অ্যাডিক্টেড টু ইউ পর্ব-১০+১১

0
408

#অ্যাডিক্টেড_টু_ইউ
#অরনিশা_সাথী
#পর্ব_১০

ছাদে হলুদের স্টেজ করা হয়েছে। মুগ্ধ ভাইয়ের বাসার সকলে নিচে থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে ছাদে এসে বসেছে আপিকে হলুদ দেওয়ার জন্য। মুগ্ধ ভাইয়াও আছে এখানে। দুজনকে এখানে একসাথে হলুদ দেওয়া হবে। হলুদের অনুষ্ঠান শেষে মুগ্ধ ভাইয়া চলে যাবে। ওড়নার চারকোনা আপির মাথার উপর দিয়ে ধরে আপিকে মাঝে দাঁড় করানো হয়েছে। পেছনের দুকোনা শান আর রুপ ভাইয়া ধরেছে আর সামনের দুকোনা আদ্র আর ফারাবী ভাইয়া। মাঝেই আপি পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওদের সামনে আমি রুশাপু হিমাদ্রি ফাইজা মাইশা তিন্নি এই ছয়জনে ‘সায়ান সুপাস্টার’ গানে নাচ করতে করতে স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। শান, রুপ, ফারাবী ভাইয়াও গানের তালে তালে আমাদের সাথে নাচ করছে। আদ্র শুধুমাত্র গম্ভীর করে রেখেছে মুখটাকে। আচ্ছা উনার কি কোনো কারনে মুড অফ? এভাবে থমথমে মুখে কেন আছেন উনি? পরে সময় করে সেটা জিজ্ঞেস করে নিবো। এইসব ভেবে আবার আনন্দ হই হুল্লোড়ে মেতে উঠলাম।

একে একে মুগ্ধ ভাইয়ার বাসার সকলে আপিকে হলুদ লাগিয়ে চলে গেলো৷ এখন আমাদের বাসার সকলেও আপিকে হলুদ দিচ্ছে। শুধুমাত্র আমাদের কাজিনমহলের সকলে বাকী আছি আপিকে হলুদ ছোঁয়ানোতে। ঠিক করলাম আমি আর আদ্র একসাথে আপিকে হলুদ ছোঁয়াবো৷ তাই এদিক ওদিক তাকিয়ে আদ্রকে খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ করেই লোকটা এভাবে চোখের আড়াল হয়ে গেলো কি করে? চারিদিকে চোখ বুলিয়ে শেষে ছাদের এক কর্নারে দেখলাম রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন দেখছে। মৃদু হেসে আমি আদ্রর দিকে এগোলাম। পথিমধ্যে ইরান ভাইয়া সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
–“হলুদ লাগাবে না?”

আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাতেই ইরান ভাইয়া প্রশস্ত হেসে বললো,
–“তাহলে চলো, যাওয়া যাক? একসাথেই হলুদ লাগিয়ে আসি?”

আচমকা ইরান ভাইয়ার এমন কথায় খানিক চমকে উঠলাম আমি৷ আদ্রর দিকে দৃষ্টি ফেলতেই দেখলাম আদ্র আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ উনার চোখের ভাষাটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। হাতে স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকালাম সেদিকে। ইরান ভাইয়া আমার হাত ধরে বললো,
–“কি হলো, দাঁড়িয়ে পড়লে যে? চলো।”

আমি আবারো আদ্রর দিকে তাকালাম। এবার উনার চোখদুটো দেখে আঁতকে উঠলাম আমি। আমার হাত ধরে রাখা ইরান ভাইয়ার হাতের দিকেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে উনি৷ বা হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে৷ আমি দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিলাম। হাসার চেষ্টা করে বললাম,
–“আপনি গিয়ে আপিকে হলুদ লাগান। আমি পরে দিবো।”

আমার কথায় ইরান ভাইয়ার হাসি হাসি মুখটাতে অন্ধকার নেমে এলো৷ তারপরও মৃদু হাসার চেষ্টা করে সেখান থেকে চলে গেলো। আমি ধীর গতিতে আদ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমাকে দেখেই উলটো ঘুরে রেলিঙের উপর দু হাত রেখে সামনে তাকিয়ে রইলেন। আমিও উনার পাশে দাঁড়িয়ে রেলিঙের উপর হাত রাখলাম। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
–“ওদিকে সবাই আপিকে হলুদ লাগাচ্ছে। চলুন না, আমরাও গিয়ে আপিকে হলুদ লাগিয়ে আসি।”

–“আ’ম নট ইন্ট্রেস্ট। তুমি যাও।”

আমি আদ্রর হাতের উপর হাত রেখে বললাম,
–“প্লিজ চলুন না। দুজনে একসাথেই আপিকে হলুদ দিয়ে আসি।”

আদ্র ঝামটা মেরে আমার হাত থেকে ওর হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর মৃদু চিৎকার করে বললো,
–“বললাম না আমি হলুদ লাগাবো না। তুমি যাও।”

–“র্ রেগে আছেন আপনি?”

–“নাহ।”

–“আমার মনে হচ্ছে আপনি কোনোকারনে রেগে আছেন। আচ্ছা আপনি কি আমার উপর রেগে___”

আদ্র এবার আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
–“নাহ, একদমই না। তোমার উপর কেন রেগে থাকবো আমি? তুমি পড়ে যাবে সেখানে ওই ছেলেটা তোমার বাহু ধরে তোমাকে বাঁচাবে তাতেও আমি রেগে নেই। তোমার দিকে মুগ্ধ নয়নে ছেলেটা তাকিয়ে থাকবে এতেও আমার রাগ উঠবে না। এই যে এখন, এখন ছেলেটা যে তোমার হাত ধরলো এতেও আমি রেগে নেই। কেন রেগে থাকবো আমি? তোমার কোনোকিছুতে আমার কিছু যায় আসে না। তোমার উপর রাগ করারও কোনো রাইট নেই আমার। কে তুমি? হু আর ইউ?”

