অ্যাডিক্টেড টু ইউ পর্ব-০৩

0
460

#অ্যাডিক্টেড_টু_ইউ
#অরনিশা_সাথী
#পর্ব_০৩

–“আপি আমি উনার সাথে কোথাও যাবো না। তুমি প্লিজ আম্মুকে একটু বোঝাও না। অচেনা একটা ছেলের সাথে উনি কি করে পারছেন নিজের মেয়েকে একা ছাড়তে?”

আমি কথাটা বলার সাথে সাথেই আপি ধমকে উঠলেন আমাকে। রাগী স্বরে বললেন,
–“অচেনা কোথায় রুহি? মামা মামি আদ্রকে তিন বছর আগে থেকে চিনে। যখন তুমি ক্লাস টেনে পড়ো। আর তাছাড়া গতকাল তোমার নামের পাশে আদ্রর নাম যুক্ত হয়েছে। তোমাকে ওর নামে করে নিয়েছে ও। তাহলে এরপরেও কি করে অচেনা থাকে ও?”

আপির কথা শুনে মাথা নিচু করে নিলাম। সব্বাই উনার সাপোর্টে। আমার কথা কেউ শুনছেই না। আমি বিড়বিড় করে বললাম,
–“তোমরা সবাই উনাকে আগে থেকেই চিনো। কিন্তু আমি তো আর আগে থেকে চিনি না। কালই ফার্স্ট দেখেছি। এখন উনাকে নিয়ে আমার মনে তো সংশয় থাকতেই পারে এটা কি আমার দোষ? এখন উনি যদি আজ আমাকে উনার সাথে করে অনেক দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরে গুম করে ফেলে তখন? তখন কি হবে?”

আমি কথাগুলো বিড়বিড় করে বলে ভয়ে আঁতকে উঠলাম। সত্যিই যদি উনি এরকম করেন? আমার বিড়বিড় করে বলা প্রত্যেকটা কথাই আপি শুনেছে। আপি অবাক হয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“লাইক সিরিয়াসলি? তোমার এরকমটাই মনে হয়? আদ্রর ব্যাপারে এরকম ধারনা পুষে রেখেছো তোমার মনে?”

তড়িৎ গতিতে চোখ তুলে তাকালাম আপির দিকে। ইশ্! কথাটা বুঝি একটু জোরেই বলে ফেলেছি। ধ্যাত আমিও না! আপি আবারো বললো,
–“রুহি ছোট মামাকে কম বেশি আমরা সবাই ভয় পাই। কারন উনি খুবই স্ট্রিক্ট৷ বিশেষ করে ছোটদের লাইফ স্টাডি এসব নিয়ে উনি একটু বেশিই স্ট্রিক্ট। তোমার ছোটখাটো বিষয়েও মামা কতটা সিরিয়াস থাকে সেটা নিশ্চয়ই জানো তুমি। সেখানে বিয়ের মতো এত বড় একটা বিষয়ে কোনো খোঁজ খবর ভাবনা চিন্তা না করেই কিন্তু তোমার নামের সাথে আদ্রর নাম জড়াননি মামা। সব দিক দিয়ে আদ্রকে উনার বেস্ট মনে হয়েছে তোমার জন্য তাই উনি রাজি হয়েছেন। সব থেকে বড় কথা আদ্র তোমাকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসে। যেখানে মামা তোমাকে অল্প বয়সে বিয়ে তো দূরে থাক স্টাডি শেষ না হওয়া অব্দি এই বিষয়ে ভাবতেই চাইনি সে মামাও আদ্রর ভালোবাসার কাছে হার মেনে নিয়ে তোমাকে আদ্রর নামে করে দিয়েছে। ভাবো একবার তাহলে ছেলেটা তোমাকে কতটা ভালোবাসে। যে ছেলেটা তোমাকে এতটা ভালোবাসে সে ছেলেটা তোমায় মেরে গুম করে দিবে এসব ভাবো কি করে তুমি? আর ইউ ম্যাড রুহি?”

