#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ১৫
২০!!
গত তিনদিন যাবত ভার্সিটিতে যাচ্ছে না কথা। আর নিহাদের সাথেও তেমন কথা বলছে না। ঘরের লোকদের দেখানোর খাতিরে টুকটাক যা একটু কথা বলে এই পর্যন্তই। আজ সকালে উঠেই কথা তৈরি হচ্ছে ভার্সিটিতে যাবে বলে। নিহাদও তৈরি হচ্ছিল। কথাকে তৈরি হতে দেখে বলল,
‘ভার্সিটিতে যাবে?’
‘হুম।’
অন্যসময় তৈরি হবার সময় নিহাদ কত দুষ্টুতি করত। কথা বিরক্তি হবার ভঙ্গিমায় রাগ করত। নিহাদ ওকে আরও রাগিয়ে দিত। সাহসী আর আবেগময় স্পর্শে মুগ্ধ করত। কথা মুখে রাগের ভঙ্গি দেখালেও মনে মনে বলত,
‘তোমার এ পাগলামী ভালোবাসা, এ অবাধ্য আদর আমার বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।’
কিন্তু আজ দু’জনার মাঝে মস্তবড় দেয়াল। নিহাদ টাই নিয়ে কথার কাছে আসল। কথাই রোজ ওর টাই বেঁধে দিত। গত তিনদিন যাবত বাঁধছে না। নিহাদ প্রতিদিন টাই নিয়ে কথার সামনে যায় কথা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। আজ যাবার সময় নিহাদ টাই নিয়ে কথার কাছে আসল। কথা পূর্বের মতোই যত্ন করে টাই বেঁধে নিহাদের বুকে মাথা রাখল। নিহাদ, ওর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরল। কথার চোখ বেঁয়ে টুপ করে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ধীমি আওয়াজে বলল,
‘এখানে কি শুধুই আমার বসবাস?’
নিহাদ, কথাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘হ্যাঁ।’
‘অন্য কারও স্থান নেই এখানে?’
‘না।’
কথা হিচকি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘মনটা যখন একান্তই আমার, শরীরটা কেন নয়? আমি তো চাইতাম দুটোই একান্ত আমার হয়ে থাক। তাহলে কেন সেখানে অন্য কারও গন্ধ?’
‘নিহাদ নিশ্চুপ।’
অনেকটা সময় কেটে গেল একে অপরকে জড়িয়ে ধরেই। অনেকক্ষণ পর কথা, নিহাদের বুক থেকে মাথা তুলে বলল,
‘আজ সন্ধ্যার পর তুমি ফ্রি?’
‘তুমি যখন বলবে তখন ফ্রি থাকব।’
‘আচ্ছা।’
‘ভার্সিটিতে আমার সাথে যাবে?’
‘হুম।’
এই প্রথম নিহাদ, কথাকে ভার্সিটির গেটের সামনে নয় বরং ওর ডিপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিলো। নিহাদ মনে মনে বলল,
‘অনেক হয়েছে স্যার-ছাত্রী, স্বামী-স্ত্রীর লুকোচুরি খেলা। সবার জানা উচিত নিহাদের একটা কথা আছে। সে কথা ব্যতিত কারও হবে না।’
ভার্সিটির বেশ কয়েকটা মেয়ে নিহাদকে প্রেম নিবেদন করেছিল। নিহাদ সবাইকে সবসময় বলেছে ও বিবাহিত। কিন্তু কথা যে ওর স্ত্রী এ কথা তেমন কাউকে বলেনি। কথা বাইক থেকে নেমে দেখল তূবা ওদের দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। তূবা কাছে এসে বলল,
‘দুলাভাই থুক্কু স্যার, আজ একেবারে ডিপার্টমেন্টের সামনে ল্যান্ড করলেন?’
‘সবার জানা উচিত নিহাদের একটা কথা আছে।’
তূবা হেসে বলল,
‘বাহ্! কথাটা শুনতেই বেশ লাগছে। নিহাদের কথা আছে। যাই হোক আপনার কথাকে নিয়ে যাচ্ছি জরুরি মিটিং আছে। নিহাদ হেসে বলল,
‘মিটিংটা নিশ্চিত আমার শালাবাবুকে নিয়ে।’তূবা লজ্জা পেল। নিহাদ বলল,
‘আচ্ছা তোমরা থাকো আমি গেলাম। আমার ক্লাস আছে।’
গল্পের মাঝে বিরতি
“আমার নতুন বই আসছে “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”।”
নিহাদ চলে গেল। নিহাদের আজ একটু ভালো লাগছে। ওর ধারণা কথা ওর সাথে স্বাভাবিক হচ্ছে। হয়তো ওর উপর রাগ করে কথা বলা বন্ধ রাখবে, ওকে শাস্তি দিবে কিন্তু ওকে ছেড়ে যাবে না। নিহাদ এই বিষয়টা ভেবেই ভয় পাচ্ছিল, যদি কথা ওকে ছেড়ে যায় তাহলে ও কী করবে? ও তো পাগল হয়ে যাবে। সকালে কথার স্বাভাবিক আচরণে ওর মনে হলো কথা ওকে ছেড়ে যাবে না। কারণ কথাও ওকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কিন্তু নিহাদ, কথার মনের ভয়াবহ চিন্তাধারা সম্পর্কে সামান্যতম অবগত না। নিহাদ মনে মনে বলল,
‘কথা আমাকে একটা সুযোগ দিক, তারপর সম্পর্ক কীভাবে স্বাভাবিক করতে হয় তার দায়িত্ব আমার।’
নিহাদ চলে যেতেই তূবা বলল,
‘কিরে তিনদিন ক্লাসে আসিসনি কেন? আমাদের অনাগত পুচকু কি এরমধ্যেই জ্বালা দিচ্ছে।’
কথা চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘চুপ। এ কথা তুই ব্যতিত কেউ জানে না।’
‘স্যারকে বলিসনি?’
‘না। বলেছিলাম না ওর বার্থডে গিফ্ট।’
তূবা, কথার পেটে হাত দিয়ে বলল,
‘ইশ! আমার যে কী খুশি লাগছে। চিৎকার করে সবাইকে জানাতে ইচ্ছা করছে।’
কথা মলিন হাসল। তূবা, কিছুক্ষণ কথার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কথা?’
‘হুম।’
‘কী হয়েছে?’
‘কই কিছু না তো?’
