অ্যডিক্টেড টু ইউ পর্ব-১২+১৩

0
421

#অ্যডিক্টেড_টু_ইউ
#অরনিশা_সাথী
#পর্ব_১২

ইরানের কথা শুনে উপস্থিত সকলে চমকে তাকালো। আর আপির ফুপ্পি মুখ বাঁকিয়ে পান চিবুতে মনোযোগ দিলো। ফারাবী ভাইয়া ইরানের সামনে গিয়ে বললো,
–“কি বলছিস তুই এসব?”

ইরান ফারাবী ভাইয়ার দিকে ঘুরে বললো,
–“দোস্ত তুই একটু আংকেলকে বোঝা। আমি সত্যিই রুহিকে অনেক ভালো রাখবো।”

–“তুই চল এখান থেকে, এটা সম্ভব না। রুহি বিবা___”

–“ফারাবী তুই যদি আমার হয়ে আংকেলকে বোঝাতে না পারিস তো আমার আর আংকেলের মাঝেও কথা বলিস না। ইট’স মাই রিকুয়েষ্ট।”

আদ্র এতক্ষণ রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছিলো। প্রথমে আপির ফুপ্পি এখন আবার ইরান সব মিলিয়ে আদ্রর রাগ সপ্তম আসমানে পৌঁছে গেছে। রুপ ভাইয়া এখনো উনাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। আর আমি কান্না থামিয়ে ইরান ভাইয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে আবার ভয়ার্ত চোখে আদ্রকে দেখছি। লোকটা ভয়ানক রেগে আছে। উনার সামনেই উনার বিয়ে করা বউকে অন্য একজন বিয়ে করতে চাচ্ছে। ভাবা যায়? আব্বু কিছু বলছে না বলে আপির ফুপ্পি বললো,
–“সবকিছু যেনেও যে তোমাদের এমন দুশ্চরিত্রা মেয়েকে ওই ছেলেটা বিয়ে করতে চাচ্ছে এটা তোমাদের সাত কপালের ভাগ্য। রাজি হয়ে যাও বিয়ে দিতে নয়তো___”

আপির ফুপ্পিকে পুরো কথা বলতে না দিয়ে আদ্র এবার চিল্লিয়ে উঠলো। গর্জে উঠে বললো,
–“ইনাফ ইজ ইনাফ। অনেক্ক্ষণ যাবত আপনার উল্টাপাল্টা কথা শুনে যাচ্ছি৷”

–“কত্ত বড় সাহস তোমার। তুমি আমার ভাইয়ের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে ধমকিয়ে কথা বলছো?”

–“আই সোয়্যার, আপনি যদি আর একটা সাউন্ড করেন তো আমি ভুলে যাবো আপনি নীলাদ্রির ফুপ্পি। এখানে আমার, আমার বউয়ের এবং ওর ফ্যামিলির সম্মানহানির জন্য আপনাকে পুলিশে দিতে বাধ্য হবো আমি।”

বিষ্ময়ে আপির ফুপ্পি হা হয়ে গেলো৷ উনার মুখ দিয়ে যেন আর কোনো কথা বেরোচ্ছেই না। ইরান ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রর দিকে। আদ্র ইরানের সামনে গিয়ে বললো,
–“রুহিকে বিয়ে করার প্রপোজাল দিচ্ছিলেন না রুহির আব্বু মানে আমার শশুড় মশাইকে? প্রপোজালটা বরং উনাকে না দিয়ে আমাকে দিন। উনি লাস্ট ছ’মাস আগে রুহির অভিভাবক ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে রুহির অভিভাবক আমি। সুতরাং প্রপোজালটা উনাকে দিয়ে লাভ নেই। আমাকে দিন, এতে আপনার লাভ হলেও হতে পারে। আমি আমার বউকে আপনার সাথে বিয়ে দিলেও দিতে পারি।”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বললো আদ্র। আপির ফুপ্পি তখনো বললো,
–“তো্ তোমরা বিবাহিত?”

আদ্র আপির ফুপ্পির দিকে রাগী স্বরে তাকিয়ে বললো,
–“এনি ডাউট?”

তিনি মাথা নামিয়ে নিলেন। এরপর উনার আর কিছু বলার মুখ নেই। না জেনেশুনে এতক্ষন অনেক আজেবাজে বলেছেন। এবার উনি নিজেই নিজের কাছে বেশ লজ্জিত। আদ্র দাঁতে দাঁত চেপে ইরানকে বললো,
–“কি হলো এখন কথা বলছেন না কেন?”

–“রুহি যে বিবাহিত এটা___”

–“জানতেন না রাইট? তো কারো ব্যাপারে সব খোঁজ না নিয়ে বিয়ের প্রপোজাল কিভাবে দেন?”

ইরান কিছু বললো না। আদ্র আবারো বললো,
–“তো এখনো বিয়ে করতে রাজি আছেন? কাজি ডাকবো এখনি নাকি একেবারে সন্ধ্যায় নীলাদ্রির বিয়ের সাথেই বিয়ে করবেন আমার বউকে?”

আদ্রর কথায় কাজিন মহলের সকলে মিটিমিটি হাসছে। আর ইরান তো পুরো থতমত খেয়ে গেছে৷ আদ্রর কথার উত্তরে ইরান কি বলবে সেটা ভেবে পেলো না। তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছোট্ট করে বললো,
–“স্যরি। আমি বুঝতে পারিনি।”

আদ্র আপির ফুপ্পির সামনে গিয়ে বললো,
–“আপনার আর কিছু বলার আছে? আর কোনো আজেবাজে মন্তব্য করার আছে আমাদের দুজনকে নিয়ে?”

