অলীকডোরে চন্দ্রকথা পর্ব-৪+৫

0
193

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ঋতুতে বর্ষার আগমন ঘটেছে দিন তিনেক হলো। অথচ বৃষ্টিকন্যার দেখা নেই। দুপুর, বিকেল সাঁঝ লগ্ন পেরিয়ে নুপুর পায়ে টাপুর টাপুর শব্দ তুলে বৃষ্টিকন্যা এলো এই সাত সকালে। সৈকত তখন শেখ বাড়ির দরজায়। পকেটে হাত গুজে আশপাশ পরখ করছে।
পুরো বাড়িতে কেবল মুনের উপস্থিতি বলে ভেতরে যায়নি সৈকত। অস্বস্তি লাগছে তার। মুনকে ম্যাসেজ করে বেরুতে বলে গেইটের বাইরে অপেক্ষা করছে। মিনিট দুয়েক হয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নকন্যা এলো না। এলো বৃষ্টিকন্যা। অকালবর্ষণে চমকে গেল সৈকত, এক চটা বৃষ্টি এসে পড়ল তার মুখে, গায়ে।

শেখ বাড়ির গেইটটা বিশাল। পুরনো আমলের বাড়ি। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি উঁচু পিলারের ছাদনাতলা। মাঝে লোহার গেইট। সৈকত তড়িঘড়ি করে গেইটের নিচে আশ্রয় নিল। কপালে বিরক্তির ভাঁজ টেনে টি-শার্ট ঝাড়তে লাগল। বৃষ্টিটাকে এখুনি আসতে হলো! একে তো ভোর, তারউপর বৃষ্টি। ফিরতি পথে বেশ কসরত করতে হবে। ওর বিরক্তিলগ্নে বৃষ্টিকন্যার সাথে দৃশ্যমান হলো স্বপ্নকন্যা। খট করে গেইট খোলার শব্দে ফিরে তাকাল সৈকত। সেই পলকে আটকাল সে।

সদ্য ঘুমভাঙা নারীর মুখখানা বড়োই মায়াবী লাগে। ঘুমজড়ানো ফোলা চোখ, শুস্ক ঠোঁটে একটা আকর্ষণ কাজ করে। সৈকত এই আকর্ষণ টের পেল। কোমল চোখে চাইল এক পলক। তারপর চোখ পেরাল। মুন তাড়া দিয়ে বলল, ‘চলুন, ভাইয়া!’

বলে সৈকতের দিকে না তাকিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে তালা লাগাতে শুরু করল। ভাইয়ের চিন্তা তাকে বাকি সব ভুলিয়ে দিচ্ছে। মুখটা থমথমে। অস্থিরতায় তালা লাগাতে পারছে না সে। সৈকত এগিয়ে এসে নিজ উদ্যোগে তালা লাগিয়ে দিল। বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেছে অনেকখানি। সৈকত কোমল স্বরে বলল,
‘ এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হওয়া ঠিক হবে না। গাড়ি পাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বৃষ্টি কমলে বের হই!’

এক রত্তি দাঁড়াবার ইচ্ছে নেই মুনের। সৈকতের বেশভূষা দেখে তার অস্থিরতা বাড়ছে। নিশ্চয় বড়ো কিছু হয়েছে, নয়তো সৈকত ভাইয়া এই বেশে বের হতো! এত বছরের তো কখনো এভাবে আসতে দেখেনি। ভাইয়ের জন্য মন কাঁদছে ওর, চোখের কোণে জল জমছে। ভাইকে সে ভীষণ ভালোবাসে। না দেখা অবধি শান্তি পাবে না। মুন বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাঁটা ধরল।

ওর অবাধ্যতা দেখে হতাশ শ্বাস ফেলল সৈকত। ভাইয়ের চিন্তায় বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটা। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যেতে পারবে! গা ভিজে কেমন দেখাবে! তারউপর রাস্তায় কংক্রিটে ভরা। বৃষ্টির পানিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে। মেয়েটা উদাস হয়ে যেভাবে হাঁটছে এখনি উলটে পড়বে, তখন রুবাবের পরিবর্তে মুনকে নিয়ে দৌড়াতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা মুন এখন সৈকতের আমানত। আসবার কালে রুবাব বলেছিল,
‘আমার বোনটাকে তোর কাছে আমানত দিলাম। সহি সালামতে নিয়ে আসিস।’

দায়বদ্ধতার খাতিরে সৈকত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরুল। দ্রুত পা ফেলে মুনের কাছে গেল। তারপর খপ করে হাত ধরল মুনের। পাশের একটা গেটের চাউনিতে নিয়ে দাঁড় করাল। কিছুটা আদেশের সুরে বলল,
‘ বৃষ্টি থামা অবধি অপেক্ষা করো। আমি দেখি উবার পাই কি না।’

আদেশের সুরে বলা কথার পরে পা বাড়ানোর সাহস পেল না মুন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সৈকতের খেয়াল হলো হাতের দিকে। ও হাত ধরে আছে মেয়েটার! ঝট করে ছেড়ে দিল। অনুতপ্ত হয়ে বলল, “স্যরি!’

