হৃদয়াবেগ পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0
952

#হৃদয়াবেগ
#অন্তিম_পর্ব (প্রথমাংশ)
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

পশ্চাতে দন্ডায়মান মানুষটাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে চট করে উঠে দাঁড়ায় নাযীফাহ। স্তম্ভিত নাযীফাহ শ্বাস আঁটকে এলো তার। মনে হচ্ছে সব যেন তার অচেতন মনের কল্পনা।অসাড়, অবশ সমস্ত কায়া। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না তাহমিদ এসেছে। চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়। শুকনো ঢুক গিলে সে। অশান্ত মন শান্ত হলো। বিনা প্রস্তুতিতে তাহমিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাযীফাহ।

নাযীফাহ’র অতর্কিত অনুরাগ মিশ্রিত হামলায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তাহমিদ। তার ধারণাতীত ছিলো নাযীফাহ তাকে জড়িয়ে ধরবে। আলতো হেসে তাহমিদও নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো নাযীফাহকে। এতোদিনের অন্তঃস্থলে বয়ে যাওয়া প্রলয় ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে গেলে মানসিক শান্তি বড্ড প্রয়োজন। এটাই হলো সেই শান্তি। অত:করনে রাজ করা মানুষ পাশে থাকলে বুঝি এতো সুখানুভব হয়?

‘আপনি আগের থেকে শুকিয়ে গেছেন। কালো হয়ে গেছেন। ঠিকমতো খান না নাকি?’

তাহমিদ নিজের বুক থেকে নাযীফাহ’র মাথাটা তুলে ললাটের এলোমেলো চুল গুলো সরিয়ে উষ্ম স্পর্শ দিলো।

‘সুখ পাখিটাকে ছেড়ে থাকি। তাই কোনো কিছুতেই মন বসে না।’

____________________________________________

গেইটের বাইরে পা ফেলার জায়গা নাই। যত না ছাত্র ছাত্রী তার থেকেও বেশি অভিভাবক। তাহমিদ শক্ত করে নাযীফাহ’র হাত ধরে রেখেছে। আর একটু বাদে বাদে বলছে,

‘একদম ভয় পাবি না। মাথা ঠান্ডা রাখ।ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিবি। মানুষের আক্কেল জ্ঞান কিছুই নেই। পরীক্ষা দিবে একজন পুরো পরিবার চলে আসছে। একজন আসলেই তো হয়। এজন্যই আমি বাবা আর মামুকে আসতে নিষেধ করেছি। অভিভাবকদের জন্য আসল পরীক্ষার্থীরাই দাঁড়াতে পারছে না।’

অতঃপর হলরুম খোঁজে বের করে নাযীফাহকে সিটে বসিয়ে তাহমিদ নাযীফাহ’র গালে হাত রেখে বলল,

‘আমি আশেপাশেই আছি। একদম ভয় পাবি না বলে দিলাম। পরীক্ষা শেষে আমি না আসা অব্দি কোথা যাবি না।’

নৈঃশব্দ্যে মাথা নাড়ে নাযীফাহ। তার থেকে দু’বেঞ্চ সামনে জান্নাত।

প্রথম দুইটা পরীক্ষার সময় তাহমিদ থাকলে তৃতীয় পরীক্ষার আগের দিন নিজ কর্মস্থলে ফিরে যায় সে। তৃতীয় পরীক্ষার দিনই ঘটে এক কান্ড। নাযীফাহ আর জান্নাত হলে বসে কথা বলছিলো। পরীক্ষা শুরু হয়নি তখনও। তখন একটা মেয়ে এসে নাযীফাহকে বলল,

‘কিছু মনে না করলে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

মেয়েটির দিকে তাকায় নাযীফাহ। মেয়েটি আমতা আমতা করে বলল,

‘তোমার সাথে রোজ যে লোকটা আসে, আজ আসেনি?’

তাহমিদের কথা জিজ্ঞেস করায় কপাল কুঁজিত হয় নাযীফাহ’র। অতঃপর না বোধক মাথা নাড়ে সে।

‘উনি নিশ্চয়ই তোমার ভাই হয়। ভাই বলে সম্বোধন কর তাই বললাম। উনাকে দেখে ক্রাশ খাইছি। কি এটিটিউড উনার। কারো দিকে তাকালো না পর্যন্ত। যদি উনার নাম্বারটা দিতে?’

চোখেমুখে কাঠিন্যভাব দেখা দিলো নাযীফাহ’র। তার ইচ্ছে করছে সামনের মেয়েটাকে কষিয়ে দু’টো থা’প্প’ড় দিতে। পরীক্ষা দিতে এসেছিস পরীক্ষা দিবি এতো দিকে নজর কেন তোর? মিটমিট করে হাসছে জান্নাত। নাযীফাহ’র রাগান্বিত আনন দেখে এবার শব্দ করেই হেসেই দিলো।

‘কোনো লাভ নেই বোন। উনি অলরেডি বুকড। তাও কিনা প্রায় দু’বছর আগে থেকে। আর সেই বুকিং করা মানুষটা আর কেউ না তোমার সামনে যে বসে আছে।’

মেয়েটা নিজের মাথায় চাটি মে’রে বলল,

‘ওপস সরি, কিন্তু তুমি ভাই কেন ডাকো?’