তিনি লজ্জায় মাথা নিচু করলেন। তবুও দমে গেলেন না। বাঁকা কন্ঠে বললেন,
–“তো তোমদের যে বিয়ে হইছে সেটা কেউ জানে? জানে না তো। নিজেদের বিয়ের কথা এভাবে লুকিয়ে চুড়িয়ে রেখেছো কেন? নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে এতে। নয়তো___”

হঠাৎই আদ্র চেঁচিয়ে উঠলো। উঁচু গলায় বললো,
–“সেভেন ডেইস। অনলি সেভেন ডেইস। এর মধ্যেই রুহিকে বিয়ে করবো আমি। পুরো ঢাকা শহরকে জানিয়ে রুহিকে আমার ঘরে তুলবো আমি।”

আদ্রর কথায় চমকে উঠলাম আমি৷ সাথে আব্বু আর আম্মুও। আর এই কথা শুনে ইরান হনহনিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো। ইরানের পিছু পিছু মাইশাকেও যেতে দেখে বেশ অবাক হলাম আমি। তবে সেদিকে অতটা মাথা ঘামালাম না। আমি আদ্রর কথাটা ভাবতে ব্যস্ত। কি বললেন উনি এটা? সাতদিন? সাতদিনের মধ্যে বিয়ে করবেন আমাকে? আদ্রর কথা শুনে আপির ফুপ্পি মুখ বাঁকালেন। আদ্র সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আব্বুর সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে আব্বুর দুহাত উনার হাতের মুঠোয় নিয়ে আকুতি ভরা কন্ঠে বললো,
–“আংকেল প্লিজ এবার অন্তত না করবেন না। তিনতে বছর সময় নিয়ে রাজি হয়েছেন আপনি। এবার আর অপেক্ষা করাবেন না আমাকে। আজ থেকে ঠিক সাতদিনের মাথায় ধুমধাম করে পুরো শহরকে জানিয়ে রুহিকে আমার করে দিবেন প্লিজ।”

আব্বু স্ট্রিক্ট গলায় বললো,
–“আদ্র রুহি তোমারই। তোমার সাথে ওর অলরেডি রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। সেটা আমাদের দু পরিবারের সবাই জানে। অন্য কে জানলো না জানলো সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। রুহির স্টাডি শেষ হলে তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান করার কথা ছিলো আর তাই হবে। যাদের বিবেকবুদ্ধি যেমন তারা তেমনই ভাববেন।”

শেষের কথাটা আব্বু আপির ফুপ্পিকে উদ্দেশ্য করে বললো। আদ্র নাছোরবান্দার মতো সেখানেই বসে থেকে বললো,
–“আমি অতদিন অপেক্ষা করতে পারবো না। আজকে উনি যেভাবে আঙুল তুলেছেন আমাদের সম্পর্কে সামনে আরো অনেক মানুষ আঙুল তুলবে। রুহির চরিত্র নিয়ে কথা উঠবে সেটা আমি মানবো না। আমি রুহিকে সাতদিন পরই বিয়ে করবো। বিয়ের পর ও ওর স্টাডি শেষ করবে। ও যদি হায়ার এডুকেশনের জন্য বাহিরের দেশে যেতে চায় আমি সেখানেই পাঠাবো ওকে। তবুও আমি ওর স্টাডি শেষ অব্দি ওয়েট করতে পারবো না।”

–“আদ্র বাচ্চাদের মতো জেদ করো না। তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউর। তোমাকে বাচ্চামোতে মানায় না।”

–“আমি রুহিকে চাই আংকেল। পুরোপুরি ভাবে চাই। প্লিজ ওকে পুরোপুরিভাবে আমার করে দিন।”

আদ্রর এমন কথাতে আব্বু কি বলবেন খুঁজে পেলেন না। আর আমি লজ্জায় পড়ছি উনার এমন বিহেভিয়ার এর জন্য। আর কাজিনমহলের সকলে তো আছেই মুখ টিপে হাসার জন্য। আদ্রর হয়ে শান ভাইয়াও কথা বললো আব্বুর সাথে। আব্বু মানতে নারাজ। আদ্র উনার আব্বু আম্মুকে জরুরী ডাকলেন এখানে। আধ ঘন্টার মাঝে উনারাও এসে হাজির। আংকেল আন্টিও আদ্রকে বোঝাচ্ছে বাট উনি মানতে নারাজ। উনি এর মাঝেই আমাকে উনার বাড়ি নিয়ে যাবে বলে পন করেছে। শেষে উনার জেদের কাছে আব্বু হার মেনে নিলো। আর জানালো আজ থেকে ঠিক সাতদিনের মাথায় আদ্র আর আমার হলুদ। আব্বুর কথায় আদ্রর খুশি দেখে কে? খুশিতে পাগল হয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরলো। আব্বুও মুচকি হেসে আদ্রর পিঠে হাত রাখলেন। আদ্রর এমন বাচ্চামোতে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। কেমন নির্লজ্জের মতো আব্বুর সামনে জেদ ধরে বসে থেকে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে ফেললো। আব্বু আদ্রকে ছেড়ে দিলো। আদ্র আপির ফুপ্পির সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো,
–“প্রথম দাওয়াতটা তাহলে আপনাকেই দিই, কি বলেন? আমার আর রুহির বিয়ের দিন অবশ্যই আসবেন কিন্তু।”

