#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৯
১২!!
সিনথিয়া, নিহাদকে দেখে সামনে গিয়ে সালাম করল,
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
বিরক্তি মাথা কণ্ঠে নিহাদ জবাব দিলো
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
‘স্যার, কি বাসায় যাচ্ছেন?’
‘কেন?’
‘আমাকে একটু লাইব্রেরীর সামনে লিফ্ট দিতেন।’
নিহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘বেশি বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু।’
‘শুরুটা কে করেছিল? প্লিজ স্যার লিফ্ট দিন।’
‘অসম্ভব!’
‘কথাকে তো রোজ লিফ্ট দেন।’
‘কথা স্টুডেন্ট শুধুমাত্র ভার্সিটিতে। বাকি সময় ও আমার স্ত্রী, ওর সাথে যা ইচ্ছা করার অধিকার আছে আমার।’
‘একদিন হয়তো আমিও আপনার সাথে যা খুশি করার অধিকার রাখব।’
‘সেদিন জীবনে আসবে না। সবসময় নিজেকে লিমিটের মধ্যে রাখো।’
‘আমার লিমিট আমি জানি। কথার চেয়ে বেশি।’
‘কোথায় বিশাল সমুদ্র আর কোথায় পচা ডোবা? তোমার পাশে দাঁড়ালেও গন্ধ আসে। খবরদার নিজেকে আমার কথার সাথে তুলনা করবে না। আমার কথা বিশাল সমুদ্র আর তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে র্নিলজ্জ প্রাণী শুকরের চেয়েও অধম আমার নিকট।’
নিহাদ আর সেখানে দাঁড়াল না। বাইক নিয়ে চলে যায়। বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
‘হে সৃষ্টিকর্তা আমাকে রক্ষা করো এই মেয়ের যন্ত্রণা থেকে।’
তূবা, কথাকে ওর ভাইয়ের করা মেসেজগুলো দেখাচ্ছিল। শ্রাবণের মেসেজ পড়ে কথা হাসতে হাসতে বলল,
‘বাহ্! ভাই দেখছি আমার খুব বুদ্ধিমান? এমন করে বললে তো যে কোনো মেয়ে পটে যেত তুই কেন পটছিস না বলতো?’
তূবা রাগ করে বলল,
‘আমি যে কোনো মেয়ে?’
‘ওরে গাধি আমি বলতে চেয়েছি অধিকাংশ মেয়েরা এমন টাইপ কথায় গলে যায় তুই কেন গলছিস না?’
‘আমি কি মোমবাতি আর তোর ভাই আগুন যে কিছু বললে বা কাছে আসলে গলে যাব?’
‘আমার ভাই আগুন-ই তো? দেখছিস না কেমন দেখতে। লম্বা, ভীষণ ফর্সা, একটু চিকনা বাট বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের পর চিকনা ছেলে মেয়ে মটু হয়ে যায়। কথাটা বলে কথা চোখ টিপল।’
তূবা দুম করে কথার পিঠে কিল বসিয়ে বলল,
‘কি সব অশ্লীল ইশারা দিচ্ছিস।’
কথা নিজের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘আরে অশ্লীল কী বলছি? আমাকে আর নিহাদকে দেখ বিয়ের আগে আমি কত শুকনা ছিলাম, গায়ের রঙও তখন শ্যামলা লাগত। এখন দেখ একটু গলুমলু হয়েছি, সাথে বেশ ফর্সাও। আর নিহাদও তো চিকন ছিল, এখন স্বাস্থ্য দেখ কত ভারী। ওকে দেখলেই আমার গায়ে কাটা দেয়।’
তূবা রাগ করে বলল,
‘ব্যাপারটা তোর আর ভাইয়ার না। ব্যাপারটা হচ্ছে তুই আমাকে ঐ গাধাটাকে বিয়ে করতে বলছিস। বিয়ের পর মোটা হবারও কথা বলছিস। তোরা বিয়ে করে মোটা হয়েছিস ভালো কথা, আমাকে কেন তোর ভাইয়ের সাথে টানছিস?’
