#অরণ্যে_রোদন
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৩
শ্রাবণ বাসায় গিয়ে তূবাকে মিসকল দিলো। তূবা মনে মনে বলল,
‘কেমন ফহিন্নি মার্কা ছেলে, সত্যি সত্যি মিসকল দিলো? করব না কল। যা পারে করুক গিয়া। বান্দর একটা!’
তূবা ফোনটা রেখে শুয়ে পড়ল। আর এদিকে শ্রাবণ অধির আগ্রহে তূবার কলের অপেক্ষা করতে লাগল। পর পর তিন চারটা মিসকলও দিলো কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। শ্রাবণকে রুমে পায়চারি করতে দেখে বর্ষণ বলল,
‘কিরে কী হয়েছে? এত রাতে এমন করে হাঁটছিস কেন? তা-ও আমার রুমে এসে।’
‘তোর রুমে পড়তে ভালো লাগে।’
‘তাহলে হয় পড় না হয় এসে শুয়ে পড়। তোর জন্য আমার ঘুমে ব্যঘাত ঘটছে। সকালে আমার অফিস আছে।’
‘ভাই তোর ফোনটা দে।’
‘কেন?’
‘দে তারপর বলছি।’
‘পাশেই রাখা। কথা বললে বাইরে গিয়ে, রুমের লাইট নিভিয়ে যা। আমাকে প্লিজ ঘুমাতে দে।’
শ্রাবণ ফোন নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল। তারপর তূবাকে কল করল। ঘুম ঘুম চোখে তূবা ফোনটা হাতে নিয়ে বর্ষণের ফোন নাম্বার দেখে খানিক অবাক হলো। কল রিসিভ করে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’
শ্রাবণ কঠিন গলায় বলল,
‘ঐ কল দাওনি কেন?’
‘ওহ তুই? একবার অবশ্য মনে হয়েছিল, এত রাতে বর্ষণ ভাইয়া কেন কল করবে? তুই-ই তার ফোন থেকে কল করছিস। তারপর ভাবলাম তিনিও কল করতে পারেন।’
‘তূবা।’
‘আপু ডাক।’
‘তোমার ঘুম ঘুম কণ্ঠটা জাস্ট খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে, এমন সুন্দর।’
‘ফাও প্যাচাল না পুটে যা বলার, বল।’
‘তুমি, না বললা আমাকে বুঝাবা?’
‘কী বুঝাবো?’
‘এই প্রেম, ভালোবাসা? ইত্যাদি, ইত্যাদি।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তূবা বলল,
‘শ্রাবণ, শোন আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। আমাকে আজ আর প্লিজ বিরক্ত করিস না। আমি নিজে ডেকে তোকে বুঝিয়ে দিব। তার আগ পর্যন্ত তুই আমার চোখের সামনেও পড়বি না।’
মন খারাপ করে শ্রাবণ বলল,
‘কবে ডাকবে?’
‘পরশু ভার্সিটিতে বসে বলব। দুটো দিন অন্তত আমাকে শান্তি দে। গত কয়েকদিন যাবত তোর অত্যাচারে আমার ঘুম ক্লিয়ার হয় না। সারাক্ষণ মাথা যন্ত্রণা থাকে।’
শ্রাবণ বিষন্ন কণ্ঠে বলল,
‘ওকে।’
শ্রাবণ কল কাটার পর বর্ষণের ফোনে নীরার কল আসল। শ্রাবণ ফোন নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ভাইয়া, ভাবি কল করছে।’
‘রিসিভ করে বল, ঘুমাচ্ছি। সকালে কল দিব।’
‘ভাইয়া তুই তোর বউ এর কল এভাবে ইগনোর করছিস?’
‘হুঁ করছি।’
‘কেন?’
