অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
144

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_২৫

রান্নাঘরে বিয়ে বাড়ির খাবার রাঁধা হচ্ছে। বাড়ির বউরা বাবুর্চিদের খাবার রান্নার উপকরণ একে একে এগিয়ে দিচ্ছেন। কজন বাড়তি লোকও এসে বসেছে চেয়ার নিয়ে। মহিলারা গল্প করতে করতে রান্না করছেন। তুলি তখন সবে রান্নাঘরে ঢুকবে বলে রুম থেকে বেরিয়েছে। শুভ্র গোসলে গেছে।বাথরুমে যাওয়ার আগে বলে গেছে, সে ফিরে এসে যেন তুলিকে সামনে পায়। তুলি শুভ্রর কথা শুনেনি। ওই নির্লজ্জ পুরুষের কথা শোনা মানে, তুলির আজ সারাদিন ঘর থেকে না বেরুনো। বিয়ে বাড়িতে এসেছে, টুকটাক সাহায্য না করলে কেমন খারাপ দেখায় না?
তুলি রান্নাঘরে ঢুকবে, তখন কানে এলো এক মহিলা বলছেন;

‘তানির মার মনটা ভাঙল শেষ অব্দি। আফরোজা তো ছেলে বউ সমেত বিয়ে খেতে এলো।’

ফাহিমা মসলা বাটছেন। উত্তর দিলেন তিনি;

‘কপালে নাই তো কী আর করার। আমি ভালো মানুষ, ভাবলাম আফরোজা আপার দুঃখ এবার শেষ করে দেই। বিয়েটা হলে লাভ ছিল না বলো? শুভ্র এ বাড়ির জামাই হলে আব্বার রাগ পড়তো না?যে কারণে আব্বাকে দিয়ে দাওয়াত পাঠালাম আমি আর তোমার ভাই। কী হলো শেষ অব্দি? নিজের কপাল নিজেই পোড়াল আফরোজার আপা। এই বিয়ে শেষ হলে এ কেউ মুখ দিয়ে কখনো কেউ বলবে এ বাড়ি আসার জন্যে। আমি তাও এবার বলে আনালাম। আর কী আনব? কে করবে আব্বার সাথে যুদ্ধ? আরেকবার বললে আমাকে শুদ্ধ বাপের বাড়ি পাঠাবে। চৌধুরী বাড়ির পুরুষদের যা রাগ, আমার চৌদ্দ পুরুষের ওমন রাগ নেই।’

তুলি তাদের কথোপকথন শুনে আর ভেতরেই গেলো না। রাগে চলে এলো রুমে। শুভ্র তখন মাত্রই গোসল করে বেরিয়েছে। সে শার্ট পড়ছিল। তুলি গিয়ে দরজায় খিল তুলে দিল। শুভ্র দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজে পেছনে ফিরল। তুলির দিকে চেয়ে দুষ্টু হেসে বললো;

‘কী ব্যাপার? দিন দুপুরে দরজা বন্ধ করছ কেন?’

তুলি এসব কথা পাত্তা দিল না। সোজা শুভ্রর সামনে দাঁড়াল। বললো;

‘আমরা কবে ঢাকা যাচ্ছি?’

‘আজ, কেন?’

‘আম্মুকে কিছু বলবেন না, আপনার বড় মামি আপনাদের দাওয়াত দিয়ে আনিয়েছেন শুধুমাত্র আপনার সঙ্গে তানির বিয়ের কথা বলার জন্যে। এখন আমি আপনার স্ত্রী আছি দেখে তারা নেক্সট টাইম আপনাদের এ বাড়ি আনাবে না।’

শুভ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো;

‘তুমি এসব কোথা থেকে শুনলে?’

‘আমি রান্নাঘরে যাওয়ার সময় শুনেছি।’

তুলি মিথ্যা বলছে না, শুভ্র জানে। শুভ্র বিশ্বাসও করে, তার নানাবাড়ির মানুষ চূড়ান্ত স্বার্থপর। কিম্তু আফরোজা এমন জেদ ধরলেন, শুভ্র মানা করতে পারেনি। রাগে শুভ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। সে বললো;

‘আমরা আজ চলে যাচ্ছি। ওরা বলবে কেনো, আমি আম্মুকে বারবার অপমানিত হতে এখানে আসতে দিবো না।’

কথাটা বলে শার্ট পরে শুভ্র বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। শুভ্র ভেবেছিল আফরোজাকে কিছু বলবে। কিন্তু ভাই-ভাবিদের সঙ্গে আফরোজাকে হাসতে দেখে শুভ্র থেমে গেলো। মন চাইল না মায়ের এই সুন্দর মুহূর্তটা তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে।

তারপর- তারপর সেদিন বিয়ে থেকে আসার পর শুভ্ররা আর কখনো চৌধূরী বাড়ি যায়নি। আফরোজা অপেক্ষা করেন, কেউ আসবে তাকে নিতে। বলবে একবার যাওয়ার জন্যে। কিন্তু না, কেউই আসে নি। শুভ্র বুঝে,
কিছু কিছু অভিমানের জোরটা বড্ড বেশি থাকে। অভিমান কাটলেও, সেখানে জন্ম নেয় ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ কেড়ে নেয় নিজের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কগুলো। ক্ষোভের দাবানলে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয় সম্পর্কগুলো। সম্পর্কের আহুতি দিয়েই যেন ক্ষোভের শান্তি।
___________________
দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেছে। শুভ্রর স্বামী হওয়ার তিন বছর ছ মাস কেটেছে। তুলিও এমবিবিএস পাশ করে একটা ক্লিনিকে জব নিয়েছে। সামনে ডিগ্রিও করার ইচ্ছে। শুভ্র এরমধ্যে এমডি করেছে ক্লিনিকাল সাইডে, পেডিয়াট্রিক বিষয়ে। তুলির বাবা বহু বছর পর দেশে আসলেন। তার মাথায় আপাতত অন্য ভাবনা চলছে। সেই ভাবনা থেকে তিনি দাওয়াত করলেন শুভ্র আর আফরোজাকে নিজেদের বাসায়। শুভ্র হসপিটাল থেকে ফিরে আফরোজাকে নিয়ে গেলো তুলিদের বাসায়। তুলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল শুভ্রর জন্যে। যেই না শুভ্রর গাড়ি তুলি দেখল, সঙ্গেসঙ্গে তুলি হেসে লুকিয়ে গেলো। তুলির জন্যে ইয়াসমিন গোলাপি রঙের শাড়ি বের করে রেখে এসেছিলেন বিছানার উপর। তুলি শাড়িটা একটু নেড়েচেরে ব্লাউজ-পেটিগোট নিয়ে বাথরুমে গেলো।