‘একটু টানলাম না হয় কী সমস্যা?’
‘আমার কিন্তু রাগ উঠতাছে, কথা?’
‘আচ্ছা সরি রাগ করিস না। চল ক্লাসে। আজ আমার জামাইর ক্লাস আছে।’
‘হ্যাঁ, তোমার জামাই তো তোমারে ক্লাসে বসে চিনেই না।’
‘আর বাড়ি বসে কাছ ছাড়া করে না। ইদানিং যা বিরক্ত করে তা কী বলব?’
‘কেনরে?’
‘কে জানে? সারাক্ষণ ফেবিকলের মতো চিপকে থাকে। ইদানিং র্নিলজ্জও হয়েছে বেশ। বাবা-মা এর সামনে বসে হুটহাট জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়। লজ্জায় আমার তখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা।’
তূবা হেসে বলল,
‘আহা! দুলাভাই আমার কত্ত রোমান্টিক।’
‘রোমান্টিকতার এ হ্যাপা তো সবসময় নেওয়া যায় না।’
তূবা হেসে বলল,
‘বিয়ের পর তো এমনি এমনি তুই মোটা আর ফর্সা হোসনি? আমার তো মনে হয় এই রোমান্টিকতার বদৌলতে হয়েছি।’
কথার গাল লাল হয়ে গেল। লজ্জায় লাল হয়ে বলল,
‘চুপ।’
সিনথিয়াও ওদের কথা শুনছিল। কথাকে বলল,
‘নিহাদ স্যার বুঝি, অনেক রোমান্টিক?’
কথা, তূবা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘সিনথিয়া, তুমি কি আমাদের কথা শুনছিলে?’
‘একটু আধটু। সরি ফর দ্যাট। তোমরা নিহাদ স্যারকে নিয়ে বলছিলে তো তাই।’
কথা হেসে বলল,
‘আমারা মোটেও নিহাদ স্যারকে নিয়ে বলছিলাম না, আমরা কথা বলছিলাম আমার বরকে নিয়ে।’
সিনথিয়া বলল,
‘একই কথা হলো।’
তূবা বলল,
‘একই কথা কীভাবে?’
‘স্যার আর কথাকে কখনও ক্লাসে বা ভার্সিটিতে বসে তেমন কোনো আচরণ করতে দেখেছো কখনও?’
‘না। তবে যতই স্যার ছাত্রী হোক ওরা স্বামী স্ত্রী এটা তো সত্যি?’
কথা বলল,
‘তা অবশ্য ঠিক।’
সিনথিয়া বলল,
‘কথা তোমাদের লাভ ম্যারেজ নাকি এ্যারেঞ্জ?’
‘দুটোই। নিহাদের লাভ, আমার এ্যারেঞ্জ।’
‘কীভাবে?’
‘তূবা যখন ইন্টারে পড়ত তখন নিহাদ স্যার ওকে প্রাইভেট পড়াতেন ওদের বাসায় এসে। ওদের বাসায় আমার সবসময় যাওয়া আসা হতো। সেখান থেকেই নিহাদ আমাকে ভালোবেসে ফেলে তারপর সোজা নিজের পরিবার নিয়ে আমাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসে। আমার পরিবারেরও নিহাদকে পছন্দ হয়। তার কিছুদিন পর বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয়।’
সিনথিয়া বলল,
‘একটা কথা বল কথা, তূবাকে তুখোর সুন্দরীদের কাতারে অনায়াসে ফেলা যায়। আর সেখানে তুমি শ্যামলা গরনের মেয়ে। তো নিহাদ স্যার তূবার মতো ভুবন ভোলানো সুন্দরী ছেড়ে তোর মতো মেয়েকে কেন ভালোবাসলো?’