‘কারণ ও ম্যাচিওর, তোর মতো বলদ না। ও বুঝবে কেন ইগনোর করেছি।’
‘প্রেমিকা আর বউয়ের কল রিসিভ না করা, রীতিমতো বড় ধরণের ক্রাইম।’
‘তবে তুই রিসিভ করে কথা বল।’
শ্রাবণ কল রিসিভ করে বলল,
‘ভাবি, ভাইয়া কোন মেয়ের সাথে যেন কথা বলছে, সে কারণে তোমার সাথে কথা বলবে না বলছে।’
বর্ষণ লাফ দিয়ে উঠে ফোনটা নিয়ে বলল,
‘নীরা, ও মিথ্যা বলছে।’
নীরা হেসে বলল,
‘ফোন স্পিকারে দাও।’
বর্ষণ ফোন স্পিকারে দেওয়ার পর নীরা বলল,
‘দেবর মশাই, এই কথায় আমার সাথে আর তোর ভাইয়ার সাথে প্যাচ লাগবে না। আমি তোর ভাইকে গত দশ বছর যাবত চিনি। এত সহজে তো আমাদের মাঝে প্যাচ লাগানো যাবে না ভাইটি। একবার বিয়ের অনুষ্ঠানটা হোক তারপর তোর কান আমি ছিড়ে নিব।’
শ্রাবণ হেসে বলল,
‘আরে ভাবি চ্যাতো কেন? তোমার সাথে মজা করমু না তো কার সাথে করমু?
রাত দুইটা,
শ্রাবণ, তূবার ফোনে কল করল। তূবা ঘুম ঘুম চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে কল রিসিভ করে বলল,
‘ভাই, তোর সমস্যা কী? কেন টর্চার করছিস?’
‘জানালা খোলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি।’
তূবার ঘুম পুরো উড়ে গেল। শোয়া থেকে বসে জানালার কাছে গেল। জানালা না খুলেই বলল,
‘হুম বল।’
‘জানালা খোলো প্লিজ।’
তূবা ভয়ে জানালা খুলল। খুলে দেখল শ্রাবণ দাঁড়িয়ে হাসছে। তূবা প্রচন্ড রাগ করে বলল,
‘ফাজিল ছেলে, আবার কেন আসছিস?’
‘তুমি, না দুদিন দূরে থাকতে বললে সে জন্য আজ একটু দেখতে আসলাম।’
‘তা বলে এই রাত দুটোর সময়? তোরে কি ভূতেও ধরে না?’
‘আমার সাথে, শরীর বন্ধকের তাবিজ আছে। ভূতে ধরবে না। এই কোমরে দেখবা?’
‘তোর কোমর দেখে আমার কি কাজ? চিংড়ি মাছের মতো চিকনা তুই।’
‘শোনো আমি কুচো চিংড়ি না। আমি হলাম বড় জাতের শলা চিংড়ি। ভীষণ সুস্বাদু।’
‘তুই, কি মাছের প্রজাতির কেউ নাকি?’
‘কেন?’
‘সেদিন বললি ইলিশ মাছ, আজ বলছিস চিংড়ি মাছ। তোরে নিশ্চিত মেছো পেত্নীতে পেয়েছে।’
‘আয় হায় কী বলো?’
‘সত্যি বলছি।’
‘আমার তো মনে হয়, আমাকে ভালোবাসার পেত্নীতে পেয়েছে। আর এটা এমন পেত্নী যে অন্য কোনো পেত্নী ধারে কাছে আসতে দেয় না।’
‘আর কিছু বলবি?’
‘কেন?’
‘আমার ঘুম পাচ্ছে।’
‘আমি রাত দুইটা বাজে ভূত, পেত্নী উপেক্ষা করে তোমার কাছে আসলাম আর তুমি ঘুমাবে?’
‘আমি তোকে আসতে বলছি? নিজে নাচতে নাচতে আসছিস আবার নাচতে নাচতে চলে যা।’
‘পাথর মনের নারী। তোমার মনে দয়ামায়া নেই?’
‘না নেই। যা ভাগ।’
শ্রাবন মুখ কালো করে বলল,
‘সত্যি চলে যাবো?’
তূবা, শ্রাবণের মুখের উপর জানালা বন্ধ করে দিলো। শ্রাবণ বিড়বিড় করে বলল,
‘কী করে বুঝাই বলো তোমায়?’
৫!!
‘কথা, দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
‘একটু ওয়েট। পাঁচ মিনিট আসছি।’
নিহাদ জুতা পরতে পরতে বলল,
‘এত লেট করলে চলে বলো? তোমার ক্লাস আজ নয়টা পয়তাল্লিশে। আমারও তখন। অলরেডি নয়টা সতেরো বাজে।’
কথা তাড়াহুড়ো করে এসে বলল,
‘আমি তৈরি। চলো।’
নিহাদ, কথার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আজ হঠাৎ শাড়ি পরলে যে?’
‘এমনি ইচ্ছা হলো। কেন ভালো লাগছে না?’