আপির এত্ত বিশাল বক্তৃতা শুনে আমার করুন অবস্থা। সামান্য একটা কথা বলেছিলাম আমি। তার কারনে যে এত এত কথা শুনতে হবে ভাবিনি আমি। এর মাঝেই আম্মু রুমে এলেন। আমাকে অলস ভঙ্গিতে বিছানার এক কোনে বসে থাকতে দেখে বললেন,
–“একি রুহি, তুমি এখনো রেডি হওনি? আদ্র আর কতক্ষণ তোমার জন্য ওয়েট করবে? ও তো বলেছিলো বিকেলে তোমাকে নিয়ে বের হবে তুমি যেন রেডি থাকো। তাহলে ও আসার পরও তুমি এখনো রেডি না হয়ে বসে আছো কেন?”

রেডি হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কাবার্ড থেকে ডার্ক রেড কালার গাউন নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। চেঞ্জ করে এসে চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি করে নিলাম। সামনে ছোট ছোট কয়েকটা চুল খোলা রাখলাম। ইয়ার-রিং এবং বা হাতে একটা রিং পড়ে নিলাম। বা হাতের অনামিকা আঙুলে তো এনগেজমেন্ট রিং ছিলোই। হাতে ঘড়ি চোখে হালকা করে কাজল আর ঠোঁটে ডার্ক রেড লিপস্টিক। ব্যাস এতটুকুতেই রেডি আমি। উড়না নিয়ে আম্মুর পিছন পিছন বেরিয়ে এলাম আমি। সাথে আপিও এলো। আমাকে দেখে উনি ফোন থেকে চোখ সরিয়ে একবার পরখ করে নিলেন। আমাকে দেখে উনার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো আদ্র। আম্মুর থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে বললেন,
–“চলো।”

আমি থেমে গিয়ে হঠাৎই বলে উঠলাম,
–“আপি তুমিও চলো না প্লিজ। আমার একা একা ভালো লাগবে না।”

আমার এরকম কথা আদ্র আম্মু আপি কেউ-ই আশা করেনি। আমার কথা শুনে আদ্র কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে আপিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“হ্যাঁ আপি আপনিও চলুন আমাদের সাথে।”

আপি কিছুটা কেঁশে উঠলো। আম্মু চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। আপি গলা ঝেড়ে বললো,
–“আজ না অন্য কোনোদিন। আমার একটা কাজ আছে সেটা কমপ্লিট করতে হবে৷”

–“প্লিজ আপি চলো না। কাজটা পরে বাসায় এসে করে নিবা।”

এবারে আপিও চোখ রাঙিয়ে তাকালো আমার দিকে। আদ্রও সৌজন্যতার খাতিরে বললো,
–“আপনি গেলে আমাদের খুব ভালো লা___”

–“রুহির সাথে সাথে কি তুমিও পাগল হলে আদ্র? আজ ফার্স্ট টাইম তুমি রুহিকে নিয়ে বের হচ্ছো সেখানে আমি গিয়ে করবো? রুহি এমনিতেই তোমার সাথে ফ্রি হতে পারছে না। আলাদা সময় কাটাও দুজন একসাথে বসে কথা বলো দেখবে ও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে তোমার সাথে। আর তাছাড়া আমি গিয়ে করবো? আমি সাথে গেলে রুহি কখনো তোমার সাথে ফ্রি ভাবে কথা বলতে পারবে না। আমাকে নিয়েই মেতে থাকবে। তার থেকে বড় তোমরা দুজনেই যাও আজ। ফ্রি হও দুজনে। নেক্সট টাইম না হয় আমরা সবাই মিলে যাবো।”

আপি যে সরাসরি এভাবে কথাগুলো বলে দিবে আমি কল্পনাতেও ভাবিনি। ইশ্ কি ভাবলো উনি? আপিকে এখন ইচ্ছেমতো কতগুলো কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার। এসব ভেবে আদ্রর দিকে তাকাতেই দেখলাম উনার ঠোঁটের কোনের এক ঝলক হাসি এসে ভীর জমালো। তার মানে আপির কথায় উনি সন্তুষ্ট। আপি না যাওয়াতে উনি বেশ খুশি হয়েছেন এতক্ষণ উপরে উপরে যাওয়ার কথা বলছিলেন। আমি একা উনার সাথে যাবো না বলে আপিকে নিতে চাইলাম সাথে। আর আপিটাও না সবটা বাঞ্চাল করে দিলো। ধ্যাত ভাল্লাগে না! উনি সবার থেকে বিদায় নিয়ে এবার সরাসরি আমার হাত ধরেই বেরিয়ে এলেন বাসা থেকে। লোকটার কি লজ্জা সরম কিছু নেই? এভাবে আপি আম্মুর সামনে থেকে আমার হাত ধরে বেরিয়ে এলেন?

