অবাধ্য বাঁধনে পর্ব-৯+১০

0
206

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৯]
__________________
” সমস্যা তৈরি করতে নয় বরং সমাধান করতে এসেছেন!আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না ঈশান স্যার।”

ঈশানের নজর সরে এলো মুজাহিদ হাসানের দিকে তাকালেন নরম চোখে।

” আপনার ভাইকে আমরা পেয়েছি।”

মুজাহিদ হাসান সহ ঈশা সুলতানা চমকে তাকান।এতদিন যাবৎ নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিতে খুঁজে পাওয়া গেছে!

“তাকে টেকনাফে পাওয়া গেছে। আমার লোক সব বন্দোবস্ত করে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”

” সে এখন কোথায়?আমাদের আগে খবর দেননি কেন?”

মুজাহিদ হাসান উত্তেজিত হয়ে পড়লেন ঈশা দ্রুত এসে তার পাশে দাঁড়ালো এবং ইশারা করলো শান্ত হতে।

” আমরা তাকে এনে জিজ্ঞেসাবাদ করি আমার টাকার ব্যপারে।তিনি সাতষট্টি লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দেন বাকি টাকাটা খরচ ফেলেছেন।”

” বাকিটাকা নেই।”

স্বল্প স্বরে আওড়ালেন মুজাহিদ হাসান।তার বুক থেকে যেন ভারি পাথরটা সরে গেছে।দু -দন্ড শান্তিতে বাঁচা যাবে এবার।

” বাকি টাকা তিনি ফিরিয়ে দেবেন আর আমরাই ফিরিয়ে নেব সেটা যে করে হোক।তবে আপনি এসব বিষয়ে চিন্তা করবেন না টাকা পয়সার ব্যপারে আপনার সাথে আমাদের আর কোন সম্পর্ক নেই,আপনাকে আর হয়রানো করা হবে না।”

মুজাহিদ হাসানের বুক থেকে ভারী পাথরটা আজ সরে গেল,সুলতানার দুচোখ চকচক করে উঠে।সন্তুষ্টর চোখে চাইলো ঈশার দিকে তবে ঈশার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না মেয়েটা শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে ঈশানের দিকে।

” এ বিষয় নিয়ে আপনার সাথে আমার লোক খারাপ ব্যবহার করেছে আমি করেছি।আসলে ভাবতেই পারছেন এতগুলো টাকা..”

” জ্বি আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা।”

” আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি আঙ্কেল।যেহেতু অন্যয়টা আমি করেছি সেহেতু ক্ষমা চাইছি। আপনি কী আমাকে ক্ষমা করবেন না?”

” ছিহ ছিহ এসব বলে আমায় লজ্জায় ফেলবেন না স্যার।দোষ আমার ভাইয়ের সাক্ষি হিসেবে তার দায় আমারো ছিল।”

ঈশানের পাশে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ইসমাইল।সেদিনের সেই ত্যাজ,সাহস আজ যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেছে।ঈশান তাকালো তার দিকে এবং আদেশ সুরে বলে,

” সেদিনের ব্যবহারের জন্য আঙ্কেলের কাছে ক্ষমা চাও। ”

ঈশানের আদেশ দিতে হয়তো দেরি হলো কিন্তু ইসমাইলের ক্ষমা চাইতে দেরি হলো না।নরম স্বরে হাত তুলে ক্ষমা চাইলো ইসমাইল।ঈশান আড় চোখে একবার তাকালো ঈশার দিকে মেয়েটার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে না ঈশা খুশি কিংবা সন্তুষ্ট।ঈশানের ভাবনার মাঝে ফোড়ন কাটলো ঈশা।

” এভাবে হয় না মিস্টার ঈশান।সেদিন যে অপমানটা আমাদের করা হয়েছে তার ক্ষত এভাবে তো যাবে না।উনাকে বলুন আমার বাবার পা জড়িয়ে মাফ চাইতে।”

ঈশার কথায় প্রতিক্রিয়া জানালেন মুজাহিদ হাসান।কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঈশাকে বলেন,

” তুমি ভিতরে যাও।তর্ক করো না ঈশা।”

” আমি তর্ক করছি না বাবা আমি আমার মন্তব্য জানিয়ে দিলাম।এবার ঈশান শাহরিয়ার কি করবেন তিনি নিজে ভেবে দেখবেন।”

