অবাধ্য বাঁধনে পর্ব-৫+৬

0
248

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৫]
_________________
এতক্ষণ যাবৎ যে হাঁসফাঁস ঈশাকে ঘিরে রেখেছিলো তা আর নেই বললেই চলে।তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য এই সেই বলে বারবার হাসানোর চেষ্টা করছে।ঈশাও চুপচাপ থাকতে পারে না তিয়াশের বলা খুনশুটি ময় কথাগুলোতে কখনো চাপা স্বরে কিংবা গলা ছেড়ে হেসে উঠে ঈশা।তিয়াশ নামক দারুন ব্যক্তিত্বের ছেলেটি হলো রুমার বন্ধু।রুদবার জন্মদিন অনুষ্ঠানে পরিবার থেকে শুরু করে পরিচিত নানান জনের ভীড় জমেছে।ঈশার একাকিত্ব বুঝতে পেরে রুমা তিয়াশকে জানিয়ে দেয় ঈশার পাশাপাশি থাকতে এখানে অবশ্য তিয়াশও একা বলা চলে।

তাদের এই আনন্দ সহ্য হচ্ছে কারো কাছে। যার সারা শরীরে বিদ্যুতের ন্যায় খানিক বাদে বাদে জেদরা লাগামগীন ঝলকে উঠছে।হাতের মুঠোয় থাকা গ্রিপ বলটা দুমড়ে মুচড়ে নিজের রাগ সংযত করতে ব্যস্ত।চোখের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ ঈশার মাঝে।মেয়েটার প্রতি তার সীমাহীন জেদের পরিণাম কী হবে জানা নেই তার নিজেরো।

“ঈশান মেয়েটাকে আর নজর দিস না, মেয়েটার গায়ে ফোসকা পড়ে যাবে।।”

রাসেলের আফসোস সুরের কথায় মনোযোগ ক্ষুণ্ণ হলো ঈশানের।চোখ সরিয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালো রাসেলের পানে।

” ফোসকা পড়বে কেন?”

” কুদৃষ্টির প্রভাবে।”

রাসেলের মজা নেওয়াটা মোটেও পছন্দ হলো না তার।বরং তীব্র রাগে জ্বলে পুড়ে ছারখার অবস্থা।

” কিসব ফা;লতু কথা বলছিস?”

” সিরিয়াস হচ্ছিস কেন?আমি তো মজা করছিলাম।”

” তোর মজাটাই ফালতু ছিল।”

ঈশানের রাগটা প্রবল হলো।তিয়াশ ছেলেটাকে এই মুহূর্তে তার বিষের ন্যায় লাগছে।ভেবেছিল ঈশাকে একা পেয়ে শায়েস্তা করবে কিন্তু তিয়াশ যে তার সঙ্গী হবে কে জানতো?

রাত নয়টা নাগাদ কেক কাটা শেষ হলে বাচ্চাদের আনন্দ শেষে রাতের খাওয়ার পরিবেশন করা হয়।ঈশা এবং তিয়াশ এক সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়ার শুরু করে।ঈশার খাওয়ার মাঝে তিয়াশ এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছিল ঈশান দূর থেকে সবটা পরখ করছিল।ভেতরে ভেতরে জেদটা তার বাড়তে লাগলো এখন শুধু অপেক্ষা ঈশাকে কখন একা পাওয়া যাবে।

খাবার শেষে হাসিন ফোন করায় ছাদের দিকে রওনা হলো ঈশা।ভেতরের ঘরে কোলাহলে শান্তিতে দু’দন্ড কথা বলার সুযোগ নেই।ছাদটা অল্প সল্প ফেইরি লাইটে বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে।হালকা আলোয় আলোকিত ছাদে কারো অস্তিত্বের দেখা মিললো না।তাই নিশ্চিন্ত মনে ঈশা একা একাই ছাদে কথা বলতে থাকলো হাসিনের সাথে। এত রাতে বাড়ির বাইরে থাকায় ভীষণ রেগে আছে হাসিন।আদুরে ভাইটাকে বোঝাতে বোঝাতে কেটে গেল বেশ খানিকটা সময়।হঠাৎ ওপাশ থেকে সাড়া শব্দ মেলে না।চক্ষুদ্বয়ের সামনে ফোন তুলতে বিরক্তে মুখ কুচকে গেল ঈশার।