একটু আগেই হিমাদ্রি ওরা সকলে পার্লার থেকে সেজে আপিকে নিয়ে একসাথে বাড়িতে এলো। আপিকে বউসাজে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। লাল রঙের ব্রাইডাল কাতান শাড়ি পড়েছে আপি। দেখে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। সব্বাই মিলে গাঢ় নীল রঙের জর্জেট শাড়ি পড়েছে। একই রকম সাজ আর খোলা চুলে অসম্ভব সুন্দর লাগছে সবাইকে। আর এদিকে আমি এখনো রেডিই হইনি। মাথা ব্যাথার জন্য পার্লারেও যাইনি। হিমাদ্রি পার্লার থেকে এসে আমাকে অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসে ফোন টিপতে দেখে বেশ রেগে যায়। সাথে রুশাপুও চটে যায় আমি এখনো রেডি হইনি দেখে৷ আমি মুখ গোমড়া করে ব্লাউজ আর পেটিকোট পড়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। তারপর শাড়িটা রুশাপুর হাতে দিয়ে বললাম পড়িয়ে দিতে৷ রুশাপুও আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শাড়ি পড়িয়ে দিলো আমায়৷ শান ভাইয়ার ডাক পড়াতে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। হিমাদ্রি আর ফাইজা সেল্ফি তুলে ফোনের গ্যালারি লোড করছে৷ আমি চুপচাপ হালকা সেজে নিলাম। সাইডে সিথি করে চুলগুলো ছেড়ে দিলাম। ঝুমকো কানে দিচ্ছিলাম। তখনই মাইশা আর তিন্নি আদ্রকে টেনে রুমে নিয়ে এলো। আয়নার মধ্য দিয়েই আদ্রকে দেখে আমার চোখ আটকে গেলো। ফুল ব্ল্যাক গেটাপে আছে আদ্র। কালো শার্ট-প্যান্ট, কালো স্যুট। পায়ের সু থেকে চোখের সানগ্লাসটা অব্দি কালো। সাথে কালো হ্যান্ড ওয়াচ তো আছেই। বুকের ভেতর ধুকপুকানি শব্দটা বেড়ে গেলো। বুকের বা পাশে হাত রাখলাম আমি। ঠিক তখনই আয়নার ভিতর দিয়েই আদ্র আমার দিকে পূর্ন নজর দিলো। আজ কেমন যেন লজ্জা ভয় কিছু লাগছে না। উনার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছি আমি। দুজন দুজনকে দেখছি৷ মাইশা আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে ঝাকাতেই আমার হুশ ফিরে। তড়িঘড়ি করে ঝুমকো পড়ে নিলাম। মাইশা হেসে বললো,
–“জানো ভাবী, ভাইয়া তোমার জন্য বেলিফুলের মালা এনেছে চুলে লাগানোর জন্য৷ আমার কাছেই দিয়েছিলো, কিন্তু আমি ধরে/বেঁধে নিয়ে এসেছি ভাইয়াকে। ভাইয়া আজ নিজে তোমার চুলে বেলিফুলের মালা লাগিয়ে দিবে৷”

মাইশার কথায় আরো একবার তাকালাম উনার দিকে। উনি তখনো আমাকেই দেখছে৷ চোখ নামিয়ে নিলাম। মাইশা আবারো আমাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আদ্রকে টেনে এনে আমার ঠিক পেছনটায় দাঁড় করালো। তারপর বললো,
–“নাও এবার তুমি নিজেই ভাবীর চুলে ফুল লাগিয়ে দাও।”

আদ্র মুচকি হেসে মালাটা হাতে নিলো। আমি আয়নায় উনাকেই দেখছি৷ উনি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“বউ, আমি কিন্তু কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি৷ আর তো সাতটা দিন। এই সাতদিন অন্তত আর পাগল করো না আমাকে। নয়তো এই সাতদিনও থাকতে পারবো না আমি।”

উনার কথায় লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম আমি। উনি বাঁকা হেসে চুলে ফুল লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

একটু আগেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সারাজীবনের জন্য আপি মুগ্ধ ভাইয়ার হয়েছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে পেয়েছে। এত খুশির মাঝেও কিছু তো মন খারাপ আছেই। পরিবার পরিজন সকলকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। নিজের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসার কষ্ট। বিবাহিত জীবনে আটকা পড়ার কষ্ট। মুগ্ধ ভাইয়ার বাসার সকলে তাড়া দিচ্ছে আপিকে ছাড়ার জন্য। এতক্ষণের আনন্দ হই হুল্লোড়ে ভরা পরিবেশ হুট করেই গুমোট হয়ে এলো। কাজিনমহলের সকলের মুখ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। আংকেল মুগ্ধ ভাইয়া আর উনার বাবার হাতে আপিকে তুলে দিয়ে কেঁদে ফেললো। আপি আংকেলকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। খুব দ্রুতই আবার আংকেল নিজেকে সামলে নিয়ে আপিকে নানান কথা বোঝাতে লাগলো। আপি তখনো হেঁচকি তুলে কাঁদছে৷ আপি ফুপ্পি আর হিমাদ্রিকে জড়িয়ে ধরেও চিৎকার করে কাঁদছে। উপস্থিত সকলের চোখে পানি। একে একে সবার থেকে বিদায় নিলো আপি। আব্বুর সামনে গিয়ে হুট করেই আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আপি যেখানে আব্বুর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতো না ভয়ে সেই আপিই আজ আমার সেই স্ট্রিক্ট আব্বুটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আব্বু আপির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আব্বুর চোখেও পানি দেখা গেলো। মুগ্ধ ভাইয়া আপিকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই আপি পিছন ফিরে আমাকে খুঁজতে লাগলো। আমি মানুষের ভীরে থেকে সরে দূরে এককোনে বসে নিঃশব্দে কাঁদছিলাম। আপিকে বিদায় দেওয়ার ঝামেলায় কেউ খেয়াল করেনি আমায়৷ আদ্রও ওদিকে ব্যস্ত ছিলো।