তূবা বলল,
‘এটা কোন ধরণের নীচু কথা সিনথিয়া? পৃথিবীতে সৌন্দর্যই সব না। মানুষের মন চরিত্রেরও একটা ব্যাপার আছে। আর তুই যে চোখে কথাকে দেখছিস সে চোখে স্যার দেখেননি। তিনি কথাকে ভালোবেসেছেন মন থেকে, মন দেখে। স্যার আর কথার সংসার, সম্পর্ক তোর আমার ধারণার বাইরে সুন্দর। আর নিহাদ স্যার সর্বদা আমাকে ছোটো বোনের নজরে দেখেন। আমি এত সুন্দর বলেও কখনও শালীকার মতো দুষ্টুমি করেননি। সবসময় বোনের মতো স্নেহ করেন, শিক্ষক হলেও অভিবাবকের মতো শাসন করেছেন। বড় ভাইয়ের মতো যে কোনো বিপদে পাশে থেকেছেন। তার চোখে কখনও আমার জন্য বাজে কোনো কিছু দেখিনি। আমার দেখা অনেক ভালোমানুষের মধ্যে তিনি একজন।’
সিনথিয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘স্যারের প্রশংসায় দেখছি তোরা পঞ্চমুখ।’
‘তো প্রশংসা করার মতো মানুষের প্রশংসা করব না?”
সিনথিয়া বেশ রাগ করে বলল,
‘শোন, মানুষ নিজেকে যতটা ভালো প্রদর্শন করে ততটা ভালো হয় না। তার মনটা কেবল সে-ই জানে।’
কথা বেশ রাগ করে বলল,
‘নিহাদকে নিয়ে তোর প্রবলেম কী বলতো? সবসময় দেখছি উল্টা পাল্টা কথা বলছিস?’
‘আমার কী প্রবলেম হবে? আমি তো জাস্ট বলছি মানুষকে চেনা এতটাও সহজ না।’
কথা বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীকে চেনা অতটাও কঠিন না।’
‘ওহ আচ্ছা।’
সিনথিয়া যেতে নিলে তূবা বলল,
‘সিনথিয়া, নিহাদ স্যারকে নিয়ে তোর প্রবলেম কী?’
‘আমার আবার কী প্রবলেম হবে?’
‘তুই তার বিষয়ে খুব কৌতুহলী। সেদিনও নাকি কথার সাথে কি কি বলেছিস, আজ আবার বলছিস। মানে সব কিছু ঠিক আছে তো?’
‘ঠিক থাকবে না তো কী হবে?’
তূবা খোঁচা মেরে বলল,
‘স্যারের প্রেমে পড়ে যাসনি তো আবার?’
সিনথিয়া খানিকটা রাগ করে বলল,
‘কী যা তা বলছিস?’
তূবা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘না মানে যেভাবে সবসময় স্যারের কথা জানতে চাস। তাই আরকি বললাম।’
সিনথিয়া কিছুটা সময় চুপ রইল। তারপর বলল,
‘তেমন কিছু না। আমি এমনি জানতে চাই। স্বামী-স্ত্রী, স্যার আর ছাত্রী, তা-ও একই ভার্সিটির এমন খুব কম দেখা যায়। তাই কিউরিসিটি হচ্ছিল। তাছাড়া মিথ্যা বলব না, নিহাদ স্যারকে আমার ভালো লাগে। তিনি দেখতে তো হিরোর চেয়ে কম না। চোখে ভালো লাগে এমন সুন্দর। তো তাকে সাধারণভাবে ভালোলাগাটা নিশ্চয়ই অন্যায় কিছু না?’
কথা বলল,
‘অন্যায় কেন হবে? যার যার ভালোলাগা তার তার কাছে। তবে ব্যাপারটা ভালোলাগা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখিস। কারণ শত হোক স্যার বিবাহিত।’
‘হুম জানি।’
সিনথিয়া চলে যেতেই তূবা বলল,
‘ওর দিকে বিশেষ নজর দিবি। ওর কার্যকলাপ ভালো ঠেকছে না।’
কথা বলল,
‘আরে বাদ দে।’
১৩!!