‘নাহ্! তোর চেহারায় বিস্তর পরিবর্তন। চোখে মুখে হতাশা, গ্লানির ছাপ। চিন্তায় যেন ভিতরে ভিতরে গুমরে আছিস। কিছু বলতে চাইছিস? কী হয়েছে বল আমাকে?’
কথা, তূবার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
‘আমি ভালো নেইরে তূবা। প্রতিটা মুহূর্ত নিজের সাথে যুদ্ধ করে চলছি। প্রতিটা মুহূর্ত হাজারবার মরছি। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছি। আমার দমটা জাস্ট গলার কাছে এসে বেড়িয়ে যাবার জন্য ছটফট করছে। তুই জানিস না, আমার জীবনটা এখন কতটা এলোমেলো। আমি জীবনের ঐ স্থানে দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে জীবন আর মৃত্যু একরকম দেখায় প্রায়। কিন্তু আমি মৃত্যুকে না জীবনকে বেঁছে নিব। বর্তমানে জীবনটাকে ততটা ভালোবাসি না, যতটা ভালোবাসলে বেঁচে থাকা যায়। আবার ততটা ঘৃণাও করি না, যতটা ঘৃণা করলে মরে যাওয়া যায়। জীবন মৃত্যুর মধ্যস্থানে অবস্থান করছি আমি।’
তূবা কথার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
‘কীরে বল? কী চিন্তা করছিস?’
‘কিছু না। তুই কি যেন বলবি করে?’
‘আগে আমার কথার উত্তর দে। তোর কী হয়েছে?’
‘কিছুই না।’
তূবা, কথার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুই ভুলে যাচ্ছিস তুই আমার কাছে মিথ্যা বলতে পারিস না।’
কথা মনে মনে বলল,
‘এবার মিথ্যা বলতে হবে রে। নয়তো আমার নিহাদটা সমাজের কাছে ছোটো হয়ে যাবে। আমি চাই না আমার নিহাদটাকে কেউ নিচু চোখে দেখুক। সে তুই-ও না। বড্ড ভালোবাসি যে ওকে। ওর সম্মান মানে আমার ভালোবাসার সম্মান। আমি আমার ভালোবাসাকে অসম্মানিত করতে পারব না। পারব না সমাজের কাছে ছোটো করতে। হ্যাঁ নিহাদ আমার ভালোবাসাকে আমার চোখে ছোটো করে দিয়েছে। কিন্তু আমি একই কাজ করব না। তাছাড়া সমাজের লোক শিক্ষকদের নিচু চোখে দেখুক তা-ও আমি চাই না। দোষ হয়তো সিনথিয়া আর নিহাদ দুজনার বরাবর কিন্তু সমাজে পাঁচজন জেনে গেলে নিহাদের দিকেই আঙুল তু্লবে। প্রথমত সে পুরুষ, দ্বিতীয়ত সে শিক্ষক। আর সিনথিয়া এত ঠান্ডা মাথার মেয়ে যে নিহাদকে ফাঁসাতে ওর দুই মিনিট সময় লাগবে না। সিনথিয়ার সম্পর্কে আমি সব খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু আমি কাউকে বলব না এ কথা।’
তূবা আবার কথাকে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
‘আবার চুপ করে আছিস। বল?’
‘সত্যি কিছু নারে। প্রগনেন্সির প্রথম দিকে শরীর খারাপ, মরনিং সিকনেস, মন খারাপ, ডিপ্রেশন এসব কমন।’
‘পাক্কা তুই ঠিক আছিস?’
‘১০০%।’
তূবা, কথার কথা মানলেও বিশ্বাস করতে পারল না। তূবা ওকে সেই ছোটোবেলা থেকে চিনে। কথাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে ওর ভিতরে বড়সর ঝড় চলছে। কিন্তু কথা যখন বলতে চাইছে না, তখন তূবা জোর করল না। ভাবল, কথার যখন ঠিক মনে হবে তখন ঠিক বলবে।
“গল্পের মাঝে বিরতি
আমার নতুন বই আসছে “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”।”
তূবা, কথাকে বলল,
‘তোর ভাই তো নো বলে ছক্কা মারছে।’
কথা স্মিত হেসে বলল,
‘কী করছে।’
‘আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, চুমু খেয়েছে।’
কথা চোখ বড় বড় করে বলল,
‘বলিস কি? শ্রাবণ এসব করেছে? না না আমার ভাই এমন করতে পারে না!’
‘না না! তোমার ভাই এমন করতে পারে? সে তো দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। একদম পবিত্র। সে তো সদ্য জন্ম নেওয়া ছোট্ট বাবু, কুট্টি বাবু, সে কি কিছু বুঝে! অথচ আমি যদি একটু নরম হয়ে সুযোগ দিতাম এতদিনে সে বাচ্চার বাবা হয়ে যেত।’
কথা হেসে বলল,
‘সুযোগ দে না। আমাকে বানিয়ে নে ননদ, আর উপহার দে ছোট্ট একটা ভাতিজি বা ভাতিজা। যারা আমাকে সারাদিন ফুুপি ফুপি করে ডাকবে।’
তূবা রাগী ভঙ্গিতে বলল,
‘আমার ভবিষ্যৎ বোনের ছেলের মেয়েদের কথা ভেবে তোকে ছেড়ে দিলাম। নয়তো পিঠ বরাবর কিল বসিয়ে দিতাম।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা মনে মনে বলল,
‘কেউ একজন বুকে ছুড়ি বসিয়েছে। এখন আর কিল চড় গায়ে লাগে না রে।’
মুখে বলল,
‘তো তারপর তোর রিয়াকশন কী ছিল?’
তূবা কথাকে সবটা খুলে বলল। যোগোযোগের সব মাধ্যম থেকে ব্লক করার কথাও। তারপর বলল,
‘ব্লক করেও তো শান্তি পাইনি রে।’
‘কেন?’
‘বজ্জাতটা আমাদের বাসায় গিয়ে তামিমকে পড়ায়। প্রথম দুদিন পড়াতে এসে আমার সাথে দেখা করতে পারেনি। আমি নিজেই তো দেখা করিনি। ঘাপটি মেরে রুমে বসে ছিলাম। তৃতীয়দিন তো লিমিট ক্রস করে গেল।’
‘কেন কী করছে?’
‘ছোট চাচি বাসায় ছিলেন না। শ্রাবণ, তামিমকে অঙ্ক করতে দিয়ে বলল,
‘তামিম, তূবা আপু কোথায়?’
