#অরণ্যে_রোদন
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৫
‘দেখো মা, তুমি আর কথা মিলে আমার আর বাবার উপর খুব অন্যায় করো।’
‘আসছে অামার ন্যায় অন্যায়কারী জজ সাহেব। ঘর মুছে ফোন দিবি। আর আগে কথাকে আদা, লবঙ্গ, দারুচিনি দিয়ে ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে দিবি। শোন চায়ে চিনি দিবি না, মধু দিবি। মেয়েটার গলা একদম বশে গেছে। কেমন খুকখুক করে কাশছে। মনে হচ্ছে বুকে কফ জমে গেছে।’
‘তোমরা শাশুড়ি, বউ মিলে তো ভালো যন্ত্রণা দিচ্ছো।’
‘চুপ। বউকে ভালোবাসতে না পারলে খেয়াল রাখতে না পারলে সে আবার কেমন পুরুষ?’
‘ওর জন্য আজ আমি ভার্সিটিতে পর্যন্ত যাইনি। আজকে পাঁচটা ব্যাচ ছিল কোচিং-এ, তাদের ফোন করে বলেছি, আজ পড়াব না।’
‘বড় উদ্ধার করেছেন। নিহাদ শোন, তোর সাত পুরুষের ভাগ্য ভালো কথার মতো এমন মিষ্টি একটা মেয়েকে জীবন সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিস।’
‘তুমি তো সবসময়ই ওর দলের লোক। মাঝে মাঝে মনে হয় ও তোমার মেয়ে আর আমি তোমার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে।’
মোমেনা হেসে বলল,
‘জানিস বাবা, একটা মেয়ের দুনিয়া থাকে স্বামী। বিয়ের পর সে তার স্বামীর মাঝেই পৃথিবীটা খুঁজে নেয়। তো স্বামীর কি দায়িত্ব না এই ভালোবাসাটাকে আগলে রাখা? তোর কাছে আমার সবসময় একটাই চাওয়া থাকবে কথাকে খুব ভালোবাসবি, ওর সাথে কখনও অন্যায় করবি না।’
নিহাদ কল কেটে মনে মনে বলল,
‘অন্যায় তো করে ফেলেছিই। মস্ত বড় অন্যায়।’
নিহাদ, কথার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ভালোবাসি তোমায়।’
‘আমিও। এখন মা যেমন করে চা বানাতে বললেন তেমন করে চা বানিয়ে আনো।’
‘ওকে মহারাণী।’
নিহাদ চা বানাচ্ছে। তখন সিনথিয়ার কল আসল। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে নিহাদ কল রিসিভ করে বলল,
‘সময় অসময় কল করতে নিষেধ করেছি।’
‘আজ কলেজে আসলে না কেন?’
‘এই বেয়াদব মেয়ে, তোমাকে না বলেছি আমাকে তুমি করে বলবে না। শিক্ষকের সাথে বেয়াদবের মতো কথা বলো।’
সিনথিয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘শিক্ষক কী করেছে তা বোধ হয় ভুলে গেছে। মনে করিয়ে দিব?’
নিহাদ কিছু সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল,
‘কী জন্য কল করলে?’
‘কলেজে আসলেন না তাই।’
‘কথার খুব জ্বর। ওর খেয়াল রাখছি।’
‘ছোটো বাচ্চা তো না। নিজের খেয়াল রাখতে পারে।’
‘কথাকে নিয়ে ঠিকভাবে কথা বলবে। নয়তো থাপড়ে দাঁত ফেলে দিব।’
‘আপনি আমাকে আগে বলেননি কেন কথা আপনার স্ত্রী?’
‘এটা না জানার মতো তো কিছু না। আমাদের জানামতে ভার্সিটির অনেকেই জানে। আর কথার ক্লাসের তো সবাই-ই জানে। তুমি জানতে না, সেটা তোমার ভুল। আমার না।’
‘আপনার বলা উচিত ছিল।’
‘আমি বিবাহিত সেটা তো জানতে? তো আমার স্ত্রী কে সেটা ফ্যাক্ট না। মূল কথা হচ্ছে আমি বিবাহিত পুরুষ। ভুল তুমি করেছো। তোমার কারণে আমাকে এখন প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে মরতে হচ্ছে।’
নিহাদ কলটা কেটে দিলো। এই একটা মেয়ের সাথে কথা বললেই ওর রাগ লাগে। ঘৃণা করে ও সিনথিয়াকে। প্রচণ্ড ঘৃণা। ঐ একটা মেয়ের জন্য ওর মনে এত ঝড়। সবসময় ভয়ে থাকে কথাকে না হারিয়ে ফেলে। নিহাদ চায়ের মগ কথার হাতে দিয়ে বলল,
‘অন্য কিছু খাবে? বিস্কুট বা ফল?’