মুন কিছু বলল না। উদাস চোখে চেয়ে রইল বৃষ্টির পানে। সৈকত ফোন বের করে উবাব চেক করতে লাগল। মুন আকস্মিক প্রশ্ন করে বসল, ‘কাল কী হয়েছিল ভাইয়ার?’

রুবাব মুনকে এত কিছু বলেনি। শুধু বলেছে সে হাসপাতালে। বন্ধু প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গিয়ে চোর অপবাদে ধাওয়া মুত্রে ডুবেছে এটা মুনকে বলতে দ্বিধা হলো সৈকতের। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
” রাতে বেরিয়েছিল ও। এই তো এই গলির রাস্তার কংক্রিটের উপর পড়ে গেছে। ”

মুন ব্যাথাতুর চোখে চেয়ে বলল, “আমাকে না ডেকে আপনাদের ডাকল কেন?’

সৈকত ধীরে জবাব দিল, ‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে রুবাব জাগাতে চায়নি। ‘

মুনের চোখ ভরে গেল জলে। দুই এক ফোঁটা চোখ ভেদ করে গড়াল গালে। ওর মুখে বৃষ্টির চটা। বৃষ্টি ফোটা আর অশ্রু ফোটার পার্থক্য ধরতে পারল না সৈকত। অশ্রুকে বৃষ্টি বলেই ধরে নিল। টের পেল যখন অশ্রুফোটা জলপ্রপাতের মতো ঝরতে লাগল। সৈকত হকচকিয়ে গেল। সান্ত্বনাসূচক বাণী ছুঁড়ল, কোমল স্বরে,
‘ বেশি চোট পায়নি। জাস্ট আগের নখে আঘাত লেগেছে, সকালে ড্রেসিং করতে হবে বলে রাতটা রেখে দিয়েছি। চিন্তার কারণ নেই।’

সান্ত্বনায় মুনের কান্নার বেগ কমলেও বন্ধ হলো না। চোখ ভরতি জলে ভাটা পড়ল না। স্বপ্নবধূর অশ্রুভেজা চোয়াল ভালো ঠেকল না সৈকতের। সে অনুধাবন করল, মুনের কান্না তার অসহ্য লাগছে। এটা বিরক্তি নয়, এটা খারাপ লাগার অনুভূতি। তার মন কাঁদতে নয়, হাসতে দেখতে চাইছে মুনকে। সৈকত কোমল সুরে বলল,
‘ রুবাব ঠিক আছে তো! আজই রিলিজ দিবে। কাঁদছো কেন! প্লিজ কেঁদো না, চন্দ্রকথা!’

বিষাদের চাপে মুনের খেয়াল হলো না, আজও আনমনে সৈকত ওকে ‘চন্দ্রকথা’ সম্বোধন করেছে। মুন বিষন্ন হয়ে রইল। ওর এই বিষন্নতা আজ কাঁটার বিঁধল সৈকতের। সে রুবাবকে কল দিল। ফোন তুলতেই আগ বাড়িয়ে জানিয়ে দিল সে কী কী বাহানা দিয়েছে। সেই সাথে বলল,
‘ধর, তোর বোনকে বুঝা তুই ঠিক আছিস। মেয়েটা মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে।’

রুবাব স্মিত হাসল। ১৯বছর বয়সী তার এই বোনটা একটু বেশিই ইমোশনাল, তা সে বেশ জানে। বোনের এই কান্না ঠেকাতেই জানায় নি। রুবাব কোমল স্বরে কতশত বলে কান্না থামাল বোনের।

বৃষ্টি ঝাপটা কমে এলো। উবার পেয়ে ওরা হাসপাতালে চলে গেল। ঘরের বেশভূষায় একটা নারীর পাশে বসে থাকতে সৈকতের অস্বস্তি হচ্ছিল বটে। ভাইয়ের সান্ত্বনায় মুন কিছুটা শান্ত হলেও হাসপাতালে গিয়ে ভাইকে দেখেই অশান্ত হয়ে গেল । হাতে পায়ে ব্যান্ডেজে একাকার। আগে এক পা ছিল, এখন দুই পায়ে ব্যান্ডেজ়। মুন শব্দ করে কেঁদে ফেলল,
‘কী হাল করেছো নিজের! বেরুতে মানা করেছিলাম। একটা কথাও শুনোনা। আমি মা বাবাকে সব বলে দিব। ‘
অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে বকা দিয়ে গেল মুন। রুবাব হেসে বোনের মাথায় হাত রেখে বলল, ‘কাঁদছিস কেন! আমি ঠিক আছি তো!’