নিহাদ, কথার কপালে চুমো খেয়ে বলল,
‘মিষ্টি লাগছে। তবে তুমি ভার্সিটিতে শাড়ি পরে না গেলেই বেশি খুশি হবো।’
‘কেন?’
‘শাড়িতে তোমায় এত সুন্দর লাগে, তখন ভয় হয় যদি কারও নজর পড়ে যায়।’
কথা হেসে বলল,
‘নজর তো একজনার পড়েই আছে সেই কবে থেকে।’
নিহাদ, কথাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মাঝে মাঝে ভাবি, আমার তোমাকে এত কেন ভালোবাসতে ইচ্ছা করে।’
‘নিজের বউকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করবে না তো কাকে করবে?’
নিহাদ, কথাকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলল,
‘সরি কথা। আমি এক বিশাল বড় ঝামেলায় খুব বাজে ভাবে ফেঁসে আছি। সেখান থেকে কিছুতেই বের হতে পারছি না। তোমাকে বললে তুমি হয়তো সহ্য করতে পারবে না। সে জন্য সরি কথা, সরি, লক্ষ কোটিবার সরি।’
কথা বলল,
‘এখন দেরী হচ্ছে না।’
নিহাদ লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘তোমাকে যখন জড়িয়ে ধরি, আমার বুকের ভিতরটায় এত শান্তি লাগে, সারাক্ষণ মনে হয় জড়িয়ে ধরে রাখি।’
কথা চুমো খেলো নিহাদের বুকে। তারপর বলল,
‘চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
বাইকে বসে কথা বলল,
‘ভার্সিটি থেকে আসার সময় আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাব।’
‘কেন?’
‘এমনিই। কদিন হলো তাকে দেখি না। আজ রাতে থাকব কিন্তু সেখানে।’
‘আমি যাব?’
‘হ্যাঁ, তুমি না গেলে মা রাগ করবেন। আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?’
‘তোমার ক্লাস শেষ কয়টায়?’
‘আজ তো মাত্র দুটো ক্লাস। এগারোটার মধ্যে শেষ।’
‘আমার তো একটা পর্যন্ত।’
‘ওহ। তাহলে তুমি বরং ক্লাস শেষ করে এসো, একসাথে লাঞ্চ করব।’
‘আচ্ছা। আমার কিন্তু বিকালে টিউশন আছে।’
‘আমি জানি। তুমি টিউশন পড়িয়ে রাতে কিন্তু আমাদের বাড়ি যাবে। আবার ভুলে বাসায় যেও না।’
‘বউ যেখানে থাকবে আমারও সেখানে যেতে হবে।’
কথা হেসে বলল,
‘সামনে তাকিয়ে চালাও।’
কথাকে গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে নিহাদ বাইক পার্ক করতে গেল। তখন কথার, সমানে সিনথিয়া আসল। নিহাদও বাইক পার্ক করে কথার কাছে আসল। সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে নিহাদ খানিক অস্বস্তিতে পড়লেও, নিজেকে সামলে বলল,
‘কথা, আমি যাচ্ছি। তুমি ক্লাসে যাও।’
‘আচ্ছা।’
নিহাদ যেতেই সিনথিয়া বলল,
‘তো নিহাদ স্যার আর তুই স্বামী-স্ত্রী?’
‘হ্যাঁ।’
‘কই আগে তো বলিসনি কখনও?’
‘এটা বলার কী আছে? আমার বন্ধুমহলের সবাই জানে। আমার তো মনে হয় পুরো ক্লাস জানে, শুধু আমার সামনে বলে না এই যা।’
‘কতদিন তোদের বিয়ে বয়স?’
‘প্রায় চার বছর।’
‘এখনও বাচ্চা নিসনি? নাকি হয় না?’
সিনথিয়ার এ কথাটা খুব গায়ে লাগল কথার কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বলল,
‘নিহাদ বলেছে, গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পর বেবি নিবে।’
‘ওহ। তোকে নিশ্চয়ই পড়ালেখায় খুব হেল্প করে।’
‘তা তো করেই।’
‘ওহ। নিশ্চয় পরীক্ষার আগে প্রশ্নও দেয়?’