‘উহুঁ। একটু পাশে বসো।’
নিহাদ পাশে বসার পর কথা ওর বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলল,
‘এই বুকটায় এত শান্তি আমার। পুরো পৃথিবীর বদলেও এ শান্তি আমি কাউকে দিব না। কাউকে না।’
নিহাদ, কথায় মাথায় গাঢ় চুমু খেলো।
৮!!
রাত দশটা,
শ্রাবণ চুপচাপ টেবিলে বসে ভাতে নড়াচড়া করছে। আজ ওর পছন্দের গরুর মাংস হয়েছে, তা-ও ও চুপচাপ বসে আছে। কথা প্লেটে অল্প একটু ভাত নিয়ে ডাল আর আমের আচার দিয়ে খাচ্ছে। জ্বরের কারণে মাংস তেতো লাগছে। নিহাদ, বর্ষণও স্বাভাবিকভাবে খাচ্ছে। কথার মা, শ্রাবণী বলল,
‘কিরে শ্রাবণ খাচ্ছিস না কেন?’
শ্রাবণ ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মা, আমি বিয়ে করব।’
কথাটা শুনে কথা বিষম খেয়ে নাকে মুখে ভাত, ডাল উঠিয়ে ফেলছে। কাশতে কাশতে প্রাণটা যায় যায় অবস্থা। নিহাদ, শ্রাবণী, কথার বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে পানিয়ে খাইয়ে অনেকক্ষণ পর স্বাভাবিক করল। শ্রাবণী, শ্রাবণের কাছে এসে ধমক দিয়ে বলল,
‘সবসময় উল্টা পাল্টা কথা। দেখছিস মেয়েটার কত জ্বর। সারাদিন কিছু খেল না। মাত্র একটু ভাত খেতে নিলো, দিলি তো মেয়েটার খাওয়া বন্ধ করে।’
শ্রাবণ কঠিন চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কথা সাথে সাথে বলল,
‘ও তো এমনই। আরে বোকা আমার চার বছরের চাচাতো ননদকে তো তোর জন্য ঠিক করেই রাখছি। সে-ও বড় হোক, ততদিনে তুইও সেটেল হ তারপর দুজনার চার হাত এক করে দিব।’
শ্রাবণ কিছু বলতে যাবে ওমনি কথা ধমক দিয়ে বলল,
‘শ্রাবণ চুপচাপ খা বলছি। খেয়ে আমার রুমে আসবি তোর সাথে জরুরি কথা আছে তোর ভাইয়ার।’
কথা টেবিলের নিচ দিয়ে নিহাদকে খোঁচা মারল। নিহাদ বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সত্যি বলতে ভুলে গেছিলাম। আগে ভাত খা। তারপর আমার রুমে আয়।’
শ্রাবণ, কথার দিকে তাকাতেই কথা চোখ বড় করে তাকাল। এবার শ্রাবণ কিছু বুঝে চুপ হয়ে গেল। কথা আর খেল না। রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শরীরটা এত খারাপ লাগছে যে বিছানা ছাড়া চোখের সামনে কিছু দেখছে না। নিহাদ রুমে এসে বলল,
‘বেশি খারাপ লাগছে?’
‘হুম। মাথাটা ভার হয়ে যাচ্ছে।’
নিহাদ কপালে হাত দিয়ে বলল,
‘হুম জ্বরটা বাড়ছে। ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ো, দেখবে সকালে ভালো লাগবে।’
‘আগে গাধাটা আসুক ওর সাথে কথা আছে।’
‘তূবার সাথে নিশ্চয়ই ঝামেলা হয়েছে।’
‘সেটা তো হবেই। তূবা আর ওর কি যায় বলো?’