‘আরে ওরা কাজিন ছিলো তাই।’

সেদিন নাযীফাহ পরীক্ষা শেষে বাসায় গিয়ে আগে তাহমিদকে কল করলো। দু’বার কে’টে দেওয়ার পর তৃতীয়বার কল রিসিভ করলো সে।

‘নাযীফাহ পাগলামি কেন করছিস। বাসায় গিয়ে কল দিবো তো।এখন অফিস টাইম।’

‘আপনি আর আমি যদি কোথাও যাই তবে যে যে আমাদের সাথে যে কোশল বিনিময় করবে তাদেরকে বলবেন আপনি বিবাহিত আর আমি আপনার বউ।’

হঠাৎ নাযীফাহ এমন আজগুবি কথা শুনে তাহমিদের কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে।

‘পরীক্ষা শেষে রাস্তায় কিছু খেয়েছিলি? কিসব উল্টো পাল্টা বকছিস।’

নাযীফাহ কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘মানুষ আপনাকে আমার ভাই বলে কেন? আবার নাম্বারও চায় প্রেম করার জন্য।’

‘কি হয়েছে বলতো।’

তখনকার ঘটনা খুলে বলতেই শব্দযোগে হাসতে লাগলো তাহমিদ।

‘একদিন বলেছিলাম না এই ভাই বোন বলা নিয়ে তুইও একদিন জ্বলবি। মিলল তো? বেটার হাফকে এসব বললে রাগ হয় খুব রাগ। আমারও সেদিন এমন রাগ হয়েছিল। এবার আল্লাহ ওয়াস্তে ভাই ডাকা বন্ধ কর।’

____________________________________________

সময় কত দ্রুত চলে যায়। পলক ফেলার সাথে তা হয়ে যায় অতীত। নাযীফাহ’র পরীক্ষা শেষ রেজাল্টও দিলো। আবার এডমিশনের পর্বও শেষ। অথচ তাহমিদকে ছয়মাস পরে ঢাকায় ট্রান্সফারের কথা থাকলে আরো দুইমাস তাকে চট্টগ্রাম থাকতে হবে। বর্তমানে তার কোম্পানি একটা মেগা প্রজেক্টে হাত দিয়েছে। আর সেটা প্রেজেন্টেশনের দায়িত্ব পড়েছে তাহমিদের কাঁধে। তার কথা বলার ধরনে মুগ্ধ বস৷ সহজে যে কেউ আকৃষ্ট হয়ে যাবে। প্রজেক্টের ফাইলটা মাত্রই বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চোখ জোড়ায় রাজ্যের ঘুম। ক্লান্তি জেঁকে বসেছে সর্বাঙ্গে। চোখ দু’টো যখন লেগে এলো রিংটোনের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকায় সে। রিসিভ করেই বলল,

‘এখনো ঘুমাসনি? শরীর খারাপ করবে তো।’

নাযীফাহ নিস্তেজ গলায় বলল,

‘ঘুম আসছে না আমার। ভালো লাগছে না কিছু।’

‘দাদি কি ঘুমিয়ে গেছে? আজ মা আসেনি তোর কাছে?’

‘দাদি ঘুমোচ্ছে। রোজ রোজ ফুপি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে ঘুম পাড়িয়ে দিবে এসব ভালো লাগে না আমার। উনার বয়স হয়েছে। বিশ্রাম প্রয়োজন। তাই আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতে বলেছি।’

‘মন কি বেশি খারাপ?’

অকস্মাৎ নাযীফাহ ফুপিঁয়ে উঠলো।

‘আমার আপনাকে খুব প্রয়োজন তাহমিদ ভাই। আপনার সান্নিধ্যে থাকতে চাই। চারিদিকের সবকিছু বি’ষাক্ত লাগে। নিজেকে পরাজিত সৈনিক মনে হয়। আমার তো কতো শখ ছিলো ঢাকা ইউভার্সিটিতে পড়বো। চেষ্টাও করলাম হলো না কেন?আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতেও অপারগ আর আপনারটাও। আমি ব্যর্থ তাহমিদ ভাই আমি ব্যর্থ।’