কথার মাইগ্রেনের সমস্যাটা খুব বাজে আকার ধারণ করছে। ডাক্তার ওকে বেশ কিছু নিয়ম নীতি অনুসরন করতে বলেছিল কিন্তু কথা ডাক্তারের কথা একদম মেনে চলে না। তা নিয়ে নিহাদ প্রচন্ড রাগ করে আছে। নিহাদ কতক্ষণ যাবত বকবক করছে কথা চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছে। নিহাদ রাগ করে বলল,
‘কথা, তোমাকে আর কীভাবে বুঝাবো বলো? তুমি ছোটো বাচ্চা নও যে নিজের খেয়াল রাখতে বারবার বলব। সারাদিন এত ব্যস্ত থাকার পরও বারবার তোমাকে কল দিয়ে ওষুদের কথা মনে করিয়ে দিতে হয় কেন? ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করো না, ওষুধ খাও না। কী হয়েছে কী?’
কথা বিড়বিড় করে বলল,
‘আজ সব মাস্টারগিরি ঝাড়বে এখন।’
নিহাদ রাগ করে বলল,
‘কী বললা?’
‘না না কিছু না।’
‘দেখো কথা, আমাকে খবরদার রাগাবে না।’
‘রাগ করার আর বাকি রাখছো কি?’
‘দেখবা?’
‘হ্যাঁ।’
‘কান ধরো।’
‘কী বললা?’
‘বলছি কান ধরো।’
‘দেখো নিহাদ তোমার স্যারগিরি খবরদার বাসায় দেখাবে না। এখানে বস আমি।’
নিহাদের হাসি পেলো কিন্তু নিজের রাগ বজায় রেখে ধমক দিয়ে বলল,
‘কান ধরো।’
কথা রাগে নিহাদের কান ধরে টেনে দিলো, চুল ধরে, নাক ধরে টেনে দিয়ে বলল,
‘আসছে স্যারগিরি দেখাতে। এখানে তোমার স্যার, ম্যাডাম, বস সব আমি। এখানে স্যারগিরি দেখালে একদম স্বামীর চাকরি দেখে বরখাস্ত করে দিব।’
নিহাদ অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
‘পুরুষ যত বড় লেভেলে জব করুক না কেন, বউয়ের কাছে দুই টাকার দামও পায় না।’
কথা নিহাদের চুল আবার টেনে বলল,
‘এই কথাটা আগে মনে ছিল না। আসছে কান ধরাতে।’
‘মনে রেখ, কাল ক্লাসে কান ধরাব।’
‘কাল ক্লাসে কান ধরালে রাতে তোমার চুল একটাও থাকবে না তুমিও মনে রেখ।’
নিহাদ চুপ করে বসে রইল। কথা ওর পাশে বসে গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বলল,
‘রাগ করছো?’
‘একটা চুমুতে রাগ আর চুলের ব্যথা কোনোটাই কমবে না।’
কথা হেসে নিহাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মাঝে মাঝে তুমি মেঘের মতো হুট করে রঙ বদলাও। এই কালো মেঘ তো এর খিলখিলিয়ে রোদ। তবুও তোমার সব রূপকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।’
‘এভাবেই সারা জীবন ভালোবাসবে তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওয়াদা?’
‘ওয়াদা।’
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব:১০
নিহাদ কথাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ভালোবাসি।’
‘আমিও।’
কিছুটা সময় নীরবতায় কাটানোর পর নিহাদ বলল,
‘কথা?’
‘হুম।’
‘যদি কখনও তোমার বিশ্বাস ভাঙার মতো কাজ করি। তাহলে ক্ষমা করতে পারবে আমায়?’
‘না।’
নিহাদ খানিকটা হতাশ কণ্ঠে বলল,
‘কেন পারবে না? অনেক সময় মানুষ তো ট্রাপে পড়েও কত বিশ্বাস ভাঙার মতো কাজ করে?’
‘তুমি তো ইমম্যাচিওর নও নিহাদ। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তোমাকে ট্রাপে ফেলা এতটা সহজ না।’
‘তবুও কেউ ট্রাপে ফেলল, আমি তোমার বিশ্বাসে আঘাত করলাম, তখন কী করবে?’