‘এই ছেলেটা দেখছি বড্ড জ্বালাতন করছে।’
‘সন্ধ্যার পর তূবা কল করেছিল। ও যাতে তূবার পিছন ছেড়ে দেয়, সে কারণে তূবা ওকে বোঝাতে চেয়েছিল তারপর রেগে গিয়ে নাকি যা তা বলেছে। তূবার রাগ তো জানো। খুব মাথা গরম মেয়েটার। কিন্ত মনটা তুলোর মতো নরম। শ্রাবণকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে নিজে সে কি কাঁদল। বারবার বলল, শ্রাবণকে যাতে সামলে নেই। আর আমাদের ছাগলটাকে দেখো মাথা গরম করে সত্যি সত্যি মাকে সব বলতে যাচ্ছিল।’
‘ওকে এখন কী বলবে?’
‘কী বলবো সেটাই ভাবছি। আমাদের দুই পরিবারের কেউ যদি ঘুনাক্ষরেও টের পায় শ্রাবণ, তূবাকে অন্য চোখে দেখে বিশ্বাস করো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগবে। এমনি দুই পরিবারের সম্পর্ক কেমন গোলমেলে। ওদের ব্যাপারটা জানলে জল যে কোন দিকে গড়াবে তা ভেবেই ভয় পাচ্ছি। আর সু্লতান কাকা মানে তূবার যদি একবার জানে, উনি আমাদের কিছু না করলেও তূবাকে মেরে ফেলবে।’
‘হ্যাঁ, তোমাদের দুই পরিবারে তো আবার খুনাখুনির সম্পর্ক।’
‘আমার বড্ড মাথা ঘোরাচ্ছে।’
নিহাদ, কথাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলল,
‘টেনশন কম করো। আমি শ্রাবণকে বোঝাচ্ছি।’
কথা আরাম করে নিহাদের বুকে মাথা রাখল। চোখ বন্ধ করে বলল,
‘আমার শ্রাবণের জন্য যতটা চিন্তা হচ্ছে তারচেয়ে বেশি তূবার জন্য হচ্ছে। শ্রাবণ ছেলে মানুষ নিজেকে সামলে নিতে পারবে কিন্তু তূবা যদি কোনোভাবে ওর প্রতি আর্কষিত হয়ে পড়ে তবে মেয়েটা মরে যাবে। তুমি তো জানো ও কখনও কাউকে ভালোবাসবে না, বিয়ে করবে না বলে শপথ করেছে। অবশ্য তূবার স্থানে আমি থাকলে আমিও সেটাই করতাম। মেয়েটার জীবনে এমনি কম কষ্ট যে আমার ভাই ওকে কষ্ট দিচ্ছে।’
কথা এবার কান্না করেই ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আমার খুব কষ্ট হয় ওর জন্য। ভীষণ কষ্ট হয়। মেয়েটার মা নেই। বাবার সাথে তেমন ফ্রি না। ওর চাচা-চাচি শত ভালোবাসলেও ও নিজের কথা কাউকে বলতে পারে না। আর ঐ বিষয়টা…! এবার শ্রাবণ যদি ওকে কষ্ট দেয়, ও পাগল হয়ে যাবে। আমি চাই না আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীটা আর কষ্ট পাক। ওর জন্য আমার বুকটা ফেটে যায়। ওর অতীতটা ভাবলে কষ্টে আমার বুকে রক্তক্ষরণ হয়। শ্রাবণ যদি একটু বড় হতো, আমি নিজে ওকে ভাইয়ের বউ করে আনতাম। বর্ষণ ভাইয়া তো আগে থেকেই নীরা ভাবিকে পছন্দ করত। সে কারণে তাকে বলার সাহস হয়নি। শ্রাবণ ছোটো, ওর সাথে কি তূবার যায় বলো? যদি যেত তবে আমি নিজে তূবাকে রাজি করাতাম। তাতে ও যা শপথ করছে তা ভুলিয়ে হলেও রাজি করতাম।’
‘তুমি সত্যি তূবার সবটা জেনেও নিজের ভাইয়ের বউ করে আনতে?’