” দূর চার্জ এখনি শেষ হতে হলো।”

ঈশার পেছনে এসে নিশ্চুপ দাঁড়ায় ঈশান।সুযোগ এখনি এমন সুযোগ হয়তো আজকের দিনে সে পাবে না।তাই যে ভাবা সে কাজ।ছাদে থাকা চিলেকোঠার ঘরের দুয়ার তখন খোলা ছিল।অন্ধকার আচ্ছাদিত চিলেকোঠার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো ঈশান।এই মুহুর্তে তাকে কী করতে হবে সবটা পরিকল্পনা করা শেষ।মোবাইল বন্ধ হওয়ায় আপনাআপনি বকতে বকতে ঈশা যখনি ঘুরে তাকাবে তখনি তাকে কেউ ধ্বাক্কা দিয়ে চিলেকোঠার ঘরে প্রবেশ করায়।
ঈশান বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে নিশ্চিন্ত মনে ছাদ থেকে নিচে নেমে যায়।

অতিথিরা চলে যেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে এলো ঘরটা।বিশেষ পরিচিত কাছের আত্মীয় ছাড়া কাউকে আর উপস্থিত দেখা গেল না।তিয়াশ এতক্ষণ যাবৎ রুদবাকে নিয়ে গেমস খেলছিল ঈশার কথা মাথায় আসলেও রুমার সাথে আছে ভেবে নিশ্চিন্ত ছিল।সোফায় বসে চাপা কণ্ঠে সুরে সুরে গান গাইছিল ঈশান।হাতে থাকা ফোনটা বেহুদা স্ক্রুল করে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে।রাসেল তিয়াশের সাথে টুকটাক কথা বলে বসে যায় ঈশানের পাশে।

” কিরে ঈশা মেয়েটাকে দেখছি না কেন?”

রাসেলের প্রশ্নে ক্ষীণ হাসে ঈশান।

” তার দায়িত্ব কী আমার কাছে?আমি জানবো কী করে?”

” তুই আবার কিছু বলেছিস তাকে?মেয়েটা হঠাৎ কোথায় গায়েব হলো।”

” চুপ কর এই মেয়ের ব্যপারে কথা বলতে আমার রুচিতে বাধে।”

রাসেল আর কথা বাড়ালো না।সেন্টার টেবিলে থাকা পপকর্নের ঝুড়ি থেকে মুঠো ভরতি পপকর্ন নিয়ে মুখে ছুড়লো।ঈশানকে দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ খুশি।হঠাৎ ঈশানের এত কিসের আনন্দ?বড্ড চিন্তায় ডুবে গেল রাসেল।

রান্না ঘরের দিকটা সামলাতে সামলাতে ঈশার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে রুমা।পাশে থাকা ফোনটা বেজে উঠতে ঈশার বাবার নাম্বার দেখে দ্রুত ফোন রিসিভ করেন রুমা।

” আঙ্কেল বলুন।”

” ঈশা মা কোথায়?ফোন বন্ধ বলছে।”

” রুদবার সাথে আছে আঙ্কেল আপনি চিন্তা করবেন না।”

” রাত বারোটা বেজে গেছে আমি আসছি তাকে এসে নিয়ে যাব।”

” এতদূর আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না আঙ্কেল, আমাদের ড্রাইভার তাকে পৌঁছে দেবে।আমি বরং এক্ষুনি তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

” ঠিক আছে মা নিশ্চিন্ত হলাম।”

ফোন রেখে বসার ঘরে উপস্থিত হলেন রুমা।ঈশাকে না দেখতে পেয়ে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েন।তিয়াশের কাছে জানতে চায় ঈশার কথা তিয়াশ জানেনা বলে নিজেও চমকে যায়।রুমা দ্রুত সারা বাড়ি ঈশাকে খুঁজতে থাকে ঘরের কোথাও ঈশা নেই তিয়াশ একবার ছাদেও চেক করে আসে কিন্তু ঈশা নেই।যে কেউ দেখলে ভাববে ঈশান এতক্ষণ গেমস খেলায় মগ্ন ছিল কিন্তু কেউ তো জানে না ঈশান সবার হাঁসফাঁস দেখে আনন্দ পাচ্ছে বিশেষ করে তিয়াশের।হাতে থাকা গেমসের মোবাইলটা পাশে রেখে চিন্তিত সুরে বলে,

” রুমা তোমার চেহারা এত চিন্তিত লাগছে কেন?”