ঈশান কিঞ্চিৎ হাসলো,ঈশা যে গড়বড় করবে এটা তার ধারণায় ছিল তাই তো ইসমাইলকে ইশারা করা হলো মাফ চাইতে। ঈশানের নির্দেশ মানতে বাধ্য সে তাই তো মুজাহিদ হাসানের পা জড়িয়ে মাফ চাইলেন।

” আঙ্কেল আমরা আসছি আপনার সাথে আমাদের আর কোন বৈরিতা নেই।যেকোন সমস্যায় আপনি আমাকে স্মরণ করতে পারেন আমি অবশ্যই সাহায্য করবো।”

ঈশান বেরিয়ে গেল ঈশা দরজা বন্ধ করার উদ্দেশ্য দরজার কাছে যেতে সিড়ি বেয়ে পুণরায় উঠে এলো ঈশান।ঈশার চোখে চোখ রেখে ক্রূর হেসে বলে,

” মামলা-মোকদ্দমা আপনার বাবার সাথে সমাপ্ত হয়েছে তবে আপনার সাথে নয় মিস ঈশা।মনে রাখবেন,এই ভালো ঈশানের রূপটা আপনার জন্য নয়।”

” ঈশান শাহরিয়ারের ধমকে আমি ভয়ে কান্না করে দিব।এই কেউ আমার চোখের নিচে একটা বালতি ধর আমি কান্না করি।”

ঈশার ব্যঙ্গার্থে শান্ত মেজাজটা অশান্ত হয়ে পড়লো ঈশানের।ঈশানের চোখে মুখে রাগের আভাস ফুটে উঠতে থেকে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামালো রাসেল।

১৯.

একটা সময় বড্ড দুরন্ত স্বভাবের ছিল রাসেল।জীবনে বন্ধু বলতে শুধুমাত্র ঈশান নামক মানুষটাই তার জীবনে ছিল।ঈশান ছোট থেকে বড্ড জেদি আপসহীন ছিল।তার জেদ,প্রখর রাগের সাথে সখ্যতা কেউ করতে চাইতো না তাই তো ঈশানের বন্ধু সংখ্যা শূণ্যর কৌটায়।অপরদিকে রাসেল ঈশানের সাথে মানিয়ে যেত,রাসেলের সিক্রেট বাক্স ছিল ঈশান অপরদিকে ঈশানের ছিল রাসেল।কেউ যদি রাসেলের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইতো কিংবা রাসেল অন্যদের সাথে একটু বেশি সময় কাটাতো বিষয়টা মোটেও হজম হতো না ঈশানের।তার জেদ এতটাই বাড়তো অন্যদের আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করতো না।ঈশানের এসব দুঃসাহসের জন্য অনেকবার প্রধান শিক্ষক তার অভিভাবক ডেকে পাঠায়।সময়টা তাদের এভাবেই কেটে গেল পাঁচ বছর।
স্কুল জীবনের শেষ সময় আকস্মিক অসুস্থতায় রাসেলের মা মারা যান।অপরদিকে মায়ের মৃত্যুর এক মাসের মাথায় তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন।সৎ মায়ের সংসারে ঠাই হলো না তার।রাসেলকে রেখে আসা হলো তার নানার বাড়ি।প্রথম কয়েকদিন ভালো চললেও মামিদের অবহেলায় জীবনটা বিষিয়ে উঠলো তার।একটা সময় তার জীবন ছিল রাজপুত্রের ন্যায় অথচ মায়ের মৃত্যুর পর হয়ে গেল চাকরের মতো।মায়ের অবর্তমান জীবনটা যে এতটা কষ্টের, যন্ত্রণার,অবহেলার,ছোট্ট রাসেল তখন একটু একটু করে বুঝতে শেখে।তার কাছে মনে হয় এই পৃথিবীর আলো,বাতাসে বিষাক্ততা ছড়িয়ে আছে যা তাকে ক্রমশ গ্রাস করছে।

রাসেলের চলে যাওয়ার পর ঈশানের জীবন কঠিন হয়ে পড়লো তার পাগলামি ক্রমশ বাড়তে থাকলো।ঈশানের মা মাহমুদা নিজের ছেলের মতো দেখেছিলেন রাসেলকে।নানার বাড়িতে রাসেলের দুদর্শার কথা জানতে পেরে ছেলেটাকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।ভবিষ্য চিন্তা করে রাসেলের পরিবারকে জানিয়ে দেওয়া হয় রাসেলের উপর কোন অধিকার তাদের থাকবে না ভবিষ্যতে।