শুভ্র বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। তার মুখোমুখি ইয়াজিদ সাহেব। তিনি শুভ্রকে সরাসরি এই প্রথম দেখলেন। শুভ্র চুপচাপ বসে আছে। মূলত ইয়াজিদ সাহেবের সঙ্গে সে কী কথা বলবে খুঁজেই পাচ্ছে না। ইয়াজিদ সাহেব এবার নিজেই মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে কথা তুললেন;

‘শুভ্র ভালো আছো তো? হাসপাতালের কাজ কেমন যাচ্ছে?’

‘ভালো যাচ্ছে আঙ্কে- সরি বাবা।’

শুভ্র লজ্জা পেয়ে গেছে। আঙ্কেল আর বাবা বলার অভ্যাসের মধ্যে সে সবসময়ই কনফিউজড হয়ে যায়। এটা নিয়ে তুলির কাছে সে কম বকা খায়নি। তবুও পারেনা। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। ইয়াজিদ সাহেব বললেন;

‘শুনলাম নতুন হাসপাতাল তৈরি করছো?’

‘জ্বি বাবা। অন্যের চাকরি আর কত? নিজের কিছু একটা হওয়া উচিত।’

‘টাকা পয়সার ব্যাপার তো অনেক। সামলাতে পারছো তো?’

‘হয়ে যাচ্ছে। আমরা তিন বন্ধু মিলে করছি, বাকি টাকা শর্ট পড়ায় ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়া হয়েছে।’

‘টাকা লাগলে আমাকেও বলো। চেষ্টা করবো সাহায্য করার।’

‘লাগলে বলব বাবা।’

ইয়াজিদ থামলেন। আর কী কথা বলবেন খুঁজে পেলেন না। তবে শুভ্র ছেলেটাকে সামনাসামনি দেখে তিনি দারুণ সন্তুষ্ট। যেমন দেখতে ভালো, তেমনি আচার ব্যবহার। মেয়ের জন্যে একদম সোনা পেয়েছেন ইয়াজিদ। তবে ইয়াজিদ যদি জানতেন, শুভ্র বেডরুমে তারই মেয়ের সঙ্গে চূড়ান্ত অসভ্যতা করে, তাহলে হয়তো আজকে তিনি শুভ্রর সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করতেন না। শুভ্র মনেমনে হাসলো খানিক। বাইরের মানুষের সঙ্গে শুভ্র হচ্ছে ভদ্র পুরুষ, অথচ বউয়ের সঙ্গে? চূড়ান্ত অভদ্র। একমাত্র তুলি এর ভক্তভোগী, তুলি জানে শুভ্র কেমন ফাজিল এবং অসভ্য।

ইয়াজিদ এবার স্ত্রীকে ডাকলেন। ইয়াসমিন রান্নাঘরে নাস্তা বানাতে বানাতে আফরোজার সঙ্গে গল্প করছিলেন। স্বামীর ডাক শুনে তিনি এলেন। ইয়াজিদ বললেন;

‘মেয়েকে নিয়ে আসো।’

‘আনছি।’

কথাটা বলে ইয়াসমিন তুলির ঘরের দিকে ছুটলেন। তুলি তখন সবে শাড়ি পড়ছে। শাড়ি সামলাতেই পারছে না তুলি। শাড়ি নিয়ে একপ্রকার যুদ্ধ করা লাগছে। ইয়াসমিন তুলির এমন বেহাল অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলেন। তুলি মায়ের দিকে চেয়ে ঠোঁট উল্টে বলল;

‘আম্মু পড়ায় দাওনা এটা।’

ইয়াসমিন এসে শাড়ির আগা ধরলেন। শাড়ি সুন্দর করে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন;

‘তুই এতো বছরেও শাড়ি পরা শিখলি না। আজ বাদে কাল উঠিয়ে নিবে। তখন কিভাবে পড়বি?’

তুলি উত্তর দেয়না। মাকে তো আর বলতে পারে না, ও বাড়িতে তাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার জন্যে দুজন আছে। শুভ্রর আম্মু আর স্বয়ং শুভ্র। তুলি শাড়ি পরতে পারে না দেখে, শুভ্র একদিন তুলির সামনে বসে ইউটিউব থেকে দেখে শাড়ি পরা শিখেছে। তারপর দেখে দেখে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে তুলিকে। সঙ্গে অসম্ভব দুষ্টুমি তো আছেই। হাতটা বড্ড চলে শুভ্রর, খালি ওখানে ছোঁয় এখানে ছোঁয়। তুলি হাসলো। ইয়াসমিন তুলিকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে অলংকার হালকা কিছু পড়ালেন। শুভ্র যে বালা দিয়েছিল তুলিকে, তুলি সেটা হাতে দিলো। শুভ্র একটা লকেট দিয়েছিলো ইদানীং। লকেটে তুলি আর শুভ্রর প্রথম অক্ষর,
‘ST’ দেওয়া, লকেটের ভেতরে দুজনের ছবিও আছে। তুলি সেটাই পড়লো আজ। শুভ্রকে আজ সারপ্রাইজ দেওয়া হবে। তাই তুলি একদম শুভ্রর মনমতো সেজেছে।
___
তুলিকে নিয়ে আসা হলো শুভ্রর সামনে।তুলি ধীর পায়ে এগুচ্ছে। তুলিকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছিল, শুভ্র হা হয়ে তুলিকে একবার দেখলো। পরপরই সবাই পাশে আছে দেখে শুভ্র চোখ সরিয়ে নিলো। গলা খাকারি দিয়ে সোজা হয়ে বসল। ইয়াসমিন তুলিকে শুভ্রর পাশে বসালেন। শুভ্র গা ঘেষে বসেছিলো তুলি। শুভ্র বড়রা পাশে আছে দেখে একটু সরে বসলো। তুলি এটা দেখে মাথা নিচু করে হেসে ফেলল। আসছে তুলির লাজুক বর, হ্যাহ!