আপি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আমার এতক্ষণের নিঃশব্দ কান্নাটা এখন চিৎকারে পরিনত হলো। আপিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছি আমি। এতগুলো বছর আপির সাথে থাকা। সেই আপি আজ বিয়ে করে বরের বাড়ি চলে যাচ্ছে। কিভাবে থাকবো আমি আপিকে ছাড়া? আপি কাঁদতে কাঁদতে বললো,
–“একদম কাঁদবি না সোনা। তুই কাঁদলে ভালো লাগে আমার? মামা-মামির সব কথা শুনে চলবি। আর আদ্রকে একদম রাগাবি না৷ আদ্রর রাগ সম্পর্কে তো তোর জানা আছে রাইট?”

আপির কথায় মাথা দুলালাম আমি। আপি আবারো বললো,
–“লক্ষীটি হয়ে থাকবি। পড়াশোনা মন দিয়ে করবি। কেমন?”

আমি আপিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
–“আপি তুমি যেও না প্লিজ। তোমাকে ছাড়া থাকবো কিভাবে আমি? আমার একা রুমে ঘুমাতে একটুও ভালো লাগবে না আপি। তুমি চলে গেলে কে ঘুমাবে আমার সাথে? কে আমার সব আবদার রাখবে?”

আমার এমন কথায় আপিও নিজের সাথে আঁকড়ে নিলো আমাকে। দুজন দুজনকে এমন ভাবে ধরেছি যেন ছেড়ে দিলেই একে অপরের থেকে হারিয়ে যাবো। আদ্র আমায় ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
–“রুহি, রুহি ছাড়ো ওকে। ও তো একেবারে চলে যাচ্ছে না। আবার কালই চলে আসবে।”

–“নাহ, আমি আপিকে যেতে দিবো না। আপিকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি। আমার আপিকে আমার কাছে থাকতে বলুন না। ও চলে গেলে আমার একটুও ভালো লাগবে না।”

আদ্র একপ্রকার টেনেই আমাকে আপির থেকে ছাড়িয়ে রাখলো৷ আদ্র আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে উনি৷ উনার বুকে মাথা রেখেই আমি একই প্রলাপ করে যাচ্ছি। মুগ্ধ ভাইয়া আপিকে নিয়ে কিছুদূর যেতেই আপি জ্ঞান হারালো। সাথে সাথেই মুগ্ধ ভাইয়া কোলে তুলে নিলো আপিকে। কোলে করে আপিকে গাড়িতে বসালো। তারপর মুগ্ধ ভাইয়াও সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। ধীরে ধীরে গাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে গেলো। আদ্র আমাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে এলো।

কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে নিরবে কাঁদছি। আপিকে ভীষণ রকমের মিস করছি। আপিও পর হয়ে গেলো? এখন থেকে কি আর আগের মতো আপিকে কাছে পাবো না আমি? এভাবে কতটা সময় পার হয়েছে জানি না। আদ্র এসে বেশ কয়েকবার ডাকলো আমাকে। কোনো সারা দিলাম না আমি। এবারে উনি আমাকে হাত ধরে টেনে বসালেন। তারপর উনিও আমার পাশে বসে আমাকে একহাতে জড়িয়ে নিলেন। তারপর উনার ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–“নীলাদ্রি লাইনে আছে, কথা বলবে তোমার সাথে।”

খুশিতে আমার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। দ্রুত উনার হাত থেকে ফোন নিতে গেলেই উনি ফোনটা সরিয়ে নিয়ে বললেন,
–“কথা বলতে দেবো তবে একটা শর্ত আছে।”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। উনি বললো,
–“কান্নাকাটি করতে পারবে না৷ তুমি কান্না করলে কি ওর ভালো লাগবে? ওর তো ওখানে একা একা আরো বেশি খারাপ লাগবে। সুতরাং মন খারাপ হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে ভালোভাবে খুশিমনে কথা বলতে হবে। রাজি আছো?”

আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা চাইলাম। উনি হয়তো বুঝতে পারলেন আমি রাজি তাই ফোনটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমিও উনার কথা মেনে নিয়ে খুশিমনে বেশ কিছুটা সময় কথা বললাম আপির সাথে৷ আদ্রর জরুরী একটা ফোন আসায় উনি বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

আমি হিমাদ্রি ফাইজা মাইশা তিন্নি পাঁচজনে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হিমাদ্রি ওর ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“দেখ রুহি, তোর আর ভাইয়ার ছবিগুলা জাস্ট অস্থির হইছে।”

হিমাদ্রির হাত থেকে ফোন নিলাম আমি। বেশ কয়েকটা ছবি দেখলাম ওর ফোনে। আদ্র যখন আমার চুলে বেলি ফুল আটকে দিচ্ছিলো তখনকার ছবি৷ সবকটা ছবিই মুটামুটি সুন্দর এসেছে। তবে তার মধ্যে দুটো ছবি বেশি সুন্দর হয়েছে। প্রথম ছবিটা হিমাদ্রি আমাদের পেছন থেকে তুলেছে। পেছন থেকে আমাদের দুজনের কিছু অংশ আর আয়নায় আমাদের দুজনের প্রতিচ্ছবি সহ ছবিটা ক্লিক করেছে হিমাদ্রি। আয়নায় দেখা যাচ্ছে, আদ্র বাঁকা হেসে আমার চুলে ফুল আটকে দিচ্ছে আর আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে মুচকি হাসছি। আর দ্বিতীয় ছবিটা হলো, আমি কানে ঝুমকো ধরে মুগ্ধ চোখে আদ্রকে দেখছি আর আদ্রও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদ্রর চোখে অন্যরকম একটা নেশা কাজ করছে। এই ছবিটাও হিমাদ্রি পাশ থেকেই নিয়েছে৷ আয়নায় আমাদের দুজনের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। চট করেই ছবি গুলো আমি হোয়াটসঅ্যাপ করে নিয়ে নিলাম। এবং আমার চুলে ফুল আটকে দেওয়া ছবিটা ওয়ালপেপারে সেট করে নিলাম৷ ছবিটা অসম্ভব রকমের সুন্দর হয়েছে।

কিছুক্ষণ বাদেই আদ্র, রুপ, ফারাবী, শান ভাইয়া আর রুশাপু এলো রুমে৷ শান ভাইয়া বললো,
–“চলো শালীকারা, নীলাদ্রির ওখান থেকে ঘুরে আসি আমরা। ও সব্বাইকে নিয়ে যেতে বলেছে। ওর একা ভালো লাগছে না ওখানে।”

শান ভাইয়ার কথায় সকলেই চট করে উঠে পড়লাম। উদ্দেশ্য মুগ্ধ ভাইয়াদের বাসায় যাবো৷ সকলে গাড়িতে করে গেলেও আমি আদ্র এবং রুশাপু, শান ভাইয়া এই চারজনে বাইকে করে রওনা হলাম মুগ্ধ ভাইয়াদের বাসায় উদ্দেশ্যে।

চলবে~

#অ্যাডিক্টেড_টু_ইউ
#অরনিশা_সাথী
#পর্ব_১৩

আপিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ হলো আপির শশুড় বাড়ি এসেছি। আমরা মেয়েরা বিছানায় বসে আছি। আর মুগ্ধ ভাইয়া আদ্র উনাদের নিয়ে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। আপি রুশাপু হিমাদ্রি ওদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। সাথে আপির দুজন ননদ আছে। একজন মুগ্ধ ভাইয়ার ছোট বোন। আর অন্যজন মুগ্ধ ভাইয়ার খালাতো বোন। আদ্র আড়চোখে আমাকে দেখছে বারবার।আমি চুপচাপ আপিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আপির কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছি। একপর্যায়ে মুগ্ধ ভাইয়ার ছোট বোন, মিলি আপু, আপিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“ভাবী, রুহি তো দেখছি তুমি বলতে পাগল।”

আপি মুচকি হেসে আমার গালে হাত বুলিয়ে দিলো। বিনিময়ে আমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। মুগ্ধ ভাইয়ার খালতো বোন, নিশি আপু মৃদু হেসে বললো,
–“ভাবী রুহিকে তো তোমার কাছে রেখে দিলেই পারো।”

নিশি আপুর কথায় উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো সবাই। আমি তখনো চোখ বন্ধ করে আছি। মিলি আপু চট করেই বলে ফেললো,
–“এক্সাক্টলি ভাবী, রুহিকে বরং মিহির ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে এই বাড়িতেই রেখে দাও। তখন দুই বোন দুই জা হয়ে যাবে, একই বাড়িতে থাকবে। আর রুহিরও তোমাকে ছাড়া থাকতে আর কষ্ট হবে না।”

মিলি আপুর কথায় আমি চট করেই চোখ খুলে ফেললাম। সকলেই আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে মিলি আপুর দিকে৷ নিশি আপু হেসে বললো,
–“একদম, আমিও এটাই বলতে চাচ্ছিলাম। আমাদের মিহির ভাইয়াও কোনো অংশে কম না। রুহির সাথে একদম পারফেক্ট ম্যাচ হবে।”

মিলি আর নিশি আপুর কথায় সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেসে দিলো। আমি ভয়ে ভয়ে আদ্রর দিকে তাকাতেই আমার চোখ কপালে। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে এদিকেই। হাত মুঠো করে রেখেছে। কপালের রগ স্পষ্ট ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আমাকে অনুসরণ করে আপি রুশাপু ওরা সবাই আদ্রর দিকে তাকালো। আপি বুঝতে পেরে নিশি আপুদের কিছু বলার আগেই আদ্র গম্ভীর কন্ঠে বললো,
–“রুহি চলো, বাড়ি ফিরবো।”