তপ্ত শ্বাস ফেলল তাহমিদ। এডমিশনের পর থেকে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে নাযীফাহ। এইচএসসিতে আশানুরূপ ফলাফল করলেও কোনো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স হয়নি তার। যেদিন ঢাকা ভার্সিটির রেজাল্ট দিলো, মেরিট লিস্টে নিজের নাম না দেখে সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা যায় নাযীফাহ।
নাযীফাহ শারীরিক ও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে বলে উদ্ভ্রান্ত ও ক্লেশিত হয়ে ছুটে এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে। সে যখন ঢাকায় পৌঁছায় তখন রাত্রিবেলা। ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা পঁচিশ। নাযীফাহ কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। নাযীফাহ যখন পিটপিট করে চোখের পাতা উন্মেষিত করেই দেখল তাহমিদ তার হাত ধরে বসে আছে। এলোমেলো চুল, আতঙ্কগ্রস্ত আনন।সবমিলিয়ে উন্মাদগ্রস্ত লাগছিলো তাকে। অক্ষিপটে তাহমিদ কে দেখে অবুঝের মতো কান্না শুরু করে দিয়েছিলো।

‘তাহমিদ ভাই, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্নটা আমার স্বপ্নই রয়ে গেলো।আমার এতোদিনের পরিশ্রম। আমি ব্যর্থ।’

ক্লান্ত অবসন্ন তাহমিদ তখন দু’হাতে আগলে নিয়েছিলো ভেঙে পড়া প্রেয়সীকে।

‘ঢাকা ইউভার্সিটিতে হয়নি আরো পাবলিক ভার্সিটি আছে তো। সেখানে হবে। এতো ভেঙে কেন পড়ছিস?’

না হয়নি আর কোথাও হয়নি নাযীফাহ’র। সেটা নিয়েই ডিপ্রেশড নাযীফাহ। সারাক্ষণ কেউ না কেউ থাকা লাগে তার সাথে।

ভাবনাচ্ছেদ হয় তাহমিদের। কতগুলো দিন চলে গেলো। হাসিখুশি নাযীফাহ হুট করেই বদলে গেলো। এখন আর তাকে সহজে হাসতে দেখা যায় না।

‘তোর এই ভেঙে পড়া আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। বললাম চাকরি ছেড়ে চলে আসি এখানেও তোর নিষেধাজ্ঞা। আমি তোর থেকে এতোটা দূরে তোর বিষন্ন, হতাশ, অপ্রফুল্ল গলা শুনলে আমার অন্তর পুড়ে। স্বামী হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হয় কারণ তোর এই খারাপ সময়ে আমি তোর পাশে নেই। স্বামী হিসেবে আমি অযোগ্য। জীবনে সফল হতে হলে যে ঢাকা ইউনিভার্সিটি বা বা অন্যান্য পাবলিক ভার্সিটিতেই পড়তে হবে এমন তো না। ভেতরে যদি পুঁজি হিসেবে জ্ঞান আর বিদ্যা থাকে তো যেকোনো অবস্থান থেকেই সফল হওয়া যায়। মূলকথা হচ্ছে আমি শিক্ষা অর্জন করছি কিনা। ‘আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। যা আমার জন্য কল্যানকর তাই ঘটে আমার সাথে।’ এই একটা কথা যদি মানতে পারিস আর কখনো হতাশ হবি না। সন্তুষ্ট থাকবি আল্লাহর সকল সিদ্ধান্তের উপর। শুকরিয়া আদায় করবি। মনে থাকবে?’

নাযীফাহ ভাঙা গলায় বলল,

‘হুম মনে থাকবে।’

‘প্রতিটা শ্বাসে হতাশা না থেকে শুকরিয়া থাকে। শুননা বস কি বলেছে? বলেছে, যদি এই ডিল ফাইনাল হয়ে যায় তো বস আমাদের হ্যানিমুন প্যাকেজের সকল খরচ বহন করবে। পুরো সাতদিন কক্সবাজার ভাবা যায় বল? আমি তো শুধু ডিল ফাইনাল আর আমার নাযীফাহ’র আঠারো পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় আছি।’

সকল হতাশা বিলীন হয়ে নাযীফাহকে ঘিরে ধরলো লজ্জা আর ত্রপা। এইতো আর কয়েকটা দিন নতুন করে সংসার পাতবে সে।

____________________________________________

শপিংমলে সবগুলো ব্যাগ নিয়েছে কিনা গুনে নিচ্ছে ওয়াহিদা আর ফাহমিদা বেগম। বিয়ের শপিং বলে কথা। পাঞ্জাবি কিনার জন্য তাহমিদ আর নাযীফাহ জেন্টস কর্ণারে গেছে। বাবা আর মামুকে আশেপাশে না দেখে ফাহিম তার মাকে রোঁদন করে বলল,

‘ওমা মা, তোমার বড় ছেলেকে তো বিয়ে দিয়ে দিলে।এবার আমার জন্যও পাত্রী খুঁজো। যাতে ভাইয়ের রিসিপশনের দিন আমারও গতি হয়ে যায়। তাহলে তোমাদেরও খরচ বেঁচে যাবে। এভাবে সিঙ্গেল জীবন পার করা যায়।’