কথার এবার মেজাজ খারাপ হলো। বেশ রাগি কণ্ঠে বলল,
‘এগুলা কেমন কথা সিনথিয়া? পৃথিবী শুধু আমরা একমাত্র কাপল না, যারা স্যার ছাত্রী। হাজারো আছে। সব স্যাররা কী তাদের স্ত্রী কিংবা স্বামীদের প্রশ্ন দেয়? তাছাড়া সবাই ভালো করে জানে নিহাদ ওর পেশার প্রতি কতটা সৎ।’
সিনথিয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘মানুষটা সৎ তো?’
কথা বেশ রাগী কণ্ঠে বলল,
‘সিনথিয়া কথাবার্তা সাবধানে হিসাব করে বলবি। নিজের লিমিটে থাকবি। নিহাদকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে তুই ভাবতেও পারবি না তোকে কী করব।’
কথা মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ করে ক্লাসে চলে গেল।
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৪
৬!!
আজ তূবা, শ্রাবণকে কি কি প্রশ্ন করবে তার যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে আজ শ্রাবণ যা-ই বলুক মাথা গরম করবে না। ঠান্ডা মাথায় ওকে বোঝাবে। ও ছোটো মানুষ কত-ই বা বয়স কেবল উনিশ বছর। এ বয়সে ছেলে মেয়ে এমন ভুল করে। তাকে রাগারাগি করে কোনো লাভ হবে না। তাকে বুঝাতে হবে শান্ত ভাষায়। আজ ঠান্ডা মাথায় কথা বলে দেখুক ছেলেটাকে বোঝাতে পারে কি না।শ্রাবণ, তূবার সামনে এসে বলল,
‘কথা আপু কই?’
‘তোর বোন, দুলাভাই একজনও কলেজে আসেনি আজ।’
‘ও হ্যাঁ, আপুর তো রাত থেকে হালকা জ্বর। সে কারণে ভাইয়াও ওর দেখাশোনা করার জন্য ছুটি নিয়েছেন।’
‘হুম জানি।’
ক্যাম্পাসে ঘাসের উপর তূবা আসন পেতে বসল। শ্রাবণ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তূবা চোখের ইশারায় ওকে বসতে বলল। শ্রাবণ পাশে বসতেই তূবা বলল,
‘দূরত্ব বজায় রাখ।’
ভদ্র ছেলের মতো শ্রাবণ দূরে গিয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
‘এখন আগে বল, তুই কি সত্যি আমার প্রেমে পড়েছিস নাকি মাস খানিক যাবত এমনি বিরক্ত করছিস?’
‘সত্যি প্রেমে পড়েছি।’
‘আমরা ছোটোবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি, আগে কখনও তোর চোখে আমার জন্য অন্য কোনো অনুভূতি দেখিনি। তবে হঠাৎ এমন কী হলো যে তোকে আমার প্রেমে পড়তে হলো?’
‘সব দোষ তোমার?’
‘কেন?’
‘তুমি দেখতে এত সুন্দর হলে কেন?’
‘সুন্দর বলে ভালোবেসে ফেললি?’
‘না তো।’
‘তাছাড়া সুন্দর কি আগে ছিলাম না?’
‘তুমি বরাবরই সুন্দর।’
‘তাহলে সুন্দর দেখে প্রেমে পড়লি? এমন সস্তা রিজন দিবি?’
‘উহুঁ। তোমার সবটা আমার ভালোলাগে, স্পাসিফিক কিছু নেই। আর সুন্দর অসুন্দর তো পরের ব্যাপার।’
‘সেই ভালো লাগাটা কবে থেকে শুরু হলো?’
‘পাঁচ মাস আগে। বর্ষণ ভাইয়ার আকদের পরের দিন থেকে।’
‘কেন?’
‘মনে আছে বর্ষণ ভাইয়া আর নীরা ভাবির আকদের পরের দিন, আমরা ছোটোরা মিলে, ছোটো একটা পার্টির আয়োজন করেছিলাম।’
‘হ্যাঁ! তো?’
‘সেদিন তুমি শাড়ি পরেছিলে?’
‘তো শাড়ি পরা দেখে ভালো লেগেছে?’
‘না। শাড়ি তো তুমি পূর্বেও বহুবার পরেছিলে। তবে সেদিন গ্রাম্য স্টাইলে শাড়ি পরেছিলে। তুমি, কথা আপু এবং তোমার বান্ধবীরা। সবাই একই রকম করে শাড়ি পরেছিলে।’
‘হ্যাঁ তো?’