‘কেন আনতাম না? ওর মতো হীরার টুকরা মেয়ে লাখে ছাড়ো, কোটিতে পাবে? কখনও না। ওর একটা ছোটো সমস্যার জন্য নিশ্চয়ই ও সারা জীবনে শাস্তি ডেজার্ভ করে না? আমাদের শ্রাবণটা ওর সমবয়সী হলেও সমস্যা হতো না কিন্তু ও তো অনেক ছোটো।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিহাদ বলল,
‘ঠিক বলছো।’
‘শোনো স্বামীর ভাগ কাউকে দেওয়া যায় না, এই কথাটা যদি আমার মন মস্তিষ্কে গেথে না থাকত, তবে তূবাকে আমি আমার সতীন করে ফেলতাম।’
নিহাদ বুকে হাত দিয়ে বলল,
‘ইন্নালিল্লাহ্। এসব কী বলছো মাথা ঠিক আছে?’
‘একদম ঠিক বলছি। তূবা আমার অনেক প্রিয়।’
‘মাফ করো। এ কথা আর বলো না। আমি আমার কথামনির স্থান কাউকে দিব না। কাউকে না।’
কথা হেসে নিহাদকে জড়িয়ে ধরল। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে শ্রাবণ নিজ মনে বলল,
‘কী সমস্যা তূবার?’
শ্রাবণ, কথার রুমে ঢুকতে নিয়েও ভিতরে গেল না। নিহাদ, কথাকে জড়িয়ে ধরে আছে। শ্রাবণ নিজের রুমে চলে গেল। ও ওদের বিশেষ মুহূর্ত নষ্ট করতে চায় না। ভালোবাসা সুন্দর পবিত্র। আর স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসাময় মুহূর্ত সবচেয়ে বিশেষ। জীবনে চলার পথে প্রেম ভালোবাসা নামক অধ্যায়টাও খুব জরুরি। ভীষণ জরুরি।
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৬
৯!!
সকালবেলা শ্রাবণের ঘুম ভাঙল তূবার মিষ্টি মুখটা দেখে। ঘুম ঘুম চোখে তূবাকে দেখে বেশ চমকালো শ্রাবণ। চোখ মেলে ভালো করে তাকাতেই দেখল, স্বর্গীয় রূপে দাঁড়িয়ে আছে প্রেয়সী। তূবা আজ শাড়ি পরেছে। তাঁতের কাজ করা সুতির শাড়ি। কালো শাড়িতে সোনালী রঙের পাড়। মনে হচ্ছে সাক্ষাত স্বর্গ থেকে পরী নেমে এসেছে। ফর্সা ফোলা ফোলা গালের মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে যে শ্রাবণের মাথায় চক্কর দিলো। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় বলল,
‘এটা স্বপ্ন। এটা স্বপ্ন। মধুর স্বপ্ন।’
তূবা শ্রাবণের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ঐ ইডিয়েট, ওঠ আমার সাথে ভার্সিটিতে চল।’
শ্রাবণ তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। তারপর বলল,
‘এটা কী সত্যি?’
‘কী?’
‘তুমি এত সকালে আমার রুমে, এমন স্বর্গী রূপে বসে আছো?’
তূবা, শ্রাবণের মাথায় চড় মেরে বলল,
‘গাধা, সকাল দশটা বাজে। এত সকাল কোথায়? ওঠ। উঠে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর ভার্সিটিতে চল। আমার ক্লাস এগারোটা পয়তাল্লিশে। আমি ততক্ষণ কথার রুমে গিয়ে বসছি।’
শ্রাবণের মনে হলো আজকের মতো মিষ্টি সকাল আর হয় না। কখনও হয় না। শ্রাবণ বিছানা থেকে উঠে দ্রুত দাঁত ব্রাশ করল, হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে কাপড় পাল্টালো। তূবা, কথার রুমে বসে ওর সাথে কথা বলছে।
‘কিরে এখন শরীর কেমন?’
‘মোটামুটি।’
‘ভাইয়া কই?’
‘সকালে কোচিং গেছে। সেখান থেকে ভার্সিটিতে যাবে। তূবা, আজ তোকে এত সুন্দর লাগছে। সত্যি শাবনূরের মতো লাগছে।’
তূবা লজ্জা পেয়ে বলল,
‘তুইও দেখছি তোর ভাইয়ের টোনে কথা বলছিস।’
কথা হেসে বলল,
‘তুই চাইলে রাজি হতে পারিস। আমার পরিবারের বিষয়টা আমি হ্যান্ডেল করব। চাইলে তোর পরিবারের সাথেও কথা বলবো।’
তূবা বেশ রাগ করে বলল,
‘মাথা ঠিক আছে তোর?’