ইয়াজিদ বললেন;

’আফরোজা, শুভ্র তুলির সম্পর্কটা এবার এগুনো উচিত। কথা দিয়েছিলাম, মেয়েকে দুই বছর পরে তুলে দিবো। দেরি হয়েছে কিন্ত কথা রাখবো আমি। আরও আগেই দিতে পারতাম। কিম্তু আমি দেশে নেই, একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে সেটা বাবা হয়ে মন মানছিল না আমার, রাগ করো না এটার জন্য। এখন আমি দেশে এসেছি, আমি চাই তুলিকে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে-গুজিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ি পাঠাব। কী বল তুমি?’

শুভ্র অবাক হয়ে ইয়াজিদের দিকে তাকাল। তুলি হাসছে মনেমনে। আফরোজা খুশি হয়ে বললেন;

‘অবশ্যই। তুলিকে আমি নিজের মেয়ের থেকে কম দেখিনি ভাইজান। ও আমার ঘরে আসা মানে আমার একটা মেয়ের অভাব পূরণ করা। আমরা রাজি।’

শুভ্র এবার হালকা হাসলো। ইয়াজিদ বললেন;

‘কথাবার্তা তাহলে সাড়া যাক। জোবায়ের? তোমার বোন আর দুলাভাইকে নিয়ে ছাদ ঘুরে আসো। যাও।’

জোবায়ের হেলেদুলে এসে শুভ্রর হাত ধরলো। বললো;

‘চলো দুলাভাই। আপু আসো আসো।’

শুভ্র জোবায়েরকে কোলে তুলে নিলো। জোবায়ের এতেই হম্বিতম্বি করে উঠে বলল;

‘কোলে না কোলে না। আমি বড় হয়ে গেছি দুলাভাই। নামাও আমাকে।’

শুভ্র হেসে ফেলল। বললো;

‘ওরে বাবা। বড় হয়ে গেছে জবু?’

শুভ্র জোবায়েরের সঙ্গে হাসতে হাসতে কথা বলছে, তুলি সামনে। ছাদের দিকে এগুচ্ছে। শুভ্রও তুলির পেছন পেছন ছাদের দিকে গেল। ছাদের দরজা পেরুতেই জোবায়ের কোল থেকে জোর করে নেমে গেলো। শুভ্রর দিকে চেয়ে বলল;

‘তোমরা গল্প করো। আ’ম গিভিং ইউ গাইজ প্রাইভসি। এনজয়।’

কথাটা বলে দৌঁড়ে চলে গেলো জোবায়ের। শুভ্র হাঁটুর বয়সী বাচ্চার মুখে এ ধরনের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তুলিকে জিজ্ঞেস করল;

‘ও প্রাইভসি দেওয়া শিখলো কিভাবে?’

তুলি কপাল কুঁচকে বললো;

‘আরে ওর ফ্রেন্ড। একেকটা ভয়াবহ পাকনা। ওদের থেকেই মনে হয়।’

শুভ্র হালকা হাসলো। বললো;

‘সেদিনের জোবায়ের আজকে আমাদের প্রাইভসি দিচ্ছে। ভাবা যায়? আগে তো আমাদের সঙ্গে পিছু পিছু ঘুরত।’

তুলি হাসল। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো;

‘দেখতে দেখতে তিন বছরে কেটে গেছে, না?’

তুলি শুভ্রকে দেখে। শুভ্র এগিয়ে এসে তুলির কোমর চেপে ধরে। তুলি শুভ্রর বুকের সঙ্গে মিশে যায়। শুভ্র তুলির কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে বলে;

‘এবার অফিসিয়ালি, এন্ড ইকুরেটলি আমার বউ আমি ঘরে তুলব।’

‘তারপর-‘

‘তারপর আবারো যাবো সাজেক হানিমুন। তারপর দুই থেকে তিন হয়ে ফিরবো আমরা।’

তুলি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। শুভ্র বলল;

‘আমি আর অপেক্ষা করবো না কিন্তু তুলি। বিয়ের এক বছরের মধ্যে আমার একটা পরী চাই।’

‘পরী চাই? ছেলে না?’