উনার এতসব কথায় বেশ অবাক হলাম আমি। আমার অনিচ্ছায় কিছু ঘটে গেছে তার জন্য উনি এরকম বিহেভ করবেন আমার সাথে? লোকটা ভয়ংকর ভাবে রেগে আছে। বেশি ঘাটানো যাবে না। পরে হীতে বিপরীত হবে। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
–“ওসব তো ইচ্ছাকৃত ভাবে হয়নি। আর আমি কে? এই প্রশ্ন আপনি আমাকে করছেন? আপনিই তো অলওয়েজ বলেন আমি মিসেস মুশফিকান আদ্র। তাহলে আজ এই প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে আমি কে?”

–“ওহ রিয়েলি? তুমি মিসেস মুশফিকান আদ্র? তাহলে মিসেস মুশফিকান আদ্রকে আমি মুশফিকান আদ্র ছাড়া অন্যকেউ ছোঁয়ার সাহস পায় কি করে?”

–“ওটা অনিচ্ছাকৃত ভাবে___”

—“রুহি যাও এখান থেকে।”

–“আমার কথাটা___”

–“রুহি যেতে বললাম না তোমাকে আমি? মাথা ঠিক নেই আমার পরে উল্টাপাল্টা বলে ফেলবো তখন তুমিই কষ্ট পাবে। সো প্লিজ, যাও এখান থেকে।”

আর কথা বাড়ালাম না আমি। এখন এর থেকে বেশি কিছু বলতে গেলে আরো ভয়ানক কিছু হয়ে যেতে পারে তাই। উলটো ঘুরে চলে আসছিলাম। আদ্র আমার হাত ধরে টেনে রেলিঙের সাথে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“লিসেন, ইউ আর মিসেস মুশফিকান আদ্র। নো ওয়ান হ্যাস দ্যা রাইট টু টাচ ইউ। নো ওয়ান ক্যান টাচ ইউ। আই ডিড নট গিভ দ্যাট রাইট টু এনিওয়ান। হাউ ডাজ ইরান টাচ ইউ? হাউ? নেক্সট টাইম সামওয়ান ডেয়ারস টু টাচ ইউ, ইট উইল বি ভেরি ব্যাড।”

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে উনি আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে উনার সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। আমিও আর কিছু না বলে দৌড়ে চলে এলাম ওখান থেকে। নিচে নামার আগে সকলেই জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে আমার? আপিকে হলুদ লাগাতেও বলেছিলো৷ আমি মাথা ব্যাথার অযুহাত দিয়ে নিচে নেমে রুমে এসে দরজা লক করে দিয়েছি। মানলাম আমাকে অন্যকেউ টাচ করলে সেটা উনার সহ্য হয় না। তাই বলে এরকম বিহেভিয়ার করবে আমার সাথে? এতক্ষন খুব কষ্টে চোখের পানিগুলো আটকে রেখেছিলাম কিন্তু এখন আর পারছি না। না পেরে শেষে বালিশে মুখ গুজে কান্না করে দিলাম।

এভাবে কতটা সময় কেটেছে জানি না। খুব জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কানোর শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম পৌনে বারোটা বাজে। আর আমি রুমে এসেছিলাম দশটার দিকে। এতটা সময় যাবত ঘুমিয়েছি আমি? কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়েছি নিজেই জানি না। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম ফুপ্পিদের বাসায় আপির রুমে আছি৷ আজ আপির হলুদ৷ মূহুর্তেই আদ্রর তখনকার বিহেভিয়ার এর কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। নিমিষেই মুখটা কালো হয়ে গেলো আমার। দরজা ধাক্কানোর শব্দ ক্রমশ বেড়ে চলছে৷ তাই দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সামনে আদ্র দাঁড়িয়ে আছে৷ তারমানে এতক্ষণ যাবত উনিই ডেকেছেন? আদ্র রাগী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার হাত ধরে ভিতরে এসে দরজা লক করে দিলো। তারপর শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“কতক্ষণ যাবত দরজা ধাক্কাচ্ছি, দরজা খুলছিলে না কেন? জানো কতকটা টেনশন হচ্ছিলো আমার? আর একটু হলে টেনশনে মরে যেতাম আমি।”

আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ উনার বুকে মাথা রেখে উনার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি শব্দ শুনছিলাম। আদ্র আমার থুতনি ধরে মুখটা একটু উঁচু করে বললো,
–“আ’ম স্যরি বউ। আমি জানি আমি তোমাকে হার্ট করেছি। কষ্ট দিয়েছি অনেক। আমার বিহেভে তুমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু কি করবো বলো? তোমাকে অন্যকেউ টাচ করেছে সেটা আমার সহ্য হয়নি। তোমাকে আমি ছাড়া অন্যকেউ টাচ করেছে এটা মানতে পারিনি আমি। তাই রাগের মাথায় ওরকম বিহেভ করে ফেলেছি। আমি সত্যিই স্যরি বউ। প্লিজ রেগে থেকো না।”

তবুও কিছু বললাম না আমি৷ উনি আবারো বললো,
–“ও বউ স্যরি তো। আর এমন হবে না সত্যিই। তবুও প্লিজ কথা বলো আমার সাথে৷ রেগে থেকো না প্লিজ।”

–“রেগে নেই তো আমি৷ আমি কেন রেগে থাকবো? উলটো রেগে থাকবেন তো আপনি। আপনাকে আমি রাগিয়ে দিয়েছি। স্যরি তো আমি বলবো, আপনি না।”

আদ্র আমাকে ঘুড়িয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমার ঘাড়ে ওর থুতনি রেখে বললো,
–“আমি জানি তোমার মনে অভিমানের পাহাড় জমেছে৷ আমার উপরই তো অভিমান করেছো। তাহলে তোমার সব রাগ দুঃখ কষ্ট অভিমান যা আছে সব আমার উপর ঝেড়ে ফেলো৷ আমাকে মারো, কাটো যা ইচ্ছে করো। তবুও প্লিজ এভাবে চুপ করে থেকো না।”

