অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০৭

0
314

# অবেলায় ভালোবাসি
# লেখনিতে সাবরিন জাহান
#পর্ব-৭

মধ্যরাত! চারদিক শুনশান। ঘুমন্ত পুরী এই শহরে যারা জেগে আছে তাদের মধ্যে একজন আয়ান। ঘুম যেনো এর চোখে আসবে না বলে পণ করে রেখেছে। চোখ বন্ধ করলেই আয়ুশীর মুখশ্রী ভেসে ওঠে। আয়শীর লজ্জ মাখা মুখ বারবার মনে পড়ছে। ভেবে পাচ্ছে। না, এমন কেনো হচ্ছে বুঝতে পারছে না ও। সব মিলিয়ে অসহ্য লাগছে ওর, গ্যালারিতে গিয়ে কাঙ্খিত ব্যাক্তির ছবি বের করলো। নিজে নিজেই বললো,
” কেন এমন হচ্ছে ইহরা? আমার তো শুধু তোমাকে নিয়ে ভাবা উচিত। তাহলে কেনো এমন অনুভূতি হচ্ছে ?”
আয়ান আবার নিশ্চুপ। আবার বলতে লাগলো, “আমি এ কোন ঝড়ে উড়ছি? বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।”

আবারও নিরবতা, অতঃপর চোখমুখ শক্ত করে বললো, “উহু, আমি
ভাববো না ওকে। আমার লাইফ জুড়ে শুধু তুমি থাকবে ইহরা! শুধুই তুমি।”

পরদিন রেস্টুরেন্টে বসে আছে ইভা। মুখে তার রাজ্যের বিরক্তি। মায়ের কথা রাখতে এখানে এলেও, ওর মূল উদ্দেশ্য বিয়ে ভাঙা। কিছুক্ষণ বাদেই এলো কাঙ্খিত ব্যাক্তি। ঘর্মাক্ত মুখশ্রীর মাঝে মুচকি হাসিটা বেশ নজর কাড়া, যেকোন মেয়েই এই মুহুর্তে প্রেমে পড়তো, কিন্তু ইভা কোনোভাবেই সেইটা চাইছে না বলে চোখ সরিয়ে নিলো।
” মিস ইভা?”
“জি।”
“ওহ সরি ফর লেট।” বলেই সৌজন্যমূলক হাসলো।
ইভা বিরক্ত হলো, এখন কি ভালো সাজা হচ্ছে। অথচ যৌতুক চায় কি সহজে!ইভাকে চুপ দেখে লোকটি বললো,
“কি অর্ডার দিবো ?”
” কিছু না..”, ইভার সোজা সাপ্টা উত্তর.
“রেস্টুরেন্টে আছি, কিছু না অর্ডার দিলে কেমন হবে?”
“আপনি দিন না আপনার অর্ডার।”
” আমি একা বসে বসে খাবো, আর আপনি নজর দিবেন তা কেমন দেখায় না?”
“কি বললেন আপনি?”
” অর্ডার প্লিজ । ”
ইভা কটমট করে তাকালো মেনু কার্ড হাতে নিয়ে একটা জুস অর্ডার দিলো ওর দেখাদেখি লোকটিও জুসই অর্ডার করলো।
” আমার নাম জানেন ?”
“কেনো আপনি কি সেলিব্রেটি নাকি যে আপনার নাম জানবো?”

লোকটি থতমত খেলো মেয়ে তো নয় যেনো লাল মরিচের গুঁড়ো। আবার গরম তেলও বলা যায়। পানি পড়লে যেমন তেল হ্যাত ছ্যাত করে উঠে।এমন হাজারো নাম দিয়ে হেসে বললো,
“আমি জুনাইদ, জুনাইদ নীরব …..”
আর কিছু বলার আগেই ইভা বলে উঠলো,
” আপনি সরকারি চাকরি, করেন, বড় বাড়ি আছে। আপনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আর কিছু?”
“সব জানেন, তাহলে …”