তামিম বলল,
‘রুমে।’
‘আচ্ছা তুই অঙ্ক কর আমি তূবার কাছে একটু কথা বলে আসি। কথা আপুর নোটখাতা তার কাছে। আমাকে নিয়ে যেতে বলছে।’
‘আচ্ছা ভাইয়া।’
আমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের সব কথা শুনছিলাম। ভাবলাম দরজার ছিটকিনি দিয়ে রাখি কিন্তু পরে ভাবলাম, তামিম কী না কি ভাবে! যতক্ষণে ভাবলাম ততক্ষণে বাদরটা আমার রুমে এসে দরজার সিটকিনি দিয়ে খপ করে আমার হাত ধরে ফেলল।’
কথা চোখ বড় বড় করে বলল,
‘তারপর?’
‘তারপর কি আমার হাত ধরে বলল,
‘জলদি আমাকে আনব্লক করো।’
আমি বেশ রেগে বললাম,
‘করব না। তোর অসভ্য ভাইটা আমাকে একরকম জড়িয়ে ধরে বলল,
‘এখন যদি আনব্লক না করো তাহলে চিল্লাপাল্টা করে এলাকার লোক এক করে আজই বিয়ে করে ফেলব।’
‘বলিস কী? তারপর?’
‘তারপর কি বাধ্য হয়ে ওকে আনব্লক করতে হয়েছে। ওর চোখের তেজে যা ভয় পেয়েছিলাম। যেন সূর্যের মতো প্রখর।’
তূবা চোখ বন্ধ করে ভাবল, গতকাল সন্ধ্যার পরের কথা। শ্রাবণ রুমে ঢুকেই খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলে ওকে নিজের বাহুডোরে বন্দী করে নেয়। কৌশলে তূবার সাথে যোগাযোগের সব মাধ্যম আনব্লক করিয়ে আবার তূবাকে বাহুবন্দী করে বলেছিল,
‘এরপর আমাকে ব্লক করলে ব্যাপারটা মোটেও ভালো হবে না।’
তূবা, শ্রাবণের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করলেও ওর ছোট শরীরটা শ্রাবণের পেশীর সাথে পেরে উঠছিল না। শ্রাবণ, তূবার চোখের উপর পড়া চুলগুলো ওর কানের পাশে গুজে দিলো তারপর আলত করে তূবার কপালে চুমো একে বলেছিল,
‘তোমার মধ্যে এত ঘোর কেন? সারাজীবন ভালোবাসেও আমার এ ঘোর কাটবে না। বিশ্বাস রাখতে পারো। এই যে তোমার ধূসর রঙের চোখ, চোখের বিন্দুটা গভীর কালো আমি তো এ চোখে তাকিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারব। তোমার এই ফোলা ফোলা গাল, ডাগর ডাগর চোখ, সুন্দর নাক এসবের দিকে তাকিয়ে থেকেই একজন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়।’
শ্রাবণ, তূবার হাত ধরে আঙুলের ফাঁকে আঙুল জড়িয়ে বলেছিল,
‘এই যে ছোট্ট নরম হাতদুটো, এই হাতে পরা চিকন সোনার দুগাছা চুরি সব মিলিয়ে কী ভয়াবহ সৌন্দর্য, তুমি নিজেও জানো না! স্বর্ণের সোনালী আভাও তোমার আভার কাছে হার মেনেছে।’
শ্রাবণ আবার তূবার আঙুলে চুমো খেল। তূবার অনামিকা আঙুলে ছোট্ট করে কামড় দিয়ে বলেছিল,
‘এই আঙুলের ফাঁকেও তো আমায় বন্দী করে রাখতে পারো। তুমি চাইলে সারাজীবন তোমার আঙুলের ফাঁকে পড়ে থাকব। এই যে সুন্দর অনামিকা আঙুলটা এ আঙুলে একদিন শ্রাবণ নামের রিং থাকবে। শুধু আঙুলে না তোমার শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে একদিন আমার নাম থাকবে। মিলিয়ে নিও।’
আজ আর তূবা নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। ভয় আ ভালোবাসার মুগ্ধতায় ওর হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেল। শ্রাবণ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
‘তুমি যতই আমার কাছ থেকে নিজের অনুভূতি লুকাও না কেন আমি জানি তুমিও আমায় ভালোবাসো। শুধু কিছু বাঁধা তোমায় আটকে দিচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তুমি নিজে আমাকে ভালোবাসি বলবে।’
শ্রাবণ, তূবাকে ছেড়ে দিয়ে ওর টেবিল থেকে একটা খাতা নিয়ে তামিমকে পড়াতে গেল। তূবা, স্তব্ধ হয়ে ওখানেই বসে ছিল ঘন্টাখানিক। শ্রাবণের স্পর্শ আর অনুভূতিরা ওর সত্ত্বাকে এমনভাবে অবশ করেছিল যে তূবার নিজেকে সামলাতে অনেক সময় লেগেছিল।’
কথা, তূবার চোখের সামনে তুড়ি মেরে বলল,
‘তূবা, শ্রাবণের ঘোর থেকে বের হ। স্যার এসেছেন ক্লাসে।’
তূবা নিজে স্বাভাবিক করে ক্লাসে মন দিলো কথা বলল,
‘তূবা, তুই কি শ্রাবণকে ভালোবাসে ফেলেছিস?’
তূবা মাথা নিচু করে রইল। ওর মৌনতা যেন কথাকে সব উত্তর দিয়ে দিলো।
“আমার নতুন বই আসছে “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”।”
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ১৬
কথা আর তূবা ক্লাস শেষে ক্যাম্পসে বসে ছিল। শ্রাবণ হাঁপাতে হাঁপতে এসে বলল,
’কথা আপু, তোর কী হয়েছে?’
‘কেন?’
‘তিনদিন যাবত ফোন দেস না কেন বাড়ি? মা চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে।’
‘মাকে বলিস একটু ব্যস্ত ছিলাম। বাড়ি গিয়ে কল করব।’
শ্রাবণ, কথার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,
‘আপু, তুই ঠিক আছিস?’
‘হ্যাঁ, কেন?
‘তোর চোখের নিচটা কেমন কালো হয়ে গেছে। চোখ মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? বিষন্ন লাগছে। কী হয়েছে বল?’
‘তোর আর তূবার কথার ধরণ দেখছি এক রকম। আমার কিছুই হয়নি। যা হয়েছে কদিন পর জানতে পারবি।’
তূবা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘আমি জানি কী হয়েছে?’