‘সেদিন তোমাকে দেখতে হুবহু নায়িকা শাবনূরের মতো লেগেছিল। তুমি মানো বা না মানো তোমার চেহারা শাবনূরের সাথে ম্যাচ করে। সেই ফোলা ফোলা গাল, ডাগর ডাগর বড় চোখ, ভ্রু গুলো কেমন কালো চিকন, নাকটা পারফেক্ট সব মিলিয়ে তোমাকে এত সুন্দর লাগছিল যে আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। তোমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। পুরোটা সময় আমি তোমার আশে পাশে ঘুরঘুর করে তোমাকে দেখেছি। কেন জানি আমার ঘোর লেগে গেছিল। মনের মাঝে এমন অদ্ভুত অনুভূতি পূর্বে কখনও হয়নি।
ঘটনা এ পর্যন্ত থামতে পারত কিন্তু সমস্যা হলো রাতে ঘুমানোর পর। চোখ বন্ধ করেই তোমাকে নিয়ে এক ঝাক স্বপ্ন দেখলাম। আর প্রতিটা স্বপ্নে আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছো, কপালে চুমু খেয়েছো। এই স্বপ্ন শুধু এক রাতে না, প্রতি রাতে দেখি। আমি চোখ বন্ধ করতে পারি না। তোমার মুখটা চোখের সামনে ভাসে। রাতের পর রাত র্নিঘুম পায়েচারি করে কাটাই। আবার দিনের বেলা, যখন ভার্সিটিতে থাকি না তখন তোমাকে দেখার নেশায় বারবার চোখ বন্ধ করে থাকি। তোমার মুখটা এত পবিত্র লাগে। আমার সবসময় মনে হয়, তোমাকে সামনে বসিয়ে রেখে সারাদিন দেখি। তো দোষ কার?’
তূবা বিস্ফরিত চোখে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল,
‘অসভ্যটা বলে কী?’
শ্রাবণ আবার বলল,
‘তুমি দেখতে যেহেতু শাবনূরের মতো, আমি তোমার রিয়াজ হতে চাই। আমি দেখতে কিন্তু রিয়াজের চেয়ে কোনো অংশে কম না। ফর্সা, সুন্দর, লম্বা, স্বাস্থ্যও খারাপ না।’
শ্রাবণের এবারের কথায় তূবা হেসে ফেলল। হেসেই,
‘তারপরও দেখতে তোকে বাচ্চাদের মতো লাগে। ঠিকমতো দাঁড়ি গোফ গজায়নি আসছে নিজের চেয়ে তিন বছরের বড় মেয়ের সাথে প্রেম করতে।’
‘মোটেও তিন বছর না। দুই বছর সাত মাস। আর শোনো মাত্র তিন মাসের মধ্যে দাঁড়ি গোফে ভরিয়ে ফেলব। আজকে থেকে সপ্তাহে দুইবার তিনবার শেভিং করব। দেখবা তিন মাসের মধ্যে দাঁড়ি উঠিয়ে আঙ্কেল হয়ে যাব। তখন তোমার চেয়েও বড় লাগবে। লম্বায় তো এমনিও আমি তোমার চেয়ে বড়।’
‘তো শোনেন রিয়াজ সাহেব, চেহারায় বড় দেখালেই তো হবে না, বয়সেও বড় হতে হবে। আপনি রিয়াজ হতে চাইলেই তো হতে পারবেন না। আর শাবনূরের সাথে কেবল একা রিয়াজকে মানায় না, ফেরদাউস, শাকিব খানকেও বেশ মানায়। সো আমি বরং আপনাকে বাদ দিয়ে ফেরদাউস বা শাকিব খান খুঁজে নিব। আপনি প্লিজ নিজের লেভেলের মানে বয়সের কাউকে খুঁজে নিন।’
‘তুমি কি আমাকে প্রত্যাখান করলে?’
‘এতদিন কি বরণ করেছি?’