কথা হাসল তারপর বলল,
‘তাহলে আজ শাড়ি পরে আসছিস কেন?’
‘ভার্সিটি থেকে সোজা খালামনির বাসায় যাব। ভাবলাম তোকে দেখে যাই। তুই আবার তোর ভাইকে ঘুম থেকে জাগানোর দায়িত্ব দিয়ে দিলি।’
কথা দুষ্টু হেসে বলল,
‘ঘুম থেকে উঠে মিষ্টি একটা মুখ দেখলে দিনটা ভালো যায়। ভাবলাম গতকাল তো শ্রাবণের দিন খুব খারাপ ছিল, আজ নাহয় ভালো যাক। একটা কথা বলি, রাগ করবি না তো?’
‘না, বল।’
‘আমার সত্যি তোকে ভাবি বানাতে মন চায়। একসেপ্ট করে নে না রে শ্রাবণটাকে। সফল হতেও তো পারে অসম বয়সের এ সম্পর্কটা। হয়তো ঝড় বেশি যাবে। তাতে কী? দেখবি শেষে গিয়ে ঠিক পরণিতি পাবে। তাছাড়া কত স্বাভাবিক সম্পর্কও তো কত সুন্দর থাকে তা-ও পরিণতি পায় না। আবার অনেক অসম বয়সের সম্পর্কও পরিণতি পায়। যদিও তাদের সম্পর্কে অনেক ঝড়বৃষ্টি যায়, তবুও দেখা যায় শেষটা সু্ন্দর হয়।’
তূবা হেসে বলল,
‘সব জেনেও তুই এ কথা বলছিস?’
‘কেন বলবো না? তুই আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার প্রিয় মানুষটাকে আমি নিজের কাছে রাখতে চাইবো না?’
তূবা মন খারাপ করে বলল,
‘কথা, আমার বিষয়ে তোর কাছে কোনো কিছু গোপন নেই। তুই অন্তত বাচ্চাদের মতো কথা বলিস না। শ্রাবণের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। ও ছোটো, বাচ্চা মানুষ, তাই বিষয়টার গম্ভীরতা হয়তো বুঝতে পারবে না। কিন্তু তুই তো বড়, ম্যাচিওর। তোর তো বোঝা উচিত।’
কথা মন খারাপ করে বলল,
‘যে বিষয়টাকে তুই এত বড় করে দেখছিস সে বিষয়টা অতটাও বড় না।’
‘হয়তো। তবুও আমি কারও জীবন নিয়ে খেলার অধিকার রাখি না, কারও স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ নষ্ট করার অধিকার রাখি না।’
কথা ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আল্লাহ কেন তোর সাথে এমন করলেন?’
‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তিনি তো মহাজ্ঞানী। তিনি হয়তো বুঝেছেন আমার জন্য এটা বেস্ট সে কারণে হয়তো।’
কথা, তূবাকে জড়িয়ে ধরল। তূবা, কথার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘কেন যে তুই আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করিস ভেবে পাই না।’
‘নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে নিয়ে চিন্তা করব না?’
‘না করবি না। অযথা চিন্তা তো একদমই করবি না। চাচি কোথায়?’
‘একটু পাশের বাড়ি গেছেন।’
‘ভার্সিটিতে যেতে পারবি?’
‘নাহ্। শরীরটা ভালো লাগছে না।’
‘আচ্ছা তাহলে আমি গেলাম।’
‘শ্রাবণের সাথে যাবি?’
‘হুম। কালকে ওর সাথে অনেক রুড বিহেব করছি। আজ সুন্দর করে বোঝাতে পারি কি না দেখি।’
‘দেখ। তবে আমি এখনও বলবো রাজি হয়ে যা, ভবিষ্যৎ কে জানে বল?’
তূবা, কথার মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
‘তুই শ্রাবণের বোন তা প্রমাণিত।’
কথা হাসল।
শ্রাবণ সাইকেল নামিয়ে কেবল সাইকেলে বসেছে। তূবা সাইকেলের পিছনে বসে বলল,
‘শ্রাবণ, চল আমি তোর সাথে যাব।’
‘আমার সাথে সাইকেলে যেতে পারবে?’