ঈশানের প্রশ্নে ভ্রু কুচায় তিয়াশ এই ছেলেটা কি এতক্ষণ কিছুই পরখ করেনি?আবার প্রশ্নের থালি নিয়ে বসেছে।

” ঈশাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাই।”

” খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?কী বলো তাকে তো দেখলাম কানে ফোন নিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে।”

” তুমি শিউর ভাই?”

” হ্যা আমি স্পষ্ট দেখেছি।”

রুমা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো মেঝেতে।তাকে না বলে ঈশা এখান থেকে কেন যাবে?তাছাড়া ঈশার পার্স তার আলমারিতে।মেয়েটা যেতে নিশ্চই ভাড়ার প্রয়োজন হবে কিন্তু পার্স তো তার কাছে।

” না ঈশা যায়নি ঈশার পার্স আমার কাছে।”

চমকে উঠলো তিয়াশ।রুমা ঈশার দায়িত্ব তার কাছে দিয়েছিল অথচ মেয়েটা লাপাত্তা মনে মনে অপরাধবোধ হলো তার।

” রুমা তোর বাড়ির আশেপাশে ঈশাকে খোঁজা উচিত।”

তিয়াশের কথায় সম্মতি জানান রুমা। তৎক্ষণাৎ সবাই মিলে ঈশাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে।একমাত্র ঈশান পায়ের উপর পা তুলে পুণরায় গেমস খেলতে থাকে।রাসেলের সন্দেহ অবশেষে সত্যি হয়েছে ঈশান নিশ্চই ঈশার কিছু করেছে।

” ঈশান সত্যি করে বল ঈশা কোথায় রাত হয়ে গেছে মেয়েটার বাড়ি ফেরা উচিত।”

” তুই আমাকে এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

” আমি জানতে চাই ঈশা কোথায়?”

” ঈশা জীবন কইরা দিলো আঁধার দুনিয়া,
ঈশা ঈশা কইরা একদিন যাবো মরিয়া। ”

ঈশানের গানে রাগান্বিত চোখে তাকালো রাসেল।রাসেলের হাহুতাশে ঈশান বেশ মজা পাচ্ছে।ঈশান তার বেসুরা গলায় গানের সুর তুলে। তার কর্মকান্ডে প্রচন্ড বিরক্ত হয় রাসেল।এই মুহুর্তে এই আধা পা/গলের সাথে ঝগড়া করার চেয়ে ঈশাকে খোঁজা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