ওয়াহিদা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘তোর লজ্জা করে না মায়ের সামনে কিসব বলছিস? দিবো এক চড়।’

‘এতো লজ্জা রেখে কি হবে বলো।লজ্জা তো নারীর ভূষণ।’

‘অনার্স শেষ হলে তোরও বিয়ে দিবো।’

‘আহারে! আবারও অপেক্ষা। এই জীবনে অপেক্ষা শেষ হবে না।’

মা ছেলের কথায় মিটিমিটি হাসছে ফাহমিদা বেগম। পরিবার সুন্দর হতে মানুষের মন-মানসিকতাও সুন্দর হওয়া প্রয়োজন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে তাহমিদ ফাহিম কে কল করে বলে যেন বাসায় চলে যায়। কারন বাসায় আমেনা বেগম একা।

নরম হয়ে এসেছে আমেনা বেগম। আগের থেকে শরীর দূর্বল। এতো অসুখ বিসুখ আর দূর্বলতার মাঝেও তার আনন্দের শেষ নেই। বড় নাতির বিয়ের অনুষ্ঠান বলে কথা।

রিক্সায় বসে আছে তাহমিদ আর নাযীফাহ। দুজনের হাতে চারটা শপিং ব্যাগ। দুই মায়ের জন্য লাল জামদানী শাড়ি আর দুই বাবার জন্য পাঞ্জাবি। দুই মাকে সাজাবে কনে রূপে আর বাবাদের বর রূপে। সেজন্যই কায়দা করে দুজন ওদেরকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।

রিক্সা বাসার কাছাকাছি আসতেই নাযীফাহ তাহমিদের দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলল,

‘বাকি পথটা হেঁটে যাই। কতদিন পরে দুজনের আবার রাত্রিবেলা হাতে হাত রেখে হাঁটার সুযোগ হয়েছে।’

‘সারাদিন এমন ছুটাছুটির পর পারবি হেঁটে যেতে? আগের বাসা কিন্তু নেই। এখন কিন্তু আরো একটু ভিতরে।’

‘ক্লান্ত হয়ে গেলে আপনি আছেন তো।বাকিটা পথ না হয় পাঁজা কোলে করে নিয়ে যাবেন।’

আবাসিক এলাকার আশপাশ একটু নিরবই থাকে। মাঝে মাঝে দুই একটা রিক্সা যায়।তাহমিদের হাতের ফাঁকে হাত গলিয়ে হাঁটছে নাযীফাহ।

‘তুই প্রথম ঢাকা আসার পর আমরা যেদিন প্রথম বের হলাম তোর মনে আছে সেদিনের কথা?’

নাযীফাহ মৃদু হেসে বলল,

‘হুম মনে আছে।’

‘সেসময় আমার অন্তরতম অঁচলে এক আকাশ পরিমাণ আবেগ আর অনুরাগ থাকলেও তোর ভেতরে এসবের ছিটেফোঁটাও ছিলো না। সেসময় তোর কাছে যেতে আমার ভয় হতো।তুই যদি আমাকে ভুল বুঝিস। ইচ্ছে করতো তোকে জড়িয়ে ধরি। আমার অন্তর্দেশ ঠান্ডা করি। আমি চাই এমন একটা রাত আবার আসুক।যখন তোর মনেও আমার জন্য আকাশ সমান ভালোবাসা থাকে।হয়তো সেই দোয়াটা আজ কবুল হয়েছে।’

‘আপনি কখন বুঝেছিলেন আপনি যে আমাকে ভালোবাসেন?’

‘যেদিন গ্রাম থেকে খবর পেলাম তোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন মনে হয়েছিলো আমি আর আমার মাঝে নেই। কেউ আমার হৃদপিণ্ডটা কে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে গেছে। সেদিনই বুঝেছি আমি আর আমার নেই।’

____________________________________________

প্রাইভেট কারের দরজা খোলে দাঁড়িয়েছে নাযীফাহ। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো সে। গ্রামের নির্মল বাতাস গায়ে মাখতেই কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো। তিন তিনটা বছর পরে সে গ্রামের মাটিতে পা রেখেছে। কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে। টিনের ঘরের জায়গায় দালান হয়েছে। কত পরিবর্তন। খালেদ মোশাররফ গাড়ি থেকে ব্যাগপত্তর নামাচ্ছেন। বিয়েটা গ্রামেই হবে। নাযীফাহ জোর করে জান্নাতকে সাথে নিয়ে এসেছে। নিতুর মা কথা দিয়েছে বিয়ের দিন আসবে। অন্তরসত্বা তিনি।নিতুর বাবার সাথে তুমুল ঝগড়ার পরে বাচ্চা নেওয়ার জন্য রাজি হয়েছেন তিনি। তপ্ত শ্বাস ফেলে দু’কদম সামনে এগুতেই সে দেখতে পেলো।

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#অন্তিম_পর্ব (শেষাংশ)
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