কথা চোখ রাঙাল। শ্রাবণ বলল,
‘আমাকেও বলো। আফটারঅল আই আম ইউর উড বি।’
তূবা রাগ করে বলল,
‘যা-ও বলতাম এখন আর তোকে বলব না। যা পিচ্চির বাচ্চা পিচ্চি।’
শ্রাবণ চোখ মেরে দুষ্টু হেসে বলল,
‘সত্যিই কি পিচ্চি? পিচ্চি কি কি করতে জানে তা তো জানোই।’
তূবা লজ্জায় লাল হয়ে চুপ করে গেল। কথা দুজনার মুখ ভঙ্গি দেখে বলল,
‘তোদের নতুন নতুন প্রেমে সুভাসে আমার পেটে মোচর দিচ্ছে। খিদা লাগছে আমার।’
শ্রাবণ বলল,
‘খিদা তো আমারও লাগছে। আপু টাকা দে।’
শ্রাবণ, কথা ব্যাগ থেকে নিজেই টাকা নিতে লাগলে তূবা বলল,
‘নিজের টাকা খরচ করতে পারিস না? সবসময় বোনের ব্যাগ ডাকাতি করিস।’
শ্রাবণ জিব বের করে ভেংচি কেটে বলল,
‘করলে করি তাতে কার কী?’
তূবা মনে মনে বলল,
‘কাল আমার সাথে দুনিয়ার কান্ড করে এখন বলছে কার কী?’
কথা, শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘গতকাল সন্ধ্যার পর তূবার সাথে কী করছিস?’
শ্রাবণ খানিকটা তুতলে বলল,
‘কই কী করছি? আমার তো কাল ওর সাথে দেখাই হয়নি।’
কথা খপ করে শ্রাবণের কান ধরে বলল,
‘তুই কি ভাবছিস, তূবা আমাকে বলবে না? ওর রুমে ঢুকে কি কি করেছিস সব বলেছে। এতটুকু বয়সেই পেকে গেছিস না? আজ মেরে তোর পিঠের ছাল চামরা তুলে নিব।খুব পেকে গেছিস।’
‘আপু কান ছাড় ভার্সিটির সবাই দেখে কী ভাবছে বল তো? এত বড় একটা ছেলের কান ধরে একটা মেয়ে টানছে। আমার ইজ্জত নিয়ে সিনিমিনি খেলিস না।’
কথা কান ছেড়ে বলল,
‘ভার্সিটি বলে ছেড়ে দিলাম। এরপর যদি শুনছি এমন পাকনামি করছিস মেরে তোর হাড্ডি ভেঙে দিব।’
‘আমি পাকনামি করছি তাতে দোষ হলো, তোর বান্ধবীরও তো খারাপ লাগেনি। বরং আমার তো মনে হয় ওর বেশ ভালো লেগেছে।’
তূবা চোখ বড় বড় করে তাকাল। কথা বলল,
‘তুই কীভাবে বুঝলি ওর ভালো লাগছে নাকি খারাপ?’
শ্রাবণ বলল,
‘ওর খারাপ লাগলে ও নিশ্চিত আমার গালে চড় বসিয়ে দিত। তা তো করেইনি। উল্টো লজ্জায় লাল, কড়া লাল, তার চেয়ে বেশি লাল হয়ে গেছিল। শুধু তাই না মৃগী রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছিল।’
তূবা উঠে শ্রাবণের মাথায় ঠাস করে থাপড় দিয়ে বলল,
‘গাধা!’
শ্রাবণ কথার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘দেখছোস প্রমাণ ও আমাকে পছন্দ করে। না করলে, গালে মারত, মাথায় কেন মারল?’
তূবা যেইনা শ্রাবণকে মারতে যাবে ওমনি শ্রাবণ দূরে গিয়ে বলল,
‘গালে একশর্তে থাপ্পর মারতে দিব, যদি সন্ধ্যার পর ছোট্ট করে একটা চুমু খাও।’
তূবা, কথা দুজনেই চোখ বড় বড় করে তাকাল। শ্রাবণ বলল,
‘বাটা মাছের মতো চেয়ে আছিস কেন? বল কী খাবি? ফুচকা নাকি চটপটি, নাকি ঝালমুড়ি?’
কথা রেগে বলল,
‘তোকে চিবিয়ে খাব।’
‘ছি! এসব কী বলছিস? তুই না আমার মায়ের পেটের বোন! আমার মতো মিষ্টি একটা ছেলের বোন কখনও মানুষ খেকো হতে পারে না।’
শ্রাবণের কথা শুনে কথা হেসে দিলো। তূবা রাগী চোখেই তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ, তূবার দিকে তাকিয়ে কথাকে বলল,
‘আপু, দেখ তোর বান্ধবী কেমন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখের আগুনে আমায় পুড়িয়ে ছাই করে দিবে।’
কথা আবারও হেসে বলল,
‘ঝাল ঝাল করে ফুচকা নিয়ে আয়।’
শ্রাবণ বলল,
‘আর এই আগুন রাণীর জন্য?’
কথা হেসে বলল,
‘বোম্বাই মরিচ দিয়ে চটপটি।’
‘ওকে।’
শ্রাবণ যেতেই কথা হেসে বলল,
‘তোদের কাহিনী তো জমে ক্ষীর।’
তূবা ধমক দিয়ে বলল,
‘চুপ থাক। ওরে আমি এমন শিক্ষা দিব মনে রাখিস।’
কথা হেসে বলল,
‘সেটা তোদের ব্যাপার।’
দূর থেকে নিহাদ কথাকে হাসি খুশি দেখে বেশ খুশি হয়ে বলল,
‘যাক অবশেষে ওর মনের মেঘটা কাটতে শুরু করেছে। হে আল্লাহ, ও যেন স্বাভাবিক হয়। আমাদের সম্পর্কটা আবার আগের মতো করে দিন।’
কথা, শ্রাবণ ও তূবা একসাথে খাচ্ছিল তখন সিন্থিয়া এসে কথার প্লেট থেকে ফুচকা নিয়ে মুখে নিয়ে বলল,
‘দারুণ মজা!’