উনার এত এত কথার পিঠেও আমি কিছু বললাম না। এবার উনি গোমড়া মুখে বললো,
–“প্লিজ বউ কথা বলো না। তুমি বলেছিলে না, আমি রাগ করে তোমার সাথে কথা না বললে তোমার ভিতরে পুড়ে যায়? বিশ্বাস করো, তুমিও যে এখন অভিমান করে আছো আমার উপর। অভিমান থেকে যে কথা বলছো না এতেও আমার ভিতর জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

ব্যাস! এতটুকুই ছিলো আমার অভিমানের পাহাড় নিমিষেই ভেঙে দিতে। উনার কথায় সব অভিমান পড়ে গেলো আমার। পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে উনি আমার পেটের উপর হাত দিয়ে রেখেছিলেন। আমি উনার সেই হাতের উপর হাত রেখে পুরো ভর ছেড়ে দিলাম উনার উপর। উনি মুচকি হেসে উঠলো। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“সত্যিই স্যরি বউ।”

–“ইট’স ওকে।”

উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার হাত ধরে বললো,
–“চলো।”

–“কোথায়?”

–“নীলাদ্রি আর মুগ্ধকে হলুদ দিবে না?”

আমি গোমড়া মুখে বললাম,
–“এখন আর হলুদ দিয়ে কি হবে? সবাই যা মজা করার তা তো করেই নিয়েছে।”

–“আমার বউকে ছাড়া সকলেই আনন্দ হই হুল্লোড় করে নিবে তা আবার কখনো হয় নাকি?”

–“মানে?”

–“মানে রুপ ওরা কেউ এখনো হলুদ লাগায়নি, সবাই তোমার জন্য ওয়েট করছে। চলো এখন।”

কথাগুলো বলে আদ্র আবারো আমার হাত ধরে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। আমি উনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
–“আরে, একটু তো দাঁড়ান। সাজ নষ্ট হয়ে গেছে। শাড়ি কুচকে আছে একটু ঠিকঠাক করে নেই সব।”

এবার উনি পুরো দৃষ্টি ফেলে দেখলেন আমাকে। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,
–“যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এসো।”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলাম হাত-মুখ ধুতে। কিছুক্ষন বাদে বের হয়ে এলাম। হাত মুখ মুছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে নিলাম। পেছন থেকে আদ্র এগিয়ে এসে কুচকে থাকা শাড়ি ঠিক করে দিলো৷ ব্যাস! এতেই রেডি। তারপর আমার হাত ধরেই বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

ছাদে গিয়ে দেখলাম সবাই অসহায়ের মতো যে যেখানে পেরেছে বসে বসে ফোন ঘাটছে, কেউ আবার আড্ডা দিচ্ছে৷ আমাকে আর আদ্রকে দেখে কাজিন মহলের সকলে এগিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। শান ভাইয়া বললো,
–“এট লাস্ট, তোমার আসার সময় হয়েছে ছোট গিন্নী? তুমি তো দিব্যি নিচে গিয়ে আরামসে দু ঘন্টা ঘুমিয়ে এলে। আর এদিকে আমরা এখানে বসে বসে মশা মারছিলাম আর তোমার আসার অপেক্ষা করছিলাম।”

–“স্যরি ভাইয়া সবাইকে অপেক্ষা করানোর জন্য৷ তবে তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা না করলেও পারতে।”

–“হ্যাঁ তোকে রেখে আমরা সকলে আনন্দ হই হুল্লোড় করে ফেলতাম, তারপর তোর হবু বর আই মিন আদ্র আমাদের সকলকে আস্ত রাখতো তাই না?”

রুপ ভাইয়ার কথায় আদ্র চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকালেও বাকী সকলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। আম মাথা নিচু করে নিলাম। ফারাবী ভাইয়া বললো এবার যাতে সবাই হলুদ লাগিয়ে নেই। একে একে সবাই গিয়ে আপি আর মুগ্ধ ভাইয়াকে হলুদ লাগালো। সবার শেষে আমি আর আদ্র গিয়ে হলুদ লাগালাম। হলুদ পর্ব শেষ করে শুরু হলো নাচ-গানের অনুষ্ঠান। শান ভাইয়া এবং রুশাপুর দুর্দান্ত কাপল ডান্সের মধ্য দিয়ে জমে উঠলো নাচ-গানের আসর। ফাইজা আর রুপ ভাইয়াও কাপল ডান্স করেছে। আমি ফাইজা হিমাদ্রি রুশাপু মাইশা তিন্নি ছয়জনে মিলে একটা গ্রুপ ডান্স করেছি। তারপর সব ভাই বোনেরা মিলে আপিকে নিয়ে পারফর্ম করেছি। লাস্টে মুগ্ধ ভাইয়া এবং আপি সুন্দর একটা কাপল ডান্স করে৷ নাচ-গান শেষে সকলে ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।

রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ বাজে। মিডিয়াম ভলিউমে সাউন্ড বক্সে গান বাজছে। আমরা সকলে মিলে আড্ডা দিচ্ছি। আম্মু এসে বেশ কয়েকবার সকলকে নিচে গিয়ে শুয়ে পড়তে বলেছে। রাত অনেক হয়েছে কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। শান ভাইয়া বললো,
–“আমরা সবাই কমবেশি পারফর্ম করেছি। আদ্র কিন্তু একটা পারফর্মও করেনি৷ আর রুহি পারফর্ম করার সময় ওরদিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। সেটা কি কেউ লক্ষ্য করেছিলে?”

