অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ পর্ব-১২+১৩

0
145

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_১২

শুভ্র সরে এসে তুলির কাঁধে হাত রাখল। কাঁধে প্রথম কোন পুরুষের স্পর্শে তুলি চোখ তুলে চাইল। দুচোখে ভেসে উঠে শুভ্র নামক এক দায়িত্ববান সুপুরুষ! শুভ্র তুলিকে নিজের কাছে হালকা করে টেনে আনল। তারপর মৃদ্যু হেসে দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো,

‘ওকে, মিট ম্যাই ওয়াইফ। মিসেস প্রত্যাশা হোসেন তুলি।’

শুভ্রর স্ত্রী তুলি? ডাক্তার আরিফ এবিং ফারহান একসঙ্গে বিস্ময় নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ওয়াইফ?’

দুজনের এমন চেঁচিয়ে উঠাতে শুভ্র কানে হাত চাপলো। তুলি ভয়ে সেটিয়ে গেলো শুভ্রর গায়ের সঙ্গে। অস্বস্তিতে তুলি রীতিমত জমে যাচ্ছে। শুভ্র কান থেকে হাত নামালো। তারপর দুজনের উদ্দেশ্যে বললো,

‘আগে ঘরে ঢুকি? ডিটেইলস পড়ে বলি, রিয়েকশন তখন দেখাস।’

শুভ্র তুলি এতসময় ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুজনেরই হুশ ফিরলো। আরিফ দরজার সামনে থেকে সরে দ্রুত বললো,

‘ওহ হ্যাঁ, ভেতরে আয়। তুলি তুমিও ভেতরে আসো।’

শুভ্র তুলিকে আগে দিলো। তুলি ঘরে ঢুকলে আরিফের স্ত্রী মহু এগিয়ে আসলো। তুলি সালাম করলো তাকে। মহুও ডাক্তার। তবে অন্য মেডিকেলের। তুলিকে দেখে তবুও কিভাবে যেন মহু চিনে ফেললো। কিছু ভেবে বললো,

‘তুমি আরিফের মেডিকেলের স্টুডেন্ট না? তোমাকে মেডিকেলে দেখেছি আমি, চাইল্ড বার্থের উপরে প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলে, রাইট?’

তুলি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। অথচ তুলির মনে পরছে না সে মহু ম্যাডামকে তাদের মেডিকেল কখনো দেখেছে কিনা। আরিফ শুভ্রর পাশে সোফায় বসে মহুকে বললো,

‘মহু, শুভ্রর ওয়াইফ ও। আর আমাদের স্টুডেন্ট অলসো, তাইনা শুভ্র?’

শুভ্র আরিফের টিটকারি শুনে বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকালো। ছেলেটা এমনিতেই ছোট থেকে ছোট বিষয় নিয়ে শুভ্রকে টিটকারি করে। আর এখন পেয়েছে জলজ্যান্ত বিষয়। টিটকারি আবার করবে না?

মহু প্রথমে অবাক হয়েছে। পরপরই মৃদ্যু হেসে তুলির বাহুতে হাত রেখে আরিফকে বললো,

‘স্টুডেন্ট এটা এত রসিয়ে বলার কী আছে, আরিফ? তুমিও না। এত সুন্দর মেয়ে বিয়ের আগে দেখলে তুমিও লাফাতে!’

আরিফ ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে বললো,

‘মহু, আমাদের রিলেশন করে বিয়ে, ভুলে গেছো? বিয়ের আগেও তো কোন সুযোগই দিলে না, আবার লাফানো!’

মহু মুম ভেঙালো।চোখ পাকিয়ে বললো,

‘চান্স পেলে ট্যাংকি মারতে? ছিঃ! শোধরাবে না তুমি?’

পুরো ব্যাপারটা আরিফের স্রোতের উল্টোদিকে যাচ্ছে দেখে আরিফ কথা থামালো। টপিক পাল্টে বললো,

‘শুভ্র তুই অনেক টায়ার্ড, ক্ষুধাও লেগেছে, না? মহু, চটজলদি নাস্তা দাও তো আমাদের, সঙ্গে গরম গরম চা। চা খেয়েই বেড়িয়ে যাব আমরা।’

মহু আর দেরি করে না। তুলিকে ভেতরে নিয়ে যায়। মহিলারা যেতেই আরিফ এবার পুরোপুরি ঘুরে বসলো শুভ্রর দিকে। শুভ্র বাঁকা চোখে আরিফের পল্টি খাওয়া দেখলো। আরিফ নিজেকে প্রস্তুত করলো। তারপর গম্ভীর স্বরে বললো,