ওরা তিনজন বেশ অবাক হলো। কথা বলল,
‘ফুচকা খেলে অর্ডার কর। বিল আমি দিব।’
সিন্থিয়া হেসে বলল,
‘তোর এটো জিনিস খাবার অভ্যাস আমার আছে।’
কথাটা সিন্থিয়া কি ভেবে বলল তা কেবল কথাই বুঝল। পরক্ষণে সিন্থিয়া হেসে বলল,
‘মজা করছিলাম। কথা একটু এদিকে আয়। কথা আছে।’
গল্পের মাঝে বিরতি
“আমার নতুন বই আসছে “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”।”
কথা, সিন্থিয়ার সাথে বেশ দূরে গেল। জায়গাটায় তেমন লোক নেই। সিনথিয়া বলল,
‘তুই তো দেখছি মেরুদন্ডহীন কথা।’
অসহায় চোখে সিন্থিয়ার দিকে তাকাল কথা। সিন্থিয়া বলল,
‘নয়তো সেদিন নিজ চোখে সব দেখার পর, আমার সব কথা শোনার পরও তুই কীভাবে নিহাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে আছিস? তোমার শরীরে লজ্জা নেই। মেরুদন্ডহীন প্রাণী হয়ে গেছিস নাকি।’
কথা চারদিকে তাকাল। চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখল ওদের দিকে কেউ দেখছে কি না। তারপর কথা স্বজোরে সিন্থিয়ার গালে চড় বসিয়ে দিলো। সিন্থিয়া স্তব্ধ হয়ে কথার দিকে তাকিয়ে রইল।
কথা বলল,
‘লজ্জা পাবার কিছু নাই, কেউ দেখেনি যে তোকে চড় মেরেছি। তাছাড়া তোর মতো মেয়েদের লজ্জা তো থাকেই না। চরম বেহালাজ খা** টাইপ মেয়েরা দেখতে ঠিক তোর মতো হয়।’
কথার মুখের ভাষা শুনে সিন্থিয়া আরও স্তব্ধ। মনে মনে বলল,
‘কী বলছে কথা এসব? ওর মাথা ঠিক আছে?’
কথা রহস্যময় হেসে বলল,
‘অবাক হচ্ছিস আমার আচরণ আর মুখের ভাষায়? আসলে তোদের মতো বে** মেয়েদের জন্য মুখে এর চেয়ে ভালো ভাষা আসে না। আমার তো আরও বাজে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। নিজেকে সামলে নিলাম।’
সিন্থিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়েই রইল। কথা বলল,
‘মজার কথা শুনবি? আমাকে তুই এবং বাকিরা যতটা সরল মনের ভাবে একচুয়ালি আমি ততটা সরল না। সেদিন তোর কথা শুনেছি তোর দেখানো ট্রিপল এক্স সিনেমাও দেখেছি। তোর পারফরমেন্সও দেখেছি। সব দেখে শুনে তোকে ঠিক পতিতা বলা যায় না, তার চেয়ে নিকৃষ্ট। পতিতারা তো অভাবে পড়ে, নয়তো বড় কোনো সমস্যায় পড়ে নিজের সম্মান বিক্রি করে। সেখানে তুই একটা ছেলেকে ব্ল্যাকমেইল করে ফিজিক্যাললী ইনভলব হলি। আরেকটা কথা বলি, সেদিন তোর আর নিহাদের ঐ রকম মুভি দেখে এটা তখনই বুঝেছিলাম তোর সাথে ফিজিক্যাল রিলেশনে নিহাদের কোনো সম্মতি বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না। যা হয়েছে সেটা তোর ব্ল্যাকমেইলের কারণে হয়েছে। কারণ ও তো পাথরের মতো পড়ে ছিল। যা করার তো তুই করেছিলি।
গল্পের মাঝে বিরতি
“আমার নতুন বই আসছে “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”।”
আমার ভাবতেই বমি পাচ্ছে একটা মেয়ে হয়ে এতটা নিচে কী করে নামে? নিহাদকে এত বছর যাবত চিনি। আমাদের শারীরিক সম্পর্কের সময় ওর মুভমেন্ট রিয়াকশন আমার মুখস্ত। তো তেমন মু্ভমেন্ট তোর বেলায় ছিল না। ওর নির্জীব ছিল। তুই উচ্ছ্বল ছিলি, ঠিক এডাল্ট মুভির নায়িকাদের মতো। আর কি বিচ্ছিরি শব্দ করে চিল্লাপাল্লা করেছিলি। ইয়াক থু।
আর আমি না, সেদিন থেকে ভাবছিলাম কী এমন প্রতিশোধ যার কারণে তুই আমার ঘর ভাঙতে চেয়েছিলি? এবং আমার ঘর ভাঙার জন্য নিহাদকে ব্ল্যাকমেইল করে ফিজিক্যাললী পর্যন্ত ইনভলব হলি। একটা মেয়ের এমন কি রাগ থাকতে পারে, এমন কোন ধরণের প্রতিশোধের নেশা থাকতে পারে, যার জন্য সে তার সম্মান বিলি করতেও দুইবার ভাবে না। একচুয়ালি প্রতিশোধ শব্দটা তুই জাস্ট বলার জন্য বলেছিস। আমার মন ঘোরানোর জন্য। সংসারে আরও প্যাচ লাগানোর জন্য। আসলে প্রতিশোধ টোধ তেমন কিছুই না। ওটা জাস্ট তোর ছল ছিল। তোর বিষয়ে সব খোঁজ খবর নিয়েছি আমি।’
সিন্থিয়া চমকে উঠল। কথা বলল,
‘তুই নিহাদকে প্রায় সাত বছর যাবত চিনিস প্লাস ভালোবাসিস। কী ঠিক বললাম তো? নিহাদ তোর প্রথম প্রেম। তোর কিশোরী বয়সের ভালোবাসা। নিহাদ তখন ভার্সিটির জব পায়নি। তখন ও প্রাইভেট টিউটর ছিল। তোর বড় বোনকেও পড়াত তাই না? সেখান থেকেই নিহাদ তোর ক্রাশ তাই কি না? আরও বিস্তারিত শুনবি? তোকে নিহাদ দেখলেও এত বছর পর চিনতে পারেনি। চেহারায় শারিরীক গঠনে বেশ পরিবর্তন হয়েছে তোর। তাছাড়া যেখানে শিক্ষকরা ছাত্রীর চেহারা ভুলে যায়, সেখানে ছাত্রীর বোনকে ভোলা তো সাধারণ ব্যাপার। তুই তখন থেকেই নিহাদকে ভালোবাসতি। কিন্তু ভালোবাসার কথা কখনওই বলতে পারিসনি।