তপ্ত শ্বাস ফেলে দু’কদম সামনে এগুতেই সে দেখতে পেল তার ফেলে যাওয়া দিনের আনন্দগুলো একসাথে জড়ো হয়ে তাকে দেখতে এসেছে। তার সঙ্গীদের দেখে কান্না পেয়ে গেলো তার।কতশত সময় কাটিয়েছে এদের সাথে। কতটা বড় হয়েছে গেছে তিন বছরে এরা। হাতের ইশারায় কাছে ডাকতেই হাফিজ বলল,

‘না নাযুপ্পু তোমার গায়ে ময়লা লেগে যাবে। দেখো আমাদের সবার শরীর কাঁদা মাটি। সবাই মাছ ধরতে গিয়েছিলাম।তুমি আসবে শুনে সবাই ছুটে এসেছি।’

‘লাগলে লাগুক তাই বলে আমি তোদের ছুঁয়ে দেখবো না? কতদিন পরে তোদের সান্নিধ্য পেলাম বল?’

সবাই যেন হা’মলে পড়লো নাযীফাহ’র উপর। কতদিন পরে ওরা ওদের নাযীফাহকে পেলো।

‘কেমন আছিস তোরা?’

‘আমরা সবাই ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’

জান্নাত নাযীফাহ’র কাঁধে রাখতেই নাযীফাহ চোখের পানি মুছে বলল,

‘এরা আমার সঙ্গী ছিলো।আমি সবথেকে বেশি এদের শূন্যতায় পুড়তাম।’

____________________________________________

পার্লারের মহিলা বউ সাজানোর পরই বাইরে হট্টগোলের আওয়াজ শুনতে পেলো নাযীফাহ। তাহমিদ বরবেশে এসেছে মনে করে চুপ করে রইলো সে। বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে। আর মাত্র কিছু মুহূর্ত। তারপর সেই বহুল প্রতীক্ষিত রাত। মাথা নুয়িয়ে রাখলো সে। নাযীফাহ’র পাশে কেউ নাই। জান্নাত বরকে বরন করার সকল বন্দোবস্ত করছে। খালেদ মোশাররফ কক্ষে প্রবেশ করলেন তারেক সাহেব নিয়ে। সামনে দন্ডায়মান লোকটাকে দেখে আপাদমস্তকে ভয় গ্রাস করলো তাকে। অতীতের সেই আতঙ্ক। যথেষ্ট পরিমাণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তারেক সাহেব বললেন,

‘পূর্বের করা কৃত কর্মের ফল আমি পাচ্ছি রে মা। মানুষের হায়াত-মউতের ঠিক নেই। আমি একেবারে নিঃস্ব। আমার যা কিছু ছিলো সব শেষ। মরণব্যাধি ক্যানসার আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমার কর্মের ফল আমার সন্তানরা পাচ্ছে। তোর সাথে অন্যায় করেছি আমি। শুধু তোর সাথে আরো অনেকের সাথেই করেছি। আমাকে মাফ করে দিস।আমি সবার কাছে মাফ চেয়েছি।মাফ করে দিস তোরা আমায়। তোকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার কাছে শুধু দোয়া ছাড়া। জানি না এটাও আল্লাহ কবুল করবে কিনা। সুখি হ মা দোয়া করি।’

একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নাযীফাহ। ভয়ে পেয়ে গিয়েছিল সে।

____________________________________________

লজ্জায় রুম থেকে বের হচ্ছে না ওয়াহিদা আর ফাহমিদা বেগম। এই বয়সে বধূ বেশে লজ্জায় নেতিয়ে গেলো তারা। নাযীফাহ আর তাহমিদ যে কি করে না। বাহিরে এতো কাজ অথচ তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু পরে কক্ষে প্রবেশ করলেন আমেনা বেগম। দুজনের দিকে তীক্ষ্ণধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

‘তোমরা এমন করছো কেন? লাল শাড়িই তো পড়েছো। তাহমিদের দাদা বেঁচে থাকলে দেখিয়ে দিতাম সাজ কাকে বলে যাও বাইরে যাও। সবাই তোমাদের খুঁজছে।’

লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে কক্ষ থেকে প্রস্থান নিলেন ওনারা। এই বয়সে এইসব সাজ সাঝে?’