তুলি জিজ্ঞেস করল। শুভ্র তুলির কপালে চুমু খেয়ে বললো;

‘আল্লাহ যা দেন তাতেই আলহামদুলিল্লাহ।’

#চলবে

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_২৬

শুভ্র এবং তুলির বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে আগামী ২৫ মে বাদ আসর। হাতে আছে মাত্র দশ দিনের মতো। এখন থেকেই দুই পক্ষের মানুষদের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। শুভ্র ইদানীং হাসপাতাল তৈরির কাজে ভীষণ ব্যস্ত সময় পাড় করছে। হাসপাতালের কাজে টাকা পয়সা লাগছে প্রচুর, সে জন্যে চেম্বারও করা লাগছে নিয়মিত। তাই সে বিয়ের সমস্ত কেনাকাটা আফরোজার উপর চাপিয়ে নিজে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তুলি অবশ্য এতে সক্রিয়। বিয়ের কেনাকাটা সবেতেই আফরোজা তুলিকে সাথে নিয়ে ঘুরেন। হাতে আছে আর পাঁচদিন। আজকেও আফরোজা বেরিয়েছেন শপিং এ। সঙ্গে তুলি, আর জোবায়ের। আজ বিয়ের বেনারসি কেনা হবে। আজকালকার যুগে লেহেঙ্গা খুব চলে, কিম্তু শুভ্রর এক কথা। বিয়ে বলুক আর বৌভাত নাহয় হলুদ,প্রতিটা অনুষ্ঠানে শাড়িই পরতে হবে। তাই তুলি শুভ্রর পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি কিনতে এসেছে।

দোকানদার শাড়ি দেখাচ্ছে। একটা ছোট কিশোর ছেলে শাড়িগুলো পরে পরে দেখাচ্ছে। আফরোজা এখন থেকে একটা লাল শাড়ি দেখিয়ে বললেন;

‘অ্যাই তুলি, এটা দেখ। সুন্দর না?’

তুলি শাড়িটা নেড়ে দেখল। বেশ সুন্দর শাড়ি। তুলি আয়নার সামনে গিয়ে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে শুভ্রকে ছবি পাঠাল। শুভ্র এখন কনস্ট্রাকশন এরিয়ায়। সবাইকে বলছিলো, কোন দিকে কোন জিনিসটা বসাবে। তুলির মেসেজ পেয়ে শুভ্র চেক করল। লাল শাড়ি পরে মুচকি হেসে ছবি পাঠিয়েছে তুলি। নিচে লেখা;

‘বউকে কোন রঙে দেখতে চায়, শিশু ডক্টর।’

শুভ্র হাসল। লিখে পাঠাল, ‘ লালে আমার বউকে বধূ লাগবে। তবে হালকা গোলাপীতে শুভ্রর বেস্ট বধূ লাগবে।’

তুলি মেসেজটা পেয়ে হাসল। আফরোজাদের কাছে গিয়ে বললো;

‘হালকা গোলাপি রংয়ের শাড়ি দেখি, আম্মু?’

আফরোজা দোকানদারকে তুলির কথামতো শাড়ি দেখাতে বললেন। তুলি একটার পর একটা শাড়ি দেখে তারপর একটা শাড়ি পছন্দ করল। সেটা গায়ে জড়িয়ে হালকা হেসে ছবি তুলে শুভ্রর ফোনে পাঠাল। শুভ্র তুলির মেসেজরই যেন অপেক্ষায় ছিল। শুভ্র ছবি দেখে মুগ্ধ হলো ভীষণ। মনেমনে কল্পনা করল, বিয়েতে এই শাড়ি সাজে তুলিকে কেমন দেখাবে। শুভ্র রিপ্লে করল; ‘বেস্ট ওয়ান। শুভ্র’জ পারফেক্ট ওয়াইফ।’

তুলি হাসল। তারপর শাড়িটা নিয়ে আফরোজাদের পাশে এসে বললো;

‘আম্মু, এই শাড়িটাই নেই?’

আফরোজা হেসে উঠলেন। বললেন;

‘তোকে সবচেয়ে ভালো এটাতেই মানিয়েছে।’

তুলি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসলো। আফরোজা তারপর শাড়িটার টাকা মেটালেন। তারপর একে একে অলংকারসহ মেকআপ, প্রসাধনী সামগ্রীও কেনা হলো।

সারাদিন শপিং করে তুলি ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়েছে মাত্রই। মনে মনে ভাবছে, আগের আকদই ঠিক ছিলো। কোন ঝামেলা নেই, শুধু কবুল বলা আর বিয়ে হয়ে যাওয়া। এসব অনুষ্ঠান বিরক্ত লাগছে তুলির। পাঁচদিন যাবত ক্লিনিক করে বাসায় এসে আবার এসব ঝামেলা। গা ধরে যাচ্ছে ব্যথায় এবার। আগামীকাল থেকে তুলি ক্লিনিকে ছুটি নিয়েছে। জয়েন করবে বিয়ের তিনদিন পর। তারপর আবার সেই একঘেয়ে জীবন। তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসব ভাবনার মধ্যে শুভ্রর কলটা তখনই এলো। তুলির মনে হলো সমস্ত ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই শুভ্রর একটা কলেই হাওয়া হয়ে গেছে। তুলি কল ধরলো। লম্বা করে সালাম দিল মজা নিয়ে। শুভ্র হাসলো। ছোট্ট করে সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলো;

‘কী ব্যাপার, আজ এত পতি ভক্তি? মাথায় কী চলছে তোমার?’

তুলি হেসে বললো; ‘সওয়াব কামাচ্ছি, শিশু ডক্টর।’

শুভ্র পেডিয়াট্রিকে এমডি করার পর থেকে তুলি শুভ্রকে ‘শিশু ডক্টর’ ডাকে। আগে ‘স্যার’ ডাকত বলে শুভ্র বেশ রাগ করতো। শুভ্রর মতে; হাসবেন্ডকে আদর করে কত নামে ডাকা যায়। এই ‘স্যার’ আবার কী ডাক? অবশেষে তুলির ডাক বদলেছে। তবে এতোবছর চেষ্টা করেও তুলির মুখ থেকে ‘আপনি’ ডাক কোনক্রমেই শুভ্র ‘তুমি’ তে কনভার্ট করতে পারেনি। অসম্ভব এক ব্যপার যেন এটা।

শুভ্র তুলির কথায় হেসে বললো; ‘আর কটাদিন, তারপর আরও এক্সট্রা ভাবে সাওয়াব কামাবো তোমাকে দিয়ে।’

তুলি অবাক হওয়ার ভান করে বললো: ‘কিভাবে?’