১১.
চিলেকোঠার ঘরটায় এতটাই অন্ধকার ভয়ের চোটে ঈশার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা।বেশ কয়েক মাস এই ঘরটি বন্ধ ছিল তাইতো অপরিষ্কার কক্ষে বাসা বেধেছে মাকড়াসা,তেলাপোকা সহ অনন্য ছোট পোকা। উড়ন্ত তেলাপোকা গুলো কিছুক্ষণ পরপর উড়ে উড়ে এপাশ থেকে ওপাশে ফিরছে।কয়েকটা তেলাপোকা আটকে গেছে ঈশার চুলে।এই কক্ষের বিদঘুটে পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে বেশ কয়েকবার চ্যাঁচামেচি করেছে সে, কিন্তু লাভটা হলো কী?বাড়ির ব্যস্ত সদস্যরা কেউ শুনতে পেলনা ঈশার চিৎকার।জন্মদিনের আয়োজন যেখানে করা হয়েছে সেখানে বেশ জোরে গান চলছিল হয়তো তাই কেউ শুনেনি।ঈশান যখন চিলেকোঠার দরজা বন্ধ করছিল সেখানে চিলেকোঠার ঘরে একটি বিড়াল ছিল।ঈশানের ফাঁদে পড়ে বেচারা বিড়াল মশাই কক্ষে বন্দি হয়ে যায়।বিড়ালটি অন্ধকার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বেশ কিছুক্ষণ লাফালাফি করেছি।কিন্তু লাভ হলো কী?ঈশার চিৎকারে বিড়ালটি আরো দ্বিগুণ ভয় পেয়ে যায়। যার ফলে বিড়ালটি ঈশাকে আক্রমণ করতেও দ্বিরুক্তি করেনি।বিড়ালের আঁচড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল ঈশা কিন্তু লাভ হলো না।হাতে পায়ে বিড়ালের আঁচড়ে শরীরের জ্বালা ক্রমশ বাড়ছে।সবাইকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত দেহটা ছেড়ে দিল দরজার পাশে।অতিরিক্ত আতঙ্কে কাপুনি ধরে গেল তার শরীরে তৎক্ষণাৎ উগরে ফেললো পেটের সকল খাদ্য কণা।
#চলবে___

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৬]
__________________
জন্মদিনের আনন্দ এক নিমিষে যেন হাওয়া হয়ে গেছে।ছোট্ট রুদবা ঈশামনিকে খুঁজতে খুঁজতে কেঁদেই ফেললো।মেয়েটার কান্নায় মন খারাপটা বেড়ে গেল তিয়াশের।মন খারাপের সঙ্গ নিয়ে রুদবাকে কোলে নিয়ে ছুটলো ছাদের দিকে।

” মামা আমার ঈশামনি কই?”

” তোমার ঈশামনিকে আমরা পেয়ে যাব তুমি শুধু শুধু কাঁদছো।”

তিয়াশের আশ্বস্ত পেয়ে কান্না থামালো মেয়েটা।রুদবাকে নামিয়ে পুরোটা ছাদ ঘুরে দেখলো তিয়াশ।পুরোটা ছাদ নিস্তব্দ উপায়ন্তর না পেয়ে ঈশা ঈশা বলে বেশ কয়েকবার ডাকলো সে।রুদবা তখন দাঁড়িয়ে ছিল চিলেকোঠার সম্মুখে।বদ্ধ দরজার ভেতর থেকে করাঘাতের শব্দ আসায় চমকে তাকায় সে।

” মামা এখানে কেউ আছে।”

তিয়াশ এগিয়ে এসে দাঁড়ালো রুদবার পাশে।

” এখানে কে থাকবে?ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।”

” আমি শুনেছি কেউ দরজায় ধাক্কালো।”

রুদবার কথা অনুসারে তিয়াশ দেরি করলো না।ঝটপট অস্থির হাতে খুলে দিলো চিলেকোঠার ঘর।বন্ধী দশায় মুক্তি পেয়ে অতিদ্রুত ছুটে পালালো বিড়ালটি।ঈশা তখন পিটপিট চোখে দেখছিলো সবটা।ঈশার করুন পরিস্থিতি দেখে হাটু মুড়ে বসে পড়ে তিয়াশ।

” ঈশা তুমি এখানে কী করছো?”

তিয়াশের প্রশ্নে প্রত্যুত্তর জানালো না ঈশা বরং তার দুর্দশার কথা মুখ ফুটে বলার আগে মুহুর্তে কেঁদে ফেললো।তিয়াশ একের পর এক প্রশ্নের থালি নিয়ে বসে কিন্তু লাভ কী হলো? ঈশার মুখ থেকে টু-শব্দটিও বের হলো না।মেয়েটা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।নাকে বুমির গন্ধ আসায় আশেপাশে সচেতন দৃষ্টিতে চোখ বুলালো তিয়াশ। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে চিন্তা বাড়লো বহু গুণ।

” উঠে দাঁড়াও নিচে চলো।”