গাড়ির জানালায় দুহাত দিয়ে তার উপর মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছি। উনি খুব স্লোলি গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়িতে উঠেছি পর থেকে আমি এভাবেই বসে আছি। উনিও আর কথা চেষ্টা করেনি। চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছেন। হঠাৎই উনি গাড়ি ব্রেক কষাতে আমি কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে গেলাম৷ গাড়ির সাথে বাড়ি খাওয়ার আগেই উনি আমায় বাহু ধরে টান দিলেন। আমি যে সিটবেল্ট না লাগিয়ে বসেছি উনি হয়তো খেয়াল করেনি। নয়ত এভাবে গাড়ি ব্রেক কষতেন না। আমি বাইরে মুখ করে থাকাতে উনি বেশ কয়েকবার বলেছেন ওভাবে না বসতে। তারপরও যখন শুনলাম তখনই উনি আচমকা গাড়ি থামালেন। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে উনার দিকে ঘুরে বললাম,
–“কি হলো? এভাবে গাড়ি থামালেন কেন?”

উনি আমার বাহু ছেড়ে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। আমি চোখ তুলে ভালো করে তাকালাম উনার দিকে। রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। চোখদুটো রাগে লাল হয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রাগ নিয়ন্ত্রণের আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উনি। যা উনার ঘাড়ের ফুলে ফেঁপে উঠা রগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললাম। আচমকা উনার রেগে যাওয়ার কোনো কারন খুঁজে পেলাম না আমি। একটু থেমে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম,
–“ক্ কি হ্ হয়েছে? আ্ আপনি কি র্ রেগে আছেন?”

আদ্র কিছু না বলে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত বাড়ি মেরে বাইরের দিকে তাকিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। স্টিয়ারিংয়ে অতটা জোরে বাড়ি না মারলেও আমি ভয়ে কিছুটা কেঁপে উঠলাম। কিছুক্ষণ পর উনি বড়বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আমার দিকে ফিরে বসলেন। আমার দু গালে হাত রেখে বললেন,
–“সিটবেল্ট বেধেঁ বসোনি কেন? গাড়িটা যদি আমি স্লোলি না চালিয়ে স্পিডে চালিয়ে হঠাৎ করে ব্রেক কষতাম তাহলে কি হতে পারতো ভেবেছো একবারো?”

আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিলাম। এরকমটা একদমই ভেবে দেখিনি আমি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে যেন উনার রাগটা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। রাগীস্বরে গম্ভীর ভাবে বললেন,
–“কি হলো কথা বলছো না কেন? সিটবেল্ট বেঁধে বসোনি কেন?”

-“ক্ খেয়াল ছিলোনা।”

উনি কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। আমার গাল থেকে হাত সরিয়ে সিটের সাথে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম,
–“স্যরি। আর কখনো এরকম হবে না।”