শুভ্র দুষ্টু হাসলো। বললো: ‘ওআওয়ার ফার্স্ট নাইট ইজ কামিং,তুলি।’

শুভ্রর এমন কথায় তুলি লজ্জা পেল বোধহয়। এতটা রাত দুজন একসঙ্গে কাটিয়েছে, অথচ তুলি এখনো সেই প্রথম রাতের ন্যায় লজ্জা পায়। রীতিমত ‘বাসর, নাইট’ এসব শুনতেই পারে না। শুভ্র এসব ভেবে হাসলো।

তুলি মেকি রাগ দেখিয়ে বললো; ‘আপনার জীবনে কয়বার আসে এই ফার্স্ট নাইট?’

শুভ্র উত্তর দিল- ‘একবারই আসবে, পাঁচদিন পর।’
তুলি বললো- ‘তাহলে এতবছর কী ছিল?’

শুভ্র হাসল। জড়ানো গলায় বললো;

‘ওসব রাতের অনুভুতি অন্যরকম ছিলো, তুলি। কিন্তু সামনে যে রাতটা আসবে, সেটা আলাদা একদম। তুমি প্রপারলি আমার জন্যে বৌ সাজবে, আমরা শ লোকের সামনে কবুল বলবো। আমাদের বাসর সাজানো হবে, ফুলের বিছানায় তুমি ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে। আমি আসবো, ঘোমটা সরিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলবো-‘মা শা আল্লাহ। তুমি লজ্জা পাবে। তারপর-‘

‘তারপর আমরা কথা বলবো সারা রাত।’

শুভ্রর মুখ থেকে তুলি কথা কেড়ে নেয়। শুভ্র হাসে; কৌতুক করে বলে; ‘হ্যাঁ, চাঁদের আলোয় বসে আমরা দুজন এই রাতটায় শুধু কথাই বলব। আর কিছু না।’

তুলি শুভ্রর কথার ধরনে হেসে উঠে। এখনো এত দুষ্টু কথা বলে এই শুভ্র। তুলির হাসি শুনে শুভ্রও হাসে, তারপর দুষ্টুমি বাদ দিয়ে সুন্দর করে জিজ্ঞেস করে;

‘তারপর আজকে সারাদিন কী কী করলে বলো?’
_______________
আজ তুলির হলুদ সন্ধ্যা, ঘরোয়া ভাবে আয়োজন করা হয়েছে। তুলিকে আজ সবুজ পাড়ের হলুদ রঙের শাড়ি পরিয়ে সোফায় বসানো হয়েছে। তুলির সকল কাজিনরা আজ সবুজ রঙের শাড়ি পরে আছে। রুমে হালকা আওয়াজে গান বাজছে।

‘মেহেন্দি হ্যা রাচনেওয়ালি,
হাতো ম্যা গেহরী লালি’

সবাই গানের সঙ্গে গুনগুন করছে। একসময় অপেক্ষা শেষ হলো, হলুদ নিয়ে ঘরে এলেন ইয়াসমিন। তুলির পাশে বসে প্রথমেই চুমু বসালেন মেয়ের কপালে। তারপর তুলির দু গালে হলুদ লাগিয়ে হালকা হেসে বললেন;

‘হলুদের মতোই ফুটে থাকুক তোর সারা গা। স্বামী সোহাগী হ, মা।’

ইয়াসমিন তার চোখ থেকে কাজল নিয়ে তুলির কানের পেছনে লাগিয়ে দিলেন। তুলির মনে পড়ল, সাজেকে একবার শুভ্র কয়লার কালি দিয়ে তুলির কানের পেছনে নজর ফোঁটা দিয়ে দিয়েছিল। তখন বিয়ের শুরু-শুরু সময় ছিলো। তারপর ধীরে ধীরে একে অন্যের প্রেমে পড়া, লাজুক শুভ্রর খোলস ভেঙে অসভ্য শুভ্র হওয়া, তুলিও শুভ্রর সামনে খোলা বইয়ের মতো হওয়া। সবকিছুই এখনো তরতাজা স্মৃতি। আজ তুলি সেই শুভ্র স্বামীকেই আবার স্বামী হিসেবে কবুল করতে যাচ্ছে। এবার শুভ্রর বাসায় তুলির একটা সংসার হবে। শুভ্রর কথামতো সেই সংসারের রানি হবে তুলি। আর শুভ্র, শুভ্র রাজা। নিজেদের এসব কথা ভেবে তুলির বুকটা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত তৃষ্ণায়।

একে একে সবাই তুলির শরীরে হলুদ মাখিয়ে দিলো। তুলির সারা শরীরে এক ফোঁটাও জায়গা নেই। সবখানেই কাঁচা হলুদ। তুলিকে দেখে মনে হচ্ছে হলুদের মিশ্রণে ডুব দিয়ে এসেছে ও। তুলি নিজেকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললো;

‘বিয়ে মানেই একগাদা হলুদ ডুবে যাওয়া, উফ।’

তুলিকে এই অবস্থায় দেখে সব কাজিনরা হাসছে। পুরো হলুদ মুখের মধ্যে একমাত্র তুলির চোখটাই সাদা। একজন তো মজা করে শুভ্রকে ভিডিও কল দিয়ে বসলো। শুভ্র ফোনের ওপাশ থেকে তুলিকে দেখে হাসতে হাসতে শেষ। শুভ্র হাসতে হাসতে বললো;

‘হলুদ বোধহয় একটু কম পড়েছে শালিকা। আরো লাগানো উচিত ছিল।’

শুভ্রর কণ্ঠ শুনে তুলি সামনে চোখ তুলে তাকাল। শুভ্র ভিডিও কলে। তুলি লজ্জা পেয়ে দুহাতে মুখ ঢাকল। শুভ্র দেখে ফেলেছে, আর দেখানো যাবে না। ওপাশ থেকে শুভ্র এটা দেখে টিপ্পনি কেটে বললো:

‘খুব লুকিয়ে পড়েছ, তুলি। আমরা তো কেউই তোমাকে দেখতে পারছি না। শালিকারা, আপনারা কেউ দেখছেন আপনাদের বোনকে?’