মুন নাক টেনে বলল, ‘আমাকে ডাকলে না কেন! সকালে উঠে তোমাকে না দেখে আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল।’

মুন একাধারে ভাইকে শাসন করতে লাগল। ডাক্তার কী বলল, কী ওষুধ দিল, ওষুধ খেয়েছে কি না! কত খোঁজ তার!
রুবাবের ঠোঁটের কোণে হাসিটা সরছে না। বোনের উদ্ধিগ্নতা দেখে কী ভীষণ ভালো লাগছে তার! পৃথিবীতে মায়ের পরে বোনেরা ছেলেদের সবচেয়ে বেশি যত্ন করে। বোনের ভালোবাসার সাথে কোন ভালোবাসার তুলনা হয় না। বড়ো হোক কিংবা ছোটো প্রতিটা ভাইয়ের জন্য বোনের অফুরন্ত ভালোবাসা আর যত্ন বরাদ্দ থাকে।

মুগ্ধ চোখে তিন যুবক দেখছে ভাই-বোনের খুনসুটিময় চমৎকার দৃশ্যখানা। সৈকতের চোখের ভাষা ভিন্ন। ওর বোন নেই। ওরা দুই ভাই। বোনের ভালোবাসা, যত্ন পায়নি। এই ক্ষণে মুনের যত্নবোধ দেখে আফসোস হলো, ওর যদি একটা বোন থাকতো তবে খুব ভালো হতো। আগে হলে সেই বোনের জায়গা মুনকেই দিতে পারতো। কিন্তু আজকাল মুন বোনের জায়গা থেকে সরে গিয়ে মনের দিকে ওগুচ্ছে। এই যে এখনো চেয়ে আছে মেয়েটার পানে, বাকি দুই বন্ধুর চেয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে। মেয়েটাকে দেখতে ভালো লাগছে ওর, বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে। ও কী চন্দ্রকথার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে! ভেতরে ঝাঁকি দিল। এটা ঠিক না। রুবাব মানবে না। সৈকত বলল,
‘আমি দেখে আসি, ডাক্তার এলো কি না।’

রুবাব বলল, ‘ সৈকত তুই বরং বাসায় চলে যা। ভিজে গেছিস, আবার ঠান্ডা লেগে যাবে। রাতে ও ঘুমাসনি, ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিস।’

সৈকত বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘ চিল! কিছু হবে না। সবাই একসাথেই যাই। ‘

বন্ধুকে এমতাবস্থায় ফেলে যেতে বড্ডো আপত্তি সৈকতের। মুন ও বলল, ‘এখন তো আমি আছি। আপনারা সবাই বাসায় চলে যান না হয়! ‘

নাহিদ বলল, ‘ আমরা থাকতে তুমি এত কষ্ট করবে কেন পিচ্চি! রুবাবের জন্য আমরা আছি, সবসময়। ওকে ফেলে কেউ যাচ্ছি না। একসাথে ফিরব।’

নির্দ্বিধায়, তীব্র অধিকারবোধ নিয়ে বলল নাহিদ। সবার চোখে চোখে ঘুম, শরীরে ক্লান্তি। নির্ঘুম রাতে ওমন দৌড়াদৌড়ির পর একটু ঘুম না হলেই নয়। তবু্ও তারা অনড়। বাকি সব গোল্লায় যাক, বন্ধুর পাশ ছাড়ছে না। রুবাব আবার মুগ্ধ হলো, ও ভুল কাউকে বন্ধু বানায়নি। ও যাদের বন্ধু বানিয়েছে, তারা পাশে থাকতে জানে, পাশে রাখতে জানে, বন্ধুত্ব জানে।

সকাল বেলা ডাক্তার এলো। চেকাপ করে, ড্রেসিং
করে রিলিজ দিল। তিনদিন বাদে আবার এনে ড্রেসিং করতে হবে। সাথে মেডিসিন দিল ।
সমস্যা বাঁধল বিদায় বেলা। রুবাব হেঁটে যেতে পারবে না। অন্তর হুইলচেয়ারের জন্য গেল, খালি পেল না। হতাশ হয়ে ফিরল। সৈকত বাঁকা হেসে বলল,
‘আয়, আমি তোরে কোলে নিই।’

রুবাব ভীত স্বরে বলল, ‘তোরে কোলে যাব না। তোর নজর আর মতলব, কোনটাই ভালা না।’

সৈকত রুবাবের ভাবভঙ্গি দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
‘আমি কোনদিন কোন ছেলেরে কোলে নি নাই। আজ তোরে কোলে নিয়ে দেখব, ছেলেদের কোলে নিতে কেমন লাগে। আয়, প্লিজ!’

রুবাব কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘দরকার হলে সারাজীবন হাসপাতালে থাইক্যা যাব। সেঁজুতিরে ডাইকা আইনা, এখানেই সংসার পাতব। জায়গায় অভাব হলে ওয়াশরুমে ডাইনিং টেবিল বসিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করব। তবুও তোর কোলে উইঠ্যা নিজেরে কলঙ্কিত করব না। ‘

থেমে বাকি দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দোস্ত আমারে বাঁচা! এই শা লা প্রেমিক প্রেমিক আচরণ করতেছে। আমার ভয় লাগছে।’

অন্তর আর নাহিদ মুখ চেপে হাসছে। মুন বোকার মতো চেয়ে আছে। অন্তর বলল, ‘রাত থেকে তোরা যা শুরু করছস। এখন ভয় আমার তোদের দুজনের উপরই লাগতেছে। ‘

নাহিদ উৎসুক হয়ে বলল, ‘রাতে কী কাহিনি হইছে? আমারে ক!’