আমার স্যরি বলাতে উনি কোনো রেসপন্স করলেন না। আগের ন্যায় বসে রইলেন। এভাবে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলো। এবার যেন আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো। উনি আছেন আমার পাশে অথচ রাগ করে কথা বলছেন না। বিষয়টা বেশ কষ্টদায়ক মনে হচ্ছে আমার কাছে। যার সম্পর্কে আধ ঘন্টা আগেই আমার মনে উল্টাপাল্টা ধারনা ছিলো তার জন্যই এখন আমার কষ্ট হচ্ছে। সে মানুষটা আমার সাথে কথা না বলাতে আমার বুক ভারী হয়ে আসছে। কি অদ্ভুত না ব্যাপারটা? বিয়ে! এই বিয়ের মাধ্যমে দুজন অচেনা অজানা মানুষের মনে আল্লাহ একে অপরের প্রতি অঢেল মায়া ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যে মানুষটাকে আমি আগে এক সেকেন্ডের জন্যও কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়েনা সামান্য একটা সিগনেচারের পরই সেই মানুষটার জন্য আমি আমার মনে তার জন্য মায়া টান ভালোলাগা অনুভব করছি। বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক। আল্লাহ তা’আলা নিজে সকলের জীবনসঙ্গী বেছে রেখছেন। উনাকেও আমার জন্য তিনিই বেছে রেখেছেন৷ আর এই একদিনের মাঝেই আল্লাহ আমার মনে তার জন্য জায়গা করে দিয়েছেন৷ বিকেলে যে ছেলেটাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলেছি এখন সেই ছেলেটা আমার সাথে কথা বলছে না বলে আমি তার জন্য টান অনুভব করছি। একই সাথে থেকেও কথা না বলার সামান্য এই দূরত্বটুকুও আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি উনার আরো একটু কাছ ঘেঁষে বসলাম। তবুও কোনো রেসপন্স করলেন না উনি। আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
–“খুব বেশিই কি রাগ করেছেন আমার উপর?”

উনি তবুও কিছু বললো না। আমার অবস্থা এমন যে আর একটু সময় যদি আদ্র আমার সাথে কথা না বলে তাহলে আমি কেঁদে ফেলবো৷ কেননা এখনই আমার চোখে পানি টলমল করছে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে উনার হাত ধরে বললাম,
–“এই শুনছেন, সত্যিই স্যরি। এই স্যরি বললাম তো। আর এরকম হবে না। প্লিজ কথা বলুন না। আপনার রাগ করে কথা না বলাটা আমাকে ভীষণ ভাবে পোড়াচ্ছে।”

কথাগুলো বলেই মাথা নিচু করে নিলাম। পলক ফেলতেই নিঃশব্দে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে৷ আমার ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়ে উনি তড়িৎ গতিতে তাকালেন আমার দিকে। আমাকে কাঁদতে দেখে আমার চোখের জল মুছে দিয়ে একটানে বুকে জড়িয়ে নিলেন আমাকে। মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে বললেন,
–“আরেহ পাগলি কাঁদছো কেন তুমি?”

আমি তখন কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ পর পর শুধু নাক টেনে যাচ্ছি। উনি আবারো বললেন,
–“কেঁদো না প্লিজ। তুমি কাঁদলে আমার ভালো লাগে না। তোমার চোখের পানি আমার একদমই সহ্য হয় না।”

–“আ্ আপনি তাহলে রে্ রেগে ছিলেন কেন আমার উপর?”

–“সত্যিই রাগ করিনি আমি।”

–“বুঝি আমি। রেগে ছিলেন বলেই তো এতটা সময় কথা বলেননি।”

–“তুমি যখন কাঁদো কাঁদো স্বরে জিজ্ঞেস করলে আমি রেগে আছি কিনা তখনই আমার সব রাগ কর্পূরের মতো উবে গেছে। বিশ্বাস করো বউ।”

–“তাহলে এতক্ষণ কথা বলেননি কেন?”

–“দেখতে চেয়েছিলাম আমি রেগে গেলে আমার পাগলিটা কিভাবে আমার রাগ ভাঙায়। কিন্তু বুঝিনি আমার রাগ ভাঙাতে গিয়ে তুমি কেঁদে ফেলবে। স্যরি কষ্ট দেওয়ার জন্য।”

আদ্রর কথা শুনে আমি অভিমানে গাল ফোলালাম। আদ্র আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“আমার কথা না বলাতে বুঝি আমার বউটার কষ্ট হয়?”

–“হ্যাঁ খুব বেশি।”

–“কেন?”