‘কেন? আগে তো বহুবার তোর সাইকেলে চড়ে ঘুরেছি।’
শ্রাবণ কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
‘তখনকার তুমি আমি এক হলেও অনুভূতি আর সম্পর্কগুলো তো এক নেই। সব কেমন পাল্টে গেছে।’
তূবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শ্রাবণের মাথায় একটা চড়ের মতো মেরে বলল,
‘কিছু পাল্টায়নি। চল।’
তূবা, শ্রাবণের সাইকেলের পিছনে উঠে বসল। শ্রাবণ সাইকেল চালাতে চালাতে বলল,
‘তোমাকে আজ মিষ্টি লাগছে। কালো রঙে তোমাকে সত্যি মানায়।’
‘ধন্যবাদ।’
‘আজ কি বিশেষ কিছু?’
‘কেন?’
‘শাড়ি পরছো যে?’
তূবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘ক্লাস শেষে খালার বাসায় যাব।’
‘ওহ।’
শ্রাবণ সামনের দিকে তাকিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। তূবা পিছনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল,
‘সেখানে ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে।’
শ্রাবণ সাইকেলে এত দ্রুত ব্রেক করল যে তূবা নিজেকে সামলাতে শ্রাবণের কোমর জড়িয়ে ধরল। শ্রাবাণ মন অনেক খারাপ করে বলল,
‘বিয়ে করবে?’
‘সবকিছু পছন্দ হলে করে নিব।’
‘ওকে বেস্ট অফ লাক।’
তূবা খানিক অবাক হলো। শ্রাবণ মনে মনে বলল,
‘আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছো। গতকাল রাতে আপু আর ভাইয়ার কথা শুনেছি। তুমি কেন বিয়ে করতে চাও না সে কারণটা আমি ধীরে ধীরে জেনে নিব। তবে আপাতত তুমি বিয়ে করতে না চাওয়াটাই আমার জন্য ভালো। বেশি না জাস্ট পাঁচ ছয় বছর বিয়ে না করলেই হবে। ততদিনে নিজের একটা পরিচয় বানিয়ে ফেলব।’
শ্রাবণ সাইকেল চালাতে চালাতে বলল,
‘তূবা?’
‘হুম।’
‘আমি ছোটো খাটো একটা বিজনেস শুরু করতে চাচ্ছি।’
‘কিসের বিজনেস?’
‘কয়েকটা আইডিয়া আছে। দেখি কোনটা বেস্ট হয়?’
‘এত দ্রুত কেন? কেবল ফাস্ট ইয়ারে পড়ছিস, গ্রাজুয়েশন শেষ হোক তারপর যা করার করিস।’
‘অতদিন অপেক্ষা করা যাবে না।’
‘কেন?’
‘তোমাকে পেতে হবে তো? তারজন্য নিজের একটা পরিচয় তো বানাতে হবে?’
তূবা বেশ শব্দ করে হাসল। শ্রাবণ সাইকেল থামিয়ে বলল,
‘হাসছো কেন?’
‘তোর ধারণা তুই এসব কথা বলে আমাকে পটাতে পারবি?’
‘তোমাকে পটানোর কিছু নেই। আমি জানি তুমি অামার হবে।’
‘এত আত্মবিশ্বাস?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভালো। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো। শুরু কর ব্যবসায়। দেখি তোর আত্মবিশ্বাসের জয় হয় কি না?’
শ্রাবণ মনে মনে বলল,
‘আমার তোমাকে চাই। চাই মানে চাই। তার জন্য যদি ভুল কোনো পন্থা অবলম্বন করতে হয় আমি তা-ও করব। যে কোনো মূল্যে আমার তোমাকে চাই।’
১০!!