অন্তর এবার শার্ট খোলার ব্যাপারটা রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগল। এ নিয়ে সে কী হাসাহাসি! ওরা যেন ভুলেই গেছে এখানে মুনের উপস্থিতি। আকস্মিক সৈকতের নজর পড়ল মুনের উপর। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে আছে মেয়েটা। চোখে অবিশ্বাস! মুন ওকে নিয়ে কী ভাবছে! রুবাব যেভাবে একে উপস্থাপন করল তাতে যে অর্থ দাঁড়ায় সেটা ভাবতেই কেশে উঠল সৈকত। ভীষণ বিব্রতবোধ করল। সঙ্কোচে বেরিয়ে পড়ল রুম থেকে। ওর এহেন কান্ড দেখে হুঁশ হলো সবার। মুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ইতস্ততবোধ করল। বোনের সামনে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলায় লজ্জাজনক পরিস্থিতি পড়ল রুবাব। বোকা হেসে বলল,
‘ তুই আছিস! আমি ভাবছি তুই নিচে চলে গেছিস।’

মুন ভাইয়ের দিকে অবিশ্বাসী চাহনি দিয়ে বেরিয়ে গেল। শেষ অবধি নাহিদ বন্ধুকে কোলে নিয়ে নিচে নামাল। মুনকে বাসায় পাঠিয়ে ওকে রুবাবকে নিয়ে ফিরল বন্ধুদের ফ্ল্যাটে। ভাইকে নিজ বাড়ি ছেড়ে বন্ধুদের বাসায় যেতে দিতে বেজায় আপত্তি মুনের। নাহিদ বুঝিয়ে বলল ওকে,
‘দেখো, রুবাবের শরীরের যা অবস্থা, তাতে দিন দশেক ওকে বেডরেস্ট নিতে হবে। কিন্তু ও বাসায় থাকলে রাত বিরাতে সেঁজুতির বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে। আবার হোঁচট খেয়ে বাসায় ফিরবে। আন্টি আংকেল ব্যাপারটাকে খারাপভাবে নিবেন, কষ্ট পাবেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, রুবাবের এখন সেঁজুতিদের এলাকায় যাওয়া সেইফ না। সেঁজুতির ভাই ওকে হন্য হয়ে খুঁজতেছে। হাতের নাগালে ফেলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিবে। এতে জীবন এবং ক্যারিয়ার দুটোই যাবে। তারচেয়ে ভালো আমাদের এখানে থাকুক, আমরা দেখে রাখব ওকে। কোন সমস্যা হবে না এখানে।’

মুন বুঝল পুরো ব্যাপারটা। ভাইয়ের উপর রাগ হলো, একটা মেয়ের জন্য এত পাগলামোর মানে হয়! রেগে বলল, ‘একদম শিকলে বেঁধে রাখবেন। না হয় আমাকে জানাবেন, আমি এসে বাঁধব।’
নাহিদ হাসল, ‘আচ্ছা।’

মুন নরম সুরে বলল, ‘ভাইয়া বুয়ার রান্না খেতে পারে না। আপনাদের বাসার রান্না তো বুয়া করে। ভাইয়া খেতে পারবে না। আমি ভাইয়ার জন্য খাবার নিয়ে যেতে পারব?’

নাহিদ আবার হাসল, ‘পারবে।’

মুন আবার বলল, ‘ভাইয়ার কাপড়চোপড় ও তো নেই। আপনারা একজন চলুন আমার সাথে, আমি ভাইয়ার জিনিসপত্র দিয়ে দিই।’

নাহিদ সায় জানিয়ে গেল। মুন আরও কত কী বলে বিদায় নিল। নাহিদ মুনের যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। ওর মনে পড়ল নিজের বোনের কথা। তার ছোটো বোন ও মুনের বয়সী। নাম নুহা। গ্রামের বাড়িতে থাকে বাবা মায়ের সাথে। দুমাসে একবার গ্রামে যায় সে,দিন তিনেকের জন্য। সেদিন বোনটার কত যত্ন, কত জমানো গল্প। ওর কাপড় অবধি ধুয়ে দেয়। নাহিদ ফোন বের করে নুহার নাম্বার ডায়াল করল।

__________

পরদিন সকাল সকাল হাসির শব্দে ঘুম ভাঙল সৈকতের। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বেশ বিরক্ত হলো। সেই বিরক্তির মাত্রা বাড়ল, যখন দেখল মুন বসে আছে ওর থেকে কিছুটা দূরে। এই মেয়েটা আচ্ছা জ্বালাচ্ছে তো! শয়নে স্বপনে এসে হানা দিচ্ছে। ঠিকমতো মনোযোগ বসছে না পড়ায়। দু’দিন যাবত যে রঙে ঢঙে দেখা দিচ্ছে তাতে কেবল তারই খেয়াল আছে। যেন মাথা কিনে নিয়েছে। এটাও নিশ্চয় কল্পনা! নয়তো এই সাতসকালে ওর ঘরে কী করবে চন্দ্রকথা।