‘কাহিনি ঝাড়। তুলি আর তুই? কিভাবে কি? রিলেশন করে বিয়ে আমাকে বলবি না। তুই ওরকম ছেলেই না, আমি জানি।’

ফারহানও ওদিকে উৎসুক চোখে শুভ্রর দিকে চেয়ে আছে। শুভ্র তারপর দুজনকেই পুরো কাহিনি শোনালো। সব শুনে ফারহান বললো,

‘তুলি মেনে নিয়েছে তোকে?’

শুভ্র উত্তর দিলো,

‘বোধহয় ট্রাই করছে।’

‘আর তুই?’

আরিফের প্রশ্নে শুভ্র থামলো। পরপর ছোট্ট করে নিঃশ্বাসনিয়ে বললো,

‘চেষ্টা করছি, আই থিঙ্ক আমার ওকে ভালোই লাগে! শি ইজ অ্যা ম্যাচোর গার্ল, চিন্তা ভাবনা একদম আমার মতো। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তুলি আম্মুর সাথে খুবই ফ্রেন্ডলি। আম্মু তুলির সংস্পর্শে ভালো থাকে, যেমনটা আমি সবসময় চেয়ে এসেছি। বিয়ে নিয়ে আমি সবসময় ভয় পেতাম, জানিস।সবসময় চিন্তা থাকতো, যে মেয়ে আসবে,আম্মুকে আমার মতো ভালোবাসবে কিনা। বাট নাও, আম স্যাটিসফাইড। তুলি সবদিকেই আমার কাছে বেস্ট লেগেছে। বাকিটা এখন ভাগ্য।’

সব শুনে আরিফ এবং ফারহানকে নিশ্চিন্ত হতে দেখা গেলো। ফারহান বললো,

‘এই ট্যুরটা তোদের জন্যে খুব কাজে দিবে। ভালো করেছিস তুলিকে নিয়ে যাচ্ছিস সাথে। তোদের ফার্স্ট হানিমুনও সেরে গেলো ব্যাটা।’

শুভ্র হালকা হাসলো। ওদের কথা বলার ফাঁকে আরিফকে রান্নাঘর থেকে ডাকল মহু। আরিফ উঠে নাস্তা রান্নাঘর থেকে এনে টেবিলে সাজালো। সবাই মিলে নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে গেলো বাস স্টেশনের উদ্দেশ্যে।

আরিফ টিকেট আনতে গেছে সবার জন্যে। শান্তি পরিবহন বাস ঢাকা থেকে খাগড়াছডি অব্দি যাবে। একমাত্র এই বাসেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অব্দি যাবে। তাই তারা এই বাসেই ঠিক করছে সাজেক যাওয়ার জন্যে।

শুভ্র এইফাঁকে তুলিকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কিছু কিনবে? বাসে খাওয়ার জন্যে?’

তুলি আশেপাসে একবার দেখে বললো,

‘আচার পাওয়া যাবে এখানে?’

শুভ্র একবার আশেপাশের দোকান দেখে বললো,

‘আমি দেখি পাই কিনা। তুমি মহুর সাথে দাড়াও।’

শুভ্র তুলিকে মহুর পাশে দাড় করিয়ে রেখে আচার খুঁজতে চলে গেল। মহু জিজ্ঞেস করল তুলিকে,

‘শুভ্র আবার কোথায় যাচ্ছে?’

‘আচার কিনতে।’

‘কে খাবে? তুমি?’

তুলি স্বাভাবিক ভাবে মাথা নাড়লো। মহু হালকা হেসে বললো,

‘আমার কাছে আছে, আবার আনাতে গেলে কেন? আচার তো আমার কাছে কয়েকমাস থেকে সবসময়ই থাকে।’

‘কেন ম্যাডাম? আপনি এত আচার পছন্দ করেন?’

তুলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। মহু মৃদ্যু হাসলো। পেটে হালকা করে হাত বুলিয়ে বললো,

‘ইনি আসার পর থেকে রোজ খাওয়ান আমাকে। আচার খেলে বমি কম হয়, তাই আরিফ কয়েক ধরনের আচার এনে রাখে বাসায়।’

তুলি খানিক বিস্মিত হল। বললো,

‘আপনি প্রেগনেন্ট অবস্থায় এতদূর যাচ্ছেন? সমস্যা হবে না?’