ঈশানের বাবা থাকতেন দেশের বাইরে।কলেজ জীবনের মাঝামাঝি সময়ে ঈশানের বাবার কাছে তারা চলে যায় এরপরের জীবনটা অন্যরকম ছিল রাসেল কিংবা ঈশানের কাছে।ঈশানের মা বাবা কখনো পর চোখে দেখেননি রাসেলকে তারা সর্বদা নিজের ছেলের মতো আদর করেছেন।তাই তো রাসেলের জীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাদের ছিল এবং আছে।

রাতটা তখন গভীর রাসেল এবং ঈশান দুজনে মুভি দেখার সিদ্ধান্ত নেয়।বেশ মনোযোগ সহকারে দুজনে মুভি দেখছিল এমন সময় ভিডিও কল করলেন মাহমুদা।রাসেলের ফোনে কল করায় ফোনটা রাসেল ধরে।দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কথা চলে ঈশান পাশেই বসেছিল টুকটাক কথায় সায় জানিয়ে মুভির দিকে মন দেয়।মাহমুদা যে বিশেষ উদ্দেশ্যে ফোন করেন সেই উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে রাসেলকে বলেন,

” রাসেল আন্টি তোমার জীবনের একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমার সিদ্ধান্তে আশা করি তোমার মত থাকবে।”

“কেন নয় আন্টি?আপনি আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।”

” আমার একটা মেয়েকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে।ঈশান তো বিয়ে শাদি করবে না মনে হয়।সে বিয়ে করুক আর না করুক তাতে আমার কী?তাকে নিয়ে আমি ভাবতে চাই না।তোমার জন্য আমি একটা মেয়ে দেখে রেখেছি।”

” সত্যি?কিন্তু আমি বিয়ে করে নিলে ঈশান একা হয়ে যাবে আন্টি।”

ঈশানের দিকে তাকিয়ে আফসোস সুরে বললো রাসেল।রাসেলের কথা না শোনার ভান ধরে মুভিতে মন দিল ঈশান।

” হোক একা তাতে তোমার কী?তুমি তোমার জীবন নিয়ে ভাববে।মেয়েটাকে আমার ভীষন পছন্দ হয়েছে আমি তোমাকে ছবি পাঠাচ্ছি চেক করো।”

দ্রুত হাতে ল্যাপটপ অন করলো রাসেল।মাহমুদার পাঠানো ছবিটি চেক করতে হঠাৎ জেন আকাশ থেকে পড়লো রাসেল।

” আন্টি তুমি এই মেয়েটাকে পছন্দ করেছো?”

” হুম।সুন্দর না?মেয়েটার নাম ঈশা।”

চকিতে কেঁপে উঠলো ঈশান।সন্দিহান চোখে ল্যাপটপে নজর রাখতে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো ঈশার ছবির দিকে।এক হাতে দ্রুত ল্যাপটপ নিয়ে অন্য হাতে মোবাইল ছিনিয়ে নিল সে।

” তোমার রুচির এত অধঃপতন!তুমি এই মেয়েটাকে রাসেলের জন্য পছন্দ করেছো।এটা আমি কিছুতেই মানবো না মা”

রেগে গেলেন মাহমুদা ছেলের প্রতি জমানো রাগের রেশ নিয়ে বলেন,

” তোর কাছে আমি জানতে চাইনি মেয়েটা কেমন,আর জানতে চাইও না। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।রাসেল তোর পছন্দ হয়েছে মেয়েটাকে?”

রাসেল ঘাবড়ে গেল, ঈশান তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে।বেচারা যেন গ্যাঁড়াকলে ফেসে গেছে একদিকে মাহমুদার সিদ্ধান্ত অপরদিকে ঈশানের চাহনি সব মিলিয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা।

” কিরে কথা বলছিস না কেন রাসেল?তুই ঈশানের দিকে তাকাচ্ছিস কেন?বল মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি?”