তারপর তোর বাবার চাকরিতে বদলী হয়। না চাইতেও তোদের এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হয়। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে তোরা আবার এখানে ফিরিলি। হয়তো কো-ইনসিডেন্টলী দেখলি নিহাদ এই ভার্সিটিরই টিচার। তোর পুরাতন প্রেম নতুন করে জেগে উঠল। কিন্তু জানতে পারলি নিহাদ বিবাহিত, আমার বর। তারপর যত গুটি চালা শুরু করলি।
তুই নিহাদকে কীভাবে ফাঁসিয়েছিস তা কিন্তু আমি জানি না। কিছুটা আন্দাজ করেছি বাকিটা আজ রাতে নিহাদের থেকে সবটা জানব। বাই দ্যা ওয়ে সেদিন নিহাদের সাথে তোর পারফমেন্স দেখে এতটুকু বুঝেছিলাম এটা তো প্রথম ফিজিক্যাল রিলেশন না। মেয়েদের প্রথম ফিজিক্যাল রিলেশনে তাদের আচরণ দেখলে বোঝা যায়। নিহাদ আর আমার বিয়ে প্রায় চার বছর। কিন্তু এখনও যখন ও আমার কাছে আছে, আমি লজ্জায় গুটিয়ে যাই। সেখানে তুই তো পুরাই…! তখনই বুঝেছিলাম বারো ঘাটের পানি খাওয়া বারো*ভাতারি মেয়ে তুই।
আমার নিহাদটা সত্যি দুর্বল, বোকা, যে তোর ট্রাপে পড়ে গেল। তুই নিজের লেভেল না দেখে আমাকে মেরুদন্ডহীন বলছিস। শোন নিহাদের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন হবে সেটা আমি ঠিক করব তুই না। সংসার করা না করার সিদ্ধান্ত আমার হবে তোর না। এখন যা।’
কথাও সিন্থিয়াকে তেমনই ভাবেই ছুড়ে মারল যেভাবে ও সেদিন কথা আর নিহাদকে মেরেছিল। কথা আবার বলল,
‘জানি প্রচন্ড শকে আছিস তুই। ভেবে পাচ্ছিস না আমি তোর সিক্রেট কীভাবে জানলাম। বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাব।’
সিন্থিয়া হতভম্ব হয়ে এতক্ষণ কথার কথা শুনছিল। প্রথমত থাপ্পরের হতভম্ব কাটিয়ে ওঠার আগেই কতগুলো বোম ফেলল কথা। বারবার ভাবছিল কথা এসব কীভাবে জানল?
যেতে যেতে কথা ভাবল,
‘নিহাদ ওর কর্মের শাস্তি পাবে। তবে তোকেও আমি ছাড়ব না সিন্থিয়া। তোর যে কী হাল করব তুই নিজেও জানি না। তোকে যদি পতিতাদের কাতারে না নামিয়েছি তো আমার নামও কথা না।’
“আমার নতুন বই আসছে “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”।”
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ১৭
কথা, তূবা আর শ্রাবণের কাছে আসতেই তূবা বলল,
‘কি রে, কী বললেন মহারাণী?’
‘আজাইরা প্যাচাল। বাদ দে। বাসায় যাব।’
শ্রাবণ বলল,
‘তূবা, আমার সাথে সাইকেলে যাবা?’
‘কেন তোর সাইকেল কি রাজবাহন যে আমার সেখানে চড়তে হবে? ভাঙচোরা পিচ্চির ভাঙাচোরা সাইকেল তা নিয়ে আবার বড় কথা। তোর সাইকেলে তুই যা।’
শ্রাবণ মুখ গোমড়া করে বলল,
‘আজ তাচ্ছিল্য করলা তো একদিন সেধে বসবা।’
‘তোর সেই একদিন কবে আসবে? সবসময় খালি বলিস, একদিন হ্যান করবা, ত্যান করবা, কত কী করব একদিনে?’
‘সেটা সে একদিন আসলেই বুঝবা।’
কথা হেসে বলল,
‘হয়েছে ঝগড়া বন্ধ কর। আমি নিহাদকে কল করে ওর সাথেই বাসায় যাব। তোরা একসাথে যা বা আলাদা আলাদা। সেটা তোদের বিষয়।’
কথা নিহাদকে কল করল। কল রিসিভ করতেই কথা বলল,
‘ক্লাস শেষ তোমার?’
‘আগেই শেষ। টিচারদের সাথে একটু কথা বলছি। তুমি কী করছো?’
‘বাসায় যাব। তুমি যাবে?’
‘হ্যাঁ। ওয়েট আমি আসছি।’
কিছুক্ষণ পর নিহাদ বাইক নিয়ে কথার সামনে এসে দেখল, শ্রাবণ, তূবাও একসাথে দাঁড়িয়ে। নিহাদ, শ্রাবণকে বলল,
‘কী শালাবাবু গাড়ি কতদূর গেল?’
‘বেশি দূর না। ঠেলাগাড়ির মতো চলছে।’
‘আপাতত ঠেলাগাড়ির স্প্রিডেই চলো। বেশি দ্রুত চড়লে দূর্ঘটনা ঘটবে।’
শ্রাবণ, কথা হাসল। তূবা মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। কথা বাইকে বসে ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ওরা যেতেই শ্রাবণ বলল,
‘কী রাগী রাণী বাড়ি যাবেন?’
‘বাড়ি যাব না তো এখানে থাকব?’
‘আমার সাথে চলো।’
‘যাব না।’
তূবা রিকশায় উঠে চলে গেল। শ্রাবণ সাইকেল নিয়ে তূবার রিকশার পাশে পাশে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তূবা রাগী চোখে তাকাচ্ছে আর শ্রাবণ হাসছে।
কিছুদূর যাবার পর কথা, নিহাদকে বলল,
‘তোমার কাছে টাকা আছে?’
‘কত?’
‘হাজার পঞ্চাশ।’
নিহাদ সাইড করে বাইক থামিয়ে বলল,
‘কতটাকা বললে?’
‘পঞ্চাশ হাজার।’
‘এত টাকা তো এখন হাতে নেই। এটিএম থেকে তুলে দিতে পারব। এখন লাগবে?’
‘বিকালে দিলেই হবে।’
‘আচ্ছা চলো এটিএম থেকে তুলে নিয়েই বাড়ি যাই।’
‘আচ্ছা।’
টাকা তুলে নিহাদ, কথার হাতে দিয়ে বলল,
‘এখন বাড়ি যাবে?’