সবাই একসঙ্গে জোরে বলে উঠল;

‘না, দুলাভাই।’

সবাই এভাবে মজা নিচ্ছে দেখে তুলি মুখ লুকানো অবস্থায় হেসে ফেলল। তুলির দেখাদেখি সবাই হেসে উঠল। হলুদ সন্ধ্যা এভাবেই স্বপ্নের মতো কাটলো এই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ দম্পত্তির।

#চলবে

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_২৭

শুভ্র তুলির বিয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল আসর পর বিয়ে। তুলিদের বিল্ডিং পুরোটাই সাজানো হয়েছে বাতি, সদর গেইট ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। জামাই আসবে এ বাড়ি। একটা আলাদা সৌন্দর্য্য তো দেখানো লাগবে নিজেদের। সন্ধ্যার পর চা খেয়ে ইয়াজিদ তখন রুমে বসে আগামীকালের খরচের হিসাব করছেন। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল: ‘বাবা, আসবো?’

ইয়াজিদ চোখ তুলে তাকালেন। মেয়েকে দেখে বললেন: ‘আসো, ভেতরে আসো।’

তুলি হেঁটে ভেতরে ঢুকলো। বাবার পাশে বিছানায় বসে বাবার দিকে চেয়ে বললো: ‘ডেকেছিলে? মা বললো!’

ইয়াজিদ তুলিকে দেখেন। তুলির গা থেকে আজ হলুদ-পারফিউম সব মিলিয়ে সুন্দর একটা বউ বউ গন্ধ আসছে। মুখটা লাগছে যেন আস্ত এক চাঁদের টুকরো। বিয়ের ফুল ফুটলে সব মেয়েদেরই বোধহয় চেহারায় সৌন্দর্য্য বাড়ে। ইয়াজিদের আবারও মনে পড়ে যাচ্ছে- মেয়ে তার চলে যাবে কাল পরের বাড়ি। এতদিন মেয়েকে পরের বাড়ি দেননি,কাল দিতে হবে। তারপর- তারপর এই ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাবে, ঠিক ইয়াজিদের বুকটার মতো। ইয়াজিদের বুকে কিছু যেন একটা দলা পাকাতে চাইছে। কষ্ট নাকি মেয়ে বিয়ে দেওয়ার যন্ত্রণা? ইয়াজিদ একটু কাশলেন। তুলি উৎসুক চোখে বাবার দিকে চেয়ে আছে। ইয়াজিদ কথা তুললেন- ‘ভালো লাগছে তোমার? কাল তো বিয়ে। ব্যাগ গুছিয়েছো?’

তুলি বাবার এমন প্রশ্নে আহ্লাদ দেখল। তুলি জবাব দিল- ‘মা গুছিয়ে দিয়েছেন। এখান থেকে বেশি কিছু নিয়ে যেতে শুভ্র স্যার মানা করেছেন! জরুরি জিনিস নিয়েছি শুধু।’

ইয়াজিদ চশমাটা এবার চোখে তুললেন। বললেন- ‘শুভ্র? শুভ্র তোমার স্বামী ছিল এতদিন। কাল থেকে ও ঘরে যাবে, ও ঘরে সংসার হবে তোমার। তুমি খুশি? আমাদের সিদ্ধান্তে তুমি কখনো এত বছরে আফসোস করেছো? বলো আমাকে।’

তুলি বুঝতে পারলো মূলত ইয়াজিদ কেন তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। শুভ্রদের সম্পকে জানতে। উৎকণ্ঠায় ভুগছেন ইয়াজিদ। তুলি হালকা হাসলো। বাবার দিকে চেয়ে দৃঢ় গলায় বললো- ‘তোমাদের সিদ্ধান্তটা ভালো ছিলো বাবা। হয়তো আমি নিজে কাউকে পছন্দ করলে শুভ্র স্যারের মতো বর বা তার পরিবারের মতো পরিবার পেতাম না। আমার জীবনটাকে এভাবে সুন্দর করে গুছিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ বাবা।’

ইয়াজিদ মেয়েকে দেখলেন। তুলির চোখেমুখে খুশি ঝলমলাচ্ছে। ইয়াজিদ মনেমনে বাবা হিসেবে প্রচণ্ড খুশি অনুভব করলেন। খুশিটুকু লুকিয়ে তাড়া দেখিয়ে হিসাবের খাতাটা হাতে নিয়ে বললেন- ‘আচ্ছা যাও এখন। তোমার আম্মুকে পাঠিয়ে দিয়ো একবার। কথা আছে।’

তুলি বাবাকে দেখে। বাবাদের বোধহয় সন্তানদের পাশে কান্না করা মানায় না। হোক সেটা খুশির কান্না!
___________________
শুভ্র আজ শেরওয়ানি পড়েছে। সাদা রঙের শেরওয়ানি। গলার কাছটায় কারুকাজ করা, হাতের মধ্যে সিলভার রঙের কারুকাজ করা। শুভ্রর মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দিলেন আফরোজা। তারপর শুভ্রর ঘাড়ে নজর ফোঁটা দিয়ে বললেন- ‘হাজার বছর বেঁচে থাকুক আমার শুভ্র। কারো নজর না লাগুক।’

পাশ থেকে আরিফ টিপ্পনী কেটে বললো- ‘কাকিমা, নজর তো লেগে গেছে শুভ্রর। তার বউয়ের।’

আফরোজা বাচ্চাদের এসব পাগলামি কথায় হেসে চলে গেলেন। শুভ্র আরিফের হাতে থাপ্পড় বসিয়ে বললো- ‘আম্মুর সামনেও তোর মুখ কা/চির মতো চলে। মহুরে বলা লাগবে।’