বলেই উঠে দাঁড়ালো। আমি তখন অসহায় চোখে আপির দিকে তাকালাম। আপি আদ্রকে বললো,
–“এখনি চলে যাবে? একটু পরে যাও আদ্র।”

–“হুট করেই একটা কাজ পড়ে গেছে এক্ষুনি যেতে হবে।”

থমথমে গলায় আদ্র জবাব দিলো৷ আমরা সকলেই বুঝলাম মিলি আর নিশি আপুদের মজার ছলে বলা কথাটা উনি সিরিয়াস নিয়েছেন। মুগ্ধ ভাইয়া বললো,
–“আদ্র ওরা মজা করে ব___”

–“আমি ওদের কথায় কিছু মনে করিনি। কাল তো আসছিই রুহিকে নিয়ে। কিন্তু এখন যেতে হবে।”

কথাটা বলে আদ্র আবার আমার দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললো,
–“বাহিরে ওয়েট করছি আমি। যাওয়ার হলে এক্ষুনি এসো।”

কথাটা বলে হনহনিয়ে চলে গেলো রুম থেকে। আমিও কিছু না বলে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। মিলি আর নিশি আপু আদ্রর হঠাৎ এমন করার কারন জিজ্ঞেস করলে আপি বললো আমাদের বিয়ের কথা। পুরোটা শুনে ওদের মুখটা ছোট হয়ে যায়। ওরাও বুঝতে পারেনি মজার ছলে বলা কথার জন্য আদ্র এভাবে রেগে বেরিয়ে যাবে। আমি কিছু না বলে আপিকে বাই বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। রুশাপু-রা একটু পর আসবে৷ এক দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। আদ্র বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে দেখে বাইকে বসলো। আমিও দ্রুত উঠে পড়লাম বাইকে।

নিস্তব্ধ রাত৷ সোয়া বারোটা নাগাদ বাজে। মুগ্ধ ভাইয়াদের বাসা থেকে বেরিয়ে আদ্র একটা ফাঁকা ব্রীজের উপর এসে বাইক থামিয়েছে। ব্রীজের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে বুকে দুহাত গুজে দাঁড়িয়েছে আদ্র। আমিও ধীর পায়ে হেঁটে উনার পাশে গিয়ে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম৷ বেশ ক্ষানিকটা সময় রেলিঙে দুহাত রেখে নদীর পানির শব্দ শুনছিলাম। মাঝে মাঝে দূরের গাছ থেকে পাখি/বাদুরের ডানা ঝাপটানো শব্দ ভেসে আসছে। রাতের আধারের পো/কা মা/ক/রে/র ডাকে শরীর শিউড়ে উঠে। আদ্রর দিকে তাকিয়ে উনার মতোই রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। শুনশান নিরবতা। কেউ কোনো কথা বলছি ন৷ অবশেষে আমিই নিরবতা কাটিয়ে বললাম,
–“এখনো রেগে আছেন?”

–“নাহ।”

উনার গম্ভীর মুখের জবাবে কিছুটা ভড়কে গেলাম আমি। কি এমন বলেছিলো ওরা? জাস্ট মজা করেই তো কথাটা বলেছিলো। এই সামান্য কথাটার জন্য কিভাবে ওখান থেকে রে/গে/মে/গে চলে এলো। কি মনে করলো সবাই? এখনো রেগে আছে। আল্লাহ জানে এখন এই রাগ কিভাবে ভাঙাবো আমি। উনার হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখলাম আমি৷ উনি তখনো আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।
–“শুনুন না।”

–“শুনছি।”

–“রেগে থাকবেন না প্লিজ। ওখানে তো সবাই মজা করছিলো৷ সামান্য___”

কড়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি চুপ হয়ে গেলাম। কথাটা পুরো করতে পারলাম না। উনি বললো,
–“সামান্য?”

–“মজা করেছিলো তো ওরা।”

–“এ ধরনের মজা পছন্দ না আমার।”

–“আর এমন হবে না। আপনার বউকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে না।”

–“নিতে দিলে তো।”

–“তাহলে? রাখার জন্য তো আপনি আছেনই। তাহলে এরপরও কেন রেগে যান? আমাকে তো আপনার করেই নিয়েছেন। এরপরও এত ভয়?”

আদ্র চুপ করে গেলো। আমিও আর কিছু বললাম না। আদ্র নিজেই বললো,
–“নিচে যাবে?”

চকিত তাকালাম উনার দিকে। উনি ব্রীজের রেলিঙে হাত রেখে ব্রীজের নিচে তাকিয়ে আছে৷ আমার দিকে না তাকিয়েই আবারো বললো,
–“যাবে?”

আমি মাথা দুলাতেই উনি আমার হাত ধরে ব্রীজ থেকে সরে রাস্তার ধারে গিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো৷ থেমে পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ অন করে আবার আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করে।

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি দুজন। ব্রীজের এক সাইডে দাঁড়িয়েছি৷ উনি এখনো আমার হাত ছাড়েনি। নদীর পাড়ে ঘাসের উপর বসে পড়লাম দুজনেই। উনি আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
–“আমার সামনেই সবাই কেন তোমাকে বিয়ের কথা বলে বলো তো? সকালে ইরান তো একদম সিরয়াস ছিলো৷ তোমাকে বিয়ে করার জন্য একদম মরিয়া হয়ে গেছিলো। আর এখন মিলি আর নিশি ওরা মজার ছলে বলুক আর যাই বলুক। বলবে কেন? আমার জাস্ট সহ্য হয় না এসব। আমার সামনেই ঘুরেফিরে এসব হাসি/ঠাট্টা করতে হয় সকলের? তখন নিশি আর মিলির কথায় মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেছিলো তাই ওভাবে বেরিয়ে এলাম।”

–“এখন মাথা ঠান্ডা হয়েছে?”