–“জানিনা হঠাৎ করেই কষ্ট হচ্ছিলো খুব আপনার চুপ করে থাকাতে।”

আদ্র আর কিছু বললো না। শুধু শক্ত করে মিনিট পাঁচেক জড়িয়ে ধরে রাখলেন। আমিও উনার বুকে মুখ গুজে উনাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রইলাম। আদ্র আমার মুখ তুলে কপালে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে বললেন,
–“তো ম্যাডাম এখন কি এভাবেই জড়িয়ে ধরে বসে থাকবেন? যেতে হবে না আমাদের?”

উনার কথা শুনে আমি চমকে চোখ খুলে তাকালাম। আচমকাই উনাকে ছেড়ে দিয়ে আবারো গাড়ির জানালা ঘেঁষে বসলাম। আমার কান্ডে উনি মুচকি হাসলেন। তারপর নিজেই আমার সিটবেল্ট লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণের কথাগুলো ভাবছিলাম। আদ্র কথা না বলাতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো কেন? উনি আমার সাথে কথা বলছিলো না বলে আমি কেঁদে ফেলছিলাম কেন? তবে কি উনাকে ভালো লাগতে শুরু করলো আমার? ধীরে ধীরে কি উনার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছি আমি? এসব ভেবে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। চোখ বন্ধ করতেই একটু আগে আদ্রর বুকে মাথা রাখার কথাটা মনে হলো আমার। সাথে সাথেই চোখ খুলে ফেললাম। আদ্রর দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি একমনে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিলাম উনার থেকে। বুকে হাত দিয়ে দেখলাম হৃদপিণ্ডটা লাফাচ্ছে৷ এই প্রথম কোনো ছেলের এতটা কাছে এসেছি আমি৷ এই প্রথম কোনো ছেলের বুকে মাথা রেখেছি। এই প্রথম কোনো ছেলে আমার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ করেছে। কথাগুলো মনে হতেই সারা শরীরে একরাশ লজ্জা এসে ভর করলো। বুকের ভিতর ধুকপুকানি শব্দটা যেন ক্ষনে ক্ষনে বেড়েই চলছে। আমি পর পর কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। আচমকা আদ্র আমার হাত নিয়ে ওর বুকে চেপে ধরে বললো,
–“হৃদপিণ্ডটা কিন্তু তোমার একাই লাফাচ্ছে না। আমারটাও একটু চেক করে দেখো।”

এই বলে উনি আমার হাতটা উনার বুকে চেপে ধরে রইলেন বেশ কিছুটা সময়। আসলেই উনার হার্টবিট খুব দ্রুত বাউন্স করছে। আদ্র আমার হাত ওর বুক থেকে নামিয়ে সিটের উপর রাখলো। তখনো কিন্তু আমার হাত উনি ছাড়েনি। একহাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে এবং অন্যহাতে আমার হাত ধরে রেখেছে। সামনের দিকে তাকিয়েই উনি বললেন,
–“তোমার এতটা কাছে আসা প্রথম মানুষটা যেমন আমি। তেমন ভাবেই আমার এতটা কাছে আসা প্রথম মানুষটা কিন্তু তুমিই। আর আমি চাই সারাজীবন এই মানুষটা আমার এতটা কাছেই শুধুমাত্র আমার হয়ে থাক।”

কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। আদ্রর কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছে আমার। এভাবেই টুকটাক কথা বলতে বলতে বড় একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে গাড়ি থামালো উনি। আমার হাত ধরেই রেস্টুরেন্টের ভিতরে প্রবেশ করলেন। একদম কর্নারের বড় একটা টেবিলের সামনে এসে উনি থামলেন৷ আমি আশ্চর্য হলাম কেননা এখানে খালি কোনো টেবিল নেই। তাহলে উনি এখানে এসে দাঁড়ালেন কেন? পেছনে তো আরো অনেক টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে সেখানে না বসে এখানে নিয়ে এলেন কেন? আমার এসব ভাবনার মাঝেই আদ্র বলে উঠলো,
–“স্যরি অনেকটা সময় তোদের অপেক্ষা করানোর জন্য।”

আদ্রর কথা শুনে টেবিলে বসা মানুষগুলো রাগী চোখে তাকালেন আদ্রর দিকে। এখানে আট নয় জন ছেলে-মেয়ে হবে বসে আছে। তার মাঝে তিনটে মেয়ে আর বাকী সব ছেলে। একটা ছেলে বলে উঠলো,
–“এই আর নতুন কি? সেই কলেজ লাইফ থেকেই তো এভাবে লেট করে আসিস আর এসে স্যরি বলিস।”