‘আমি ভেঙে যাব। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যাবে আমার মনটা। আমি তোমাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি পজেসিভ। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া তুমি। তোমাকে নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র ছাড় দিব না।’
নিহাদ শক্ত করে কথাকে জড়িয়ে ধরল। ও ভেবেছিল কথাকে সিনথিয়ার ব্যাপারে সবটা খুলে বলবে। কিন্তু কথার কথা শুনে সেটা বলার মতো সাহস হলো না। নিহাদ, কথার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘আমি তোমাকে হারাতে চাই না। কোনো কিছুর বিনিময়ে না। তোমাকে পেতে চাই শুধু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। তার জন্য যদি সারাজীবন সত্যি লুকিয়ে মিথ্যা বলতে হয়, তা-ও বলব।’
১৪!!
তূবা নিজ থেকে শ্রাবণকে কল করল। শ্রাবাণ বারবার চোখ কচলে দেখতে লাগল সত্যি তূবার কল কি না? যখন থেকে শ্রাবণ, তূবাকে নিজের অনুভূতির কথা বলেছে, তখন থেকে তূবা শুধু ওকে এড়িয়েই চলে না, বরং সহজে কথাও বলে না। মাঝে মাঝে ফোনে টুকটাক মেসেজ দেওয়া নেওয়া হয়। এছাড়া ভার্সিটিতে গেলে দু এক মিনিট হয় তা-ও যখন শ্রাবণ নিজে সেধে বলে। রোজ তো ভার্সিটিতে দেখাও হয় না। ওদের দুজনার ক্লাস রুটিন আলাদা। সপ্তাহে দুই দিন কি একদিন মাঝে মাঝে দেখা হয়। আগে অবশ্য তূবা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কাজে ওদের বাসায় আসত। এখন আর কথা বেড়াতে না আসলে আসে না। আগে দেখা যেত কথা শ্বশুরবাড়ি থাকলেও তূবা প্রায়ই কথার মায়ের সাথে এসে গল্প করত কিন্তু শ্রাবণের ওর প্রতি অনুভূতি জানার পর থেকে আসে না। তূবার কল দেখে শ্রাবাণ এতটা উত্তেজিত হলো যে, কল রিসিভ করার বদলে উল্টা কেটে দিলো। শ্রাবণ কল কেটে নিজের গাধামিতে নিজেই নিজেকে বকা দিতে দিতে তূবাকে কল করল। তূবা সাথে সাথেই কল রিসিভ করে বলল,
‘শ্রাবণ।’
শ্রাবণ ওর পুরো কথা না শুনে বলল,
‘সরি ভুলে কল কেটে গেছিল।’
‘কোথায় তুই?’
‘এই তো একটু মোড়ের দোকানে।’
‘ব্যস্ত?’
‘না, বলো।’
‘সদর হাসপাতালে আসতে পারবি?’
কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতেত শ্রাবণ বলল,
‘সব ঠিক আছে?’
‘হ্যাঁ। তুই একটু দ্রুত আয়। সাইকেল নিয়ে আসিস না।’
‘আচ্ছা। আধাঘন্টার মধ্যে আসছি।’
শ্রাবণ রিকশা নিয়ে দ্রুত সদর হাসপাতালে চলে গেল। তারপর তূবার বলা রুমে গিয়ে দেখল তূবা একটা স্টেচারে শুয়ে আছে। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ, মাথায় ব্যান্ডেজ। শ্রাবণ বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল,
‘কী হয়েছে তোমার?’
‘তেমন কিছু না। রিকশা থেকে পড়ে গেছিলাম।’
‘কীভাবে?’
‘রিকশা একটা ভাঙা খাদে পড়ে গেছিল। আমি, রিকশা এবং রিকশাওয়ালা তিনজনই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি।’
‘কোথায় কোথায় লাগল?’
‘পা মচকে গেছে, হাতের কনুই ছিলে গেছে, মাথা হালকা ফেটে গেছে। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই কোথাও ভাঙেনি কিংবা সেলাই লাগেনি।’
শ্রাবণ, তূবার পাশে বসে বলল,
‘খুব কষ্ট হচ্ছে?’