‘দেখো শাবনূরের সাথে রিয়াজকে যেমন মানায় তেমন কাউকে মানায় না। বিশ্বাস না হলে ওদের সব মুভি দেখো। বিশেষ করে “ও প্রিয়া তুমি কোথায়” মুভিটা দেখো। সেখানে শাবনূর, রিয়াজ, শাকিব সবাই আছে। মিল কিন্তু রিয়াজের সাথে হয়। শাকিব মারা যায়।’
তূবা হেসে বলল,
‘এদিকে এগিয়ে বস। কাছে আয়।’
শ্রাবণ খুশি মনে কাছে আসল। তূবা ওর মাথায় চুলে নিজের আঙুল বুলালো। তারপর গালে হাত দিয়ে বলল,
‘আমি তোকে সে নজরে কখনও দেখিনিরে। একটু বোঝার চেষ্টা কর। তুই আমার কাজিন। তা-ও বয়সে অনেক ছোটো। তোকে সে নজরে কী করে দেখি বল? জীবন আর মুভি তো এক নয়। মুভিতে অবাস্তব অনেক কিছু হয়। বাস্তবে হয় না।’
শ্রাবণ বেশ অভিমান করে বলল,
‘বাস্তব মুভির চেয়েও বেশি নাটকীয়। এসব মুভি টুভি বাদ দাও। আমাদের ইসলামে কী বড় মেয়েকে বিয়ে করা নিষেধ?’
‘না।’
‘মহানবী আর মা খাজিদার বয়সের পার্থক্য জানো?’
‘একটা থাপ্পর দিব। প্রেম নামক ফালতু বিষয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটাকে টানলে। তিনি তোর মতো বেহায়া ছিলেন না। তিনি মা খাদিজার পিছনে বেহায়ার মতো ঘোরেননি। বরং মা খাদিজা তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর খবরদার এসব প্রেম টেমে ধর্ম কিংবা নবীকে টানবি না।’
‘ভালোবেসে যদি একটু বেহায়া হতে না পারি তবে কী ভালোবাসলাম বলো?’
শ্রাবণের এ কথাটা তূবার ভালো লাগলেও নিজের চেহারায়র ভাবমূর্তি একটুও পাল্টালো না। কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘যদি বেহায়া হোস, মহা মানবদের উদাহরণ দিস তবে তাদের করা কাজের ১% কাজ তুই করে দেখা। তারপর তোর ভালোবাসাকে রিয়াল ভাবব।’
‘কী করতে হবে, বলো?’
‘যা তোর পরিবারকে গিয়ে আমাদের কথা বল। তাদের বল আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে। পারলে আমার পরিবারকে রাজী করা। যদি তা করতে পারিস তবে কথা দিচ্ছি তোর হয়ে যাব। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে যতটা ভালোবাসে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসবো। তুই যা বলবি তা-ই করব। পারবি নিজের পরিবারকে জানাতে? পারবি আমার পরিবারকে রাজী করাতে? বল?’
শ্রাবণ মাথা নিচু করে রইল। তূবা আবার বলল,
‘কী সব হিরোগিরি শেষ? বেলুনের বাতাস যেমন ফুস করে বের হয় তেমন ফুস! তোদের ছেলেদের প্রেমের পর কী ধান্ধা থাকে আমি জানি না ভাবছিস। তোরা ছেলেরা প্রেম করবি কিন্তু বিয়ের বেলায় যত বাহানা। আর তোদের বয়সী ছেলেরা বয়সে বড় মেয়েদের কেন পছন্দ করে, আমি জানি না ভেবেছিস?’
‘কেন পছন্দ করে?’
‘একটা অল্প বয়সী মেয়েকে পছন্দ করলে তাদের সবকিছু বুঝিয়ে তার সাথে ফিজিক্যালী অ্যাটাচ হতে ছেলেদের অনেক সময় লাগে কিন্তু বয়সে মেয়েটা বড় হলে, এমনি ম্যাচিওর হয়। তোরা ভাবিস তার সাথে দ্রুত ফিজিক্যালি অ্যাটাচ হতে পারবি। শোন ছেলেদের এসব টেকনিক আমি বহু আগে থেকে জানি।’
শ্রাবণ আটকানো কণ্ঠে বলল,
‘তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। আমি তেমন কিছু ভাবনি।’
‘আচ্ছা তাহলে আগে তোর পরিবারকে রাজি করা তারপর কথা বলতে আসিস। ভেবেছিলাম তোকে সুন্দর করে বুঝাবো কিন্তু তুই সুন্দরের ভাষা বুঝিস না। কুকুরের লেজের মতো। জীবনে সোজা হবি না।’
শ্রাবণ সিক্ত কণ্ঠে বলল,
‘তুমি আমাকে এতটা নিকৃষ্ট ভাবো যে কুকুরের সাথে তুলনা করলে?’
