অবেলায় তোমার আগমন পর্ব-০১

0
1059

#অবেলায়_তোমার_আগমন
#Adrrija_Aman
#সূচনা_পর্ব

“পেপারটাতে সই করে দে শ্রীজা।”
শরৎ ভাইয়ের কথাগুলো আমার কর্ণপথে পৌছনো মাত্রই চমকে তার দিকে তাকালাম আমি।সাদা মাটা একটা কাগজ তার হাতে, কাগজটার মাঝে আছে অজস্র ছোট ছোট শব্দমালা, তবে তা নিয়ম আইন মাফিক, কাগজটাকে ভালো করে লক্ষ করা মাত্রই বুঝতে পারলাম, শরৎ ভাই কোনো সাধারণ কাগজ বা পেপারের কথা বলছেন না।পেপার শব্দটার আগে ডিভোর্স কথাটা উল্ল্যেখ করেননি তিনি, হয়তোবা তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই।কাগজটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ শেষে অশ্রুশিক্ত চোখে শরৎ ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আমি।কিন্তু তিনি সেই দৃষ্টির আড়ালে থাকা কান্নাকে দেখতে পাননি।মনে একটা কৌতুহল জেগেছে এই কৌতুহলে ভয়, দুঃখ দুটোই আছে।ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কে মুষ্টিবদ্ধ করে শরৎ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম…

“এটা তো ডিভোর্স পেপার শরৎ ভাই।”

শরৎ ভাইয়ের খিটখিটে মেজাজ আর বিরক্তিভরা চাহনী।

“এটা যে ডিভোর্স পেপার তা তো আমিও দেখতে পাচ্ছি। নে এবার ফটাফট সই করে দে এটাতে।”

শরৎ ভাইয়ের কথায় হৃদপিন্ডটাই যেনো কেঁপে উঠলো আমার, যা ভয় করছিলাম তাই হলো, যেই ভয়ের কারণে নিজের বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে এসে থাকছি, সে ভয়ই এসে ঘিরে ধরলো আমাকে।মানুষটার হৃদয়ে কখনো আমার জন্য কোনো ভালোবাসা বা কোনো প্রকার অনুভুতি ছিলো না।
সময়ের অপচয় না করে আমি শরৎ ভাইকে প্রশ্ন করলাম…

“কেনো সই করবো শরৎ ভাই?”

আমার কাছ থেকে এমন অর্থহীন কথা যেনো আশা করেননি তিনি। তার রাগ এবার প্রবোল গতিতে বেড়ে গিয়েছে। এতোক্ষণ শান্ত স্বরে কথা বললেও এবার তিনি কিছুটা উচ্চ স্বরে রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন…

“কেনো সই করবি মানে? তুই ২ বছরের ছোট বাচ্চা এমন অর্থহীন প্রশ্ন করছিস।শ্রীজা তুই খুব ভালো করেই জানিস আমার আর অনুর সম্পর্কের কথাটা।আর অনুর ছোট বোন হওয়ার সুবাদে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবটাই তোর খুব ভালো করে জানা, এতো কিছু জানার পরও তোর মুখে এমন ফালতু প্রশ্ন কখনোই মানায় না!”

হালকা হাসঁলাম আমি লোকটার স্ত্রী হওয়া শর্তেও কোনো অধীরকার নেই আমার তার প্রতি।সম্পর্কটার নাম আছে ঠিকই তবে তাতে কোনো রকম অনুভুতি নেই যা আছে সবটাই তিক্ততা আর বিরক্ততার। শরৎ ভাইয়ের কথার প্রেক্ষিতে আমি ভেজা গলায় বিরবির করে বলে উঠলাম…

“তার ছোট বোন হওয়াটাই তো আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো শরৎ ভাই।”

“কিছু বললি? ”

আমি কথা ঘোরানের জন্য বলে উঠলাম…

“না মানে ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে তো কমপক্ষে ছয় মাসের প্রয়োজন হয়।”

আমার কথা শুনে হাসঁলেন শরৎ ভাই।তবে তার হাঁসির মানেটা ভালো করে ধরতে পারলাম না আমি।

“তোর বয়স কতো?”

শরৎ ভাইয়ের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে ইকটু হিমশিম খেলাম আমি।আমার বয়সটা শরৎ ভাইয়ের খুব ভালো করেই জানা।তবুও প্রশ্ন করাতে উত্তর তো দিতেই হয়।মাথা নিচু করে বললাম…

“২১ চলছে।”

“আর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে কতো বছর পূর্বে?”

“উমমম, প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি হবে।”

“এই ৫০ বছরে দেশের কিছু উন্নতি হয়েছে?নাকি তাও হয়নি?”

“উন্নতি হবে না কেনো? আমরা তো এখন উন্নয়নের পথেই।”

“৫০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে দেশে যেমন উন্নতির হার বেড়েছে, তার থেকে ৪ গুণ বেশি বেড়েছে দুর্নীতির হার।আর সেই দুর্নীতির কুফলেই আমি ৬মাসের যায়গায় ২মাসের মধ্যে ডিভোর্স পেপার তৈরি করেছি।আর কোনো কনফিউশন? ”