ঈশার বাহু টেনে দাঁড় করালো তিয়াশ তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না।ক্লান্ত দেহটা ছেড়ে দিল চোখের পলকে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে তিয়াশ না চাইতেও ঈশাকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়।ছোট ছোট চোখ করে ঈশা তখনো কাঁদছিলো।তিয়াশের বুকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো তাকে।এর মানে সে তিয়াশের কোলে উঠতে চায় না।তার সম্মতি বুঝতে পেরে তিয়াশ বলে,

” এই শরীরে তুমি নিচে নামতে পারবে?জেদ করে লাভ নেই ঈশা।”

ব্যস্ত পায়ে ঈশাকে নিয়ে ছুটে চললো তিয়াশ।তার পিছু পিছু এগিয়ে গেল রুদবা।
.

বসার ঘরটা নিরিবিলি নিস্তব্ধ। অতিথিরা সবাই চলে গেলো ঘণ্টা খানেক আগে।ঘরের বাকি সদস্যরা ঈশাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো, একা একা বসে রইলো ঈশান।হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা জেনে নিলো।অনেক রাত হয়েছে এবার ঈশাকে ছাড়া উচিত মেয়েটাকে নিশ্চয়ই এবারের মতো চরম শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।ভাবনা অনুযায়ী উঠে দাঁড়ালো সে।এক কদম এগিয়ে যেতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো তিয়াশ তার কোলে ঈশা। মেয়েটার খোলা চুল এলোমেলো ময়লা জড়িয়ে আছে।ঈশান পিলে চমকে উঠলো রুদবা ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে ঈশানের পেট ঘেষে দাড়ালো।

” মামা মামা ঈশামনির কি হয়েছে সে কাঁদছে কেন?”

রুদবাকে কোলে তুলে নিলো সে।তিয়াশ ততক্ষণে ঈশাকে নিয়ে ছুটে চলে যায় রুমার কক্ষে।সদর দরজা দিয়ে কোলাহলের শব্দে ঘুরে তাকায় ঈশান। রুমা,রাসেল সহ বাদবাকিরা ছোটাছুটি করে ঘরে ফিরছে।
.

রাতটা বেশি হওয়ায় বিপাকে পড়তে হয়েছিল রুমাকে।কি করবে না করবে ভেবে ভেবে অস্থির সে।তিয়াশ তাকে অভয় দিল এবং এই রাতে বাড়ির পাশে একটি ক্লিনিক আছে সেখান থেকে ডাক্তার নিয়ে ফিরলো ।প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে ডাক্তার ফিরে গেল।বসার ঘর তখনো ছিল থমথমে। ঈশার বাবা একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছেন কিন্তু তাকে মানাতে ব্যর্থ রুমা।

” আঙ্কেল আমার কথাটা শুনুন ঈশা আজকে রাতটা রুদবার সাথে থাক।”

” কোন প্রয়োজন নেই ঈশাকে ফোনটা দাও সে ফোন তুলছে না কেন?”

” আঙ্কেল ঈশা ঘুমিয়ে পড়েছে আপনি…. ”

” আমার সাথে মিথ্যা বলছো তুমি আমার মেয়ের কি হয়েছে সত্যিটা বলো।তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম রুমা।”

ঈশার বাবা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।ফোন লাউডে থাকায় সবটা শুনছিল ঈশা পিটপিট চোখে চেয়ে থেকে রুমার থেকে ফোনটা চেয়ে নিল সে।

” বাবা আমি ঠিক আছি।”

” তোমার কি মনে হয়, তুমি কী আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছো ঈশা?।”

” আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙছিনা বাবা।হাসিন ভাইকে পাঠাও আমি বাড়ি ফিরবো।”

মাথা তুলে বসে পড়লো ঈশা।তিয়াশ পাশ থেকে কাতর চাহনীতে নিবদ্ধ।রুমা আর কথা বাড়ালো না, ঈশাকে তৈরি করে দিল দ্রুত।পুরো হাতার জামা হওয়ায় মেয়েটার হাতের ছোট ছোট ব্যান্ডেজ গুলো ভালো ভাবে দেখা গেল না।তা ভেবে নিশ্চিন্ত হলো ঈশা। এই ব্যপারে পরিবারের কাউকে কিছু বলা যাবে না।

” ঈশা তুমি যা বলছো আমি বিশ্বাস করছি কিন্তু চিলেকোঠার ঘরে তোমায় কে আটকে রাখবে?”