আবার ঘুমে ঘোরে ডুবল। আকস্মিক চোখ খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চাইল পাশে, তারপর নিজের দিকে তাকাল। নিজের উদাম গা আবিষ্কার করে তড়িৎ উঠে বসল।

চলবে…

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-৫)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

সুরেলা হাসির শব্দে তন্দ্রা কাটবার পর চোখ মেলতেই সৈকতের সর্বপ্রথম নজরে এলো শুভ্রতার আবরণের এক স্নিগ্ধা নারীর মুখাবয়ব, প্রাণবন্ত হাসি। দূর পাহাড়ের জলপ্রপাতের মতো ছন্দে ছন্দে বাজছে হাসি। ঘুমজড়ানো ফোলা চোখের ধোঁয়াশে দৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে প্রথমে স্বপ্নই মনে হলো। আজকাল এই ললনার বাস তার শয়নে স্বপনে। হুটহাট এসে ধরা দিচ্ছে। এখনো হবে হয়তো তেমন কিছু। ভেবে আবার চোখ বুঝল। মিনিট গড়াল, আকস্মিক চোখ মেলল। উদ্ভ্রান্ত চোখে চাইল নিজের পানে, একটা শর্ট বাদে কিছুর দেখা পেল না। তারপর চট করে চাইল বাঁ দিকে। হাস্যজ্বল নারীর অস্তিত্ব তখনো রুমের অন্যপাশের ফ্লোরিং বেডে। মনোযোগ এদিকে নেই, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। মুন তবে বাস্তবে এসেছে! উদাম গায়ে ঘুমাচ্ছে সে, একটা মেয়ের সামনে! সৈকত বিব্রতবোধ করল, তড়াক করে উঠে বসল। একটা বালিশ টেনে ধরল সামনে। রুবাবের সাথে চোখাচোখি হতেই কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রুবাব দুঃখিত চাহনি দিয়ে ইশারায় রুম ছাড়তে বলল।

সৈকত অস্বস্তিতে নুয়ে হাতড়ে টি-শার্ট হাতে নিল। পরবার সময় দৈবাৎ ঘাড় ঘুরাল মুন। সৈকতের মুখটা তখন টি-শার্টের গলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। হাত গা খালি। চোখাচোখি হতেই অপ্রস্তুত হলো সৈকত। অস্বস্তি হলো মুনের ও। চট করে ফিরে গেল। সৈকত টি-শার্ট পরে দ্রুত পালাল গিয়ে পালাল রুম থেকে।

রুবাবের মুখোমুখি আরেকটা রুম । সৈকত এই রুমের দরজায় গিয়ে থেমে গেল, কী যেন পিছু চাইল। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে মুনকে। এই ক্ষণে খেয়াল হলো মুন শাড়ি পরেছে, কালো পাড়ের সাদা শাড়ি। গলায় আইডি কার্ড ঝুলানো, বোধহয় ভার্সিটিতে প্রেজেন্টেশন আছে। ভীষণ স্নিগ্ধ আর মায়াবী লাগছে মেয়েটাকে। সৈকতের হৃদস্পন্দন বেড়ে একাকার, এই ক্ষণে টের পেল মেয়েটাকে দেখতে ভালো লাগছে, মেয়েটাকে ও বোধহয় ভালো লাগে। অনুভূতিরা তীব্র হবার আগেই রুবাবের চোয়ালে চোখ গেল, পরিণতি ভেবেই দীর্ঘশ্বাস এলো। রুমে ঢুকল সৈকত।

অন্তর ঘুমাচ্ছে। নাহিদ খিচুড়ি খাচ্ছে। সৈকত কপট রেগে বলল,
“মুন এই রুমে যাবার আগে আমাকে জাগাবি না?”

নাহিদ কপাল কুঁচকে বলল, ” আমি ঘুম থেইক্যা উঠে দরজা খুলতেই পিচ্চি রুবাব কোথায় জিজ্ঞেস করে ঘরে গেছে গা। ”

সৈকতের বিব্রত মুখ দেখে থেমে বলল, “আরে চিল, ও আমাদের বোন লাগে, তাই না? কিছু মনে করব না। ”

সৈকত দিক বেদিক না ভেবে বিড়বিড় করল, “আমার লাগে না।”

নাহিদ না শুনে জিজ্ঞেস করল, “কী বললি? ”

চোখ রাঙিয়ে সৈকত বলল, “কিছু না।”

নাহিদ খাবার সাধল, “বাবার দরবার থেকে খানা এসেছে, খাবি? সেই টেস্ট!”