–“কিছুটা। আর শোনো এরপর থেকে আমি সাথে থাকি বা না থাকি যেখানেই যাও আগেই বলে দিবে তুমি ম্যারিড। তোমার বর আছে। তাহলে আর কেউ এ ধরনের মজা করবে না।”

আদ্রর এমন বাচ্চামো কথায় আমি হাসলাম৷ লোকটা আসলেই পাগল। আমি চট করেই বললাম,
–“ভালোবাসেন আমাকে?”

চট করেই উনি তাকালেন আমার দিকে। বেশ কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
–“নাহ।”

আদ্রর এমন জবাবে থমকে গেলাম আমি৷ ভালোবাসেন না উনি আমাকে? তাহলে সবাই যে বলে উনি গত সাড়ে তিন বছর যাবত আমাকে ভালোবাসে, আমাকে পাওয়ার জন্য আমার আব্বুর পিছন পিছন ঘুরেছে। তাহলে? তাহলে ভালোবাসে না এটা কিভাবে বলছে? ভালো না বাসলে কি উনি এতটা সময় ব্যয় করতেন আমার পিছনে? ছলছল চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–“তাহলে এতগুলো বছর আমাকে পাওয়ার জন্য নষ্ট করেছেন কেন? বিয়ে করেছেন কেন আমাকে? ভালোই তো বাসেন না৷ তাহলে গত সাড়ে তিনবছর যাবত এতসব করে আসছেন কেন?”

আদ্র কেমন যেন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়েছে আমার দিকে৷ আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি আমার হাত ধরতেই কেঁপে উঠলাম আমি। অন্যান্য সময় আমাকে স্পর্শ করা আর আজকের এই স্পর্শর মাঝে বেশ তফাৎ অনুভব করলাম। আজকে আমাকে স্পর্শ করাটা অন্যান্য সময়ের মতো স্বাভাবিক লাগছে না আমার কাছে৷ আমি দ্রুত উনার থেকে সরে গিয়ে বসলাম। উনি আমার কোমড় টেনে ধরে আমাকে উনার একদম কাছে নিয়ে এলো। চমকে গেলাম আমি। আজকে উনার স্পর্শগুলো আমার কাছে অন্যরকম অচেনা লাগছে। হঠাৎ করে উনার এমন অদ্ভুত আচরনে বেশ ঘাবড়ে গেছি আমি। আমি আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
–“ক্ কি কর___”

আদ্র ফিসফিস করে বললো,
–“ভালোবাসি না বললাম বলে মন খারাপ হলো?”

আমি কিছু বললাম না। উনার থেকে ছাড়া পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। উনি শক্ত করে আমার কোমড় চেপে ধরে বললো,
–“কেন এতসব করছি তোমাকে পাওয়ার জন্য? কেন বিয়ে করেছি জানতে চাও তুমি?”

আমি চোখ তুলে তাকালাম উনার দিকে। উনি তখনো অন্যরকম দৃষ্টিতে দেখছিলেন আমাকে৷ আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি আমাকে নিজের সাথে আরো জড়িয়ে নিয়ে বললো,
–“তোমার প্রতি আমার অন্যরকম একটা নেশা কাজ করে রুহি। তোমাকে দেখার পর প্রথম প্রথম আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে যাওয়ার। কিন্তু পারিনি। তোমার নেশা কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না আমি। ধীরে ধীরে তোমার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছিলাম। তোমাকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলাম আমি। আমার শুধু তোমাকে দরকার ছিলো। তোমার নেশা কাটানোর জন্য আমার কেবলই তোমাকে দরকার ছিলো। তোমার টানা টানা চোখ, তোমার মন মাতানো হাসি, তোমার ওই লম্বা চুল, এক কথায় আস্ত তুমিটার নেশায় জড়িয়ে গেছিলাম আমি। আর তোমার নেশা আমি অন্য কোনো কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। তাই তোমাকে পাওয়ার জন্য এতকিছু করেছি আমি৷ জাস্ট এই একটাই কারন আ’ম অ্যাডিক্টেড টু ইউ, বুঝলে বউ?”

কথাগুলো বলে উনি আমার নাকের ডগায় চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কোনো ভাবাবেগ হলো না আমার। তেমন করেই বসে আছি। এতক্ষণ কি বললো উনি? নেশা? আমি উনার নেশা? এজন্যই বিয়ে করেছন আমাকে? ভালোবেসে বিয়ে করেনি? নিমিষেই সারা মন জুড়ে অন্ধকার মেঘের আনাগোনা শুরু হলো। আদ্র মুচকি হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর বললেন,
–“রাতটা কি এখানেই কাটানোর ইচ্ছে আছে নাকি বাসায় যাবে?”