” জানি না।তবে আমি অনুভব করেছি কেউ আমাকে পেছন থেকে ধ্বাক্কা দিয়ে ভেতরে রেখে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল।কার মনে কী আছে আমি কীভাবে বলবো।”
.

” ঈশান কাজটা ভালো করলি না তুই।”

” কোন কাজ?”

মিহিয়ে এলো ঈশানের কণ্ঠ।ঈশার সাথে এতটা বাজে পরিস্থিতি হবে ভাবতে পারেনি ঈশান।সে ভেবেছিল মেয়েটা অন্ধকারে ভয় পাবে ব্যস এইটুকুই কিন্তু এতটাও চোট পাবে, ভাবতে অপরাধবোধ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

” নাটক করছিস?ঈশাকে তুই চিলেকোঠার ঘরে বন্দী করেছিস তাই না?এত কিসের রাগ তোর বলবি আমায়?”

” বাজে কথা বন্ধ কর আর আমার সামনে থেকে যা।”

” সবসময় গলা উচিয়ে বাঁচা যায় না।তুই তোর বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকলি।”

রাসেলের কথায় প্রত্যুত্তর করলো না ঈশান।অবশ্য রাসেল ঈশানের কাজে এর উত্তর আশাও করেনি।গেটের বাইরে রাস্তার পাশে সিএনজি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ঈশান ছেলেটির অবয় বুঝলেও চেহারাটা ঠিক ঠাহর করতে পারলো না।রুমার সাথে তখন গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঈশা সিএনজিতে উঠে হাত উঠিয়ে বিদায় জানালো রুমাকে।গাড়িটা চলতে শুরু করলো ঈশা যতটা দূরে যেতে থাকলো ততটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ঈশানের বুক চিড়ে।

১২.
কংকর ঢালা রাস্তায় ছোট ছোট পা ফেলে আসছে ঈশা অনু।গতকাল রাতের বৃত্তান্ত দিয়ে ড্যাবড্যাব চোখে অনুর দিকে তাকালো ঈশা।অনুর প্রতিক্রিয়া দেখতে বেশ আগ্রহ নিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়ালো সে।

” কিরে অনু চুপ হয়ে গেলি কেন?”

” আমার বড্ড রাগ লাগছে ঈশা।এই লোকটার এত সাহস হলো কী করে এমন বাজে একটা কাজ করার।সবচাইতে বেশি তোর উপর রাগ হচ্ছে তুই কেন সবাইকে বললি না ঈশান শাহরিয়ার এই কাজটা করেছে।”

“বিশ্বাস কর চুপচাপ গম্ভীর স্বভাবের মানুষ।যেন কিচ্ছু বুঝেনা কিচ্ছু জানেনা এত ভালো মানুষ এই সমাজে আর একটিও নেই আমি তখন এই কথা বললে কেউ বিশ্বাস করতো না।বরং আমাকে সবাই ভুল বুঝতো তাই তো চুপ ছিলাম।”

” এত চুপচাপ থেকে কাজ হবে না ঈশু বরং ঈশান শাহরিয়ারকে চুপচাপ জবাব দেওয়া উচিত।”

দুই বান্ধবীর কথা চললো দীর্ঘক্ষণ।নিরিবিলি রাস্তার পাশে একটি গাড়ি দেখে দু’চরণ থেমে যায় ঈশার।

” এই অনু এই গাড়িটি ঈশান শাহরিয়ারের।”

” হ্যা তাই তো উনি কি এখানে আছেন নাকি।”

ঈশা অনু দুজনে সর্তক দৃষ্টিতে চারিদিকে চোখ বুলালো দুপুরের শুনশান পরিস্থিতে তেমন কোন মানুষনেই।সরু রাস্তাটায় দুই চারটা গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে।রাস্তার পাশে বিশাল মাঠ সেই মাঠে একটি গরু খুটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে।গরুর পাশে সাদৃশ্য হলো কয়েক থাবা গোবর।