সৈকতের রাগ তখনো চোয়ালে, ” তোর বাবার দরবার থেইক্যা আসছে তুই খা।”

বলে অন্তরের পাশে শুয়ে পড়ল। ফজরের পর ঘুমিয়েছে। কাঁচা ঘুম ভাঙায় মেজাজ তিরিক্ষ হয়ে আছে, তার উপর বলা কওয়া ছাড়া হুট করে মুনকে ঘরে আনাও মানা যাচ্ছে না। বন্ধুর রাগ দেখে নাহিদ হাসল। খেতে খেতে বলল,
“আমার বাবার দরবার থেইক্যা আসে নাই, রুবাবের বাবার দরবার থেইক্যা আসছে। মুন রান্না করে এনেছে।”

সবে চোখ বন্ধ করেছে, মুনের কথা শুনে আবার চোখ মেলল। মুন রান্না করেছে! খেয়ে দেখতে হয় তো! খাবার প্রতি একটা আগ্রহ অনুভব করল। চট করে উঠে বসল। মুখ না ধুয়েই খেতে বসে গেল। চটজলদি বন্ধুর মতের রদবদল দেখে নাহিদ হতভম্ব হয়ে গেল।

___________

তখন মধ্যবিকেল। বন্ধুরা সব পড়ার টেবিলে। রুবাব একা বসা বেডে। বিমর্ষ, উদাস বদনে। হাতে ফোন, মন খারাপের কারণে ফোনেই আটকা পড়েছে।

দেড়টায় ভাত খেয়ে জিরিয়ে পড়তে বসে টানা তিনঘণ্টা পড়েছে। একটানা পড়ে হাঁপিয়ে গেছে সৈকত। উঠে গেল পাশের ঘরে। রুবাবের মলিন চেহারা নজরে এলে। মলিন মুখে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে রুবাব। ওকে ভীষণ হতাশ, বিষন্ন, দুঃখী দেখাচ্ছে। এতটা দুঃখী কাল হাসপাতালে যাবার সময় ও দেখায়নি। অথচ তখন তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল ওর। কী এমন ব্যাথা যা ওকে শরীরের কষ্ট থেকে ও বেশি আঘাত করছে? রুবাবকে কিছু জিজ্ঞেস না করে এগিয়ে গেল অন্তরের পড়ার টেবিলের কাছে। অন্তর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। সৈকত মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কাহিনি কী?”

অন্তর পড়া থামিয়ে ভ্রু কুঁচকাল, “কিসের?”

সৈকত রুবাবকে দেখাল। অন্তর বন্ধুকে পরখ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেঁজুতি। খোঁজটোজ পাচ্ছে না।”

সৈকত খানিক ভেবে বলল, “চল আমরা খোঁজ এনে দিই।”

অন্তর চমকাল, “কিভাবে?”

“চল, তারপর দেখবি।”

সেই ক্ষণেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল দুই বন্ধু। সৈকতের কথামাফিক গিয়ে পৌঁছল সেঁজুতির বাসার সামনে। অন্তর কিছুটা ভয়ের সাথে বলল, “সাদাত ভাই, চিনে গেলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাব।”

“উনি আমাদের চিনে না।” বলে আশপাশে চোখ বুলাল সৈকত। সেঁজুতিদের পাশের বিল্ডিংয়ে ঝুলানো টু-লেট নোটিশ বোর্ড দেখে চোখ চকচক করে উঠল সৈকতের। পঞ্চমতলায় বাসা ভাড়া দেয়া হবে, ফ্যামিলি বাসা। সৈকত অন্তরকে জিজ্ঞেস করল, “সেঁজুতিদের বাসা কয় তালায়?”

“পাঁচ তলায়? ওই যে ওটা।” ইশারায় দেখিয়ে দিল অন্তর।
“পারফেক্ট। ” বিজয়ী হাসল সৈকত।

এগিয়ে গিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের দারোয়ানের সাথে কথা বলল, ফ্যামিলি বাসা ভাড়া হবে। সৈকত গিয়ে দারোয়ানকে জানাল, তারা বাসা দেখতে আগ্রহী। পরিচয় দিল, অন্তর আর সে ভাই। তাদের মা-বোন গ্রামে থাকে। বাসা পছন্দ হলে এসে উঠবে। সেদিন রাতের আঁধারে দারোয়ান ওদের তেমন খেয়াল করেনি, ফলে মনে নেই। সৈকতদের কথা বাড়িওয়ালাকে কল দিল। তারা কেউ বাসায় নেই। দারোয়ান নিজেই গেল ওদের সাথে। পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং, সেঁজুতিদের দিকের বাসাটা ভাড়া হবে। সৈকত রুম দেখার বাহানায় এ ঘর ও ঘর ঘুরে বারান্দায় গেল। অন্তরকে ইশারা করা লাগল না, অন্তর নিজেই বুঝে দারোয়ানকে অন্যরুম দেখাতে বসে রুম থেকে বের হলো।

সেঁজুতিদের বাসার জানালা, এ বাসার বারান্দা মুখোমুখি। সৈকত বারান্দায় গিয়ে ওই বাসায় উঁকি দিল। জানালা খোলা কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সৈকত হতাশ শ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইল, আকস্মিক কাউকে আসতে দেখা গেল। সেঁজুতি! সৈকত সময় নষ্ট না করে ডেকে উঠল,
“এই নাহিদ? এদিকে শুনতো! ”

একটু জোরেই ডাকল। সেঁজুতির নাম নিলে কারো সন্দেহ হবে বলে। কৌতুহলী হয়ে এদিকে চাইল সেঁজুতি! সৈকতকে দেখে ভীষণ চমকাল। সৈকত তার ফোনে রুবাবের ছবি এনে ইশারা করে বুঝাল যে রুবাবের সাথে যোগাযোগ করতে। সেঁজুতি ভীত ঢোক গিলে আশপাশে চাইল। তারপর জানালার কাছে এলো। কাতর চাহনি নিয়ে অসহায় গলায় বলল,
“ভাইয়া কড়া পাহারায় রেখেছে আমায়। কিছুতেই যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। রুবাব কেমন আছে?”