সকাল থেকে কাজ করতে করতে ক্লান্ত কথা। আজ ওর শ্বশুর-শাশুড়ি, দাদি শাশুড়ি সবাই আসবেন। মাস দেড়েক আগে তারা নিহাদের পৈত্রিক বাড়ি গিয়েছিলেন।সেখানে নিহাদের বড় চাচা থাকেন। নিহাদের দাদি তখন তার কাছে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েই তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েরঅ ফলে নিহাদের বাবা-মাকে তাকে দেখতে যেহে হয়। নিহাদ, কথাও গিয়েছিল তাকে দেখতে কিন্তু ওরা দাদিকে দেখে চলে এসেছিল। নয়ন শিকদার মানে নিহাদের বাবা আর মোমেনা থেকে যায়। নিহাদের দাদি একটু সুস্থ হওয়ায় আজ তারা একেবারে নিহাদের দাদিকে নিয়ে ফিরবেন।
কথা ঘরের সব কাজ একা হাতে পেরে উঠছে না। তারা এসে দুপুরে খাবেন বলেছিলেন। নিহাদও আজ ব্যস্ত। কথা রান্না বান্না সহ সকল কাজ সেরে ঘেমে নেয়ে যা তা অবস্থা। সব কাজ সেরে রুমে এসে ফ্যান ছেড়ে বিছানার মাঝামাঝি শুয়ে পড়ল। ভাবল, একটু জিরিয়ে গোসল করবে। এখন একটু চোখ বন্ধ করে থাকবে কিছুক্ষণ। তখন নিহাদ এসে কথার উপর শুয়ে পড়ে নিজের ভার ওর উপর ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘দরজা খোলা রেখে বিছনায় মাঝামাঝি হয়ে শুয়ে আছো যে?’
‘ওহ দরজা খোলা ছিল? খেয়াল ছিল না।’
‘খেয়াল থাকে কোথায়?’
‘তখন একটু বাইরে গেছিলাম। তারপর দরজা বন্ধ করে হয়তো খেয়াল ছিল না। এখন উপর থেকে ওঠো গরম লাগছে।’
‘না।’
নিহাদ, কথার চোখের দিকে তাকাল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো যেন হীরের টুকরা। ঘামের সাথে কপালে কিছু চুল লেপ্টে আছে। নিহাদ মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল কথাকে। ওর কপালে ঘামের সাথে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কথার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘কথা!’
‘হুম।’
‘আই মিস ইউ।’
কথা চোখ বড় বড় করে নিহাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চেয়ে বলল,
‘তোমার মিস করার মানে আমি খুব ভালো করে জানি। এই সরো তো সরো। সকাল থেকে কাজ করে এখন ক্লান্ত লাগছে। আমাকে তো একটু হেল্প তো করোইনি এখন আসছে মিস করতে।’
‘বিজি ছিলাম তো?’
‘তো?’
‘তো সে জন্য হেল্প করতে পারিনি।’
‘আমিও এখন মিস করার সুযোগ দিব না।’
নিহাদ দুষ্টু হেসে বলল,
‘নিজের বউ এর কাছে অনুমতি চাইলে পাপ হয়, জানো না বুঝি।’
‘ছাড়ো।’
‘হুস।’
গভীর ভালোবাসায় নিহাদ জড়িয়ে নিলো কথাকে।
নিহাদ গোসল সেরে বের হয়ে দেখল কথা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাচ্ছে। নিহাদ ওর কাছে গিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘থ্যাংকস, মিষ্টি দুপুরটার জন্য।’
কথা রাগি চোখে তাকাল। নিহাদ হেসে বলল,
‘উফ! এভাবে তাকিও না, আমার আরও প্রেম প্রেম পায়।’
‘স্যার মা*ই*র চিনেন?’
‘মা*ই*র তো স্যার ছাত্রীকে দেয়।’
‘আমি আমার দুষ্টু বরটাকে মাঝে মাঝে দি। এখন এক দফা দিব?’
নিহাদ হাসল। হঠাৎ কথার মাথার মধ্যে কেমন চক্কর দিলো। মাথা চেপে বিছানায় বসে পড়ল ও। নিহাদ বিচলিত হয়ে বলল,
‘কী হয়েছে কথা?’
‘বুঝতে পারছি না, কদিন যাবত মাথার মধ্যে হুটহাট চক্কর দিয়ে মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করে। মাইগ্রেনের ব্যথাটা আবার বোধ হয় বেড়েছে।’
‘বিকালেই ডাক্তার কাছে যাব।’
‘আরে না। কতদিন পর বাবা-মা আসছেন।’
‘তো তোমার মনে হয় তোমার ডাক্তার কাছে যাওয়াতে মা-বাবা রাগ করবেন?’
‘আরে তা না। তাদের সাথে সময় কাটাতাম।’
‘চুপ।’
নিহাদ কথার হাতদুটো নিজের মুঠোবন্দী করে বলল,
‘তুমি কেন বোঝো না, তোমার একটু কষ্টে আমার প্রাণটা কেমন ছটফট করে।’
চলবে…