ওকে আবার থামিয়ে ইভা বললো বললো,
“আমি কি একবারও বলেছি, কিছু জানিনা?”
ছেলেটা এবার বেশ বিরক্ত হলো।বির বির করে বললো, “ধানিলঙ্কা একটা।”
” কিছু বললেন ?’
“আমি সোজাসাপ্টা কথা পছন্দ করি।”
“তো?”
“অবুঝের মতো না বিহেভ করে বলে ফেলুন আপনার আমাকে পছন্দ না..”
“বেশ, আপনায় আমার পছন্দ না!”
“কারণ ? ”
“আর যাই হোক, সেখানে যৌতুকের কথা বিয়ে ঠিক করার আগে হয়, সেখানে আমি যেতে চাই না।”
” যৌতুক ?”
“এমন এ ভাব করছেন যেনো জানেনই না কিছু ..”
“সিরিয়াসলি, আপনার কথা বুঝতে পারছি না আমি।”
“বেশ, আমি বলছি। মেয়ে দেখার আগেই আপনার ফ্যামিলি আগেই দেনার হিসেব কষলেন। এক কথায় যৌতুক। ”
জুনাইদ এখন সম্পূর্ণটা বুঝতে পারলো। মুচকি হেসে বললো,
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
“মোটেও না।”
যৌতুকের কথা উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা আমার ফুঁফি বলেছে। আমার মা-বাবা না। ইনফ্যাক্ট ওরা বাসায় ফুফিকে বুঝিয়েছে এই ব্যাপারে। ভেবেছিল বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে ওরা এমনেই মানা করে দিবে এই ব্যাপারে…. ইভা হতভম্ভ।
” কি আপনি সত্যি বলছেন তো?’
জুনাইদ হেসে বললো, “সত্যি!”
ইভার অনুশোচনা হলো লোকটির ব্যবহারই বলে দিচ্ছে সে মিথ্যে নয়। জুনাইদ ওর অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, ” সব সরকারি চাকুরীজীবীরা খারাপ হয় না।”
” আই এম সরি! না জেনে এভাবে বলাটা আমার উচিত হয়নি।”

জুনাইদ আবার নিজের মন ভোলানো হাসি উপহার দিলো ।সামনে দুটো টিকিট মেলার রেখে বললো, ” এবার মত দিন।”
“মানে ?”
“মানে আমায় পছন্দ হলে এখন মেলায় যাবে।। আর না হলে বাসায়! এখন আপনি টিকিট তুলবেন, না বাসায় যাবেন, ডিপেন্ডস অন ইউ..”
ইভা বেশ কিছুক্ষণ ভাবলো। জুস শেষ করে অতঃপর মুচকি হেসে বললো,
” মেলায় যাওয়া বেটার ”
জুনাইদত্ত বিনিময়ে মুচকি হাসি উপহার দিলো ।

পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে। পরীক্ষার এই কয়দিন আয়ুশীর সাথে আয়ানের একবারও দেখা হয়নি। ইদানীং আয়ুশী কেমন মনমরা হয়ে থাকে। ব্যাপারটা ইভা, সীমা বেশ ভালোই বুঝতে পারে। কিন্তু ওদেরই বা কি করার। ইভার আর জুনাইদের প্রেম ভালোই চলছে। সব কিছুই ঠিকঠাক, কিন্তু আয়ুশীর মনে মেঘের ছায়া। আজ শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে তিনজন আলাপ করতে করতে বের হচ্ছে । তখনই আয়ানের দেখা পেলো ওরা আয়ান কিছু কাগজ দেখতে দেখতে আসছে। আয়ুশীর মুখে এতদিনে হাসি ফুটলো। সামনে এগিয়ে যাবে তার আগেই নিচ ভালোমতো দেখে নিলো, না হোচট খাওয়ার বা স্লিপ খাওয়ার কোনো চান্সই নেই। তাই দেখে সীমা বাঁকা হাসলো। আয়ুশী এগিয়ে যেতে নিলেই সীমা এক পা ওর সামনে দিলো। ফলাফল ল্যাং খেয়ে আয়ুশী পড়ে যেতে নিলো। এদিকে আয়ান আয়ুশীকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে হাতের কাগজ সব ফেলে দিলো। কিন্তু আয়ুশী নিজেকে ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। আয়ান অসহায় চোখে তাকালো।
“মিস ঝামেলা! সারাদিন হোঁচট খাওয়া ছাড়া আসলেই কি তোমার কাজ নেই?তোমার সাথে দেখা হলেই আমার সাথে কিছু না কিছু হয়…”
“স্যার কে যেনো ল্যাং…”, বলে পিছে তাকাতেই দেখলো সীমা মুচকি মুচকি হাসছে। আর কিছু বোঝার বাকি নেই ওর। রাগী চোখে সীমাকে হুমকি দিয়ে আয়ানকে বললো,”সরি, স্যার।”
আয়ান কিছু না বলে কাগজগুলো উঠাতে লাগলো, আয়ুশীও সাহায্য করলো অতঃপর আয়ান কিছু না বলেই চলে গেলো। আয়ুশী তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সীমার দিকে খেয়ে ফেলা টাই টাইপ লুক দিলো। তাই দেখে সীমা মেকি হাসলো।
ফুচকার দোকানে গালে হাত দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আসে সীমা, আয়ুশীর থা’প্প’ড়ে’র ইফেক্ট আরকি। ভাবলো শেষ পরীক্ষা। একটু চিল করা যাক। তাই ফুচকার দোকানে আসা। কিন্তু সিটে বসার আগেই আয়ুশী ওকে ল্যাং মা’রা’র প্রতিশোধ নিয়েই নিলো ..ফুচকা আসতেই আয়ুশী বললো,
“প্র’তি’ব’ন্ধী’র মতো বসে না থেকে গিল।”
“তুই আমাকে এভাবে মা’র ‘লি আয়ু? ”
” ল্যাং মা’রা’র আগে ভাবা উচিত ছিলো?
“তোর ভালোর জন্যই তো দিলাম। ”
” এতে আমার কি ভালো শুনি?”, ভ্রু কুঁচকে আয়ুশী জিজ্ঞেস করলো।
“যাহ বাবা! আরে তোকে ল্যাং না মা’র’লে স্যার ও পাশ কেটে চলে যেতো আর তুই আড়চোখে দেখতি ৷ না হতো কথা, না হতো ঠিকমতো দেখা। তোর তো আমাকে থ্যাঙ্কস বলা উচিত।”
আয়ুশী ভেবে দেখলো আসলেই মন্দ বলেনি, কিন্তু এখন পল্টি খাওয়া যাবে না…তাই বললো,” আর উনি যে আমাকে কথা শুনালো ওগুলো ?”