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। তাহমিদকে আর নাযীফাহকে একসাথে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ঠিক সেই মূহুর্তে নিতুর মা এলেন নিতুকে নিয়ে। বড় একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো গিফট দিলো নাযীফাহ’র হাতে। এবং এটাকে এখানেই আনপ্যাক করতে বলল। আনপ্যাক করার সাথে একেবারে ‘থ’ হয়ে নাযীফাহ। এটা তো সেইদিনের ছবি। নিতুর জন্মদিন ছিলো। তাহমিদ নাযীফাহ কে হারানোর ভয়ে কেঁদেছিলো সেই ছবি। নিতুর মায়ের তাকাতেই উনি প্রশস্ত হেসে বলে উঠলেন,

‘আমার তরফ থেকে ছোট্ট উপহার এই মিষ্টি দম্পতির জন্য। দোয়া করি সুখে থাকো। আর তাহমিদ নাযীফাহকে ঠিক এভাবেই আগলে রেখো।’

জান্নাত নাযীফাহ মুখটা নিজের হাতের আঁজলায় নিলো। অশ্রু সিক্ত চোখে ঠোঁট ছুঁয়ালো নাযীফাহ’র কপালে।

‘বাবা মা কি দিয়েছি জানি না। বাবা তোকেও তার একটা মেয়ে মনে করে। তুই তো আমার বোন।আমার পক্ষ থেকে এটাই আমার ভালোবাসাময় উপহার। যেদিন নতুন অতিথির আগমন ঘটবে সেদিন তার খাম্মি তাকে বিশাল কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবে। বাট তোকে কিছু দিবো না।’

নাযীফাহ ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো জান্নাতকে। পিছন থেকে তাহমিদের এক বন্ধু বলল,

‘দুস্ত এদেরকে থামা। না হলে বন্যা নিশ্চিত।

টিকটিক করে বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠলো নাযীফাহ’র। যদিও বিদায় হয়েছিল আরো আগে। আবারও হবে। তখন বাবার সাথে অভিমান করে কথা না বললেও এই বাবার বুকে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে। পাশে ফাহমিদা বেগম দাঁড়িয়ে।

নিজের চোখের মুছে খালেদ মোশাররফ ভাগ্নের দিকে তাকালেন।

‘তোকে নতুন করে কিছু বলার আমার নাই। আমার মেয়েটা আমার থেকেও বেশি তোর কাছে সুরক্ষিত থাকবে। সুখে থাক বাবা।’

গাড়িতে উঠানো যাচ্ছে না নাযীফাহকে। বাবার পাঞ্জাবি শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। নাযীফাহকে স্বাভাবিক করার জন্য ফাহিম বলল,

‘আশ্চর্য তুই কান্না করছিস কেন? কান্না করার কথা তো আমার ভুলাভালা ভাইটার। আহারে নাদান ভাই টা আমার। তোর মতো আ’জরাইলের জন্য আমার অল্প বয়সী ভাইয়ের কলিজাটা একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো।’

নাযীফাহ রণমুর্তি ধারন করে কিছু একটা বলতে গেলেই তাহমিদ আড়ালে নাযীফাহ’র হাত ধরে ফেলে। তাহমিদের দিকে তাকাতেই সে চোখের ইশারায় বলে শান্ত হতে।

তাহমিদের গাড়ি ছেড়ে যেতেই ওয়াহিদা খালেদ মোশাররফ কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘যৌতুক নেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু নিবো না। তুই তো এমনি ফকির হয়ে গেছিস তোকে আর কি করবো।’

বোনের কথায় খালেদ মোশাররফ হাসলেন। তাহমিদের বাবার হাতটা ধরে বললেন,

‘আমার বাড়ির দুই রত্নের ঠাই হয়েছে তোমার বাড়িতে। আগলে রেখো ভাই। আর কিছু বলার নেই।’

জামান সাহেব খালেদ মোশাররফের হাত ধরে আশস্ত করলেন।

____________________________________________

ফুল সজ্জিত বিছানায় বসে আছে নাযীফাহ। অপেক্ষা তাহমিদের জন্য। কিছুক্ষন বাদে বাদে চোখ বুলিয়ে দেখছে রুমটা। এর আগেও বহুবার সে এই রুমে প্রবেশ করেছে। তখনকার আর এখনকার অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পা গুটিয়ে বসলো সে। ভেবেছে তাহমিদ এসেছে। মাথা তুলে দেখে আমেনা বেগম। এই বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। এই নারী মানে অন্যরকম এক আশ্রয়। এতোটা দিন কি সুন্দর আগলে রেখেছিলো তাকে। আমেনা বেগম কপট অভিমান করে বললেন,

‘এখন তো বর পেয়ে এই বুড়িকে ভুলে যাবি। আর মনেই থাকবে না।’

আমেনা বেগমের অভিমানী কথা শুনে নাযীফাহ মৃদুস্বরে হাসলো।

‘কিছু কিছু মানুষ কারণে অকারণে প্রিয় হয়ে যায়। তুমিও ঠিক তেমন। তোমাকে ভুলে মানে নিজের সাথে অন্যায় করা। আমার আমি কে আমিও এতোটা বুঝি না যতটা তুমি বুঝো। তুমি আমার সেই প্রিয়জন যার সান্নিধ্য আমাকে হাসায়, প্রশান্তি দেয়।

‘পাঁকা পাঁকা কথা আছে।’ বলেই এক লোকমা খাবার নাযীফাহ’র মুখের সামনে ধরলো। নাযীফাহ হতবিহ্বল তাকিয়ে রইলো এই অনন্যময়ী নারীর দিকে। চোখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বারিবিন্দু।

‘বুঝলে কি করে আমার যে খিদে পেয়েছে?’