‘তুলনা করার মতো চান্স কি তুই দিসনি?’
তূবা আর কোনো কথা বলল না। রাগে হনহন করে চলে গেল। শ্রাবণ ওখানেই বসে রইল। ওর গাল বেয়ে ঘাসের উপর টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।’
৭!!
কথার জ্বরটা আরও বেড়েছে। নিহাদ ওর মাথায় পানি দিয়ে শরীরটা মুছিয়ে দিয়ে বলল,
‘বেশি খারাপ লাগছে?’
কথা নিহাদের বুকে মাথা রাখল। নিহাদ কথার কপালে চুমো খেয়ে বলল,
‘বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও বৃষ্টিতে কেন ভিজলে? তুমি ঠান্ডা তেমন সহ্য করতে পারো না, তা-ও ভিজলে কেন?’
কথা চুপ করে রইল। নিহাদ বলল,
‘নিজের একটু তো খেয়াল রাখবে। এখন কেমন জ্বরে ছটফট করছো।’
‘মাথাটা ঘুরাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘর, ঘরের দেয়াল, ছাদ সব ঘুরছে।’
‘একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। দেখবে ভালো লাগবে।’
নিহাদ, কথাকে শুইয়ে দিয়ে ওর মা মোমেনাকে কল করল,
‘হ্যালো, মা।’
‘কিরে কেমন অাছিস? কথা কেমন আছে?’
‘আমি ভালো আছি। কথার রাত থেকে খুব জ্বর।’
‘সে কিরে কাল রাত থেকে মেয়েটার জ্বর আর তুই এখন জানাচ্ছিস?’
‘তোমরা কবে আসবে?’
‘তোর দাদির শরীরটা এত খারাপ যে চেয়েও আসতে পারছি না।’
‘কথারও জ্বর। জ্বরে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না।’
‘দুপুরে কী খেয়েছিস?’
‘ভাত আর আলুভর্তা করেছিলাম সেটাই খেয়েছিস।’
‘তাহলে কথাকে নিয়ে ওদের বাসায় চলে যা। আমি তো আরও তিন চারদিনে আসতে পারব না। মেয়েটা জ্বরে কষ্ট পাবে। বেয়ান বরং তোর চেয়ে ওর ভালো কেয়ার করতে পারবে। এবার তোর দাদিকে একবারে নিয়েই আসব।’
‘তোমার বেয়ানও তা-ই বলেছিলেন, কথাকে নিয়ে যেতে।’
‘আচ্ছা চলে যা। আগে ওকে ডাক্তার কাছে নিয়ে যা।’
‘আচ্ছা।’
‘কথাকে দে একটু কথা বলি।’
নিহাদ ফোনটা কথাকে দিলো। কথা সালাম দিলো,
‘আসসালামু আলাইকুম, মা।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী ব্যাপার সোনামা, রেখে আসলাম মাত্র ক’দিন হলো এর মধ্যে জ্বর বাঁধালি?’
‘একটু ঠান্ডা লাগল।’
‘ঐ পাজিটা কাজ টাজ করে কিছু? নাকি সব তোকে দিয়ে করায়?’
‘সব কাজ আমাকে দিয়ে করায়। কিছু করে না মা।’
‘ফোনটা স্পিকারে দে। ছাগলটাকে ঘাস খাওয়াই।’
কথা ফোন স্পিকারে করল। মোমেনা বলল,
‘নিহাদ, ঐ ছাগল তুই কথাকে কাজে হেল্প করিস না কেন?’
‘ও মিথ্যা বলছে মা। আমি হেল্প করি ওকে। তাছাড়া সারাদিন তো বাসায় সময় পাই না।’
‘তা পাবি কেন? অনেক বড় মাস্টার হয়ে গেছিস না? বাবার মতো হয়েছিস কামচোর।’
‘বাবাকে কেন টানছো এর মধ্যে?’
‘একশোবার টানবো। কী করবি তুই আর বাপ?’
‘আমরা কী করব? নীরিহ দুই পুরুষ তোমাদের দুজনার হাতে বন্দী।’
‘কী বললি?’
‘নাহ কিছু না।’
‘তোর শাস্তি হচ্ছে এখন পুরো ঘর দুইবার মুছবি।’
‘পারব না।’
‘তুই পারবি তোর বাপও পারবে।’
চলবে…