” ঈশা প্রতিশোধ নেওয়ার সময় এসেছে।”

ঈশা ভ্রু কুচকে চাইলো অনুর পানে মেয়েটা কেমন করে হাসছে।

” এই গাড়িতে গোবর দিয়ে গোসল করাবো।”

অনুর বুদ্ধিতে সম্মতি জানালো না ঈশা।নাক কুচকে বলে,

” ছিহ!ফা/ল/তু বুদ্ধি।”

” আরে বেশি ঝামেলা নেই লাঠি নিয়ে একটু একটু করে গাড়ির কাঁচে লাগিয়ে দিব।”

” আমি পারবো না এসব।”

” তোর জন্য আমি রিক্স নিলাম আর তুই বলছিস পারবি না এই তোর বন্ধুত্ব।”

অভিমানের স্বরে কথাটি বলে হাটা শুরু করলো অনু।তার পিছু ছুটে যায় ঈশা।

” আচ্ছা চল।আবার ধরা পড়বো না তো?”

” একদমি না।”
.
পুরোনো বিজনেস পাটনার নিয়ে জমি দেখতে এসেছিলো ঈশান এবং রাসেল।ঈশানের তদারকিতে বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন বিজনেস পাটনার আলী।জমি দেখা শেষ হতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাছে এগিয়ে যান তারা।গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে থমকে যায় রাসেল
হঠাৎ তার নাকে আসে বিদঘুটে গন্ধ।মিস্টার আলী নাকে রুমাল চেপে ভ্রু কুচকে তাকান ঈশানের দিকে।

” মিস্টার ঈশান আপনার গাড়ি থেকে এমন বাজে স্মেল আসছে কেন?”

ঈশান ঘাবড়ে যায় দ্রুত পায়ে পুরো গাড়িটা চেক করে পেছন সাইডে গোবর লেপটানো দেখে রাগান্বিত চোখে তাকায় রাসেলের দিকে।গোবর দেখে রাসেল নিজেও রেগে গেল,

” মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছাকৃত এমনটা করেছে ঈশান।”

” এমন দুঃসাহস কার হলো আমি দেখতে চাই রাসেল।”

মিস্টার আলী খানিকটা বিরক্ত বোধ করলেন তার তাড়া আছে ভেবে ঈশানকে বলে,

” আমি বরং আমার ড্রাইভার কে আসতে বলি আমার তাড়া আছে আমি চললাম ঈশান।পরবর্তীতে আমাদের দেখা হবে কোন একসময়।”

নিজের প্রিয় গাড়িটির দিকে তাকিয়ে বড্ড কষ্ট পেল ঈশান।গাড়িটির কি বিশ্রি অবস্থা হয়েছে।কোমড়ে হাত ঠেকিয়ে থুলনিতে হাত বোলাতে বোলাতে আশেপাশে তাকিয়ে মানুষজন খুঁজছিল সে।তখনি চোখে পড়ে একটি ডিপাটমেন্টাল স্টোরে থাকা সিসি ক্যামেরার দিকে।

” রাসেল ওই যে সিসি ক্যামেরা আজকের ফুটেজটা আমার চাই।”

“পেয়ে যাবি এখন বরং বাড়ি ফিরি।ড্রাইভারকে বলবো গাড়িটা নিয়ে যেতে।”
.
অফিসের কাজ সেরে পুণরায় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে এসে দাঁড়ালো ঈশান।দোকানি সিসি টিভি ফুটেজ দেখাতে বারণ করেননি বরং হাসিমুখে গ্রহণ করেছে ঈশান এবং রাসেলকে।দুজনে মিলে বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে শুরু করে ফুটেজটা কিন্তু একটা পর্যায়ে দুটো মেয়েকে দেখা যায় ঈশানের গাড়িতে গোবর লাগাচ্ছে তাদের চেহারা চিনতে পেরে চমকে যায় রাসেল।ভয়ার্ত চোখে ঈশানের দিকে তাকাতে দেখতে পায় ঈশানের হতবাক চাহনি।
#চলবে___
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