ঘাড় নেড়ে না বোধক ইশারা করলাম আমি। কিছুক্ষণের ব্যাবধানে শরৎভাই আমার হাতে ডিভোর্স পেপারটা ধরিয়ে দিলেন।আর তার জিন্সের পকেট থেকে কালো রঙয়ের একটা জেল পেন বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি বুঝতে পারলাম শরৎ ভাই অপেক্ষা করছেন কখন আমার সই করা শেষ হবে। আমি কলম হাতে নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম মাঠের এক প্রান্তে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় ঠান্ডা হিমেল হাওয়া বয়ে চলেছে চারপাশে।আকাশে মেঘ ডাকছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের কাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে মাঠের এক কোণায় দাড়িয়ে আছি আমি আর শরৎ ভাই। ছাত্রী হলের বারান্দায় দাড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে রিদা,সুরভি,নুপূর। হয়তোবা এতোক্ষণে হল থেকে বেরিশে পড়েছে আমাকে খোঁজার জন্য।এখানকার মাঠ বিশাল এক স্থান থেকে অন্যস্থানে রিকশা দিয়েও যাতায়াত করার প্রয়োজন হয়।আমি পায়ের কাছে থাকা গাছ থেকে ঝড়ে পড়া শুকনো পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি।কিছু একটা নিশ্চিত হবার চেষ্টা করছি।হঠাৎ কিছু একটা অনুভব করতেই পেপারটাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললাম আমি। আমি জানি শরৎ ভাই এখন এতোটুকুও অবাক হয়নি। তবে তার রাগ যে তীব্র থেকে তীব্রতরো হচ্ছে তাও আমার অজানা নয়। হুট করেই আমার হাত ধরলেন শরৎ ভাই সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা শরীরে আলাদা একটা শীহরণ বয়ে গেলো। মুহুর্তেই ঝুম বৃষ্টি নামতে লাগলো তবুও আমার হাত ছাড়লেন না শরৎ ভাই। বরং আরো শক্ত করে ধরলেন আমার হাত। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করলেন।

“পেপারটা ছিড়লি কেন?”

“আমি মনে মনে ভয় পেলেও সামনা-সামনি তা প্রকাশ করলাম না।উল্টো বলে উঠলাম…

“কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি শরৎ ভাই।”

শরৎ ভাইয়ের মুখের রঙ বদলে গেলো। তার চেহারায় দেখা দিলো সেই আগের রাগ আর বিরক্তিতে ভরা চাহনী।উনি দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন…

“আবার সেই একই কথা বলছিস তুই! ভালোবাসা কী হাতের তৈরি মুড়ির মোয়া?যে বললেই হয়ে যাবে।”

আমি পাল্টা উত্তর দিলাম…

“আমিও তো তাই বলছি। ভালোবাসা কি মুড়ির মোয়া নাকি? যে বললেই শেষ হয়ে যাবে বা অপ্রকাশিত থেকে যাবে?”

শরৎ ভাই এবার নিজেকে শান্ত করার জন্য ঠান্ডা স্বরে বলে উঠলেন…

” তুই কি আমাকে রাগাবার জন্য এসব করছিস শ্রীজা! হূ—-চ্ছু।”

বলেই মুখ মুছতে লাগলেন তিনি।এই বৃষ্টিতে অযথা এভাবে মুখ মোছার কোনো মানে দেখলাম না আমি। অনেকটা রাগ হলো আমার তার প্রতি।একে তো ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসেছে।এরপর আবার এই বৃষ্টিতে সর্দি লাগিয়ে ছেড়েছে।সাথে আমাকে বৃষ্টিতে ভেজাচ্ছে।আমি কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলাম…

“হয়ে গেলো তো? সর্দিটা লাগিয়েই ছাড়লেন তাই না? এখন আপনার সাথে সাথে আমাকেও এই বৃষ্টিতে ভিজতে হলো।এবার আমারও সর্দি হবে।বলি আপনাকে দেখবার জন্য তো মামনি আছে।আমাকে এই হোস্টেলের ভেতর এসে কে দেখে যাবে?”

বিরক্তিতে ভরা চাহনি শরৎ ভাইয়ের।রাগে গাল দুটো লাল হয়ে গিয়েছে।এখব কিছু বলতেও পারছেন না।আমার ওনার অবস্থা দেখে হাঁসতে মনচাইলেও হাসঁলাম না আমি।নিজেকে যথা সম্ভব সংযতো করে বলে উঠলাম…

“অনেক হিরোগিরি হয়েছে। এবার দয়া করে আপনার হিরোগিরি বন্ধ করে। দ্রুত বাড়িতে যান।নিশ্চই মামনি চিন্তা করছে।মানুষটাকে চিন্তা ছাড়া আর কিছু তো দিতে পারেন না আপনি। পাড়লে শপিং মলে গিয়ে ড্রেস চেন্জ করে নিবেন।এখন তো শুধু সর্দি বাধিঁয়েছেন এরপর জ্বর বাধাঁবেন।দ্রুত যান এতো দেড়ি করলে এই ঝড় বাদলের দিনে এমন ভেজা কাপড়ে কোনো ট্যাক্স – ক্যাব আপনাকে লিফ্ট দেবে না।”

শরৎ ভাই আর কিছু বলার আগেই।ছাত্রী হলের দিকে উদ্দেশ্যে দৌড়ে গেলাম আমি।রাগ,বিরক্তি মিশ্রিত অনুভুতি অনুভব করতেই হাত মুঠ করে নিলো শরৎ ভাই।কপালে এসে পড়া ভেজা চুলগুলোকে ঝাড়তে ঝাড়তে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন শরৎ ভাই।
হুট করেই আমার মুখে লেগে থাকা হাঁসিটা উধাও হয়ে গেলো।চোখে মুখে এসে হানা দিলো কান্নারাশি।আর শরৎ ভাইকে হারানোর ভয়।হুট করেই মনে পড়ে গেলো আজ থেকে ঠিক দু মাস আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা…..

চলবে।