সেঁজুতির চোখে টলমল করছে জল। দহন তবে দুই পক্ষেই হচ্ছে। সৈকত পকেট থেকে একটা স্মার্টফোন বের করে রুবাবকে কল দিল, ভিডিও কল। দু’বার রিং হতেই রুবাব কল ধরল। প্রাণহীন স্বরে ঠাট্টা করল,
“কীরে শা লা প্রেমিকার মত ভিডিও কল দিস ক্যান! আমি আগেই কইছিলাম, তোর ভাবসাব ভালা না। মতলব কী তোর?”

সৈকত হেসে বলল, “দেখ কী মতলব। ” বলে ফোনে ব্যাক ক্যামরা অন করল। গ্রীল ভেদ করে সেঁজুতির মুখটা ভেসে উঠতেই চমকাল রুবাব। এতটা অবাক হলো যে কথা বলতে ভুলে গেল। খানিক বাদে অস্ফুট স্বরে বলল, “সেঁজুতি! কিভাবে… ”

সৈকত একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “তোর এই বাপ্পারাজ টাইপ বিরহ দেখতে দেখতে বোর হয়ে গেছি। এবার দয়া করে লো বাজেটের সাকিব খান হ। নে কথা বল…

ফ্রন্ট ক্যামেরা এনে ফোন ঘুরাল সৈকত। সেঁজুতির চোখ গেল ক্যামরা। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। বিস্ময়, হতাশা, কাতরতা নিয়ে চেয়ে রইল। জমাট বাধা অশ্রু গাল গড়িয়ে পড়িয়ে পড়তে লাগল। রুবাবের চোখে ও পানি। কেউ কথা বলছে না, দু’জনের দিকে চেয়ে আছে। এ যেন দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর পূর্ণমিলন। দুজনার মনে হচ্ছে কতকাল দেখেনি। সেঁজুতি চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে রুবাবহীন তার দিন বড্ড খারাপ গেছে।

কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর সৈকত ফোনটা সেঁজুতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” ফোনটা আপনার, আর আমার বন্ধু মন ভালো রাখার দায়িত্বটাও। কোন সমস্যা হলে আমাদের বলবেন, আমরা সবসময় আপনাদের সাথে আছি। কিন্তু আমার বন্ধুকে কষ্ট দিবেন না, এটা আপনার কাছে অনুরোধ। ”

সেঁজুতি আমতা-আমতা করল, “কিন্তু আমি আপনার ফোন কিভাবে…?”

সৈকত মিথ্যা বলল, ” এটা আমার ফোন নয়, রুবাব পাঠিয়েছে আমাকে দিয়ে। নিন।”

রুবাবের কথা বলায় নিল সেঁজুতি। রুবাব অবাক হয়ে দেখে গেল, সে কোন ফোন দেয়নি সৈকতকে। এমনকি, সে জানত ও না যে, সৈকত দেখে সেঁজুতির খোঁজ আনতে গেছে। বন্ধুর উপর বেজায় কৃতজ্ঞ হলো রুবাব। সৈকত জানে ও না, আজকে সে তাকে কী দিয়েছে। এই ঋণ আজীবন মনে রাখনে রুবাব।

বাসায় ফিরতেই সৈকতকে জড়িয়ে ধরল রুবাব। কৃতজ্ঞ সুরে বলল, “থ্যাঙ্কিউ দোস্ত।”

সৈকত ওকে ছাড়িয়ে মুখ কুঁচকাল, “এবার কিন্তু তুই প্রেমিকার মতো আচরণ করতেছিস। সর!”

ওর ঠাট্টায় গা না ভাসিয়ে আবার ধন্যবাদ দিল। সৈকত বলল, “তোর এত ধন্যবাদ দিয়া আমি কী করব? দেয়া হলে বোন বিয়া দে, তোরে শালা ডাকি।”

রুবাব বুঝল, সৈকত কোন ক্রেডিট নিবে না। সে বলল, “আমারে পাগলে পায়নাই, তোর কাছে বোন বিয়া দিব।”

সৈকত হাসতে হাসতে বলল, “পাগলে পাইলে দিবি? কোন ক্যাটাগরির পাগল এরেঞ্জ করব, বল।”