ফারহান হাসল। আরিফ বললো- ‘আর মহু? একটা বাচ্চাই আমাকে মহুর থেকে আলাদা করে দিয়েছে। রাতেও পাইনা, দিনেও পাইনা। তার মধ্যে আরেকট আসছে। বাচ্চা নিলে মেয়েদের যে হারে মুড সুইং হয় ভাই. . যদি জানতি। দেখবি ছোট থেকে ছোট কথায় হয় কাঁদে, নয় মার বসায় নয়, বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। তোর ভোলাভালা বউও এমনি করবে দেখিস।’

শুভ্র হাসল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাগড়ি ঠিক করতে করতে বললো- ‘বাচ্চা আসলে আমার বউর সাত খুন মাফ। একটা বেবী ক্যারি করার জন্যে তাকে হাজারবার কাঁদার, মারার অনুমতি দেওয়া হল। শুধু বাপের বাড়ি যাওয়া যাবে না, আমার বাড়ি বসে বসে রাগ মেটাক. ., ভাঙ্গুক যা ইচ্ছা।’

ফারহান এবার হা হুতাশ করে বলল- ‘শুভ্র রে, আরিফ দুই বাচ্চার বাপ হতে যাচ্ছে। আমিও বাপ হয়ে গেলাম। পিছিয়ে গেলি তুই। বিয়ে করে জলদি জলদি আমাদের সঙ্গে কম্পিটিশনে লাগ, বুঝলি?’

শুভ্র হাসলো, কিছু বললো না। একটা বাচ্চা! একটা বাচ্চার আবদারই করবে সে আজ তুলির কাছে। একবার করবে, বারবার করবে। বত্রিশ বছর হয়ে গেলো, মামা. . কাকা, দুলাভাই সব ডাক শুনল। এবার একটা বাবা ডাক শোনা লাগবে। শুভ্র তুলিকে বলবে- তুলির কিছু করা লাগবে না। শুধু বেবি ক্যারি করবে, পৃথিবীতে আনবে, আর দুধটুকু খাওয়াবে। বাচ্চার বাকী দেখাশোনা শুভ্র একাই করবে। শুভ্রর দম আছে এখনো . .. বুঝিয়ে দিবে মিসেস প্রত্যাশা হোসেন তুলিকে।
_________________
তুলি শুভ্রর আর তার টেক্সট দেখছে। লাস্ট মেসেজ এসেছিল আধা ঘণ্টা আগে। শুভ্র পাঠিয়েছে-
‘রেডি হয়ে ছবি দিয়ো।’

তুলি উত্তর করেছে- ‘একবারে এসে দেখে নিন বউকে।’

তুলি রেডি তো হয়েছেই। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি, সোনালি রঙের গহনা, অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করছে শুভ্রর পরিয়ে দেওয়া স্বর্ণের আংটি, হাতে শুভ্রর দেওয়া বালার সঙ্গে ডজন চুরি পড়েছে। ইয়াসমিন বালা দুটো আজকের জন্যে খুলে রাখতে চেয়েছিলেন। তুলি দেয়নি। শুভ্রর দেওয়া দ্বিতীয় উপহার, যা তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। এটা দিয়েই শুভ্র প্রথম তুলিকে ভালোবাসি বলেছিল। তুলির স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বালা দুটোতে।

শুভ্রর পাল্টা মেসেজ- ‘আমিও তাহলে ছবি দিব না। একবারে কবুল পরে দেখা দিচ্ছি।’

তুলি হাসলো। পাগল এখনো! তুলি স্ক্রল করে তাদের পূরনো মেসেজ পড়তে থাকে। এরপর তো আর মেসেজে কথা খুব কম হবে। ও ঘরে সংসার পাতবে তুলি, যা কথা বলাই সামনাসামনিই হবে। তুলি মেসেজগুলো আবারও পড়ছে, লাজুক হাসছে বারবার।

‘বর এসেছে, বর এসেছে’
সাজসাজ রব পড়ে গেলো তুলিদের বাড়ি। তুলি উঠে দৌঁড়ে গিয়েও আটকে গেল। বর আসার দৃশ্য নাকি বউদের দেখতে নেই, নজর লাগে। তুলি হেসে আবারও বসে গেলো বিছানায়। বুকটা লাফাচ্ছে খুব। শুভ্র এসেছে. . তুলির বর এসেছে?

শুভ্রকে বরণ করা হলো। ওপাশ থেকে টাকা চাওয়া হলো পঞ্চাশ হাজার। বেচার শুভ্র পড়েছে ফ্যাসাদে। বউর কাছে যেতেও পঞ্চাশ হাজার, তারপর আবার কাজিনগুলো হুমকি দিয়েছে বাসর রাতে নাকি টাকা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। ওহ গড! শুভ্র কী করবে? দিল টাকাটা। টাকা পেয়ে হৈ হল্লোর চললো কিছুসময়। শুভ্রকে ঘরে ঢুকানো হলো। ঘরেই স্টেজ করা হয়েছে ছোটখাটো। শুভ্রকে প্রথমেই মিষ্টি খাওয়ানো হলো। শুভ্রর সুগার কম খায় ইদানীং। তবুও মিষ্টি খেল। আফরোজা বলেছেন এটা নাকি নিয়ম।
শুভ্র উসখুস করছে: তুলিকে এরা কখন এনে পাশে বসাবে। আধা ঘণ্টা তো কাটল!