‘উহু। বরং আমার মাইন্ড ফ্রেশ হবে। কদিন ধরে মনে হচ্ছে, আমি মেন্টালি খুব উইক হয়ে যাচ্ছি। অযথা চেচাচ্ছি। আরিফের সঙ্গেও কয়েকবার খারাপ ব্যবহার করলাম। ও কিছু বলে না আমাকে, কিম্তু আমি বুঝতে পারছি আমার ফ্রেশ হওয়া দরকার। ডেইলি লাইফের এমন ঝুটঝামেলা থেকে কদিন রেহাই দরকার। তাইই ভাবলাম ঘুরে আসি।’

তুলি অবাক হয়। মানুষটার কী ধৈর্য্য। এমন একটা অবস্থায় এভাবে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তুলি হলে বিছানায় ল্যাদ খেয়ে পড়ে থাকত। নিজে যন্ত্রণায় ভুগতো, আশেপাশের সবাইকেও জ্বালিয়ে মারতো। তুলি হালকা হাসলো। এরমধ্যে শুভ্র এসেছে। হাতে পলিথিন। আচারের সঙ্গে আরও হাবিজাবি চকলেটস আর চিপস কিনে এনেছে। আরিফও এরমধ্যে টিকেট কিনে এনেছে।

বাস ছেড়েছে কিছুক্ষণ হয়েছে। মহু শরীর খারাপ লাগছে, আরিফের কাঁধে মাথা হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। ফারহানের কাঁধে মাথা হেলিয়ে বাহিরের দিকে চেয়ে আছে দিয়া। তাদের দেখে তুলিরও ইচ্ছে করছে শুভ্রর কাঁধে মাথা রাখতে। কিন্তু সঃঙ্কোচের কারণে হচ্ছে না। শুভ্রও তো আগবাড়িয়ে কিছু বলছে না। তুলি মেয়ে হয় কিভাবে বলবে? সেই কখন থেকে ওরা দুজন চুপ করে বসে আছে বাসে। কেউ কি তাদের দেখে বলবে, এরা সদ্য বিবাহিত কোনো কাপল?

তুলি বিরক্ত হয়ে বাসের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে। বাস ক্রমাগত নড়ছে। তুলি তাই ঠিকঠাক মাথা রাখতে পারছে না। উল্টো ব্যাথা পাচ্ছে। তুলি তাও রাগে মাথা সরাল না। ঠেকিয়েই রাখলো। শুভ্র ফোনে এতোক্ষণ কাজ করছিল। একপর্যায়ে তার চোখ গেল তুলির দিকে। তুলি ঘুমে পড়ে যাচ্ছে। তাও কষ্ট করে চোখ খুলে রেখেছে। কপালে কী ব্যাথা লাগছে না তুলির? শুভ্রর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তুলি চাইলে শুভ্রর কাঁধে মাথা রাখতে পারে। কিন্তু লজ্জা আর সংকোচে বলতে পারছে না। তাও সে বললো,

‘তুলি? তুলি? এভাবে ঘুমিও না। কপাল ফুলে যাবে বাসের ধাক্কায়। রাস্তাটা বেশি ভালো না।’

তুলির ধ্যান ভাঙে। ঘুম থেকে উঠে বসে আবার সোজা হয়ে। শুভ্রর দিকে চায়। ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না তুলি। চোখ ঘুরিয়ে ঘুমানোর জায়গা খুঁজছে। শুভ্র বললো,

‘কী দেখছ?’

তুলি লম্বা হামি তুলে বলল,

‘ঘুমাবো কোথায় আমি? সিটটা পেছনে হেলানো যায় না আর?’

শুভ্র সিটটা হাত দিয়ে একবার দেখলো। তারপর বললো,

‘না আর যাবে না।’