” হ হ্যাঁ কি ন…”

” ব্যস এটাই শুনতে চেয়েছিলাম।তুই রাজি উফফ আমি আজ ভীষণ খুশিরে।আমি দেশে এসে বাকি সিদ্ধান্ত নিব।”

মাহমুদা ফোনটা কেটে দিল।ঈশান রাসেলের ফোনটা তার কোলে ছুড়ে বলে,

” তুই ঈশাকে বিয়ে করবি?ওঁই উটকো ঝামেলাকে ঘরে তুলবি?আর মেয়ে পেলিনা আমার শত্রুকেই বিয়ে করতে হবে এত সাহস তোর।তুই বিয়ে করিস কীভাবে আমিও দেখবো।”

” ক..কবুল বলে বিয়ে করবো দোস্ত।”

” ফাজলামি করছিস আমার সাথে।”

” ঈশান রেগে যাস না প্লিজ।আন্টি শুধু আমাকে জানালো এখনো কোথায় কি।”

ঈশান বড্ড রেগে গেল।টিভিটা অফ করে রিমোট ছুড়েলো দেয়ালে।আলমারিতে কিছু খুঁজতে খুঁজতে বলে,

“তুই দেখিস মেয়েটাকে শহর ছাড়া করে ছাড়বো যে করে হোক।”
#চলবে__

#অবাধ্য_বাধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১০]
____________________
রাসেলের আরামের ঘুম হারাম করার জন্য ঈশানের জেদটাই যথেষ্ট।বালিশের পাশে থাকা ফোনটা দেদারসে বেজে চলেছে।ঘুমের ঘোরে বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েকবার কেটে দিয়েছিলো রাসেল।কিন্তু এতবার ফোন আসায় ঘুমটা ছাড়তেই হলো তাকে।স্কিনে অনুর নাম্বারটা দেখে বেশ বিচলিত হয়ে পড়লো ছেলেটা।ঘড়িতে তিনটার কাছাকাছি।ঈশানের সাথে মুভি দেখার কথা থাকলেও মাঝ পথে সব পণ্ড হয়ে যায়।

” হ্যালো অনু এত রাতে?কোন সমস্যা? ”

” সমস্যা তো তোমরা দুই বন্ধু।”

” মানে?কি হয়েছে?”

” ঈশান একটু আগে ঈশাকে ফোন করেছে মেয়েটা হুমকি দিয়েছে তাকে নাকি এই শহর ছাড়া করবে তার পরিবারের ক্ষতি করবে।এসব কোন ধরনের ফাজলামো বলতো?”

” ঈশানের রাগ উঠেছে তাই বলেছে বাদ দাও অনু।”

” বাদ দেওয়ার বিষয় এটা নয় রাসেল।ঈশা কাঁদছে। ”

” তুমি কোথায়?”

” আমি ঈশার বাসায় দিহানের জন্মদিন তাই দুজনে টুকটাক হাতের কাজ করছিলাম।তার পরেই তো ঈশানের ফোন আসে।আমি আমার ফ্রেন্ডের ক্ষতি কখনোই চাইবো না রাসেল। তুমি যদি আমায় বন্ধু ভাবো তবে ঈশাকে এই আপদ্’টার হাত থেকে বাঁচাও।”

” আমি আছি তুমি একদম চিন্তা করবে না।”

” এই ঈশা আসছে আমি রাখছি, পরে কথা হবে। ”

রাসেল ফোন রাখলো।ঈশান কি করছে একবার দেখা দরকার ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।উদ্দেশ্যে ঈশানের খোঁজ করা।ঈশানের কক্ষের দ্বার ভেতর থেকে বন্ধ ।রাসেল দরজায় কান লাগিয়ে ভেতরে কি হচ্ছে বেশ কয়েকবার শোনার চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল বৃথা।
.

করাঘাতের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় রাসেলের।গতরাতে ভালো ঘুম হয়নি তাই তো সকালেও ঘুমটা পরিপূর্ণ হলো না।হেলেদুলে দ্বার খুলে ঈশানকে দেখে ভ্রু তুলে তাকায় সে,

” কি হয়েছে?”

” ঘড়ি দেখ দশটা বাজতে চলেছে অফিসে যাবি না?”

” উপ্সস বড্ড দেরি করে ফেলেছি।তার আগে আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”

” কী কথা?”