শান ভাইয়ার কথায় হিমাদ্রি আর রুশাপু সায় জানালো। আদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাঁকা হেসে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম আমি। শান ভাইয়া বললো,
–“আমি একটা কথা বলতে চাই। তবে সবাইকে আমার সাথে একমত হতে হবে।”

ভাইয়ার কথায় সকলে আশ্বাস দিলো যে সবাই একমত হবে। শান ভাইয়ার মতলব ভালো ঠেকছে না৷ তাই দ্রুত উঠে পড়লাম ওখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু শান ভাইয়া আমার হাত ধরে আমায় বসিয়ে দিয়ে বললো,
–“আমরা সবাই পারফর্ম করেছি। শুধু আদ্র করেনি৷ তাই আমি চাচ্ছিলাম আদ্র আর রুহি দুজনে মিলে একটা পারফর্ম করুক। কি বলো সবাই?”

এটারই ভয় পাচ্ছিলাম আমি। জানতাম শান ভাইয়া এরকম কিছুই বলবে। শান ভাইয়া কথায় সকলে বেশ হই হুল্লোড় করেই মত প্রকাশ করলো। এদিকে আমি অসহায় চোখে সকলের দিকে তাকিয়ে আছি৷ শান ভাইয়া আদ্রকে বললো,
–“আদ্র তুমি কি বলো? আই হোপ তোমার কোনো আপত্তি নেই এতে।”

শান ভাইয়ার কথায় আদ্র মৃদু হাসলা। তারপর আমার দিকে তাকালো। আমি ইশারায় না করতে বললাম উনাকে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আদ্র বললো,
–“আমার কেন আপত্তি থাকবে? আমার জন্য তো আরো ভালো নাচ করার সুবাদে হলেও বউকে কিছুটা কাছে পাবো।”

চলবে~

#অ্যাডিক্টেড_টু_ইউ
#অরনিশা_সাথী
#পর্ব_১১

আদ্র উঠে এসে আমার সামনে এক হাত বাড়িয়ে দিলো। কাঁপা-কাঁপা হাতে উনার হাতে হাত রাখলাম আমি। আদ্র আমাকে নিয়ে স্টেজে উঠে গেলো। সব লাইট অফ হয়ে গেলো। সাউন্ড বক্সে ‘তেরি মেরি, মেরি তেরি প্রেম কাহানি’ গান বাজতেই আদ্র আর আমার উপর স্পট লাইট জ্বলে উঠলো। গান শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আদ্র আমার চারিপাশে ঘুরলো। তারপর আমার হাত ধরলে দুজনে দুদিকে হেলে গেলাম। স্পট লাইট অফ হয়ে হালকা নীল এবং হলুদ বাতি জ্বলে উঠলো আশেপাশে। নীল এবং হলুদ বাতির আলোয় আমাদের দুজনের মুখ আবছা দেখা যাচ্ছে। শুধু অবয়বটাই বেশি বোঝা যাচ্ছে। আদ্র আমার হাত ধরে টেনে একদম উনার সাথে মিশিয়ে নিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে এদিক ওদিক হেলে নাচ করতে লাগলে কিছুক্ষণ। আমাকে নিজের থেকে সরিয়ে কিছুটা দূরে ঠেলে দিয়ে আবার একটানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আদ্র একহাতে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরেছে এবং অন্য হাতে আমার হাত মুঠো করে ধরেছে। আমিও একহাতে আদ্রর গলা আকঁড়ে ধরলাম। তারপর চোখে চোখ রেখে দু/তিনবার ঘুরলাম এভাবেই। আদ্র আমাকে নিচের দিকে ছেড়ে দিলো। আমি পেছন দিকে হেলে আছি। আর আদ্র ঝুঁকে আছে আমার দিকে। তারপর আবার একটানে উঠিয়ে নিলো। বা-হাতটা ধীরে ধীরে আমার শাড়ির নিচে দিয়ে উম্মুক্ত পেট খামচে ধরে ঘাড়ের কাছে মুখ আনলো৷ আমার পেটে রাখা আদ্রর হাত খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলাম আমি। আমার অন্য হাতে আদ্র উঠিয়ে উনার গাল স্পর্শ করালো। আদ্রর বুকে আমার পিঠ লেগে আছে। হুট করেই আদ্র আমার দুহাত ধরে উপরে তুলে নিলো। আদ্রর মুখ তখন আমার পিঠ স্পর্শ করে৷

আচমকাই চমকে উঠলাম আমি। লোকটা আজ কি করছে এসব? কাপল ডান্স তো আরো অন্যভাবেও করা যায়৷ উনি এত ক্লোজ ভাবে কেন করছেন? আমার দিকটা কি বুঝতে পারছেন না একবারো? বুকের ভিতর ধুকপুকানি শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলছে। কয়েক সেকেন্ড বাদে নামিয়ে দিলো আমাকে। আমার ডান হাতের আঙুল ধরে কিছু সময় ঘোরালো আমাকে৷ তারপর আবার আমাকে টেনে নিয়ে ওর বুকের সাথে আমার পিঠ ঠেকালো। আমার হাত ধরেই দুদিকে দু হাত মেলে দিয়ে আবার আমার দুহাতে উনার গাল স্পর্শ করালো। তারপর আবার আমাকে ঘুরিয়ে উনার মুখোমুখি দাঁড় করালো। আমি একহাত উনার কাঁধে দিয়ে অন্যহাত দিয়ে উনার হাত মুঠো করে ধরেছি৷ আর উনি একহাতে আমার কোমড় চেপে ধরেছে। পলকহীনভাবে দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি।