হাসিঠাট্টা চলল। বন্ধুত্বের সৌন্দর্য বাড়ল।

__________

পরদিন থেকে সকালে নিয়ম করে মুন খাবার নিয়ে আসল, শুধু ভাইয়ের জন্য নয়। ভাইয়ের বন্ধুদের জন্য ও। এই কাজটা নিত্যরুটিন হয়ে গেল। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর মুনের দর্শন পাওয়া যেন সৈকতের অভ্যাস হয়ে গেল। সেই অভ্যাসে লুকাল প্রেম, যা সৈকত টের পেল না। টানা পাঁচদিন আসার পর ছ’দিনের মাথায় মুন এলো না। সকাল থেকে অপেক্ষায় বসল সৈকত। মুখ ফুটে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে পারল না। সে বেলা আর এলো না মুন। পরদিন ও এলো না। সৈকতের ভেতরটা কেমন যেন অস্থির হলো। সেদিন পড়ায় ও মন বসল না। ক’বার বসে ও মনোযোগ দিতে পারল না। দুপুরবেলা কী হলো কে জানে, মুনের ভার্সিটির চলে গেল। গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই বুঝি মুন এলো। কিছু মুনের দেখা নেই, মেয়েটা বোধহয় ওকে অপেক্ষা করিয়ে মজা পায়। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পাক্কা আধঘন্টা পর দেখা গেল মুনকে।

সৈকত দূর থেকে স্থির চোখে দেখল মুনকে। ওর এক তরফা অনুভূতি ভীষণ তৎপর হলো ক্ষণে ক্ষণে। মেয়েটাকে দেখে শান্তি লাগছে, এ টের পেল দু’দিনের অস্থিরতা চাপিয়ে গেছে এই ক্ষণে। একপা দু’পা করে মুন এগিয়ে এলো। সৈকতের পাশ কাটতে গিয়ে থেমে গেল হঠাৎ। ওকে খেয়াল করে সৈকতের সামনে এসে দাঁড়িয়ে নম্র স্বরে সালাম দিল,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”

মুনের চোখে চোখ পড়তেই সৈকতের হৃদস্পন্দন বাড়ল। ভীষণ নার্ভাস ফিল করল। কিছুক্ষণ থেমে সালামের উত্তর দিল। কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“ক্লাস শেষ? ”
মুন আশপাশ চোখ বুলিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ভাইয়া কোথায়?”

সৈকত ধীরে বলল, “রুবাব বাসায়। আমি একা এসেছি।”

” আমি ভেবেছিলাম ভাইয়ার সাথে এসেছেন। তা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে?”

সৈকত বলল, “একজনের অপেক্ষা করছিলাম।”

“কার?” আনমনে প্রশ্ন করল মুন। পরক্ষণেই ওর মনে হলো প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। ভাইয়া তার গার্লফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছেন হয়তো।

সৈকত একবার মুনের দিকে তাকাল। তারপর অন্যদিকে ফিরে মনে মনে উত্তর দিল, ” তোমার।”

এই ছোট্টো শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না। কথা এড়িয়ে বলল,
“বাসায় যাবে এখন?”

ওর কথা ঘুরানো দেখে মুন তার ধারণার সবুজ দাগ বসাল। সে মাথা নাড়াল। যার অর্থ বাসায় যাবে। একটা অধিকার নিয়ে সৈকত বলল,
“দাঁড়াও, রিক্সা ঠিক করে দিই।”

সৈকত রোদে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রিক্সা ঠিক করে আনল। মুন উঠে বসবার পর বলল, “সাবধানে যেও, কেমন?”

মুন মাথা নাড়াল। রিক্সা চলতে শুরু করল, এক সময় অদৃশ্য হলো। সৈকত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এখন শান্তি লাগছে, ভীষণ শান্তি। হঠাৎ যেন হুঁশ হলো ওর। পরের দিন গুলোও মুন বাসা মুখো হলো না। রুবাব সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেল। সৈকত লুকিয়ে চুবিয়ে ভার্সিটির সামনে গিয়ে দেখে আসল, নিত্যকার। এখন যেন মুনকে দেখা আর মুনকে নিয়ে ভাবাই ওর মুখ্য বিষয় হয়ে গেল। বিসিএসের গুরুগম্ভীর পড়ায় মন বসল না।
পড়ার সময়ে নিজেকে ভার্সিটির সামনে আবিষ্কার করে নিজেই অবাক হলো। বই থেকে দূরত্ব টের পেতেই চিন্তার ভাঁজ পড়ল, এখন পড়া ছাড়া কোন কিছু নিয়ে ভাবা উচিত নয়। ওকে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। তাছাড়া এই অনুভূতির পরিণাম ভালো নয়। নাহ্! এই অনুভূতির শেষ এখানেই টানতে হবে।
এই ভেবে নিজেকে নিজের অনুভূতিকে শাসাতে দূরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। ক’টাদিনের জন্য গ্রামে চলে যাবে। নিজের পরিবারের সাথে থেকে মুনের ভূত মাথা থেকে সরিয়ে তারপরই ফিরবে।

যেই কথা সেই কাজ, পরদিন ভোরবেলায় রওনা হলো গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু যার অনুভূতি দমাতে এতদূর যাওয়া, সে কি সরেছে স্মরণ থেকে? না কি বসেছে মনে শক্ত করে?

চলবে…