তুলির তখন শুভ্রর মাথায় মারতে ইচ্ছে হলো। বলতে ইচ্ছে হল, আপনার বুক আর কাঁধ থাকতে আমি কেন সিটে মাথা দিয়ে ঘুমাবো?
কিন্তু বলতে পারল না। তাদের সম্পর্ক আট দশটা স্বাভাবিক কাপলদের মতো নয়।তাই দুজনের কেউই চাইলে স্বাভাবিক কাপলদের মতো আচরণ করতে পারে না। তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাল ছেড়ে দিয়ে শেষমেশ সোজা সিটেই হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। সিটে মাথা রেখে চোখ বুজলো। তবে বাসের ধাক্কায় বারবার মাথা পড়ে যাচ্ছে তুলির। শুভ্র সব দেখছে। একবার ফারহান আর আরিফকে দেখে তার খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তুলিকে নিজের কাঁধে মাথা রাখার কথা। কিম্তু গলায় যেন আজ কেউ পাথর বসিয়ে দিয়েছে। শুভ্র কথাই বলতে পারছে না ঠিকঠাক। সদ্য বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে তুলি পাশে বসে আছে, হানিমুনে যাচ্ছে তারা। এই ব্যাপারটাই শুভ্রকে বারবার লজ্জা দিচ্ছে।

তুলি ঘুমাতে পারছে না ভালো করে। তাই শুভ্র একসময় নিজেকে শক্ত করল। কাচুমাচু হয়ে তুলিকে ডাকল,

‘তুলি, এই তুলি? উঠো। আমার কাঁধে মাথা রেখে শোও। এভাবে ঘুমালে ঘাড় ব্যাথা করবে তো।’

#চলবে

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_১৩

‘তুলি, এই তুলি? উঠো। আমার কাঁধে মাথা রেখে শোও। এভাবে ঘুমালে ঘাড় ব্যাথা করবে তো।’

তুলি এ কথা শুনে সঙ্গেসঙ্গে চোখ খুলে ফেললো। শুভ্র আচমকা চোখ খোলায় ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে তাকালো তুলির দিকে। তুলি চোখের পলক দুবার ফেলে শুভ্রর দিকে চেয়ে থাকলো। আরেকবার বলুক সে, তুলি মরিয়া হয়ে ঝাপাবে তার কাঁধে। শুভ্র বুঝলো, তুলি হয়তো শুনতে পারেনি। তাই শুভ্র গলা পরিষ্কার করে ধিমে আওয়াজে বললো,

‘ঘুমাবে তুমি? এভাবে ঘুমালে ব্যথা পাবে। অস্বস্তি ফিল না করলে আমার কাঁধে মাথাটা রাখো।’

তুলি মৃদ্যু হাসলো। লজ্জায় অবনত হয়ে হালকা সরে এসে শুভ্রর হাত জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রাখল পরম আবেশে। শুভ্রর গা এই প্রথম কোন নারী স্পর্শ করলো, কাঁধে মাথা রাখল। সেই নারীটা তার স্ত্রী। ব্যাপারটা কতো সুন্দর! শুভ্রর হাত যত্ন নিয়ে তুলির চুলে মালিশ করল। আরামে চোখ বুজল তুলি। শুভ্র মৃদু আওয়াজে বললো,

‘এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাও, আ’ম দ্যায়ার!’

তুলির কথাটা কী যে ভালো লাগলো। বোধহলো শুভ্রর কাঁধে শক্ত করে মাথাটা চেপে রাখতে। তুলি একবার মাথা তুললো। শুভ্র তাকাল। তুলি বললো,

‘থ্যাংকস, সবকিছুর জন্যে।’

শুভ্র হাসলো খানিক। তুলি আবার আরাম করে শুভ্রর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজলো।
______________
বাস এসে থেমেছে দিঘীনালিতে। এখান থেকে আর কোনো বাস যাবে না। বাকিটা পথ যেতে হবে চান্দের গাড়ি করে। চান্দের গাড়ি মূলত একপ্রকার জিপ গাড়িই। সাজেকের সবাই এটাকে জিপ না বলে সুন্দর ভাষায় চান্দের গাড়ি বলে। তুলি বাস থেকে নেমে মুখে পানি ছেটালো। ঘুমে চোখ খুলতে পারছে না সে। শুভ্রর হাতে সব ব্যাগ। সে একপাশে ব্যাগ রেখে তুলির কাছে গেলো। বললো,

‘চা খাবে তুলি? ঘুম কাটবে তাহলে।’

তুলি হামি ছেড়ে বললো,

‘খাবো, আপনি?’