এভাবে কতটা সময় কেটেছে জানি না। তবে গান বন্ধ হওয়ার পর সকলের হাততালি আর সিটি বাজানোর শব্দে আমাদের দুজনেরই ঘোর ভাঙে৷ আদ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে স্টেজ থেকে নেমে গেলাম আমি৷ আদ্রর চোখদুটোর মাঝে কিছু একটা ছিলো। উনার চোখ দুটোতে আমি আমাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখেছি। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও উনার ওই চোখে ডুবে গেছিলাম আমি। সিড়ির দিকে যাওয়ার আগেই হিমাদ্রি আর মাইশা এসে আমাকে টেনে সকলের ওখানে নিয়ে যায়৷ দুজনে দু পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আমায়। মাইশা আমার দিকে ঝুকে বললো,
–“আমার ভাইয়া যে বেশ রোমান্টিক আমি আগেই জানতাম। কিন্তু আমার ভাবীটাও যে এত্ত রোমান্টিক সেটা জানা ছিলো না তো।”

মাইশার কথায় হিমাদ্রি হতাশ কন্ঠে বলে,
–“আমরাই এতদিনে জানতে পারলাম না৷ আর তুমি কি জানবে? ভাগ্যিস শান ভাইয়া আজ ওদের কাপল ডান্সের কথা বলেছিলো, নয়তো আজো জানতে পারতাম না যে আমাদের রুহিও এত্ত রোমান্টিক।”

ওদের দুজনের কথায় এদিকে আমি লজ্জায় হাঁশফাঁ’স করছি। আমি আর নাচলাম কই? যা নাচানোর তা তো আদ্রই নাচালেন আমাকে। আমার এমন চিন্তার মাঝেই শান ভাইয়া আমাকে নিয়ে আদ্রর পাশে দাঁড় করালেন৷ লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। শান ভাইয়া বললেন,
–“নাচের পুরোটা সময় দেখলাম আদ্র নেশাগ্রস্ত দৃষ্টিতে রুহিকে দেখছে৷ ওর থেকে যেন চোখই সরছিলো না৷”

শান ভাইয়ার কথায় আদ্রর দিকে তাকালাম আমি। উনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাই মাথা নিচু করে নিলাম। শান ভাইয়া আবারো বললো,
–“আদ্রর যা অবস্থা দেখছি তাতে তো আমার মনে হচ্ছে, ছোট মামাকে যেভাবেই হোক রাজি করিয়ে খুব শীঘ্রই রুহিকে আদ্রর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো এই ছেলে কখন কি করে বসে আল্লাহ মালুম।”

শান ভাইয়ার কথায় আদ্রর চোখমুখে খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠলো৷ আদ্র আমার দিকে তাকিয়েই শান ভাইয়াকে বললো,
–“হ্যাঁ ভাইয়া প্লিজ, এই ব্যবস্থাটা অন্তত করে দিন আমাকে। গত সাড়ে তিনটে বছর যাবত ওয়েট করছি আপনার শালীকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। আংকেল যা-ই ওকে এখন আমার নামে করে দিয়েছে কিন্তু পুরোপুরি ভাবে পাওয়ার অনুমতিটা এখনো দিচ্ছে না। মানে বিরিয়ানির প্লেট আমার সামনে দিয়ে রেখেছে কিন্তু আমি খেতে পারবো না। এটা কি ভাবে পসিবল বলুন? ছেলেমানুষ তো ভুলভাল কিছু তো করে ফেলতেই পারি।”

আদ্রর এরকম লাগামহীন কথাবার্তায় সেখানে উপস্থিত সকলে হেসে দিলেও লজ্জায় মাথা নুইয়ে ছিলাম আমি। এভাবে আরো কিছুক্ষণ হাসি ঠাট্টা করার পর সকলেই বললো আমাদের নাচটা নাকি খুব সুন্দর হয়েছিলো৷ ছাদে আরো কিছু সময় কাটিয়ে নিচে নেমে যাই সকলে।

ভোর সাড়ে চারটা বাজে৷ চোখটা লেগে এসেছিলো এমন সময় ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। দেখলাম আদ্রর ম্যাসেজ। তাই ডায়াল করলাম উনার নাম্বারে৷ দু বার রিং হতেই রিসিভ করলেন উনি। ঘুম জড়ানো কন্ঠে আমি বললাম,
–“হ্যাঁ বলুন, কি জন্য ম্যাসেজ করেছিলেন?”

আদ্র খানিক সময় ওর বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরে বসে রইলো। তারপর ধরা গলায় বললো,
–“ইশ্! বউ কি দরকার ছিলো ঘুমের ঘোরে ফোন দেওয়ার? এখন আমার ঘুমটা তো নষ্ট করে দিলে।”

আদ্রর কথায় পাত্তা না দিয়ে আমি বললাম,
–“ম্যাসেজ করেছিলেন যে? কিছু দরকার?”

–“উমম ছিলো, কিন্তু এখন আর লাগবে না৷ ঘুমিয়ে পড়ো তুমি।”

–“সমস্যা নেই, বলুন আপনি।”

–“পেটের মধ্যে ইদুর দৌড়াদৌড়ি করছে৷ ভীষণ ক্ষু___”

আদ্রর এতটুকু কথা শুনেই ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি। তারপর দ্রুত কন্ঠে বললাম,
–“রাতে কিছু খাননি আপনি?”

–“উঁহু, রেগে ছিলাম তো আপনার উপর। তাই আর খাওয়া হয়নি।”

–“আপনি আমার উপর রাগ করে খাননি, আর এদিকে রুশাপু আমাকে খাইয়ে দিয়েছিলো আর আমিও দিব্যি খেয়ে নিছি৷ ইশ্! কি বিশ্রী একটা ব্যাপার। আচ্ছা আপনার সাথে কি আর কেউ আছে?”

–“নাহ। আমি একাই আছি।”

–“আপনি একটু বসুন, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

–“এখন আর লাগবে না৷ আপনি ঘুমান৷ আপনার ওই ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনে আমার পেট ভরে গেছে।”

–“নো সাউন্ড। চুপচাপ বসে থাকুন, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলেই ফোন রেখে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি৷ কিচেনে গিয়ে দেখলাম ফুপ্পি আর আম্মু চা করছে৷ ড্রয়িংরুমে আব্বু আর বড় চাচা আংকেল মামা সকলেই বসে আছেন৷ সম্ভবত উনাদের জন্যই চা করছেন৷ আমাকে এসময় কিচেনে দেখে বেশ অবাক হলেন আম্মু আর ফুপ্পি। আম্মু এগিয়ে এসে বললেন,
–“কি ব্যাপার রুহি? সকলে ঘুমিয়ে আছে, তুমি এত ভোরবেলা কিচেনে যে?”