‘একটা কল করি।’
কথা কাকে যেন কল দিয়ে বলল,
‘টাকা রেডি এখন নিবি নাকি পরে?’
অপর পাশের লোকটা বলল,
‘এখনই নিব।’
‘আচ্ছা।’
কল কেটে কথা, নিহাদকে বলল,
‘আমি যেখানে বলছি সেখানে চলো।’
‘আচ্ছা।’
কথার কাজকর্মে নিহাদ একটু অবাক হলেও কথাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। আজকাল ওর কথাকে বড্ড ভয় হয়। কথার বলা স্থানে গিয়ে বাইক থামাল। সেখানে গিয়ে কথা একটা ছেলেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিল। ছেলেটা বলল,
‘ধন্যবাদ। এ উপকার সারাজীবন মনে থাকবে আমার।’
‘তুইও আমার কম উপকার করিসনি।’
‘আরে না না। আমি যত দ্রুত সম্ভব টাকাটা ফেরত দিয়ে দিব।’
‘আচ্ছা।’
ছেলেটা চলে গেল। কথা, নিহাদের কাছে গিয়ে বলল,
‘জানতে চাইবে না এতগুলো টাকা কাকে দিলাম? কী করলাম?’
‘কখনও জানতে চেয়েছি?’
‘তা ঠিক।’
‘বাসায় চলো।’
বাইক চালাতে চালাতে নিহাদ বলল,
‘ছেলেটা রাব্বি ছিল না? তোমার ক্লাসমেট?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওহ।’
‘ওর মা খুব অসুস্থ। ঢাকা গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে। ছোট্ট একটা অপারেশনও লাগতে পারে। ওর তো বাবা নেই। ছেলেটা হন্যে হয়ে টাকা খুঁজছিল। আমি জানতে পারায় হেল্প করলাম। সাথে ওর থেকে বড় ধরণের একটা হেল্প নিয়েছি।’
‘ও আচ্ছা।’
‘জানতে চাইবে না কী হেল্প নিয়েছি?’
‘কী হেল্প?’
‘সিন্থিয়ার কিছু সিক্রেট জেনেছি।’
নিহাদ বাইক ব্রেক কষে বলল,
‘বুঝলাম না?’
‘রাতে সব বলব। সে কারণে সকালে জিজ্ঞেস করেছিলাম রাতে ফ্রি কি না?’
‘আচ্ছা।’
গল্পের মাঝে বিরতি
“আমার নতুন বই আসছে “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”।”
২১!!
বর্ষণ কঠিন চোখে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর সাথে তূবার সম্পর্ক চলছে?’
শ্রাবণ মাথা নিচু করে রইল। বর্ষণ বেশ জোরে ধমক দিয়ে বলল,
‘কী রে কথা বল? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।’
শ্রাবণ ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ।’
‘কতদিন যাবত চলছে এ সম্পর্ক?’
‘বেশ কয়েকমাস। তোমাদের আকদের পর থেকে।’
শ্রাবণ বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘শুধু তুই তূবাকে ভালোবাসিস নাকি দুজন দুজনকে?’
‘জানি না।’
‘মানে?’
‘কখনও কখনও ওর আচরণে মনে হয় আমাকে পছন্দ করে, আবার কখনও কখনও মনে হয়, আমি কোন ক্ষেতের মূলা তা ও চেনেই না।’
‘ও তোকে সরাসরি বলছে, তোকে ভালোবাসে?’
‘না।’
‘তুই বলছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘ও উত্তর কী দিছিল?’
‘ঠিকভাবে উত্তর তো দেয়ইনি উল্টা আমাকে ধরে মারছিল। এখনও মারে। কিছু বললেই মারে, বকা দেয়।’
বর্ষণের বেশ হাসি পেল। কিন্তু শ্রাবণের সামনে নিজেকে যথা সম্ভব কঠিন রেখে বলল,
‘তাহলে তো বোঝাই যায়, তোকে ভালোবাসে না। তাহলে আর কী? তোর একতরফা প্রেম, দুদিন পর এমনি শেষ হয়ে যাবে।’
‘মোটেও না। আই রিয়েলী লাভ হার।’
বর্ষণ কৃত্রিম রাগের ভঙ্গি করে বলল,
‘বেয়াদব! বড় ভাইর সামনে এসব কী বলছিস? লজ্জা করছে না?’
শ্রাবণ মাথা নিচু করে রইল। বর্ষণ ধমক দিয়ে বলল,
‘কথা বলছিস না কেন?’
‘প্রেম পড়লে লজ্জা সরম থাকে না। সব ভাতের সাথে গিলে খেয়ে ফেলতে হয়।’
বর্ষণ শ্রাবণের কান ধরে বলল,
‘বাবার কাছে বলে তোর লজ্জা সরম বের করছি। ইডিয়েট! এই বয়সেই প্রেমে পড়ছিস? তা-ও নিজের চেয়ে তিন বছরে বড় মেয়ের?’
‘মোটেও তিন বছর না। দুই বছর সাত মাসের বড়। তাছাড়া আমার বয়স তো বিশ বছর। এখন প্রেমে পড়েছি। বয়সটা মোটামুটি ম্যাচিওর এর দিকে। তুমি তো সেই ইন্টারে পড়াকালীন থেকে নীরা ভাবির সাথে প্রেম করতা। তোমরা তো সমবয়সী। সেখানে আমি আমার চেয়ে বড় মেয়েকে পছন্দ করলে সমস্যা কী?’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বর্ষণ বলল,
‘দুজনার পরিবার মানবে?’
শ্রাবণ মুখ বোচা করে বলল,
‘পরিবার তো পরের অধ্যায় আগে ঐ তূবাটাকে তো রাজি করাই? জীবন্ত চিংড়ি মাছের মতো ছটছট করে লাফ মারে। কিছু বলাই যায় না। বললেই সাপের মতো ফস করে ওঠে।’
‘সেটা কী স্বাভাবিক না?’