‘ওই যে বললি না আমি তোর থেকেও তোকে বেশি বুঝি।’

অধর প্রসারিত হলো তার। আমেনা বেগমের হাতে চুমু এঁকে মুখে তুলে নিলো সেই খাবার।

____________________________________________

আমেনা বেগম চলে যেতেই তাহমিদ এলো।

‘এই গরমের মধ্যে আর এসব ভারী পোশাক গায়ে জড়িয়ে রাখতে হবে না। ঢিলেঢালা কিছু একটা পড়েনে। আমি বারান্দায় আছি।’

এসব শাড়ি গহনা ছেড়ে নাযীফাহ একটা সুতি থ্রি-পিস পড়লো। এখন অনেক হালকা লাগছে। এতোক্ষণ মনে হচ্ছিল দম আঁটকে আসছে। নাযীফাহ ডাকলো তাহমিদকে। তাহমিদ রুমে আসতেই নাযীফাহ বলল,

‘সারা গা কেমন কুটকুট করছে। সারা শরীর কেমন পানি পানি করছে। হাত পা ধুইতে পারলে ভালো ছিলো।’

মোটামুটি সবাই ঘুমিয়ে গেছে। তাহমিদ নাযীফাহকে নিয়ে গেলো ওয়াশরুমে। গ্রামে শহরের মতো রুমে রুমে এটাচড ওয়াশরুম নেই। প্রায় মিনিট তিরিশ পরে সে বেরিয়ে এলো।

রুমে এসে ফ্যান চালু দিয়ে বসেছে। প্রচুর গরম লাগছে। তাহমিদ কিছুটা দূরে হাত ভাঁজ করে নাযীফাহকে দেখছে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে তাহমিদ এগিয়ে এলো নাযীফাহ’র কাছে। নাযীফাহ’র হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো নিজের হাতে।

‘জানিস এই একটা রাতের জন্য কত অপেক্ষায় ছিলাম আমি। কত কাতরেছি অপেক্ষা করতে করতে। চোখের পিপাসা মিটানোর জন্য রাতের কতটা সময় তোর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছি তার কোনো ইয়ত্তা আছে?’

বিস্ফোরিত চোখে তাকায় নাযীফাহ। নত মস্তকে মুচকি হাসে তাহমিদ।

‘আমি এমনে ম’রা’র মতো ঘুমাই? একটুও টের পেলাম না?’

এবার নাযীফাহ দিকে তাকিয়ে হাসলো সে।

‘আজ আমার অপেক্ষা শেষ হলো। মিসেস তাহমিদ প্রস্তুত তো তার বেটার হাফের পাগলামি সহ্য করার জন্য?’

লাজুক হাসলো নাযীফাহ।

‘অপেক্ষা এক মিষ্টি যন্ত্রণার নাম। প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেও ভাল্লাগে।’

নিস্তব্ধ পরিবেশ নীরবতায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। কক্ষ জুড়ে ড্রিম লাইটের আবছা আলো।

‘আমি তোকে এতোটা দিন আগলে রেখেছি। হয়তো বা রাখতেও পারিনি। কারণ মানসিক যন্ত্রণার সময় আমি তোর কাছে ছিলাম না। এটাই আমার জীবনের একটা আক্ষেপ। আজকে আমাদের জীবনের স্মরণীয় এই রাতে তোর কাছে আমার এক আবদার আছে।’

প্রশ্ন সূচক চাহনি নিক্ষেপ করে নাযীফাহ।

‘আমি আজকের আমাদের কাছে আসা তোর মাধ্যমে হউক। এতোদিন যাবৎ আমি আমার সকল আবেগ ঢেলে দিয়েছে। আর কিছুই নেই আমার কাছে। ফিরতি হিসেবে আমি কিন্তু তোর কাছ থেকে কিছুই পাইনি। আমি চাই আজ তুই এগিয়ে আসবি আমার দিকে।’

তাহমিদ কহন শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই সমস্ত কায়া কেঁপে উঠলো নাযীফাহ’র। এটাও আদৌ সম্ভব? তাহমিদ কে এতোটা কাছে দেখেই তো তার হাঁটু কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এখন নাকি তাকে আরো কাছে যেতে হবে। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। ত্রপা গ্রাস করলো সর্বাঙ্গ। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। ক্ষনে ক্ষনে মনে হচ্ছে এই বুঝি র’ক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। নিশ্বাস আঁটকে সে মা-রা যাবে।

তাহমিদ পুনশ্চ বলল,

‘নতুবা বুঝে নিবো তুই আমাকে ভালোবাসিস না।এসব তোর মোহ। যা এক সময় কেটে যাবে।’

বিদীর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নাযীফাহ। মুখটা কেমন পাংশুটে হয়ে গেছে। মুখশ্রী নেমে এসেছে নিকষ কালো আঁধারি। নাযীফাহ তাহমিদের অভিমুখে দাঁড়িয়ে পা উঁচু করলো। শার্টের কলার ধরে নিজের উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া দিলো তাহমিদের কপালে। নাযীফাহ কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াতেই আবারও বলল,

‘কোনো ফিল পেলাম না। রেগে চুমু দিয়েছিস নাকি?’

নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মনের অন্তরীক্ষে জমেছে ধূলিজাল। তাহমিদ এগিয়ে গেলো সেদিকে।

‘রাগ করেছিস আমার কথায়’

নিশ্চুপ নাযীফাহ। তাহমিদ দু’হাতে জড়িয়ে নিলো অভিমানী প্রণয়িনীকে। ললাটের মধ্যিখানে চুমু এঁকে বলল,

‘ওই কথা বলেছি বলে তো কত দ্রুত আমার কাছে চলে গেলি।না হলে যেতি নাকি। জড়তার জন্য চুপচাপ বসে থাকতি। এখন জড়তা কে’টে গেছে। ভালো হয়েছে না?’

নাযীফাহ’র গুটিয়ে রাখা হাত দু’টো স্পর্শ করলো তাহমিদের পিঠ।

‘আপনি এমন কেন তাহমিদ ভাই?’

‘ভাই ডাকিস বলে।’

‘আপনিও তো আমাকে তুই বলে ডাকেন।’

‘তুই ভাই বলা ছেড়ে দিলে দেখবি আমিও ঠিক হয়ে গেছি। এখনো নিজেকে তোর ভাই মনে হয়। সেড লাইফ।’

‘নতুন কেউ আসার আগে মনে হয় না এই ভাই ডাকা শেষ হবে?’

‘মেহমান নিয়ে আসার জন্য মিশন শুরু করতে হবে?’

‘বিশের আগে নো বেবি আপনি বলেছেন।’

তাহমিদ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

‘নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেলাম।’

প্রশস্ত হাসলো নাযীফাহ। নাযীফাহকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে তাহমিদ বলল,

‘এবার একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে একটা চুমু দে তো আগেরটা একেবারে নিরামিষ চুমু ছিলো।’

নাযীফাহকে নিসাড়া দেখে তাহমিদ মন খারাপের অভিনয় করে বলল,

‘দে না একটা। এমন করছিস কেন?’

নাযীফাহ শুকনো ঢুক গিলে। তাহমিদের পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে পুনশ্চ চুমু দিলো। ঝাঁকি দিয়ে উঠলো তাহমিদের শরীর।

‘ দেখ দেখ রিলোডেড হচ্ছে আবার আবেগ। এজন্য কারেন্টের মতো শক করলো। এখন আর তোকে এগিয়ে আসতে হবে না। আমিই সকল কাজ করে নিতে পারবো।’

লজ্জায় তাহমিদের বুকে মুখ লুকালো সে। তাহমিদের এই চাহনিতে নাম না জানা মাদকতা আছে। একেবারে ঘায়েল হয়ে যাবে সে। ফিসফিস করে বলল সে,

‘আপনি আমার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ। যেই আবেগের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। অন্তহীন এক ‘হৃদয়াবেগ’। এই বাজে লোকটাকে ভালোবাসি, হুট করে রাগিয়ে দেওয়া লোকটাকে ভালোবাসি, বলিষ্ঠ হাতে অবুঝ মেয়েটাকে আগলে নেওয়া লোকটাকে ভালোবাসি, হারানোর ভয়ে কাতরানো লোকটাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি, ভালোবাসি এবং ভালোবাসি।’

চোখ বুঁজে নিলো সে। শান্তি বিরাজ করছে তার চারিপাশে। অন্তর্দেশে বর্ষিত হচ্ছে প্রেম নামক বর্ষণ। আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে নাযীফাহকে।

‘তুই’ নামক আমার অনুরক্তি, মোহ মায়া যেন দিন গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রবল আকার ধারন করছে। আমার আমিকে আমি চিনতে পারি না।সে বিলীন হয়ে গেছে তোর মাঝে। সবটা জুড়ে শুধু তুই, তুই আর তুই। ‘তুই’ নামক ‘হৃদয়াবেগ’ আমার সেদিনই নিঃশেষ হবে যেদিন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন। যেদিন লব ডব বন্ধ করে হৃদপিণ্ড অবসরে যাবে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে তোর ভাঁজ পড়া হাতটা ধরে রাস্তা পাড়ি দিতে চাই। নাতি নাতনিদের সাথে তোর আর আমার প্রণয়ের গল্প করতে চাই। তোর সাথে বাঁচতে চাই হাজার বছর।

__________________সমাপ্ত____________________