–“আসলে আম্মু__”

–“কি হয়েছে বলো? কিছু লাগবে?”

–“উনি রাতে কিছু খাননি। তাই উনার জন্য খাবার__”

–“কে আদ্র?”

আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানাতেই আম্মু চটে গেলেন আমার উপর৷ চোখ রাঙিয়ে বললো,
–“আদ্র রাতে কিছু খায়নি তুমি আমাকে এখন বলছো? ইশ্ ছেলেটার নিশ্চয়ই অনেক ক্ষুধা লেগেছে৷ রুহি তুমি কি একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারো না? ছেলেটা সারারাত কিছু খায়নি আর তুমি এখন__”

–“আমি কি জানতাম নাকি উনি আমার উপর রাগ করে রাতে না খেয়ে থাকবে? আমি তো ভেবেছিলাম উনি খেয়ে নিয়েছেন সকলের সাথে।”

আম্মু কিছুক্ষণ বকাবকি করলেন আমাকে। তারপর প্লেটে গরম গরম ভূনা খিচুড়ি আর কষা গরুর গোশত তুলে দিয়ে প্লেট আমার হাত দিয়ে বললেন,
–“পুরোটা যেন শেষ করে৷ একটু খাবারো যাতে ফেরত না আসে।”

আমি চুপচাপ প্লেট হাতে বেরিয়ে গেলাম। যাহ বাবা! এখানে আমার দোষ কি? আম্মু শেষের কথাগুলো বলার সময় এমন লুক দিয়েছে আমার দিকে মনে হলো আমি মানুষ খুন করার মতো বিরাট বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আদ্রকে যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেই রুমের দরজায় টোকা দেওয়ার আগেই আদ্র দরজা খুলে আমার হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে দরজা লক করে দিলো। আচমকা এমন হওয়াতে বেশ ভড়কে গেলাম আমি। উনি আমার হাত থেকে খাবার প্লেটটা নিয়ে বেড সাইড টেবিলে রেখে দিলেন। তারপর উনি বিছানায় বসে পড়লো। আমি পাশেই দাঁড়িয়ে দরজার দিকে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম৷ কেউ যদি এভাবে দরজা বন্ধ অবস্থায় দেখে তাহলে নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা ভাববে৷ তাই আমি উনার দিকে ঘুরে বললাম,
–“আম্মু বলে দিয়েছে পুরো খাবারটা শেষ করতে। আপনি খেয়ে নিন, আমি আসছি।”

কথাটা বলে উলটো ঘুরে চলে আসতে নিলেই আদ্র আমার হাতের কবজি ধরে টেনে উনার কোলে বসিয়ে দিলেন। পেছন থেকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বললেন,
–“এখন তো যেতে দিচ্ছি না।”

–“কেউ যদি এভাবে দেখে অন্যকিছু মনে___”

–“কেউ যাতে না দেখে সেজন্যই তো দরজা বন্ধ করেছি। আর আমি তো অন্যকিছু করছি না। তবে নাচ করার সময় ভীষন ইচ্ছে করছিলো জানো?”

–“ক্ কি?”

–“অন্যকিছু করার।”

–“ধ্যাত! শুধু অসভ্য মার্কা কথাবার্তা। ছাড়ুন আমায়।”

–“ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে।”

–“তো ছাড়ুন আমায়। খেয়ে নিন।”

–“খাইয়ে দিবে?”

–“আ্ আমি?”

–“হ্যাঁ, কেন খাইয়ে দিবে না?”

–“তো খাইয়ে দেওয়ার জন্য তো ছাড়তে হবে আমাকে। এভাবে কোলে বসিয়ে রাখলে কিভাবে খাইয়ে দিবো?”

আদ্র মৃদু হেসে ছেড়ে দিলো আমাকে। আমি উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে গিয়ে প্লেট নিয়ে উনার সামনে বসলাম। উনি আয়েস করে বসলো। কাঁপা কাঁপা হাতে লোকমা তুলে ধরলাম উনার মুখের সামনে। উনি বেশ আয়েশ করেই খেলেন আমার হাতে। মাঝে উঠে গিয়ে নিজেও হাত ধুয়ে এসে খাইয়ে দিলেন আমাকে। খাওয়ানোর মাঝে বেশ ক’বার ইচ্ছে করেই আমার হাতে কামোড় বসালেন উনি। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই উনি বোকা বোকা হাসি দিতেন। খাওয়ানো শেষে প্লেট নিয়ে উঠে গেলাম আমি। দরজার কাছে যেতেই পেছন থেকে উনি আবারো বললো,
–“প্লেট রেখে আবার একটু আসবে?”

–“কোনো দরকার ছিলো?”