আরো দশ মিনিট পর তুলি এলো। এক পাশে ইয়াসমিন, অপর কাঁধ ধরে আছে অন্য এক মেয়ে। হাঁটার তালে তুলির শাড়ির কুচি দুলছে। শাড়ির আঁচলটা সম্পূর্ণ কারুকাজ কড়া, ঝুলে আছে একপাশে। শুভ্রর জানামতে তুলি ওই হেঁটে আসা তার দেখা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য! এই দৃশ্যে শুভ্রর যেকোনো সময় মিনি হার্ট অ্যাটাক হলেও হতে পারে। তুলি ধীর পায়ে এগিয়ে এলো, শুভ্রর পাশে বসানো হলো তাকে। শুভ্র তুলিকে একবার দেখেই চোখ সরিয়ে নিলো, বড়রা পাশে। তুলির ক্লাসমেটরা এগিয়ে এসে তুলি শুভ্রকে মিষ্টি খাওয়াল। তারা শুভ্রর সঙ্গে তেমন কিছু মজা করলো না। তবে তুলির কানেকানে বলে গেলো- ‘একরোখা স্যারের সঙ্গে প্রথম বাসরটা কেমন কাটে জানাইস।’

তুলি মাথা নিচু করে হাসে। এদের কে বলবে; তাদের এই একরোখা , রাগী, মেজাজি স্যার একাকী রুমে বড্ড রসিক আর- আর রোমান্টিক! ভেবে তুলি হাসলো।

প্রিন্সিপাল এলেন এবার। শুভ্র তুলিকে মিষ্টি খাইয়ে দোয়া দিলেন। তুলির দিকে চেয়ে বললেন- ‘শুভ্র কিন্তু দু বছর আমাদের থেকে বিয়ের কথা লুকিয়েছে। বুঝিনা. . বিয়ে আল্লাহর মর্জি। যার সঙ্গে যার জোর তার সঙ্গে তার বিয়ে। আমি খুশি হয়েছি তোমাদের বিয়েতে। খুব ভালো থাকো।’

তুলি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করলো। প্রিন্সিপাল শুভ্রর দিকে চেয়ে বললেন- ‘বিয়ের কথা আমাদের থেকে লুকিয়ে ঠিক করো নি শুভ্র। তোমার আগামী সাত দিনের ছুটি ক্যানসেল করা হলো। সামনের মাসের পনেরো দিনের ছুটিও ক্যানসেল।’

শুভ্র হাসলো। লজ্জিত গলায় তারপর বলল- ‘সরি স্যার।’

প্রিন্সিপাল হু হা করে হাসলেন। শুভ্রর কাঁধে হাত রেখে বললেন- ‘আই ওয়াজ কিডিং ইয়াং ম্যান। ছুটি পাবে তুমি, জমিয়ে নিজের বিবাহিত লাইফ এনজয় কর। গুড লাক।’

তুলি স্যার যেতেই জিজ্ঞেস করলো- ‘সামনের মাসে আবার পনেরো দিনের ছুটি কেন?’
শুভ্র তুলির দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল-‘ফর হানিমুন!’

তুলি কিছুক্ষণ শুভ্রকে হা হয়ে দেখে পরপরই লজ্জায় মাথা নিচু করলো। এই শিশু ডক্টর একদম লাগাম ছুট হয়েছে। যাতা বলে শুধু!

এবার কবুল বলার পালা। কবুল বলা হবে শুধু বিয়েতে ছবি তোলার জন্য। আকদনামা তো আগেই হয়ে আছে। কবুল বলার মুহূর্তে তুলির ঘোমটায় আড়াল করা মুখের দিকে শুভ্র তাকাল। তুলির আড়চোখে শুভ্রর দিকেই চেয়ে ছিলো। শুভ্র তুলির দিকে চেয়ে ভুবন ভোলানো এক হাসি দিল, তুলির বুক বরাবরের মতো ধ্বক্ উঠল। চোখ সরিয়ে নিল তুলি।

কাজী তুলিকে বললেন-
‘বলো মা কবুল।’

তুলি একনজর শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র ভীষন উৎসুক চোখে তুলিকে দেখছে। তুলি শুভ্রর ওই মুখটার দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বললো- ‘কবুল, কবুল, কবুল।’

শুভ্র মুগ্ধ চোখে তুলিকে দেখলো। প্রথমবার কবুল বলার সময় তুলির কণ্ঠে জড়তা ছিলো। এ আজ- আজ তুলির কণ্ঠে আছে আত্মবিশ্বাস। আছে শুভ্রর প্রতি অগাধ ভালোবাসা!

শুভ্রকে কবুল বলতে বলা হল। শুভ্র তুলির দিকে চেয়ে হালকা আওয়াজে বলে দিলো- ‘কবুল, কবুল, কবুল।’

‘আলহামদুলিল্লাহ’ পুরো ঘরময় হৈ-হল্লোর লেগে গেলো একপ্রকার। তুলিকে শুভ্রর পাশে বসানো হল। আয়না আনা হলো। আয়নায় তুলির মুখ দেখিয়ে শুভ্রকে জিজ্ঞেস করা হল- ‘বলো তো কাকে দেখা যাচ্ছে?’

শুভ্র হালকা হেসে জবাব দিল- ‘আমার অর্ধাঙ্গিকে।’

সবাই ‘হো, হো’ বলে উঠল। তুলিকে শুভ্রর মুখ আয়নায় দেখানো হলো,’কাকে দেখা যাচ্ছে’ জিজ্ঞেস করা হল। তুলি লাজুক গলায় শুভ্রর মুখটা এবার দেখে মাথা নিচু করে বললো- ‘আমার ভয়ংকর শিশু ডক্টরকে।’

শুভ্র লজ্জা পেয়ে তুলির দিকে তাকালো।তুলি লজ্জায় ফিরে তাকালো না শুভ্রর দিকে।

অতঃপর মহা সমারোহে হাসিখুশি ভাবে সম্পন্ন হল পেডিয়াট্রিক ডাক্তার উমায়ের হোসেন শুভ্র এবং সদ্য ডাক্তার প্রত্যাশা হোসেন তুলির।

#চলবে