‘স্বাভাবিক কেন হবে? আরে বাবা, এত সুন্দর হিরোর মতো দেখতে ছেলেটা তোকে পছন্দ করে, কোথায় আইসক্রিমের মতো গলে যাবি, তার সাথে প্রেম করবি কিন্তু না পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। নিজের মনটাকে তো পাথর করেছেই, সাথে আমাকে দেখলেই সেই পাথর ছুড়ে মারে। বজ্জাতের হাড্ডি। ভালো মানুষের কদর বু্ঝে না। আরে আমার মতো প্রেমিককে মানুষ কদরের রাতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে চায়। আর তুই না চাইতেই পেয়ে গেলি, কোথায় মাথায় তুলে নাচবি তা না করে তাচ্ছিল্য করছিস। ঘি আর গরম ভাত কি সবার কপালে জোটে? আমি হলাম গরম ভাত আর আর খাঁটি ঘি সাথে বগুড়ার খাঁটি দই। বগুড়ার খাটি দইকে নষ্ট দুধ ভেবে ফেলে দিচ্ছিস। পরে মজা বুঝবি।’
বর্ষণ এবার হেসে ফেলল। হেসে বলল,
‘তোকে তো আমার বরং ফেটে যাওয়া দুধ মনে হচ্ছে।’
‘শোনো ভাইয়া, ফেটে যাওয়া দুধ থেকেই রসোগোল্লা হয়। রস টুপ টুপ করে পড়ে। রসোগোল্লার মতো মজার কিছু আছে?’
বর্ষণ এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
‘তোকে ছোটোবেলা থেকে যত সোজা করতে চেয়েছি তুই তত বাঁকা হয়েছিস। তবুও তোর কাজগুলো ভালো লাগত। কিন্তু তোর এবারের কাজে ভালো লাগছে নাকি খারাপ, সেটা বুঝতে পারছি না। কিন্তু ভয় অবশ্যই লাগছে। আমাদের পরিবারের বিষয়টা না হয় আমি আর কথা কোনোমতে সামলে নিলাম কিন্তু তূবার পরিবারকে কী করে সামলাবি? তূবার বাবা নিজেই তো ভোলডেমর্টের। কখন কাকে কামড়াবে সে আশায় থাকে।’
শ্রাবণ জিব কামড়ে বলল,
‘ছি! ছি! ভাই আমার শ্বশুরকে এমন বিচ্ছিরি ভিলেনের নামে অব্যাহিত করিস না।’
‘তাহলে কি থেনোস বলব?’
‘ছি! ছি! তুমি বরং তাকে গব্বর সিং বলতে পারো।’
‘এর চেয়ে তো থেনোস বেটার ছিল। এটলিস্ট মেয়েদের কাঁচ ভাঙার উপর নাচাইতো না। দুনিয়ার অর্ধেক জীবন খতম করে দুনিয়াকে নতুন রূপ দিতে চেয়েছিল। সে-ও আমাদের অর্ধেক জমি গ্রাস করতে চাইছে।’
অতঃপর দুই ভাই একসাথে শব্দ করে হাসল।’
বর্ষণ বলল,
‘ব্যাপারটা নিয়ে যতই হাসিস না কেন তারিক চাচা তোদের সম্পর্কের কথা জানলে, তূবাকে কিছু পরে বলবেন আগে তোর লাশটা নদীতে ভাসাবেন।’
শ্রাবণ মুখ গোমড়া করে বলল,
‘ভালোবাসা এত হিসাব করে হয় নাকি?’
বর্ষণ শ্রাবণের মাথায় চড় মেরে বলল,
‘ধূর! তোকে বোঝানো বৃথা। ছাগল একটা। বাংলা মুভি দেখে দেখে সারাক্ষণ বাংলা মুভির ডায়লগবাজি করোস। আমি বাবাকে সবটা বলছি। তারপর যা করার তিনি করবে।’
শ্রাবণ, বর্ষণের হাত ধরে বলল,
‘বড় ভাই হয়ে ছোটো ভাইকে এমন বিপদে ফেলতে পারবা তুমি? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?’
‘ভালোবাসি বলেই, চাই না তোর কোনো বিপদ হোক।’
শ্রাবণ মাথা নিচু করে রইল।
২২!!
সন্ধ্যার পর থেকে কথার শরীরটা প্রচন্ড খারাপ। বেশ কয়েকবার বমি করে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। নিহাদ ওর পাশে বসে আছে। হঠাৎ কথার এত বমি হওয়ার কারণ কেউ ধরতে পারছে না। কথা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
নিহাদ পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘কথা!’
খুব আস্তে করে কথা বলল,
‘হুম।’
‘এখন কেমন লাগছে?’
‘একটু ভালো।’
‘আরেকটু লেবুর শরবত দিব?’
‘নাহ।’
‘তাহলে কিছু খাবে?’
‘নাহ।’
‘হঠাৎ এত বমি করছো কেন?’
‘কথা নিশ্চুপ।’
প্রশ্নটা করে নিহাদ কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
‘গত দুই মাস যাবত তোমার সাইকেল ঠিক নেই। কথা, আর ইউ প্রেগনেন্ট?’
কথা খানিকটা চমকে উঠল। তারপরও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,
‘না।’
‘টেস্ট করিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘রেজাল্ট কি?’
‘নেগেটিভ।’
নিহাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘হসপিটালে গিয়ে একবার চেকাপ করাবে?’
‘কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি। তাছাড়া তুমিই বলেছিলে গ্রাজুয়েশনের আগে বাচ্চা নিবে না।’
‘হুম। কিন্তু হঠাৎ কদিন যাবত তোমার শরীরটা খারাপ লাগছে দেখে বললাম।’
কথা মনে মনে বলল,
‘আমি তোমাকে বলব না আমাদের সন্তানের কথা। একদম বলব না। তোমাকে শাস্তি দিব কঠিন শাস্তি। তোমাকে সেদিন জানাব যেদিন এ ভ্রুনটাকে আমি এবরশন করে ফেলে দিব। কোনো চরিত্রহীন লোক আমার সন্তানের বাবা হতে পারবে না। এ সন্তানকে আমি পৃথিবীতে আসতেই দিব না।’
আসছে আমার নতুন বই “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”।
এছাড়া আমার ছয়টা বই: ঘর, সংবৃত, কিছু সাদা টিউলিপ, তোমায় নিয়ে, সমান্তরাল বাঁধন, সমীকরণের মিশ্রণ পাচ্ছেন রকমারি সহ যে কোনো অনলাইন বুকশপে। এছাড়াও আমার দুটো ই-বুক: শেষ পাতা, একদিন বিকালে সকাল হয়েছিল, পাচ্ছেন বইটই এ্যাপে।
এছাড়া বিস্তারিত জানতে আমাকে নক করুন।
চলবে…