–“না এমনিতেই।”

আমি আর কিছু না বলে চলে এলাম ওখান থেকে। কিচেনে গিয়ে প্লেট ধুয়ে রেখে দিলাম৷ সকাল ছয়টা বাজে এখন। সারা বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা। শুধু বাইরে যে রান্না/বান্না চলছে তার শব্দ আসছে৷ আব্বু আম্মু ফুপ্পি সকলেই বোধহয় চা খেয়েই ঘন্টা খানেকের জন্য শুতে গিয়েছেন। আমরা যে রুমে শুয়েছিলাম ওই রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলাম। হুট করেই আদ্রর কথা মনে হলো। যেতে বলেছিলেন আমাকে আবার। তাই আর রুমে না গিয়ে আদ্রর কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। রুমে ঢুকে দরজাটা চাপিয়ে দিলাম। হালকা নীল রঙা ড্রীম লাইটের আলোতে রুমটার সবকিছুই আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। আমি যখন বের হলাম তখনও তো লাইট অন ছিলো। তাহলে কি উনি ঘুমিয়ে পড়লেন? ভাবলাম চলে আসবো। তাই রুম থেকে বেরিয়েও যাচ্ছিলাম। কিন্তু কি মনে করে যেন আবার বিছানার কাছে এগিয়ে গেলাম। আদ্রর ঘুমন্ত মুখ দেখার লোভটা কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। ধীর পায়ে বিছানায় উঠে আদ্রর পাশে বসলাম। উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে লোকটা৷ গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। ফর্সা গায়ে কালো গেঞ্জিটা অসম্ভব রকমের সুন্দর লাগছে। একটু আগেই লোকটাকে দেখলাম ফোন ঘাটছে। আমি গিয়েছিলাম ১০/১৫ মিনিট হবে। এর মাঝেই এমন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো লোকটা? হালকা ড্রীম লাইটের আলোয় উনার ঘুমন্ত মুখটা দেখতে অসম্ভব রকমের ভালো লাগছে৷ ঘুমালেও কাউকে এতটা সুন্দর দেখায়? এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেছে।

উনাকে দেখতে দেখতে কখন যে সাড়ে ছয়টা নাগাদ বেজে গেছে বুঝতে পারিনি। চারিদিকে অন্ধকার ডুবে গিয়ে আলো ফুটে উঠছে৷ মানুষজন ঘুম থেকে উঠতে শুরু করছে। জানালা ভেদ করে হালকা সূর্যের আলো ঘরে প্রবেশ করেছে। আদ্রর এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো ভীষণ। তাই উনার চুলের ভাজে আঙুল ঢুকিয়ে দিলাম আমি। ভীষণ রকমের ভালোলাগার মূহুর্ত নিয়ে উনার চুলগুলো ছুঁয়ে দেখছি আমি৷ হুট করেই মনের মাঝে এক সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠলো আমার। যা হয়তো উনি জাগ্রত অবস্থায় পূরন করতে পারবো না আমি৷ আমার ঘুমন্ত আদ্রকে ভীষণ করে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ মানে ভীষণ রকমে। নিজের এই অবাধ্য ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে আচমকাই আদ্রর কপালে চুমু দিয়ে বসলাম আমি। নিজের কাজে নিচেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি করলাম এটা আমি? আমার স্পর্শ পেয়ে যদি উনার ঘুম ভেঙে যেতো তখন কি লজ্জাজনক একটা অবস্থায় পরতাম আমি। ইশ্! ভাবতেই লজ্জা লাগছে৷ চলে আসতে নিলেই আদ্র আমার হাত ধরে এক টান দিলো৷ ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে উনার বুকের উপর গিয়ে পড়লাম আমি৷ ইশ্! উনি এতটা সময় জেগে ছিলেন? কি হবে এবার? উনি তো লজ্জা দিতে দিতেই মেরে ফেলবেন আমাকে। আদ্র একহাতে শক্ত করে আমার কোমড় খামচে ধরে অন্যহাত দিয়ে আমার মুখের উপর পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিলেন৷ তারপর বাঁকা হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“এমনিতে তো বেশ লজ্জা পাও। আর এখন আমার ঘুমানোর সুযোগ নিয়ে আমার কপালে চুমু দেওয়া হচ্ছে তাই না? দিস ইজ নট ফেয়ার রুহি।”

–“ন্ না মানে__”

–“আমি কিন্তু কারো কাছে ঋণী থাকি না৷ সুধ সমেত ফেরত দিবো এখন আমি।”

কথাটা বলে উনি আমার দিকে এগোতে গেলেই জোর করেই উনার উপর থেকে উঠে গিয়ে বিছানা থেকে নেমে যাই আমি। আমার কান্ডে উনি শব্দ করে হেসে দিলেন। আমি দৌড়ে রুম থেকে বের হতেই দেখি আপির ফুপ্পি অগ্নিচোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললাম আমি। উনি আশেপাশের মানুষের কথা নিয়ে পড়ে থাকেন বেশি। তিলকে তাল বানিয়ে সারা এলাকা ছড়াছড়ি করে বেড়ান। উনার এমন চাহনীর কোনো কারন খুঁজে পেলাম না আমি। হুট করেই আঁতকে উঠলাম আমি। আদ্র আর আমাকে একসাথে দেখেনি তো? ভয়ে ভিতর শুকিয়ে এলো আমার। আপির ফুপ্পি আমাকে মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
–“তোমাকে তো আমি অনেক ভালো মনে করেছিলাম রুহি। তোমাকে দিয়ে এসব আশা করিনি৷ তুমি এরকম? ছিঃ।”

–“ফুপ্পি আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু না। ভুল ভাবছেন আপনি।”

–“হয়েছে হয়েছে, তোমার ওই মুখে আর কথা বলা শোভা পায় না৷ ধরা পড়লে সবাই এরকম বলে। তোমাকে তো সবাই খুব ভালো সুশীল একটা মেয়ে ভাবে কিন্তু তুমিও যে ওইসব ন/ষ্টা মেয়েদের মতো ছেলেদের সাথে ঘঁষা/ঘঁষি করো সেটা তো জানতাম না আমি।”

উনার এমন বিশ্রী সব কথা শুনে চোখ পানিতে ভরে উঠলো আমার। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। উনার এমন বড় আওয়াজের কথা শুনে ততক্ষণে আদ্র রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে মরিয়া হয়ে বললো,
–“রুহি, এই রুহি কাঁদছো কেন? কি হইছে বলো আমাকে।”

আমি কিছু না বলে কেঁদেই যাচ্ছি। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে আমার। আপির ফুপ্পি আদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“সারারাত ফষ্টি/নষ্টি করে সকাল বেলা ধরা পড়লে ওরকম ন্যাকা কান্না সকলেই করে।”

আমার কান্নার পরিমান আরো বেড়ে গেলো৷ আদ্র অবাক চোখে তাকালেন উনার দিকে। অবাক কন্ঠেই বললেন,
–“মানে, কি বলতে চাইছেন আপনি?”