শুভ্র হেসে উত্তর দিল,

‘চায়ে কখনও আমার ‘না’ নেই।সর্বদা হ্যাঁ।’

তুলি হেসে ফেললো। হেসে হেসে আনমনে বললো,

‘ভালোই হয়েছে দুজন চা পাগল। মাঝরাতে চাঁদ দেখতে দেখতে কয়েক কাপ চা সাবাড় করা যাবে।’

শুভ্র হাসলো। তুলির তার সংসার নিয়ে কত ইচ্ছে। তাঁকে নিয়ে কত স্বপ্ন! ব্যাপারটা শুভ্রর ভীষণ ভালো লাগলো। শুভ্র মুচকি হেসে চা আনতে গেল।

চা খেয়ে সবাই চান্দের গাড়িতে চড়ে বসলো। ওদের ছয় জনের জন্যেই একটাই চান্দের গাড়ি লেগেছে। ছয় সিটে ছয়জন।

সাজেকের পথটা বেশ বন্ধুর। বারবার তুলি গাড়ির ধাক্কায় শুভ্রর উপরে পড়ে যাচ্ছে। ওড়নাও ঠিকঠাক জায়গায় থাকছে না। স্যারদের সামনে তুলি একপ্রকার নাস্তানাবুদ অবস্থা। শুভ্র হয়তো বুঝতে পারলো। ফিসফিস করে বললো,

‘ওড়নায় পিন দিয়ে দাও, খুলবে না আর।’

তুলি তাই করলো।তুলি ঠিকঠাক বসতে পারছে না দেখে, শুভ্র বাম হাতে তুলির কাঁধ ধরে নিজের সঙ্গে চেপে ধরেছে। তুলি শুভ্রর দিকে চেয়ে। শুভ্র নিরন্তর বসে গল্প করছে আরিফ ফারহানের সাথে অথচ এখনো একহাতে তুলিকে আগলে আছে। তুলি শুভ্রর যত্নে আরও একবার তার প্রতি ভালো বাসা জন্মালো। মানুষ হিসেবে কতটা অসাধারণ শুভ্র, সেটা কী শুভ্র কোনোদিন জানবে? তুলিকে এতটা সেইফ অনুভব করানো, এতটা যত্নে এতদূর নিয়ে আসার জন্যে তুলির শুভ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, সেটাও কী এই শুভ্র মহোদয় জানবে? তুলি একদিন জানাবে। সব জানাবে।

একদিন পূর্ণিমা রাতে, দুজন বারান্দার দোলনায় দোল খেতে খেতে চাঁদ দেখবে। তখন তুলি শুভ্রকে জানাবে, কাবিনের পর কিভাবে তুলি একটু একটু করে শুভ্রর প্রেমে পড়েছিল। একটু একটু করে দুজন কাছাকাছি এসেছিল। একটু একটু করে তুলি দুর্বল হয়েছিল এই মানুষের প্রতি। তুলি বলবে, একদিন অবশ্যই বলবে। সেও জানুক, পুরুষ হিসেবে সে কতটা, ঠিক কতটা অসাধারণ!
__________________
সাজেকে একটা রিসোর্ট নেওয়া হয়েছে, সাজেক ইকো ভ্যালি রিসোর্ট। শুভ্ররা রিসিপশনের কাজ সামলে যে যার রুমে ঢুকলো। তুলি রুমে ঢুকেই বিস্ময় নিয়ে চারদিক দেখল। কাঠের দরজা, দেয়াল, বিছানা। সবই কাঠের তৈরি।সামনে খোলা বারান্দা, তুলি বারান্দায় গেল। শীতল হাওয়া বইছে। তুলির খুব ভালো লাগল। শুভ্র বারান্দায় এসে তুলির পাশে দাঁড়াল। তুলি বললো,

‘ভীষণ সুন্দর রিসোর্টটা, আমার ভালো লেগেছে।’

শুভ্র মৃদ্যু হাসলো। বললো,

‘সাজেকের মোস্ট অফ দ্য রিসোর্ট এরকমই থাকে। এটাই সাজেকের বিশেষত্ব।’

‘আমরাও একদিন এমন একটা ঘর বানাবো, কাঠের সবকিছু থাকবে, এরকম একটা খোলা বারান্দা থাকবে। কোন কৃত্রিম সাজসজ্জা থাকবে না। যা থাকবে সব প্রাকৃতিক। রুমের চারপাশে একধরনের লম্বা মোমবাতি পাওয়া যায় যে, ওগুলো থাকবে। মনে হবে, আমরা ধূলোবালিজমা শহরে নয়, গ্রামে কোনও এক পাহাড়ের উপরে থাকছি। বেস্ট হবে জানেন?’