ঈশান সন্দিহান চোখে তাকালো রাসেলের দিকে।রাসেল তার হাত টেনে রুমের ভেতরে নিয়ে যায়।

” তোর চাওয়া পাওয়ার মূল্য আমি যেমন দি তেমনি আমার চাওয়া পাওয়ার মূল্য নিশ্চয়ই তুই দিবি ঈশান।”

” হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

” আমি ঈশাকে পেতে চাই ঈশান।!

রাসেলের একটা বাক্যে ঈশানের মাঝে যেন বিস্ফোরণ ঘটেছে।স্থির চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল সে। রাসেল ঈশাকে বিয়ে করতে চাইবে এটা কখনো ভাবেনি ঈশান।

” তোর মাথা ঠিক আছে রাসেল?কি বলছিস তুই।”

” ভেবে চিনতে বলছিরে আমি ঈশাকে বিয়ে করতে চাই তবে তার আগে ঈশাকে ভালোভাবে বুঝতে চাই।যদি এর মাঝে তোর আর ঈশার ঝামেলা লেগে থাকে তবে কোনদিন আমার প্রতি ঈশার পজেটিভ ধারণা আসবে না।”

” তার মানে তুই বলতে চাইছিস তোর আর ঈশার মাঝে আমি বাঁধা?”

” আমি সেটা বলিনি তবে..”

” যা বোঝার আমি বুঝতে পেরেছি তোর বিয়ে তুই কর,যা ইচ্ছা তাই কর আমি আর এসবে নেই।আর রইলো বাকি ঈশা, আজ থেকে আমি ভুলে গেলাম ঈশা নামের কোন মেয়েকে আমি চিনি বা চিনতাম।”

ঈশান বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে।বেচারা রাসেল যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।বিছানায় গা এলিয়ে দিল নিশ্চিন্ত মনে।

২০.
দিহানের জন্মদিনটা একটা রেস্টুরেন্টে করা হবে।ঈশা,অনু,মীরা তিনজনে মিলে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা সাজিয়েছে।দিহান ইতোমধ্যে উপস্থিত হয়ে গেছে রেস্টুরেন্টে, মীরা তার সাথেই আছে।আজ ঈশা নিজের হাতে দিহানের জন্য কেক তৈরি করে এনেছে।বড্ড বেশি দেরি হওয়ায় দ্রুত পায়ে হাটছে ঈশা।পুরো বিল্ডিংটা সাত তলা।ছয়তলায় রেস্টুরেন্টে বাকি নিচের ফ্লোরে শপিং মল।লিফট থেকে নেমে এপাশওপাশ ছোটাছুটি করে দিহানকে খুঁজতে খুঁজতে আকস্মিক একটি ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে তার।যার দরুণে সম্পূর্ণ কেকটা উলটে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়।ঈশা হতবাক চোখে পাশে তাকাতে দেখতে পায় ঈশানকে।ঈশানের কানে ফোন নিশ্চয়ই কারো সাথে কথা বলছিল। বেচারা ঈশান নিজেও হতবিহ্বল এটা কী করে হলো!

মেঝেতে পড়ে থাকা কেকটার দিকে তাকিয়ে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ঈশার।এই কেকটা অনেক সময় নিয়ে প্রস্তুত করেছিল সে কতটা আবেগ,ভালোবাসা,যত্ন মিশেছিল তাতে।

” আপনি এটা কি করলেন!”

ঈশান ঘাবড়ে গেল।সে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে কিছুতেই ঈশার সাথে ঝগড়া করবে না।

“আমি দুঃখিত ঈশা।তোমার জন্য আমি আরেকটা কেকের ব্যবস্থা করছি।”

” এটা আমার তৈরি কেক হাজার খানেক কেক এনে দিলেও এই কেকের ঘাটতি পূরণ করতে পারবেন না।”

কথাটা চিৎকার দিয়ে বললো ঈশা।রেস্টুরেন্টের আশেপাশে থাকা লোকেদের ভীড় জমেছে। ঈশাকে কাঁদতে দেখে অনু তার হাত টেনে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু ঈশা গোঁ ধরেছে।সে কিছুতেই যাবে না।

” আপনি এটা ইচ্ছে করে করেছেন তাই না ঈশান?”

” একদমি না তুমি আমাকে ভুল বুঝো না ঈশা।”

“ভুল বুঝবো না?রাতেও আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন এখন আবার….”