আদ্রর কথায় আপির ফুপ্পি আমার হাতের কবজি ধরলেন শক্ত করে। তারপর বললেন,
–“এখন যা বলার সকলের সামনেই বলবো।”

কথাটা বলেই টানতে টানতে আমাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে সোফায় আব্বু, বড় চাচা, আংকেল এবং ফাইজার আব্বু সকলেই বসে চা খাচ্ছিলেন। শান ভাইয়া আর রুশাপুও পাশে বসে কথা বলছে। আপির ফুপ্পি আমাকে টেনে ড্রয়িংরুমের সামনে এনে আব্বুর দিকে কিছুটা ঠেলে দিয়ে বললেন,
–“এই যে তোমাদের এত আদরের ভদ্র মেয়ের আসল চেহারা আজ আমার সামনে ফাঁ/স হয়ে গেছে।”

আংকেল চায়ের কাঁপটা টি-টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে বললেন,
–“তুই কি বলতে চাচ্ছিস আপা?”

–“তোদের এই আদরের মেয়ে রুহিকে আমি ওই ছেলেটার সাথে একইরুমে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছি।”

আদ্রকে আর আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন উনি। আমি তখনো নিঃশব্দে কাঁদছি। ততক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আম্মু ফুপ্পি বড় চাচি কাজিন মহলের সকলেই ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সাথে বিয়ে বাড়িতে আসা অন্যসব লোকজন তো আছেই। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। সামান্য একটা বিষয়কে উনি কিভাবে টেনে হিঁচড়ে বড় করছেন। আব্বু এবার গলা উঁচু করে বললো,
–“আমার মেয়ের নামে একদম উল্টাপাল্টা কিছু বলবেন না আপনি। কতটুকু চিনেন আপনি আমার মেয়েকে? যে ওকে নিয়ে এসব আজেবাজে কথা বলছেন আপনি।”

–“যা চেনার আমি চিনে নিয়েছি। ছিঃ ছিঃ কিভাবে দুজনে জড়াজড়ি করছিলো। এসব বলতেও আমার মুখে বাঁধছে।”

উনার কথায় এবার আদ্র পুরোপুরি রেগে গেলো। চিৎকার করে বললো,
–“আপনি বয়সে বড় বলে এতক্ষণ আমি চুপ করে ছিলাম। তাই বলে যে আপনি উল্টাপাল্টা বলেই যাবেন আর আমি চুপচাপ সেসব মেনে নিবো এমন হবে না। আপনি জানেন রুহি আমার কি হয়? ওর সাথে আমার কি সম্পর্ক সেটা জানেন আপনি?”

–“তা আর জানতে বাকী কই? নিজের চোখের তো দেখলাম কি সম্পর্ক তোমাদের দুজনের।”

আপি এবার ওর ফুপ্পির দিকে এগিয়ে এসে বললো,
–“ফুপ্পি অনেক বলে ফেলছো তুমি। আর একটা কথাও বলবে না। না জেনেশুনে কি বাজে বকছো তুমি?”

–“আমি বাজে বকছি? তোদের আমার কথাগুলো বাজে মনে হচ্ছে? আমি বাজে বকার মতো মানুষ?”

–“ফুপ্পি তুমি কেমন তা আমরা সকলেই জানি। ছোট একটা বিষয়কে তুমি পেঁচিয়ে অনেক বড় করে ফেলো। মানুষের জীবনে কি হয় না হয় সেসব নিয়ে তুমি টানা/হেঁচড়া করো বেশি।”

হিমাদ্রির কথায় ওর ফুপ্পি হিমাদ্রির দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তারপর আবার বললেন,
–“যে মেয়ের হয়ে তোরা সকলে এত সাফাই গাইছিস তো সেই মেয়েকেই জিজ্ঞেস কর না এই ভোর সকালে ওই অচেনা ছেলেটার ঘরে একই বিছানায় দুজনে কি করছিলো?”

ফুপ্পি এগিয়ে এসে তেজ দেখিয়ে উনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“আপা, আপনি অনেক্ক্ষণ যাবত আমার ভাইজিকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করেই যাচ্ছেন। ওদের নিয়ে আর একটা কথাও বলবেন না আপনি। ওরা দুজনে___”

–“আজকাল দেখছি ভালো বললেও দোষ। তোমার ভাই ভাবী মেয়েকে এই শিক্ষা দিয়েছেন? ন/ষ্টা মেয়েদের মতো ছেলেদের সাথে__কে বিয়ে করবে এরকম একটা মেয়েকে?”

সবাই উনাকে আমার আর আদ্রর সম্পর্কের কথাটা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু উনি সেটা কানেই নিচ্ছেন না। উলটো আজেবাজে বলে যাচ্ছেন। আদ্র এককোনে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে উনার। রুপ ভাইয়া আদ্রকে সামলানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আম্মু বললেন,
–“আমার মেয়ের বিয়ের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আমার বিয়ে নিয়ে ভাবার জন্য আমরা এখনো বেঁচে আছি।”

আপির ফুপ্পি মুখ ভেংচি কেটে সোফায় গিয়ে বসে পান মুখে দিলেন। হুট করেই ইরান ভাইয়া আব্বুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
–“আংকেল আপনি যদি আপত্তি না করেন তাহলে রুহিকে আমি বিয়ে করবো। রুহির কখনো কোনো অযত্ন হতে দিবো না আমি। আংকেল আপনি আমাকে প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না।”

চলবে~

[ রি-চেক করিনি।