‘একটু।’
শ্রবাণ, তূবার দিকে ভালো করে তাকাল।
ফর্সা মুখটা যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে। যন্ত্রনায় চোখ মুখও বসে গেছে কিন্তু তবুও চেহারায় কি মুগ্ধতা। তূবা, শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
‘ছেলেটা আমার দিকে সবসময় এমন মুগ্ধতার চোখে তাকিয়ে থাকে কেন? ও কি বুঝে না ওর এ চাহনী আমার হৃদয় নাড়িয়ে দেয়? তূবা, শ্রাবণের চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
‘হাবার মতো চেয়ে আছিস কেন?’
‘হাবা কি?’
‘বলদ যে, তারে সুন্দর ভাষায় হাবা বলে।’
শ্রাবণ বিড়বিড় করে বলল,
‘আমি হাবা বলদ হলে তুমি আমার বলদি।’
‘কী বললি?’
‘কিছু না।’
তখন রুমে ডাক্তার ঢুকলেন। তূবাকে বললেন,
‘আপনার রিলেটিভ এসেছে?’
তূবা, শ্রাবণকে দেখিয়ে বলল,
‘জি এই যে।’
‘কী হন আপনার?’
‘আমার ছোটো ভাই।’
ছোটো ভাই পরিচয় দেওয়ায় শ্রাবণ মনে মনে বেশ কষ্ট পেল। মনে মনে বলল,
‘আমি তোর কোন জন্মের ভাই লাগিরে? দূর সম্পর্কের কাজিন। কাজিন মানেই কি ভাই? শয়তান মেয়ে সবসময় আমাকে হেনস্তা করার জন্য তৈরি থাকে।’
ডাক্তার বলল,
‘আপনি এখন যেতে পারেন। মিঃ নিহাদ আপনার সব বিল পে করে দিয়েছে।’
‘আচ্ছা।’
শ্রাবণ বলল,
‘নিহাদ ভাই এসেছেন?’
‘তুই আসার কয়েক মিনিট আগে আসলেন। এ্যাকসিডেন্ট করে প্রথমে চাচা আর কথাকে কল করেছিলাম তাদের না পেয়ে তোকে কল করলাম। বাবা শহরের বাইরে। তাকে এসব এল টেনশন দিতে চাই না। তোকে কল করার পরই কথার কল আসে। ও তো আসতে পারেনি তাই স্যারকে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া আমার কাছে টাকাও ছিল না তেমন। হসপিটালের বিল তো নিহাদ স্যারই পে করলেন। তোকে লজ্জায় টাকার কথা বলতে পারিনি। কথাকে সবটা বলার পর ওর স্যারে পাঠালো। ওর শরীরটা ভালো নেই নয়তো নিজেই আসত।’
শ্রাবণ মনে মনে বলল,
‘তাহলে আর আমি এসে কী করব?’
তূবার দিকে তাকিয়ে বেশ রাগী কণ্ঠে বলল,
‘আমার কাছে টাকা চাইতে লজ্জা কেন করবে? এক্ষুনি তো ছোটো ভাই বানিয়ে দিলে?’
তূবা ঠোঁট টিপে হাসল। নিহাদ এসে শ্রাবণকে দেখে বলল,
‘কিরে তুই কখন আসলি?’
‘মাত্র।’
‘আচ্ছা তাহলে তূবাকে বাড়ি নিয়ে যা। আমার কাজ আছে।’
শ্রাবণ বেশ খুশি হয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
নিহাদ চলে যেতেই শ্রাবণ বলল,
‘হাঁটতে পারবে?’
‘একটু সাহায্য কর।’
‘কীভাবে?’