ঈশা দিশাহীন হয়ে পড়লো।রাগে জেদে মাথাটা যেন ফেটে যাচ্ছে।মাটিতে থাকা কেকটা তুলে ছুড়ে দিল ঈশানের গায়ে।আশেপাশে সবাই অবাক চোখে দেখছে কেউ কেউ ফোন ক্যামেরা অন করে দিয়েছে।

” আমার গায়ে কেক ছোড়ার সাহস কে দিল তোমায়?”

” সাহস আমার বরাবরি বেশি।”

ঈশা এগিয়ে এলো ঈশানের গায়ে থাকা কোটে মাখিয়ে দিল কেকের ক্রিম।মুখে লাগানোর আগেই তার হাতটা শক্ত ভাবে ধরে নেয় ঈশান।

” বলেছিনা ইচ্ছে করে ধাক্কা লাগেনি এমন করছো কেন?”

জোর গলায় কেঁদে উঠলো ঈশা।ঈশানের হাত থেকে ছাড়া পেতে হাত টানতে হুঁশ ফিরলো ঈশানের।আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো মানুষের কীর্তি।এখান থেকে যাওয়া উচিত ভেবে লিফটের দিকে পা বাড়ালো সে তবে ছাড়লো না ঈশার হাত।ত্বরান্বিত লিফটে উঠে দ্রুত হাতে বাটন প্রেস করলো, তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা।অনু পড়লো বিপাকে ঈশাকে নিয়ে ঈশান কোথায় গেল প্রশ্নরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে তার মনে।উপায়ন্তর না পেয়ে রাসেলকে ফোন করলো সে।

নিচ তালায় নেমে ঈশার হাত টেনে পার্কিং জোনে এসে থামলো ঈশান।আশেপাশের মানুষজন তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।অপরদিকে ঈশার ফ্যাচফ্যাচ কান্নার আওয়াজ বিরক্ত বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ।পরিস্থিতি বেগতিক ঈশান বুঝতে পেরে ঈশাকে বলে,

” গাড়িতে উঠো।”

” আমি কেন যাব আপনার সাথে?”

” উঠতে বলেছি।”

” উঠবো না।”

ঈশান পুণরায় ঈশার হাত ধরে নেয়।
গাড়িতে উঠতে বললে ঈশা হাত ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠে।
তাদের কান্ড তিনজন ছেলে পরখ করছিল একটু সাহসিকতার পরিচয় দিতে এগিয়ে আসলো তারা।তাদের মাঝে একজন ঈশানের কাধে হাত দিয়ে বলে,

” মেয়েটার সাথে জবরদস্তি করছিস কেন?”

ঈশান অবাক হলো কোথা থেকে কে এসে তাকে ধমকি দিচ্ছে অদ্ভুত।

” কাঁধ থেকে হাত সরা।”

ঈশানের কথায় ছেলেগুলো আরো বাড়াবাড়ি করলো।ওদের মাঝে একজন ঈশার কাঁধে হাত রেখে বলে,

” আপনি চিন্তা করবেন না আমরা আছি।”

ঈশান তীক্ষ্ণ নজরে চেয়েছিল ঈশার দিকে।ছেলেটার উদ্দেশ্য যে খারাপ বুঝতে সময় লাগলো না তার।ঈশান দ্রুত হাতে টেনে ঈশাকে তার পাশে আনলো।

” বাবু গিরি করছিস?মেয়েটাকে ছেড়ে দে।”

” মেয়েটাকে তোরা চিনিস?কোথা থেকে উড়ে এসে তর্ক করছিস এখান থেকে যা।”