সীমা দাত কেলিয়ে বললো, “পেয়ার কি জাঙ্গ মে,এছি ছোটি ছোটি বাতে সুন্নি পাড়তিহে, বেবী। ”
আয়ুশী ওর পায়ে লাথি দিলো, এতে সীমা ব্যাথা পেয়ে একটু আর্তনাদ করলো আর এই সব দেখে ইভা ফিক করে হেসে দিলো।

দিন যেনো চোখের পলকেই কেঁটে যাচ্ছে। কোনভাবে যে এক মাস কেটে গেলো। বেলাল সাহেব এখন সুস্থ হলেও যেহেতু এই ইয়ারের আর কয়েকমাস বাকি তাই আয়ানকেই পড়াতে বলেছেন। এই বছর শেষে উনিও অবসরে যাবেন। আয়ানের ছোট খাটো বিজনেস, এতেই চলে যাবে দিব্বি সংসার।আর নিজেরও কিছু জমা তো আছেই। আজ আয়ুশীদের বাসায় আয়ানরা। মোশাররফ আর বেলাল বাল্যকালের বন্ধু । সেই বন্ধুত্ব আজও আছে। ওদের মাধ্যমে মরিয়ম আর নাহারেরও সখ্যতা। মাঝে আয়ান ক্লাস সেভেনেই চলে যায় দেশের বাইরে। নাহারের ইচ্ছেতেই হয়েছে এমন। উনি চাইতেন ছেলে হায়ার স্টাডি করুক। তাই আয়ুশীর সাথে কখনোই দেখা হয়নি ওর। বেলাল বিয়ের পর থেকেই শহরে থাকে। সেই হিসেবে আয়ুশীরা মাত্র কয়েকবছর হলো আছে। আজকে এখানে আসার মূল কারণ আয়ান । আয়ুশী যখন খুব ছোট তখন একবার এসেছিলো, মরিয়মের রান্না তার খুব পছন্দের,তাই আজ রেঁধে বেড়ে খাওয়াতেই এই আয়োজন। যদিও আয়ান আসতে চায়নি, কিন্তু এভাবে না করাটাও ভালো হবে না। সব দিক বিবেচনা করেই ওর আসা। মরিয়মদের ভাড়ার বাড়ি, দুই রুম আর ডাইনিং। আলাদা কোনো ড্রয়িং রুম নেই বিধায় মরিয়মদের রুমেই সবাই বসেছে। মরিয়ম রান্না শেষে গোসলে ঢুকেছে। ওরা কথা বলার মাঝেই নাহার লক্ষ করলেন ছেলে কেমন হাসফাস করছে।
“কি হয়েছে আয়ান ?”
“একটু ফ্রেশ হওয়ার দরকার ছিলো মা।”
আয়ানের কথা শুনে মোশাররফ বলে উঠলেন, ” তুমি আয়ুশীর রুমে চলে যাও তাহলে।”
আয়ুশীর রুম শুনে আয়ান নাকোচ করলো।
“আরে যাও । ওর রুমে কেউ নেই। আয়ুশীও ভার্সিটিতে।”
কেউ নেই বলেই আয়ান গেলো। অন্যদিকে সবে মাত্র বাসায় এলো আয়ুশী। পড়ায় এখন প্রচুর ব্যস্ত সে। তার উপর কয়েকদিন পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ওখানে এজ এ স্টুডেন্ট ওকে বক্তৃতা দিতে হবে। মেয়ের ব্যস্ততা দেখে মরিয়ম জানায়নি আজ আয়ানরা আসবে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ঢুকলো ও। ওড়না টা পাশে রেখে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো ও। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ওর। সেই মুহুর্তে ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজে চোখ মেললো ও। আয়ানকে দেখে একবার নিজেকে পরখ করতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো ওর। ফট করে উঠেই ওড়না পেঁচিয়ে নিলো ও। বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আপনি?”
এদিকে আয়ান আয়ুশীর সামনে আসবে না আসবে না করেও বার বার এসে পড়ছে। কি অদ্ভুত যেটা চায় না। নিয়তি বার বার তার কাছেই নিয়ে যায়।বিরবির করে বললো, “হায়রে কপাল।”

#চলবে