উনার কথায় ভাবনার ছেদ ঘটতেই উঠে দাঁড়ালাম। উনার হাত না ধরে একাই রাস্তায় উঠে গিয়ে ব্রীজের উপর বাইকের সামনে গেলাম। উনিও আমার পেছন পেছন আসলেন৷ বেশ কয়েকবার হাত ধরার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আমি ধরতে দেইনি। মন খারাপের পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে বড় আকার ধারন করছে। গত ছ’মাসে জেনে এসেছি এই মানুষটা আমাকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসে। কিন্তু আজ উনি বললেন আমাকে নাকি ভালোবাসেন না? আমিও বা কি? উনি তো এতদিনে কখনো আমায় বলেনি যে ভালোবাসে। তাহলে কেন শুধু শুধু ভাবতে গেলাম উনি ভালোবেসে বিয়ে করেছে আমায়? আমি উনার নেশা বলেই সে নেশা কাটানোর জন্য আমাকে পেতে আব্বুর পিছু লেগে ছিলো। উনি ভালোবাসেন না আমাকে। ভালোবাসেন না। আমি শুধুই উনার নেশা? এজন্য বিয়ে করেছেন আমাকে? নেশা তো একসময় কেটে যাবে। তাহলে তখন কি উনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?

আমার এরকম হাজারো ভাবনার মাঝেই আদ্র আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
–“চিন্তা করো না বউ, এই নেশা আমার মৃত্যুর আগ অব্দি কাটবে না। তোমার নেশাতেই আমৃত্যু মত্ত থাকবো আমি। আ’ম অনলি অ্যাডিক্টেড টু ইউ। তোমার নেশা আমার এ জনমে কেন? এরপরও যদি কোনো জনম থাকে সে জনমেও কাটবে না মুশফিকান আদ্র’স প্রমিস।”

এই বলে উনি বাইক স্টার্ট দিলেন। আমিও চুপচাপ বাইকে উঠে বসলাম। ভাবতে ইচ্ছে করছে না আর। এতক্ষণ অনেক ভেবেছি এসব নিয়ে। ভাবতে ভাবতে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। তবুও এর কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না আমি। তাই আপাতত এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।

আপির রিসেপশন পার্টি শেষ হয়েছে দুদিন হলো। আমরা আমাদের বাসায় চলে এসেছি৷ আমাদের বাসা ডেকোরেশনের কাজ চলছে। মাঝে আর তিনটে দিন আছে। চারদিনের দিনই আমার আর আদ্রর হলুদ। সেদিনের পর উনার সাথে কিছুটা দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছি। আমি কিছুতেই এটা মানতে পারছি না যে উনি আমাকে ভালোবাসেন না। আমার উপর উনার নেশা কাজ করে বলে বিয়ে করেছেন আমায়। বিয়ের কেনাকাটা অব্দি করতে যায়নি। আপাতত এই বিয়ে নিয়ে আমার একদমই কোনো ইন্ট্রেস্ট নেই। দায়সারা ভাবে সবকিছু শুধু করছি এমন মনে হচ্ছে আমার। সারাক্ষণ মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেটা হলো উনি আমাকে ভালোবাসেন না। আর ভাবতে পারছিলাম না এসব। দুহাতে নিজের চুল টেনে ধরলাম। তখনই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে আদ্রর নাম ভাসছে৷ না চাইতেও রিসিভ করলাম। কথা বললাম না কোনো। আমাকে চুপ দেখে আদ্র বললো,
–“আমার বউয়ের কি মন খারাপ?”

আমি ছোট্ট করে ‘নাহ’ বললাম। উনি আবারো বললেন,
–“আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, সেদিনের পর থেকে তুমি দূরত্ব বাড়াচ্ছো আমাদের।”

আমি তাচ্ছিল্য হেসে বললাম,
–“দূরত্ব বাড়লেই কি কমলেই কি? আপনি তো আর ভালোবেসে বিয়ে করছেন। নেশা কাটানোর জন্য বিয়ে করছেন। নেশা কাটাতে পারলেই তো হলো। দূরত্ব কমলো কি বাড়লো সেসব দিয়ে কি আসে যায়?”

আমার কথায় মুখ টিপে হাসলো আদ্র। উনার নিঃশব্দ হাসিটাও ধরে ফেললাম আমি৷ হাসার কারন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো না৷ তাই চুপ করে রইলাম। উনি নিজেই বললো,
–“অনেক কিছু। অনেক কিছু আসে যায়। আমার যে আমার বউয়ের দূরত্বটা সহ্য হয় না আমার। আমি সবসময় কাছে চাই। একদম কাছে৷”

–“রাখছি।”

এইটুকু বলেই উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিলাম আমি৷ ফোনটা একপাশে ছুড়ে ফেলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। উনার কোনো কথা-ই আমি স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছি না৷ একবার বলছে ভালোবাসি না আবার একবার বলছে কাছে চাই। মানুষ তো ভালোবেসেই ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে চায়। আর উনি কিনা বলেন ভালোবাসে না অথচ কাছে চায়? এসব মন খারাবি জিনিস গুলো আর নিতে পারছি না৷ তাই চুপ চাপ ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এপাশ ওপাশ করতে করতেই আদ্রর ম্যাসেজ এলো,
–“পাগলী বউ আমার, মন খারাপ গুলো সাইডে রেখে ঘুমিয়ে পড়ো এখন৷ আমার এত জটিল জটিল কথা তোমার ওই ছোট্ট মাথায় ঢুকবে না৷ বিয়েটা হতে দাও, একবার নিয়ে আসি নিজের কাছে, তারপর সব প্র‍্যাক্টিকালি দেখাবো ”

চলবে~