ঈশানের শান্ত স্বরটা হজম হলো না ঈশার মনে হচ্ছে ঝড় আসার আগ মুহূর্তে।এতক্ষণ যাবৎ ঈশানের কাঁধ থেকে হাত সরালো না ছেলেটি বরং এবার করে বসলো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ।ঈশানের ঘাড় ছেড়ে দুহাত বাড়িয়ে দিল তার কলারে শান্ত মেজাজটা ভীষণ ভাবে তেঁতে উঠলো ঈশানের।আশেপাশে সিকিউরিটি গার্ডরা ছিলনা বলেই জল এতদূর গড়ালো।ঈশার প্রতি জমানো ক্ষোভ ছেলেগুলোর বাড়াবাড়ি সব মিলিয়ে ক্রোধ বাড়লো প্রবল ভাবে।তিনটা ছেলের সাথে লেগে গেলো তার ধস্তাধস্তি।তিনটে ছেলেকে মারতে মারতে একজনের কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে।বাকিরাও কম যায় না তারাও পালটা মারতে থাকে ঈশানকে।তিনজনের অবস্থা তখন ক্রমশ খারাপ হয়ে যায়।আশেপাশে মানুষের ভীড় জমে গেল কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না।ঈশানকে এবার থামানো উচিত ভেবে ঈশা এগিয়ে এলো।ঈশার ছোট্ট দুইহাতে ঈশানকে বাঁধা দিতে বড্ড কষ্টসাধ্য ছিল।না পেরে ঈশানের পা জড়িয়ে বসলো ঈশা তৎক্ষণাৎ ঈশার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল ছেলেটা।ঈশাকে তুলে নিল শক্ত হাতে।

” আজকে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছো ঈশা।”

ঈশানের একটা বাক্যে স্থির হয়ে গেল মেয়েটা।ঈশানের এই একটা বাক্যে ছিল প্রবল ধিক্কার,জেদ,বিতৃষ্ণা।ঈশাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো সে।গায়ে থেকে কোট’টা খুলে ছুড়ে ফেললো ঈশার গায়ে।দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল লহমা’য়।ঈশানের গাড়ি যাওয়ার দিকে শুধু তাকিয়ে রইলো।তাকে ফেলে ঈশান চলে গেল!

২১.

হাতের ব্যান্ডেজটায় চোখ রাখতে ঈশার কথা স্মরণে এলো ঈশানের।মেয়েটা নিজেকে যতটা চালাক ভাবে ততটা চালাক সে নয়।ছেলেগুলোর অসৎ ছোঁয়া সে বুঝেও চুপচাপ ছিল।চাইলেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারতো ছেলেটার হাত, অথচ মেয়েটা নিরব ছিল।ঘাড়ের ব্যথায় বসা থেকে শুয়ে পড়লো ঈশান।দরজা খোলার শব্দে রাসেল চোখে চোখ পড়লো তার।

” এসব আমি কি শুনছি তার হাতে চোট লেগেছে।”

” তোকে কে বলেছে এসব?”

” কে বলছে জেনে তোর কী?”

রাসেলের রাগান্বিত স্বরে হেসে ফেললো ঈশান।সন্দিহান চোখে বলে,

” দারোয়ান আঙ্কেল বলেছে তাই না?আমি বারণ করেছিলাম তাকে।”

” কেন বারণ করেছিস?গার্ড নিয়ে গেলি না কেন?”

” রুমার বাসায় যাবো ভাবছিলাম তাই রুদবার জন্য কিছু কিনতে গেলাম আর এতকিছু যে হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি।”

রাসেল পাশে বসলো ঈশানের হাতটা ধরে বলে,

” হাতটা মোচড়ে গেছে,এই হাতে আমায় কবে শাসন করবি ঈশান।”

” আরে তুই এত ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছিস কেন?আমি ঠিক আছি।”

রাসেলের গলা ধরে এলো চোখটা কেমন জ্বালাপোড়া করছে।চোখ ফেটে জল পড়তে চাইছে কিন্তু ঈশানের সামনে কাঁদা যাবে না।ঈশানের কিছু হয়ে গেলে রাসেল অন্তত স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে পারবে না।বট বৃক্ষের ন্যায় ঈশানের ছায়া তার মাথায় যে আগলে আছে এই কথা অস্বীকার করা যায় না যে।

” রাসেল একটা হেল্প কর।দিহানের জন্মদিনটা ভেস্তে গেছে।তুই নিজের হাতে সব আয়োজন করে তাদের সারপ্রাইজ দে।”

ঈশানের কথা শুনে বিস্মিত হলো রাসেল।

” তুই ওদের নিয়ে ভাবছিস?”

” আমার জন্য এমনটা হয়েছে ভুলে যাস না।যা বেরিয়ে পড়।”

রাসেল বেরিয়ে যাওয়ার আগে তাকে ডেকে উঠলো ঈশান।রাসেল ঘাড় বাঁকাতে সে বলে,

” আজ আমি ঈশার সাথে একটুও খারাপ ব্যবহার করতে চাইনি।যেটা হয়েছে তার জন্য আমি সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলাম।
#চলবে___
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