‘হাত ধরে।’
শ্রাবণ, তূবার হাত ধরে ওকে হাঁটতে সাহায্য করল। নিহাদ দূর থেকে দেখে বলল,
‘দু’টোতে মানিয়েছে বেশ। এখন দু’জনার পরিবার সেকেলে বয়সের গোড়ামি ধরে না রাখলে হয়।’
শ্রাবণকে দেখে নিহাদ ইচ্ছা করেই চলে গেল, যাতে ওরা নিজেদের মতো করে একটু সময় পায়। নিহাদ মনে মনে বলল,
‘শ্রাবণ ভালো ছেলে, তূবাকে ভালো রাখবে। কিন্তু তূবার পরিবার নিয়ে একটু টেনশন হচ্ছে। কথার বাবা-মাকে তো আমিই রাজি করাতে পারব কিন্তু তূবার বাবা মানবে বলে হয় না। তবে ওদের ভালো থাকার অধিকার আছে। দু’জনেই বেশ ভালো।’
নিহাদ বাইক নিয়ে চলে গেল। শ্রাবণ, তূবার হাত ধরে রিকশায় উঠতে হেল্প করল। রিকশায় ওঠার পর শ্রাবণ যথা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখতে চাইল। চেষ্টা করল যাতে তূবার সাথে ওর শরীরের স্পর্শ না লাগে। তূবা বিষয়টা বুঝতে পেরে শ্রাবণকে একটা ধমক দিয়ে বলল,
‘কী সমস্য? কুইচ্চার মতো মোড়াচ্ছিস কেন?’
‘না মানে। তুমি সব কিছুতে রাগ করে। যদি তোমার সাথে ঠেসে বসলে যদি রাগ করো।’
‘ঠিকভাবে বস। এখন কি তুই-ও রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙবি? তোকে কে সামলাবে? আর আমার কাছে তোকে ডাক্তার দেখানের মতো টাকা নেই। ঠিকভাবে বস আর আমার কাঁধে হাত রাখ। আমার মাথা ঘোরাচ্ছে, যে কোনো সময় পড়ে যেতে পারি।’
শ্রাবণ, তূবার কাঁধে হাত রাখল। তূবা খেয়াল করল, শ্রাবণের হাত কাঁপছে। শুধু তাই নয় শ্রাবণও ঠকঠক করে কাঁপছে সাথে ওর কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তূবার এত হাসি পেল। তবুও নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
‘মৃগী রোগির মতো কাঁপছিস কেন? স্বাভাবিকভাবে বস।’
শ্রাবণ ফিসফিস করে বলল,
‘তুমি বুঝতে পারছো না আমার অনুভূতি। আমার মনে হচ্ছে, আমি আগুনের গোলার পাশে বসে তার উপর হাত রেখেছি। ভিতর থেকে জ্বলে পুরে ছাড়খার হচ্ছি আর একটু হলেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাব। ইশ! তোমাকে যদি আমার ভিতর দেখাতে পারতাম। তাহলে বুঝতে পারতে তোমাকে ভালোবেসে, তোমার ভালোবাসার আগুনে জ্বলে কতটা দগ্ধ আমি।’
রিকশা চলছে নিজ গতিতে। তূবা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘আমাকে তুই ভয় পাস কেন?’
শ্রাবণ রাগী কণ্ঠে বলল,
‘তখন ডাক্তার কাছে বললা না ছোটো ভাই। তো ছোটো ভাই ভয় পায় না?’
তূবা হেসে বলল,
‘কথাটায় মাইন্ড করছিস?’
‘তো করব না? আমি মোটেও তোমার ছোটো ভাই না।’
‘একশবার তুই আমার ছোটো ভাই। ছোটো বেলায় তোকে ল্যাংটু কত কোলে নিছি। এখন বড় হয়ে আমার পিছনে ট্যাংকি মারছিস।’
শ্রাবণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘মুখে খুব বাজে একটা কথা আসছিল কিন্তু বললাম না।’
তূবা বলল,
‘বল, শুনি তোর বাজে কথা।’
শ্রাবণ, তূবার কানে কাছে মু্খ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘তুমি চাইলে এখনও ছোটো বেলার মতো দেখতে পারো।’
তূবার কান গরম হয়ে গেল। লজ্জায় কান দিয়ে ধোয়া উঠছে। শ্রাবণের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
‘আর একটা কথা বললে রিকশা থেকে লাত্থি মেরে ফেলে দিব।’
‘হুহ সত্যি কথা বললেই হাজি সাহেবের মুখ খারাপ। যত দোষ তখন তার।’
অতঃপর বাকিটা পথ দুজন কথা না বলেই চুপচাপ চলে গেল।
আমার নতুন বই আসছে “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”। দোয়া করবেন।
চলবে…