ঈশাকে নিয়ে তার ভাবা উচিত হবে না।অন্তত রাসেলের সাথে কখনোই সে বেইমানি কর‍তে পারবে না।

এই রাতটা যেমন তেমন কেঁটে গেলো ঈশানের জীবন থেকে।ভোরের হালকা আলোতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।বারান্দায় কিছুক্ষণ পাইচারি করে সিদ্ধান্ত নিলো হাঁটতে বের হবে।অনেকদিন হয়েছে সকালের ব্যায়াম করা হচ্ছে না।দ্রুত জামা পালটে রাসেলের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।দেখা যাক রাসেল যদি উঠে তাহলে তার সাথে বের হবে।

রাসেলের রুমের দরজা ভিড়ানো ছিল ঈশান দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো বিছানার কাছে।রাসেলের গায়ে আলতো হাত দিয়ে বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার নড়েচড়ে উঠে সে।

” এই রাসেল হাঁটতে যাবি?”

” না তুই যা আমি মাত্র ঘুমিয়েছি।”

ঘুমের ঘোরে এলোমেলো হয়ে এলো রাসেলের কণ্ঠ ঈশানের সন্দেহ লাগলো বাকিটা রাত সে কি করেছে।

” মাত্র ঘুমিয়েছিস কেন?বাকি রাত কী করেছিস?”

” অনু পাগলীটার সাথে কথা বলেছি দিনে তো সময় হয় না।”

” অনু!”

মিহিয়ে এলো ঈশানের কণ্ঠ।রাসেল ঘুমের ঘোরে কি বলেছে হয়তো সে নিজেও জানে না।নিজের প্রবল সন্দেহকে মনে বেঁধে রাখতে চায় না ঈশান।ঈশার সাথে যদি রাসেলের সম্পর্ক গড়ে উঠে তাহলে অনুর সাথে রাত জেগে কথা বলার মানে কী?মনে মনে ফন্দি আঁটলো ঈশান রাসেলের হাত টেনে বলে,

” এই রাসেল তোর ফোনের লকটা খুলে দে।আমার ফোনে চার্জ নেই জরুরি ফোন করার আছে।”

” এত সকালে কিসের ফোন ভাই?”

” আরে দে না।দ্রুত দে।”

রাসেল ফোনের লক খুলে ঈশানকে দিলো।ঈশান দ্রুত হাতে ফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুম ছেড়ে।রাসেলের পার্সনাল বিষয় নিয়ে কখনো নাক গলায়নি ঈশান।ছেলেটা অনলাইনে কি করছে কার সাথে মিশছে তবে আজ সন্দেহ দূর করতেই হবে তাকে।

রাসেলের ফোন ঘেটে থ বনে গেলো বেচারা ঈশান।অনুর সাথে তিন ঘন্টার অডিও কলে কথা হয়েছে।রাসেলের প্রতিটা মেসেজে বুঝিয়ে দেয় অনু তার জীবনে স্পেশাল কেউ।ঈশান পুরোনো মেসেজে আর গেলো না সাম্প্রতিক মেসেজগুলো পড়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে।মেসেঞ্জার ওপেন করতে অনুর আইডি সবার উপরে।অথচ কোথাও ঈশার নাম নেই।রাসেলের ফোনের গ্যালারি জুড়ে অনুর ছবি অথচ কোথাও ঈশার ছবি নেই।যদি ঈশা তার প্রায়োরিটি লিস্টের বাইরে থাকে তাহলে ঈশানের সামনে যে ঈশা ঈশা বলে যে আতিশয্য তাহলে তা কী?এসব কী শুধুই ছলনা?মাহমুদাকে খুশি করার বাহানা?
#চলবে___
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ ❌