কথাটা বলে বেশ আনন্দ নিয়ে শুভ্রর দিকে ঘুরল তুলি। শুভ্র স্থির চোখে চেয়ে দেখছে তুলিকে। তুলি হাসছে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। শুভ্র আনমনে চেয়ে আছে তুলির মুখের দিকে। শুভ্র এভাবে চেয়ে আছে দেখে তুলি ভ্রু নাচিয়ে হেসে হেসে জিজ্ঞেস করল,

‘কী দেখছেন?’

‘তোমাকে।’

তুলি ভ্রু কুচকে ফেললো। সঙ্গেসঙ্গে শুভ্র থমকে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। লজ্জা এবং অস্বস্তি দুজনকেই ঘিরে ধরল। শুভ্র ইতিওতি চেয়ে নিজেকে সামলে বললো,

‘ফ্রেশ হয়ে নাও, বাথরুমে সব রাখা আছে।আমি পড়ে ঢুকব।’

কথাটা বলেই শুভ্র আগেআগে বারান্দা থেকে রুমে ঢুকে গেলো। তুলি পেছনে দাঁড়িয়েই রইল। টালমাটাল চোখে চেয়ে রইলো শুভ্রর চলে যাওয়ার দিকে। খানিক পর মৃদু হেসে নিজেও ঘরে ঢুকলো।শুভ্র বিছানায় বসে আছে। তুলি সেদিকে একবার তাকিয়ে টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। শুভ্র মাথা তুলে তাকাল তখন। আজ মূলত তার হচ্ছেটা কী? নিজেকে এতটা অদমনীয় মনে হচ্ছে কেন? তুলি সামনে থাকলে এতটা উতলা হয়ে যাচ্ছে কেন? শুভ্র মাথার চুল খামছে ধরে থাকল, মাথাটা বড্ড ধরে আছে আজ। প্যারাসিটামল খেতে হবে একটা।

তুলি গোসল করে বের হয়েছে। টাওয়াল দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে শুভ্রর সামনে এসে দাঁড়াল। শুভ্র অন্যদিকে চেয়ে আছে। তুলি বললো,

‘আমি এসে গেছি। গোসল করবেন না আপনি?’

শুভ্র সঙ্গেসঙ্গে উঠে গেলো। একনজর তুলির ভিজে চুলের দিকে চেয়ে দ্রুত পায়ে স্যান্ডেল পরে টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। তুলি তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইল শুভ্রর যাওয়ার দিকে।

শুভ্র গোসল থেকে বের হলো প্রায় আধা ঘণ্টা পর। সারাদিন জার্নি করে গায়ে মনে হচ্ছে ধুলোর বস্তা লেগে আছে। তাই আজ গোসলে বেশ দেরি হয়ে গেছে তার। তুলি তখনও চুল ঝাড়ছে। কোমর অব্দি বেশ ঘন চুল তুলির। চুল ঝাড়তেও বড্ড কষ্ট হচ্ছে তুলির। হাত মনেহচ্ছে ভেঙে আসছে।তুলির চুলের পানিতে মেঝে পুরো ভিজে গেছে।
শুভ্র টাওয়াল দিয়ে নিজের চুল মুছে বললো,

‘তুলি, চুলটা বাধো। মেঝে একদম ভিজিয়ে দিয়েছো, দেখো।’

তুলি পেছনে ফিরলো। শুভ্র কথা বলতে বলতে এগুলো,

‘চুল আগে বেঁধে পানি ঝরাও, দেন খুলে ঝাড়বে। এভাবে চুল ঝাড়লে
হেয়ার ড্যামেজ হতে পা— অ্যা’

এক চিৎকার দিয়ে শুভ্র ভিজে মেঝেতে পা পিছলে সোজা তুলির গায়ের উপর পরলো। এভাবে গায়ে পরায় তুলি শুভ্রর ভার সহ্য করতে না পেরে সোজা গিয়ে পরলো বিছানার উপর।হঠাৎ টাল সামলাতে না পেরে শুভ্রর হাত পেঁচিয়ে ধরলো তুলির মেদহীন কোমড়, ঠোঁট ছুয়ে গেল একদম তুলির গলার নিচের অংশে। জীবনের প্রথম এমন স্পর্শে তুলি একপ্রকার থমকে গেল। শুভ্রও সঙ্গেসঙ্গে মুখ তুলল তুলির গলা থেকে। হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটা উল্টো স্রোতে ঘুরে গেল গেল এ নতুন দম্পত্তির।

#চলবে