ছেলেটার কথায় তাল মিলিয়ে একটা মেয়ে বললো,
–“হ্যাঁ ব্যাপার না। তোর এইসব কর্মকান্ডের সাথে আমরা সকলে অনেক আগে থেকেই পরিচিত।”

ভাইয়া আর আপুটার কথায় সেখানে উপস্থিত বাকি সকলেই সহমত প্রকাশ করে। আমি তখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উনাদের সবার কথা শুনছি। একপর্যায়ে আদ্র আমার বাহু ধরে টেনে ওর কাছে নিয়ে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“মিট মাই ফিয়্যান্সে রাশফিয়াদ রুহি।”

উনি আমাকে সবার সামনে এভাবে ধরে রাখায় আমার বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছিলো। তারউপর আবার উনার কথা শুনে আমার লজ্জাটা যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। আদ্রর কথা শেষ হতেই সেখানে উপস্থিত সকলে একসাথে বলে উঠলেন,
–“হাই ভাবী।”

–“হ্ হাই।”

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কথাটা বলে মাথা নিচু করে নিলাম। এখানে উপস্থিত সকলেই আমার বেশ কয়েক বছরের বড়। নিজের থেকে বড় বড় ছেলে-মেয়ে দের মুখ থেকে ভাবী ডাক শুনে লজ্জায় নুইয়ে গেলাম আমি। আদ্র আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“রুহি লজ্জা পাচ্ছো? লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ওরা সবাই আমার খুব ভালো ফ্রেন্ড।”

আমাকে আর আদ্রকে পাশাপাশি বসার জায়গা করে দিলো। আমি কাচুমাচু হয়ে বসে আছি। আদ্র তখনো আমার একহাত উনার হাতের মুঠোয় বন্দী করে রেখেছে। সবার সাথে কথা বলে ধীরে ধীরে আমার জড়তা কেটে যাচ্ছে কিন্তু আদ্রর কন্ঠ শুনলেই বা উনার আশেপাশে থাকলেই আমার মনের মাঝে উথাল-পাথাল ঢেউ শুরু হয়। কেন শুরু হয় জানি না আমি। আর জানতে চাইও না। হয়তো ভালো লাগার মানুষটা আশেপাশে থাকলে এমনই হয়। আদ্রর সাথেও কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছি। ধীরে ধীরে হয়তো যেটুকু জড়তা আছে সেইটুকুও কেটে যাবে। অপেক্ষায় রইলাম সেইদিনের। দেখি না দিনটা কবে আসে। বা আদেও আসে কিনা? আমি একমনে এসবই ভাবছিলাম৷ তখনই আদ্র কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
–“কি ভাবছো এত? খাওয়া শুরু করো।”

আদ্রর কথায় সম্মতি জানালাম। খাওয়া শেষে সবাই আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম রেস্টুরেন্ট থেকে। রেস্টুরেন্টে কাটানো সময়টুকু আমার বেশ লেগেছে৷ আদ্রর ফ্রেন্ডগুলো সব অল্পতেই আমার সাথে একদম কাছের মানুষের মতো মিশে গেছে। এবার গাড়িতে উঠেই আগে সিটবেল্ট বেঁধে নিয়েছি। আগের বারের মতো ভুল আর করিনি। আদ্র আমাকে একদম উনার কাছ ঘেঁষে নিয়ে বসিয়েছে। ভয় দ্বিধা সংশয় সব কাটিয়ে আদ্রর এক বাহু জড়িয়ে কাঁদে মাথা রাখলাম আমি৷ কেন যেন এই মূহুর্তে খুব ইচ্ছে করছিলো আমার উনার কাঁধে মাথা রাখার। সাথে সাথেই গাড়ি ব্রেক কষলেন উনি। আর আমি এটাও জানি উনি এখন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু এতে আমার কি? আমি আগের মতোই চুপচাপ উনার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছি। উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো।

চলবে~